তৈরি পোশাকে বাংলাদেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই শিল্প খুব বেশিদিন হয়নি গড়ে উঠেছে। তবে দক্ষতা, নেতৃত্ব, কোয়ালিটি ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশ এই ‘শিল্পে’ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দেখা গেছে বিশ্বে অর্থনীতিতে একটা মন্দাভাব দেখা দিলেও পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে এর প্রভাব খুব একটা পড়েনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ‘হাউজগুলো’ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রেতা। বাংলাদেশ যেমনি সস্তায় তৈরি পোশাক উৎপাদন করতে পারে, ঠিক তেমনি আমাদের পণ্য মানসম্মত। তাই বিশ্বের বড় বড় নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বাংলাদেশে ভিড় করছে। বিশ্বে তৈরি পোশাক উৎপাদনের দিক দিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। তারপরেই বাংলাদেশের স্থান। ভারতের অবস্থান আরো পেছনে। এটা সত্য, চীন এক সময় স্বস্তায় তৈরি পোশাক রফতানি করতো। এখন চীনে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায় না। শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। ফলে চীন এখন আর আগের মত স্বস্তায় তৈরি পোশাক উৎপাদন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। সে জন্যই বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে বাংলাদেশের আগ্রহ বাড়ছে। এখন এই শিল্পে যদি অস্থিরতা, কিংবা বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশী পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস করা যায়, তাহলে অন্য একটি ‘পক্ষ’ এ থেকে সুবিধা নিতে পারবে। আন্তর্জাতিক আসরে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে ভারত, ভিয়েতনাম আমাদের প্রতিপক্ষ। তারা এখন এ বাজারটি ‘দখল’ করে নিতে পারবে।
বৈদেশিক আয়ের একটা অন্যতম উৎস হচ্ছে এই তৈরি পোশাক। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এক হাজার ৯০০ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ। এখন নিশ্চিন্তপুরের ঘটনায় রফতানির ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা আসতে পারে। বাংলাদেশ শতকরা ১৫ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করেই প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে একটি বাজার পেয়েছে। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস) সুবিধা চাইছে। জিএসপি হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া শুল্ক সুবিধা। বাংলাদেশসহ ১২৮টি দেশ এই সুবিধার আওতায়। যদিও তৈরি পোশাক এই সুবিধা পায় না। সিরামিক, সার ইত্যাদি ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা পায় বাংলাদেশ। আমেরিকার শ্রমিক সংগঠনগুলোর ফেডারেশন এএফএল-সিআইও দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জেএসপির সুবিধার বিরোধিতা করে আসছে। তাদের অভিযোগ বাংলাদেশের ইপিজেড, তৈরি পোশাক এবং চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত খাতে শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও নেই। তৈরি পোশাকের কারখানাগুলোতে ‘কমপ্লাইয়েন্স’ ইস্যুতে আমেরিকার ‘বায়ার’রা সোচ্চার। ‘কমপ্লাইয়েন্স’ এর অর্থ হচ্ছে ফ্যাক্টরীগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সেই সাথে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা। বিশুদ্ধ খাবার পানি থেকে শুরু করে কারখানাগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা এর অন্তর্ভুক্ত। ‘বায়ার’দের প্রতিনিধিরা সরাসরি কারখানাগুলো পরিদর্শন করেন এবং ‘কমপ্লাইয়েন্স’ এর ব্যাপারে তারা সন্তুষ্ট হলেই তারা অর্ডার দেন। ফলে যারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা করতে চায়, তারা সঙ্গত কারণেই ‘কমপ্লাইয়েন্স’-এর ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। শ্রমিকদের স্বার্থ তারা দেখার চেষ্টা করেন। এখন নিশ্চিন্তপুরের ঘটনায় প্রমাণ হয়ে গেল, কারখানাগুলোতে ‘কমপ্লাইয়েন্স’-এর ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি আমেরিকার লেবার সংস্থা অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টিকে ইস্যু করবে এবং বাংলাদেশী পণ্যের আমদানিতেও তারা বাঁধা দেবে। জিএসপি সুবিধা পাবার সম্ভাবনাও এখন ক্ষীণ। আমি জানি না, এই ভাবমূর্তি আমরা কীভাবে ফিরিয়ে আনবো। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিন্তপুরের ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ ও ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যদিও কোনো এক পত্রিকায় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তার বক্তব্যও ছাপা হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী যখন ‘পরিকল্পিত’ ও ‘ষড়যন্ত্র’র কথা বলেন, তখন আমার ভয় হয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে ৫টি কমিটি গঠন হয়েছে, তাদের পক্ষে প্রকৃত ‘সত্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে কী না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিশ্চয়ই ‘পরিকল্পনা’ ও ‘ষড়যন্ত্রের’ যথেষ্ট তথ্য আছে। আমরা খুশি হবো তিনি যদি তা জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করেন। আমাদের এই সেক্টরটি নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ হবে, তা আমরা চাই না। কঠোর হস্তে এই ‘ষড়যন্ত্র’ দমন করা প্রয়োজন।
আমি তাজরিন গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই দায়ী করবো। প্রতিটি ফোরের গেটে তালা দেয়া, আগুন দেখেও সেটা মহড়া হিসেবে আখ্যায়িত করা, কর্মকর্তাদের পালিয়ে যাওয়া, কোম্পানির ৫০ কোটি টাকার ঋণ, বিমার টাকা ইত্যাদি নানা প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য গার্মেন্টসে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নতুন নয়। যখনই মানুষ মারা যায়, তখনই সরকার ‘ষড়যন্ত্রের’ কথা বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে তৎপর হতে দেখা যায়, তারপর যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যায়। আমাদের শ্রমমন্ত্রী হঠাৎ করেই উৎসাহী হয়ে গেলেন। বললেন, প্রতিটি কারখানায় তিনটি করে বহির্গমন থাকতে হবে। না হলে ওই কারখানা বন্ধ করে দেয়া হবে। প্রায় ৪ হাজার কারখানা বাংলাদেশে। অবিলম্বে সার্ভে টিম করে কারখানাগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের চূড়ান্ত সময়সীমা দেয়া হোক প্রয়োজন হলে বন্ধ করে দেয়া হোক। আমাদের গার্মেন্টস কর্মীরা ‘ফার্মের মুরগী’র মত ব্যবহৃত হতে পারে না। তাদের ‘কারখানায় ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়া ফৌজদারী অপরাধ। বিজিএমইএও এই কাজটি করতে পারে নিয়মিত। যেখানে তালা মারা থাকবে, ওই কোম্পানিকে বিজিএমইএ কয়েক লাখ টাকা ফাইন করবে।
এত বড় একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। মৃত্যুর মূল্য এক লাখ টাকা হতে পারে না। সরকারও সাহায্য করুক। বায়াররাও সাহায্য করছে। যারা মারা গেছেন, তাদের পরিবার যেন এ টাকা পায়- এটা নিশ্চিত করা হোক। তাজরিন ফ্যাশনের জন্য পুরো তৈরি পোশাক শিল্প একটা ঝুঁকির মুখে থাকতে পারে না। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে আমরা ‘বায়ার’দের তথা আমেরিকার শ্রমিক সংগঠনের আস্থা অর্জন করতে পারি। তাজরিন ফ্যাশনের মালিক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গ্রেফতারেরও দাবি করছি। সেই সাথে ‘কমপ্লাইয়েন্স’ ব্যবস্থা সব ফ্যাক্টরীতে বাস্তবায়ন করারও দাবি করছি। বিরোধী পক্ষকে দায়ী করে বক্তব্য দিলে তাতে করে মূল ঘটনা ‘চাপা’ পড়ে যাবে। ‘ষড়যন্ত্র’কারীরা আরো শক্তিশালী হবে। আর বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি আরো নষ্ট হবে।
0 comments:
Post a Comment