গ্রিসের
পরিস্থিতি এখন কোন দিকে? গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় শেষ পর্যন্ত
কিছু শর্তসাপেক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা পুনরায় গ্রিসকে ঋণ দিয়েছেন।
কিন্তু গ্রিসের সিপ্রাস সরকারের এ ঋণ গ্রহণের মধ্য দিয়ে গ্রিসে বড় ধরনের
বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। দলের অভ্যন্তরে বড় ধরনের এক বিদ্রোহের সম্মুখীন
হয়েছেন সিপ্রাস। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। তার কোয়ালিশন
সরকার ভেঙে গেছে। তিনি নয়া মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। এবং জনগণের ম্যান্ডেট
নেয়ার জন্য আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে নয়া নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেছেন। সব
মিলিয়ে এক বড় ধরনের অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রিস। এখানে বলা ভালো,
দাতাগোষ্ঠীর শর্ত না মানায় গেল ৩০ জুনের মধ্যে গ্রিস আইএমএফের কাছ থেকে
নেয়া ঋণের ১৬০ কোটি ইউরো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে দেশটি দেউলিয়া হয়ে
যায়। দাতাদের শর্ত গ্রহণ করা হবে কি না, এ প্রশ্নে গ্রিস সরকার একটি
গণভোটের আয়োজন করলে ভোটারদের একটি বড় অংশ এ শর্ত প্রত্যাখ্যান করে। এতে করে
প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাসের অবস্থান শক্তিশালী হলেও, শেষাবধি তিনি
দাতাগোষ্ঠীর কিছু শর্ত মেনেই পুনরায় ঋণ গ্রহণ করেন। আর্জেন্টিনা, কিংবা
স্পেনের ক্ষেত্রেও আইএমএফ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারো ঋণ
দিয়েছিল। এখন তারাই গ্রিসকে ৮ হাজার ৬০০ কোটি ইউরো ঋণ দিয়েছে। কিন্তু এতে
করে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
এক. এ ঋণ কি গ্রিসের অর্থনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে? গত প্রায় পাঁচ বছর গ্রিস এভাবেই ঋণ গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু তাতে অর্থনীতিতে পরিবর্তন এসেছে খুব সামান্যই। বরং পরিস্থিতির দিনে দিনে সেখানে অবনতি হয়েছে। দুই. গ্রিসের পরিস্থিতির সঙ্গে ইউরোপের তিনটি দেশ_ স্পেন, পর্তুগাল আর আয়ারল্যান্ডের পরিস্থিতির অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্পষ্টতই ইউরো জোনের অর্থনীতিতে দুটো ঋণের জন্ম হয়েছে। একটি ধনী ইউরোপ, যার নেতৃত্বে রয়েছে জার্মানি ও ফ্রান্স। অন্যদিকে গরিব ইউরোপ, গ্রিসের মতো দেশ যার অংশ।
তিন. জার্মানির অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন গ্রিসের ইউরো জোন (১৯টি দেশ নিয়ে গঠিত) ত্যাগ করা উচিত। আগামীতে এ বক্তব্যটি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
চার. গ্রিস যদি পুনরায় ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গ্রিস কি নবগঠিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের দিকে হাত বাড়াবে? চীন ও রাশিয়া কি এ সুযোগটি গ্রহণ করবে?
পাঁচ. গ্রিস ন্যাটোর অন্যতম সদস্য। দেশটির স্ট্রাটেজিক অবস্থানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে গ্রিস কি ন্যাটো থেকেও বের হয়ে যাবে?
ছয়. ইউরো জোনের ব্যর্থতা কি ইউরোপের অখ-তাকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে?
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তি।
অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিন্তু ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট ইইউর ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে।
এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ছয়টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। ২৮টি দেশ এখন ইইউর সদস্য। এর মাঝে আবার ২৪টি দেশ ন্যাটোর সদস্য। তবে জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এ দুটি দেশকে ন্যাটোর সদস্যপদ দিতে চাচ্ছে, যাতে রাশিয়ার রয়েছে আপত্তি।
ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো হলো ইউরোপীয় কাউন্সিল, কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দপ্তর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইন্সটিটিউট, কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোপই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। যে যুক্তি তুলে একসময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সে যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না?
২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার পঞ্চাশতম পূর্তি উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরো মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল ইউরোর সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিহ্নিত ছিল এ কারণে যে নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে পারে।
জার্মানি ও স্পেন ইইউর জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের 'ভেলভেট রেভ্যুলুশন' দেশগুলোকে সোভিয়েতনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় এবং দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এ দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউর সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া হারজেগোভিনা, কিংবা ক্রোয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকট জর্জরিত ইউরোপে আবারো মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। ২০১৩-২০১৪ সময়সীমায় ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ইইউর প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোঠায়। তাই ইউরোপ নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ তা আরো বাড়বে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এ বিভক্তির কথা বলেছিলেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা, যদিও এ বিভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কি না, কিংবা 'নতুন ইউরো'র স্বরূপ কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসন্ন, তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা-না থাকা নিয়ে গণভোট করতে চান, তখন ইউরোপের ঐক্যে যে ফাটলের জন্ম হয়েছে, তারই ইঙ্গিত দিলেন তিনি। ক্যামেরন স্পষ্ট করেই বলেছেন, আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি, তাহলে ইউরোপের পতন হবে এবং ব্রিটিশরাও পতনের দিকে যেতে থাকবে।
অতীতে ইইউ সম্পর্কে এত ভয়ংকর কথা কেউ বলেননি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত কঠিন সময় ইইউর জন্য। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায় আগামী এক দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন ইউরোপের চেহারা দেখতে পাব। ইইউতে থাকা-না থাকা নিয়ে ব্রিটেনের গণভোটের আয়োজন ও ক্যামেরনের সর্বশেষ বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক কর্মকা-ে বেশ অসন্তুষ্ট। ব্রিটেনের পর এখন দৃষ্টি গ্রিসে আবদ্ধ।
তবে সব ছাপিয়ে গেছে গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গ্রিসের সংসদের অধিকাংশ সদস্য ৫ জুলাইয়ের গণভোটে 'না' ভোটের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ঋণদাতা দেশগুলো যে সংস্কারের কথা বলেছে, অর্থাৎ বাজেট কাট এর কথা বলছিল, তাতে সংসদের আপত্তি রয়েছে, যদিও সিপ্রাস সে শর্তই মেনে নিলেন। গণভোটে 'না' ভোট জয়যুক্ত হয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে গ্রিসের জনমত ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। শেষাবধি গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি না, তাও একটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কিংবা এমনও হতে পারে, গ্রিস ব্রিটেন ও ডেনমার্কের মতো অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকেও নিজস্ব মুদ্রা তারা ব্যবহার করবে। যেমন ব্রিটেনে ইউরো চালু না হওয়ায় এখনো পাউন্ড সেখানে চালু রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে গ্রিস তার পুরনো মুদ্রা ড্রাকমা পুনরায় চালু করবে, এটাই বাস্তবতা। তবে সব কিছু নির্ভর করছে আগামী তিন বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। এখানে এ কথা বলা প্রয়োজন, গ্রিস যদি ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যায়, এর একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বের অর্থনীতিতেই পড়বে। ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি স্টক এক্সচেঞ্জ মার্কেটের পতন ঘটেছে। শুধু অস্ট্রেলিয়ার স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার 'হাওয়া' হয়ে গেছে। মুদ্রা হিসেবে ডলারের মানও কমে গেছে। বলা হচ্ছে, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২০১৬ সালে এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ০.৩ ভাগ কমে যাবে। সুতরাং সারা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। গ্রিস ব্যর্থ হলে এর প্রতিক্রিয়া পড়বে পর্তুগাল, স্পেন ও আয়ারল্যান্ডেও। Daily Jai jai Din 23.07.15
এক. এ ঋণ কি গ্রিসের অর্থনীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে? গত প্রায় পাঁচ বছর গ্রিস এভাবেই ঋণ গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু তাতে অর্থনীতিতে পরিবর্তন এসেছে খুব সামান্যই। বরং পরিস্থিতির দিনে দিনে সেখানে অবনতি হয়েছে। দুই. গ্রিসের পরিস্থিতির সঙ্গে ইউরোপের তিনটি দেশ_ স্পেন, পর্তুগাল আর আয়ারল্যান্ডের পরিস্থিতির অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্পষ্টতই ইউরো জোনের অর্থনীতিতে দুটো ঋণের জন্ম হয়েছে। একটি ধনী ইউরোপ, যার নেতৃত্বে রয়েছে জার্মানি ও ফ্রান্স। অন্যদিকে গরিব ইউরোপ, গ্রিসের মতো দেশ যার অংশ।
তিন. জার্মানির অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন গ্রিসের ইউরো জোন (১৯টি দেশ নিয়ে গঠিত) ত্যাগ করা উচিত। আগামীতে এ বক্তব্যটি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
চার. গ্রিস যদি পুনরায় ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গ্রিস কি নবগঠিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের দিকে হাত বাড়াবে? চীন ও রাশিয়া কি এ সুযোগটি গ্রহণ করবে?
পাঁচ. গ্রিস ন্যাটোর অন্যতম সদস্য। দেশটির স্ট্রাটেজিক অবস্থানও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিস্থিতিতে গ্রিস কি ন্যাটো থেকেও বের হয়ে যাবে?
ছয়. ইউরো জোনের ব্যর্থতা কি ইউরোপের অখ-তাকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে?
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তি।
অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিন্তু ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট ইইউর ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে।
এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ছয়টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। ২৮টি দেশ এখন ইইউর সদস্য। এর মাঝে আবার ২৪টি দেশ ন্যাটোর সদস্য। তবে জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এ দুটি দেশকে ন্যাটোর সদস্যপদ দিতে চাচ্ছে, যাতে রাশিয়ার রয়েছে আপত্তি।
ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো হলো ইউরোপীয় কাউন্সিল, কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দপ্তর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইন্সটিটিউট, কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোপই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। যে যুক্তি তুলে একসময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সে যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না?
২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার পঞ্চাশতম পূর্তি উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরো মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল ইউরোর সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিহ্নিত ছিল এ কারণে যে নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে খেপিয়ে তুলতে পারে।
জার্মানি ও স্পেন ইইউর জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের 'ভেলভেট রেভ্যুলুশন' দেশগুলোকে সোভিয়েতনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় এবং দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এ দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউর সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া হারজেগোভিনা, কিংবা ক্রোয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকট জর্জরিত ইউরোপে আবারো মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে। ২০১৩-২০১৪ সময়সীমায় ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ইইউর প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোঠায়। তাই ইউরোপ নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। এখন ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ তা আরো বাড়বে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এ বিভক্তির কথা বলেছিলেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা, যদিও এ বিভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কি না, কিংবা 'নতুন ইউরো'র স্বরূপ কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসন্ন, তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা-না থাকা নিয়ে গণভোট করতে চান, তখন ইউরোপের ঐক্যে যে ফাটলের জন্ম হয়েছে, তারই ইঙ্গিত দিলেন তিনি। ক্যামেরন স্পষ্ট করেই বলেছেন, আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি, তাহলে ইউরোপের পতন হবে এবং ব্রিটিশরাও পতনের দিকে যেতে থাকবে।
অতীতে ইইউ সম্পর্কে এত ভয়ংকর কথা কেউ বলেননি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত কঠিন সময় ইইউর জন্য। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায় আগামী এক দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন ইউরোপের চেহারা দেখতে পাব। ইইউতে থাকা-না থাকা নিয়ে ব্রিটেনের গণভোটের আয়োজন ও ক্যামেরনের সর্বশেষ বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক কর্মকা-ে বেশ অসন্তুষ্ট। ব্রিটেনের পর এখন দৃষ্টি গ্রিসে আবদ্ধ।
তবে সব ছাপিয়ে গেছে গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গ্রিসের সংসদের অধিকাংশ সদস্য ৫ জুলাইয়ের গণভোটে 'না' ভোটের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ঋণদাতা দেশগুলো যে সংস্কারের কথা বলেছে, অর্থাৎ বাজেট কাট এর কথা বলছিল, তাতে সংসদের আপত্তি রয়েছে, যদিও সিপ্রাস সে শর্তই মেনে নিলেন। গণভোটে 'না' ভোট জয়যুক্ত হয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে গ্রিসের জনমত ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। শেষাবধি গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি না, তাও একটা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কিংবা এমনও হতে পারে, গ্রিস ব্রিটেন ও ডেনমার্কের মতো অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকেও নিজস্ব মুদ্রা তারা ব্যবহার করবে। যেমন ব্রিটেনে ইউরো চালু না হওয়ায় এখনো পাউন্ড সেখানে চালু রয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে গ্রিস তার পুরনো মুদ্রা ড্রাকমা পুনরায় চালু করবে, এটাই বাস্তবতা। তবে সব কিছু নির্ভর করছে আগামী তিন বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। এখানে এ কথা বলা প্রয়োজন, গ্রিস যদি ইউরো জোন থেকে বেরিয়ে যায়, এর একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বের অর্থনীতিতেই পড়বে। ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি স্টক এক্সচেঞ্জ মার্কেটের পতন ঘটেছে। শুধু অস্ট্রেলিয়ার স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার 'হাওয়া' হয়ে গেছে। মুদ্রা হিসেবে ডলারের মানও কমে গেছে। বলা হচ্ছে, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২০১৬ সালে এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ০.৩ ভাগ কমে যাবে। সুতরাং সারা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। গ্রিস ব্যর্থ হলে এর প্রতিক্রিয়া পড়বে পর্তুগাল, স্পেন ও আয়ারল্যান্ডেও। Daily Jai jai Din 23.07.15
0 comments:
Post a Comment