পাঁচ বছর পর পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার প্রথম দফার নির্বাচন শুরু হয়েছে গত ৪ এপ্রিল। আসন মাত্র ১৮টি। প্রথম দফায় দ্বিতীয় পর্বে ভোট হবে ১৭ এপ্রিল ৫৬ আসনে। নির্বাচন হচ্ছে আসামেও। কেমন হলো এই নির্বাচন? কলকাতার পত্রিকাগুলো এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। জঙ্গলমহলে বড় ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন অনেকে। চরমপন্থি মাওবাদীদের এলাকা হচ্ছে এই জঙ্গলমহল। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মাওবাদীরা এখানে সক্রিয় ছিল। কিন্তু মাওবাদাী নেতা কৃষানজির মৃত্যুর পর এই আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত। মাওবাদীরা ভোট বয়কটের ডাক দিলেও তাতে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রায় ৮০ ভাগের ওপরে ভোট পড়েছে ১৮টি আসনে। অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবেই প্রথম দফা ভোট শেষ হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন দু’-একটি ‘ঘটনা’ ঘটেছে। ভোট কারচুপি (ওরা বলছে ছাপ্পা ভোট), মাস্তানি ও শাসক তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের ভোট কেন্দ্রে সন্ত্রাস ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। তবে নির্বাচন কমিশনকে দেখলাম তারা স্বস্তি প্রকাশ করেছে। নির্বাচনের আগে ও পরে বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনার খবরও আমরা দেখলাম পত্রপত্রিকায়। মমতা ব্যানার্জির টার্গেট দেখলাম বিজেপির চাইতে বেশি কংগ্রেসের দিকে। এক সভায় তিনি বলেছিলেন ‘পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সাইনবোর্ড বন্ধ হয়ে যাবে!’ আমাদের দেশের নেতানেত্রীরাও এভাবে কথা বলেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে বড় ধরনের কোনো অভিযোগ আমি পত্রপত্রিকায় দেখলাম না। বলার অপেক্ষা রাখে না এই নির্বাচন খোদ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সর্বভারতব্যাপীও এর একটা গুরুত্ব রয়েছে। বিজেপি এখানে দুর্বল। দুর্বল কংগ্রেসও। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা শতকরা একশ’ ভাগ এমন কথাই বলছে জনমত জরিপগুলো। মুশকিল হচ্ছে চূড়ান্ত ফলাফল জানার জন্য অমাদের অপেক্ষা করতে হবে মে মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত। দ্বিতীয় দফা ভোট হবে ১৭ এপ্রিল (৫৬ আসন), তৃতীয় দফা ২১ এপ্রিল (৬২ আসন), চতুর্থ দফা ২৫ এপ্রিল (৪৯ আসন), ৫ম দফা ৩০ এপ্রিল (৫৩ আসন) এবং ষষ্ঠ দফা ৫ মে (২৫ আসন)। মোট আসন ২৯৪।
উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সাল থেকে বামফ্রন্ট সেখানে ক্ষমতায় ছিল। সেই ক্ষমতার দুর্গে আঘাত করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সালে। পতন ঘটেছিল বামফ্রন্টের একক মমতা। মমতা ব্যানার্জি গত ৫ বছর যেভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা কমে গেছে এটা বলা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। ২০১১ সালের বিধান সভার নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের। আর এবার ঘটল উল্টোটি, অর্থাৎ কংগ্রেস এবার জোট গড়েছে বামফ্রন্টের সঙ্গে। জরিপে বিজেপির ঝুলিতে মাত্র ১টি আসন যেতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। আসামের ক্ষেত্রে জরিপ বলছে ১২৬ আসনের আসাম বিধানসভায় কংগ্রেস মাত্র ৩৬টি আসন পেতে পারে। অন্যদিকে বিজেপি-অসম গণপরিষদ আর বিপিএফ জোট পেতে পারে ৭৮ আসন। এর বাইরে মাওলানা বদরুদ্দিন আজমলের নেতৃত্বাধীন ও আইইউডিএফ পেতে পারে ১০ আসন। আসামে ক্ষমতায় আছে তরুণ গগৈর নেতৃত্বে একটি কংগ্রেস সরকার। তবে জনমত জরিপ যে সব সময়ই সত্য প্রমাণিত হয় তা নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দুটি রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। কেননা তিস্তার পানি বাইরের বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে মমতা ব্যানার্জির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় এক সঙ্গে আসার কথা ছিল। আসছিলেন। এসেছিলেন পরে আরো একবার। বলেছিলেন তিস্তা চুক্তির জন্য অপেক্ষা কেমন হলো প্রথম দফা প্রশ্ন এ নিয়েইকরতে হবে। আমরা জানতাম এটি খোদ পশ্চিমবঙ্গে একটি ইস্যু। নির্বাচনে বিএজপি এটা ক্ষমতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। তাই অত্যন্ত কৌঁসুলি মমতা তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে বিধানসভার নির্বাচনের আগে কোনো ‘কমিটমেন্টে’ যেতে রাজি হননি। তাই এই নির্বাচনটি আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকায় এসে তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন ‘অপেক্ষা করার’ জন্য। এখন দেখা যাক নির্বাচনের পর এই অপেক্ষার পালা শেষ হয় কী না! তবে বলা যেতে পারে সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচনের গুরুত্ব আছে।
এই বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসে ঐক্য করেছে বামফ্রন্টের সঙ্গে। অথচ গেল বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের নির্বাচনী মিত্র ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। বলা যেতে পারে মমতা ব্যানার্জি এক সময় যুব কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। তবু কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে এককভাবে তিনি পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। কংগ্রেস বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে তেমন জনমত তৈরি করতে পারেনি। কংগ্রেসের ব্যর্থতাই মমতাকে পশ্চিমবঙ্গে সামনে নিয়ে এসেছিল। এবারে কংগ্রেস ফিরে গেছে বাম শিবিরে। শুধু তাই নয় বাম জোট ও কংগ্রেসের সঙ্গে যে নির্বাচনী ঐক্য হয়েছে সেখানে মুলায়ম সিংয়ের সমাজবাদী পার্টি, লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, সংযুক্ত জনতা দলকে দুটি করে আসন দেয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গেও মহাজোট গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলো। বিহারে বিজেপি উৎখাতে সেখানে মহাজোট গঠিত হয়েছিল। সংযুক্ত জনতা দলনেতা নীতিশ কুমারকে সেদিন সমর্থন দিয়েছিল সবাই রাষ্ট্রীয় জনতা দল (লালু প্রসাদ), মুলায়ম সিংয়ের সমাজবাদী পার্টি। এমনকি পাটনায় মহাজোট সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন মমতা ব্যানার্জি, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক, জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ প্রমুখ। মুলায়ম সিং যাদব ও তার ছেলে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিং যাদব ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলেও তাদের সমর্থন ছিল। বিহারে মহাজোটের অন্যতম শরিক কংগ্রেসের সুপ্রিমো রাহুল গান্ধী, সিপিএম নেতা সীতাবাম ইয়েচুরিও উপস্থিত ছিলেন। ফলে কেন্দ্রে মোদিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য একটি মহাজোটের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। পশ্চিমবঙ্গে এর কিছুটা হলেও প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও এখানে তৃণমূল হয়েছে টার্গেট। এখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে অন্যরা। বিধানসভার এই নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি আবারো অভিবাসী ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে। মোদি, অমিত শাহ কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে অনাকাক্সিক্ষত বাংলাদেশি অভিবাসীদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। অনেক বলার চেষ্টা করেছেন যে এসব কথার কথা। কিন্তু এটা তো সত্য ভারতে, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে এই ‘মুসলমান বিদ্বেষ’ লক্ষ্য করা গেছে। পরিসংখ্যান বলছে পশ্চিমবঙ্গের জনগোষ্ঠীর ২৭ ভাগ হচ্ছে মুসলমান। এই জনগোষ্ঠীর মাঝে ১০ ভাগ আবার উর্দুভাষী। অবশিষ্টরা বাংলাভাষী। উর্দুভাষাীরা মমতাকে পছন্দ করেন। আর বাংলাভাষীরা এতদিন সিপিএম ও কংগ্রেসকে সমর্থন করে আসছিলেন। এদের একটা অংশ ইদানীং মমতার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
মোদি যখন লোকসভা নির্বাচনের আগেও বাংলা ভাষাভাষীদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তখন মমতা এদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। উল্লেখ্য, মমতার পূর্ব পুরুষরা এক সময় যশোরের বাসিন্দা ছিলেন। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে মমতার বাপ-দাদারা কলকাতায় চলে যান। মমতার জš§ কলকাতায়। এখন বিধানসভার নির্বাচনের আগে ‘বাংলাদেশ বিরোধী’ কথাবার্তা, সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করার ঘোষণা সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশে একটি ভুল মেসেজ পৌঁছে দিতে পারে। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, আমরা দেখতে চাই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টিকে পশ্চিম বাংলা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নেবে এবং সমস্যা সমাধানের উদ্যোগী হবে। ঢাকায় মমতা বলে গিয়েছিলেন তার ওপর আমরা যেন আস্থা রাখি। তিনি এও বলেছিলেন দু’দেশের সমস্যার সমাধানে তিনি দ্যুতিয়ালি করবেন। তিনি ঢাকায় নিজেকে ‘কাঠবিড়ালির’ ভূমিকার সঙ্গেও তুলনা করেছিলেন। এখন আমরা দেখতে চাই তিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের স্বার্থে কাজ করেন কি-না? মমতা অত্যন্ত চালাক। তার যেখানে স্বার্থ আছে, কংগ্রেসের সঙ্গেও তিনি সখ্য করেছিলেন। আবার কংগ্রেসকে ছেড়ে আসতেও তার বেশি সময় লাগেনি। বিজেপির সঙ্গেও কেন্দ্রে ছিলেন। আবার বিজেপিকে ছেড়েও এসেছিলেন। বিহারে নিতীশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ভারতব্যাপী একটি মহাজোট গঠনের যে সম্ভাবনার জš§ হয়েছিল মমতার কারণে তা এখন ভেস্তে যেতে বসেছে। তার দলের নেতাকর্মীদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার এন্তার প্রমাণ ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। সর্বশেষ দুর্নীতির খবর কলকাতায় উড়াল সেতু নির্মাণে ধস। যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এই উড়াল সেতুটি নির্মাণ করেছিল তারা অদক্ষতার অভিযোগে অনেক রাজ্যেই নিষিদ্ধ। অথচ এই কোম্পানিটি পশ্চিমবঙ্গে কাজ পেয়েছিল। হয়তো শেষ অবধি তৃণমূল কংগ্রেসই বিজয়ী হবে। কিন্তু এতে করে পশ্চিমবঙ্গবাসীর উপকার কতটুকু হবে এ প্রশ্ন থাকবেই। পশ্চিমবঙ্গবাসী সম্ভবত আরো একবার তার ওপর আস্থা রাখতে যাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতার বিকল্প একমাত্র মমতাই। বিজেপি কিংবা কংগ্রেসের কোনো নেতা নেই যে মমতার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। একমাত্র বামফ্রন্ট পারলেও বামফ্রন্টের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব বাবুর প্রতি মানুষের আস্থা কম। তাই অঙ্কের হিসাব অনুযায়ী মমতাই থেকে যাচ্ছেন। এতে করে তিস্তার পানির বণ্টন হবে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
Daily Manobkontho
11.04.16
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment