ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঐতিহাসিক চীন সফরের পর এমন একটা ধারণা জন্ম
হয়েছিল যে এশিয়ার এই দুটি দেশের মাঝে সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হবে।
কিন্ত ২০১১ সালে মুম্বাই হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী লাখভির ব্যাপারে
অতিসম্প্রতি চীনের একটি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্পর্ক নিয়ে আবার
নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। লাখভিকে ইসলামাবাদের হাইকোর্ট মুক্তিদানের
নির্দেশ দিলে ভারত এর প্রতিবাদে জাতিসংঘের দারস্থ হয়েছিল। ভারতের অভিযোগ
ছিল লাখভির মুক্তিদানের নির্দেশ জাতিসংঘের ১২৬৭ নং প্রস্তাবের লঙ্ঘন। উক্ত
প্রস্তাবে জঙ্গি ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে।
জাতিসংঘের যে নিষেধাজ্ঞা কমিটি রয়েছে, সেখানেই ভারত তার আপত্তি জমা দেয়।
গত ২৫ জুন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কমিটি প্রথমদিকে এজন্য পাকিস্তানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু চীনের আপত্তির কারণে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়টি আটকে গেল। চীনের যুক্তি ভারত যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। লাখভি জাতিসংঘ কর্তৃক চিহ্নিত সন্ত্রাসী। অভিযোগ আছে ২০১১ সালে মুম্বাই হামলায় ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন আর আহত হয়েছিলেন ১৬৫ জন। এর মূল পরিকল্পনা করেছিল লাখভি, যিনি পাকিস্তানের নাগরিক। এই ঘটনায় ভারত-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি দাগ লাগলো।
চীন ও ভারত সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উভয় শক্তিই এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে।এ ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। প্রভাব বিস্তার করার এই যে প্রতিযোগিতা, এই প্রতিযোগিতায় এ অঞ্চলের দেশগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে।
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আর ভারত ইতোমধ্যে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে ভারত তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা আগামীতে চীন সম্পর্ককে আঘাত করবে। ভবিষ্যতের নীতি নির্ধারকরা এখন একান্তেই বলছেন তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি মেনে চলতে পারবেন না। গুগলের আই ও আর সম্মেলনে (মার্চ ২০১৫) এই মেসেজটাই তারা দিয়েছেন্। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সাথে একাধিক পররাষ্ট্রচুক্তি এ দুটো দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং এবং ভবিষ্যতে ‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়।
ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ভারত প্রাচীনকালে তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় পন্ডিতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে দক্ষিনের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোল এর আমলে নৌ বাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌ বাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট তাতে দেখা যায়- ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিসর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার আবার অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা হয়ে সুমাত্রা জাভা (মালাক্কা প্রণালী), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণি্জ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল।
মোদি সরকার এই ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা এই সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। একদিকে চীনা নেতা শি জিনপিং তার ‘সিল্ক রুট’ এর ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। এর প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত তার পুরনো ‘কটন রুট’ এর ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরী হবে সেভাবেই। বাণিজ্যনির্ভর এই দ্বন্দ্ব শেষ অব্দি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌ বহরে বিমানবাহী জাহাজ আরো বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌ বাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌ ঘাঁটি নির্মাণ করছে।
বলা হয়, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপিইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সাথে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সাথে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটা পক্ষ নিয়েছে। অতিসম্প্রতি চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে ‘সিল্ক রুট’ এর কথা বলেছেন তা অন্য চোখে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ধারণা এতে করে বিশাল এক এলাকা জুড়ে চীনা কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এই সিল্ক রোডটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সিল্ক রোড এর মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের নয়া প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একইসাথে একটি ‘মেরিটাইম সিল্করুট’ এর কথাও আমরা জানি, যা কিনা চীনের সাথে দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র পাঠিয়েছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মেরিটাইম সিল্করুটের ধারণাও কয়েক’শ বছরের। এই মেরিটাইম সিল্করুট ধরে চীনা এডমিরাল ঝেং হে (মা হে) ১৪০৫ সাল থেকে ১৪৩৩ সাল -এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে চীনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৪২১-১৪৩১ সালে তিনি দু’বার তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও এ এসেছিলেন। চীন এই নৌরুটটি নতুন করে আবার ব্যবহার করতে চায়। তবে কয়েক’শ বছরের ব্যবধানে এই অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। চীন আর একক শক্তি নয়। ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাথে নিয়েই তার নিজের স্বার্থ আদায় করতে চা্য়। ফলে এটা স্পষ্ট নয় ভারত চীন সম্পর্ক আগামীতে কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে। কেননা ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। মৎস্য সম্পদ থেকে শুরু করে জ্বালানী সম্পদ ও জ্বালানী সম্পদ সরবরাহের অন্যতম রুট হচ্ছে এই ভারত মহাসাগর। পরিবর্তিত এই রাজনীতির কারনে এই সামুদ্রিক রুটের গুরুত্ব বাড়ছে। এই সামুদ্রিক রুটের গুরুত্ব অনুধাবন করেই চীন এ অঞ্চলে তার নৌ বাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছে। এর ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থও বিঘ্নিত হচ্ছে। ভারত তাই এ অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোতে তার নৌ বাহিনীর উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব বাড়াচ্ছে। ফলে এক ধরনের ‘স্নায়বিক যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে এশিয়ার প্রভাবশালী এই দেশ দু’টোর মধ্যে।
গেল মে মাসে (২০১৫) নরেন্দ্র মোদি বেইজিং সফর করেন। ভারতীয় মহাসাগরভূক্ত অঞ্চলে ভারতীয় তৎপরতা দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় আদৌ স্থান না পেলেও, চীনা নেতারা বিষয়টি জানেন ও বোঝেনও। মোদি নিজে চীনের ব্যাপারে যতই আগ্রহী থাকুন না কেন, ভারতে একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আছে। এবং ভারতের গোয়েন্দাসংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সবসময় ‘বড়’ করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিন এশিয়ায় ইতোমধ্যে ভারতের এক ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের স্ট্রাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে তা নয়। বরং বিশ্বের ‘কার্গো শিপমেন্ট’ এর অর্ধেক পরিবাহিত হয় এই ভারত মহাসাগর দিয়ে। একইসাথে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো, ব্যবহৃত জ্বালানী তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ, এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর তাবৎ জায়গায় যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানীকৃত পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগ পরিচালিত হয় এই সমুদ্র রুট ব্যবহার করে। সুতরাং এই সমদ্রপথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে।
এই সমদ্রপথে কর্তৃত্ব বৃদ্ধির প্রশ্নেই চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ অনিবার্য। এই দ্বন্দ্ব ও বিবাদ দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক বৃদ্ধির যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, তা ভেস্তে যেতে পারে। এই যখন পরিস্থিতি তখন আসলো লাখভি’র বিষয়টি। বলা ভালো লাখভির জামিন পাওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানী উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সারা বিশ্ব যখন সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের নিন্দা জানিয়ে আসছে, তখন লাখভির বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরীফের উপস্থিতি পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন একটি দিগন্তের সূচনা করলেও এখন এই ছোট ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে অবিশ্বাস করতে শুরু করবে এবং সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনা একটি অনিশ্চয়তার মাঝে আটকে থাকবে। একইসাথে চীন ও ভারতের মধ্যে সৃষ্টি হবে আস্থাহীনতা, যে আস্থাহীনতা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। এখন লাখভির জামিনপ্রাপ্তি সবকিছু ওলট-পালট করে দিল। Prio.com 02.07.15
গত ২৫ জুন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কমিটি প্রথমদিকে এজন্য পাকিস্তানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়ার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু চীনের আপত্তির কারণে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়টি আটকে গেল। চীনের যুক্তি ভারত যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। লাখভি জাতিসংঘ কর্তৃক চিহ্নিত সন্ত্রাসী। অভিযোগ আছে ২০১১ সালে মুম্বাই হামলায় ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন আর আহত হয়েছিলেন ১৬৫ জন। এর মূল পরিকল্পনা করেছিল লাখভি, যিনি পাকিস্তানের নাগরিক। এই ঘটনায় ভারত-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি দাগ লাগলো।
চীন ও ভারত সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উভয় শক্তিই এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে।এ ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। প্রভাব বিস্তার করার এই যে প্রতিযোগিতা, এই প্রতিযোগিতায় এ অঞ্চলের দেশগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে।
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আর ভারত ইতোমধ্যে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে ভারত তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা আগামীতে চীন সম্পর্ককে আঘাত করবে। ভবিষ্যতের নীতি নির্ধারকরা এখন একান্তেই বলছেন তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি মেনে চলতে পারবেন না। গুগলের আই ও আর সম্মেলনে (মার্চ ২০১৫) এই মেসেজটাই তারা দিয়েছেন্। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সাথে একাধিক পররাষ্ট্রচুক্তি এ দুটো দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং এবং ভবিষ্যতে ‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়।
ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ভারত প্রাচীনকালে তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় পন্ডিতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে দক্ষিনের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোল এর আমলে নৌ বাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌ বাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট তাতে দেখা যায়- ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিসর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার আবার অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা হয়ে সুমাত্রা জাভা (মালাক্কা প্রণালী), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণি্জ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল।
মোদি সরকার এই ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা এই সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। একদিকে চীনা নেতা শি জিনপিং তার ‘সিল্ক রুট’ এর ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। এর প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত তার পুরনো ‘কটন রুট’ এর ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরী হবে সেভাবেই। বাণিজ্যনির্ভর এই দ্বন্দ্ব শেষ অব্দি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌ বহরে বিমানবাহী জাহাজ আরো বাড়াচ্ছে। ভারতও ভারত মহাসাগরে তার নৌ বাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌ ঘাঁটি নির্মাণ করছে।
বলা হয়, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপিইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সাথে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সাথে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটা পক্ষ নিয়েছে। অতিসম্প্রতি চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে ‘সিল্ক রুট’ এর কথা বলেছেন তা অন্য চোখে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ধারণা এতে করে বিশাল এক এলাকা জুড়ে চীনা কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এই সিল্ক রোডটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সিল্ক রোড এর মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের নয়া প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একইসাথে একটি ‘মেরিটাইম সিল্করুট’ এর কথাও আমরা জানি, যা কিনা চীনের সাথে দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র পাঠিয়েছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মেরিটাইম সিল্করুটের ধারণাও কয়েক’শ বছরের। এই মেরিটাইম সিল্করুট ধরে চীনা এডমিরাল ঝেং হে (মা হে) ১৪০৫ সাল থেকে ১৪৩৩ সাল -এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে চীনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৪২১-১৪৩১ সালে তিনি দু’বার তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও এ এসেছিলেন। চীন এই নৌরুটটি নতুন করে আবার ব্যবহার করতে চায়। তবে কয়েক’শ বছরের ব্যবধানে এই অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। চীন আর একক শক্তি নয়। ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাথে নিয়েই তার নিজের স্বার্থ আদায় করতে চা্য়। ফলে এটা স্পষ্ট নয় ভারত চীন সম্পর্ক আগামীতে কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে। কেননা ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। মৎস্য সম্পদ থেকে শুরু করে জ্বালানী সম্পদ ও জ্বালানী সম্পদ সরবরাহের অন্যতম রুট হচ্ছে এই ভারত মহাসাগর। পরিবর্তিত এই রাজনীতির কারনে এই সামুদ্রিক রুটের গুরুত্ব বাড়ছে। এই সামুদ্রিক রুটের গুরুত্ব অনুধাবন করেই চীন এ অঞ্চলে তার নৌ বাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছে। এর ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থও বিঘ্নিত হচ্ছে। ভারত তাই এ অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোতে তার নৌ বাহিনীর উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব বাড়াচ্ছে। ফলে এক ধরনের ‘স্নায়বিক যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে এশিয়ার প্রভাবশালী এই দেশ দু’টোর মধ্যে।
গেল মে মাসে (২০১৫) নরেন্দ্র মোদি বেইজিং সফর করেন। ভারতীয় মহাসাগরভূক্ত অঞ্চলে ভারতীয় তৎপরতা দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় আদৌ স্থান না পেলেও, চীনা নেতারা বিষয়টি জানেন ও বোঝেনও। মোদি নিজে চীনের ব্যাপারে যতই আগ্রহী থাকুন না কেন, ভারতে একটি শক্তিশালী আমলাতন্ত্র আছে। এবং ভারতের গোয়েন্দাসংস্থা পৃথিবীর শীর্ষ গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর একটি। এরা ভারতের স্বার্থকে সবসময় ‘বড়’ করে দেখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিন এশিয়ায় ইতোমধ্যে ভারতের এক ধরনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের স্ট্রাটেজিস্টদের চোখ এখন ভারত মহাসাগরের দিকে। ভারত মহাসাগরে শুধু যে বিশাল সম্পদই রয়েছে তা নয়। বরং বিশ্বের ‘কার্গো শিপমেন্ট’ এর অর্ধেক পরিবাহিত হয় এই ভারত মহাসাগর দিয়ে। একইসাথে ৩ ভাগের ১ ভাগ কার্গো, ব্যবহৃত জ্বালানী তেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ, এবং ৪ ভাগের ৩ ভাগ ট্রাফিক পৃথিবীর তাবৎ জায়গায় যেতে ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথ। পৃথিবীর আমদানীকৃত পণ্যের (তেলসহ) শতকরা ৯০ ভাগ পরিচালিত হয় এই সমুদ্র রুট ব্যবহার করে। সুতরাং এই সমদ্রপথের নিরাপত্তার প্রশ্নটি তাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি করে।
এই সমদ্রপথে কর্তৃত্ব বৃদ্ধির প্রশ্নেই চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ অনিবার্য। এই দ্বন্দ্ব ও বিবাদ দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক বৃদ্ধির যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল, তা ভেস্তে যেতে পারে। এই যখন পরিস্থিতি তখন আসলো লাখভি’র বিষয়টি। বলা ভালো লাখভির জামিন পাওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানী উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সারা বিশ্ব যখন সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ডের নিন্দা জানিয়ে আসছে, তখন লাখভির বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরীফের উপস্থিতি পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন একটি দিগন্তের সূচনা করলেও এখন এই ছোট ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে অবিশ্বাস করতে শুরু করবে এবং সম্পর্ক বৃদ্ধির সম্ভাবনা একটি অনিশ্চয়তার মাঝে আটকে থাকবে। একইসাথে চীন ও ভারতের মধ্যে সৃষ্টি হবে আস্থাহীনতা, যে আস্থাহীনতা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। এখন লাখভির জামিনপ্রাপ্তি সবকিছু ওলট-পালট করে দিল। Prio.com 02.07.15
0 comments:
Post a Comment