রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আজ গ্রিসে অর্থনীতি রক্ষার বড় পরীক্ষা

আজ ৫ জুলাই গ্রিসে অর্থনীতি রক্ষায় (বেইল আউট) গণভোট হতে যাচ্ছে। গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে ৩০ জুনের মধ্যে ১০০ কোটি ৭০ লাখ ডলার পরিশোধ করার ব্যর্থতা শুধু গ্রিসের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই নয়, বরং বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। বস্তুত বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়েছে ইউরো জোনের ভবিষ্যৎ। ৩০ জুন গ্রিসের ১০০ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণ পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় গ্রিস দেউলিয়া হয়ে গেছে। আইএমএফের কাছ থেকে এ ঋণ নিয়েছিল গ্রিস। গত ৫ বছর ধরেই গ্রিসের ঋণ সংকটজনিত পরিস্থিতি বিশ্বের গণমাধ্যমে স্থান পেয়ে আসছিল। এই ঋণ পরিস্থিতি ও ঋণ পরিশোধ করার ব্যর্থতার কারণে সেখানে সরকারের পতন পর্যন্ত ঘটেছিল। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আলেকসিস সিপ্রাসের নেতৃত্বে একটি বামপন্থী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটের কোনো সমাধান দিতে পারছিল না সরকার। এমনই এক পরিস্থিতিতে ঋণ পরিশোধে আরও অর্থ দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল আইএমএফ। কিন্তু তারা শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। শর্তের মাঝে অন্যতম ছিল কঠোর ব্যয় সংকোচন। কিন্তু এই শর্তের প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়। উল্লেখ্য, এর আগের সরকার কঠোর ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করলে সরকারের পতন ঘটে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সিপ্রাস প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে আইএমএফের এই শর্তের বিরোধিতা করে আসছিলেন। শেষ মুহূর্তে সরকার ৫ জুলাই একটি গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দেয়। সরকার গণভোটে না ভোট দেয়ার জন্য গ্রিসের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে ইউরো জোনের নেতারা গণভোটে হ্যাঁ ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে গ্রিসের পার্লামেন্টের সদস্যরা না ভোট দেয়ার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এর অর্থ পরিষ্কার-না ভোট জয়যুক্ত হলে গ্রিস ইউরো জোন থেকে ছিটকে পড়বে। অর্থাৎ যে ১৯টি দেশ নিজস্ব মুদ্রা হিসেবে ইউরো চালু করেছিল, তাদের মধ্যে গ্রিস আর থাকতে পারবে না। এখানে বলা ভালো, বর্তমানে ২৮টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠিত। তবে সব দেশ এখনও তাদের নিজস্ব মুদ্রা হিসেবে ইউরো গ্রহণ করেনি। কোনো কোনো দেশ (ব্রিটেন, ডেনমার্ক) তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে ইউরো গ্রহণ করেনি। আবার কোনো কোনো দেশ ইউরো গ্রহণে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছিল, সেসব শর্ত পূরণ করতে পারেনি। যেসব দেশে ইউরো চালু হয়েছে, ওই সব দেশকে নিয়েই ইউরো জোন গঠিত। যেমন- অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, সাইপ্রাস, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুস্কেমবার্গ, মাল্টা, হল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভাকিয়া ও স্পেন- এসব দেশ এর সদস্য। এর বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো (যেমন- চেক রিপাবলিক, পোল্যান্ড, সুইডেন, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি) এখনও ইউরো জোনের বাইরে রয়েছে। গ্রিস ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে গেলে দেশটির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। বিকল্প হিসেবে গ্রিস সদ্যগঠিত চীনের নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) দিকে তাকাতে পারে। এটা হলে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কর্তৃত্ব আরও খর্ব হবে।তবে গ্রিসের পরিস্থিতি একটা শংকা তৈরি করেছে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সদস্য দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ২০১৬ সালে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে দেশটির থাকা, না থাকা নিয়ে একটি গণভোট করবে। স্পষ্টতই সমগ্র ইউরোপে অভিন্ন এক ইউরোপের ধারণা তখন কল্পনাতেই থেকে যেতে পারে। ২০১১ সালের পর থেকে অর্থনেতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোনো অমূলক ধারণা ছিল না। বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্র“য়ারিতে স্বাক্ষরিত ম্যাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ।ম্যাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চে শেনজেন চুক্তি এবং ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউর সদস্য সংখ্যা এখন ২৮। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ইইউর ১৫টি দেশের মধ্যে ১১টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৯টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই এ মুদ্রা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল, ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এ আশংকাই সত্যে পরিণত হল। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও সদস্য দেশগুলোয় তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজি ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত নয় বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ইইউর কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে যায়। ইতিমধ্যে গ্রিস ও ইতালির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চরমে ওঠেছে। কিন্তু গ্রিসের পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে খারাপ। সেখানে পাপেন্দ্র সরকারের পতন, বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, কিংবা ২০১৫ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে বামপন্থী আলেকসিস সিপ্রাসের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হলেও গ্রিস অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। বরং সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে।আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তি। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট ইইউর ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে। এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড ও লুস্কেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। ২৮টি দেশ এখন ইইউর সদস্য। এর মাঝে আবার ২৪টি দেশ ন্যাটোর সদস্য। তবে জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনও ন্যাটোর সদস্য হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ওই দুটি দেশকে ন্যাটোর সদস্যপদ দিতে চাচ্ছে, যাতে রাশিয়ার রয়েছে আপত্তি।ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দফতর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইন্সটিটিউট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এ সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোপই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখে। যে যুক্তি তুলে একসময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (একক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হল। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় তা হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি-না?২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উৎসব পালন করে, তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লুস্কেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরো মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল ইউরো সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু এর বিরোধিতা করেছিল ফ্রান্স। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিন্তিত ছিল এ কারণে যে, নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউর জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের ভেলভেট রেভ্যুলেশন এ দেশগুলোকে সোভিয়েত নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় এবং দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এ দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউর সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া হারজেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া এখনও ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারও মন্দার আশংকা বাড়ছে। ২০১৩-১৪ সালে ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ইইউর প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোঠায়। তাই ইউরোপ নিয়ে শংকা থেকেই গেল। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ, তা আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এ বিভক্তির কথা বলেছিলেন। জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এ বিভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যি ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কি-না, কিংবা নতুন ইউরোপের স্বরূপ কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসন্ন, তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা, না থাকা নিয়ে গণভোট করতে চান, তখন ইউরোপের ঐক্যে যে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে, তারই ইঙ্গিত মেলে। ক্যামেরন স্পষ্ট করেই বলেছেন, আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি, তাহলে ইউরোপের পতন হবে এবং ব্রিটিশরাও পতনের দিকে যেতে থাকবে। অতীতে ইইউ সম্পর্কে এত ভয়ংকর কথা কেউ বলেননি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত কঠিন সময় ইইউর জন্য। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়, আগামী এক দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন ইউরোপের চেহারা দেখতে পাব।ব্রিটেনের মতো একটি বড় দেশ যদি ইইউ ত্যাগ করে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব আর থাকে না। অভিবাসী প্রশ্নে ক্যামেরনের সর্বশেষ বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে বেশ অসন্তুষ্ট। ব্রিটেনের পর এখন দৃষ্টি গ্রিসের দিকে।তবে সব ছাপিয়ে গেছে গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গ্রিসের পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্য ৫ জুলাইয়ের গণভোটে না ভোটের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ঋণদাতা দেশগুলো যে সংস্কারের কথা বলেছিল, অর্থাৎ বাজেট কাটছাঁট করা, তাতে তারা সায় দেবে না। ধারণা করছি গণভোটে না ভোট জয়যুক্ত হবে। এর অর্থ হচ্ছে গ্রিস ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যাবে। শেষ অব্দি গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি-না, সেটাও একটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে। কিংবা এমনও হতে পারে গ্রিস ব্রিটেন ও ডেনমার্কের মতো অবস্থান গ্রহণ করবে। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকেও নিজস্ব মুদ্রা তারা ব্যবহার করবে। যেমন ব্রিটেনে ইউরো চালু না হওয়ায় এখনও পাউন্ড সেখানে চালু রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, গ্রিস তার পুরনো মুদ্রা ড্রাকমা পুনরায় চালু করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে আজকের গণভোটের ফলাফলের ওপর। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, গ্রিস যদি ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যায়, এর একটা মারাÍক প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে পড়বে। এরই মধ্যে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি স্টক এক্সচেঞ্জ মার্কেটে দরপতন ঘটেছে। শুধু অস্ট্রেলিয়া স্টক একচেঞ্জ থেকেই ৩৫ বিলিয়ন ডলার হাওয়া হয়ে গেছে। মুদ্রা হিসেবে ডলারের মানও কমে গেছে। বলা হচ্ছে, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২০১৬ সালে এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ০.৩ ভাগ কমে যাবে। তাই সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে আজ গ্রিসের গণভোটের দিকে।গ্রিসের এই দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একটি উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রও যে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, এটা এই প্রথমবারের মতো প্রমাণিত হল। ফলে ইউরোপের আরও অনেক দেশ নিয়ে এ প্রশ্ন থাকল। দ্বিতীয়ত, ঋণদাতা সংস্থা, বিশেষ করে আইএমএফের অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা যে কোনো দেশের স্বার্থরক্ষা করতে পারে না, এটা প্রমাণিত হল। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নীতি একটি স্বাধীন অর্থনীতির পরিপন্থী। গ্রিসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আইএমএফের প্রেসক্রিপশন ছিল পেনসনের পরিমাণ কমানো, ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়ানো ইত্যাদি। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নীতি হচ্ছে ঋণগ্রহীতা দেশকে তার সুপারিশমালা অনুযায়ী চলতে বাধ্য করা।পাঠক, বাংলাদেশের কথা ভাবতে পারেন। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকে সম্প্রসারিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির আওতায় কাজ করে যাচ্ছে। এক বছরে সরকারের ৯টি ক্ষেত্রে করণীয় কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে ৫৭টি দেশ নিয়ে চীনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বা এআইআইবি। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক (যারা ইউরো জোনে নেই) এর সদস্য। গ্রিস এ ব্যাংকে যোগ দিতে পারে।তবে আইএমএফ তার নিজের স্বার্থেই তাদের সুপারিশমালা কিছুটা নমনীয় করে গ্রিসকে তার অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে আরও ঋণ দেবে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ নমনীয় হয়ে কিছু শর্ত প্রত্যাহার করে নিলে গ্রিস সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে, এমন কথাই জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস। আগামী ১০ জুলাই গ্রিসকে প্রাইভেট লগ্নিকারী সংস্থাগুলো থেকে নেয়া ২ বিলিয়ন ইউরো পরিশোধ করতে হবে। ফলে সমস্যা একটা থাকলোই। এখন আবারও গ্রিসকে ঋণ দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র সবুজ সংকেত পেলেই আজকের গণভোট বাতিল হতে পারে।গ্রিসের পরিস্থিতি আমাদের অনেকের জন্যই একটি শিক্ষা। আইএমএফের ফাঁদে পা দিলে একটি দেশের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, গ্রিসের অবস্থা এর বড় প্রমাণ। Daily Jugantor 05.07.15

0 comments:

Post a Comment