শেষ পর্যন্ত গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী আলেকসিস সিপ্রাস কি টিকে গেলেন? প্রথমে
আইএমএফের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা ও দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, পরে গণভোটে দাতাগোষ্ঠীর
‘প্রস্তাব’ প্রত্যাখ্যান এবং শেষ পর্যন্ত ইউরো জোনকে বাঁচাতে দাতাগোষ্ঠীর
পুনরায় ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্তে আপাতত মনে হয়েছে সিপ্রাসের হাত শক্তিশালী হয়েছে
এবং সরকার টিকে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলে? গত এক সপ্তাহে আমরা
দুটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছি। এক. গ্রিসের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে (বেইল আউট)
তৃতীয় কিস্তির ঋণ ছাড় দেয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতাদের সিদ্ধান্তের
সমালোচনা করেছে আইএমএফ। আইএমএফ বলেছে ‘গ্রিসের সাধারণ ঋণ দেশটিকে খুবই
অস্থিতিশীল করে তুলেছে।’ আইএমএফের মতে, দেশটির ঋণের দায় থেকে মুক্তি
প্রয়োজন। গ্রিসকে দেয়া ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনারও পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
আইএমএফ জানিয়ে দিয়েছে জার্মানি ও এর মিত্ররা যদি গ্রিসের ঋণের পরিমাণ না
কমায়, তাহলে দেশটিকে পরবর্তী কোনো ধরনের ঋণ ছাড়ের ব্যাপারে অংশ নেবে না
তারা। গ্রিসের মোট ঋণের ১০ শতাংশ আইএমএফ সরবরাহ করেছে। অনেকেই স্মরণ করতে
পারেন গত ৩০ জুন গ্রিসকে দেয়া আইএমএফের ঋণ পরিশোধের দ্বিতীয় ডেড লাইনের
মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু গ্রিস ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। ১৬০ কোটি ইউরো
পরিশোধ করতে না পারায় গ্রিস দেউলিয়া হয়ে যায়। আমি এর আগে এনটিভি অনলাইনে
লেখা এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম দাতাগোষ্ঠী তাদের স্বার্থেই গ্রিসকে
আবারো ঋণ দেবে। শেষ পর্যন্ত আমার কথাই সত্য প্রমাণিত হলো। ইউরো জোনের
নেতারা গ্রিসকে ইউরো জোনে রাখার স্বার্থে আবারো ৮৬০০ কোটি ইউরো ঋণ দিয়েছে।
তবে এখানেও শর্ত আছে। শেষ অবধি গ্রিসের পার্লামেন্ট ওই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন
করেছে। দুই. ইউরো জোনের এই নয়া ঋণ প্রস্তাব নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী
সিপ্রাসের সিরিজা পার্টির মাঝে বড় ধরনের বিতর্কের জš§ হয়েছে। বেশ কয়েক
মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সিরিজা পার্টির মধ্যে বড় ধরনের ‘বিদ্রোহ’ সংঘটিত
হয়েছে। দলের কট্টরপন্থিরা সিপ্রাসের এই সমঝোতার সমালোচনা করে পার্লামেন্টের
ভোটাভুটিতে সিপ্রাসবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। দল এখন ভেঙে যাওয়ার মুখে।
এমনকি সরকারের কোয়ালিশন পার্টনার ইন্ডিপেন্ডেট গ্রিক পার্টিও এই সমঝোতার
বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ফলে সিপ্রাস এক বড় ধরনের সংকটের মাঝে আছেন। তিনি
আগামী সপ্তাহেই মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করবেন এবং আভাস দিয়েছেন আগামী
সেপ্টেম্বর তিনি নয়া নির্বাচন দিয়ে পুনরায় জনগণের ম্যান্ডেট নেবেন। এখানে
বলা ভালো গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে গেল জানুয়ারি মাসে (২০১৫)
সেখানে যে নির্বাচন হয় এই নির্বাচনে বামপন্থি সিরিজা পার্টি বিজয়ী হয়ে
সিপ্রাসের নেতৃত্বে সেখানে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়েছিল। এখন যে
প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে গ্রিক কি তার অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে
আদৌ বের হয়ে আসতে পারবে? কতগুলো
পরিসংখ্যান দিলেই বোঝা যাবে সংস্কার আনতে গিয়ে গ্রিসের অর্থনীতিতে কি
পরিমাণ ধস নেমেছে। ২০১০ সালের পর ২৯ লাখ লোকের পেনশনের পরিমাণ শতকরা ৪৫ ভাগ
কমানো হয়েছে। এটা করা হয়েছে আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী। গ্রিসের মোট ঋণের
পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে ৩২০ বিলিয়ন ডলারে, যা কিনা জিডিপির শতকরা ১৮০ ভাগ।
অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ৬০ ভাগ। অর্থাৎ
কৃচ্ছ তা অবলম্বন করেও গ্রিস ঋণের পরিমাণ কমাতে পারেনি। আইএমএফের পরামর্শ
অনুসরণ করে দেশটির জিডিপির পরিমাণ কমেছে, বাড়েনি। পরিসংখ্যান বলছে ২০০৮
সালে গ্রিসের জিডিপির পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৫৪ মিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে তা কমে
এসে দাঁড়ায় ২৪২ বিলিয়ন ডলারে। এই পরিসংখ্যান বিশ্বব্যাংকের। গত ৫ বছরে,
অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংকট ও আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী চলার প্রায় কাছাকাছি সময়
থেকে গ্রিসে ১০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছে। এই মুহূর্তে কর্মক্ষম গ্রিকবাসীর
প্রতি ৪ জনের মাঝে একজন বেকার। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে প্রায় ২ লাখ গ্রিক
নাগরিক দেশ ত্যাগ করেছেন, যাদের অনেকেই দেশে ইঞ্জিনিয়ার অথবা ডাক্তার এবং
আইটি সেক্টরে কাজ করতেন। সেদিন বিবিসির এক প্রতিবেদনে দেখলাম মেলবোর্নে
প্রায় ৪ লাখ গ্রিক নাগরিক বসবাস করেন। একজন গ্রিক ব্যাংকারের সাক্ষাৎকার
প্রচার করা হয়েছিল, যিনি মেলবোর্নে (অস্ট্রেলিয়া) এখন একটি গ্রিক ক্যাফেতে
সাধারণ কাজ করেন। মাত্র ১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটিতে ১০ লাখ মানুষের
কোনো স্বাস্থ্য ইন্স্যুরেন্স নেই। যেখানে ইউরো জোনে বেকারের গড় হিসাব হচ্ছে
জনসংখ্যার ১১ দশমিক ১ ভাগ, সেখানে গ্রিসে এই সংখ্যা ২৫ দশমিক ৬ ভাগ। অথচ
২০০৮ সালে ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৮ ভাগ। গত ৫ বছর থেকেই গ্রিক আইএমএফের পরামর্শ
অনুযায়ী অর্থনীতিতে কৃচ্ছ তা সাধন করে আসছে। বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ড
বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, অথবা সেখানে কাটছাঁট করা হয়েছে। বর্তমানে বেতন কমানো
হয়েছে শতকরা ২০ ভাগ হারে। সরকারি সেক্টরে বেতন বৃদ্ধি ‘ফ্রিজ’ করে দেয়া
হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস চেয়েছিলেন ন্যূনতম বেতন ৭৫০ ইউরোতে (৮৩৫
ডলার) উন্নীত করতে। কিন্তু আইএমএফের চাপে তিনি পারেননি। গ্রিকবাসীর মাঝে
শতকরা ২০ ভাগ মানুষের বয়স ৬৫ বছর বয়সের ওপরে। ওই বুড়ো মানুষগুলোর পেনশন
কমানো হয়েছে প্রায় ৪৮ ভাগ হারে। কিন্তু তাতে করে মানুষের জীবনযাত্রার মানের
উন্নতি করা যায়নি। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার কল্যাণে বাংলাদেশে মানুষ দেখেছে
গ্রিসে ‘হোমলেস’ অথবা গৃহহীন মানুষের সংখ্যা কিভাবে বাড়ছে। এই সংখ্যা এখন
মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ২৫ ভাগ। চিন্তা করা যায় গ্রিসের মতো একটি উন্নত দেশে
শতকরা ২৫ ভাগ মানুষের থাকার কোনো জায়গা নেই।
গ্রিসের পরিস্থিতিকে অনেকে ২০০১ সালের আর্জেন্টিনার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। আর্জেন্টিনা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ঋণ দাতারা তাদের স্বার্থেই আবার আর্জেন্টিনাকে ঋণ দিয়েছিল। আজকে গ্রিসের পরিস্থিতিকে জিম্বাবুয়ে ও সোমালিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এই দেশ দুটি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মূলত বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ কাঠামোগত সামঞ্জস্য বা ঝঃৎঁপঃঁৎধষ অফলঁংঃসবহঃ-এর আওতায় এই ঋণ দিয়ে থাকে। এই ধরনের ঋণের সঙ্গে কড়া শর্ত জড়িত থাকে এবং এটা এক ধরনের সুপরিকল্পনা, যা ঋণ গ্রহীতা দেশকে অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সুপারিশমালা অনুসরণ করে ঋণ গ্রহীতা দেশ তাদের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পেরেছে। কাঠামোগত সামঞ্জস্যে যেসব সুপারিশ থাকে তার মাঝে রয়েছে, গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস করা, প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারিকরণ, উঁচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, আমদানি অবাধ করা, মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এসব সুপারিশমালা গ্রিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গ্রিসের বামপন্থি সরকার আইএমএফ কর্তৃক দেয়া এসব সুপারিশমালার অনেকগুলো গ্রহণ করেও সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তেমন উন্নতি করতে পারেনি। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো এবং সমাজতন্ত্র পরবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো (১৯৯১ পরবর্তী) এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় আমলেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আর আগের জায়গায় ফিরে যায়নি। পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ, যারা এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ছিল, তারা পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিলেও এখন পর্যন্ত তারা ইউরো জোনে যোগ দিতে পারেনি। ফলে স্পষ্টতই ইউরোপ এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। জার্মান ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে ধনী ইউরোপ, অন্যদিকে গ্রিস, পর্তুগাল কিংবা স্পেনের মতো গরিব ইউরোপ। পূর্ব ইউরোপের কথা না হয় নাই বা বললাম। সমস্যাটা এখানেই।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট যখন শুরু হয়, তখন থেকেই মোট তিন দফায় বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেও গ্রিস তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারছে না। আইএমএফ তথা ‘ট্রয়কা’র ‘প্রেসক্রিপশন’ অনুযায়ী বারেবারে বাজেট কাট, পেনশন কাট, সামাজিক খাতে ব্যয় হ্রাস করেও কোনো পজিটিভ ফল পাচ্ছে না গ্রিসের জনগণ। ফলে সেখানে ‘ট্রয়কা’ (আইএমএফ, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) বিরোধী একটি শক্তিশালী জনমত রয়েছে। সর্বশেষ যে ঋণ সিপ্রাস সরকার গ্রহণ করেছে, সেখানে যেমন শর্ত রয়েছে, তার মাঝে রয়েছে পেনশনের পরিমাণ আরো হ্রাস, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ। কিন্তু এতে করে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাই ইউরো জোনের মাঝে (১৯ সদস্য দেশ) গ্রিসকে ইউরো জোন থেকে বের করে দেয়ার দাবি শক্তিশালী হচ্ছে। জার্মানি ইউরো জোনের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। জার্মানির অর্থমন্ত্রী শোয়েবলে এবং বিরোধী ‘দি লিংকে’ দলের সভাপতি অস্কার ল্যাফোনটেন প্রকাশ্যেই বলেছেন ইউরো জোন থেকে গ্রিসের বিদায়ই একমাত্র সমাধান। কিন্তু চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল আবার গ্রিসকে ইউরো জোনে রাখার পক্ষে। আর তাকে সমর্থন করছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ। তাদের যুক্তি গ্রিস ইউরো জোনে থাকলেই ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ টিকে থাকবে। গ্রিস যদি ইউরো জোন থেকে বের হয়ে যায়, তাতে লাভবান হবে রাশিয়া। এমনকি ন্যাটোর ঐক্যও ঝুঁকির মুখে থাকবে। তাই গ্রিস নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। আপাতত গ্রিস ব্যাংকগুলো খুলেছে, অর্থনীতির কর্মকাণ্ড বাড়ছে। কিন্তু গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। Daily Manobkontho 29.07.15
গ্রিসের পরিস্থিতিকে অনেকে ২০০১ সালের আর্জেন্টিনার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেন। আর্জেন্টিনা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে ঋণ দাতারা তাদের স্বার্থেই আবার আর্জেন্টিনাকে ঋণ দিয়েছিল। আজকে গ্রিসের পরিস্থিতিকে জিম্বাবুয়ে ও সোমালিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এই দেশ দুটি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মূলত বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফ কাঠামোগত সামঞ্জস্য বা ঝঃৎঁপঃঁৎধষ অফলঁংঃসবহঃ-এর আওতায় এই ঋণ দিয়ে থাকে। এই ধরনের ঋণের সঙ্গে কড়া শর্ত জড়িত থাকে এবং এটা এক ধরনের সুপরিকল্পনা, যা ঋণ গ্রহীতা দেশকে অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই সুপারিশমালা অনুসরণ করে ঋণ গ্রহীতা দেশ তাদের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পেরেছে। কাঠামোগত সামঞ্জস্যে যেসব সুপারিশ থাকে তার মাঝে রয়েছে, গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস করা, প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারিকরণ, উঁচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, আমদানি অবাধ করা, মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এসব সুপারিশমালা গ্রিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গ্রিসের বামপন্থি সরকার আইএমএফ কর্তৃক দেয়া এসব সুপারিশমালার অনেকগুলো গ্রহণ করেও সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তেমন উন্নতি করতে পারেনি। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো এবং সমাজতন্ত্র পরবর্তী পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো (১৯৯১ পরবর্তী) এই কাঠামোগত সামঞ্জস্যের আওতায় আমলেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আর আগের জায়গায় ফিরে যায়নি। পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ, যারা এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ছিল, তারা পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিলেও এখন পর্যন্ত তারা ইউরো জোনে যোগ দিতে পারেনি। ফলে স্পষ্টতই ইউরোপ এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। জার্মান ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে ধনী ইউরোপ, অন্যদিকে গ্রিস, পর্তুগাল কিংবা স্পেনের মতো গরিব ইউরোপ। পূর্ব ইউরোপের কথা না হয় নাই বা বললাম। সমস্যাটা এখানেই।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট যখন শুরু হয়, তখন থেকেই মোট তিন দফায় বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেও গ্রিস তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারছে না। আইএমএফ তথা ‘ট্রয়কা’র ‘প্রেসক্রিপশন’ অনুযায়ী বারেবারে বাজেট কাট, পেনশন কাট, সামাজিক খাতে ব্যয় হ্রাস করেও কোনো পজিটিভ ফল পাচ্ছে না গ্রিসের জনগণ। ফলে সেখানে ‘ট্রয়কা’ (আইএমএফ, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) বিরোধী একটি শক্তিশালী জনমত রয়েছে। সর্বশেষ যে ঋণ সিপ্রাস সরকার গ্রহণ করেছে, সেখানে যেমন শর্ত রয়েছে, তার মাঝে রয়েছে পেনশনের পরিমাণ আরো হ্রাস, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ। কিন্তু এতে করে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তাই ইউরো জোনের মাঝে (১৯ সদস্য দেশ) গ্রিসকে ইউরো জোন থেকে বের করে দেয়ার দাবি শক্তিশালী হচ্ছে। জার্মানি ইউরো জোনের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। জার্মানির অর্থমন্ত্রী শোয়েবলে এবং বিরোধী ‘দি লিংকে’ দলের সভাপতি অস্কার ল্যাফোনটেন প্রকাশ্যেই বলেছেন ইউরো জোন থেকে গ্রিসের বিদায়ই একমাত্র সমাধান। কিন্তু চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল আবার গ্রিসকে ইউরো জোনে রাখার পক্ষে। আর তাকে সমর্থন করছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলান্দ। তাদের যুক্তি গ্রিস ইউরো জোনে থাকলেই ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ টিকে থাকবে। গ্রিস যদি ইউরো জোন থেকে বের হয়ে যায়, তাতে লাভবান হবে রাশিয়া। এমনকি ন্যাটোর ঐক্যও ঝুঁকির মুখে থাকবে। তাই গ্রিস নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। আপাতত গ্রিস ব্যাংকগুলো খুলেছে, অর্থনীতির কর্মকাণ্ড বাড়ছে। কিন্তু গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। Daily Manobkontho 29.07.15
0 comments:
Post a Comment