রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পারমাণবিক চুক্তির ভবিষ্যৎ

ভিয়েনায় দীর্ঘ ১৭ দিন আলাপ-আলোচনার পর গত মঙ্গলবার ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় জাতির যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাকে 'ঐতিহাসিক' আখ্যায়িত করা হলেও চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথমত, মার্কিন কংগ্রেসে চুক্তিটি অনুমোদিত হতে হবে। না হলে চুক্তিটির কার্যকারিতা থাকবে না। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ, সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ এখন ওবামাবিরোধী রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে এই চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন। ওবামার ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকরাও সবাই যে খুশি নয় তা-ও তাদের কারো কারো মন্তব্যে মনে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হচ্ছে ইসরায়েল। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছেন যে 'এটা একটা ঐতিহাসিক ভুল।' ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ চুক্তির কোনো কোনো ধারা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ওই চুক্তির প্রশংসা এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এই চুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করলেও ঈশান কোণে একটি 'কালো মেঘ' থাকলই। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে- এই অভিযোগ তুলে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বাতিল করার দাবিসংবলিত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর অন্তত এ-সংক্রান্ত আরো ছয়টি প্রস্তাব পরে গ্রহণ করা হয়েছে এবং ইরান ওই কর্মসূচি বাতিল না করায় ২০১০ সালে জাতিসংঘ ইরানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার সম্পদ জব্দসহ দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে ২০০৬ সাল থেকেই ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি) আলোচনা চলে আসছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে ২০১৩ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত হাসান রুহানি বিজয়ী হলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। ফলে এই ছয় জাতি আলোচনা আরো গতি পায়। গেল বছরের নভেম্বরে একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং এপ্রিলে (২০১৫) সুইজারল্যান্ডের লুজানে একটি খসড়া চুক্তিতে ইরান ও ছয় জাতি উপনীত হয়। গত ৩০ জুনের মধ্যে এই খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু তা হয়নি। এখন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অন্তত একটি জিনিস স্পষ্ট হলো আর তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই সম্পর্ক আরো উন্নত করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে, প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে এখনো ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের পর দীর্ঘ ৪৪৪ দিন রেভল্যুশনারি স্টুডেন্টস কর্তৃক তেহরানের মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেওয়ার ঘটনার স্মৃতি একটি 'ক্ষতচিহ্ন' হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনাটা অতি সহজ ছিল না। এরপর যোগ হয় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ওই ঘটনার দীর্ঘ ৩৬ বছর পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এই দেশ দুটিকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এর ফলেই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো যুক্তরাষ্ট্রের 'বন্ধু' ইসরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিস্টরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়ায় জঙ্গিবাদী ইসলামিক স্টেটের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে হলে তাদের ইরানের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, গেল নভেম্বর মাসে (২০১৪) বারাক ওবামা স্বীকার করেছিলেন তিনি গোপনে ইরানি সমর্থন চেয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। প্রত্যুত্তরে খামেনিও তাঁকে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পরে ইয়েমেনে 'হুথি বিদ্রোহ' প্রমাণ করল এখানেও একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনে ইরানের সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। কেননা হুথিরা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ আছে, হুথি বিদ্রোহীরা ইরান থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকে; যদিও ইরান বারবার তা অস্বীকার করে আসছে। এখন 'ইরান চুক্তি' স্বাক্ষরিত হওয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক আরো স্বাভাবিক হবে ও যুক্তরাষ্ট্র এটাই চাইছে। একটি সৌদি-ইরান জোট পারস্য অঞ্চলের রাজনীতিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক, এটা চাইবে মার্কিন স্ট্যাটেজিস্টরা। একই কথা প্রযোজ্য সিরিয়ার ক্ষেত্রেও। তবে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখানে উল্লেখ করার মতো। যুক্তরাষ্ট্র যদি 'ইরান চুক্তি'র পরও সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের বিরোধ জিইয়ে রাখে, তাহলে এ অঞ্চলে আইএসের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়বে।
১০৭ পৃষ্ঠাব্যাপী 'ইরান চুক্তি'তে ইরানের করণীয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে চুক্তির দুটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, চুক্তিতে ইরানের পরমাণু তৎপরতা কমিয়ে আনা হবে এবং পূর্ণ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ থাকবে ইরানের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। ইরান কোনো কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্য দেশে স্থানান্তর করবে এবং ভবিষ্যতে নতুন কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে না। দ্বিতীয়ত, ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে শিথিল করা হবে। তবে ইরানের ওপর থেকে অস্ত্র রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আপাতত তুলে নেওয়া হচ্ছে না। এখন ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে ইরান এ অঞ্চলে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। ইরানে বিনিয়োগ বাড়বে। বিশেষ করে ইরানের গ্যাস ও তেল সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়বে। তবে অনেক বিষয়ের ওপর এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এক. ইসরায়েলের বিরোধিতা ও মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের আপত্তির মুখে এই চুক্তি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (নভেম্বর ২০১৬) বিষয়টি একটি ইস্যু হয়ে যেতে পারে। দুই. ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সমর্থনের ওপর নির্ভর করছে এই চুক্তির ভবিষ্যৎ। ইরানের সনাতন ধর্মীয় নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করতে পারেন এবং আয়াতুল্লাহ খামেনিকে এই চুক্তিবিরোধী অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারেন। তিন. ইরানের উদারপন্থীদের জন্য এটা একটা টেস্ট কেস। প্রেসিডেন্ট রুহানির ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে এই চুক্তির ফলাফলের ওপর। ২০১৬ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচন ও ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুহানি পুনর্নির্বাচিত হবেন কি না, সেটা এই চুক্তির ওপর নির্ভর করছে। Daily Kalerkontho 16.07.15

0 comments:

Post a Comment