তিনি তিস্তার পানি দেবেন না, যাতে করে বাংলাদেশ-ভারতের মাঝে যে সম্পর্কের ‘নয়া অধ্যায়’-এর সূচনা হয়েছে, তা একটি প্রশ্নের মধ্যে থাকুক। বাংলাদেশ ভারতের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলুক! তাতে করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে প্রশ্ন উঠুক এবং তিনি তাতে লাভবান হন। ৪ এপ্রিল-৫ মে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন। তিনি চান না বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ‘নয়া অধ্যায়ের’ কারণে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়–ক। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে (তিস্তার পানির উপকারভোগী) তার জনপ্রিয়তা তলানিতে। অথচ বাংলাদেশে এসে তিনি এমন ভাব দেখিয়েছিলেন যে, তিনিই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হাসিনা দিদি হিসেবে সম্বোধন করে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি কত আন্তরিক। প্রটোকল তার কাছে মুখ্য ছিল না, ছিল গৌণ। একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে এভাবে প্রকাশ্যে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করা যায় না, মমতা ব্যানার্জির কাছে এটা বিবেচনায় আসেনি। সেবার তার জন্য গণভবনে দুুপুরের খাবারেরও আয়োজন করা হয়েছিল। ১২ পদের খাবারের তালিকায় ইলিশ ছিল ৩ পদের। সবাই জানেন বাংলাদেশের ইলিশের প্রতি মমতার বিশেষ টান আছে। আগে মমতা যখন দিল্লিতে রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে যারাই নয়াদিল্লি গেছেন (বিশেষ করে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী), তারা অবধারিতভাবেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন ‘পদ্মার ইলিশ’। তাই ইলিশ প্রসঙ্গ এসেছিল (আপাতত রপ্তানি বন্ধ) মমতার সফরে। কিন্তু সারা জাতি ও মিডিয়া সেবার তাকিয়ে ছিল মমতা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার অনাপত্তির কথা জানিয়ে যাবেন। কেননা তিস্তার পানিবণ্টনের সমস্যা একটাই আর তা হচ্ছে মমতা। মমতার আপত্তির মুখে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখনো মমতার আসার কথা ছিল। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী এলেও, শেষ মুহূর্তে মমতা তার আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। ফলে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আর করা হয়নি। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে মমতার দৃষ্টিভঙ্গির কি কোন পরিবর্তন এসেছে? গেলবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি দু’দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন এ কথাটা। এর আগে ভারতীয় হাইকমিশনার কর্তৃক আয়োজিত ‘বৈঠকি বাংলা’য়ও মমতা নিজেই বলেছিলেন তার ওপর ‘আস্থা’ রাখতে। স্থলসীমানা চুক্তি নিয়ে তার আপত্তি নেই এটা অবশ্য তিনি প্রমাণ করেছেন। ঢাকাতেও এ কথাটা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন মমতা। কিন্তু তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার ‘কমিটমেন্ট’ কোথায়? সোজাসাপ্টা হিসাব হচ্ছে, তিনি ঢাকায় এসে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কোনো ‘কমিটমেন্ট’ করে যেতে চাননি। এটাই মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক চরিত্র। যেখানে স্বার্থ রয়েছে, সেখানে মমতা আছেন। তিস্তার পানির ব্যাপারে তার স্বার্থ অনেক বেশি। এখন সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। এটাকে তিনি বিজেপির হাতে তুলে দিতে চান না। উত্তরবঙ্গে পানির চাহিদা বেশি। মমতা এটা জানেন ও বোঝেন। বলা ভালো, ১৯ ফেব্রুয়ারি (২০১৪) পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রাক্কালে তিস্তায় পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছিল। এটা কাকতালীয় কিনা জানি না। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ক’টি বিষয় অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল, তার মাঝে তিস্তার পানিবণ্টন অন্যতম। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটা আগ্রহ থাকলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। সেই মমতা ব্যানার্জিই এখন আবার ক্ষমতায় আসছেন। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার ঢাকা আসার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। তিস্তায় পানিবণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৫) সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ওই মাসের প্রথম ৫ দিনে তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল ৫০০ কিউসেকের নিচে। বলা ভালো, সেচ প্রকল্পে পানি দেওয়া দূরের কথা, শুধু নদী বাঁচানোর জন্যই দরকার এক হাজার কিউসেক। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা আজ মৃত্যুমুখে। গত নভেম্বর থেকেই তিস্তার পানিপ্রবাহ কমতে থাকে।
বাংলাদেশের লালমনিরহাটে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীতে ইতিহাসের সবচেয়ে কম পানিপ্রবাহ রেকর্ড হয়। ফেব্রুয়ারি (২০১৫) মাসের প্রথম চার দিনের হিসাবে দেখা গেছে, প্রথমদিকে পাওয়া গেছে ৪২৬ কিউসেক, দ্বিতীয় দিন ৪৭৫ কিউসেক, তৃতীয় দিন ৪৪৫ কিউসেক আর চতুর্থ দিন ৪১৬ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয় (একটি জাতীয় দৈনিক, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। যৌথ নদী কমিশন সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানিপ্রবাহ ভালো ছিল বলে তুলনার জন্য ওই সময়কালের হিসাবকে ঐতিহাসিক গড়প্রবাহ ধরা হয়। ওই ১২ বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম ১০ দিনে পানিপ্রবাহ ছিল ৫৯৮৬ কিউসেক। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে আসে ৯৬৩ কিউসেকে। এরপর তা নেমে যায় ৫০০ কিউসেকের নিচে। অথচ নদী রক্ষার জন্যই দরকার ১ হাজার কিউসেক পানি। আর বিদ্যমান সেচ প্রকল্পের জন্য আরও সাড়ে ৩ হাজার কিউসেক পানি দরকার। ওই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি ‘নোট ভারবাল’ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
মমতা ব্যানার্জির প্রথম ঢাকা সফরের আগে আমরা অনেক প্রত্যাশার কথা শুনেছি। তবে এটা সত্য, তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে এটা সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারক করা, যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন এটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ীর কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্দা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে।
ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুদেশের মন্ত্রীপর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ, ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুদেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল ক্ষমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচকাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা বরাবরই মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’। তাই মমতা তিস্তা চুক্তি করে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করবে এটা আমার তখনই বিশ্বাস হয়নি। তাই মমতায় আস্থা রাখা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। আমরা ভারতের অনেক দাবি পূরণ করেছি। মোদির আমলে সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে দুদেশের সীমানা এখন নিশ্চিত। দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের পর মমতা যদি তার ওপর রাখা আস্থার প্রতিদান না দেন তাহলে তা যে দুদেশের সম্পর্কের মাঝে একটা অবিশ্বাসের জন্ম দেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে রুদ্র কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতে পারেন, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের এই পানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেওয়া সম্ভব বলে সুপারিশ করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব কুমার রায়ও এই সুপারিশ সমর্থন করেছিলেন। এর ভিত্তিতেই মমতা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
Daily Amader Somoy
11.04.16
0 comments:
Post a Comment