রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ছোট মন্ত্রীসভা

মন্ত্রীসভায় ৩ জন নতুন মন্ত্রীর অন্তর্ভূক্তির মধ্য দিয়ে মন্ত্রীসভার সম্প্রসারণ ঘটেছে বটে, কিন্তু এতে কোন চমক নেই। গত মঙ্গলবার মোট পাঁচ মন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। এর মাঝে তিনজন পূর্ণমন্ত্রী, দুজন প্রতিমন্ত্রী এবং নবাগত। পূর্ণমন্ত্রীদের একজন নতুন, বাকি দু’জনের পদোন্নতি ঘটেছে। মিডিয়ায় একটি গুঞ্জন ছিল যে বিতর্কিত অন্তত দুজন পূর্ণমন্ত্রী বাদ পড়তে পারেন। কিন্তু মন্ত্রীসভা সম্প্রসারণে তারা বাদ পড়লেন না। বহাল তবিয়তেই তারা আছেন। তবে বিতর্কিত একজন মন্ত্রীর সাথে নয়া একজন প্রতিমন্ত্রীকে জুড়ে দেয়া হয়েছে। আর সৈয়দ আশরাফকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন মন্ত্রী করা হয়েছে।
মন্ত্রীসভায় রদবদল একটি স্বাভাবিক ঘটনা এবং সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী তার ‘সন্তুষ্টি সাপেক্ষে’ যে কাউকে মন্ত্রী করতে পারেন। যাদেরকে পদোন্নতি দেয়া হলো কিংবা নতুন যাদের নেয়া হলো, তাদের কোন যোগ্যতাবলে নেয়া হলো আমি বলতে পারবো না। তবে এদের নিয়েও সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন, তাকে পূর্ণমন্ত্রী করা হয়েছে। বিএনপির বিগত ‘ব্যর্থ আন্দোলন’ দমনে তিনি সফল ছিলেন। কিন্তু তিনমাসের জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি, বাসে আগুন লাগিয়ে নিরীহ মানুষদের হত্যা করা তিনি বন্ধ করতে পারেন নি। তার প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে কোন কোন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আন্তর্জাতিক আসরে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। একসময় ‘গুম’ আতংক বাড়লেও এখন অবশ্য তা কমে এসেছে। মানুষের মনে স্বস্তি নেমে এসেছে। তার প্লাস পয়েন্ট ছিল একটাই- প্রতিমন্ত্রী হয়েও তিনি পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্বই পালন করছিলেন। এখন বাঁধাটা সরে গেল। এখন তিনি পূর্ণমন্ত্রী।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। অতীতে যারাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেছেন, তারাই বিতর্কিত হয়েছেন কোন না কোনভাবে। অনেক বাঘা বাঘা আওয়ামী লীগ নেতাও অতীতে মন্ত্রণালয় পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন দেখার পালা আসাদুজ্জামান খান কামাল কীভাবে আগামীতে পরিচিত হন।তবে তিনি মিডিয়াবান্ধব। আমার অনেক পরিচিত মিডিয়াকর্মীকে আমি দেখেছি সরাসরি তাকে ফোন করতে এবং তিনি তা রিসিভও করতেন। সজ্জন ব্যক্তি তিনি। বোধকরি এটা তার আরেকটি প্লাস পয়েন্ট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি চ্যলেঞ্জিং জায়গা। এখানে শক্ত নেতৃত্ব দরকার। পুলিশ বাহিনীর দূর্নীতি নিয়ন্ত্রণ তথা ভাবমূর্তি উদ্ধারে তার ভূমিকার দিকে এখন তাকিয়ে থাকবে পুরো জাতি।
বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে যিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, তিনি পদোন্নতি পেয়ে পূর্ণমন্ত্রী হলেন। তিনি সংসদ সদস্য নন। একজন ছড়াকার। মিডিয়া জগতে একটা কথা চালু আছে, যা সত্য কি মিথ্যা আমি বলতে পারবো না। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটি ছড়া লিখে ‘পুরস্কার’ হিসেবে প্রথম মন্ত্রীসভায় ছোটমন্ত্রী হিসেবে জায়গা পেয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর একজন সদস্য ও প্রয়াত ব্যক্তিত্ব শওকত ওসমানের সন্তান। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে তার কোন উল্লেখযোগ্য অবদান আমার চোখে পড়েনি। এমনকি তিনি তার মন্ত্রণালয়ে খুব বেশি ‘অগ্রগতি’ সাধন করেছেন এটাও বলা যাবেনা। তিনি এখনও ছড়া লেখেন এবং নি:শন্দেহে একজন সজ্জন ব্যক্তি। ইয়াফেস ওসমানের সাফল্য বোধহয় এখানেই যে তিনি নিজেকে দুর্নীতি ও সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে পেরেছেন।
নুরুল ইসলাম বিএসসি স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে তার জীবন শুরু করলেও তিনি এখন চট্রগ্রামের একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে বেশ কিছুদিন যাবৎ ছোট্র একটি কলাম লিখে আসছেন নিয়মিত। তিনি চট্রগ্রাম-৮ আসনে জাতীয় সংসদ (৫ জানুয়ারি) নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির সাথে সমঝোতার ফলশ্রুতিতে ওই আসনটি দেয়া হয় জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদককে। তখন প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন ভবিষ্যতে তাঁকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। এখন প্রধানমন্ত্রী তাকে পূর্ণমন্ত্রী বানিয়ে পুরস্কৃত করলেন। প্রধানমন্ত্রী তার কথা রেখেছেন। এভাবেই প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেন। অতীতেও তিনি কথা রেখেছিলেন। এখন যিনি ধর্মমন্ত্রী তাঁকেও তিনি কথা দিয়েছিলেন। সে কথা তিনি রেখেছেন। দিলীপ বড়ুয়ার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। জীবনে কোন নির্বাচনে সাম্যবাদী দলের এই নেতা পাঁচশ ভোটের উপর পাননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। তার দলটি আবার ১৪ হলের শরিক দল। ফলে সংগত কারনেই তার আসনটিতে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী তখন দিলীপ বড়ুয়াকে কথা দিয়েছিলেন। জীবনে যিনি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেননি, তিনি শুধুমাত্র এবং একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদে পূর্ণমন্ত্রী হন। তবে দিলীপ বড়ুয়া কথা রাখেন নি। সারাজীবন বাম রাজনীতি করেও নানারকম দুর্নীতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য কেউই প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেননি। তবে নুরুল ইসলাম বিএসসি ৭৩ বছর বয়সে এসে মন্ত্রী হয়ে কতটুকু বিতর্কের উর্ধ্বে থাকতে পারবেন জানিনা। একজন ব্যবসায়ী যখন মন্ত্রী হয় তিনি কখনোই নিজেকে ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর উর্ধ্বে থাকতে পারেন না। একজন ব্যবসায়ীকে মন্ত্রী না করাই ভালো। দু’জন প্রতিমন্ত্রী নিয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই। সাধারণত তরুন প্রজন্মের ছোট মন্ত্রীরা সমাজের জন্য মডেল হন। তাদেরকে দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হন। এক্ষেত্রে কারো পারিবারিক জীবন নিয়ে যকি স্ক্যান্ডাল হয়, যদি তিনি মিডিয়ার আলোচনার খোরাক হন, তিনি তখন আর তরুণ সমাজের আদর্শ হতে পারেন না।
মন্ত্রীসভায় কোন রদবদল হয়নি। শুধু সংখ্যা বেড়েছে। গুণগত কোন পরিবর্তন হয়নি। আশাবাদী হওয়ার মতো কোন ঘটনাও ঘটেনি। এটা ছোটখাট একটা ‘কসমিক চেঞ্জ’। মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি ঈদের পর আরো একবার মন্ত্রীসভার সম্প্রসারণ ঘটবে। তখন হয়তো আমরা আরা বেশ কয়েকজন পূর্ণমন্ত্রী পাবো। এক্ষত্রে যে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার তা হচ্ছে যোগ্যতা এবং বিতর্কিত নন এমন ব্যক্তিদেরই যেন মন্ত্রীসভায় নেয়া হয়। একসময় যিনি ‘পাখির মতো’ সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন, বিদেশী মন্ত্রীদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছেন এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে যিনি ছিলেন উদাসীন, তিনি দলের বড় যতো বড় নেতাই হোন না কেন, মন্ত্রীসভার ভাবমূর্তির জন্য তিনি যোগ্য ব্যক্তি নন।
আরেকজনের কথা বলি। সিলেটের শিশু রাজন হত্যার জন্য তিনি দায়ী করেন খালেদা জিয়াকে। মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এর উত্থানের জন্য তিনি দায়ী করেন বেগম জিয়াকে। তার দূর্নীতি নিয়ে যখন যমুনা টিভি প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন খটকা লাগে। এভাবে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে কী তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? আমার অবজারভেশনটা হচ্ছে এখানেই। বড় মন্ত্রীসভার প্রয়োজন নেই। দরকার ছোট মন্ত্রীসভা কিন্তু তারা হবেন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন। যতদূর জানি অতীতে কোন একটি কমিটির সুপারিশ ছিল এমনটাই -২০ থেকে ২৫ জনের মধ্যে মন্ত্রীসভার সদস্য সীমাবদ্ধ রাখা। এটাই সঠিক। সাধারণত ‘জেলা কোটা’, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি কারনে কেবিনেট সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। প্রায় ক্ষেত্রেই যোগ্যতার বিষয়টি খুব একটা বিবেচনায় নেয়া হয় না। তবে বলতেই হবে বর্তমান কেবিনেটে বেশ ক’জন সদস্য রয়েছেন, যারা স্ব স্ব মন্ত্রণালয় পরিচালনায় যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাধারণত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নেয়া হয়। তবে সংবিধানের ৫৬(২) ধারা মতে, টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রী নেয়া হয় (মোট সদস্যদের দশভাগের একভাগ)। এই ধারাটি পরিবর্তন প্রয়োজন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা যোগ্য এবং আন্তর্জাতিক আসরে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন, এমন কাউকে কাউকে মন্ত্রীসভায় নেয়া যায়। বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যনির্ভর বিশ্বব্যবস্থায় যেখানে ‘নেগোশিয়েশনস’ এর বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে কোন কোন মন্ত্রনালয় (বাণিজ্য, শিল্প, পররাষ্ট্র, মানবসম্পদ) পরিচালনায় দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মন্ত্রী প্রয়োজন। সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, দলকে তারা সংগঠিত করে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির অনেক জটিল প্যাচ ও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে তাদের ধারণা নাও থাকতে পারে। প্রয়োজনটা এ কারনেই।
মন্ত্রীসভার সম্ভাব্য সম্প্রসারণ নিয়ে আরো একটি কথা বলা দরকার। আর তা হচ্ছে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি! কোন কোন মিডিয়ায় এমন আভাষ দেয়া হচ্ছে যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে (বর্তমানে জনপ্রশাসনমন্ত্রী) আরো বড় দায়িত্ব দেয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই নাকি উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে! যদিও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দলের অভ্যন্তরে আরো বিতর্ক বাড়াবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে একসাথে একাধিক উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে কাউকে কাউকে ‘একোমোডেট’ করার জন্য। এটা কোন সমাধান হতে পারে না। যিনি বছরে মাত্র ২০ দিন অফিস করেন, তিনি যতো সৎ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোন না কেন, উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দিয়ে তার ‘যোগ্যতা’ বাড়ানো যাবে না। তাই সম্প্রসারণ নয়, দরকার মন্ত্রীদের যোগ্যতা বিচার করা। কোন মন্ত্রী সঠিকভাবে মন্ত্রণালয় চালাতে পারছেন কীনা, নিজেকে দূর্নীতির উর্ধ্বে রাখতে পারছেন কীনা, ‘অতি ক্ষমতাধর’ আমলাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন কীনা এটাই হোক ‘প্রায়োরিটি’, অগ্রাধিকার। ছোট মন্ত্রীসভাও অনেক দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারে। Prio.om 21 July 2015

0 comments:

Post a Comment