রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বৈশ্বিক কর ফাঁকির রাজনীতি ও অসমতার গল্প

বৈশ্বিক কর ফাঁকির ঘটনা নিয়ে সারা বিশ্বে এখন রাজনীতির ঝড় বইছে। এরই মধ্যে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর অবস্থাও নড়বড়ে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। সারা বিশ্ব এখন জেনে গেছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, অভিনেতা, ব্যবসায়ী, ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়স্বজন সবাই নিজ দেশের ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে পানামার একটি কম্পানির মাধ্যমে (মোসাক ফনসেকা) অফশোর কম্পানিতে কোটি কোটি ডলার সরিয়ে নিয়েছেন। এই কর ফাঁকি ব্যবসাকে মোসাক ফনসেকা একটি আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে, যার জন্য পৃথিবীর ৪০টি দেশে তাদের অফিস কাজ করছে। এই কর ফাঁকির ঘটনা একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি ব্যাংক (ডয়েচে ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, এইচএসবিসি) কিছু কিছু দ্বীপপুঞ্জ শাসিত দেশ বা অঞ্চলে শত শত তথাকথিত কম্পানি খুলে সেখানে বেনামে ওই অ্যাকাউন্টগুলোতে টাকা সরিয়ে নিয়েছে। এর বিস্তারিত ইতিমধ্যেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি কর ফাঁকি আর পাচার করা অর্থের পরিমাণ বছরে ২০০ মিলিয়ন ডলার। আর ইতিমধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। গত পাঁচ বছরে টাকা পাচারের হার বেড়েছে ২৫ শতাংশ। পাঠক চিন্তা করতে পারেন ৭ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার কী পরিমাণ অর্থ? এবং এই অর্থ দিয়ে আমরা কী করতে পারতাম? বিশ্বে যে অসমতা, ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে যে পার্থক্য—তা আমরা দূর করতে পারতাম। গরিব দেশের লোকগুলো তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে পারত। আফ্রিকায় এইডস, এবোলা আর অতি সম্প্রতি লাতিন আমেরিকায় জিকা রোগের যে প্রাদুর্ভাব তা আমরা নির্মূল করতে পারতাম। এসব সংক্রামক রোগের জন্য যে গবেষণা প্রয়োজন এবং তার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়, আমরা তার সংস্থান করতে পারতাম। বিশ্বকে আরো রোগমুক্ত করতে পারতাম। গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ করতে পারতাম। আফ্রিকার দেশগুলোর দরিদ্রতা দূর করতে পারতাম। একটি সমতাময় বিশ্ব আমরা পেতে পারতাম। ক্ষমতাসীনরা, ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীরা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ পাচার করে দিয়েছেন এসব অফশোর দ্বীপপুঞ্জে প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। তাঁরা কর ফাঁকি দিয়েছেন। অর্থ পাচার করেছেন। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় তাঁদের আইনের আশ্রয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এসব অর্থ নিজ নিজ দেশে ব্যবহৃত হলে সেসব দেশের আর্থসামাজিক অবস্থাটাই বদলে যেত। আমরা কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করব যে বিশ্বে ধনী শ্রেণির মানুষ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈষম্যও। ধনী রাষ্ট্র আরো ধনী হয়েছে। কিন্তু আইনের কড়াকড়ি উপেক্ষা করেও সেখান থেকে অর্থপাচার হয়েছে। চীনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে নামলেও তাঁর আত্মীয়স্বজনই (শ্যালক) অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। অভিযোগ উঠেছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধেও। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে অর্থপাচার হয়ে যাওয়ায়, অর্থ এখন এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। লন্ডনের গার্ডিয়ান (১৩ অক্টোবর ২০১৫) আমাদের জানিয়েছিল যে বিশ্বের মাত্র ১ শতাংশ মানুষের কাছে বিশ্বের মোট সম্পদের অর্ধেক এখন কেন্দ্রীভূত। ক্রেডিট সুইসের গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন কিংবা কর ফাঁকির কারণে বিশ্বে ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বিশ্বের বর্তমান জনগোষ্ঠী (মার্চ ২০১৬) প্রায় ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন। এর মধ্যে ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীকে ধরা হয় কর্মক্ষম, যাদের অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ডলারের নিচে (৭০ শতাংশ)। বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের হাতে কী পরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত—অক্সফাম তার একটি হিসাব দিয়েছে। বিশ্বের মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫০ ট্রিলিয়ন ডলার। এখান থেকে ৭ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদের মালিক ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনগোষ্ঠী। আবার ৩১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ (১২.৫ শতাংশ) রয়েছে ১০০৩ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কাছে। ১১২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের (৪৫.২ শতাংশ) সম্পদ রয়েছে ০.৭ শতাংশ অর্থাৎ ৩৪ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর কাছে, যাদের সবার সম্পদের পরিমাণ এক মিলিয়ন ডলারের বেশি করে। এই পরিসংখ্যান আমাদের বলে দেয় বিশ্বে ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে এবং ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য বাড়ছে। আমরা যে পরিসংখ্যান পাই, তাতে দেখা যায় সবচেয়ে বেশি ধনী লোকের বাস যুক্তরাষ্ট্রে। তবে আশ্চর্যের বিষয়, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী লোকের বাস চীনে। চিন্তা করা যায়? চীন এখনো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখনো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। তবে চীনের রাজনীতিতে প্রয়াত তেং শিয়াও পিংয়ের উত্থানের পর অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এটাকে তারা বলছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। এর ফলে চীনে অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমানো হয়েছে। ব্যক্তি পুঁজির সেখানে বিকাশ ঘটেছে। ফলে হাজার হাজার ধনী ব্যবসায়িক শ্রেণির জন্ম হয়েছে, যারা অসৎ পন্থা অবলম্বন করে ‘ধনী’ হয়েছে। অথচ চীনে দরিদ্রতা আছে। যে ২০টি দেশে ধনী লোকের সংখ্যা বেশি সেখানে প্রতিটি দেশে দরিদ্রতা আছে। ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (১ দশমিক ৯০ ডলার, প্রতিদিন) সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষের (চরম দরিদ্রতা) বাস এশিয়ায়। এমনকি উত্তর আমেরিকায় (যেখানে ধনী লোকের বাস বেশি), সেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা শূন্য দশমিক ৩ মিলিয়ন। ধনী লোকের কাছে এই যে বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভূত, তা দিয়ে সব ধরনের রোগবালাই দূর করা সম্ভব। ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাথাপিছু পাঁচ ডলার ব্যয়ে বিশ্বের ৪০ লাখ মা ও শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব। নিম্ন আয়ের দেশে মা ও শিশুর সেবা পৌঁছে দিতে, তাদের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজন ৬২০ কোটি ডলার। অর্থাৎ মাথাপিছু ৬ দশমিক ৭ ডলার। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। সম্পদশালী ব্যক্তিদের সম্পদ আরো বাড়ছে। গরিব আরো গরিব হচ্ছে। আর ধনী ব্যক্তিদের সম্পদ আরো বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে মোসাক ফনসেকার মতো প্রতিষ্ঠান, যারা থাকছে আইনের ঊর্ধ্বে। তারা সাধারণ কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান নয়। গ্রাহকদের গোপন নথি তারা সুরক্ষা করবে না, এটা বিশ্বাস করা যায় না। সে কারণেই প্রশ্নটা এসে যায় কোনো বৃহৎ শক্তি কি এর পেছনে আছে? সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবাদ লিখেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক রবার্ট পেরি (Robert Parry)। প্রবন্ধের নাম ‘করাপশন অ্যাজ এ প্রোপাগান্ডা উইপন’। এটি ছাপা হয়েছে ‘গ্লোবাল রিসার্চ’-এ ৫ এপ্রিল ২০১৬-তে। গ্লোবাল রিসার্চ টরন্টোতে নিবন্ধিত একটি গবেষণা সংস্থা। এটি পরিচালনা করেন অধ্যাপক মিসেল চসুডোভস্কি (Michel Chossudousky)। বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্য, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠান এবং তিনি নিজে কাজ করেন। এখানে রবার্ট পেরি দুটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এক. এই গোপন তথ্য ফাঁসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের  রেজিম চেঞ্জ (regime chanse) বা ‘সরকার পরিবর্তনের’ (বিভিন্ন দেশের) যে ‘নীতি’, তার সঙ্গে একটা মিল থাকতে পারে। তিনি উল্লেখ করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে ‘কালার রেভল্যুশন’ হয়েছে (জর্জিয়া, কিরগিজিস্তান, ইউক্রেন, এমনকি আরব বসন্তেও), তাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ একটা যোগসূত্র আছে। যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ নামে অর্থ সহায়তা করে থাকে। আমি নিজে ‘আরব বসন্ত’-এর ওপর গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি কিভাবে তরুণ নেতৃত্বকে (মিসরের) যুক্তরাষ্ট্র উদ্বুদ্ধ করেছিল মুবারকবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে। ইউক্রেনে রুশ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানোকোভিচ একটি ‘গণ-আন্দোলনে’ উত্খাত হয়েছিলেন ২০১৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ক্ষমতায় এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত প্রোসেনকো, যিনি এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট। অভিযোগ আছে, এই গণ-আন্দোলনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল। কেননা যুক্তরাষ্ট চায় ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক, তাতে রাশিয়ার সীমান্তে মার্কিন সেনা মোতায়েন করে রাশিয়াকে একটি স্নায়বিক চাপে রাখা যায়। ওই ‘আন্দোলন’ সফল হয়েছিল এবং ইয়ানোকোভিচ (যিনি ছিলেন সে দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট) অপসারিত হয়েছিলেন। মজার ব্যাপার, ইয়ানোকোভিচ উত্খাত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল শুধু অর্থনীতিতে কিছুটা গতি আনার জন্য। অভিযোগ আছে, এই অর্থ প্রেসিডেন্ট প্রোসেনকো আত্মসাৎ করেছেন। তাঁর নামে টাকা পাচার হয়েছে এবং মোসাক ফনসেকা তাঁকে আইনি সহায়তা দিয়েছে। প্রশ্নটা এ কারণেই যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ যেখানে বেশি (যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী কোনো বন্ধু নেই), সেখানে তারা সরকার পরিবর্তন ঘটায়। ইরাক, লিবিয়া এর বড় প্রমাণ। একসময় হোসনি মুবারকের প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় আসমা মাহফুজদের (মিসরের তাহ্রীর স্কয়ার আন্দোলনের নেত্রী) দিয়ে তথাকথিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ড. মুরসিকে কিছুদিন ক্ষমতায় রেখে ‘গণতন্ত্রচর্চা’ মিসরে চালু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন সেসব অতীত। ফিল্ড মার্শাল সিসিকে নিয়েই সূচিত হবে এখন নয়া স্ট্র্যাটেজি। আমার ধারণা, ইউক্রেনেও সরকার পরিবর্তন আসন্ন। তাই রবার্ট পেরি যে আশঙ্কার কথা বলেছেন তা ফেলে দেওয়ার নয়। দ্বিতীয় যে বিষয়টির দিকে পেরি দৃষ্টি দিয়েছেন, তা হচ্ছে ব্রিকস ব্যাংক গঠন। বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে চীনের নেতৃত্বে এবং ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে চীন বিকল্প একটি ‘বিশ্বব্যাংক’ গড়ে তুলেছে। এখানে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশও যোগ দিয়েছে। বিশ্বের অর্থনীতির বড় শক্তি এবং উঠতি শক্তি হচ্ছে চীন ও ভারত। ব্রিকস নিয়ে একটা ভয় ও উত্কণ্ঠা তাই যুক্তরাষ্ট্রের থাকতে পারে। ফলে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বকে দুর্বল করার জন্য তথ্য ফাঁস, অর্থপাচারের ঘটনা যে ঘটেনি, তা হলফ করে বলা যাবে না। ওই যে সরকার পরিবর্তন তত্ত্ব! কিন্তু এটা যদি ‘সত্য’ হয়ে থাকে, তাহলে স্ট্র্যাটেজিতে কিছু ভুল আছে। চীন বা রাশিয়ায় সরকার পরিবর্তন এত সহজ নয়। শি চিনপিং আর পুতিনকে সাদ্দাম হোসেন কিংবা গাদ্দাফির সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। এখানে যে প্রশ্নটা অনেকেই করেন তা হচ্ছে টাকা পাচারের জন্য কিংবা ট্যাক্স ফাঁকির জন্য এ ধরনের অফশোর শেল কম্পানিগুলোকে বেছে নেওয়া হয় কেন? আর পানামাই বা কেন? যেটা বলা দরকার, তা হচ্ছে পৃথিবীতে বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জ শাসিত দেশ বা এলাকা রয়েছে (যেমন—ভার্জিন আইল্যান্ড, কেম্যান আইল্যান্ড, সিসিলি, কুক আইল্যান্ড), যেখানে হাজার হাজার কম্পানি রেজিস্ট্রি করে ওই কম্পানির নামে সেখানকার ব্যাংকে অর্থ রাখা যায়। এসব দ্বীপপুঞ্জের কোনোটাতে এখনো ব্রিটিশ কর্তৃত্ব রয়েছে (ভার্জিন আইল্যান্ড, কেম্যান আইল্যান্ড। কুক আইল্যান্ডের কর্তৃত্ব নিউজিল্যান্ডের হাতে)। এসব দেশে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো (যেমন জার্মানির ডয়চে ব্যাংক, হংকংভিত্তিক এইচএসবিসি, যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ব্যাংক, ফ্রান্সের সোসাইটি জেনারেল) এসব দ্বীপপুঞ্জে হাজার হাজার কম্পানি রেজিস্ট্রি করে ওই কম্পানির নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ব্যবসা করে। যেমন ডয়চে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে ৫০০ কম্পানি। ব্যাংক সোসাইটি জেনারেল করেছে ২৩০০ কম্পানি। যে কেউ নাম গোপন করে এসব ব্যাংকের সহযোগিতা নিয়ে কম্পানি খুলতে পারে। ব্যবসা করতে পারে। আর মোসাক ফনসেকার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এদের আইনি সহযোগিতা করে। এখানে কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না। ফলে এসব দ্বীপপুঞ্জ ব্যবসায়ীদের জন্য স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে কম্পানি রেজিস্ট্রি করে, এখান থেকে পৃথিবীর বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। তারা যদি নিজ দেশে ব্যবসা করত, তাহলে তাদের প্রচুর ট্যাক্স দিতে হতো। ট্যাক্স ফাঁকি দিতেই তারা অফশোর কম্পানিগুলোতে টাকা পাচার করছে। অথচ রাষ্ট্রীয় খাতে কর যদি জমা হতো, তাহলে রাষ্ট্র সামাজিক খাতে এ টাকা ব্যয় করতে পারত। আমরা মা ও শিশু মৃত্যুর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ডায়াবেটিস একটি প্রাণঘাতী রোগ, যা ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। একটি পরিসংখ্যান দিই। ২০১২ সালে বিশ্বে ডায়াবেটিসে মারা গেছে ১৫ লাখ মানুষ। ৩৫ মিলিয়ন মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এইচআইভি তথা এইডস নিয়ে বসবাস করছে। অথচ মহামারি এসব রোগ নির্মূলে গবেষণায় যে অর্থ দরকার, তা পাওয়া যায়নি।
এখন পানামা পেপারসের মাধ্যমে কর ফাঁকির যে তথ্য ফাঁস হয়েছে, তাতে বড় ধরনের অনিয়মের কথা আমরা জানতে পেরেছি বটে; কিন্তু তা ধনী ও গরিবের মাঝে বৈষম্য কমাতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। কর ফাঁকি ও অর্থপাচার রোধে আন্তর্জাতিক আইন আছে বটে; কিন্তু তা যথেষ্ট কার্যকর নয়। প্রশ্নটা এখানেই। আন্তর্জাতিক পরিসরে যদি এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে অর্থপাচার রোধ করা যাবে না। Daily Kalerkontho 25.04.16

0 comments:

Post a Comment