অতি
সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা
দিয়েছে তা হচ্ছে, দেশের সংঘাতময় রাজনীতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
সেমিনারে, টকশোতে এই মুহূর্তে আলোচনার একটি বিষয়-বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি
সংঘাতময় রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা তেমন
কথা প্রকাশ্যেই বলছেন, ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝেও এই প্রশ্নটি
ঘুরেফিরে আবতির্ত হচ্ছে। সরকারি দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা, দলের সাধারণ
সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তো প্রকাশ্যেই বললেন, ‘বিএনপি-জামায়াত
গৃহযুদ্ধের পরিকল্পনা করছে।’ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মন্ত্রিপরিষদের পক্ষ
থেকে রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি এ অভিযোগ করেন। তার বক্তব্য পরদিন
পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। নিঃসন্দেহে সৈয়দ আশরাফের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ
নেতা যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন তা গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। সৈয়দ
আশরাফ সরাসরি অভিযোগ করেছেন বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে। সৈয়দ আশরাফের ওই
বক্তব্য নিয়ে যখন কানাঘুষা হচ্ছে, তখন ২৩ ডিসেম্বর ছাপা হলো আরো একটি
সংবাদ। সংবাদে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ১৪ দল
মাঠে থাকবে’। ১৪ দলের এক সভায়ই এ সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। বিএনপি ২৬
ডিসেম্বর থেকে গণসংযোগ শুরু করেছে ঢাকায়। বেগম জিয়া এসব গণসংযোগে বক্তৃতা
দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে ১৪ দলের কর্মীরা যদি মাঠে থাকে তাহলে সংঘাত তো
অনিবার্য। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান কি আমাদের জন্য ভালো কোনো সংবাদ বয়ে
আনবে? আমরা বারবার বলে আসছি রাজনীতিবিদদের মধ্যে যদি শুভবুদ্ধির উদয় না
হয়, তাহলে সংঘাত অনিবার্য। ছাত্রলীগের ছেলেদের হাতে বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড
কিংবা ২০ ছাত্রীকে গ্রেফতারের ঘটনা, কিংবা ছাত্রশিবিরের ৪১ নেতকর্মীকে
গ্রেফতারের ঘটনা সংবাদপত্রের শীর্ষ সংবাদ হয়েছে। শিবিরের সাম্প্রতিক ভূমিকা
বিতর্কিত। সংবাদপত্রে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কিন্তু
ছাত্রীদের যাদের মাঝে একজন আবার অন্তঃসত্ত্বা, পুলিশ তাদের গ্রেফতার করল।
এরা জামায়াতের রাজনীতির সমর্থক, শিবিরের ছাত্রী সংস্থার সদস্য। তারা যদি
রাষ্ট্রবিরোধী কোনো অপরাধ করে থাকে, তাহলে অবশ্যই তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ
করেছে। ইতিমধ্যে তাদের দুদিন রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রে ছাপা
হয়েছে তারা তাদের অফিসে ছিলেন। আলোচনা করছিলেন। এখন কোর্টই বিচার করবে
তারা রাষ্ট্রদ্রোহ কোনো অপরাধ করেছিলেন কি না। অপরাধ করলে অবশ্যই তাদের
বিচার দাবি করব। কিন্তু কোনো কোনো সংবাদপত্রে এ ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের
মতো ঘটনা ঘটেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। আমরা আমাদের সংবিধান নিয়ে গর্ব করি।
বিশেষ করে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বেশ কিছু ধারা রয়েছে; যা আমাদের
অধিকারকে সংরক্ষণ করেছে। বিশেষ করে ২৭নং অনুচ্ছেদে (আইনের দৃষ্টিতে
স্বচ্ছতা), অনুচ্ছেদ ৩২ (জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার), অনুচ্ছেদ ৩৬,
৩৭ ও ৩৮ (চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা)
ইত্যাদি উল্লেখ করা যায়। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ১১ অনুচ্ছেদের কথাও
উল্লেখ করতে পারি যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ড কিংবা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে গ্রেফতার
ইত্যাদি ঘটনায় সংবিধানের এইসব ধারা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা অধিকার আমাদের জানিয়েছে যে, চলতি
বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৬৪ জন
নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতিতদের মধ্যে পুলিশের হাতে ৫০ জন, র্যাবের
হাতে ৫ জন, বিজিবির হাতে ২ জন এবং জেল কর্তৃপক্ষের হাতে ২ জন নির্যাতনের
শিকার হয়েছেন (আমার দেশ, ২৩ ডিসেম্বর ২০১২)। পুলিশের এই ভূমিকা সংগত কারণেই
আমাদের উদ্বিঘœ করেছে। এমনিতেই রাজনীতি যখন উত্তপ্ত, দেশ যখন সংঘাতের
মুখোমুখি তখন এই পরিসংখ্যান আমাদের নতুন উদ্বেগজনক ভাবনায় ফেলে দেয়। সিপিবি-বাসদের
হরতালের সময় পুলিশের ভূমিকার একটি ছবিও গেল সপ্তাহে সংবাদপত্রে ছাপা
হয়েছে। এটা ছিল বাহ্যত সরকার সমর্থিত একটি হরতাল! যেখানে অন্য সময় পুলিশ
হয়ে ওঠে বেপরোয়া, কিন্তু এই হরতালে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। একটি ছবিতে দেখা
গেল পিকেটাররা বাধ্য করছে এক রিকশাচালককে ফিরে যেতে। পাশে দাঁড়ান একদল
পুলিশ। নির্বিকার। ভাবখানা এমনই যে রিকশাওয়ালা রিকশা বের করল কেন? আজ তো
হরতাল। এই ছবি কি আমাদের বোঝার জন্য স্পষ্ট নয় যে, সরকারই ওইদিন হরতাল
করেছে? আসলে ছবি কথা বলে। ছবিই বলে দেয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কী নির্দেশ ছিল
পুলিশের প্রতি। বিশ্বজিতের হত্যার দৃশ্য ধারণ করে ফটো সাংবাদিকরা আমাদের
দেখিয়ে দিলেন সরকার আসলে ওইদিন কী চেয়েছিল। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডকে
নানাভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। বিশ্বজিৎ একজন শিবিরকর্মী, একজন
অনুপ্রবেশকারী-এ ধরনের বক্তব্য এসেছে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। হত্যাকারীরা
আদৌ ছাত্রলীগ কর্মী নন, এ ধরনের দাবি ছাত্রলীগের নেতাদের মুখ থেকে
উচ্চারিত হলেও ছবিই প্রমাণ করে দিয়েছে পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটান
হয়েছিল। হত্যাকারীরা চেয়েছিল একটি ভয়ের আবহ তৈরি করতে। বিশ্বজিতের
হত্যাকাণ্ড, কুপিয়ে প্রকাশ্যে একজন মানুষকে হত্যা করার ঘটনায় সরকারের কোনো
উদ্বিগ্নতা প্রকাশ না পেলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি
হত্যাকাণ্ডের এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তার মন্তব্য প্রমাণ করে বিদেশিদের
কাছে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ইতিমধ্যে নিশ্চিন্তপুরের ১১২ শ্রমিকের
মৃত্যুর ঘটনায় আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো
প্রকাশ্যে মানুষ মারার ঘটনা। এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এসব ঘটনায়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের যে বড় বাজার, সেই বাজার
এখন হারাতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ১ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ডলারের বাজার
রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। স্পষ্টতই পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে বাংলাদেশ এ বাজার
হারাবে। ইতিমধ্যে ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে তার তৈরি পোশাক ক্রয় বাতিল
করেছে। নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন গার্মেন্ট ওয়ালমার্টকে বিশেষ ধরনের পোশাক
সরবরাহ করত। এটা বন্ধ হয়ে গেল। এটা অন্যদের ক্ষেত্রেও একটা প্রচ্ছন্ন
‘হুমকি’। নিশ্চিন্তপুরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের
ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম কিংবা ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরামের
মতো সংগঠন তৎপর হয়েছে। এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টও একটি মন্তব্য করেছে। তারা
স্পষ্ট করেই বলছে, পোশাক শ্রমিকদের মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র
বদ্ধপরিকর। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের জন্য একটি ‘মেসেজ’। পোশাক শিল্প
স্পষ্টতই একটি ঝুঁকির মুখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলো
অত্যন্ত শক্তিশালী এবং শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে যেসব মানবাধিকার সংস্থা কাজ
করে, তারা ওয়াশিংটনে এক ধরনের ‘লবিস্ট’ হিসেবে কাজ করে। কংগ্রেসম্যানদের
তারা বাধ্য করে আইন প্রণয়ন করতে। এমনকি বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তৈরি
পোশাক শিল্পে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা চেয়ে
আসছে। বাংলাদেশ এই সেক্টরে এ সুবিধা পায় না। কিছু কিছু সেক্টর যেমন,
সিরামিক, সার, ফার্নিচার ইত্যাদি শিল্পে জিএসপি সুবিধা পায়। তৈরি পোশাকে
পায় না। শতকরা ১৫ ভাগ শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে প্রবেশ করছে।
গুণগত মান ও সস্তা থাকায় বাংলাদেশি এই পণ্যের বড় বাজার রয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রে। এখন এই জিএসপি সুবিধার বিষয়টিও প্রশ্নের মুখে পড়ে গেলো। আমি
আশঙ্কা করছি, মার্কিন শ্রমিক সংগঠন তথা শ্রমিক স্বার্থ রক্ষাকারী
প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘চাপে’ কংগ্রেসে একটি আইন প্রণীত হতে পারে; যেখানে
বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা হতে পারে। এটা
হলে বাংলাদেশের জন্য তা হবে এক ধরনের আত্মহত্যার শামিল। কেননা আমাদের
অর্থনীতিতে পোশাক শিল্প একটা বড় অবদান রাখছে। ইউরোপের অর্থনীতিতে মন্দাভাব
বিরাজ করায় সেখানে বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না। এমনকি সেখান থেকে ‘অর্ডার’ও
কমে আসছে। ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা যদি হ্রাস
পায় তা আমাদের অর্থনীতির জন্য হবে হুমকি। এমনকি কম্পায়েন্সের যে
সুযোগ-সুবিধা মার্কিন ক্রেতারা দাবি করছে, তা নিশ্চিন্তপুরের ঘটনার পর আরো
শক্তিশালী হবে। ‘কম্পায়েন্স’ এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন তৈরি পোশাক
কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ওপর জোর দেবে। শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে
তারা চাইবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি। পরিস্থিতি যেদিকে
যাচ্ছে তাতে আমি ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা করছি। বলা হচ্ছে,
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্যই বিএনপি তথা জামায়াত নানা চক্রান্ত
করছে। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে বলতে পারব না। কিন্তু এটা তো সত্য, যারা
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে অপরাধ করেছেন তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। এ
দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই এটা চান। বিএনপি এই বিচারের বিরোধী নয় বলেও
জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা। তবে তাদের দাবি বিচার যেন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার
মধ্য দিয়ে হয়, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে আমরা সবাই সেটাই চাই। কিন্তু তাই
বলে দেশে এখন ‘যুদ্ধের’ মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে-এটাও আমরা চাই না।
‘গৃহযুদ্ধের’ কথা বলে আমাদের মাঝে একটা ভয় ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা এ
‘রাজনীতি’ চাই না। দুটি বড় দলকে সংলাপে বসতে হবে। একটা সমাধানে পৌঁছতে
হবে। আমরা যদি আদৌ কোনো সমাধানে পৌঁছতে না পারি, যদি প্রকাশ্যে কুপিয়ে
হত্যা বন্ধ করতে না পারি, যদি মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারি,
তাহলে বাংলাদেশ বিশ্ব মিডিয়ায় একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হবে। এটা
আমাদের কারো জন্যই কোনো ভালো খবর নয়।
DailyMANOBKONTHO
30.12.12
|
0 comments:
Post a Comment