গত ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দফতরে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিটি স্বাক্ষরিত
হয়েছে। প্যারিসে গেল ডিসেম্বরের সম্মেলনে ১৯৫টি দেশ একটি জলবায়ু চুক্তিতে
স্বাক্ষর করেছিল। তার আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে জাতিসংঘে এটি স্বাক্ষরিত হল।
১৭০টির উপরে দেশ জাতিসংঘে এ চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছে, যারা বায়ুমণ্ডলে মোট
গ্রিনহাউস গ্যাসের ৯৩ ভাগ উদ্গিরণ করে। বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাসের জন্য এ
ধরনের একটি চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। বলা ভালো, এর আগে বিশ্বের উষ্ণতা
রোধকল্পে কিয়োটোতে (১৯৯৭) একটি চুক্তি হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, শিল্পোন্নত
দেশগুলো সামগ্রিকভাবে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ১৯৯০ সালের
তুলনায় ৫ দশমিক ২ ভাগ হারে হ্রাস করবে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বড় কার্বন
নিঃসরণকারী দেশ, দেশটি হ্রাস করবে ৭ ভাগ, ইইউর দেশগুলো করবে ৮ ভাগ, জাপান ৬
ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর ওই চুক্তিতে
স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু বুশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি
এ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। ফলে কিয়োটো চুক্তি
অকার্যকর হয়ে যায়। এরপর একে একে বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে জলবায়ু সম্মেলন
অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। প্যারিসে শেষ
পর্যন্ত একটি সমঝোতা হয়েছিল এবং তারই ধারাবাহিকতায় এখন নিউইয়র্কে চুক্তিটি
স্বাক্ষরিত হল। কিন্তু সমঝোতাটি ইতিমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বলা
হয়েছিল, এটা একটা ‘জগাখিচুড়ি সমঝোতা’। এটা কোনো চুক্তি নয়। চুক্তি সম্পন্ন
হবে ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিলের মধ্যে। এখন স্বাক্ষর করল
১৭০টি দেশ। বাকি ৩৫টি দেশ আগামী এপ্রিলের মধ্যে স্বাক্ষর করতে পারবে। এবং
জাতিসংঘের আওতায় তখন এটি একটি আইনে পরিণত হবে। ৫৫ ভাগ দেশ যদি এই চুক্তিটি
স্বাক্ষর করে (যার মাঝে আবার শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর মাঝে ৫৫ ভাগ
দেশ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে), তাহলেই চুক্তিটি কার্যকর হবে। প্রশ্ন
সেখানেই। বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো নিউইয়র্কে উপস্থিত থেকে এই চুক্তিতে
স্বাক্ষর এবং এ ব্যাপারে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি,
তেল ও গ্যাস উত্তোলনকারী সংস্থাগুলোর চাপ, কর্পোরেট হাউসগুলোর ব্যবসায়িক
মনোভিত্তি ইত্যাদি নানা কারণে বড় কিছু দেশ এখন নানা জটিলতা তৈরি করতে পারে।
২০১৬ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। রিপাবলিকানদের
পেছনে বড় অর্থলগ্নি করেছে আন্তর্জাতিক তেল উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলো।
সুতরাং প্যারিসে ওবামার এই চুক্তির প্রতি সমর্থন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন
কেরির নিউইয়র্কে চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একটি আশংকা থেকেই গেল। কেননা
নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যদি রিপাবলিকান পার্টি বিজয়ী হয়, তখন
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। চীন ও ভারত বড় কার্বন নিঃসরণকারী
দেশ। কার্বন হ্রাসের ব্যাপারে এই দেশ দুটির যুক্তি হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণ
হ্রাস করলে তাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। চীন ও ভারত কয়লা
ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর এই কয়লা পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর
কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গমন হয়, যা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট।
ফলে দেশ দুটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকলই।
বিশ্বের ১৯৫টি দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রায় সবাই প্যারিস সম্মেলনে যোগ দিয়ে এই সম্মেলনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতির (যাদের একটা বড় অংশ আবার এনজিও প্রতিনিধি) ফলে সেখানে কত টন কার্বন নিঃসরণ হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। কিন্তু কোপেনহেগেনে (২০০৯ ডিসেম্বর) যে কপ-১৫ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার একটি পরিসংখ্যান আছে। প্রায় ১৫ হাজার প্রতিনিধি ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। আর খরচ হয়েছিল ১২২ মিলিয়ন ডলার। আর জাতিসংঘের মতে, এসব প্রতিনিধির আসা, নেয়া, গাড়ি ব্যবহারের কারণে তারা বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ করেছিল ৪০ হাজার ৫০০ টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড। পাঠক, এ থেকে ধারণা করতে পারেন, প্যারিসে কত টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল কী?
একটি সমঝোতা হয়েছিল। এখন চুক্তি হল কয়েক মাস পর। বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা হবে। এর জন্য বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে হবে। প্রশ্ন এখানেই- কে কতটুকু হ্রাস করবে, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে কি একই কাতারে আমরা দেখব? কিংবা রাশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলো কতটুকু কমাবে? এ ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তিতে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। সমঝোতায় আছে, উন্নত বিশ্ব জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার সাহায্য দেবে। এটা শুনতে ভালোই। কিন্তু এই অর্থ কে দেবে? কোন দেশ কতটুকু দেবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত. ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নানা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত (ভালনারেবল, রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন ইত্যাদি)। এই দেশগুলোর মাঝে অর্থ বণ্টনের ভিত্তিটি কী হবে? তৃতীয়ত. ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এই অর্থ কীভাবে ম্যানেজ করবে? কেননা উন্নয়নশীল বিশ্বে দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত। বাংলাদেশে জলবায়ু ফান্ডে প্রাপ্ত টাকা বরাদ্দ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। একসময় কথা হয়েছিল প্রাপ্ত টাকা বিলি-বণ্টনের বিষয়টি দেখভাল করবে বিশ্বব্যাংক। পরে বিশ্বব্যাংক এখান থেকে সরে যায়। বিষয়টি যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়। বরং উন্নয়নশীল বিশ্বে, বিশেষ করে সাগর পাড়ের অনেক দেশ নিয়ে এরকম সমস্যা আছে। সমঝোতা স্মারকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ দেখা হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও অত কঠোর নয়। অর্থাৎ সাগর পাড়ের দেশগুলো, বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে, সাগর-মহাসাগরে পানির পরিমাণ বেড়ে গেলে, যাদের বিশাল এলাকা সাগর গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, কোনো ক্ষতিপূরণ এর জন্য দাবি করতে পারবে না। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আসবে বড় দেশগুলোর মর্জি-মাফিকের ওপর।
নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এর প্রয়োজন ছিল। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে, সাগর উত্তপ্ত হচ্ছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে- এ সবই বাস্তব। এ ব্যাপারে কারও কোনো বক্তব্য নেই। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, গ্রিনল্যান্ড ও এনটার্কটিকায় বরফ গলছে। এর জন্য একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া প্রয়োজন ছিল। এটা সবাই উপলব্ধি করেন। কিন্তু কর্মপরিকল্পনাটা কী, কীভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে- তার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্যারিস সম্মেলনে নেয়া হয়নি। এটা বলা যাচ্ছে, বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বাড়ছে। অর্থাৎ শিল্পে, কলকারখানায়, যানবাহনে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার করার ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু এই জ্বালানির ব্যবহার আমরা কমাবো কীভাবে? জ্বালানি ব্যবহারের সঙ্গে উন্নয়নের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত। জীবাশ্ম জ্বালানি কম ব্যবহার করলে কার্বন নিঃসরণ কম হবে, এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের কাছে কি বিকল্প জ্বালানি আছে? উন্নয়নশীল বিশ্ব জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বের কাছে ‘নয়া প্রযুক্তি’ থাকলেও, তাদের অনীহা রয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই প্রযুক্তি সরবরাহের। সোলার এনার্জির একটা বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও উন্নয়নশীল বিশ্বে এই এনার্জির ব্যবহার বাড়ছে না। বাংলাদেশে যে পরিমাণে এর ব্যবহার বাড়ানো উচিত ছিল, তা কিন্তু হয়নি। কেননা এর জন্য যে খুচরা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়, তা বিদেশ থেকে আনতে হয়। খরচ অনেক বেশি পড়ে, যা আমাদের সাধ্যের মধ্যে পড়ে না। এই সেক্টরে যতদিন পর্যন্ত না বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবে, ততদিন এই সেক্টর বিকশিত হবে না। আর এই সেক্টর বিকশিত না হলে মানুষ জ্বালানির জন্য নির্ভরশীল থাকবে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় মানুষের নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো, এমনকি সাগর পাড়ের দেশগুলোর জ্বালানি দরকার। তারা বিকল্প জ্বালানি, অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্ভাবন করতে পারেনি। ফলে তাদের পক্ষে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করাও সম্ভব হবে না।
ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল যে, জলবায়ু চুক্তিটি শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে? মার্কিন তথা বহুদেশীয় সংস্থাগুলোর স্বার্থ এখানে বেশি। জ্বালানি একটা বিশাল ‘ব্যবসা’। এই ‘ব্যবসা’ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা কখনোই চাইবে না বহুদেশীয় সংস্থাগুলো। প্যারিসে একটি সমঝোতা হয়েছিল। এখন চুক্তি হল। এর প্রয়োজন ছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওসিস্টেমের অধ্যাপক মাইলেস এলেন তাই ইতিমধ্যে প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ৩৫০ অঙ্গসংগঠনটির প্রধান বিল মেকিব্বেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত বড় বড় ব্যবসায়িক তথা বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কারণে এই ‘সমঝোতা’ শেষ পর্যন্ত ভণ্ডুল হয়ে যাবে। দাতব্য সংস্থা অক্সফামও তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ফলে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। যারা অনলাইনে নিয়মিত বিভিন্ন জার্নাল পাঠ করেন, তারা দেখবেন প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার সংখ্যাই বেশি। তারপরও একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, এতগুলো দেশ একসঙ্গে প্যারিসে মিলিত হয়েছিল। বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই সেখানে গিয়েছিলেন। এবং তারা সবাই একবাক্যে একটি চুক্তির কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশও প্যারিসে গিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পরিবেশমন্ত্রী নিউইয়র্ক গেলেন এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। আমাদের বন ও পরিবেশমন্ত্রী প্যারিসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। বাংলাদেশ প্যারিস সমঝোতার আলোকে এখন চুক্তি স্বাক্ষর করল। কিন্তু প্যারিসে অংশ নেয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের কোনো কোনো সদস্য স্বীকার করেছেন, সমঝোতা স্মারকে অনেক বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে। এমনকি শিল্পোন্নত দেশগুলো যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা বা আইএনডিসি জমা দিয়েছে, তা রিভিউ করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা তিন ডিগ্রির বেশি বাড়বে। অথচ চুক্তিতে ২ ডিগ্রির বেশি বাড়তে না দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পাঁচ বছর পর কার্বন নিঃসরণ কমানোর পর্যালোচনায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ প্রয়োজন। এখন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হল। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেক। প্রতিটি দেশের পার্লামেন্টে এ চুক্তিটি অনুস্বাক্ষরিত হতে হবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে লক্ষ্য করার মতো। জন কেরি তার নাতনিকে কোলে নিয়ে এ চুক্তিটি স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে একটা মেসেজ দিলেন যে, আগামী ভবিষ্যতের জন্যই এ চুক্তি। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেস যদি এ চুক্তিতে বাগড়া দেয় তখন? চীন বলছে, আগামী সেপ্টেম্বরে চীনের হাংজু শহরে যে জি-২০ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার আগেই তারা চুক্তিটির অনুস্বাক্ষর করবে। এখন দেখার পালা চীন তার কথা রাখে কি-না!
বিশ্ব এখন রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ভারতে খরা দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ভারতকে পানি আমদানি করতে হতে পারে! ইতিমধ্যে খরায় মারা গেছে একশ’র অধিক মানুষ। ফলে বিশ্বে তাপমাত্রা যাতে নির্দিষ্ট সীমায় রাখা যায়, সে লক্ষ্যেই প্যারিস সমঝোতা ও নিউইয়র্ক চুক্তির বাস্তবায়নটা জরুরি। Daily Jugantor 25.04.16
বিশ্বের ১৯৫টি দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রায় সবাই প্যারিস সম্মেলনে যোগ দিয়ে এই সম্মেলনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতির (যাদের একটা বড় অংশ আবার এনজিও প্রতিনিধি) ফলে সেখানে কত টন কার্বন নিঃসরণ হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। কিন্তু কোপেনহেগেনে (২০০৯ ডিসেম্বর) যে কপ-১৫ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার একটি পরিসংখ্যান আছে। প্রায় ১৫ হাজার প্রতিনিধি ওই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। আর খরচ হয়েছিল ১২২ মিলিয়ন ডলার। আর জাতিসংঘের মতে, এসব প্রতিনিধির আসা, নেয়া, গাড়ি ব্যবহারের কারণে তারা বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ করেছিল ৪০ হাজার ৫০০ টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড। পাঠক, এ থেকে ধারণা করতে পারেন, প্যারিসে কত টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণ হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল কী?
একটি সমঝোতা হয়েছিল। এখন চুক্তি হল কয়েক মাস পর। বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা হবে। এর জন্য বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে হবে। প্রশ্ন এখানেই- কে কতটুকু হ্রাস করবে, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে কি একই কাতারে আমরা দেখব? কিংবা রাশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলো কতটুকু কমাবে? এ ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তিতে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। সমঝোতায় আছে, উন্নত বিশ্ব জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার সাহায্য দেবে। এটা শুনতে ভালোই। কিন্তু এই অর্থ কে দেবে? কোন দেশ কতটুকু দেবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়ত. ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নানা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত (ভালনারেবল, রেইন ফরেস্ট কোয়ালিশন ইত্যাদি)। এই দেশগুলোর মাঝে অর্থ বণ্টনের ভিত্তিটি কী হবে? তৃতীয়ত. ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এই অর্থ কীভাবে ম্যানেজ করবে? কেননা উন্নয়নশীল বিশ্বে দুর্নীতির বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত। বাংলাদেশে জলবায়ু ফান্ডে প্রাপ্ত টাকা বরাদ্দ নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। একসময় কথা হয়েছিল প্রাপ্ত টাকা বিলি-বণ্টনের বিষয়টি দেখভাল করবে বিশ্বব্যাংক। পরে বিশ্বব্যাংক এখান থেকে সরে যায়। বিষয়টি যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়। বরং উন্নয়নশীল বিশ্বে, বিশেষ করে সাগর পাড়ের অনেক দেশ নিয়ে এরকম সমস্যা আছে। সমঝোতা স্মারকে উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বার্থ দেখা হয়নি। আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও অত কঠোর নয়। অর্থাৎ সাগর পাড়ের দেশগুলো, বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে, সাগর-মহাসাগরে পানির পরিমাণ বেড়ে গেলে, যাদের বিশাল এলাকা সাগর গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, কোনো ক্ষতিপূরণ এর জন্য দাবি করতে পারবে না। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি আসবে বড় দেশগুলোর মর্জি-মাফিকের ওপর।
নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এর প্রয়োজন ছিল। কেননা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে, সাগর উত্তপ্ত হচ্ছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে- এ সবই বাস্তব। এ ব্যাপারে কারও কোনো বক্তব্য নেই। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, গ্রিনল্যান্ড ও এনটার্কটিকায় বরফ গলছে। এর জন্য একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া প্রয়োজন ছিল। এটা সবাই উপলব্ধি করেন। কিন্তু কর্মপরিকল্পনাটা কী, কীভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে- তার কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্যারিস সম্মেলনে নেয়া হয়নি। এটা বলা যাচ্ছে, বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বাড়ছে। অর্থাৎ শিল্পে, কলকারখানায়, যানবাহনে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যবহার করার ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু এই জ্বালানির ব্যবহার আমরা কমাবো কীভাবে? জ্বালানি ব্যবহারের সঙ্গে উন্নয়নের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত। জীবাশ্ম জ্বালানি কম ব্যবহার করলে কার্বন নিঃসরণ কম হবে, এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বের কাছে কি বিকল্প জ্বালানি আছে? উন্নয়নশীল বিশ্ব জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। উন্নত বিশ্বের কাছে ‘নয়া প্রযুক্তি’ থাকলেও, তাদের অনীহা রয়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বে এই প্রযুক্তি সরবরাহের। সোলার এনার্জির একটা বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও উন্নয়নশীল বিশ্বে এই এনার্জির ব্যবহার বাড়ছে না। বাংলাদেশে যে পরিমাণে এর ব্যবহার বাড়ানো উচিত ছিল, তা কিন্তু হয়নি। কেননা এর জন্য যে খুচরা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়, তা বিদেশ থেকে আনতে হয়। খরচ অনেক বেশি পড়ে, যা আমাদের সাধ্যের মধ্যে পড়ে না। এই সেক্টরে যতদিন পর্যন্ত না বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবে, ততদিন এই সেক্টর বিকশিত হবে না। আর এই সেক্টর বিকশিত না হলে মানুষ জ্বালানির জন্য নির্ভরশীল থাকবে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় মানুষের নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো, এমনকি সাগর পাড়ের দেশগুলোর জ্বালানি দরকার। তারা বিকল্প জ্বালানি, অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্ভাবন করতে পারেনি। ফলে তাদের পক্ষে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করাও সম্ভব হবে না।
ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল যে, জলবায়ু চুক্তিটি শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে? মার্কিন তথা বহুদেশীয় সংস্থাগুলোর স্বার্থ এখানে বেশি। জ্বালানি একটা বিশাল ‘ব্যবসা’। এই ‘ব্যবসা’ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটা কখনোই চাইবে না বহুদেশীয় সংস্থাগুলো। প্যারিসে একটি সমঝোতা হয়েছিল। এখন চুক্তি হল। এর প্রয়োজন ছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওসিস্টেমের অধ্যাপক মাইলেস এলেন তাই ইতিমধ্যে প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ৩৫০ অঙ্গসংগঠনটির প্রধান বিল মেকিব্বেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত বড় বড় ব্যবসায়িক তথা বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কারণে এই ‘সমঝোতা’ শেষ পর্যন্ত ভণ্ডুল হয়ে যাবে। দাতব্য সংস্থা অক্সফামও তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ফলে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। যারা অনলাইনে নিয়মিত বিভিন্ন জার্নাল পাঠ করেন, তারা দেখবেন প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার সংখ্যাই বেশি। তারপরও একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, এতগুলো দেশ একসঙ্গে প্যারিসে মিলিত হয়েছিল। বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই সেখানে গিয়েছিলেন। এবং তারা সবাই একবাক্যে একটি চুক্তির কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশও প্যারিসে গিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পরিবেশমন্ত্রী নিউইয়র্ক গেলেন এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। আমাদের বন ও পরিবেশমন্ত্রী প্যারিসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। বাংলাদেশ প্যারিস সমঝোতার আলোকে এখন চুক্তি স্বাক্ষর করল। কিন্তু প্যারিসে অংশ নেয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের কোনো কোনো সদস্য স্বীকার করেছেন, সমঝোতা স্মারকে অনেক বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে। এমনকি শিল্পোন্নত দেশগুলো যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা বা আইএনডিসি জমা দিয়েছে, তা রিভিউ করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বর্তমান শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা তিন ডিগ্রির বেশি বাড়বে। অথচ চুক্তিতে ২ ডিগ্রির বেশি বাড়তে না দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পাঁচ বছর পর কার্বন নিঃসরণ কমানোর পর্যালোচনায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর লক্ষ্যমাত্রা পুনর্নির্ধারণ প্রয়োজন। এখন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হল। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেক। প্রতিটি দেশের পার্লামেন্টে এ চুক্তিটি অনুস্বাক্ষরিত হতে হবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে লক্ষ্য করার মতো। জন কেরি তার নাতনিকে কোলে নিয়ে এ চুক্তিটি স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে একটা মেসেজ দিলেন যে, আগামী ভবিষ্যতের জন্যই এ চুক্তি। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেস যদি এ চুক্তিতে বাগড়া দেয় তখন? চীন বলছে, আগামী সেপ্টেম্বরে চীনের হাংজু শহরে যে জি-২০ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার আগেই তারা চুক্তিটির অনুস্বাক্ষর করবে। এখন দেখার পালা চীন তার কথা রাখে কি-না!
বিশ্ব এখন রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ভারতে খরা দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ভারতকে পানি আমদানি করতে হতে পারে! ইতিমধ্যে খরায় মারা গেছে একশ’র অধিক মানুষ। ফলে বিশ্বে তাপমাত্রা যাতে নির্দিষ্ট সীমায় রাখা যায়, সে লক্ষ্যেই প্যারিস সমঝোতা ও নিউইয়র্ক চুক্তির বাস্তবায়নটা জরুরি। Daily Jugantor 25.04.16
0 comments:
Post a Comment