রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

রাজ্জাকের ফিরে আসাটা মূল সমস্যার কোনো সমাধান নয়

মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) কর্তৃক অপহৃত বিজিবির নায়েক আবদুর রাজ্জাক ফিরে এসেছেন। অপহরণের আট দিন পর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা তাঁকে ছেড়ে দেয়। এর আগে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে একটি পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাজ্জাকের এই ফিরে আসা মূল সমস্যা সমাধানের কোনো কথা বলে না। মূল সমস্যাটি হচ্ছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে, যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান। বস্তুত গত মে মাস থেকেই রোহিঙ্গা সমস্যাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে আন্দামান সাগরে শত শত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি, তাদের মালয়েশিয়ায় পাচারের অপচেষ্টা, সাগরে মাসের পর মাস ভেসে থাকার পর বিশ্বব্যাপী যে বিতর্কের ঢেউ ওঠে, তাতে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে চলে আসে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জোর করে এবং মানবপাচারকারীদের সহযোগিতায় মালয়েশিয়া পাচার করার সর্বশেষ উদ্যোগটি ছিল মূলত সেখানে যে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলছে, তারই ফল। নায়েক আবদুর রাজ্জাকের অপহরণের ঘটনাটি একই সূত্রে গাঁথা।
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযানের সঙ্গে ইউরোপের বসনিয়া-হারজেগোভিনার জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের তুলনা চলে। বসনিয়া একসময় ছিল যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ ছিল মুসলমান। সার্বরা ছিল সংখ্যালঘু, ৩১ শতাংশ। অথচ এই সার্বরাই ১৯৯১ সালের পর থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। ১৯৯২ সালের মার্চে সেখানে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ওই গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিলে সেখানে সার্বরা (যারা ধর্মীয়ভাবে অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ান) ব্যাপকহারে মুসলমানদের গণহত্যা, ধর্ষণ আর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে, যা আন্তর্জাতিক আসরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। এই গণহত্যা ও উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকলে ১৯৯৫ সালের মে মাসে সার্বীয় হেডকোয়ার্টারে ন্যাটো বিমান হামলা পর্যন্ত চালিয়েছিল। সেই গণহত্যায় যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের অনেকের বিচার হয়েছে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে। আজকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গাদের তাদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ অভিযানের সঙ্গে নব্বইয়ের দশকের বসনিয়ার মুসলমানদের উচ্ছেদ অভিযানের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বসনিয়ায় সার্বরা যেমনটি চেয়েছিল বসনিয়াকে একটি সার্বীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা ও সার্বিয়ার সঙ্গে একত্রিত হয়ে একটি গ্রেটার সার্বীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া, আজকে মিয়ানমারের বৌদ্ধ নেতৃত্বও ঠিক তেমনটি চাচ্ছেন। তাঁরা চাচ্ছেন মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র হওয়ায় এবং বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ধর্মীয়ভাবে মুসলমান হওয়ায় বাংলাদেশকে এই রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। রোহিঙ্গারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান এবং শত বছর ধরে তারা আরাকান রাজ্যে বসবাস করে আসছে। কিন্তু তারা এখন উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উচ্ছেদ অভিযানের শিকার। মিয়ানমারে সাম্প্রতিককালে বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছে। এই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রমোট করছে। এরা মূলত মিয়ানমারকে একটি পূর্ণ বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। আর এ লক্ষ্যেই তারা আরাকান প্রদেশে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাদের নিজস্ব ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করছে। তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্রিশ্চিয়ান কমিউনিটির ওপর যতটুকু না আক্রমণ হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি আক্রমণ হচ্ছে মুসলমানদের ওপর। পাঠকদের বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের (১ জুলাই ২০১৩, When Buddhists Go Bad) কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বৌদ্ধ উগ্রবাদ কিভাবে মিয়ানমারে বিস্তার লাভ করছে, কিভাবে রোহিঙ্গারা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হচ্ছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে ওই প্রতিবেদনে। আছে উগ্রবাদী বৌদ্ধ নেতা ভিরাথুর বক্তব্য, যাকে কিনা বলা হয় 'বার্মিজ বিন লাদেন'। ভিরাথু তাঁর উগ্রবাদী মতবাদের জন্য ২০০৩ সাল থেকে সাত বছর জেলে কাটিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তাঁকেই এখন মুসলমানদের উচ্ছেদ অভিযানে ব্যবহার করছে। ভিরাথু মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিয়ে যে সমস্যা, তার পেছনে কাজ করছে ওই উগ্র বৌদ্ধ মানসিকতা।

এই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ এখন মিয়ানমারের রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এমনকি বিরোধী নেত্রী অং সান সু চিও এই উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতার বাইরে যেতে পারেননি। তিনি এই উগ্র জাতীয়তাবাদকে সরাসরি সমর্থন না করলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নে এবং তাদের প্রতি যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে, তার প্রতিবাদ করেননি। তাই রাজ্জাককে ধরে নিয়ে গিয়ে মিয়ানমারের ৫৪৪ জন নাগরিককে (যারা রোহিঙ্গা) যখন ফেরত নেওয়ার কথা বলল, তখন বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে রোহিঙ্গা সমস্যাটিই এর পেছনে কাজ করছে। অথচ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মিয়ানমারের বিজিপি এই কাজটি করতে পারে না। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী (আর্টিকেল ৩) নায়েক আবদুর রাজ্জাকের অধিকার ছিল আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্বীকৃত। তাঁর সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করা উচিত ছিল। কিন্তু লুঙ্গি পরিয়ে, রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁর ছবি আপলোড করে মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে। আমাদের উচিত হবে বিষয়টি জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট শাখাকে অবহিত করা। কেননা, জাতিসংঘ চার্টারের ২৫ নম্বর ধারায় জাতিসংঘের ভূমিকা এ ব্যাপারে স্পষ্ট। একই সঙ্গে আমাদের উচিত হবে রোহিঙ্গা সমস্যায় বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর (যাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো) সাহায্য ও সহযোগিতা নেওয়া। আমরা বিরোধী নেত্রী অং সান সু চির সহযোগিতাও চাইতে পারি। তবে তাঁর ক্ষমতা সীমিত। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর স্থানীয় কমান্ডারের ভূমিকাই মুখ্য।
'রাজ্জাকের' অধ্যায়টি শেষ হলো বটে, কিন্তু এ ঘটনাই 'শেষ ঘটনা' হয়ে থাকবে না। মিয়ানমারের ব্যাপারে আমরা যদি শক্ত অবস্থানে যেতে না পারি, আমার ধারণা ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আরো ঘটতে থাকবে। দুটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। এক. রোহিঙ্গা সমস্যাকে আন্তর্জাতিককরণ করা। দুই. অবৈধ ইয়াবা পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অতীতেও আক্রান্ত হয়েছিল। সীমান্ত বরাবর বিশাল অঞ্চলজুড়ে মিয়ানমার কর্তৃক পুঁতে রাখা ভূমি মাইন বিস্ফোরণে অতীতে (১৯৯৩ সালে) বাংলাদেশের ৫৩ জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিলেন ও ১২৮ জন চিরস্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছিলেন। ১৯৮৫ সালে মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায় ২০ হাজার নিয়মিত সৈন্য মোতায়েন করলে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের আচরণ আন্তর্জাতিক সীমান্ত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালে মিয়ানমার উভয় দেশকে পৃথককারী নাফ নদে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। এই বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে পরে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছিল। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০০১ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৩৫ হাজার ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ২০ হাজার সৈন্য নিজ নিজ সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছিল। যদিও এটা সত্য, এরপর দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছিল এবং মিয়ানমার বাঁধ নির্মাণ কর্মসূচি স্থগিত রেখেছিল। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় (২০০৬-২০০৮) বাংলাদেশ কর্তৃক গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান করায় (একটি কোরীয় কম্পানি কর্তৃক) মিয়ানমার সেখানে যুদ্ধজাহাজ পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ নেভিও সেখানে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছিল। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারকে আস্থায় নিয়েছে, কিন্তু মিয়ানমার সেই আস্থার কোনো মর্যাদা দেয়নি।
রোহিঙ্গা নিয়ে যে সমস্যা, তার শুরু মূলত ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে। ওই সময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত 'Operation Dragon'-এর শিকার হয়ে আরাকানের মুসলমানরা (রোহিঙ্গা) দলে দলে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ছিল আকিয়াব (সিটওয়ে), পালেটবা, মিনশিয়া, মায়োহং, মাইবন, মংডু এবং রাথেডং অঞ্চলের অধিবাসী। ওই সময় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে মিয়ানমার তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ১৯৭৮ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে আগত এক লাখ ৮৭ হাজার ২৫০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়। এদের সবার কাছেই মিয়ানমার সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত National Registration Card (NRC) ছিল। এরপর ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আবারও আরাকানে 'অপারেশন পিয়েথায়া' নামে আরেকটি অভিযান পরিচালনা করলে আবারও হাজার হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় আবৈধভাবে প্রবেশ করে এবং আশ্রয় নেয়। এরপর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা হলেও কার্যত তা খুব একটা ফল দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, প্রায় চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমান বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় অবৈধভাবে বসবাস করছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার ৪৫ জন। এরা টেকনাফের কুতুপালং ও নোয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। কিন্তু অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ সরকার অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে অবস্থানরত অনিবন্ধিত 'মিয়ানমারের নাগরিক শুমারি ২০১৫' শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে ব্যয় হবে ২২ কোটি টাকা। এই উদ্যোগটি ভালো। রোহিঙ্গাদের ওই দুটি ক্যাম্প থেকে নিঝুম দ্বীপে সরিয়ে নেওয়ার চিন্তাও করছে সরকার। এই উদ্যোগটিও ভালো। বাংলাদেশ সরকারকে এখন রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক 'ইয়াবা' আসছে। বাংলাদেশ ইয়াবার চালানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় রাজ্জাকের অপহরণের ঘটনাটি ঘটেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে 'ইয়াবার' প্রশ্নটিও তাঁর অপারেশনের সঙ্গে জড়িত। গত সাত বছরে ইয়াবার চোরাচালান বেড়েছে ১৭৭ গুণ। এই হিসাব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। ঢাকায় ইয়াবা বিক্রির রয়েছে পাঁচ শতাধিক স্পট (আমাদের সময়, ২৪ জুন)। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৩৯টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে, যেখান থেকে চোরাইপথে প্রতি মাসে সীমান্ত দিয়ে শত কোটি টাকার ইয়াবা চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে বাংলাদেশে বছরে তিন হাজার কোটি টাকার মাদকের বাজার রয়েছে। এর অর্ধেক দখল করে রেখেছে ইয়াবা (সকালের খবর, ২৪ জুন)। আর দুঃখজনক হলেও সত্য, ইয়াবা পাচারের সঙ্গে মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা জড়িত। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এ কাজে জড়িয়ে গেছেন।
সুতরাং রাজ্জাককে ফিরিয়ে নিয়ে এসে আমরা যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, তাহলে আমরা ভুল করব। কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে এবং আমাদের সীমান্তরক্ষীদের আরো সতর্ক রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এবং ইয়াবা চালান বন্ধ হলেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস পাবে।
Dainil Kalerkontho
28.06.15

মিয়ানমারকে কতটুকু আস্থায় নেওয়া যায়

বিজেবির একজন সদস্য নায়েক আবদুর রাজ্জাককে অপহরণ এবং তাকে ফেরত দেওয়ার পর একটি প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে, মিয়ানমারকে কতটুকু আস্থায় নেওয়া যায়? আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে মিয়ানমারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিয়ানমারের আচরণ দুই দেশের সম্পর্ককে এখন একটা বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। মূলত রোহিঙ্গা-ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতি ঘটিয়েছে। অতীতে মিয়ানমার তার কথা রাখেনি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তারা ফিরিয়ে নেয়নি। যদিও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তারা কথা দিয়েছিল। সে কথা রাখেনি তারা। উপরন্তু সাম্প্রতিককালে শত শত রোহিঙ্গাকে বাধ্য করেছে অথবা প্রলোভন দেখিয়ে সাগরে ভাসতে বাধ্য করেছিল। সাগর-ভাসা শত শত রোহিঙ্গাকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার উদ্যোগ সফল না হলেও বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। এ ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আবার ঘটেছিল রাজ্জাকের অপহরণের ঘটনা। স্পষ্টতই মিয়ানমারের এই ভূমিকা তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত নায়েক রাজ্জাকের অপহরণের এ ঘটনা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন করে নানা প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে না মিয়ানমারের ফাঁদে পা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট ডিপ্লোম্যান্সি’ (ঝসধৎঃ উরঢ়ষড়সধপু) প্রদর্শন করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে না গিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করে যেতে হবে। কেননা বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার নানাবিধ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই আসে এর ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্বের কথা। প্রায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখ- নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে মিয়ানমার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশ, পশ্চিম ও উত্তরে ভারত, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে চিন, পূর্বে থাইল্যান্ড ও লাওস। মিয়ানমারের এই ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে যে সড়ক যোগাযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাতে করে বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে সড়কপথে কেবল মিয়ানমারের বাজারেই নয়, বরং মিয়ানমার সরকারের সহযোগিতা নিয়ে পূর্বের অন্যান্য দেশের বাজারেও প্রবেশ করতে পারে (বিশেষ করে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর বাজারে)। ঘুমধুম-মুসে হাইওয়ে চালু হলে সড়কপথেই চিনে যাওয়া সম্ভব। ঘুমধুম বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশি এলাকা। আর মুসে হচ্ছে চিনের সীমান্ত শহর।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (ইওগঝঞঊঈ পরিবর্তিত নাম ইইওগঝঞঊঈ) এবং ইঈওগ জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত ইঈওগ জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেওয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রপ্তানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদি পশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশিরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী-বিখ্যাত। আমাদের ফানির্চার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমারে মূল্যবান পাথর, যেমন রুবি, জেড, মোম আর মার্বেলসমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালু-এডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। এই গ্যাস তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি, সেখানে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এ কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা-ইস্যু এবং সর্বশেষ নায়েক রাজ্জাকের অপহরণের ঘটনায় এই সম্পর্কে কিছুটা অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই অবিশ্বাসকে নিয়ে বেশিদূর যাওয়া ঠিক হবে না। একমাত্র ঝসধৎঃ উরঢ়ষড়সধপু-র মাধ্যমেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ককে আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। একদিকে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে, আর অন্যদিকে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে রোহিঙ্গা বিষয়টির সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই মিয়ানমারের চাপের কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করা যাবে না। রাজ্জাকের অপহরণের বিষয়টির সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রশ্নটিকে এক করে দেখাও যাবে না। যে ৫৪৪ জন মিয়ানমারের নাগরিককে ফেরত নেওয়ার শর্ত তারা জুড়ে দিয়েছিল, তাও গ্রহণযোগ্য ছিল না। এসব আরাকানবাসী মিয়ানমারের নাগরিক। এদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রয়োজন হলে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার মাধ্যমে এসব মিয়ানমারের নাগরিকের নাগরিকত্ব যাচাই করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের শুরুতে যে গণশুমারি শুরু করেছে, তাতে আরাকানবাসী রোহিঙ্গাদের তারা ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড’ (এনআরসি) দিতে অস্বীকার করে আসছে। এই এনআরসি হচ্ছে মিয়ানমারের আইনগত বৈধ অধিবাসী হওয়ার অন্যতম শর্ত। কারও কাছে এনআরসি না থাকলে তিনি মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হন না। আরাকানে বংশপরম্পরায় বাস করা হাজার হাজার মুসলমান রোহিঙ্গাকে ইচ্ছাকৃতভাবেই এনআরসি দেওয়া হচ্ছে না। এদের চিহ্নিত করা হচ্ছে বাঙালি হিসেবে। এ বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মাঝে আলোচনায় স্থান পেলেও এর কোনো সমাধান হয়নি। সমস্যা হচ্ছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কোনো আন্তর্জাতিক আইনকানুন, বিধি ইত্যাদি কিছুই মানে না। সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি না থাকায় কোনো দায়বদ্ধতাও সৃষ্টি হয়নি। সেখানে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে সেনাবাহিনী যা চায়, সেটাই আইন। একটি সংসদ আছে বৈকি, কিন্তু তা সেনাবাহিনীর সদস্য কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এমনকি বিরোধী দল নেত্রী অং সান সু চিও ওদের স্বার্থেই কাজ করছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনো জোরালো দাবি কখনো উত্থাপন করেননি। এখনো করছেন না। তিনি সেনাবাহিনীর স্বার্থের বাইরে যেতে পারছেন না। একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়Ñ তা হচ্ছে সেখানে একটি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের জন্ম। এই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘প্রমোট’ করছে। এরা মূলত মিয়ানমারকে একটি পূর্ণ বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। আর এ লক্ষ্যেই তারা আরাকান প্রদেশে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাদের নিজস্ব ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করছে। তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্রিশ্চিয়ান কমিউনিটির ওপর যতটুকু না আক্রমণ হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি আক্রমণ হচ্ছে মুসলমানদের ওপর। পাঠকদের বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের (১ জুলাই, ২০১৩, ডযবহ ইঁফফযরংঃং এড় ইধফ) কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। বৌদ্ধ উগ্রবাদ কীভাবে মিয়ানমারে বিস্তার লাভ করছে, কীভাবে রোহিঙ্গারা বৗদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হচ্ছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে ওই প্রতিবেদনে। আছে উগ্রবাদী বৌদ্ধ নেতা ভিরাথুর বক্তব্য, যাকে কি না বলা হয় ‘বার্মিজ বিন লাদেন’। ভিরাথু তার উগ্রবাদী মতবাদের জন্য ২০০৩ সালে সাত বছর জেলে কাটিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তাকেই এখন মুসলমানদের উচ্ছেদ অভিযানে ব্যবহার করছে। ভিরাথু মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিয়ে যে সমস্যা, তার পেছনে কাজ করছে এই উগ্র বৌদ্ধ মানসিকতা।
আজ যে ৫৪৪ জন মিয়ানমারের নাগরিককে নিয়ে মিয়ানমার প্রশ্ন তুলেছে এবং যাদের তারা বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়, তার সঙ্গে নায়েক রাজ্জাকের অপহরণের কোনো মিল ছিল না। দুটি ভিন্ন বিষয়।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন যে নায়েক রাজ্জাকের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছিল তা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী (আর্টিকেল-৩) নায়েক আবদুর রাজ্জাকের অধিকার ছিল আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্বীকৃত। তার সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করা উচিত ছিল। কিন্তু লুঙ্গি পরিয়ে, রক্তাক্ত অবস্থায় তার ছবি আপলোড করে মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করছে। আমাদের উচিত হবে বিষয়টি জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট শাখাকে অবহিত করা। কেননা জাতিসংঘে চার্টারের ২৫ নম্বর ধারায় জাতিসংঘের ভূমিকা এ ব্যাপারে স্পষ্ট। একই সঙ্গে আমাদের উচিত হবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর (যাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো) ‘সাহায্য ও সহযোগিতা’ নেওয়া। আমরা বিরোধী নেত্রী অং সান সু চির সহযোগিতাও চাইতে পারি। তবে তার ক্ষমতা সীমিত। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর স্থানীয় কমান্ডারের ভূমিকাই মুখ্য।
মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেয়ে স্থানীয় সেনা কমান্ডারের ভূমিকা অনেক বেশি। ২০১১ সালের পর থেকে মিয়ানমারে কিছুটা সংস্কার আনলেও রাজনীতি এখনো ‘নিয়ন্ত্রণ’ করে সেনাবাহিনী।
আমাদের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থে মিয়ানমারকে আমাদের প্রয়োজন রয়েছে, এটা স্বীকার করে নিয়ে একটা আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন জাতি হিসেবেই মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যেতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমাদের নমনীয় হলে চলবে না আবার হটকারী কোনো সিদ্ধান্তও নেওয়া যাবে না। আর এ জন্যই দরকার ‘স্মার্ট ডিপ্লোম্যাসি’।
Daily Amader Somoy
28.06.15

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃত উন্নয়নে নজর দিন

প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন মেয়েদের রূপচর্চার জন্য বিউটি পারলার তৈরি করা হবে- এমনটাই জানিয়েছেন একজন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা। সম্প্রতি স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেছেন। তিনি উপস্থিত শিক্ষকদের এ কথাও জানাতে ভোলেননি যে, এ ব্যাপারে তার নাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথাও হয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যখন নানা বিভ্রান্তি দেশে ও বিদেশে, মেধার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমরা যখন খোদ নিজেদের বিতর্কিত করছি, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি কিনা বললেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য তৈরি হবে বিউটি পারলার! তিনি এ সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন এবং আমাদের আমলানির্ভর শিক্ষামন্ত্রী এতে সায় দেবেন, এটাও আমার মনে হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এতে সায় দেবেন কি-না, তাতে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। দেশের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট সচেতন। তিনি জানেন সব। কী করতে হবে, কোন সিদ্ধান্তটি নিতে হবে- এটা তিনি ভালোই বোঝেন। কিন্তু একজন আমলা কী করে এ ধরনের উদ্ভট কথা বলতে পারেন, তা আমার মাথায় আসে না। তিনি এ সংক্রান্ত সংবাদের কোনো প্রতিবাদও করেননি। তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি কথাটা বলেছেন। অর্থাৎ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য একটি করে বিউটি পারলার তৈরি করা হবে।ওই আমলার এ উদ্ভট বক্তব্যে আমি বিভ্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত। যেখানে আমরা আমাদের মেয়েদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে চাই, সেখানে কিনা তাদের সৌন্দর্যচর্চার জন্য বিউটি পারলার! এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক সচেতন। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ারের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। আমি অনেক মেয়েকে দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েই ওরা চিন্তা করে নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে। সৌন্দর্যচর্চা ওদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে বলে আমার কাছে কখনও মনে হয়নি। সুতরাং ওই সরকারি কর্মকর্তার উচিত ছিল ওদের এ চিন্তাভাবনাটা মাথায় রেখে পরিকল্পনার কথা বলা। স্কুলের পাঠ্য কার্যক্রমের বাইরেও ওদের আইটিসহ অন্যান্য শাখায় জ্ঞান দেয়া যায়। মেয়েরা যেসব হোস্টেলে থাকে, সেখানে বৈকালিক আইটি কোর্স করানো যায়। আইটি সেক্টরে রয়েছে বিশাল এক সম্ভাবনা। শিক্ষার্থীদের যদি ছোটকাল থেকেই আইটির বিভিন্ন শাখায় দক্ষ করে তোলা যায়, তাহলে পরবর্তী সময়ে ওরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আরও উন্নতি করতে পারবে। ওদের এ সেক্টরে দক্ষ করে গড়ে না তুলে ওই সরকারি কর্মকর্তা চাচ্ছেন তাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিউটি পারলার করতে!এই যদি হয় আমাদের আমলাদের সচেতনতা, তাহলে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে কীভাবে পরিণত হব, আমি বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের শিক্ষা সেক্টরে রয়েছে নানা সমস্যা। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা আজ রীতিমতো প্রশ্নের মুখে। জিপিএ-৫-এর ছড়াছড়ি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আদৌ কোনো উন্নতির কথা বলে না। লন্ডনের টাইমের হায়ার এডুকেশন শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে ২০১৫ সালে শিক্ষার মানদণ্ডে এশিয়ার শীর্ষ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই। অথচ এক্ষেত্রে ওই সরকারি কর্মকর্তার কোনো উৎকণ্ঠা নেই। কোনো ভাবনা নেই। আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ২০২১ সালে কোন পর্যায়ে দেখতে চাই, সে ব্যাপারে তার কোনো ভাবনা নেই। লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী বেসরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএর একখানা সার্টিফিকেট নিয়ে জব মার্কেটে ঢোকার চেষ্টা করছে। কেউবা আবার ভদ্র কেরানি হচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। সেটিও আমরা করছি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ঘরে ঘরে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী তৈরি করে আর যাই হোক আমরা শিক্ষার মান বাড়াতে পারিনি। কোটা ব্যবস্থা নিয়েও চিন্তা করার সময় এসেছে। যেখানে জিপিএ-৫ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না, সেখানে কোটার কারণে ভর্তি হচ্ছে শত শত শিক্ষার্থী। অযোগ্য এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে জাতীয় জীবনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বরং এরা জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এদিকেও দৃষ্টি দেয়া দরকার। সরকারি কর্মকর্তার সময় কই এসব দেখার!জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মাঝে শতকরা ৮০ জন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হয়, তখন সত্যিকার অর্থে বিষয়টা আমাদের ভাবায়। পাসের হার বাড়িয়ে দেখানোর মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। উত্তরপত্রগুলো সাধারণভাবে মূল্যায়ন করা ও নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। এখন অভিভাবকরা বুঝতে পারবেন, জিপিএ-৫ পাওয়া সন্তানটি তাদের জন্য বোঝা হয়ে গেল। এক ধরনের হতাশা ওই সব শিক্ষার্থীর মাঝে এসে যাবে, যখন জিপিএ-৫ নিয়েও তারা কোথাও ভর্তি হতে পারবে না। এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও সচিবের চিন্তাভাবনা করা উচিত। আমার ধারণা শিক্ষামন্ত্রীকে যারা পরামর্শ দেন, তারা সঠিক পরামর্শটি দেন না। সীমিত লাভ বা সুবিধা নিয়ে আর যাই হোক, সমাজে বড় পরিবর্তন আনা যায় না। মন্ত্রী নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন।মন্ত্রীকে উপদেশ দেয়ার ক্ষমতা আমি রাখি না। সব ব্যাপারেই যদি তিনি রাজনীতি খোঁজেন, তাহলে তা হবে বড় ভুল। শিক্ষার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। তাকে এখন ভাবতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। আমলারা আপনাকে সঠিক উপদেশটি দেন বলে আমার মনে হয় না। সুবিধাভোগী আমলারা আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই মূল বিষয় থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখছে। আপনি অতীতের দৃষ্টান্ত তুলে যুক্তি খাড়া করতে পারেন। কিন্তু তাও সমর্থনযোগ্য নয়। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি ছোট ছোট বাচ্চাদের মেধাকে খাটো করে দেখতে চাই না। কিন্তু জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে আমরা কি ওদের প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে দিলাম না? একটা শিশু কষ্ট করে শিখবে, জানবে, বুঝবে। বিষয়কে আয়ত্ত করবে। একটা প্রতিযোগিতা থাকবে ওদের ভেতরে। আর ভালো করার একটা জিদ তৈরি হবে ছোটবেলা থেকেই। এর বদলে তার জিপিএ-৫ প্রাপ্তি তাকে ভালো করে পড়াশোনা করার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করবে। ভবিষ্যতে সে যখন এই জিপিএ-৫ নিয়ে কোনো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না, তখন সে হতাশায় পড়ে যাবে। একসময় অসৎ পথে পা বাড়াবে।আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা অনেক মেধাবী। তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ। ওদের নিজেদের মতো বড় হতে দেয়াই উচিত। তথাকথিত জিপিএ-৫ ওদের বড় করবে না। ওদের জীবনটা ওদেরই গড়তে দেয়া উচিত। ওরা শুধু সীমিত প্রশ্ন পড়ে, মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ নিয়ে জীবনকে বড় করে গড়ে তুলতে পারবে না। ওদের অনেক কিছু পড়াশোনা করা উচিত। বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিক্ষা- সবকিছু। জ্ঞানের রয়েছে এক বিশাল ভাণ্ডার। এর মাঝেই ওরা খুঁজে পাবে ওদের পৃথিবীকে। আমি জানি এই বয়সে ছেলেমেয়েরা অনেক মেধাবী হয়। অনেক কিছু জানতে চায়, শিখতে চায়। কিন্তু তাদের শেখাটাকে আমরা সীমিত করে দিচ্ছি। অযাচিতভাবে জিপিএ-৫ দিয়ে ওদের প্রত্যাশা আমরা বাড়িয়ে দিয়েছি। এটা ভালো নয়। এটা করে আমাদের নীতিনির্ধারকরা অভিভাবকদের কাছে বাহবা নিতে চেয়েছেন। হয়তো কোনো কোনো অভিভাবক এতে খুশি হবেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হকের মতো এমন অনেক অভিভাবক আছেন, যারা খুশি হবেন না। একজন শিক্ষক যে কাজটি করেন, ফাহমিদুল হক সে কাজটিই করেছিলেন। নিজের মেয়ের জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। এটা সঠিক কী বেঠিক এ বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু যেটা বাস্তব তা হচ্ছে এ ঢালাওভাবে দেয়া জিপিএ-৫ তিনি সমর্থন করেননি। এটাই আমরা বলতে চাই। বেশি বেশি জিপিএ-৫ দিয়ে শিক্ষার মান বাড়ানো যায় না। ওই সরকারি কর্মকর্তা যদি ওদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার কোনো অনুপ্রেরণা দিতেন, কোনো পরিকল্পনার কথা জানাতেন, আমি খুশি হতাম।উচ্চশিক্ষা নিয়েও আমার মাঝে এক ধরনের হতাশা কাজ করে। আমি যা চেয়েছিলাম, তা পাইনি। আমার ছাত্ররা যারা শিক্ষক হয়েছে, ওদের কাছে আমার যা প্রত্যাশা, তা আমি পাইনি। শিক্ষকতা, গবেষণার চেয়ে তাদের কাছে রাজনীতি, আর্থিক আনুকূল্য এসব বিষয়ই বড়। অনেক শিক্ষককে দেখেছি দু-দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অনেকটা প্রকাশ্যেই করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে জানে না, তা নয়। জানে। হয়তো তাদের প্রাথমিক অনুমতিও আছে। এটা কী করে সম্ভব আমি জানি না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্টটাইমের কথা বলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাড়পত্র বা অনুমতি নেন বটে (অনেকে তাও নেন না), কিন্তু কাজ করেন ফুল টাইম। দেখবে কে? মঞ্জুরি কমিশনের এ ব্যাপারে সরাসরি কোনো নির্দেশনা নেই। তবে আমি একাধিকবার বর্তমান মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তখন অবশ্য তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন না। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। তিনি এ বিষয়ে পুরোপুরি জ্ঞাত। আমি খুশি হব যদি তিনি এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনা দেন। কারণ উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে একটা হতাশাজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ওই সরকারি কর্মকর্তাকেও বিষয়টি ভেবে দেখার আহ্বান জানাই।তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিউটি পারলার স্থাপন না করে শিক্ষা-সংক্রান্ত অন্য বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলে ভালো করবেন। শক্ত হাতে শিক্ষা-সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখা দরকার। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি সেক্টরে শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। স্কুলে শিক্ষকরা কতটুকু আন্তরিক, কিংবা প্রাইভেট টিউশনি কতটুকু বন্ধ হয়েছে, সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া জরুরি। প্রয়োজন হলে স্কুল শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করা উচিত। আমার মনে আছে, একজন অভিভাবক ভিকারুননিসা স্কুলের পরীক্ষার ফলাফল পত্রিকায় প্রকাশের পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, তার মেয়ে যে জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাতে স্কুলের কোনো কৃতিত্ব নেই। তিনি একাধিক গৃহশিক্ষকের কাছে তার মেয়েকে পড়িয়েছেন। কৃতিত্ব তাদের। এ থেকেই বোঝা যায় ক্লাসে শিক্ষকদের আগ্রহ কম, আগ্রহ বেশি প্রাইভেট টিউশনিতে। তাতে পয়সা বেশি। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। না হলে আগামীতে স্কুল শিক্ষা শুধু গৃহ শিক্ষকতার ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।কলেজ শিক্ষকতার হাল আরও খারাপ। মফস্বলে, এমনকি ঢাকার বাইরের কলেজগুলোতে ক্লাস হয় না। বাংলা ও ইংরেজি অনার্সের মতো বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের কলেজ শিক্ষকদের কাছে ব্যাচ করে প্রাইভেট পড়তে হয়। আমি অবাক হয়ে যাই যখন শুনি একজন কলেজ শিক্ষার্থীকেও প্রাইভেট পড়তে হয়! খোঁজ নিয়ে জেনেছি শিক্ষকরা আদৌ ক্লাসে যান না। তারা বাধ্য করেন ছাত্রদের প্রাইভেট পড়তে। এই হচ্ছে আমাদের কলেজ শিক্ষাব্যবস্থা। সরকার এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো করবে।আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন। কলেজ শিক্ষকদের (সরকারি) নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ কলেজ শিক্ষকরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় কাজ করেন। এক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন দরকার। কলেজ শিক্ষকদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ন্যস্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে ৬টি বিভাগে ৬টি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে এবং প্রতিটি বিভাগে অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের নামে এক ধরনের নিজস্ব প্রশাসন চালু করেছে। শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা খুবই কম। উপাচার্য খেদাও অভিযান যেন একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষক রাজনীতি প্রায় ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং যা ভয়াবহ তা হচ্ছে, কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এক একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে একটি আইন করা জরুরি হয়ে পড়েছে।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিউটি পারলার স্থাপন না করে এসব দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। বিশ্বে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর র‌্যাংকিং কত, তা নিশ্চয়ই ওই সরকারি কর্মকর্তা জানেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে নিশ্চয়ই তিনি তা জেনেছেন। একুশ শতকের উপযোগী একটি শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি সরকারকে সহযোগিতা করবেন- এ প্রত্যাশা রইল। Daily Jugantor 26.06.15

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কে চাই স্মার্ট ডিপ্লোমেসি

বিজেবির সদস্য নায়েক আবদুর রাজ্জাকের মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ কর্তৃক অপহরণ, আটদিন আটক রাখার পর তাঁকে ফেরত দেওয়া এবং সেই সঙ্গে তাঁকে জঙ্গি পরিচয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড করার মধ্য দিয়ে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। এই ঘটনা ঘটল এমন একসময়, যখন আন্দামান সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে সারা বিশ্বব্যাপী মিয়ানমারের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে এই ঘটনায় মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে। বিজেবির পক্ষ থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদ ও একটি ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করলেও বিষয়টি সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আকার-ইঙ্গিতে যে কথা বলা হচ্ছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নায়েক আবদুর রাজ্জাক অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তাঁর বিচার হবে। অথচ এই অভিযোগের পেছনে কোনো সত্যতা নেই। কেননা নায়েক রাজ্জাক ও তাঁর সঙ্গীরা বাংলাদেশের জলসীমানাতেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। মিয়ানমারের বিজিপি তাদের ওপর কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই গুলি করে এবং একজন বিজিবি সদস্যকে হত্যাও করে। আর রাজ্জাক যে অবৈধভাবে প্রবেশ করেননি, তার প্রমাণ মিলল বৃহস্পতিবার, তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিজিপি এই কাজটি কেন করল? প্রকৃত পক্ষে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর উদ্দেশ্যেই অত্যন্ত কৌশলে এই কাজটি করেছে। সাম্প্রতিককালে মিয়ানমার সরকার মুসলমান ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে অমানবিক আচরণ করছে এবং তাদেরকে বাধ্য করছে দেশ ত্যাগ করতে, তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। রোহিঙ্গা অভিবাসন সমস্যাটি এখন একটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

ফলে মিয়ানমার সরকারের ওপর একটা চাপ আছে। তাই পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে, যাতে সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে বেশি সময় ব্যায় করে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, এতে করে রোহিঙ্গা সমস্যাটি চাপা পড়ে যাবে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় এই অপহরণ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এটা এমন এক স্পট, যেখান দিয়ে বাংলাদেশে চোরাপথে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা চালান হয়, এমনকি মানবপাচারও হয়।

পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে অভিযোগ শোনা যায়, এসব চালান ও পাচারের সঙ্গে নাকি অনেক রাঘব-বোয়ালই জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশ এখন মানবপাচার ও ইয়াবা চোরাচালান রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করায় অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এসব রাঘব-বোয়ালরা। ফলে বিজিবির ওপর একধরনের আক্রোশ তাদের ছিল। তারই প্রতিফলন ঘটেছে নায়েক রাজ্জাকের অপহরণ ঘটনার মধ্য দিয়ে। তৃতীয় আরেকটি সম্ভাবনার কথাও বলছে মিয়ানমারের কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ। তারা ৫৪৪ জন মিয়ানমারের নাগরিককে চিহ্নিত করেছে, যাদের তারা বলছে ‘বাঙালি’। এবং বাংলাদেশ যদি এদের ফেরত নেয়, তাহলে রাজ্জাককে ফেরত দেওয়া হবে।

আসলে রাজ্জাক অপহরণ ঘটনার সঙ্গে যে উদ্দেশ্যই কাজ করে থাকুক না কেন, এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সমস্যাটি যে একটি ফ্যাক্টর, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এখানে বলা ভালো, মিয়ানমারে ১৯৮২ সালে জাতীয়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড (এনআরসি) প্রণয়ন করেছিল, যা মিয়ানমারের আইনগত বৈধ অধিবাসীর নিশ্চয়তা দেয়। রোহিঙ্গাদের এই এনআরসির আওতায় আনা হয়নি। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে মনে করে না। গত ৩৭ বছর মিয়ানমার সরকার বারবার চেষ্টা করেছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করতে। ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো বিপুলসংখক রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ওই সময় মিয়ানমার সরকার ‘অপারেশন ড্রাগন’ নামে ‘রোহিঙ্গা খেদাও’ অভিযান শুরু করেছিল। ফলে ওই সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার ও পাবর্ত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গারা নিঃস্ব অবস্থায় আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে মিয়ানমার সরকার ‘অপারেশন পিরেথায়া’ নামে আবারও রোহিঙ্গা খেদাও অভিযানে নামে। বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হয়েছে, প্রায় চার লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজার এলাকায় বসবাস করছে। এদের অনেকেরই শরণার্থী হিসেবে কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই। এরা নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, মিয়ানমার সরকার নতুন করে বৈধ নাগরিকদের গণনা শুরু করলে আবারও রোহিঙ্গা খেদাও অভিযান শুরু হয়। ফলে মে-জুন মাসে সাগরভাসি মানুষকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বড় ধরনের সংবাদের জন্ম হয়।

শেষ অব্দি নায়েক রাজ্জাক মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশের জিম্মা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু এই ঘটনা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন করে একটি প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে না মিয়ানমারের ফাঁদে পা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট ডিপ্লোমেসি’ প্রদর্শন করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে না গিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করে যেতে হবে। কেননা বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার নানাবিধ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই আসে এর ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্বের কথা। প্রায় তিন লাখ ৭৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে মিয়ানমার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশ, পশ্চিম ও উত্তরে ভারত।

উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে চীন, পূর্বে থাইল্যান্ড ও লাওস। মিয়ানমারের এই ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে যে সড়ক যোগাযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাতে করে বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে সড়কপথে কেবল মিয়ানমারের বাজারেই নয়, বরং মিয়ানমার সরকারের সহযোগিতা নিয়ে পূর্বের অন্যান্য দেশের বাজারেও প্রবেশ করতে পারে (বিশেষ করে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর বাজারে)। ঘুমধুম-মুখে হাইওয়ে চালু হলে সড়কপথেই চীন যাওয়া সম্ভব। ঘুমধুম বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশি এলাকা। আর মুখে হচ্ছে চীনের সীমান্ত শহর।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (BIMSTEC, পরিবর্তিত নাম BBIMSTEC) এবং BCIM জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত BCIM জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেওয়ায় এই জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রাম মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রপ্তানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদি পশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশিরা মিয়ানমারে গবাদি পশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে।

মিয়ানমারের সেগুনকাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুনকাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর, যেমন রুবি, জেড, বোস আর মার্বেল সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে পুঁজি করে ভ্যালুএডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় সম্পদ রিলায়েন্স মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। এই গ্যাস তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি, সেখানে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এ কারণে ইস্যু এবং সর্বশেষ নায়েক রাজ্জাকের অপহরণের ঘটনায় সম্পর্কে কিছুটা অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই অবিশ্বাসকে নিয়ে বেশি দূরে যাওয়া ঠিক হবে না। একমাত্র স্মার্ট ডিপ্লোমেসির মাধ্যমেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ককে আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।
Ntv online
25.06.15

বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি কি পরিত্যক্ত

এক সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তেমন কোনো কথাবার্তা শোনা যায় না। এমনকি সরকার প্রধান কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যেও এটা প্রমাণিত হয়নি যে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে। বলতে গেলে চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামালেই (২০০১-২০০৬) বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্বমুখিতার কথা বলে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার উšে§াচন করেছিলেন। বাংলাদেশের গত ৪৪ বছরের পররাষ্ট্রনীতিতে পূর্ব দিগন্তের দেশগুলো ছিল উপেক্ষিত। বিশেষ করে মিয়ানমার কিংবা থাইল্যান্ডের মতো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করার কোনো বড় উদ্যোগ অতীতে লক্ষ্য করা যায়নি। পূর্বমুখী নীতি বলতে সাধারণত দক্ষিণ পূর্ব ও প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, জোরদার ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগকে বোঝায়। এটি ছিল অনেকটা উপেক্ষিত। যেমন বলা যেতে পারে সিঙ্গাপুরের কথা। ১৯৭৩ সালে সিঙ্গাপুর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশটি সফর করেছিলেন। এরপর ২০০৪ সালে সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোহ চোক টং বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরপর থেকে দেশ দুটির মাঝে উচ্চ পর্যায়ে তেমন একটা সফর বিনিময় হয়নি। তবে বেগম জিয়া ২০০৫ সালে সিঙ্গাপুর সফর করেছিলেন। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের একটা গুরুত্ব আছে। সিঙ্গাপুর কর্তৃক প্রস্তাবিত আমেড-৮ এ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী এশিয়া মিডিল ইস্ট ডায়লগ-৮ (আমেড-৮) এর প্রস্তাব করেছিলেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, মিসর, জর্ডান, কুয়েত এবং বাহরাইনের সমন্বয়ে প্রস্তাবিত এই ফোরামের লক্ষ্য হবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় এবং পারস্পরিক উন্নয়নের জন্য একে অপরকে সাহায্য করা। পরবর্তীতে চীনের উদ্যোগে ও ভারতের সমর্থনে নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় শোনা গেল বিসিআই’র (ভুটান, বাংলাদেশ ভারত-সাতবোন রাজ্য ও নেপাল) কথা। এগুলো সবই আঞ্চলিক সহযোগিতা। তবে এর মাঝে বিসিআইএম’র গুরুত্ব অনেক বেশি। ২০০৩ সালে চীনের প্রস্তাবিত উদ্যোগই পরবর্তীতে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। মজার ব্যাপার ভারত এ ব্যাপারে আগ্রহী হওয়ার পরেই এই বিসিআইএম জোটের ধারণা শক্তিশালী হয়। এই জোটটি কার্যকরী হলে কুনমিং (ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়ক পথে বাংলাদেশে ও ভারতেও আসা যাবে এবং পণ্য আনা নেয়া করা যাবে। এর ফলে চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে।
দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালের মধ্যে আসিয়ানে মুক্তবাজার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএম’র আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। নর্থ রুটে কুনমিং থেকে মিয়ানমারের মিয়াতকিহা হয়ে ভারতের লিডো পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। এই রুটে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে না। এই রুটটি অনেক কঠিন। সাউথ রুটে ইউনান থেকে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র বন্দর সোনাদিয়া পর্যন্ত সংযুক্ত ছিল। কুনমিং মান্দালয় (মিয়ানমার) ও এওয়ে (মিয়ানমার) হয়ে এই রুটটি চট্টগ্রামে প্রবেশ করবে। পরে ঢাকা হয়ে কলকাতা যাবে। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত না হওয়ায় (ভারতের আপত্তির কারণে) এই প্রস্তাবিত রুটটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তৃতীয় প্রস্তাবিত রুটটি হচ্ছে মিডল রুট। এই রুটটি ভালো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহƒত হচ্ছে। এটাই প্রাচীন সিল্ক রুট। কুনমিং বামো-লেসহিয়ো-টামু (মিয়ানমার), ইমফল (ভারত)-সিলেট-ঢাকা ও কলকাতা হচ্ছে এই রুট, যা কীনা কেটুকে নামেও পরিচিত। অর্থাৎ কুনমিং থেকে কলকাতা। অনেকের স্মরণ থাকার কথা এই রুটে (২৮০০ কিলোমিটার) একটি মোটর র‌্যালি (২০১৩) চালু হয়েছিল। এই জোটের সম্ভাবনা ছিল বিশাল। কেননা এই চারটি দেশের (বিসিআইএম) রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাস সম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহƒত জমি (মিয়ানমার) এবং সমুদ্র বন্দর (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামীতে যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেক অংশে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এই জোট। এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএম’র অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১.২ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৯০.২১ মিলিয়ন ডলারে। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা আর ৪৪০ মিলিয়ন মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশগুলোতে। পূর্বে রয়েছে কুনমিং আর পশ্চিমে কলকাতা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে এতে করে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে সহজ হয়। ভারত ২০০৭ সালে আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ইতোমধ্যে ভারত আসিয়ানের ‘ডায়লগ পার্টনার’ এর মর্যাদা লাভ করেছে (বাংলাদেশের অবস্থান আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামে)। ‘ডালগ পার্টনার’ এর পরবর্তী ধাপ হচ্ছে পূর্ণ সদস্য। তাই ভারতের আগ্রহ ছিল, যাতে করে ভারত তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার এই বিসিআইএম নিয়ে আদৌ এগিয়ে যাবে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তার আগ্রহ বেশি বিবিআইএন জোট নিয়ে। ফলে বিসিআইএম জোট নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি ভারত মহাসাগরে প্রভাব বলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন এক ধরনের সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, নৌ তৎপরতা এবং জিবুতিতে একটি নৌ ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ, এমনকি হামবানতোতায় চীনা  সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ফলে শ্রীলংকায় সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এমনকি ভারত মহাসাগরভুক্ত সিসিলি, মরিশাসে ভারত নৌ ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ৬০ দেশকে তিনি চীনের প্রভাব বিস্তারের আওতায় আনতে চান। ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোও এর মাঝে আছে। এটা সেই পুরনো ‘সিল্ক রোড’ এরই আধুনিক সংস্করণ। ভারত এতে উদ্বিগ্ন। ফলে ভারত তার সেই পুরনো ‘কটন রুট’ নিয়েই চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও এই প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা দেশ দুটির মাঝে এক আস্থাহীনতার সৃষ্টি করবে। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও প্রভাবিত হতে বাধ্য। তাই বিসিআইএম জোট নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হলেও এ অঞ্চলে ভারতীয় কর্তৃত্ব বাড়বে। চীনের প্রভাব এর মাঝ দিয়ে সংকুচিত হবে। তাই খুব স্পষ্ট করেই বলা যায় বিসিআইএম জোটের বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে চীনের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়বে, এটাই মনে করেন ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা। ভারতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ হয় এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না ভারত। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বিসিআইএম জোট তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে ভারতের প্রভাব বাড়ছে। আগামীতে এ অঞ্চলের তিনটি দেশ (ভুটান, নেপাল ও বাংলাদেশ) ভারতের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হবে। বিশেষ করে জ্বালানি ও বাণিজ্য নির্ভরতা এই দেশগুলোকে ভারতমুখী করে তুলবে। আর এ ক্ষেত্রে ভারতের স্ট্র্যাটেজি হবে বিবিআইএন জোটকে গুরুত্ব দেয়া এবং বিসিআইএমকে নিষ্ক্রিয় করা। এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এ প্রশ্ন এখন উঠেছে। বিবিআইএন’র গুরুত্ব যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে বিসিআইএম এরও গুরুত্ব। এমনকি আমেড-৮ কেও অস্বীকার করা যায় না।
বাংলাদেশের বিপুল জ্বালানি এবং পানি সমস্যার সমাধান করতে হলে বিবিআইএন জোটকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এ অঞ্চলে বিশাল এক জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। শুধুমাত্র ভারতের সাত বোন রাজ্যে ৭০ হাজার মেগাটাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ভুটান ও নেপালেও রয়েছে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা ভারত এখন দ্বিপাক্ষিকভাবে ব্যবহার করছে, যেখানে বাংলাদেশের দাবি উপেক্ষিত ছিল। একই কথা প্রযোজ্য পানি জলাধারের মাধ্যমে সংরক্ষণের একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও। শুষ্ক মৌসুমে ভারতের যেমনি পানির প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন আমাদেরও। এ ক্ষেত্রে বর্ষার সময় পানি ধরে রেখে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। এমনকি বাংলাদেশ যে গঙ্গা ব্যারাজ করতে চাচ্ছে এ ক্ষেত্রেও ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারতের সীমান্তের পাংখ্যা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকায় জলাধার নির্মাণ করা যায়। যাতে করে বছরে ২৫ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সমস্যা হচ্ছে ভারত এ বিষয়টি দেখছে দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির এপ্রোচটা ভিন্ন বলেই মনে হয়। তিনি বাংলাদেশে এসেও বলে গেলেন সবাইকে নিয়েই তিনি চলতে চান। তাই একটা প্রশ্ন থাকলই যে, বিবিআইএন জোটটি না শেষ পর্যন্ত একটি দ্বিপাক্ষিক জোটে পরিণত হয়। যেখানে ভারতের স্বার্থ বেশি! একই সঙ্গে আমরা যদি বিসিআইএম জোটের দিকে তাকাই যা এখনো পূর্র্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করেনি, তাহলে দেখব এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। এর মাধ্যমে কুনমিং-কক্সবাজার প্রস্তাবিত সড়কটি তৈরি শেষ হবে। সড়ক পথে চীনা পণ্য এ দেশে আসবে। ফলে চীনা পণ্যের দাম কমবে। এই জোটের মাধ্যমে পূর্বের দিকে আমাদের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে। আসিয়ানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। আসিয়ান রেজিওনাল ফোরাম থেকে আমাদের সদস্যপদ ভারতের মতো আসিয়ান ডায়ালগ পার্টনারে উন্নীত হতে পারে। এতে করে ভবিষ্যতে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ পেতেও আমাদের সুবিধা হবে, যা ভারত এখন চাচ্ছে। উপরন্তু আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে আগামী ৫ বছরের মধ্যে যে শুল্কমুক্ত বাজার সৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে শুল্কমুক্তভাবে আমাদের পণ্যের প্রবেশাধিকার সহজ হবে। অন্যদিকে আমেড-৮ এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমনি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বে বাংলাদেশ যে একটি সহনীয় ইসলাম (মডারেট ইসলাম) ধারণ করে, এই ধারণা আরো শক্তিশালী হবে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা হবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ফ্যাক্টর।
বর্তমান সরকারের আমলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কিছুটা ভারতের দিকে ঝুঁকে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে না, এটাই প্রত্যাশা করি। ভুলে গেলে চলবে না এই পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি সরাসরিভাবে জড়িত। Daily Manobkontho 23.06.15

শিক্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছেই

শিক্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ এর 'বিস্ফোরণ' নিয়ে সারাদেশ যখন উৎকণ্ঠিত, তখন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলো একটি দুঃখজনক সংবাদ। লন্ডনের টাইমের হায়ার এডুকেশন শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০১৫ সালে শিক্ষার মানদ-ে এশিয়ার শীর্ষ ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই। আমরা যারা বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, আমাদের জন্য সংবাদটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। আসলে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বত্র ব্যাপক ধস নেমেছে। একদিকে জিপি-৫ এর সংখ্যা বাড়িয়ে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যাশাকে আমরা বাড়িয়ে দিয়েছি, যারা অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। অনেকে স্মরণ করতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হক তার মেয়ে তাহিয়ার 'এ প্লাস' পাওয়া নিয়ে ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, তার কথা। ফাহমিদুল হক অত্যন্ত সাহস করে লিখেছিলেন তাহিয়া 'এ প্লাস' পাওয়ার যোগ্য নয়। তারপরও সে পেয়েছে। আমি সংবাদপত্রে শিক্ষামন্ত্রীকে এ নিয়ে গর্ব করতে দেখি। আমার তাতে দুঃখবোধ বাড়ে। আমি 'এ প্লাস'-এর বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এতে কি শিক্ষার মান বাড়ল? এরাই তো আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবে না অনেকে। তাহলে িী এই 'এ প্লাস' ওদের জন্য বোঝা হয়ে গেল না?
মাননীয় মন্ত্রী, শিক্ষার মান বাড়ছে বলে আপনি যখন গর্ব করেন তখন আপনাকে আমি সমর্থন করতে পারি না। বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষার মানের প্রচ- অবনতি হয়েছে। জিপিএ-৫ এখন গলার কাঁটা। এই জিপিএ-৫ এখন হাসির ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশে ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা নিয়েও আপনার গর্ব হতেই পারে। কিন্তু এর মধ্যেও আমি কোনো কৃতিত্ব দেখি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর মধ্যদিয়ে শিক্ষার গুণগতমান বাড়ানো যাবে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি করে ফেলেছি ইতোমধ্যে। 'রাজনৈতিক বিবেচনায়' শত শত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এক বিষয়ের শিক্ষক, অন্য বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হয়নি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। অন্যদিকে তরুণ শিক্ষকদের দায়বদ্ধতাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। তরুণ প্রজন্ম শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে বেছে নেয়নি। তাই উচ্চশিক্ষা ও এর মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। ভালো শিক্ষক না হলে ভালো ছাত্র তৈরি হয় না, মন্ত্রী হিসেবে তো এটা আপনার জানার কথা। উচ্চশিক্ষা নিয়ে মাননীয় মন্ত্রীর কাছে পূর্ণচিত্র আছে কিনা সন্দেহ। একদিকে 'ভালো ছাত্ররা' রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় যেমনি শিক্ষকতায় আসতে পারছে না, অন্যদিকে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭-তে উন্নীত করায় এখানেও তৈরি হয়েছে বৈষম্য। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হচ্ছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের যোগানদাতা। সেই মঞ্জুরি কমিশনই যখন অবসরের বয়সসীমা ৬৭ নিয়ে আপত্তি তুলেছে, তখন কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এটা বাস্তবায়ন করে কিভাবে? এখানে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। নেয়া হচ্ছে দলীয় আনুগত্য আর রাজনীতির বিষয়টি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা। উচ্চশিক্ষা নিয়ে আরো কিছু কথা বলা দরকার। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন ঢালাওভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করছে। কিন্তু কারা করছে পিএইচডি? পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, সিনিয়র জেনারেল আর সচিবরা এখন পিএইচডি করছেন। যে কেউ তার যদি মেধা থাকে, তিনি পিএইচডি করতেই পারেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই পিএইচডি একটি গবেষণা। গবেষককে ছুটি নিতে হয়। লাইব্রেরিতে যেতে হয়। ফিল্ডওয়ার্ক করতে হয়। কোর্সওয়ার্ক করতে হয়। লাইব্রেরিতে না গিয়ে, ফিল্ডওয়ার্ক না করে, 'ফুল টাইম' অফিস করে কী গবেষণা হয়? এটি দেখার কেউ নেই। মাননীয় মন্ত্রীর কাছেও সঠিক তথ্যটি নেই। ফলে উচ্চশিক্ষার নামে আমরা শুধু সার্টিফিকেটধারীদের সংখ্যাই বাড়াচ্ছি না। এখন আবার পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাও বাড়াচ্ছি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীও রয়েছে। এরা আবার স্বনামে কার্ড ছাপিয়ে তা বিলিও করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটা দেখে না। মাননীয় মন্ত্রীর সময় নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা বয়সের ভারে ক্লান্ত, অবসন্ন। কাজটি তাহলে কে করবে?
অপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। কোন কোন সেক্টরে আমাদের কতো গ্র্যাজুয়েট দরকার, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। ফলে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিবিএর মতো বিষয়ে সার্টিফিকেট নিচ্ছে এবং তারা এখন বেসরকারি খাতে 'ভদ্র কেরানি'তে পরিণত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও আমাদের চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। সেটিও আমরা করছি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ঘরে ঘরে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী তৈরি করে আর যাই হোক আমরা শিক্ষার মান বাড়াতে পারিনি। 'কোটাব্যবস্থা' নিয়েও চিন্তা করার সময় এসেছে। যেখানে জিপিএ-৫ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না, সেখানে কোটার কারণে ভর্তি হচ্ছে শত শত শিক্ষার্থী। অযোগ্য এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে জাতীয় জীবনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বরং এরা জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এদিকেও দৃষ্টি দেয়া দরকার। মাননীয় মন্ত্রীর সময় কই এসব দেখার। জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শতকরা ৮০ জন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় নূ্যনতম পাস নাম্বার তুলতে ব্যর্থ হয়, তখন সত্যিকার অর্থে বিষয়টা আমাদের ভাবায়। পাসের হার বাড়িয়ে দেখানোর মধ্যে কোনো কর্তৃত্ব নেই। এই সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল যে উত্তরপত্রগুলো সাধারণভাবে মূল্যায়ন করা ও নাম্বার বাড়িয়ে দেয়া। এসব অভিভাবকরা বুঝতে পারবেন জিপিএ-৫ পাওয়া তার সন্তানটি তার জন্য বোঝা হয়ে গেল। এক ধরনের হতাশা ওইসব শিক্ষার্থীর মধ্যে এসে থাকে যখন জিপিএ-৫ নিয়েও তারা কোথাও ভর্তি হতে পারবে না। এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। আমার ধারণা তাকে যারা পরামর্শ দেন, সঠিক পরামর্শটি তারা দেন না। সীমিত 'লাভ' বা সুবিধা নিয়ে আর যাই হোক সমাজে বড় পরিবর্তন আনা যায় না। মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন।
মন্ত্রীকে উপদেশ দেয়ার ক্ষমতা আমি রাখি না। সব ব্যাপারেই যদি তিনি 'রাজনীতি' খোঁজেন, তাহলে তা হবে বড় ভুল। শিক্ষার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। তাকে এখন ভাবতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। আমলারা আপনাকে সঠিক উপদেশটি দেন বলে আমার মনে হয় না। সুবিধাভোগী আমলারা আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই মূল বিষয় থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখছে। আপনি অতীতের দৃষ্টান্ত তুলে 'যুক্তি' খাড়া করতে চাই না। কিন্তু জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বাড়িয়ে আমরা কি ওদের প্রত্যাশাকে আরো বাড়িয়ে দিলাম না? 'একটা বাচ্চা কষ্ট করে শিখবে, জানবে, বুঝবে, বিষয়কে আয়ত্ত করবে। একটা প্রতিযোগিতা থাকবে ওদের ভেতরে। আর 'ভালো করার' একটা জিদ তৈরি হবে ছোটবেলা থেকেই। তা না করে তার জিপিএ-৫ প্রাপ্তি তাকে 'ভালো করে পড়াশোনা' করার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করবে। ভবিষ্যতে সে যখন এই জিপিএ-৫ নিয়ে কোনো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না, তখন সে হতাশায় পড়ে যাবে। এক সময় অসৎ পথে পা বাড়াবে!
আমাদের দেশের বাচ্চারা অনেক মেধাবী। তাহিয়ার মতো মেয়েরা আমাদের ভবিষ্যৎ। ওদের নিজেদের মতো 'বড়' হতে দেয়াই উচিত। তথাকথিত জিপিএ-৫ তাহিয়াদের 'বড়' করবে না। ওদের জীবনটা ওদেরই গড়তে দেয়া উচিত। ওরা শুধু সীমিত 'প্রশ্ন' পড়ে মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৫ নিয়ে জীবনকে 'বড়' করে গড়ে তুলতে পারবে না। ওদের অনেক কিছু পড়াশোনা করা উচিত। বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, সবকিছু। জ্ঞানের রয়েছে এক বিশাল ভা-ার। এর মধ্যেই ওরা খুঁজে পাবে ওদের 'পৃথিবীকে'। আমি জানি এই বয়সে বাচ্চারা অনেক মেধাবী হয়। অনেক কিছু জানতে চায়। শিখতে চায়। কিন্তু তাদের শেখাটাকে আমরা 'সীমিত' করে দিচ্ছি। অযাচিতভাবে জিপিএ-৫ দিয়ে ওদের প্রত্যাশাকে আমরা বাড়িয়ে দিয়েছি। এটা ভালো নয়। এটা করে আমাদের নীতি-নির্ধারকরা অভিভাবকদের কাছে বাহবা নিতে চেয়েছেন। হয়তো কোনো কোনো অভিভাবক এতে খুশি হবেন। কিন্তু ফাহমিদুল হকের মতো অভিভাবকও আছেন, যারা খুশি হবেন না। একজন শিক্ষক যে কাজটি করেন, তিনি সে কাজটিই করেছেন। তারপরও 'ছোট্ট' তাহিয়ার জন্য আমার অনেক ভালোবাসা ও আদর। আমি জানি ও অনেক 'বড়' হবে, বাবার চেয়েও 'বড়' যাতে করে ফাহমিদুল একদিন তার মেয়ের জন্য গর্ব করতে পারেন। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম। এই জিপিএ-৫ তার আত্মবিশ্বাসের যেন ঘাটতি সৃষ্টি করতে না পারে, সে প্রত্যাশা থাকবেই।
উচ্চশিক্ষা নিয়েও আমার মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করে। আমি যা চেয়েছিলাম, তা পাইনি। আমার ছাত্ররা, যারা শিক্ষক হয়েছে, ওদের কাছে আমার যা প্রত্যাশা, তা আমি পাইনি। শিক্ষকতা, গবেষণার চেয়ে তাদের কাছে 'রাজনীতি', তা আমি পাইনি। শিক্ষকতা, গবেষণার চেয়ে তাদের কাছে 'রাজনীতি', 'আর্থিক আনুকূল্য' এসব বিষয়ই বেশি। অনেক শিক্ষককে দেখেছি দুটো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অনেকটা প্রকাশ্যেই করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে জানে না, তা নয়। জানে। হয়তো তাদের প্রাথমিক অনুমতিও আছে। এটা কি করে সম্ভব, আমি জানি না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্ট টাইমের কথা বলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'ছাড়পত্র' বা অনুমতি নেন বটে (অনেকে তাও নেন না), কিন্তু কাজ করেন 'ফুলটাইম'। দেখবে কে? মঞ্জুরি কমিশনের এ ব্যাপারে সরাসরি কোনো নির্দেশনা নেই। তবে আমি একাধিকবার বর্তমান মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তখন অবশ্যই তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন না। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। তিনি এ বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞাত। আমি খুশি হব যদি তিনি এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনা দেন। তবে আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি কমিশনে যারা আছেন, তারা উচ্চশিক্ষার এই সমস্যাটি নিয়ে ভাবেন না। এখনই সময়। এখনই দক্ষ হাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সামলাতে হবে। একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার সুবিধাবাদ করতে হবে। এটা আছে বলেই তরুণ শিক্ষকরা গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। একটা নীতিমাল তৈরি করা হোক। নিয়মের মধ্যে আসুক সবকিছু। না হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ব আমরা। আজকে টাইমের প্রতিবেদনে যা ছাপা হয়েছে, এটা তারই ফল। উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে মঞ্জুরি কমিশনের। ঢালাওভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের কথা বলেছিলেন আবদুল মান্নান এক সাক্ষাৎকারে। আমি তাতে আশ্বস্ত হয়েছি। তাকে সাধুবাদ জানাই। তিনি 'সিস্টেম'কে এভাবে চলতে দেবেন না। এটাই প্রত্যাশা করি।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। শিক্ষকদের পদোন্নতি ও শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি নতুন করে সাজাতে হবে। আমি জানি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসিরা এটি মানবেন না। কিন্তু একজন দক্ষ ইউজিসির চেয়ারম্যানই পারেন সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে। আমার ধারণা সরকারের শীর্ষ পদে যারা আছেন, তাদের সমর্থন তিনি পাবেন। কেননা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা থাকা উচিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। Daily Jai Jai Din 22.06.15

বিসিআইএম জোট কি তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে?

বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে বিসিআইএম জোটটি কি শেষ পর্যন্ত তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির ঢাকা সফর ও চার দেশীয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট বিবিআইএন গঠনের পর খুব সংগত কারণেই বিসিআইএমের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিসিআইএম হচ্ছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাতবোন রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে বাস্তবিত একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে যখন চীন সফরে যান, তখন এই উপ আঞ্চলিক সহযোগিতার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তিনি ওই সময় ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংও সফর করেছিলেন। বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে একটি কোর কমিটি এ ব্যাপারে কাজ করছে। এই কমিটি একাধিকবার মিলিত হয়েছে। এমনকি এই চার দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও একাধিকবার বৈঠকে মিলিত হয়ে করণীয় নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু অতি সাম্প্রতিককালে চীন-ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ব্যাপারে নরেদ্র মোদির বিশেষ আগ্রহের কারণে শেষ পর্যন্ত বিসিআইএম জোটটি আত্মপ্রকাশ করবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উপরন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশেরও একটি ‘ভুল বোঝাবুঝির’ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যে প্রত্যাশা নিয়ে বিসিআইএম জোট একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল, সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটতে পারে আগামীতে। এবং শেষ পর্যন্ত সম্ভাবনায় এই জোটটি কাগজ-কলমেই থেকে যেতে পারে। উল্লেখ করা ভালো যে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে বেশ গুরুত্ব দেয়। এ কারণেই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই জোটের বিকাশের প্রয়োজন ছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কয়েকশ বছরের পুরোনো। ১৪২১ থেকে ১৪৩১ সাল পর্যন্ত ইউনান রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে একজন নাবিক মা হে (যিনি পরবর্তীকালে অ্যাডমিরাল ঝেং হে হিসেবে পরিচিতি পান) দু-দুবার বাংলার তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁও ভ্রমণ করেন। চীন তখন নাবিক মা হে-কে গুরুত্ব দেয়। চীন ২০০৩ সালে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। তখন চীন ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর কথা বলেছিল, যা এখন বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। মজার ব্যাপার হলো, ভারত এ ব্যাপারে আগ্রহী হওয়ার পরেই এই বিসিআইএম জোটের ধারণা শক্তিশালী হয়। এই জোটটি কার্যকরী হলে কুনমিং (ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ এবং ভারতেও আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেওয়া যাবে। এর ফলে চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালের মধ্যে আসিয়ানে মুক্তবাজার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। নর্থরুটে কুনমিং থেকে মিয়ানমারের মাইটকিহা হয়ে ভারতের লেডো পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। এই রুটে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে না। এই রুটটি অনেক কঠিন। সাউথ রুটে ইউনান থেকে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর সোনাদিয়া পর্যন্ত সংযুক্ত ছিল। কুনমিং মান্দালয় (মিয়ানমার) ও অ্যাওয়ে হয়ে এই রুটটি চট্টগ্রামে প্রবেশ করবে। পরে ঢাকা হয়ে কলকাতা যাবে। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হওয়ায় (ভারতের আপত্তির কারণে) এই প্রস্তাবিত রুটটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তৃতীয় প্রস্তাবিত রুটটি হচ্ছে মিডল রুট। এই রুটটি ভালো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাই প্রাচীন সিল্ক রুট। কুনমিং Bhamo-Lashio-Tamu (মিয়ানমার), ইমফল (ভারত)-সিলেট-ঢাকা ও কলকাতা হচ্ছে এই রুট, যা কিনা K2K নামেও পরিচিত। অর্থাৎ কুনমিং থেকে কলকাতা। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, এই রুটে (২৮০০ কিলোমিটার) একটি মোটর র‌্যালি (২০১৩) চালু হয়েছিল। এই জোটের সম্ভাবনা ছিল বিশাল। কেননা এই চারটি দেশের (বিসিআইএম) রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) এবং সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যটি বদলে যেতে পারে আগামীতে যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি ছাড়াও বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও অনেক অংশে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এই জোট। এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কি না বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১.২ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৯০.২১ মিলিয়ন ডলারে। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা আর ৪৪০ মিলিয়ন মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশগুলোতে। পূর্বে রয়েছে কুনমিং, আর পশ্চিমে কলকাতা। ভেতরে মান্দালয় আর ঢাকা। ভারত ও জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে, এতে করে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে সহজ হয়। ভারত ২০০৭ সালে আনিয়ানের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এরই মধ্যে ভারত আসিয়ানের ‘ডায়ালগ পার্টনার’-এর মর্যাদা লাভ করেছে (বাংলাদেশের অবস্থান আনিয়ান আঞ্চলিক ফোরামে)। ‘ডায়ালগ পাটর্নার’-এর পরবর্তী ধারা হচ্ছে পূর্ণ সদস্য। তাই ভারতের আগ্রহ ছিল, যাতে করে ভারত তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে নরেদ্র মোদি সরকার এই বিসিআইএম নিয়ে আদৌ এগিয়ে যাবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তার আগ্রহ বেশি বিবিআইমের জোট নিয়ে। ফলে বিসিআইএম জোট নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেলই। এরই মধ্যে আমরা লক্ষ করেছি, ভারত মহাসাগরে প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, নৌ তৎপরতা এবং জিবুতিতে একটি নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ, এমনকি হামবানটোটায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ফলে শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এমনকি ভারত মহাসাগরভুক্ত সিসিলি, মরিশাসে ভারত নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ৬০টি দেশকে তিনি চীনের প্রভাব বিস্তারের আওতায় আনতে চান। ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোও এর মাঝে আছে। এটা সেই পুরনো ‘সিল্করোড’-এরই আধুনিক সংস্করণ। ভারত এতে উদ্বিগ্ন। ফলে ভারত তার সেই পুরোনো ‘কটন রুট’ নিয়েই চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও, এই প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা দেশ দুটির মাঝে এক আস্থাহীনতার সৃষ্টি করবে। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কর্তৃত্ব হারাতে বাধ্য। তাই বিবিআইএন জোট নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন, এ অঞ্চলে ভারতীয় কর্তৃত্ব বাড়াবে। চীনের প্রভাব এর মাঝে সংকুচিত হবে। তাই খুব স্পষ্ট করেই বলা যায়, বিসিআইএস বিকশিত হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে চীনের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়বে মনে করেন ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা। নিজেদের স্বার্থের বিপক্ষে কোন সিদ্ধান্তে যাবে না ভারত। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এ জোট তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে ভারতের প্রভাব বাড়বে। আগামীতে এ অঞ্চলের তিনটি দেশ (ভূটান, নেপাল ও বাংলাদেশ) আরো বেশি নির্ভরশীল হবে। বিশেষ করে জ্বালানি ও বাণিজ্য নির্ভরতা তাদেরকে ভারতমুখী করে তুলবে। আর এক্ষেত্রে ভারতের ষ্ট্রাটেজি হবে আইএন জোটকে গুরুত্ব দেয়া এবং বিসিআইএসকে নিস্ক্রিয় করা। NTV online ২১ জুন ২০১৫, ১৩:৩৮

শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ ও কিছু কথা

প্রস্তাবিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য শিক্ষা খাতে মোট ৩১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাতে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অন্তর্ভুক্ত। বাজেটে মোট ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা, আর আয় দেখানো হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। ঘাটতি ৮০ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতে মোট বাজেটের ১১.৬ শতাংশ শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এটি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের চেয়ে ১.৫ শতাংশ কমেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১৩.১ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ ছিল (২৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা) তা সংশোধিত বাজেটের পরিমাণ কমিয়ে ২৮ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা করা হয়। শিক্ষা খাতে এ ব্যয় বরাদ্দ সর্বোচ্চ নয়। জনপ্রশাসনে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। তারপরও শিক্ষা খাতে এ ব্যয় বরাদ্দ নিয়ে নানা কথা আছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা শিক্ষিত বেকার তৈরি করছি কিনা, এটি নিয়ে খোদ দেশ ও বিদেশে প্রশ্ন রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের (ইকোনমিস্ট) মাঝে ৪৭ ভাগ বেকার। একমাত্র আফগানিস্তান বাদে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার বেশি। শ্রীলঙ্কায় যেখানে এ হার মাত্র ৭ ভাগ, নেপালে ২০, পাকিস্তানে ২৮, আর ভারতে ৩৩, সেখানে বাংলাদেশে এ হার ৪৭। এটি নিঃসন্দেহে একটি উদ্বেগজনক বিষয়। যেখানে প্রতি বছর ১৩ থেকে ১৬ লাখ জনশক্তি চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে, সেখানে বিভিন্ন কারণে (রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অন্যতম) এদেশে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে বেকারত্ব। এ বেকারত্বের মাঝে আবার আছে কিছু 'ছায়া বেকারত্ব'। এদের দেখা যায় না বটে। কিংবা কোনো পরিসংখ্যানেও এরা আসে না। কিন্তু ছোটখাটো, অর্ধবেলা কাজ করে এরা জীবিকা নির্বাহ করছে।

আমরা দেশে এরই মধ্যে ৩৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৯টি। সব মিলিয়ে ১২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ক'টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানসম্মত দক্ষ গ্রাজুয়েট আমরা তৈরি করেছি? এর জবাব অত্যন্ত হতাশাজনক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখন অনেকটা সার্টিফিকেট সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১০ থেকে ১৫ লাখ ছাত্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় পড়াশোনা করে। কিন্তু এখানে কি আদৌ পড়াশোনা হয়? শত শত কলেজে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। ঢাকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কিংবা ইউজিসির কর্তাব্যক্তিরা জানেন না এ অনার্স কোর্স খুলে শত শত শিক্ষকের জন্য একটি 'ব্যবসার' সুযোগ করে দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আমি অনেক কলেজের খবর জানি, সেখানে আদৌ কোনো ক্লাস হয় না। শিক্ষকরা কলেজে শিক্ষা দানের পরিবর্তে বাসায় ব্যাচের পর ব্যাচ 'প্রাইভেট' পড়ান। অথচ ওই শিক্ষকের কলেজে থাকার কথা। অনার্স পর্যায়ে কোনো ছাত্র প্রাইভেট পড়ে অথবা শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন, এটি আমাদের জামানায় আমরা না শুনলেও এটি হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন সরকারি কলেজগুলোর একটি বাস্তব চিত্র। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আসেন, ভিসি যান, কিন্তু সংস্কার কেউ করেনন না। এটি এখন মূলত একটি সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ভর্তি হয়ে চার বছর পর মেলে একখানা সার্টিফিকেট। ক্লাস না করে, সংসার ধর্ম পালন করে, কোনো টেঙ্ট বই না পড়েও যে একখানা অনার্স সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর বড় উদাহরণ। এ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশে উচ্চশিক্ষায় বড় অংশের বেকারত্ব সৃষ্টি করছে। দুঃখ লাগে, শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি এদিকে পড়েনি। তিনি আদৌ ভেবেছেন কিনা, তাতেও রয়েছে আমার সন্দেহ।

একুশ শতকে একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে শক্তিশালী করতে হবে। সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি জোর দিতে হবে প্রযুক্তিগত তথা আইটিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। এ আইটিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা একদিকে যেমনি বেকার সমস্যা সমাধানে বড় ভূমিকা রাখবে, ঠিক তেমনি বহির্বিশ্বে মানবসম্পদের একটি সুষ্ঠু ব্যবহারও হবে। আর তাই শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে, সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে এবং শিক্ষা কাঠামোতেও আনতে হবে পরিবর্তন। এজন্যই গ্রাম পর্যায়ে স্কুল বাড়িয়ে, সরকারি অনুদান বাড়িয়ে প্রতিটি স্কুলকে মানবসম্পদ গড়ার একেকটি 'কারখানা' হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সিঙ্গাপুর এ কাজটি করেছিল বিধায় ছোট এদেশটি আজ উন্নয়নশীল বিশ্বে একটি আদর্শ। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমরা এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছি কম। শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে সরকার। তাতে করে উপকৃত হয়েছে কারা? বেতন খাতেই তো চলে যায় পুরো টাকা। সরকারি কলেজগুলোতে (সরকারি) অবকাঠামো খাতে কিছু উন্নয়ন হয়। কিন্তু এখানে মানসম্মত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন না কেউ। আর শিক্ষকরা এখন গুরুত্ব দেন 'প্রাইভেট পড়ানোর' ওপর। মানসম্মত শিক্ষা তাদের কাছে মুখ্য নয়। এসব দেখারও যেন কেউ নেই। অর্থমন্ত্রী যখন নতুন বাজেট উপস্থাপন করলেন তখন এ কথাটিই আবার মনে হলো। নিয়ম রক্ষার্থে তিনি শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছেন; কিন্তু যে প্রশ্নটি ওঠে তা হচ্ছে এ বিশাল ব্যয় দিয়ে আমরা উচ্চশিক্ষার কতটুকু মানোন্নয়ন করতে পারব? বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষার মানোন্নয়ন, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় গবেষণা, আইটি সেক্টরের উন্নয়ন- এ বরাদ্দ দিয়ে আদৌ সম্ভব নয়। কেননা এ অর্থের মাঝে ১৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। আর ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা ব্যয় হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পেছনে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য যে বরাদ্দ, তাতে করে আমাদের উৎফুল্ল হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা এ টাকার খুব সামান্যই ব্যয় হয় উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের মাঝে একটি অংশ বরাদ্দ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। ২০০১-০২ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৯৩.৫৭ কোটি টাকা, আর ২০১০-১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০২.২৪ কোটি টাকা। জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.৭৫ ভাগ বরাদ্দ থাকে শিক্ষা খাতে (২০০১-০২)। এ পরিসংখ্যান বেড়েছে ০.৮৪ ভাগ ২০১০-১১ সালে। আবার যদি শুধু শিক্ষা খাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বরাদ্দের দিকে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে এ বরাদ্দ মাত্র ৭.৮৫ ভাগ (২০০১-০২) থেকে ৮.২২ ভাগ (২০১০-১১)। অর্থাৎ পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। সম্প্রতি শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে, বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। যদিও তুলনামূলক বিচারে অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বাজেট শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। তারপরও কথা থেকে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে এর চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব নয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেবে দেখতে হবে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয় বাড়ানো যায় এবং সরকারের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা কমানো যায়। এখানে আরও একটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন আর তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে টাকা বরাদ্দ করা হয়, তার খুব কম অংশই ব্যয় হয় গবেষণার কাজে। বরাদ্দকৃত টাকার একটি সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ভিসি মহোদয়রা উন্নয়ন খাতে কিংবা গবেষণায় যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল সেই টাকা নতুন শিক্ষকদের বেতন দিতে ব্যয় করেছেন। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দলীয় কোটায়, স্থানীয় কোটায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। কিছু দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি নিজের মেয়ে, ভাই, আপন ভায়রা, শ্যালিকার মেয়ে, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে শিক্ষক তথা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এ প্রবণতা প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। অভিযোগ, জাহাঙ্গীরনগর এরই মধ্যে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে! ফলে অতিরিক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট থেকে টাকা এনে শিক্ষক তথা কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ২০১১-১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুুরি কমিশন (বিমক) কর্তৃক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২২২.৪০ কোটি টাকা। এর মাঝে ১৬৫.১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে শুধু শাসকদের বেতন দিতে। শিক্ষক যে টাকা বরাদ্দ করেন, তা দিয়ে বেতন, পেনশন, সাধারণ খরচ, শিক্ষা খরচ, যানবাহন মেরামত ও মূলধনের চাহিদা মেটানো হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় বেতন পরিশোধের পর যা থাকে, তা দিয়ে অন্যকিছু করা আর সম্ভব হয় না। ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান হয় না। তাদের নূ্যনতম চাহিদাও মেটাতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। তারা অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশন দিতে পারে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। একুশ শতকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পুরোপুরিভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত হবে, এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশ একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি কল্যাণকামী অর্থনীতিও নয়। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপের কোনো কোনো রাষ্ট্রে (যেমন জার্মানি), কিংবা নরডিকভুক্ত রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্র সব নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ সেই পর্যায়ে যেতে পারেনি। ওইসব রাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা একদম ফ্রি। আমরা সেখানে পড়াশোনা করেছি কোনো ধরনের টিউশন ফি ছাড়াই (শুধু ছাত্র সংসদের জন্য কিছু অর্থ দিতে হয়)। স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরিভাবে ফ্রি না হলেও বেকার ভাতা সেখানে রয়েছে। জার্মানি বা সুইডেনের অর্থনীতির পক্ষে সম্ভব সাধারণ নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি সে পর্যায়ে নেই। তবে যে পর্যায়ে রাষ্ট্র শিক্ষা খাতকে প্রমোট করে, তা ঠিক আছে। রাষ্ট্র শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ দেবে। তবে এখানে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।

একুশ শতকে এসে একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ছাত্র বেতন না বাড়িয়েও আয় বাড়ানো যায়। এজন্য কতগুলো বিকল্প নীতি নির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন। প্রয়োজন পিপিপি অথবা বেসরকারি খাতকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগে উৎসাহিত করা। যেমন ব্যবসা প্রশাসন, অর্থনীতি, প্রযুক্তিবিদ্যা ও ফার্মেসিতে বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারি পুঁজিতে ল্যাব হতে পারে, ছাত্রাবাস নির্মিত হতে পারে, ট্রেনিং প্রোগ্রাম হতে পারে। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী রয়েছেন। প্রয়োজন একটি নীতি প্রণয়ন ও যোগাযোগ। একইসঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেকেন্ড ক্যাম্পাস কিংবা সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম (শুধু ব্যবসা প্রশাসন কোর্সই নয়) চালু করে তাদের আয় বাড়াতে পারে। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় এ উদ্যোগ নিতে পারে। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা তেজগাঁওয়ে অবস্থিত টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করতে পারেন। আর সেই বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি পেতে পারেন বড় বড় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। গার্মেন্টের পর আমাদের একটি সম্ভাবনার খাত হচ্ছে ওষুধ শিল্প। প্রতিটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়েই ফার্মেসি, বায়োটেকনোলজি বিভাগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলো বড় বিনিয়োগ করতে পারে। মোটকথা, আমাদের দৃষ্টিতে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয় চলবে। কিন্তু এখানে বিনিয়োগে বেসরকারি খাতকে আমরা উৎসাহিত করতে পারি। বেসরকারি উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে বেশ ক'টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করছে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো শিক্ষকও রয়েছেন। উদ্যোক্তারা যদি সেখানে বিনিয়োগ করতে পারেন, তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করবেন না কেন? আসলে এজন্য যা দরকার, তা হচ্ছে সুস্পষ্ট একটি নীতিমালা। বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যায় না। দলবাজ ভিসিরা এটি ব্যবহার করবেন তাদের স্বার্থে। দলবাজ শিক্ষকের সংখ্যা বাড়বে, কিন্তু দক্ষ জনশক্তি বাড়বে না। Daily Alokito Bangladesh 21.06.15

কালশীর হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর

অনেকটা অজান্তেই পার হয়ে গেল ঢাকার মিরপুরের কালশীর হত্যাকা-ের ঘটনা। খুব কম সংবাদপত্রেই ওই হত্যাকা-ের ফলোআপ প্রকাশ করা হয়েছে। গত বছরের ১৪ জুন শবেবরাতের রাতে কালশীর বিহারি ক্যাম্পে একটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এতে একই পরিবারের ৯ সদস্যসহ মারা যান ১০ ব্যক্তি। ওই সময় সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয়েছিলÑ মৃত ব্যক্তিরা যাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে না পারেন, সে জন্য বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেীয়া হয়েছিল। স্থানীয় লোকদের অভিযোগ ছিলÑ ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য জড়িত। পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল স্থানীয় বাসিন্দা। এরপর দুটি মামলা হয়েছিল। এক বছর পর ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (পশ্চিম) সাইফুল ইসলাম একটি সংবাদপত্রে (একটি জাতীয় দৈনিক, ১৩ জুন) বলেছেন, কে আগুন দিয়েছে, তা জানা যায়নি। তবে সংবাদপত্রটিকে তিনি জানাতে ভোলেননি যে, ‘তদন্ত চলছে’। একটি হত্যাকা-ে যখন ১০ ব্যক্তি মারা যান, এর তদন্ত করতে যদি এক বছর লাগে, তখন পুলিশের ওপর আমাদের আস্থাটা থাকে কই? পুলিশে যে অভিজ্ঞ ব্যক্তি নেই, তা তো নয়। পুলিশ পারে। অতীতেও পেরেছে। এই হত্যাকা-টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ছিল।কালশী কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় ২৭ এপ্রিল (২০১৪) নারায়ণগঞ্জের অপহরণোত্তর ৭ খুনের ঘটনা কিংবা একই বছরের ২০ মে ফেনী শহরে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামের হত্যাকা-ের ঘটনা। এগুলো সবই মূলত একসূত্রে গাঁথা। আমাদের নষ্ট রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেছে এসব হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে। আর এসব হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে সুশাসনের অভাব প্রচ-ভাবে অনুভূত হচ্ছে দেশে! যারা নীতিনির্ধারক তারা সুশাসনের এই অভাবটি অনুভব করেন কি না জানি না; কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক হত্যাকা- হচ্ছে এবং প্রতিটি হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়ভাবে সরকারদলীয় কর্তাব্যক্তিরা। আর প্রশাসন পালন করছে নির্লিপ্ত ভূমিকা। দেশে সুস্থ গণতন্ত্রচর্চা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ ধরনের হত্যাকা- আমাদের কোনো আশার বাণী শোনায় না।
আমাদের সংবিধানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার স্বীকৃত। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ এখন যে ঘটনা কালশীতে ঘটেছিল, যেখানে শিশু ও নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, সেখানে সংবিধান বর্ণিত মানবসত্তার মর্যাদা থাকল কোথায়? বিহারিরা উর্দুভাষী। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সংগঠনের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তাতে করে উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতেই পারেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৩ বছর পরও উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মূল ধারায় আসেনি। এখানে ব্যর্থতা কার, সে প্রশ্ন খুব সহজেই উঠতে পারে। বিহারিরা নিজেদের এখনো পাকিস্তানি মনে করেন এবং পাকিস্তানে যেতে চান। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় যেসব সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে পুনর্বাসন। অতীতে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হলেও অগ্রগতি হয়েছে কম। মাত্র একটি ব্যাচ পাকিস্তানে ফিরে গেছে। গত ১০ বছর এ নিয়ে তেমন আলোচনার খবর আমাদের জানা নেই। এক সময়ে নওয়াজ শরিফ এদের পাকিস্তানে নিয়ে যেতে রাজি হলেও প্রচ- আপত্তি ছিল প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর। বেনজির এদের পাকিস্তানি না বলে বিহারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন এরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, প্রায় ৫-৬ লাখ পাকিস্তানি নাগরিককে (সরকারিভাবে সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার) আমরা পাকিস্তানে যেতে অথবা পাকিস্তানকে গ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারিনি। এসব পাকিস্তানি নাগরিক বিভিন্ন ক্যাম্পে (ঢাকা ও সৈয়দপুর) মানবেতর জীবনযাপন করেন। শিক্ষাদীক্ষাহীন এসব নাগরিকের কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন ঢাকার কালশীর যে এলাকায় তারা থাকেন এবং যেটা তাদের স্থায়ী ঠিকানা, এটা তাদের অপরাধ হতে পারে না। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এদের অনেকেই জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের নিজস্ব জমি থেকে উচ্ছেদের একটা ষড়যন্ত্রের কথা পত্রপত্রিকায় তখন প্রকাশ করা হয়েছিল। আর ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় তখন ছাপা হয়েছিল। বিহারিরা প্রকাশ্যেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। যে তদন্ত হচ্ছে এক বছর ধরে তাতে প্রকৃত সত্য আদৌ বেরিয়ে আসবে কি না, আমার মতো অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে তাতে। তবে এই সংসদ সদস্য সম্পর্কে দৈনিক পত্রিকাটি আমাদের যে তথ্য দিয়েছিল (১৮ জুন ২০১৪) তাতে করে তার বিহারিদের ওই জমির ওপর লোলুপ দৃষ্টি থাকা অমূলক নয়। এই ব্যক্তি, যিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তার এসব অপকর্ম ঢাকতে। আমাদের দুঃখ এখানেই যে, এসব ‘ভূমিখোর’কে আমরা রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছি। দলের ছত্রচ্ছায়ায় ও প্রভাবে তারা নিজেদের পরিণত করেছেন এক একজন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবে’। একজন ব্যক্তি কী করে মিরপুরের গৃহায়নের দুয়ারীপাড়ার ৪৭৪টি প্লট, চিড়িয়াখানার ৩০০ কোটি টাকার সম্পত্তি, এমডিসি মডেল স্কুল, তুরাগ নদী কিংবা দুয়ারীপাড়ার জলাশয়ের জমি দখল করেন ভাবতেই অবাক হতে হয়। তার ক্ষমতার উৎস কোথায়? এই নষ্ট রাজনীতিই তাকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। একজন ইলিয়াস মোল্লা, নিজাম হাজারী কিংবা শামীম ওসমানের উত্থান তাই একই সূত্রে গাঁথা। তারা রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তাদের সব অপকর্মের একটা সিঁড়ি হিসেবে। আর রাজনীতির কারণেই হয়তো দেখা যাবে হত্যাকা-ের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও সবাই পার পেয়ে যাবেন। যদিও ওই সংসদ সদস্য তখন তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এক বছরেও তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়ায় জানা গেল না অনেক কিছুই।এই নষ্ট রাজনীতি আমাদের দেশে ত্যাগী রাজনীতিবিদদের জন্ম দিতে পারেনি। একুশ শতক উপযোগী যে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ আমাদের দরকার, সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি আমাদের তা উপহার দিতে পারছে না। রাজনীতি বেশি মাত্রায় পেশি ও সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত নূর হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এ বিশ্বাস করেন, তারা নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে পারেনÑ তিনি জেনেশুনেই কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাতে করে তাকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো সহজ না হয়। এটা সত্য, তাকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া জটিল। এর সঙ্গে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া জড়িত। ভারতীয় আইনে তার বিচার হচ্ছে। শাস্তি হবে। তিনি সেখানে শাস্তি ভোগ করবেন। তারপর ফেরত পাঠানোর প্রশ্ন। তাই ৭ খুনের বিচার হবে, খুনিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবেÑ এটা আমরা আশা করতেই পারি। কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন! আমার দুঃখবোধ ফেনীর ফুলগাজীর প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকের জন্য। তার হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত নিজাম হাজারী তখন ছিলেন সৌদি আরবে। এখন বাংলাদেশে। আর কালশী হত্যাকা-ে যার দিকে আঙুল নির্দেশ করা হয়েছিল, তার টিকিটি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি কেউ। সংসদে তিনি আছেন দিব্যি, যদিও সংসদের কোনো আলোচনায় তিনি কখনো অংশ নিচ্ছেনÑ এ রকমটি আমার জানা নেই।কালশী হত্যাকা- আমাদের আস্থার জায়গায় একটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধিরা নানা বিতর্কে নিজেদের জড়িত করে একটা বড় ধরনের আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছেন। এর বিচার যদি না হয়, তাহলে ‘আরেকটা কালশী’র জন্ম হবে। আরও একটা হত্যাকা- হবে, যা আমরা রোধ করতে পারব না। কালশী হত্যাকা- আমাদের বেশকিছু আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। বিহারিরা বাংলাদেশে থাকলেও এরা পাকিস্তানের নাগরিক। ফলে পাকিস্তানের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সোচ্চার হতে পারে! এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী একটি প্রোপাগান্ডায় নামতে পারে। তাতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং সেখানকার মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেকদিন থেকেই সোচ্চার। আগামীতে কালশীর হত্যাকা-কে তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসে বিষয়টি যদি বাংলাদেশবিরোধী শক্তিগুলো উত্থাপনের চেষ্টা করে, আমি তাতে অবাক হব না। যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশের যে সাহায্য পাওয়ার কথা, তাতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কালশী হত্যাকা- নিয়ে সংসদের যে ভূমিকা পালন করার কথা, সংসদ তা পালন করেনি। ফলে নয়া নির্বাচনের পক্ষে জনমত আরও শক্তিশালী হবে। সরকারি দলে একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি থাকায় সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ তখন ভাবমূর্তি-সংকটে পড়বে। দলটির জনপ্রিয়তাও এতে করে হ্রাস পেতে পারে! দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা যত দ্রুত এই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন, ততই দলের জন্য মঙ্গল। কালশী হত্যাকা-ের বিচার হোক। অন্তত একটি ক্ষেত্রে হলেও যেন আমরা বলতে পারি, ‘আমরা পেরেছি’। শুধু বিহারি বলে, ভিন্ন ভাষায় কথা বলে বিধায়, এই হত্যাকা-ের বিচার যদি না হয়, তাহলে তা হবে চরম মানবতা লঙ্ঘনের শামিল। আর একজন ব্যক্তি যখন দলকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেন, তখন দল এ ক্ষেত্রে উপকৃত হয় না। দলের জন্য তিনি হয়ে যান বোঝাÑ দলের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত যদি এটা বোঝেন, তাতে সবার মঙ্গলই নিহিত। এক বছর পর কালশী হত্যাকা- নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে এসব হত্যাকা-ের বিচার না করে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে আমরা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছি, তা দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল ডেকে আনছে না Daily Amader Somoy 20.06.15

মোদির সফরে কী পেল বাংলাদেশ


ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দুদিনের ঢাকা সফরের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কী পেল? এই সফরকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, কিংবা কানেকটিভিটি এই তিন আলোকেই আমরা যদি মোদির এই সফরকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব পাল্লাটা ভারতের দিকেই বেশি হেলে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০০ কোটি ডলারের একটি আশ্বাস পেয়েছে। ভারতীয় অর্থে বাংলাদেশি বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। যেমন একটি হচ্ছে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কের অবকাঠামো উন্নয়ন। আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়ক চারলেনে উন্নীত করা হবে। এই ঋণ প্রকল্পের আওতায় ৫০০টি ভারতীয় বাসও কেনা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ নাকি ভারতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে? এই সড়কে ভারতীয় বাস চলাচল করে। তথাকথিত কানেকটিভিটির আওতায় ভারতীয় বাস এখন কলকাতা থেকে বাংলাদেশের ভেতরে আশুগঞ্জ হয়ে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরা যাবে। তাতে লাভ হলো ভারতেরই। বাস কেনা হবে ভারতীয়। চলবে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে। প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা শহর কি এখন এসব গাড়ি ধারণ করার ক্ষমতা রাখে?

এমনিতেই যানজটে মানুষ অসহায়। রাস্তার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি। ঢাকার বাইরে রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ। সে ক্ষেত্রে গাড়ি চলার সুযোগ কোথায়? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বিআরটিসির শত শত গাড়ি ডাম্পিং স্টেশনে পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে গেছে। অথচ এগুলো সারিয়ে তুলে চলাচলের উপযুক্ত করা যেত। তা
অদৃশ্য কারণে বিআরটিসি করেনি। এখন আবার নতুন করে গাড়ি ক্রয় করা হবে। ভারতীয় ঋণের একটা সমস্যা হচ্ছে এই ঋণ নেওয়া হয় সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট-এর আওতায়, যেখানে ভারতীয় ঋণ থাকে বেশি। আমি দীর্ঘদিন ধরে মিডিয়ায় বলে আসছি, সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট কোনো ভালো ঋণ না। এতে করে ঋণ দেওয়া দেশের কাছে (এ ক্ষেত্রে ভারত) ঋণগ্রহীতা দেশের পরিপূর্ণ দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। ভারত যে দ্বিতীয়বারের মতো সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটে ঋণ দিল, তাতে বাংলাদেশ নয় বরং ভারতীয় ঋণই রক্ষিত হবে বেশি। সম্প্রতি ভারতের পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়াও একই ধরনের মন্তব্য করেছে। তারা বলেছে, ঋণের অর্থে যেসব প্রকল্প খরচ করা হবে, তার কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে কিনতে হবে। অর্থাৎ ঋণের দায় বাংলাদেশের, আর সুদাসল ছাড়াও রফতানি ব্যবসা হবে ভারতের। এই ঋণের টাকায় যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে, তাতে ভারতের ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এখন দেখা যাবে, এসব প্রকল্পে যেসব পণ্য দরকার হবে (ঠিকাদার, ইস্পাত, সিমেন্ট, ইট, যন্ত্রপাতি, ইঞ্জিনিয়ার) তা সরবরাহ করবেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এমনকি অদক্ষ জনশক্তিও আসতে পারে। আবার এসব পণ্য বাংলাদেশ উৎপাদন করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বিদেশেও রফতানি হয়। আমাদের দক্ষ জনশক্তি (ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট) আছে। কিন্তু আমরা তাদের এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারব না। তাই আমরা কখনো বলি না সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট একটি ভালো ঋণ। একসময় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো এ ধরনের ঋণ দিত (তারা ... বার্টার ট্রেড করত। আমাদের পণ্য নিত বিনিময়ে)। ভারত কিন্তু তা করবে না।
মোদির সফরের প্রাক্কালে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। যেমন বলা যেতে পারে, তিস্তাসহ সকল নদীর পানি ... বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, অঞ্চলিক যোগাযোগ বা কানেকটিভিটি, ভারতের স্থলবন্দরগুলোতে ওয়্যার হাউস নির্মাণ, এলসি ওপেন করার ব্যাপারে ভারতের সাতবোন রাজ্যে অবস্থিত ব্যাংকগুলোতে সুযোগ দান, কান্ট্রি অব অরিজিন-এর ঝামেলা দূর করা, ওষুধের ক্ষেত্রে ভারতের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা, ভিসা সহজীকরণ এবং শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করা। এ ক্ষেত্রে কোনো একটি ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট অগ্রগতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এতে করে আমাদের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে কম। তবে ৬৫ দফা যৌথ ... কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতি আমরা পেয়েছি, যা আমাদের আশান্বিত করেছে। যেমন বলা যেতে পারে, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কথা। যৌথ ঘোষণায় ২১ নম্বর দফায় এটা বলা হয়েছে যে ভারত সাংবিধানিক কারণে এখন আর এ প্রকল্পে অগ্রসর হবে না। এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত। কেননা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষ ভারতের এই প্রকল্প নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় ছিল। এ ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন কিন্তু থাকলই আর তা হচ্ছে এরই মধ্যে সেখানে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে, তার কী হবে? আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়েও আমাদের দুশ্চিন্তা ছিল। এখন যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। ভারত যদি সত্যিকার অর্থে আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে না যায়, আমার ধারণা তাতে করে ভারত একদিকে যেমনি উপকৃত হবে, ঠিক তেমনি উপকৃত হবে বাংলাদেশও। কেননা ভারতের পরিবেশবাদীরাও এই আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে। তবে একটা কথা এখানে মনে রাখা দরকার আর তা হচ্ছে আন্তনদী সংযোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারতের উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা রয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশ একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতায় নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। এটির নামকরণ করা হয়েছে বিবিআইএন। অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত (সাতগেজ রাজ্য) এবং নেপালের সহযোগিতায় একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা সম্মেলনে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। এ ধরনের একটি উদ্যোগ প্রথমে নিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল। তারই মতবাদ পরবর্তীকালে ‘গুজরাল ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এখন নরেন্দ্র মোদি নতুন আঙ্গিকে এটি নিয়ে এলেন। বাংলাদেশ ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসনেও সমর্থন দিয়েছে। এটা যৌথ ঘোষণায় আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে জাপানের ক্ষেত্রেও একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা জাপানও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে চায়। জাপানে আমাদের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। জাপানকে বাদ দিয়ে আমরা এককভাবে ভারতকে যদি শুধু এ পদে সমর্থন দিই, তাহলে বিতর্ক বাড়বে এবং জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রশ্নের মুখে থাকবে।
 এনটিভি অনলাইন, ১৪.০৬.২০১৫