পানামা পেপারস কেলেংকারি এখন বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম একটি আলোচিত বিষয়।
পৃথিবীর বড় রাষ্ট্রগুলোর শীর্যস্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর
ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনা ফাঁস হয়ে গেছে পানামা পেপারসের মাধ্যমে। পানামার আইনি
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার কাছে প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ছিল।
এসব গোপন নথিতে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়ক তথা তাদের আত্মীয়স্বজনের
অর্থ পাচার আর ট্যাক্স ফাঁকির তথ্য ছিল। মোসাক ফনসেকা এটি নিজে ফাঁস করেনি।
ফাঁস করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি অনুসন্ধানী সংবাদ সংস্থা- ইন্টারন্যাশনাল
কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে)। যতদূর জানা যায়,
বিশ্বনেতাদের এ ট্যাক্স ফাঁকি ও টাকা পাচারের তথ্য প্রথম জানতে পারে
জার্মানির একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘সুডডয়েচে সাইটুং’। পরে এটি আইসিআইজে
পায়। সেই সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের কাছেও এসব তথ্য যায়। তবে প্রথম
প্রকাশ করে আইসিআইজে। যেহেতু পানামায় নিবন্ধিত আইনি পরামর্শক সংস্থা মোসাক
ফনসেকা এসব ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের অপ্রদর্শিত
অর্থ, ট্যাক্স ফাঁকি ও অর্থ পাচারে সহায়তা করেছে এবং তাদের কাছেই তথ্যগুলো
সংরক্ষিত ছিল, এ জন্য ফাঁস হওয়া ঘটনাকে পানামা পেপারস নামে অভিহিত করা
হয়েছে। বলা ভালো, যেসব তথ্য ফাঁস হয়েছে তা ১৯৭৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত।
অর্থাৎ দীর্ঘ এ সময়সীমায় সংস্থাটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাবেক
রাষ্ট্রপ্রধান, বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানদের অর্থ পাচারে সহায়তা করে আসছে।
যেসব নথিপত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে রীতিমতো অবাক হতে হয়।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং, সৌদি
বাদশাহ সালমান, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের নাম আছে এতে। এমনকি সিরিয়ার বর্তমান
প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত গাদ্দাফি এবং সাদ্দাম
হোসেনের নামও আছে। সেই সঙ্গে আছে লিওনেল মেসি, ফিফার মহাসচিব জেরোমে ভালকে,
মিশেল প্লাতিনি ও অমিতাভ বচ্চনের নামও। বাংলাদেশী বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর
নামও আছে এ তালিকায়।
পানামা পেপারসের এ ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনা অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। এক.
পাঠক লক্ষ্য করবেন চীন ও রাশিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানের নাম থাকলেও
যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ফ্রান্সের কোনো সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং শীর্ষস্থানীয়
ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের নাম এখনও আসেনি। কেন? দুই. এ ঘটনা এই সময় ঘটল কেন?
এর সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র যে ‘রেজিম
চেঞ্জ’ অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে উৎখাতের
‘নীতি’ অনুসরণ করে আসছে, তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে কি-না? তিন. অর্থ
পাচার কিংবা ট্যাক্স ফাঁকির সঙ্গে মোসাক ফনসেকার সম্পর্ক কী, কিংবা কীভাবে
ফনসেকা তার গ্রাহকদের নিরাপত্তা দেয়? চার. এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
চীনে দুর্নীতির বিষয়টি সাম্প্রতিককালে একটি বড় আলোচিত বিষয়। শি জিন পিং
ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযানে নেমেছেন। শীর্ষস্থানীয়
পার্টি ও রাষ্ট্রীয় নেতাদের ইতিমধ্যে অপসারণ করা হয়েছে- এ ধরনের সংবাদ আমরা
সংবাদপত্র থেকে জেনেছি। কিন্তু শি জিন পিং নিজে কিংবা তার আত্মীয়স্বজন
দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এবং তারা মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে অর্থ পাচার করেছেন,
তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তবে সাবেক চীনা প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে আগেও
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ভাদিমির পুতিন যেভাবে
রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছেন, সে ব্যাপারে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে।
একবার প্রেসিডেন্ট, আবার প্রধানমন্ত্রী, আবার প্রেসিডেন্ট- এভাবে পুতিন
ক্ষমতায় আছেন দীর্ঘদিন ধরেই। ক্ষমতায় থেকে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণী তিনি গড়ে
তুলেছেন। অভিযোগের তীর তার মেয়ে কাতেরিনা ও মেয়েজামাই কিরিল শামালভের
দিকে। শামালভ সাম্প্রতিককালে রাশিয়ার অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন
বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমের পর্যবেক্ষণ। পুতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার এক
বন্ধুর নামে তিনি ২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে অফশোর শেল কোম্পানি গঠন করেছেন। চীন ও
রাশিয়ার পক্ষ থেকে যথারীতি এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। তবে চীনের
সরকারি গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস বলছে, পানামা পেপারসের সঙ্গে শক্তিশালী একটি
‘পক্ষ’ জড়িত। এবং তথ্য ফাঁস করে যুক্তরাষ্ট্র প্রকারান্তরে লাভবান হয়েছে।
বলা ভালো, উইকিলিকসে তথ্য ফাঁস হয়েছিল ২০১০ সালে। এখন তার চেয়েও অনেক বেশি
তথ্য (২ দশমিক ৬ টেরাবাইট, ১ কোটি ১৫ লাখ নথি এবং ২ লাখ শেল কোম্পানির নাম)
ফাঁস হয়েছে। এর সঙ্গে শুধু হ্যাকাররা জড়িত বলে মোসাক ফনসেকার কর্মকর্তারা
দাবি করলেও কোনো বড় ধরনের শক্তির সহযোগিতা ছাড়া এটা ফাঁস করা সম্ভব নয়। তবে
ফনসেকার ডকুমেন্টে যাদের নাম আছে তারা অর্থ পাচারে কিংবা ট্যাক্স ফাঁকি
দেয়ায় কতটুকু জড়িত, সেটা নিয়ে তদন্ত হতে পারে। কিন্তু তথ্য গোপন নিশ্চিত
করতে না পারার দায়-দায়িত্ব ফনসেকা এড়াতে পারে না। শুধু তাই নয়, অধ্যাপক
ভ্যালেনতিন কাতসোনভ ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল লিখেছিলেন (Operation Offshore
Leak, Global Research), মোসাক ফনসেকার কাছে এ ধরনের তথ্য আছে। এমনকি যতদূর
জানা যায়, জার্মান পত্রিকাটি দু’বছর আগেই এ তথ্যগুলো পেয়েছিল। তাহলে
প্রশ্ন এসে যায়, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যখন বলা হয়, ফনসেকার কাছে এ ধরনের
গুরুত্বপূর্ণ নথি আছে, তাহলে সংস্থাটি এসব নথির নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক
হল না কেন?
প্রায় ৪০টি দেশে মোসাক ফনসেকার অফিস আছে। তারা সাধারণ কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান
নয়। এসব গোপন নথি তারা সুরক্ষা করবে না, এটা বিশ্বাস করা যায় না। সে
কারণেই প্রশ্নটা এসে যায়, কোনো বৃহৎ শক্তি কি এর পেছনে আছে? দ্বিতীয়ত.
‘করাপশন অ্যাজ এ প্রপাগান্ডা ওয়েপন’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ
লিখেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক রবার্ট পেরি। এটিও প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্লোবাল
রিসার্চে’ ৫ এপ্রিল ২০১৬-তে। গ্লোবাল রিসার্চ টরন্টোতে নিবন্ধিত একটি
গবেষণা সংস্থা। এটি পরিচালনা করেন অধ্যাপক মিশেল চসুডোভস্কি। বিশ্বব্যাপী
মার্কিন আধিপত্য, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি নিয়ে তার প্রতিষ্ঠান এবং তিনি নিজে
কাজ করেন। এখানে রবার্ট পেরি দুটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এক. এ গোপন
তথ্য ফাঁসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রেজিম চেঞ্জ বা সরকার পরিবর্তনের
(বিভিন্ন দেশের) যে নীতি, তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। তিনি উল্লেখ
করেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে যে ‘কালার রেভ্যুলেশন’ হয়েছে
(জর্জিয়া, কিরঘিজস্তান, ইউক্রেন, এমনকি আরব বসন্তও), তাতে যুক্তরাষ্ট্রের
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ একটা যোগসূত্র আছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট
ফর ডেমোক্রেসি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ‘গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠার’ নামে অর্থ সহায়তা করে থাকে। আমি নিজে ‘আরব বসন্তের’ ওপর গবেষণা
করতে গিয়ে দেখেছি কীভাবে তরুণ নেতৃত্বকে (মিসরের) যুক্তরাষ্ট্র উদ্বুদ্ধ
করেছিল মোবারকবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে। ইউক্রেনে রুশ সমর্থিত
প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানোকোভিচ একটি ‘গণআন্দোলনে’ উৎখাত হয়েছেন ২০১৪ সালের
২২ ফেব্রুয়ারি। ক্ষমতায় এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত প্রোসেনকো, যিনি এখন
সে দেশের প্রেসিডেন্ট। অভিযোগ আছে, ওই ‘গণআন্দোলনের’ পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের
সমর্থন ছিল। কারণ যুক্তরাষ্ট্র চায় ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক, তাতে করে
রাশিয়ার সীমান্তে মার্কিন সেনা মোতায়েন করে রাশিয়াকে একটি স্নায়বিক চাপে
রাখা যাবে। এ ‘আন্দোলন’ সফল হয় এবং ইয়ানোকোভিচ (যিনি ছিলেন সে দেশের
নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট) অপসারিত হন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইয়ানোকোভিচ উৎখাত
হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল শুধু
অর্থনীতিতে কিছুটা ‘গতি’ আনার জন্য। অভিযোগ আছে, এ অর্থ প্রেসিডেন্ট
প্রোসেনকো ‘নয়-ছয়’ করেছেন। তার নামে টাকা পাচার হয়েছে এবং মোসাক ফনসেকা
তাকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। প্রশ্নটা এ কারণেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ
যেখানে বেশি (যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী কোনো বন্ধু নেই), সেখানে তারা সরকার
পরিবর্তন ঘটায়। ইরাক, লিবিয়া এর বড় প্রমাণ। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের হোসনি
মোবারককে প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় আসমা মাহফুজদের (মিসরের
তাহরির স্কোয়ার আন্দোলনের নেতা) দিয়ে তথাকথিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ড.
মুরসিকে কিছুদিন ক্ষমতায় রেখে মিসরে ‘গণতন্ত্র চর্চা’ চালু করেছিল
যুক্তরাষ্ট্র। এখন সেসব অতীত। ফিল্ড মার্শাল সিসিকে নিয়েই রচিত হবে এখন নয়া
স্ট্র্যাটেজি। তাই আমার ধারণা, ইউক্রেনেও সরকার পরিবর্তন আসন্ন। তাই
রবার্ট পেরি যে আশংকার কথা বলেছেন, তা ফেলে দেয়ার নয়।
এখানে যে প্রশ্নটা অনেকেই করেন তা হচ্ছে, টাকা পাচারের জন্য কিংবা ট্যাক্স
ফাঁকির জন্য এ ধরনের অফশোর শেল কোম্পানিগুলোকে বেছে নেয়া হয় কেন? আর
পানামাই বা কেন? এ প্রসঙ্গে যেটা বলা দরকার তা হচ্ছে, পৃথিবীতে বেশ কিছু
দ্বীপপুঞ্জশাসিত দেশ বা এলাকা রয়েছে (যেমন- ভারজিন আইল্যান্ড, কেম্যান
আইল্যান্ড, সিসিলি, কুক আইল্যান্ড), যেখানে হাজার হাজার কোম্পানি
রেজিস্ট্রি করে ওই কোম্পানির নামে সেখানকার ব্যাংকে অর্থ রাখা যায়। এসব
দ্বীপপুঞ্জের কোনো কোনোটিতে এখনও ব্রিটিশ কর্তৃত্ব রয়েছে (ভারজিন
আইল্যান্ড, কেম্যান আইল্যান্ড। কুক আইল্যান্ডের কর্তৃত্ব নিউজিল্যান্ডের
হাতে)। আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো (যেমন- জার্মানির ডয়েচে ব্যাংক, হংকংভিত্তিক
এইচএসবিসি, যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ব্যাংক, ফ্রান্সের সোসাইটি জেনারেল) এসব
দ্বীপপুঞ্জে হাজার হাজার কোম্পানি রেজিস্ট্রি করে ওই কোম্পানির নামে ব্যাংক
অ্যাকাউন্ট খুলে ব্যবসা করে। যেমন ডয়েচে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে ৫০০
কোম্পানি। ব্যাংক সোসাইটি জেনারেল করেছে ২ হাজার ৩০০ কোম্পানি। যে কেউ নাম
গোপন করে এসব ব্যাংকের সহযোগিতা নিয়ে কোম্পানি খুলতে পারে। ব্যবসা করতে
পারে। আর মোসাক ফনসেকার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এদের আইনি সহযোগিতা করে। এখানে
কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না। ফলে এসব দ্বীপপুঞ্জ ব্যবসায়ীদের জন্য
স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোম্পানি রেজিস্ট্রি করে পৃথিবীর বড় বড়
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। তারা যদি নিজ দেশে ব্যবসা করত, তাহলে তাদের
প্রচুর ট্যাক্স দিতে হতো। যেমন- বিখ্যাত অ্যাপেল (Appel) কোম্পানির কথা বলা
যেতে পারে, যারা এখন Sixty Eight Research নামে একটি ব্যবসায়িক
প্রতিষ্ঠানের নামে অটোমোবাইল ব্যবসায় (গবেষণা ও উন্নয়ন) পুঁজি বিনিয়োগ
করেছে। এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। অস্ট্রেলিয়ায় অনেকে ব্যবসা করেন, যাদের
মূল কোম্পানি সিঙ্গাপুরে রেজিস্ট্রিকৃত। কেন? অস্ট্রেলিয়ায় কর্পোরেট
ট্যাক্স ৩৫ ভাগ, আর সিঙ্গাপুরে মাত্র ১৭ ভাগ। ফলে তাদের কম ট্যাক্স দিতে
হয়। অফশোর দ্বীপপুঞ্জগুলোতে কোম্পানি রেজিস্ট্রি করে ব্যবসা করা বৈধ। অনেক
ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ‘কমিশন বাণিজ্য’ করেন।
মিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তারা যে কমিশন পান, তা জমা হয় এসব
ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এর খোঁজ কেউ নেয় না। নিজ দেশের ট্যাক্স কর্তৃপক্ষও তা
জানে না। ওইসব ব্যক্তিকে দায়ীও করা যাবে না। পানামা কেন? পানামায় মোসাক
ফনসেকার মতো কোম্পানি কী সুবিধা পায়? আমি একটু খোঁজখবর নিয়েছি। তাতে
দেখেছি পৃথিবীর ৮০টি দেশ ইতিমধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তিটিকে
বলা হচ্ছে Multilateral Competent Authority Agreement। এটি ২০১৪ সালের
অক্টোবরে বার্লিনে (জার্মানি) স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী
দেশগুলো ট্যাক্সসংক্রান্ত সব তথ্য বিনিময় করবে, যাতে করে যেসব প্রতিষ্ঠান
ট্যাক্স ফাঁকি দেয়, তাদের আইনি আওতায় আনা যায়। পানামা এ চুক্তিতে স্বাক্ষর
করেনি। এর অর্থ হচ্ছে মোসাক ফনসেকার মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যবসায়িক
প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব তথ্য রয়েছে, তা তারা দিতে বাধ্য নয়। এ কারণেই মোসাক
ফনসেকার গ্রাহক সংখ্যা অনেক বেশি।
কর ফাঁকি দেয়া কিংবা অর্থ পাচার করার কাহিনী আজকের নয়। আফ্রিকার সেনাশাসকরা
অতীতে কোটি কোটি ডলার নিজ দেশ থেকে পাচার করেছেন (পাঠক, নাইজেরিয়ার সাবেক
রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল সানি আবাচার সুইজারল্যান্ডে গোপনে রক্ষিত অর্থের কথা
স্মরণ করুন)। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গাব্রিয়েল জুকম্যান
Hidden Wealth of Nation Held Offshore শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
বিশ্বের মোট সম্পদের ৮ ভাগ (যার পরিমাণ ৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার) এখন এসব
দ্বীপপুঞ্জভিত্তিক হাজার হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রয়েছে। আন্তর্জাতিক
ব্যাংকগুলো এসব অর্থ আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ
করে। অধ্যাপক জুকম্যান একটি আতংকের খবর আমাদের জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,
পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের মোট সম্পদের ৫৭ ভাগ, রাশিয়ার ৫০ ভাগ, আফ্রিকার ৩০
ভাগ ও দক্ষিণ আমেরিকার ২২ ভাগ এসব অফশোর আইল্যান্ডে বিভিন্ন কোম্পানির নামে
বিনিয়োগ করা হয়েছে। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তা আমাদের চিন্তার অনেক খোরাক
জোগাবে বৈকি!
পানামা পেপারস বিশ্বে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অভিযুক্ত
আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ড গুনলাগসন পদত্যাগ করেছেন। টিআইর চিলি
শাখার প্রধান দেলাভেসু পদত্যাগ করেছেন এবং টিআইর ওই শাখা বিলুপ্ত ঘোষণা করা
হয়েছে। নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের স্ত্রী
তাহমিনা দুররানী শরিফ পরিবারের সব সম্পত্তি, যা পানামা পেপারসে উল্লেখ করা
হয়েছে, তা পাকিস্তানের জনগণের নামে দান করার দাবি জানিয়েছেন (ট্রিবিউন, ৭
এপ্রিল)। মিসেস দুররানী মনে করেন, এর মাধ্যমে শরিফ পরিবারের ‘পাপ মোচন’
সম্ভব। নিঃসন্দেহে শরিফ পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে দুররানীর এ বক্তব্য
নওয়াজ শরিফের অবস্থানকে দুর্বল করবে। ভারতে মোদি সরকার যেসব ভারতীয়
ব্যক্তির নাম পানামা পেপারসে রয়েছে, তা তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। পানামা
বলছে, তারা ট্যাক্সের ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আরও উদ্যোগ নিচ্ছে।
খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। সব মিলিয়ে
পানামা পেপারস বিশ্বে একটি বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে।
অর্থ পাচার কিংবা ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনা ফাঁস করার পেছনে আদৌ কোনো ‘উদ্দেশ্য’
আছে কি-না, কিংবা কোনো ‘শক্তি’ এ থেকে ফায়দা ওঠাতে চায় কি-না, তা দেখার
জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
Daily Jugantor
11.4.16
অনেক তথ্যবহুল, ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপনে পড়তে একটুও বিরক্তি আসেনি বরং জানার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিল। ধন্যবাদ স্যারকে এমন সুন্দর উপস্থাপনার জন্য। ভালো থাকুন স্যার, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDelete