রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আস্থাহীনতার রাজনীতি


আমাদের জাতীয় নেতাদের মাঝে আস্থাহীনতা কত প্রকট, বিজয়ের একচল্লিশ বছর পার করার পর সেটা আবারও প্রমাণিত হল। হরতালের সময় মারা গেলেন বিশ্বজিৎ দাস। যারা তাকে কুপিয়ে হত্যা করল, তারা ছাত্রলীগের কর্মী, হোক না বহিষ্কৃত। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে জল ঘোলা হল অনেক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা বললেন, হত্যাকারীরা অনুপ্রবেশকারী, কেউ কেউ শিবিরের সমর্থক! নিজেদের দোষ আমরা কেউ স্বীকার করতে চাই না। ছাত্রলীগের সবাই যে সৎ ছেলে, তা তো নয়। কিন্তু কী অবলীলায় আমাদের নেতারা বলে ফেললেন, বিশ্বজিতের হত্যাকারীরা শিবির কর্মী! দোষ স্বীকার করলে তো ক্ষতি ছিল না। কিন্তু আমরা দোষ চাপালাম বিরোধী পক্ষের ওপর। বিজয়ের একচল্লিশ বছর পার করার পরও দেখতে হল আমাদের রাজনীতিকরা সত্য কথা বলেন না। মতিয়া চৌধুরীকে আমি শ্রদ্ধা করি। সৎ ও ত্যাগী। রাজনীতির জন্য তিনি সবকিছুই ত্যাগ করেছেন। তিনি কিনা বললেন, ‘বেগম জিয়া জামায়াতের মহিলা আমীর’! এ কথাটা সাধারণ একজন কর্মীর মুখ থেকে শুনলে আমি অবাক হতাম না। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি যদি হন মতিয়া চৌধুরী, আমি অবাক হই। তিনি মন্ত্রী। এক সময়ের জঙ্গি নেত্রী, ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। আমরা যখন মধ্য সত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি, ততদিনে ছাত্র ইউনিয়ন ভাগ হয়ে গেছে। যারা মতিয়াপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, তারা ছিলেন ভদ্র, নম্র। ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থকদের আমরা কখনও উগ্র আচরণ করতে দেখিনি। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তার সেই বিখ্যাত ‘ডুগডুগি তত্ত্ব’ আজও স্মরণ করেন কেউ কেউ। সেই মতিয়া চৌধুরী কালের পরিক্রমায় ‘সমাজতান্ত্রিক নীতি’ পরিত্যাগ করে মার্কিন রাজনীতি ঘেঁষা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে মিশে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম তার উত্থান। বেগম জিয়ার রাজনীতি তার পছন্দ হবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে কি তাকে ‘জামায়াতের মহিলা আমীর’ বলা ঠিক হবে? এ সংস্কৃতি কবে আমরা বদলে ফেলতে পারব? নতুন যে জেনারেশন নেতৃত্বে আসছেন, তারা কী শিখছেন সিনিয়র নেতাদের কাছ থেকে? একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ হচ্ছে! একচল্লিশ পার করলাম। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উন্নতি করতে পারলাম না এতটুকুও!
হরতাল হতেই পারে। আগেও হয়েছে। ধারণা করছি আগামীতেও হবে। কিন্তু তাই বলে সহিংসতা কেন? কেন এ হত্যা? একজন বিশ্বজিতের খবর সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু এর আগেও হরতালে সহিংসতায় মানুষ মারা গেছে। মানুষ হত্যা বন্ধ হয়নি। উš§ত্ততা বন্ধ হয়নি। ওইদিন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সাবেক এমপি নাজিমউদ্দিন আলমের রক্তাক্ত ছবিও। কপাল ভালো, গুলিতে তিনি আহত হয়েছেন। মারা যাননি। জজকোর্ট এলাকায় বিশ্বজিৎ দাসের মতো তিনি মারা যেতে পারতেন! জনাব আলম শীর্ষ নেতা বিএনপির। তাকে পুলিশ চিনবে না, কিংবা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাকে চিনবে নাÑ এটা আমি বিশ্বাস করি না। তাকে চিনেই তার ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য একটাইÑ নৈরাজ্য সৃষ্টি করা, একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে করে মানুষ প্রতিবাদী না হয়, রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ না করে।
যারা বিশ্বজিতকে হত্যা করেছে, তাদের নাম-ধাম ও ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। যারা গুলিতে নাজিমউদ্দিন আলমকে আহত করেছে, তারাও সবাই পরিচিত। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে পুলিশ অভিযুক্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার করেছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও। সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনা পরিবহনের গাড়ি নাকি তিনি ভাংচুর করেছেন! মির্জা ফখরুলের মতো সিনিয়র নেতা গাড়ি ভাঙবেন! এ ‘সংস্কৃতি’ আমরা আগেও দেখেছি। গাড়ি পোড়ানো, গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে আগেও মামলা হয়েছিল। তিনি তখন জেলও খেটেছিলেন। আবারও জেলে গেলেন। এর মধ্য দিয়ে সরকার একটি ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ তৈরি করেছে। কিন্তু এসব করে কি সরকার পার পাবে? সরকার এরই মধ্যে তার সমর্থকদের মাঠে নামিয়েছে। বিরোধী দলের প্রতি একটা পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ প্রবণতা ভালো নয়। এ প্রবণতা সহিংসতা বাড়াবে মাত্র। ঢাকা সফররত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেকও এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
এই যে আস্থাহীনতার রাজনীতি, এই রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমরা দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। কিন্তু কেউ আমরা বলছি না, যে রাজনীতির মধ্য দিয়ে আমরা বিজয়ের একচল্লিশ বছর পার করলাম, সেই রাজনীতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আমরা সে লক্ষ্যে কোনদিনই পৌঁছতে পারব না। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বিএনপি একটি শক্তি। ৯ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশ, ১১ ও ১৩ ডিসেম্বরের হরতাল তারাই ডেকেছিল। তথাকথিত ১৮ দলীয় জোটের শরিকরা তাদের সঙ্গে আছে। একমাত্র জামায়াত বাদে কারোরই কোন শক্তি নেই। দুটি বড় দলই এ জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুটি জোটের বাইরে তৃতীয় একটি জোট গঠনের কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে। ১৭ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকের খবর ছিল এটি। ওই খবরে বলা হয়েছে, ৪টি দল খুব শিগগিরই একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছে। এ চারটি দল হচ্ছে অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারা, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং আসম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি। খবরটি শীর্ষ সংবাদ হিসেবে ছাপা হলেও বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। এ চারটি দলই ব্যক্তিসর্বস্ব দল। অধ্যাপক চৌধুরী সৎ ও গুণী ব্যক্তি, সন্দেহ নেই তাতে। ১৮ দলীয় জোটে যোগ না দিলেও যুগপৎ আন্দোলনে তাদের সঙ্গে আছেন। ব্যক্তি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছাড়া বিকল্প ধারার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন বড় জোট ছাড়া তিনি নিজে কিংবা তার ছেলে মাহি চৌধুরী আদৌ বিজয়ী হতে পারবেন কিনা সন্দেহ। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর এখন রাজনীতি থেকে অবসর নেয়া উচিত। তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার তো আর কিছু পাওয়ার নেই। তিনি নিশ্চয় ‘মোহাম্মদ উল্লাহ’ স্টাইলে আবার ভবিষ্যতে কোন মন্ত্রী হবেন না। তিনি জাতির অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেই ভালো করবেন। ড. কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে ভালো লোক, সৎ এবং আন্তর্জাতিক সম্মান তার রয়েছে। তার নিজের সংসদীয় কোন আসন নেই। একবারই (১৯৭৩) বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া আসনে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তারপর আর তাকে সংসদে দেখা যায়নি। তার দল ছোট, তাও ভেঙে গেছে। এই দল নিয়ে কারও সঙ্গে যাওয়া কী না যাওয়ায় কিছু যায় আসে না। ব্যক্তি কামাল হোসেন তৃতীয় ধারার প্রবক্তা। কিন্তু দুঃখ এটাই তাতে জনগণের তেমন সাড়া নেই। তার মতো একজন গুণী লোক কেন একটি ‘গণজোয়ার’ সৃষ্টি করতে পারলেন না, এটা আমি ভেবে পাই না। তার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে তিনি নিজেই নষ্ট করেছেন। ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে তিনি কখনও গেছেন, এটা কেউ বলতে পারবে না। এমনকি এই খোদ ঢাকা শহরে তিনি কখনও গণসংযোগে বেরিয়েছেন, তাও কেউ বলতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি সোচ্চার হন। তার কর্মকাণ্ড অনেকটা সেমিনার অর্থাৎ প্রেস ক্লাবভিত্তিক। বেইলী রোড থেকে তিনি গণফোরামকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারেননি। এক সময়ের তুখোড় বক্তা ও জাসদ নেতা আসম আবদুর রব এখন ক্ষুদ্র জেএসডি নিয়ে আছেন। মূলধারা চলে গেছে ইনুর হাতে। জাসদ নিয়ে তার মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। একবার বলেন, জাসদকেন্দ্রিক রাজনীতি তিনি করেন না, কিন্তু সেই জাসদকে (জেএসডি) তিনি ছাড়তেও পারেন না। তার একটা সম্ভাবনা ছিল। সেই সম্ভাবনাকেও তিনি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যক্তি হিসেবে মানুষ তাকে চেনে। কিন্তু দলকে কেউ চেনে না। সংসদীয় আসনে তার একটা অবস্থান আছে। কিন্তু প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। কোন বড় দলের সমর্থন না পেলে তার পক্ষে সংসদে ফিরে আসা কষ্টকর। পারবেন না। আওয়ামী লীগবিরোধী ভূমিকার কারণে তিনি সুপরিচিত। নির্বাচনে জিততে হলে তাকে তাকাতে হবে বিএনপির দিকে। তৃতীয় ধারা তার বিজয়কে নিশ্চিত করবে না। কাদের সিদ্দিকীও ব্যক্তিনির্ভর দলের প্রধান। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নাম মানুষ যতটুকু না জানে, তার চেয়েও বেশি জানে ও চেনে কাদের সিদ্দিকীকে। দলেও তিনি পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছেন, যদিও তিনি রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের বিরোধিতা করেন।
এদের এ চারজনের সমন্বয়ে কী হবে? সংসদীয় রাজনীতিতে এসব দলের আদৌ কি কোন ভূমিকা আছে? সংসদীয় আসনে জিততে হলে এদের হয় আওয়ামী লীগ, নতুবা বিএনপির ওপর নির্ভর করতে হবে। কাদের সিদ্দিকী সংসদে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তা একবার সম্ভব হয়েছিল বিএনপির সমর্থন তথা আসন ছেড়ে দেয়ার কারণে। আগামীতে তিনি কি জিততে পারবেন? মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে তাকে আবারও বিএনপির সমর্থন নিতে হবে। তৃতীয় ধারার কথা বলে তিনি এ সমর্থন নিশ্চিত করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির একটি ভূমিকা লক্ষ্য করার বিষয়। উত্তরবঙ্গনির্ভর এ দলটির এলাকাভিত্তিক সমর্থন রয়েছে। এরশাদ নয়াদিল্লি ঘুরে এসে বলেছেন, তিনি এককভাবে নির্বাচন করবেন। তিনি যদি আলাদাভাবে নির্বাচন করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তার দল একটি ফ্যাক্টর। তবে বড় দল দুটিÑ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মূল দুটি ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিকল্প তৃতীয় ধারা নয়, বরং আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপিই। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দুটি বড় দলের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে আস্থাহীনতা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা শুনি ‘অমুক’ দল পাকিস্তানের দালাল, আর ‘তমুক’ দল ভারতের দালাল। ১৫ ডিসেম্বর বিটিভিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকেও বের হল ‘পাকিস্তানি দালালের’ কথা।
পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা স্থাপনটা জরুরি। এটা না হলে বিজয় দিবস পালন কিংবা স্বাধীনতা দিবস পালন মূল্যহীন হয়ে যাবে। বিজয়ের বিয়াল্লিশ বছরে পা দিলাম। আর কত আমরা লিখব? শুভবুদ্ধির উদয় হোক। তবে হ্যাঁ, নতুন প্রজšে§র ওপর আমার আস্থা আছে। এরাই পারবে এ দুই শক্তির মাঝে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ইতিহাস তো তাই বলে।
Daily JUGANTOR
19.12.12

1 comments:

  1. Confidence building on each other is possible as both the party are now eager for maintaining or gaining India's blessings to remain or gain power.
    People have no interest or benefit in such confidence building. People are rather more interested to see ideological difference between these two major political parties.

    Because of the serious violation of the rule of law, gross disrespect towards democratic norms and tyranny on the opposition with a vow of elimination, surrendering of national interests including leasing of country's territory for corridor of another aggressive country,

    ReplyDelete