রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে বিএনপি







বিএনপি তথা ১৮ দল কর্তৃক আহূত ৯ ডিসেম্বর রাজপথ অবরোধের পর যে প্রশ্নটি আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এরপর কী? ১৮ দলীয় জোট ঢাকার রাজপথ অবরোধের ডাক দিয়েছিল কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দাবিকে সামনে রেখে— অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল। সে সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতি, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধে সরকারের ব্যর্থতা। এসব দাবি-দাওয়ার পেছনে সাধারণ মানুষের সমর্থন কতটুকু আছে কিংবা দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সরকারের ব্যর্থতা কতটুকু, এটা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা এখন অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম বিষয়। আমরা বারবার বলে আসছি, বিএনপির অতীত যা-ই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিতে হলে সরকারকে বিএনপির সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতেই হবে। এ সমঝোতার ধরন যা-ই হোক না কেন, বিএনপিকে আস্থায় নিতে না পারলে দেশের রাজনৈতিক সংকট আরও গভীরতর হবে। বিএনপি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদীয় ভাষায় যিনি ‘ছায়া প্রধানমন্ত্রী’। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (ডিসেম্বর, ২০০৮) বিএনপির ভরাডুবি দলকে ক্ষমতার বাইরে ঠেলে দেয়। কিন্তু মাত্র ৩০টি আসন পাওয়া বিএনপিকে যদি সেই বিবেচনায় বিচার করা হয়, তাহলে সেটা হবে আমাদের জন্য বড় ভুল। কেননা এ নির্বাচনেও বিএনপি ৩২ দশমিক ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর চারদলীয় জোটকে যদি বিবেচনায় নিই, তাহলে ৩৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে এ জোটের পেছনে। এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা— এ ৩৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না।
গত প্রায় এক বছর বিএনপির রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে, তা হচ্ছে বিএনপির রাজনীতিতে কোনো ‘হঠকারিতা’ লক্ষ করা যায়নি। অর্থাৎ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলেও বিএনপি বারবার হরতাল দেয়নি। হরতাল দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতি করে। বিদেশীদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। দাতারা বেশকিছু দিন ধরেই হরতালের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই কথা বলে আসছে। ধারণা করছি, বিএনপি দাতাগোষ্ঠীর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর স্বার্থেই হরতালের মতো কোনো কর্মসূচি দেয়নি। তবে বেগম খালেদা জিয়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, তিনি প্রয়োজনে লাগাতার হরতালও দিতে পারেন। স্পষ্টতই এটা একটা হুঁশিয়ারি। এ জন্যই আমরা বারবার একটা সমঝোতার কথা বলছি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এ সমঝোতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেগম খালেদা জিয়া এরই মধ্যে তার ও দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি চীন ও ভারত সফর করেছেন। সেখানে তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে একটি ‘বিকল্প নেতৃত্ব’ তিনি এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। ভারত সফরের মাধ্যমে তিনি তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের পানি সমস্যা তুলে ধরেছেন। সমমর্যাদার কথা বলেছেন। ভারতের আচরণে সেই সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা হয়নি। দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশ ভারতীয় ‘বাণিজ্যনীতি’র ফাঁদে আটকা পড়ে আছে অনেক দিন ধরে। অর্থাৎ ভারতীয় বাণিজ্যনীতি এমন যে, একটি বড় ধরনের বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, যা ভারত ব্যবহার করছে নিজের স্বার্থে। ভারত তথাকথিত বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার কথা ঘোষণা করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের রফতানি আয় কমে গেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ রফতানি করেছে মাত্র ৪৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের পণ্য (আগের বছরের আয় ৫১ কোটি ২৫ লাখ ডলার)। এতে দেখা যায়, রফতানি আয় কমেছে (কালের কণ্ঠ, ১৮ জুলাই, ২০১২)। গেল বছর ৬-৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরের সময় ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, ভারত অশুল্ক বাধা দূর করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বেগম খালেদা জিয়া ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে স্পষ্ট করলেন অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। এতে বাংলাদেশ তার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারবে। তৃতীয়ত. বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। একতরফাভাবে ভারতীয় বিএসএফ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। এ হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। পৃথিবীর কোনো সীমান্তে এভাবে মানুষ মারা হয় না। এ সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে ভারতকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে— বেগম খালেদা জিয়া এ ‘মেসেজ’ পৌঁছে দিলেন ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে। চতুর্থত. খালেদা জিয়া ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর, সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিতকরণের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী অনেক আগেই ছিটমহল সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ভারত তা করেনি। খালেদা জিয়া দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের জনগণের কথা তুলে ধরেছেন। পঞ্চমত. বাংলাদেশের দুর্বল ও ভারতঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির সুযোগে দেশটি বাংলাদেশের কাছ থেকে সুকৌশলে ট্রানজিটের নামে করিডোর সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, বহুপক্ষীয়ভাবে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান অনুরূপ সুবিধা পাবে। বাংলাদেশের জন্য চীন-নেপাল-ভুটানের যে সংযোগ ভারতের ওপর দিয়ে যাবে, তা ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে কম। সুযোগটি বাংলাদেশ পায়নি, এমনকি ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের মাত্র ২৫ কিলোমিটার স্থল সংযোগে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ভারত আমাদের সে সুযোগ দেয়নি। অথচ আমরা এককভাবে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতের ২৮ চাকার ভারী গাড়ি পারাপারের সুযোগ করে দিয়েছি। এ জন্য ভারত আমাদের কোনো ট্রানজিট ফিও দেয়নি। সাধারণ মানুষের মনোভাব আজ খালেদা জিয়াকে তুলে ধরতে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভারত নিজ স্বার্থে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের পথরেখাটি নিজের সুবিধামতো আদায় করে নিয়েছে। ভারতের এ এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের পথরেখাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢুকে ঢাকা ও সিলেট হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় প্রবেশ করবে। পথটি ভারতের জন্য অনুকূল হলেও বাংলাদেশের জন্য দুর্গম, বেশি দূরত্বের এবং অনিরাপদ হওয়ায় এটি বাংলাদেশের জন্য মোটেই লাভজনক নয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-টেকনাফ-সিত্তোই-আকিয়াব-ইয়াঙ্গুনগামী পথটি বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যের গন্তব্যগুলোয় স্থল যোগাযোগের জন্য (সড়ক ও রেলপথ) কম দূরত্ব ও কম দুর্গম এবং নিরাপদ হওয়ায় এশিয়ান হাইওয়ের যে পথ আমরা বেছে নিয়েছি, তাতে আমাদের প্রাপ্তি কম। এমনকি ভারতকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ব্যাপারে আমরা চুক্তিবদ্ধ। এসব চুক্তি আমরা এখন বাতিল করতে পারব না। তবে বেগম জিয়া ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এটা বোঝাতে পেরেছেন যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারত যদি এককভাবে সুবিধা নেয়, তাতে করে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ছে। আমদানি-রফতানিতে চট্টগ্রাম বন্দর এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে। নতুন করে ভারতীয় কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সুযোগ কম। বিষয়টি নিয়ে বেগম জিয়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপও করেছেন।
বাংলাদেশের জনগণ ভারতের বন্ধুত্ব চায়। বাংলাদেশের উন্নয়নে ও সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে ভারত যদি সমর্থন করে, তাতে বাংলাদেশে ভারতের ইমেজ নষ্ট হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষ চায় না ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করুক। তবে বেগম জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এবং সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বেগম জিয়া একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। এটা তার ভাবমূর্তির জন্য যথেষ্ট হলেও সংসদীয় রাজনীতিতে সংসদ বয়কটের রাজনীতি মানুষ পছন্দ করে না। মানুষের প্রত্যাশা, তিনি ও তার দল সংসদে ফিরে আসবে এবং সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নেবেন। এটা সত্য, তারা সংসদে বাধা পাবেন। কিন্তু তার পরও সংসদে যেতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তরুণ সমাজে প্রশ্ন আছে। তরুণ সমাজ যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারেও বেশ সোচ্চার। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি যেমন জামায়াতকে ছাড়তে পারবে না, ঠিক তেমন জামায়াতও ছাড়তে পারবে না বিএনপিকে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে তার অবস্থান শক্তিশালী করছে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলে কিছু নেই। কিন্তু তার পরও এ প্রশ্নে সংলাপ হতে পারে। কেননা ক্ষমতাসীন শরিক দলের অনেকেই চাচ্ছে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে একটি সরকার হোক, যাদের কাজ হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা। এমনকি দাতাগোষ্ঠীর প্রায় সবাই একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। কিন্তু সরকারের তাতে রয়েছে আপত্তি। প্রধানমন্ত্রী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং ওই সরকারে বিএনপিও যোগ দিতে পারে— এমন প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেবে না বিএনপি, এটাও জানাতে ভোলেননি বেগম জিয়া। এই যখন পরিস্থিতি, তখন বিএনপিকে নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু ওই নির্বাচনে বিএনপি হয়তো অংশ নেবে না। ৯ ডিসেম্বর রাজপথ অবরোধ এবং ১১ তারিখের হরতালের পর এটা প্রমাণিত হলো, সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য ভালো নয়। হরতাল ও লাগাতার হরতালের দিন আসছে। ২০১৩ সালটি আমাদের জন্য হবে চরম সংকটের বছর। হরতাল দিয়ে মহাসমাবেশ ডেকে অথবা ঢাকা অবরোধ করে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বাধ্য করানো হবে বলে মনে হয় না। তাই আমরা চাই শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। রাজনৈতিক সংকট দেশটির ভাবমূর্তির জন্য ভালো খবর নয়। এমনিতেই দুর্নীতি ও গার্মেন্টশিল্পে অব্যবস্থাপনার কারণে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এখন যদি রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়, তা আগামীতে কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। সরকারও বিএনপিকে এমন অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে বিএনপির আর ফিরে আসার সুযোগ নেই। তাই একটি ‘সংলাপ’ হোক। আমার বিশ্বাস, সংলাপের মধ্য দিয়ে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। অবরোধ ও হরতালের পর আবার সেই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দিল। ‘সংলাপ’ ভিন্ন বিকল্প নেই।
Daily BONIK BARTA
15.12.12

0 comments:

Post a Comment