রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সন্তু লারমার সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক!

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিতর্কিত নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রামের হুমকি দিয়েছেন। এমন একটি কথাই তিনি বলেছেন গত ১ ডিসেম্বর। তার বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে। (সমকাল, ২ ডিসেম্বর)। তিনি এর কোনো প্রতিবাদ জানাননি। শান্তিচুক্তির ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পূূর্ণ বাস্তবায়ন না হলে প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মতো অনিবার্য পথে যেতে বাধ্য হবে পাহাড়িরা’। তিনি সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের মানুষের দাবি আদায়ের আন্দোলনকে গলাটিপে হত্যা করার জন্যই এ সরকার চুক্তি করেছিল। তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে  সরকার যে মনোভাব দেখাবে, যে ধরনের ভূমিকা রাখবে, তার বিপরীতে কোন ভাষায় জবাব দিতে হবে, পাহাড়িরা তা জানে। ভাবতে অবাক লাগে এই অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কিংবা তথ্য কমিশনার ড. সাদেকা হালিমের মতো ব্যক্তিত্ব উপস্থিত থাকলেও তারা সন্তু লারমার এই ‘সশস্ত্র সংগ্রামের’ হুমকির কোনো প্রতিবাদ করেননি। এ ধরনের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের শামিল। সন্তু বাবু রীতিমতো হুমকি দিয়েছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করার। এটা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ। অতীতে স্বাধীনতার পর পরই ভারতের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে চাকমাদের নিয়ে শান্তিবাহিনী গঠিত হয়েছিল। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে একটি শান্তিচুক্তি করে তারা মূল ধারায় ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু তারা কখনো এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়নি। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে রাষ্ট্রের জন্ম,  আজ সন্তু লারমা সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার হুমকি দেন!
আমরা সন্তু বাবুদের এই হুমকিতে রীতিমতো আতঙ্কিত। কেননা, শান্তির নামে চুক্তি সাক্ষরিত হলেও, সেখানে দীর্ঘদিন যাবত অশান্তি বিরাজ করছে। শান্তিচুক্তি সাক্ষরের ১৫ বছর যখন আমরা পার করছি, ঠিক তখনই পাহাড়ি এলাকায় ৪ জন বাঙালির অপহরণের সংবাদ কাগজে ছাপা হয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় বাঙালি অপহরণ এবং চাঁদাবাজি এখন নিত্যনৈমিত্তিক সংবাদে পরিণত হয়েছে। চাঁদা ছাড়া সেখানে কোনো কাজ হয় না। জনসংহতি সমিতির ক্যাডাররা এই চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা নির্ধারণ করে দিয়েছে কোথায় কত টাকা চাঁদা দিতে হবে। সন্তু বাবু এই চাঁদাবাজির কোনো প্রতিবাদ করেননি কখনো। নিরীহ বাঙালিদের অপহরণ ও হত্যা করার ঘটনায়ও নিন্দা জানাননি সন্তু বাবু। উপরন্তু যে ‘শান্তিচুক্তি’র কথা সন্তু বাবু বলেন, সেই শান্তিচুক্তিকেই ‘ডেথ লেটার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে পাহাড়িদের আরেকটি সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট বা ‘ইউপিডিএফ’। এক বিবৃতিতে ইউপিডিএফ নেতা প্রসিত খীসা সন্তু লারমাকে ‘প্রতারক’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন, যা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ১ ডিসেম্বর।
সরকার যে চুক্তি করে পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, তা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছরেও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সন্তু লারমার দাবির মুখে ইতোমধ্যে একাধিক সেনা ক্যাম্প সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এইসব সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের ফলে ওইসব অঞ্চল এখন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। জনসংহতি সমিতি যে ভূমি সংস্কারের কথা বলছে, সেখানেও রয়েছে তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সরকার যদি ভূমি সংস্কার সংশোধনী প্রস্তাব পাস করে, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাবে সরকার। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে (যুগান্তর, ৫ ডিসেম্বর, ২০১২)। সন্তু বাবুদের চাপে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন যেভাবে সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তাতে করে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত বাঙালিরা তাদের ভূমির অধিকার, কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার হারাবে। বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। শুধুমাত্র পাহাড়িদের চাপের মুখে পড়ে সরকার বিদ্যমান আইনের সংশোধন করবে, তা হতে পারে না। সংসদে আইনটি পাস হবার আগে এর নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। বিদ্যমান আইনের ৬(১)গ ধারাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারাটি বিলুপ্ত করা হলে সরকারের অধিকগ্রহণকৃত ভূমি, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প-কারখানা, সরকার ও স্থানীয় সরকারের নামে রেকর্ডকৃত জমি পাহাড়িদের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে যাবে। এই অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে বসবাসরত বাঙালিরা তাদের বসতবাড়ি, ফলের বাগান, পুকুরের মাছ চাষ ইত্যাদি থেকে উচ্ছেদের হুমকির মুখে থাকবে। পাহাড়িদের পাশাপাশি বাঙালিরাও এখানে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছেন। বাংলাদেশের সংবিধান তাদেরকে অধিকার দিয়েছে এ অঞ্চলে থাকার ও বসবাস করার। এখন যদি বিদ্যমান আইনের ৬(১)গ ধারাটি তুলে দেয়া হয়, তাহলে তা হবে ১৯২৭ সালের রিজার্ভ ফরেস্ট আইন ও ১৯৭৮ সালের বন আইনের পরিপন্থী। এতে করে ১৯৫৮ সালের ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আদেশ, ১৯৭৯ সালের ৩১ মার্চ ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারি করা আদেশে গৃহীত সব অধিগ্রহণ ও ভূমি সংক্রান্ত কার্যক্রম অবৈধ হয়ে যাবে। এমনকি জনস্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য অধিগ্রহণ করা ভূমি পাহাড়ি ব্যক্তির মালিকানায় চলে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। এ আইনে গৃহীত সংশোধনী পাস হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে রেভিনিউ (রাজস্ব) সংক্রান্ত কাজে জেলা প্রশাসনের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। দেশের প্রচলিত আইনও কার্যকর থাকবে না বিধায় আদালত কর্তৃক ভূমি সংক্রান্ত মামলা পরিচালনা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তখন ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে তিন সার্কেল চিফ/রাজারা হেডম্যান কারবারীর মাধ্যমে রীতিনীতি, প্রথা-পদ্ধতি অনুসরণ করে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানা, সামাজিক প্রভাব ইত্যাদি গুরুত্ব পাবে বেশি। এছাড়া এ সংশোধনী পাস হলে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব হয়ে যাবে। কমিশনের ৫ জন সদস্যের মধ্যে ৩ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর হওয়ায় যে কোনো সিদ্ধান্ত পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদের বিপক্ষে চলে যাবে। বাঙালিদের স্বার্থ ও অধিকার ক্ষুণœ হবে। এখনই বাঙালিরা পাহাড়ি এলাকায় চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন না। সংশোধনী গৃহীত হলে প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত হবেন। এমনকি তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোও একটা সমস্যা হবে। আইনের ১৩(৩) উপধারা (নতুন) বিষয়ে বলা যায় যে, এই উপধারাটি সংযোজিত হলে কমিশনের সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে বাঙালিরা বঞ্চিত হবেন, শুধুমাত্র পাহাড়িরাই নিয়োগ পাবেন।
ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইনে বেশ কিছু প্রস্তাব দিলেও সেইসব প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। অতি সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে একচেটিয়াভাবে পাহাড়িদের স্বার্থ রক্ষা করে আইন সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটিও একই মতামত দিয়েছে। ফলে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়ে তা এখন সংসদে যাবে এবং সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে ভূমি সংস্কার সংশোধনী আইন পাস হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি পাহাড়ে শান্তি নিশ্চিত করেনি। এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব। কেউ কাউকে আস্থায় নিতে পারছেন না। বিশেষ করে পাহাড়ি নেতৃত্ব আদৌ মনে করে না যে বাঙালিদের এ অঞ্চলে থাকার অধিকার রয়েছে। সংবিধান বাঙালিদের এ অঞ্চলে থাকার অধিকার দিলেও, সন্তু লারমা গংরা তা মানতে নারাজ। একাধিকবার তিনি বাঙালিদের নোয়াখালীর চরে পুনর্বাসনের দাবি করেছেন। সরকারি তরফে এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি। এমনিতেই পরিস্থিতি সেখানে শান্ত নয়, তার উপরে ভূমি সংস্কার সংশোধনী আইনটি যদি পাস হয়, তাহলে পরিস্থিতির সেখানে আরো অবনতি হবে। পাহাড়ি-বাঙালি বিদ্বেষ আরো বাড়বে। শুধুমাত্র পাহাড়িদের প্রাধান্য দিয়ে যেকোনো ভূমি সংস্কার সংশোধনী সারা জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সংশোধনী পাসের আগে পাহাড়ি এলাকায় বাঙালিদের মতামত নিতে হবে। পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদের বাদ দিয়ে যে কোনো সংশোধনী বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দেবে।

0 comments:

Post a Comment