রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট আমাদের কী শিক্ষা দেয়

উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত গ্রিসের ঋণ পরিশোধ করতে না পারা এবং গত ৫ জুলাই গণভোটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ঋণদাতা গোষ্ঠীর প্রস্তাবের প্রত্যাখ্যানের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কোন পথে এখন গ্রিস এবং গ্রিসের এই সংকট আমাদের কী শিক্ষা দেয়? গ্রিসের শক্তিশালী নেতৃত্ব ‘ট্রয়কা’ শক্তির (আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন) বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক ধরনের ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়তে পেরেছিলেন। এতে করে আলোকসিস সিপরাসের নেতৃত্বাধীন সাইরিজা-আনয়েল (ঝুৎরুধ-অহবষ) কোয়ালিশন সরকারের পতন হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। বরং গণভোটে শতকরা ৬১ দশমিক ৩১ ভাগের সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন। এই সমর্থন ‘ট্রয়কার’ সঙ্গে গ্রিস সরকারের আলোচনার পথকে আরও প্রশস্ত করবে। এটা সত্য, প্রধানমন্ত্রী সিপরাস এখন অনেক শক্তিশালী। জনগণের ম্যান্ডেট তিনি পেয়েছেন। গণভোটে গ্রিকবাসী স্পষ্টতই রায় দিয়েছে যে, তারা ‘ট্রয়কা’ কর্তৃক প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজ (বেইল আউট) সমর্থন করে না। এখানে এখন দুটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। এক. গ্রিক জনগণ কৃচ্ছ্রতা কর্মসূচি পরিত্যাগ করায় সিপরাস এখন এই ‘বেইল আউট’ প্যাকেজকে হ্যাঁ বলতে পারবেন না। ভোটে যদি হ্যাঁ ভোট বেশি পড়ত, তাহলে তিনি পারতেন। অন্যদিকে ইউরো জোন নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে জার্মানির অবস্থান। তারা আগের অবস্থান পরিবর্তন করবেন, করলে কতটুকু করবেনÑ সেটা একটা প্রশ্ন এখন। গ্রিস সরকারের সঙ্গে আলোচনায় উভয়পক্ষ কিছুটা নমনীয় হবে, এটাই প্রত্যাশিত। গ্রিসের যেমনি প্রয়োজন রয়েছে ইউরো জোনে থাকা ও ইউরোপীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা ঠিক তেমনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দও চাইবেন না তাদের ঐক্যে ফাটল ধরুক। যুক্তরাষ্ট্রও তা চাইছে না। ন্যাটোর অন্যতম সদস্য গ্রিসে রাশিয়া ও চিনের প্রভাব বাড়–কÑ এটা হোয়াইট হাউস চাইবে না। তবে গ্রিসের গণভোটে কৃচ্ছ্রসাধনের প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় আমি অবাক হইনি। কেননা ২০১০ সাল থেকেই গ্রিস অর্থনৈতিক সংকটে আছে। প্রথম ‘বেইল আউট’ প্যাকেজ গ্রহণ করেও গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কতগুলো পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে সংস্কার আনতে গিয়ে গ্রিসের অর্থনীতিতে কী পরিমাণ ধস নেমেছে। ২০১০ সালের পর ২৯ লাখ লোকের পেনশনের পরিমাণ শতকরা ৪৫ ভাগ কমানো হয়েছে। এটা করা হয়েছে আইএসএফের পরামর্শ অনুযায়ী। গ্রিসের মোট ঋণের পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে ৩২০ বিলিয়ন ডলারে, যা কি না জিডিপির শতকরা ১৮০ ভাগ। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ৬০ ভাগ। অর্থাৎ কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন করেও গ্রিস ঋণের পরিমাণ কমাতে পারেনি। আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করে দেশটির জিডিপির পরিমাণ কমেছে, বাড়েনি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সালে গ্রিসের জিডিপির পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৫৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ২৪২ বিলিয়ন ডলারে। এই পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাংকের। গত পাঁচ বছরে, অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংকট ও আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী চলার প্রায় কাছাকাছি সময় থেকে গ্রিসে ১০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন। এই মুহূর্তে কর্মক্ষম গ্রিকবাসীর প্রতি চারজনের মধ্যে একজন বেকার। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রায় ২ লাখ গ্রিক নাগরিক দেশ ত্যাগ করেছেন, যাদের অনেকেই দেশে ইঞ্জিনিয়ার অথবা ডাক্তার এবং আইটি সেক্টরে কাজ করতেন। সেদিন বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখলাম মেলবোর্নে প্রায় ৪ লাখ গ্রিক নাগরিক বসবাস করেন। একজন গ্রিক ব্যাংকারের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছিল, যিনি মেলবোর্নে (অস্ট্রেলিয়া) এখন একটি গ্রিস ক্যাফেতে সাধারণ কাজ করেন। মাত্র ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটিতে ১০ লাখ মানুষের কোনো স্বাস্থ্য ইন্স্যুরেন্স নেই। যেখানে ইউরো জোনে যে কারোর গড় হিসাব হচ্ছে জনসংখ্যার ১১ দশমিক ১ ভাগ, সেখানে গ্রিসে এই সংখ্যা ২৫ দশমিক ৬ ভাগ। অথচ ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৮ ভাগ। গত পাঁচ বছর থেকেই গ্রিস আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী অর্থনীতিতে কৃচ্ছ্রসাধন করে আসছে। বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকা- বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অথবা সেখানে কাটছাঁট করা হয়েছে। বর্তমানে বেতন কমানো হয়েছে শতকরা ২০ ভাগ হারে। সরকারি সেক্টরে বেতন বৃদ্ধি ‘ফ্রিজ’ করে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সিপরাস চেয়েছিলেন ন্যূনতম বেতন ৭৫০ ইউরোতে (৮৩৫ ডলার) উন্নীত করতে। কিন্তু আইএমএফের চাপে তিনি তা পারেননি। গ্রিকবাসীর মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ মানুষের বয়স ৬৫ বছর বয়সের ওপরে। এই বুড়ো মানুষগুলোর পেনশন কমানো হয়েছে প্রায় ৪৮ ভাগ হারে। কিন্তু তাতে করে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি করা যায়নি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে গ্রিসে ‘হোমলেস’ অথবা গৃহহীন মানুষের সংখ্যা কীভাবে বাড়ছে। এই সংখ্যা এখন মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ২৫ ভাগ। চিন্তা করা যায়, গ্রিসের মতো একটি উন্নত দেশে শতকরা ২৫ ভাগ মানুষের থাকার কোনো জায়গা নেই! গ্রিসের পরিস্থিতিকে অনেকে ২০০১ সালের আর্জেন্টিনার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। আর্জেন্টিনা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে ঋণদাতারা তাদের স্বার্থেই আবার আর্জেন্টিনাকে ঋণ দিয়েছিল। আজকে গ্রিসের পরিস্থিতিকে জিম্বাবুয়ে ও সোমালিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এই দেশ দুটি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মূলত বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ কাঠামোগত সাহায্য বা ঝঃৎঁপঃঁৎধষ অফলঁংঃসবহঃ-এর আওতায় এই ঋণ দিয়ে থাকে। এই ধরনের ঋণের সঙ্গে কড়া শর্ত জড়িত থাকে এবং এটা এক ধরনের সুপারিশমালা, যা ঋণগ্রহীতা দেশকে অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সুপারিশমালা অনুসরণ করে ঋণগ্রহীতা দেশ তাদের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পেরেছে। কাঠামোগত সামঞ্জস্যে যেসব সুপারিশ থাকে, তার মধ্যে রয়েছেÑ গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস করা, প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারিকরণ, উঁচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, আমদানি অবাধ করা, মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এসব সুপারিশমালা গ্রিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। গ্রিসের বামপন্থী সরকার আইএমএফ কর্তৃক দেওয়া এসব সুপারিশমালার অনেকগুলো গ্রহণ করেও সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তেমন উন্নতি করতে পারেনি। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো এবং সমাজতন্ত্র-পরবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে (১৯৯১-পরবর্তী) এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ সোভিয়েত-নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় ও দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। তাই দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলার কতগুলো শর্ত দেওয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউর সমস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা কিংবা ক্রোয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারও মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। ২০১৩-১৪ সময়সীমায় ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ইইউর প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোটায়। তাই ইউরোপ নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ তা আরও বাড়বে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুস্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুস্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এই বিভক্তির কথা বলেছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর মেরকেল চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন, এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান জোসেফ ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কি না কিংবা ‘নতুন ইউরোপ’-এর স্বরূপ কী হবে তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসন্ন তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা না থাকা নিয়ে গণভোট করতে চান, তখন ইউরোপের ঐক্যে যে ফাটলের জন্ম হয়েছে তারই ইঙ্গিত দিলেন তিনি। ক্যামেরন স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি, তা হলে ইউরোপের পতন হবে এবং ব্রিটিশরাও পতনের দিকে যেতে থাকবে।’ অতীতে ইইউ সম্পর্কে এত ভয়ঙ্কর কথা কেউ বলেননি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত কঠিন সময় ইইউর জন্য। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায় আগামী এক দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন ইউরোপের চেহারা দেখতে পাব।
 Daily Amader Somoy 12.07.15

0 comments:

Post a Comment