রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি


আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ড এবং ১১১ জন শ্রমিকের মৃত্যুতে আমাদের পোশাকশিল্প শুধু যে অনিশ্চয়তার মুখেই থাকল, তা নয়; বরং বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তিও নষ্ট হলো। বিশ্বে তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। চীন প্রথম হলেও চীনে শ্রমিক মজুরি বাড়ছে এবং চীন এখন আর তৈরি পোশাকে উৎসাহিত হচ্ছে না। চীন এখন আইটি তথা মাঝারি শিল্পে মনোনিবেশ করছে। এমনকি এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল যে চীন তার পোশাক শিল্প বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে পারে। এখন নিশ্চিন্তপুরের 'হত্যাকাণ্ড' পুরো শিল্পকে একটি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিল। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বড় বাজার, সেই বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এক হাজার ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বাজার যুক্তরাষ্ট্রে। স্পষ্টতই পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে বাংলাদেশ এই বাজার হারাবে। এরই মধ্যে ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে তার তৈরি পোশাক ক্রয় বাতিল করেছে। কেননা নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন গার্মেন্ট ওয়ালমার্টকে বিশেষ ধরনের পোশাক সরবরাহ করত। এটা বন্ধ হয়ে গেল। এটা অন্যদের ক্ষেত্রেও একটা প্রচ্ছন্ন 'হুমকি'। নিশ্চিন্তপুরের 'হত্যাকাণ্ডের' সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম কিংবা ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরামের মতো সংগঠন তৎপর হয়েছে, এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টও একটি মন্তব্য করেছে। তারা স্পষ্ট করেই বলছে, পোশাক শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের জন্য একটি 'মেসেজ'- পোশাকশিল্প স্পষ্টতই ঝুঁকির মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে যেসব মানবাধিকার সংস্থা কাজ করে, তারা ওয়াশিংটনে এক ধরনের 'লবিস্ট' হিসেবে কাজ করে। কংগ্রেসম্যানদের তারা বাধ্য করে আইন প্রণয়ন করতে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তৈরি পোশাক শিল্পে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা চেয়ে আসছে। বাংলাদেশ এই সেক্টরে এ সুবিধা পায় না। কিছু কিছু সেক্টর, যেমন সিরামিক, সার, ফার্নিচার ইত্যাদি শিল্পে জিএসপি সুবিধা পায়। তৈরি পোশাকে পায় না। ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে প্রবেশ করছে। গুণগতমান ও সস্তা থাকায় বাংলাদেশি এ পণ্যের বড় বাজার রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এখন এই জিএসপি সুবিধাও প্রশ্নের মুখে থাকল। আমি আশঙ্কা করছি, মার্কিন শ্রমিক সংগঠন তথা শ্রমিকস্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর 'চাপে' কংগ্রেসে একটি আইন প্রণীত হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা হতে পারে। এটা হলে বাংলাদেশের জন্য তা হবে এক ধরনের 'আত্মহত্যার শামিল'। কেননা আমাদের অর্থনীতিতে পোশাকশিল্প একটা বড় অবদান রাখছে। ইউরোপের অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করায় সেখানে বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না, এমনকি সেখান থেকে 'অর্ডার'ও কমে আসছে। ফলে শিল্প বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা যদি হ্রাস পায়, তা আমাদের অর্থনীতির জন্য হুমকি। তৃতীয়ত, 'কমপ্লায়েন্সে'র যে সুযোগ-সুবিধা মার্কিন ক্রেতারা দাবি করছে, তা নিশ্চিন্তপুরের ঘটনার পর আরো শক্তিশালী হবে। কমপ্লায়েন্সের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ওপর জোর দেবে। শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে তারা চাইবে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। বিশুদ্ধ খাবার পানি থেকে শুরু করে কারখানাগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা এর অন্তর্ভুক্ত। 'বায়ার'দের প্রতিনিধিরা সরাসরি কারখানাগুলো পরিদর্শন করবেন এবং কমপ্লায়েন্সের ব্যাপারে তাঁরা সন্তুষ্ট হলেই তাঁরা অর্ডার দেবেন। ফলে যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়, তাঁরা সংগত কারণেই কমপ্লায়েন্সের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হবেন। শ্রমিকদের স্বার্থ তাঁরা দেখার চেষ্টা করবেন। এখন নিশ্চিন্তপুরের ঘটনায় প্রমাণিত হয়ে গেল, কারখানাগুলোতে কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, আমেরিকার লেবার সংস্থা অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টিকে ইস্যু করবে এবং বাংলাদেশি পণ্যের আমদানিতেও তারা বাধা দেবে। জেএসপি সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনাও এখন ক্ষীণ। আমি জানি না, এই ভাবমূর্তি আমরা কিভাবে ফিরিয়ে আনব। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিন্তপুরের ঘটনাকে 'পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে কোনো এক পত্রিকায় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তার বক্তব্যও ছাপা হয়েছে। তিনি বলছেন, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী যখন 'পরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রের' কথা বলেন, তখন আমার ভয় হয়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে পাঁচটি কমিটি গঠিত হয়েছে, তাদের পক্ষে প্রকৃত 'সত্য' উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে কি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিশ্চয়ই 'পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের' যথেষ্ট তথ্য আছে। আমরা খুশি হব, তিনি যদি তা জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করেন। আমাদের এ সেক্টর নিয়ে 'ষড়যন্ত্র' হবে, তা আমরা চাই না। কঠোর হস্তে এ 'ষড়যন্ত্র' দমন করা প্রয়োজন।
আমি তাজরীন গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই দায়ী করব। প্রতিটি ফ্লোরের গেটে তালা দেওয়া, আগুন দেখেও সেটাকে মহড়া হিসেবে আখ্যায়িত করা, কর্মকর্তাদের পালিয়ে যাওয়া, কম্পানির ৫০ কোটি টাকার ঋণ, বীমার টাকা ইত্যাদি প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, গার্মেেন্ট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নতুন নয়। যখনই মানুষ মারা যায়, তখনই সরকার 'ষড়যন্ত্রের' কথা বলে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে তৎপর হতে দেখা যায়। তারপর যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যায়। আমাদের শ্রমমন্ত্রী হঠাৎ করেই উৎসাহী হয়ে গেলেন। বললেন প্রতিটি কারখানায় তিনটি করে বহির্গমন পথ থাকতে হবে, না হলে ওই কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। প্রায় চার হাজার কারখানা বাংলাদেশে। অবিলম্বে সার্ভে টিম করে কারখানাগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের চূড়ান্ত সময়সীমা দেওয়া হোক। প্রয়োজন হলে বন্ধ করে দেওয়া হোক। আমাদের গার্মেন্টকর্মীরা 'ফার্মের মুরগির' মতো ব্যবহৃত হতে পারে না। তাদের 'কারখানায় ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দেওয়া' ফৌজদারি অপরাধ। বিজিএমইএও কাজটি করতে পারে নিয়মিত। যেখানে তালা মারা থাকবে, ওই কম্পানিকে বিজিএমইএ কয়েক লাখ টাকা ফাইন করবে।
এত বড় একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, আশুলিয়ায় শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় কিংবা রাষ্ট্রদূত মজিনার একাধিক বক্তব্যে এ হত্যাকাণ্ডের কথা উঠে এসেছে। সেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আজও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো নিশ্চিন্তপুরের দুর্ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র 'টিফফা' চুক্তি নিয়েও আমাদের 'চাপ' দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে তারা বলছে, এতে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি হবে। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন' (এমসিপি) গঠিত হলেও আজও বাংলাদেশ সেখান থেকে কোনো সাহায্য পায়নি। অথচ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্যই এ সংস্থা গঠিত হয়েছিল। এখন নিশ্চিন্তপুরের ঘটনার পর এমসিপি থেকে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
নিশ্চিন্তপুরের 'দুর্ঘটনা' আমাদের জন্য অনেক শঙ্কা তৈরি করেছে। সরকার ও বিজিএমইএ যদি যৌথভাবে কাজ না করে, তাহলে আমাদের পোশাকশিল্প একটি বড় হুমকির মুখে থাকবে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে প্রথমে।Daily KALERKONTHO06.12.12

0 comments:

Post a Comment