পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক ফিরে আসুক বা না আসুক সেটা ভিন্ন প্রশ্ন; কিন্তু বিশ্বব্যাংক যেসব প্রকল্পে সাহায্য দিচ্ছে, তার কী হবে?
মোট ৩৪টি প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে পদ্মা সেতুতে অর্থ সহায়তার পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার। এখন পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় অন্যান্য প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়করণে কিছুটা শ্লথগতি আসে। বিদায়ী অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৫০ কোটি ডলার। অথচ বিশ্বব্যাংক প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলার সহায়তা বাড়ানোর কথা বলেছিল। পদ্মা সেতু ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থাটি হতাশা প্রকাশ করেছে, সেগুলো হচ্ছে ঢাকা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প (১৪৯ মিলিয়ন ডলার, শুরু ২০০৯ সালে), সামাজিক বিনিয়োগ প্রকল্প-২ (১১৫ মিলিয়ন ডলার), উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি প্রকল্প (৮১ মিলিয়ন ডলার), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প, সিদ্ধিরগঞ্জ পিকিং পাওয়ার প্লান্ট, বিশুদ্ধ বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্প, ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন প্রকল্প, ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক প্রকল্প, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প, সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থ ছাড়করণের পরিমাণ খুবই কম। দুর্নীতি ছাড়াও অদক্ষতা, কাজে শ্লথগতির কারণেও বিভিন্ন সময় বিশ্বব্যাংক অভিযোগ উত্থাপন করেছে। হাইটেক পার্কে চলাচলের সুবিধার জন্য ঢাকা-কালিয়াকৈর শাটল রেলপথ নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক ৫৫০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। একটি এমওইউ স্বাক্ষরিতও হয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পের অর্থায়নও স্থগিত করেছে। এখন কোনো প্রকল্পেই বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় দিচ্ছে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার \'লেভারাইজিং আইসিটি ফর গ্রোথ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স\' প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এতে ৩০ হাজার মানুষকে প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে। এ পরিকল্পনায় সরকারের সঙ্গে ৫০৯ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য দেওয়ার একটি চুক্তি সই করেছিল বিশ্বব্যাংক। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এ প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং গত ফেব্রুয়ারি মাসে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা। এখন জটিলতা তৈরি হওয়ায় এ প্রকল্পটিও ঝুলে গেল। অথচ ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এ প্রকল্পের খুবই প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই আইসিটি ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বিশ্বে খুব ভালো নয়। ইউএনডিপি বিশ্বব্যাপী আইসিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের র্যাংকিং বা তালিকা করে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ নম্বরে। এ তালিকা আরও উন্নত করতে হলে ইন্টারনেট কানেকটিভিটি খুবই দরকার। কিন্তু এ কানেকটিভিটি কাজে লাগাতে দরকার প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, যা আমরা ওই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করতে পারতাম। এখন আমরা ওই প্রকল্প নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলাম।
বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিয়ে অনেক কথা আছে। গরিব দেশ বলে বিশ্বব্যাংক বিনা সুদে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য দেয় না। সুদে-আসলে তা তুলে নেয়। বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়েই নিজেরা টিকে আছে। তবে তুলনামূলক বিচারে তাদের সুদের পরিমাণ কম এবং পরিশোধের সময়সীমাও দীর্ঘ। যেমন পদ্মা সেতুতে তাদের সুদের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৭৫ ভাগ। অন্যদিকে মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোনো বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে সেতু নির্মিত হলে সুদের হার হবে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। উপরন্তু দীর্ঘ সময় তাদের টোল আদায়ের সুযোগ দিতে হবে। আর ঋণের টাকা তুলতে তারা অতিরিক্ত টোল আদায় করবে, যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে কথা থাকলেও সহজলভ্যতা ও সুদের হার কম হওয়ায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে ১ হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থায়ন করেছে। এখন পর্যন্ত এ সংস্থার ১ হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে ৩৪টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের মোট ৪৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। যদিও খুব কম ক্ষেত্রে এবং বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে বিশ্বব্যাংক সাধারণত অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় না। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে_ সন্দেহ নেই। এতে বাকি প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও সরকারের আচরণের ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। আমরা বিশ্বব্যাংককে যত বেশি সমালোচনা করব, তত তিক্ততা সৃষ্টি হবে। তা ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না।
বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয়টি এখন বিশ্ব আসরে আলোচনার অন্যতম বিষয়। গত ৬ ডিসেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতি বিষয়ক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্টে দুর্নীতিতে ২৪ ধাপ অবনতির কথা বলা হয়েছে। টিআইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৩। টিআইর রিপোর্টটি এলো এমন এক সময়ে, যখন পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দুদকের আলোচনা ভেস্তে গেল। দুদকের কাছে ব্যক্তি আবুল হোসেন প্রাধান্য পেল; প্রাধান্য পেল না দেশের স্বার্থ। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক দলের নাখোশ হয়ে ফিরে যাওয়া বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উদ্ধারে কোনো সাহায্য করবে না। বৈদেশিক সাহায্য, বিনিয়োগ, জিএসপি সুবিধা_ অনেক কিছুই এখন নির্ভর করে দেশটি কতটুকু দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পারছে তার ওপর। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। দেশটির সম্ভাবনা আছে; কিন্তু দুর্নীতির কারণে আমাদের সব অর্জন ও সম্ভাবনার মৃত্যু হতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক টিমের হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়া আমাদের জন্য আগামীতে কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না।
Daily Manobkontho
23.12.12
0 comments:
Post a Comment