গেল
সপ্তাহে একটি বড় ধরনের সংবাদের জন্ম হয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থায়।
চীনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে 'এশিয়ার ইনফ্রাকট্রাকসার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক'
বা এশিয়ার অবকাঠামো বিনিয়োগে ব্যাংক (এআইআইবি)। এই ব্যাংকে বলা হচ্ছে
বিকল্প বিশ্বব্যাংক। মোট ৫৭টি দেশ নিয়ে এই ব্যাংকের যাত্রা শুরু। মোট
মূলধনের পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চীন জোগান দিয়েছে ২৯ দশমিক ৭৮
ভাগ অর্থ। এর পরের অবস্থান ভারতের। ভারতের অর্থের পরিমাণ ৮ দশমিক ৩৭ ভাগ।
তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি ৪ দশমিক ৪৮ ভাগ।
ফ্রান্স ও ব্রিটেনের অবস্থান আরো অনেক পরে। বলাই বাহুল্য যুক্তরাষ্ট্র যেমনি আইআইবির সদস্য হয়নি, ঠিক তেমনি জাপানও এর সদস্য নয়। বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশ এই ব্যাংকের সদস্য। সম্প্রতি গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবগতি হলে এবং রাষ্ট্রটি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে উন্নয়নশীল বিশ্বে আইএমএফের ঋণ নীতি আবারো আলোচনায় আসে। আইএমএফ শর্ত সাপেক্ষে গ্রিসকে আরো ঋণ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রিস সরকার তাতে রাজি হয়নি। ফলে রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হয়ে যায় এবং ইউরো জোন থেকে দেশটির সিটকে পড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে এআইআইবির জন্ম যেসব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন এক চমক সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যেভাবে ভারত মহাসাগরে এই দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তাতে এই ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। এখন দেখার পালা যৌথভাবে একটি বিকল্প বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেও, এই দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়।
চীন ও ভারত সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও, ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে উভয় শক্তিই এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। প্রভাব বিস্তার করার এই যে প্রতিযোগিতা, এই প্রতিযোগিতায় এ অঞ্চলের দেশগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আর ভারত ইতোমধ্যে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ভারত তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে শুরু করছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা আগামীতে চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে।
ভারতের নীতি-নির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি সহ্য করবেন না। ভুবনেশ্বর আইওআর সম্মেলনে (মার্চ, ২০১৫) এই ম্যাসেজটি তারা দিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও এ দুটো দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলংকায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে জাফনা কার্ড ব্যবহার করা, প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন ভারত প্রাচীনকালে তার কটন রুট ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় প-িতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র্র চোলের আমলে নৌবাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌবাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট, তাতে দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিশর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, আবার অন্যদিকে শ্রীলংকা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মলি্লকা প্রণালি), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি সরকার এই কটন রুটকেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা তথা স্মৃতি এই সমুদ্র পথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। একদিকে চীনা নেতা শি জিন পিং তার সিল্ক রুটের ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব যেমনি প্রতিষ্ঠা করতে চান, এর প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত তার পুরনো কটন রুটের ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হবে সেখানেই। বাণিজ্যনির্ভর এই দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরো বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।
বলা হয় একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি, চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিকল্প রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রে বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ার মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। সম্প্রতি চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের ধারণা এতে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃক, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশে এই সিল্করোডটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সিল্করোডের মাধমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পেঁৗছে যেত। এর মধ্যদিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের নয়া প্রেসিডেন্টের নামকরণ করেছেন 'নিউ সিল্করোড ইকোনমিক বেল্ট'। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি 'মেরিটাইম সিল্করুট'-এর কথাও আমরা জানি, যা কিনা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই মেরিটাইম সিল্ক রুটের ধারণাও কয়েকশ বছরের। এই মেরিটাইম সিল্ক রুট ধরে চীনা অ্যাডমিরাল ঝেং হে (মা হে) ১৪০৫ সাল থেকে ১৪৩৩ সাল এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে চীনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৪২১-১৪৩১ সালে তিনি দুবার তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে এসেছিলেন। চীন এই নৌরুটটি নতুন করে আবার ব্যবহার করতে চায়। তবে কয়েকশ বছরের ব্যবধানে এই অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। চীন আর একক শক্তি নয়। ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়েই তার নিজের স্বার্থ আদায় করতে চায়। ফলে এটা স্বার্থ নয় ভারত-চীন সম্পর্ক আগামিতে কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে। কেননা ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। মৎস্য সম্পদ থেকে শুরু করে জ্বালানি সম্পদ ও জ্বালানি সম্পদ সরবরাহের অন্যতম রুট হচ্ছে এই ভারত মহাসাগর। পরিবর্তিত রাজনীতির কারণে এই সামুদ্রিক রুটের গুরুত্ব বাড়ছে। এই সামুদ্রিক রুটের গুরুত্ব অনুধাবন করেই চীন এ অঞ্চলে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি দাঁড়িয়েছে। এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থও বিঘি্নত হচ্ছে। ভারত তাই এ অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোতে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব বাড়াচ্ছে। ফলে এক ধরনের স্নায়ুবিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে এশিয়ার প্রভাবশালী এই দেশ দুটোর মধ্যে। গেল মে মাসে (২০১৫) রোড মোদি বেইজিং সফর করেন। ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে ভারতীয় তৎপরতা দি-পাক্ষিক আলোচনায় আদৌ স্থান না পেলেও, চীনা নেতারা বিষয়টি জানেন ও বোঝেনও। মোদি নিজে চীনের ব্যাপারে যতই আগ্রহী থাকুক না কেন, ভারতে একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আছে। এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সব সময় বড় করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে ভারতের এক ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে, তা নয়। বরং শিল্পের কার্গো শিপমেন্টের অর্ধেক পরিবাহিত হয় এই ভারত মহাসাগর দিয়ে। একই সঙ্গে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ, এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর অন্যত্র যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানিকৃত পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগ পরিচালিত হয় এই সামুদ্রিক রুট ব্যবহার করে। সুতরাং এই সমুদ্র পথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে।
এই সমুদ্র পথে কর্তৃত্ব বৃদ্ধির প্রশ্নেই চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ অনিবার্য। এই দ্বন্দ্ব ও বিবাদ দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে, তা ভেস্তে যেতে পারে। ফলে এ আইআইবির বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যদিও এটা সত্য চীন ও ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এখন ব্যবসা ও বিনিয়োগকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ থাকলেও এই বিবাদকে এক পাশে সরিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট গেল বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত সফর করেছিলেন। আর গত মে মাসে মোদি চীন সফর করে এলেন। এতেই বোঝা যায় দুই দেশই সীমান্ত বিরোধকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং একটি দ্বৈতনীতি গ্রহণ করছেন। ভারত মহাসাগরে উভয় দেশের স্বার্থ রয়েছে। এই স্বার্থ থাকবে। তবে ব্যবসা ও বিনিয়োগ নীতিতে উভয় দেশের নীতি এক ও অভিন্ন।
সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কর্তৃত্ব হ্রাস ও একটি সুস্থ অর্থনীতি প্রবর্তনে দুই দেশের অবস্থান এক। এ কারণেই এআইআইবি টিকে থাকবে। Daily Jai Jai Din 07.07.15
ফ্রান্স ও ব্রিটেনের অবস্থান আরো অনেক পরে। বলাই বাহুল্য যুক্তরাষ্ট্র যেমনি আইআইবির সদস্য হয়নি, ঠিক তেমনি জাপানও এর সদস্য নয়। বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশ এই ব্যাংকের সদস্য। সম্প্রতি গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবগতি হলে এবং রাষ্ট্রটি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে উন্নয়নশীল বিশ্বে আইএমএফের ঋণ নীতি আবারো আলোচনায় আসে। আইএমএফ শর্ত সাপেক্ষে গ্রিসকে আরো ঋণ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রিস সরকার তাতে রাজি হয়নি। ফলে রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হয়ে যায় এবং ইউরো জোন থেকে দেশটির সিটকে পড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে এআইআইবির জন্ম যেসব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন এক চমক সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যেভাবে ভারত মহাসাগরে এই দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তাতে এই ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। এখন দেখার পালা যৌথভাবে একটি বিকল্প বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেও, এই দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়।
চীন ও ভারত সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও, ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে উভয় শক্তিই এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। প্রভাব বিস্তার করার এই যে প্রতিযোগিতা, এই প্রতিযোগিতায় এ অঞ্চলের দেশগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আর ভারত ইতোমধ্যে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ভারত তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে শুরু করছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা আগামীতে চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে।
ভারতের নীতি-নির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি সহ্য করবেন না। ভুবনেশ্বর আইওআর সম্মেলনে (মার্চ, ২০১৫) এই ম্যাসেজটি তারা দিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও এ দুটো দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলংকায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে জাফনা কার্ড ব্যবহার করা, প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন ভারত প্রাচীনকালে তার কটন রুট ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় প-িতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র্র চোলের আমলে নৌবাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌবাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট, তাতে দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিশর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, আবার অন্যদিকে শ্রীলংকা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মলি্লকা প্রণালি), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি সরকার এই কটন রুটকেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা তথা স্মৃতি এই সমুদ্র পথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। একদিকে চীনা নেতা শি জিন পিং তার সিল্ক রুটের ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব যেমনি প্রতিষ্ঠা করতে চান, এর প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত তার পুরনো কটন রুটের ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হবে সেখানেই। বাণিজ্যনির্ভর এই দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরো বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।
বলা হয় একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি, চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিকল্প রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রে বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ার মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। সম্প্রতি চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের ধারণা এতে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃক, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশে এই সিল্করোডটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সিল্করোডের মাধমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পেঁৗছে যেত। এর মধ্যদিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের নয়া প্রেসিডেন্টের নামকরণ করেছেন 'নিউ সিল্করোড ইকোনমিক বেল্ট'। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি 'মেরিটাইম সিল্করুট'-এর কথাও আমরা জানি, যা কিনা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই মেরিটাইম সিল্ক রুটের ধারণাও কয়েকশ বছরের। এই মেরিটাইম সিল্ক রুট ধরে চীনা অ্যাডমিরাল ঝেং হে (মা হে) ১৪০৫ সাল থেকে ১৪৩৩ সাল এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে চীনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৪২১-১৪৩১ সালে তিনি দুবার তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে এসেছিলেন। চীন এই নৌরুটটি নতুন করে আবার ব্যবহার করতে চায়। তবে কয়েকশ বছরের ব্যবধানে এই অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। চীন আর একক শক্তি নয়। ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়েই তার নিজের স্বার্থ আদায় করতে চায়। ফলে এটা স্বার্থ নয় ভারত-চীন সম্পর্ক আগামিতে কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে। কেননা ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। মৎস্য সম্পদ থেকে শুরু করে জ্বালানি সম্পদ ও জ্বালানি সম্পদ সরবরাহের অন্যতম রুট হচ্ছে এই ভারত মহাসাগর। পরিবর্তিত রাজনীতির কারণে এই সামুদ্রিক রুটের গুরুত্ব বাড়ছে। এই সামুদ্রিক রুটের গুরুত্ব অনুধাবন করেই চীন এ অঞ্চলে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি দাঁড়িয়েছে। এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থও বিঘি্নত হচ্ছে। ভারত তাই এ অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোতে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব বাড়াচ্ছে। ফলে এক ধরনের স্নায়ুবিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে এশিয়ার প্রভাবশালী এই দেশ দুটোর মধ্যে। গেল মে মাসে (২০১৫) রোড মোদি বেইজিং সফর করেন। ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে ভারতীয় তৎপরতা দি-পাক্ষিক আলোচনায় আদৌ স্থান না পেলেও, চীনা নেতারা বিষয়টি জানেন ও বোঝেনও। মোদি নিজে চীনের ব্যাপারে যতই আগ্রহী থাকুক না কেন, ভারতে একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আছে। এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সব সময় বড় করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যে ভারতের এক ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে, তা নয়। বরং শিল্পের কার্গো শিপমেন্টের অর্ধেক পরিবাহিত হয় এই ভারত মহাসাগর দিয়ে। একই সঙ্গে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ, এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর অন্যত্র যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানিকৃত পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগ পরিচালিত হয় এই সামুদ্রিক রুট ব্যবহার করে। সুতরাং এই সমুদ্র পথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে।
এই সমুদ্র পথে কর্তৃত্ব বৃদ্ধির প্রশ্নেই চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ অনিবার্য। এই দ্বন্দ্ব ও বিবাদ দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছে, তা ভেস্তে যেতে পারে। ফলে এ আইআইবির বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যদিও এটা সত্য চীন ও ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এখন ব্যবসা ও বিনিয়োগকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ থাকলেও এই বিবাদকে এক পাশে সরিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট গেল বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত সফর করেছিলেন। আর গত মে মাসে মোদি চীন সফর করে এলেন। এতেই বোঝা যায় দুই দেশই সীমান্ত বিরোধকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং একটি দ্বৈতনীতি গ্রহণ করছেন। ভারত মহাসাগরে উভয় দেশের স্বার্থ রয়েছে। এই স্বার্থ থাকবে। তবে ব্যবসা ও বিনিয়োগ নীতিতে উভয় দেশের নীতি এক ও অভিন্ন।
সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কর্তৃত্ব হ্রাস ও একটি সুস্থ অর্থনীতি প্রবর্তনে দুই দেশের অবস্থান এক। এ কারণেই এআইআইবি টিকে থাকবে। Daily Jai Jai Din 07.07.15
0 comments:
Post a Comment