মন্ত্রিসভা নিয়ে আবারও আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। বিশেষ করে ৯ জুলাই আওয়ামী লীগের
সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে তার পূর্ববর্তী
মন্ত্রণালয় (এলজিআরডি) থেকে সরিয়ে দেয়া এবং এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাকে
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা, ১৪ জুলাই নতুন একজন
পূর্ণ মন্ত্রীসহ দুজন প্রতিমন্ত্রীকে পদোন্নতি এবং দুজন নয়া প্রতিমন্ত্রী
নিয়োগের মধ্য দিয়ে মন্ত্রিসভার যে সম্প্রসারণ করা হয়েছে, তাতে সৃষ্টি হয়েছে
একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারণ বিতর্কিত, অদক্ষ মন্ত্রীদের বাদ পড়া নিয়ে
মিডিয়ায় একটি গুঞ্জন থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত কাগজ-কলমেই থেকে গেছে, বাস্তবে
রূপ পায়নি। তবে ঈদের আগে সবচেয়ে বড় আলোচনাটি ছিল সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে।
প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে একনেকের গুরুত্বপূর্ণ একটি সভায় সৈয়দ আশরাফ
অনুপস্থিত থাকায় মন্ত্রিসভায় তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করার ঘটনাটিকে
স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। একজন মন্ত্রী, তিনি যত ক্ষমতাবানই হোন না কেন, তিনি
একনেকের মতো সভায় অনুপস্থিত থাকতে পারেন না। থাকা উচিত নয়। কিন্তু সৈয়দ
আশরাফ অনুপস্থিত ছিলেন। এর আগেও তিনি একনেকের সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। শুধু
তাই নয়, গত দেড় বছরে মাত্র ৩ দিন এবং এর আগের টার্মে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে
দীর্ঘ পাঁচ বছরে অফিস করেছিলেন মাত্র ২৪ দিন। এভাবে কোনো মন্ত্রী অফিস না
করে মন্ত্রণালয় চালাতে পারেন কি-না, আমি জানি না। তবে কাজ আটকে থাকেনি।
মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা মন্ত্রণালয়ের কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অফিস না
করা এক ধরনের দায়িত্বহীনতা, নেতৃত্বে অনীহা ও অদক্ষতাই প্রমাণ করে। যেহেতু
তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক এবং তার ক্ষমতার বলয় অত্যন্ত শক্তিশালী, সেজন্য
কেউ কথা বলতে সাহস পেত না।
কিন্তু দফতরবিহীন মন্ত্রী করার সাত দিনের
মাথায় তিনি যখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন, তখন আমি অবাকই
হয়েছি! এতে প্রমাণ হল তিনি সত্যি সত্যিই মন্ত্রিসভার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এলজিআরডির মতো জনপ্রশাসনও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। এখন তিনি এখানে
কতদিন অফিস করবেন, এ প্রশ্ন আমাকে ভাবিত করে। তিনি লন্ডনে যেতে চেয়েছিলেন
বলে খবর বেরিয়েছিল। যাননি বটে; কিন্তু লন্ডনে বাংলাদেশী কমিউনিটি জানে
সেখানে তার স্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শায়লা ঠাকুর স্থায়ীভাবে
বসবাস করেন। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায় তার নিজস্ব বাড়িও রয়েছে।শোনা
যাচ্ছে, ঈদের পর মন্ত্রিসভায় আবার রদবদল হবে। তখন আরও কিছু পূর্ণ মন্ত্রী
অন্তর্ভুক্ত হবেন। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন মন্ত্রিসভায় আর কোনো রদবদল হবে
না, তবে এটা প্রধানমন্ত্রীর মর্জির ওপর নির্ভরশীল। প্রধানমন্ত্রী ভালো মনে
করলে মন্ত্রিসভায় আবার রদবদল করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রীদের
সংখ্যা বাড়িয়েই কি কেবিনেটে গতিশীলতা আনা যায়? কিংবা কেবিনেটের দক্ষতা
বাড়ানো যায়? এর জবাব হচ্ছে, না। আমি তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে দেখাতে পারব
পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ছোট মন্ত্রিসভা নিয়ে অত্যন্ত সাফল্যের
সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। যুক্তরাজ্যে কেবিনেট পদমর্যাদায় মন্ত্রী
রয়েছেন মাত্র ২১ জন। জার্মানিতে তিনটি বড় দলের সমন্বয়ে রয়েছে একটি কেবিনেট।
সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৬। এর মধ্যে চ্যান্সেলর (বা প্রধানমন্ত্রী)
অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সিডিইউ থেকে ৭ জন, একসময়ের বিরোধী দল ও এখন
কোয়ালিশনের অংশীদার এসপিডি থেকে ৬ জন, আর সিডিইউ-এর ট্রেডিশনাল পার্টনার
সিএসইউ থেকে ৩ জন। জার্মানির মতো বড় অর্থনীতির দেশে কেবিনেটের সদস্য সংখ্যা
মাত্র ১৬, এটা চিন্তা করা যায়? যুক্তরাষ্ট্রের কথা চিন্তা করুন। সেখানে
কেবিনেট পদমর্যাদার মন্ত্রীর সংখ্যা ১৫। তবে ভাইস প্রেসিডেন্টও সেখানে
কেবিনেটের অংশ। ভারতের মতো বিশাল দেশে নরেন্দ্র মোদি মাত্র ৩৪ জন মন্ত্রী
নিয়ে একটি কেবিনেট পরিচালনা করে আসছেন। অথচ বাংলাদেশে পূর্ণ মন্ত্রী আছেন
৩২ জন, ১৮ জন রয়েছেন প্রতিমন্ত্রী ও ২ জন উপমন্ত্রী। গত ১৪ জুলাই ৩ জন
পূর্ণ মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী আমরা পেয়েছি। পূর্ণ মন্ত্রীর ২ জন
পদোন্নতি পেয়েছেন। আর একজন পূর্ণ মন্ত্রী আমরা পেয়েছি নতুন।মূলত
মন্ত্রিসভায় কোনো রদবদল হয়নি। শুধু সংখ্যা বেড়েছে। গুণগত কোনো পরিবর্তন
হয়নি। এটা ছোটখাটো একটা কসমিক চেঞ্জ। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, আরও
একবার মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ ঘটবে। তখন হয়তো আমরা আরও বেশ কয়েকজন পূর্ণ
মন্ত্রী পাব। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার তা হচ্ছে, বিতর্কিত নন
এবং যোগ্য এমন ব্যক্তিদেরই যেন মন্ত্রিসভায় নেয়া হয়। একসময় যিনি পাখির মতো
সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন, বিদেশী মন্ত্রীদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছেন এবং
জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে যিনি ছিলেন উদাসীন, তিনি দলের যত বড় নেতাই হোন না
কেন, মন্ত্রিসভার ভাবমূর্তির জন্য তিনি যোগ্য ব্যক্তি নন। আরেকজনের কথা
বলি। সিলেটের শিশু রাজন হত্যার জন্য তিনি দায়ী করেন বেগম জিয়াকে!
মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উত্থানের জন্যও তিনি দায়ী করেন বেগম
জিয়াকে! তার দুর্নীতি নিয়ে যখন টিভি প্রতিবেদন দেখি তখন খটকা লাগে। এভাবে
অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে কি তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? আমার
অবজার্ভেশনটা হচ্ছে এখানেই। বড় মন্ত্রিসভার প্রয়োজন নেই। দরকার ছোট
মন্ত্রিসভা। কিন্তু তারা হবেন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন। যতদূর জানি, অতীতে
কোনো একটি কমিটির সুপারিশ ছিল এমনটাই- ২০ থেকে ২৫ জনের মধ্যে মন্ত্রিসভার
সদস্য সীমাবদ্ধ রাখা। এটাই সঠিক। সাধারণত জেলা কোটা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক
ইত্যাদি কারণে কেবিনেট সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। প্রায় ক্ষেত্রেই
যোগ্যতার বিষয়টি খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হয় না। তবে বলতেই হবে, বর্তমান
কেবিনেটে বেশ কজন সদস্য রয়েছেন, যারা স্ব স্ব মন্ত্রণালয় পরিচালনায়
যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।সাধারণত সংসদ
সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নেয়া হয়। তবে সংবিধানের ৫৬(২)
ধারা মতে টেকনোক্রেট কোটায়ও মন্ত্রী নেয়া হয় (মোট সদস্যদের দশ ভাগের এক
ভাগ)। এ ধারাটিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা
যোগ্য এবং আন্তর্জাতিক আসরে খ্যাতি অর্জন করেছেন, এমন কাউকে কাউকে
মন্ত্রিসভায় নেয়া যায়। বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যনির্ভর বিশ্বব্যবস্থায়
যেখানে নেগোসিয়েশনসের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কোনো কোনো
মন্ত্রণালয় (বাণিজ্য, শিল্প, পররাষ্ট্র, মানবসম্পদ) পরিচালনায় দক্ষ ও
যোগ্যতাসম্পন্ন মন্ত্রী প্রয়োজন। সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, দলকে
তারা সংগঠিত করেন। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির অনেক জটিল প্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক
আইন সম্পর্কে তাদের ধারণা নাও থাকতে পারে। প্রয়োজনটা এ কারণেই।মন্ত্রিসভার
সম্ভাব্য সম্প্রসারণ নিয়ে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে
উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি! কোনো কোনো মিডিয়ায় এমন আভাস দেয়া হচ্ছে যে,
আবার কেবিনেটে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। কোনো বিশেষ
ব্যক্তিকে আরও বড় দায়িত্ব দেয়ার উদ্দেশ্য সামনে রেখেই নাকি
উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে! যদিও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। এ
ধরনের সিদ্ধান্ত দলের অভ্যন্তরে আরও বিতর্ক বাড়াবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা
যাবে, একসঙ্গে একাধিক উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে কাউকে কাউকে
একোমোডেট করার জন্য! এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। জার্মানিতে একজন
উপ-প্রধানমন্ত্রী বা ভাইস চ্যান্সেলর আছেন বটে। কিন্তু যেহেতু তিনি
কোয়ালিশনের অন্যতম অংশীদার, সেটা বিবেচনায় নিয়েই এসপিডির সভাপতিকে
উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ দেয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যেও একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী
আছেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় কোনো উপ-প্রধানমন্ত্রী নেই। ভারতেও নেই।
আমাদের সংবিধানে কোনো উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ নেই। যদি উপ-প্রধানমন্ত্রী
হিসেবে কাউকে নিয়োগ দিতে হয়, তাহলে সংবিধানে সংশোধন আনতে হবে। সংসদে বিল
আকারে তা উপস্থাপন করে সংসদে তা পাস করাতে হবে। বলা ভালো, অতীতে বাংলাদেশে
উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল, যা পরে বিলুপ্ত করা হয়।বাংলাদেশ
এখন নিু-মধ্যম আয়ের দেশ। আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও
ভূমিকা বেড়েছে। ফলে বিশ্ব আসরে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে প্রয়োজন দক্ষ,
শিক্ষিত ও প্রতিনিধিত্বশীল একটি কেবিনেট। অযোগ্য ও বিতর্কিতদের বাদ দেয়া
হোক। আধুনিকমনস্ক একটি কেবিনেটই বাংলাদেশকে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে
পারে। মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের চেয়ে এ মুহূর্তে বড় প্রয়োজন মন্ত্রিসভা
পুনর্গঠন করে ছোট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা।
Daily Jugantor
23.07.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment