গত
৫ জুলা্ই গ্রীসের গণভোটের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দাড়িয়েছে তা হচ্ছে
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ এখন কোন পথে? গ্রীসের অর্থনীতি রক্ষায় (বেইল
আউট)ঋণদাতা গোষ্ঠীর প্রস্তাব গ্রীস গ্রহণ করবে কি করবে না এই প্রশ্নে
প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস এই গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। গণভোটের ফলাফলে দেখা যায়
প্রস্তাবের পক্ষে (অর্থাৎ ঋণদাতা গোষ্ঠীর কঠিন শর্তের পক্ষে) ভোট পড়েছে
শতকরা ৩৮.৬৯ ভাগ, অন্যদিকে প্রস্তাবের বিপক্ষে (অর্থাৎ ঋণদাতা গোষ্ঠীর শর্ত
প্রত্যাখ্যান) ভোট পড়েছে শতকরা ৬১.৩১ ভাগ। এর অর্থ পরিস্কার। গ্রীস ইউরো
জোনে থাকবে কিনা, এটা বড় প্রশ্ন এখন। এখানে বলা ভালো, ৩০ জুনের মধ্যে
আইএমএফ এর ঋণের ১০০ কোটি ৭০ লাখ ডলার পরিশোধের কথা ছিল গ্রীসের। কিন্তু
গ্রীস সরকার তা পারেনি। ফরে রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হয়ে যায়। তখনই প্রশ্ন ওঠে
গ্রীস যদি ইউরো জোন থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ কি?
২০১১ সালের পর থেকেই সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোন অমূলক ধারণা ছিল না। বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপীয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত ম্যাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। ম্যাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে সেভেন চুক্তি ও ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতোমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্বে ইউরোপের সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ ক’টি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউ’র সদস্য সংখ্যা এখন ২৮। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ইইউ’র ১৫ টি দেশের মাঝে ১১ টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৯টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এতবছর পর এই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হলো। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও, তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজী ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা
গত নয় বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ইইউ এর কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে গ্রীস, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এই দেশগুলো অতিরি্ক্ত ঋণ নিয়েও পরিস্থিতি পুরোপুরি সামাল দিতে পারছে না।
গ্রীসের পরিস্থিতি নিয়ে এখন নানা অঙ্ক কষা যায়। গ্রীস আদৌ আইএমএফ তথা ‘ট্রয়কা’ (আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) এর ‘দুষ্টচক্র’ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কিনা, এটা একটা পশ্ন এখন। গ্রীসের এই দেউলিয়া হয়ে যাবার ঘটনা এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একটি উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রও যে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, এটা এই প্রথমবারের মতো প্রমাণিত হলো। ফলে ইউরোপের আরো অনেক দেশ নিয়ে এই প্রশ্ন থাকল। দ্বিতীয়ত, ঋণ দাতা সংস্থা, বিশেষ করে আইএমএফ এর অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা যে কোন দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না, এটাও প্রমাণিত হলো। বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ এর নীতি একটি স্বাধীন অর্থনীতির পরিপন্থি। গ্রীসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আইএমএফ এর প্রেসক্রিপশন ছিল পেসশনের পরিমাণ কমানো, ট্যাক্স এর পরিমাণ বাড়ানো ইত্যাদি। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর নীতি হচ্ছে ঋণগ্রহীতা দেশকে তার সুপারিশমালা অনুযায়ী চলতে বাধ্য করা। গ্রীসের বামপন্থি সরকার সেটা চায়নি।
ফলে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালের পর থেকে অর্থাৎ যখন সংকট শুরু হয় এরপর একের পর এক সরকারের পতন ঘটেছিল সেখানে। পরিস্থিতি কাটি্য়ে উঠতে সেখানে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে একটি নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে সাইরিজা (Syriza)পার্টি বিজয়ী হয়ে বামমনা একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। কিন্ত ক্ষমতা গ্রহনের মাত্র ৬ মাসের মাথায় বড় ধরনের আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছিলেন সিপ্রাসের নেতৃত্বাধীন Syriza-Anel সরকার। সিপ্রাস গণভোটের আয়াজন করে একটি ঝুঁকি নিয়েছিলেন, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্ত তিনি যে বিষয়টিকে জনগনের কাছে বেশি করে উপস্থাপন করেছিলেন তা হচ্ছে গ্রীক কী ‘ট্রয়কা’ এর কাছে আত্মসমর্পণ করবে, নাকি একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে টিকে থাকবে? মাত্র ৪০ বছর বয়সের সিপ্রাস তরুণ প্রজন্মের গ্রীসের রাজনীতিবিদ। একটি সম্মোহনী নেতৃত্ব তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। গ্রিক জনগণ একটি নতুন নেতৃত্বই চেয়েছিল। সিপ্রাস হচ্ছেন তাদেরেই প্রতিনিধি। তিনি আইএমএফ’র ফাঁদে ধরা দিতে চাননি। তিনি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন। তাদের কিছু শর্ত মেনেছেন। কিন্ত তাতে গ্রীসের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসেনি। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কাঠামোগত সামঞ্জস্য এর আওতায় ঋণ দেয়। এটা শর্তযুক্ত ঋণ এবং ঋণগ্রহীতা দেশকে তা মানতে হয়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো (১৯৯১ পরবর্তী) এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় (বাংলাদেশও) ঋণ পেয়ে থাকে। একই নিয়মে উন্নয়নশীল বিশ্বও ঋণ পাচ্ছে। কিন্ত তাতে করে কী ঋণগ্রহীতা দেশের অর্থনীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন এসেছে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে-
১৯৭৭-১৯৮৫ সালে পেরুতে বিশ্বব্যাংকের ফর্মূলা অনুযায়ী কাঠামোগত মাথাপিছু আয় শতকরা ২০ ভাগ কমেছিল, মুদ্রাস্ফীতি ৩০ ভাগ বেড়ে দাড়িয়েছিল ১৬০ ভাগে। সেইসাথে বেড়েছিল বেকারত্ব। একই ফল দেখা যায় ফিলিপাইনে ১৯৮৪ সালে। সেখানে কাঠামোগত সামঞ্জস্যের ফলে মাথাপিছু প্রকৃত আয় ১৯৭৫ সালের পর্যায়ে চলে যায় এবং শ্রমিকদের আয় শতকরা ৪৬ ভাগ কমে যায়। অনেক গবেষক (মৃসার জর্জ, জেমস কোভার্ড) দেখিয়েছেন সাহায্যের একটা বড় অংশ বৈদেশিক উপদেষ্টা নিয়োগ এবং তাদের নীতি অনুসরনের ফলে দাতা দেশেই টাকাটা ফিরে গেছে। উল্লেখ করতে চাই বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকেই এই তথাকথিত কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় বৈদেশিক ঋন পেয়ে আসছে।
আমি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পারবো এই নীতি অবলম্বনের ফলে সমাজতন্ত্র পরবর্তী পূর্ব ইউরোপে নব্বই এর দশকের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের জিএনপির পরিমাণ কমে গিয়েছিল। তাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাদের প্রতিটি দেশের মুদ্রার মান অনেক কমে গিয়েছিল। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বেকার সমস্যা বেড়ে গিয়েছিল। পূর্ব ইউরোপের ওইসব দেশগুলো পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিলেও, কোন একটি দেশও তখন অব্দি ১৯ সদস্য বিশিষ্ট ইউরো জোনে (যেখানে একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো চালু রয়েছে) যোগ দিতে পারেনি। এখানে আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। তা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ কর্তৃক ঋণ গ্রহনের সাথে উন্নয়নশীল বিশ্বের জাতীয়তাবাদী সরকারের পতনে একটা সম্পর্কও রয়েছে। যেমন গুয়েতেমালায় আরবেনজ সরকার ১৯৫৪ সালে, ডমিনিকান রিপাবলিকে বস ১৯৬৩ সালে, ব্রাজিলে গাউর্লাট ১৯৬৪ সালে, ঘানায় নক্রুমা ১৯৬৬ সালে, কিংবা আলেন্দে চিলিতে ১৯৭৩ সালে। চিলিতে আলেন্দে ১৯৭০-৭৩ সালে, আর্জেন্টিনায় ১৯৭২-৭৬ সালে পেরনিস্টরা, ব্রাজিলে গাউর্লাট সরকার বিশ্বব্যাংকের কোন ঋণ পায়নি। অথচ এরা যখন উৎখাত হয়, তখন সেখানে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য বেড়ে যায়। গ্রীসের পরিস্থিতি আজ এ আলোকেই বিশ্লেষণ করতে হবে।
উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো খুব কম ক্ষেত্রেই এই ‘ঋণের দুষ্টচক্র’ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। গ্রীসের পরিস্থিতি আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের মতই হবে। এই দুটো দেশই অতীতে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক তাদের স্বার্থেই দেশ দুটোকে আবারো ঋণ দিয়েছিল। যাতে দেশ দুটো ঋণের সুদ পরিশোধ করতে পারে। বা দিলে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিতে বাধ্য। এজন্যই ঋণের পরিমান বাড়লেও, পুঁজিবাদী সংস্থাগুলো তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য ভবিষ্যতে ঋণ দিয়ে যাবে। চূড়ান্ত বিচারে ‘ট্রয়কা’ তাদের স্বার্থেই গ্রীসকে আরো ঋণ দেবে। আর প্রশ্নটা এখানেই। এতে করে গ্রীসের অর্থনীতিকে আবারো পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কিনা?
এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিয়েও একটু ভাববার সময় এসেছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকে সম্প্রসারিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচীর আওতায় কাজ করে আসছে। এতে করে সরকারের ৯টি ক্ষেত্রে করনীয় কাজ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে দাতাগোষ্ঠী, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফএর পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ ঋণ গ্রহন করে এ শর্ত মেনেই। এগুলো হচ্ছে গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষিখাতে ভর্তুকী হ্রাস করা, প্রকৃত মজুরী হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারীকরণ, উচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, আমদানি অবাধ করা, মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। গ্রীসের ক্ষেত্রে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল এর সাথে অনেক ক্ষেত্রেই এর মিল আছে। ফলে আইএমএফ এর শর্তের কারনে গ্রীস যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, বাংলাদেশ যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে না পড়ে, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
গ্রীসের পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতি যে নতুন তা নয়। তাতে করে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনবে, এটা মনে করারও কোন কারন নেই। গ্রীসের নেতৃবৃন্দ দেখিয়েছেন কীভাবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতি হিসেবে বেঁচে থাকা যায়। এটাই আমাদের জন্য শিক্ষা।
Prio.com
07.07.15
২০১১ সালের পর থেকেই সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোন অমূলক ধারণা ছিল না। বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপীয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত ম্যাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। ম্যাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে সেভেন চুক্তি ও ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতোমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্বে ইউরোপের সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ ক’টি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউ’র সদস্য সংখ্যা এখন ২৮। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ইইউ’র ১৫ টি দেশের মাঝে ১১ টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৯টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এতবছর পর এই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হলো। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও, তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজী ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা
গত নয় বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ইইউ এর কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে গ্রীস, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এই দেশগুলো অতিরি্ক্ত ঋণ নিয়েও পরিস্থিতি পুরোপুরি সামাল দিতে পারছে না।
গ্রীসের পরিস্থিতি নিয়ে এখন নানা অঙ্ক কষা যায়। গ্রীস আদৌ আইএমএফ তথা ‘ট্রয়কা’ (আইএমএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) এর ‘দুষ্টচক্র’ থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কিনা, এটা একটা পশ্ন এখন। গ্রীসের এই দেউলিয়া হয়ে যাবার ঘটনা এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একটি উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রও যে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে, এটা এই প্রথমবারের মতো প্রমাণিত হলো। ফলে ইউরোপের আরো অনেক দেশ নিয়ে এই প্রশ্ন থাকল। দ্বিতীয়ত, ঋণ দাতা সংস্থা, বিশেষ করে আইএমএফ এর অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা যে কোন দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না, এটাও প্রমাণিত হলো। বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ এর নীতি একটি স্বাধীন অর্থনীতির পরিপন্থি। গ্রীসের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আইএমএফ এর প্রেসক্রিপশন ছিল পেসশনের পরিমাণ কমানো, ট্যাক্স এর পরিমাণ বাড়ানো ইত্যাদি। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর নীতি হচ্ছে ঋণগ্রহীতা দেশকে তার সুপারিশমালা অনুযায়ী চলতে বাধ্য করা। গ্রীসের বামপন্থি সরকার সেটা চায়নি।
ফলে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালের পর থেকে অর্থাৎ যখন সংকট শুরু হয় এরপর একের পর এক সরকারের পতন ঘটেছিল সেখানে। পরিস্থিতি কাটি্য়ে উঠতে সেখানে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে একটি নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে সাইরিজা (Syriza)পার্টি বিজয়ী হয়ে বামমনা একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। কিন্ত ক্ষমতা গ্রহনের মাত্র ৬ মাসের মাথায় বড় ধরনের আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছিলেন সিপ্রাসের নেতৃত্বাধীন Syriza-Anel সরকার। সিপ্রাস গণভোটের আয়াজন করে একটি ঝুঁকি নিয়েছিলেন, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্ত তিনি যে বিষয়টিকে জনগনের কাছে বেশি করে উপস্থাপন করেছিলেন তা হচ্ছে গ্রীক কী ‘ট্রয়কা’ এর কাছে আত্মসমর্পণ করবে, নাকি একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে টিকে থাকবে? মাত্র ৪০ বছর বয়সের সিপ্রাস তরুণ প্রজন্মের গ্রীসের রাজনীতিবিদ। একটি সম্মোহনী নেতৃত্ব তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। গ্রিক জনগণ একটি নতুন নেতৃত্বই চেয়েছিল। সিপ্রাস হচ্ছেন তাদেরেই প্রতিনিধি। তিনি আইএমএফ’র ফাঁদে ধরা দিতে চাননি। তিনি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন। তাদের কিছু শর্ত মেনেছেন। কিন্ত তাতে গ্রীসের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসেনি। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কাঠামোগত সামঞ্জস্য এর আওতায় ঋণ দেয়। এটা শর্তযুক্ত ঋণ এবং ঋণগ্রহীতা দেশকে তা মানতে হয়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো (১৯৯১ পরবর্তী) এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় (বাংলাদেশও) ঋণ পেয়ে থাকে। একই নিয়মে উন্নয়নশীল বিশ্বও ঋণ পাচ্ছে। কিন্ত তাতে করে কী ঋণগ্রহীতা দেশের অর্থনীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন এসেছে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে-
১৯৭৭-১৯৮৫ সালে পেরুতে বিশ্বব্যাংকের ফর্মূলা অনুযায়ী কাঠামোগত মাথাপিছু আয় শতকরা ২০ ভাগ কমেছিল, মুদ্রাস্ফীতি ৩০ ভাগ বেড়ে দাড়িয়েছিল ১৬০ ভাগে। সেইসাথে বেড়েছিল বেকারত্ব। একই ফল দেখা যায় ফিলিপাইনে ১৯৮৪ সালে। সেখানে কাঠামোগত সামঞ্জস্যের ফলে মাথাপিছু প্রকৃত আয় ১৯৭৫ সালের পর্যায়ে চলে যায় এবং শ্রমিকদের আয় শতকরা ৪৬ ভাগ কমে যায়। অনেক গবেষক (মৃসার জর্জ, জেমস কোভার্ড) দেখিয়েছেন সাহায্যের একটা বড় অংশ বৈদেশিক উপদেষ্টা নিয়োগ এবং তাদের নীতি অনুসরনের ফলে দাতা দেশেই টাকাটা ফিরে গেছে। উল্লেখ করতে চাই বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকেই এই তথাকথিত কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় বৈদেশিক ঋন পেয়ে আসছে।
আমি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পারবো এই নীতি অবলম্বনের ফলে সমাজতন্ত্র পরবর্তী পূর্ব ইউরোপে নব্বই এর দশকের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের জিএনপির পরিমাণ কমে গিয়েছিল। তাদের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাদের প্রতিটি দেশের মুদ্রার মান অনেক কমে গিয়েছিল। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বেকার সমস্যা বেড়ে গিয়েছিল। পূর্ব ইউরোপের ওইসব দেশগুলো পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিলেও, কোন একটি দেশও তখন অব্দি ১৯ সদস্য বিশিষ্ট ইউরো জোনে (যেখানে একক মুদ্রা হিসেবে ইউরো চালু রয়েছে) যোগ দিতে পারেনি। এখানে আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। তা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ কর্তৃক ঋণ গ্রহনের সাথে উন্নয়নশীল বিশ্বের জাতীয়তাবাদী সরকারের পতনে একটা সম্পর্কও রয়েছে। যেমন গুয়েতেমালায় আরবেনজ সরকার ১৯৫৪ সালে, ডমিনিকান রিপাবলিকে বস ১৯৬৩ সালে, ব্রাজিলে গাউর্লাট ১৯৬৪ সালে, ঘানায় নক্রুমা ১৯৬৬ সালে, কিংবা আলেন্দে চিলিতে ১৯৭৩ সালে। চিলিতে আলেন্দে ১৯৭০-৭৩ সালে, আর্জেন্টিনায় ১৯৭২-৭৬ সালে পেরনিস্টরা, ব্রাজিলে গাউর্লাট সরকার বিশ্বব্যাংকের কোন ঋণ পায়নি। অথচ এরা যখন উৎখাত হয়, তখন সেখানে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য বেড়ে যায়। গ্রীসের পরিস্থিতি আজ এ আলোকেই বিশ্লেষণ করতে হবে।
উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো খুব কম ক্ষেত্রেই এই ‘ঋণের দুষ্টচক্র’ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। গ্রীসের পরিস্থিতি আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের মতই হবে। এই দুটো দেশই অতীতে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বব্যাংক তাদের স্বার্থেই দেশ দুটোকে আবারো ঋণ দিয়েছিল। যাতে দেশ দুটো ঋণের সুদ পরিশোধ করতে পারে। বা দিলে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দিতে বাধ্য। এজন্যই ঋণের পরিমান বাড়লেও, পুঁজিবাদী সংস্থাগুলো তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য ভবিষ্যতে ঋণ দিয়ে যাবে। চূড়ান্ত বিচারে ‘ট্রয়কা’ তাদের স্বার্থেই গ্রীসকে আরো ঋণ দেবে। আর প্রশ্নটা এখানেই। এতে করে গ্রীসের অর্থনীতিকে আবারো পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কিনা?
এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিয়েও একটু ভাববার সময় এসেছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকে সম্প্রসারিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচীর আওতায় কাজ করে আসছে। এতে করে সরকারের ৯টি ক্ষেত্রে করনীয় কাজ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে দাতাগোষ্ঠী, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফএর পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ ঋণ গ্রহন করে এ শর্ত মেনেই। এগুলো হচ্ছে গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষিখাতে ভর্তুকী হ্রাস করা, প্রকৃত মজুরী হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারীকরণ, উচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, আমদানি অবাধ করা, মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। গ্রীসের ক্ষেত্রে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছিল এর সাথে অনেক ক্ষেত্রেই এর মিল আছে। ফলে আইএমএফ এর শর্তের কারনে গ্রীস যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, বাংলাদেশ যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে না পড়ে, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
গ্রীসের পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতি যে নতুন তা নয়। তাতে করে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনবে, এটা মনে করারও কোন কারন নেই। গ্রীসের নেতৃবৃন্দ দেখিয়েছেন কীভাবে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতি হিসেবে বেঁচে থাকা যায়। এটাই আমাদের জন্য শিক্ষা।
Prio.com
07.07.15
0 comments:
Post a Comment