রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কে চাই স্মার্ট ডিপ্লোমেসি

বিজেবির সদস্য নায়েক আবদুর রাজ্জাকের মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ কর্তৃক অপহরণ, আটদিন আটক রাখার পর তাঁকে ফেরত দেওয়া এবং সেই সঙ্গে তাঁকে জঙ্গি পরিচয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড করার মধ্য দিয়ে দুই দেশের মাঝে সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। এই ঘটনা ঘটল এমন একসময়, যখন আন্দামান সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে সারা বিশ্বব্যাপী মিয়ানমারের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে এই ঘটনায় মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে। বিজেবির পক্ষ থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদ ও একটি ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিয়ানমারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করলেও বিষয়টি সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আকার-ইঙ্গিতে যে কথা বলা হচ্ছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নায়েক আবদুর রাজ্জাক অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তাঁর বিচার হবে। অথচ এই অভিযোগের পেছনে কোনো সত্যতা নেই। কেননা নায়েক রাজ্জাক ও তাঁর সঙ্গীরা বাংলাদেশের জলসীমানাতেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। মিয়ানমারের বিজিপি তাদের ওপর কোনো রকম সতর্কতা ছাড়াই গুলি করে এবং একজন বিজিবি সদস্যকে হত্যাও করে। আর রাজ্জাক যে অবৈধভাবে প্রবেশ করেননি, তার প্রমাণ মিলল বৃহস্পতিবার, তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিজিপি এই কাজটি কেন করল? প্রকৃত পক্ষে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের ওপর থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর উদ্দেশ্যেই অত্যন্ত কৌশলে এই কাজটি করেছে। সাম্প্রতিককালে মিয়ানমার সরকার মুসলমান ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে অমানবিক আচরণ করছে এবং তাদেরকে বাধ্য করছে দেশ ত্যাগ করতে, তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। রোহিঙ্গা অভিবাসন সমস্যাটি এখন একটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

ফলে মিয়ানমার সরকারের ওপর একটা চাপ আছে। তাই পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে, যাতে সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে বেশি সময় ব্যায় করে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, এতে করে রোহিঙ্গা সমস্যাটি চাপা পড়ে যাবে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় এই অপহরণ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এটা এমন এক স্পট, যেখান দিয়ে বাংলাদেশে চোরাপথে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা চালান হয়, এমনকি মানবপাচারও হয়।

পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে অভিযোগ শোনা যায়, এসব চালান ও পাচারের সঙ্গে নাকি অনেক রাঘব-বোয়ালই জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশ এখন মানবপাচার ও ইয়াবা চোরাচালান রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করায় অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এসব রাঘব-বোয়ালরা। ফলে বিজিবির ওপর একধরনের আক্রোশ তাদের ছিল। তারই প্রতিফলন ঘটেছে নায়েক রাজ্জাকের অপহরণ ঘটনার মধ্য দিয়ে। তৃতীয় আরেকটি সম্ভাবনার কথাও বলছে মিয়ানমারের কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ। তারা ৫৪৪ জন মিয়ানমারের নাগরিককে চিহ্নিত করেছে, যাদের তারা বলছে ‘বাঙালি’। এবং বাংলাদেশ যদি এদের ফেরত নেয়, তাহলে রাজ্জাককে ফেরত দেওয়া হবে।

আসলে রাজ্জাক অপহরণ ঘটনার সঙ্গে যে উদ্দেশ্যই কাজ করে থাকুক না কেন, এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সমস্যাটি যে একটি ফ্যাক্টর, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এখানে বলা ভালো, মিয়ানমারে ১৯৮২ সালে জাতীয়তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড (এনআরসি) প্রণয়ন করেছিল, যা মিয়ানমারের আইনগত বৈধ অধিবাসীর নিশ্চয়তা দেয়। রোহিঙ্গাদের এই এনআরসির আওতায় আনা হয়নি। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে মনে করে না। গত ৩৭ বছর মিয়ানমার সরকার বারবার চেষ্টা করেছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করতে। ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো বিপুলসংখক রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ওই সময় মিয়ানমার সরকার ‘অপারেশন ড্রাগন’ নামে ‘রোহিঙ্গা খেদাও’ অভিযান শুরু করেছিল। ফলে ওই সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার ও পাবর্ত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গারা নিঃস্ব অবস্থায় আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে মিয়ানমার সরকার ‘অপারেশন পিরেথায়া’ নামে আবারও রোহিঙ্গা খেদাও অভিযানে নামে। বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হয়েছে, প্রায় চার লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজার এলাকায় বসবাস করছে। এদের অনেকেরই শরণার্থী হিসেবে কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই। এরা নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেছে। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, মিয়ানমার সরকার নতুন করে বৈধ নাগরিকদের গণনা শুরু করলে আবারও রোহিঙ্গা খেদাও অভিযান শুরু হয়। ফলে মে-জুন মাসে সাগরভাসি মানুষকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বড় ধরনের সংবাদের জন্ম হয়।

শেষ অব্দি নায়েক রাজ্জাক মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশের জিম্মা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু এই ঘটনা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন করে একটি প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে না মিয়ানমারের ফাঁদে পা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘স্মার্ট ডিপ্লোমেসি’ প্রদর্শন করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে না গিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করে যেতে হবে। কেননা বাংলাদেশের কাছে মিয়ানমার নানাবিধ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই আসে এর ভৌগোলিক অবস্থানগত গুরুত্বের কথা। প্রায় তিন লাখ ৭৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে মিয়ানমার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশ, পশ্চিম ও উত্তরে ভারত।

উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে চীন, পূর্বে থাইল্যান্ড ও লাওস। মিয়ানমারের এই ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে যে সড়ক যোগাযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাতে করে বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে সড়কপথে কেবল মিয়ানমারের বাজারেই নয়, বরং মিয়ানমার সরকারের সহযোগিতা নিয়ে পূর্বের অন্যান্য দেশের বাজারেও প্রবেশ করতে পারে (বিশেষ করে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর বাজারে)। ঘুমধুম-মুখে হাইওয়ে চালু হলে সড়কপথেই চীন যাওয়া সম্ভব। ঘুমধুম বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশি এলাকা। আর মুখে হচ্ছে চীনের সীমান্ত শহর।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (BIMSTEC, পরিবর্তিত নাম BBIMSTEC) এবং BCIM জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত BCIM জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেওয়ায় এই জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এই জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রাম মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প-কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রপ্তানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজশিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এই অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদি পশু আমদানি করার সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশিরা মিয়ানমারে গবাদি পশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে।

মিয়ানমারের সেগুনকাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এই সেগুনকাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমার মূল্যবান পাথর, যেমন রুবি, জেড, বোস আর মার্বেল সমৃদ্ধ। এসব মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে পুঁজি করে ভ্যালুএডিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় সম্পদ রিলায়েন্স মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। এই গ্যাস তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারত নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রফতানি করা সম্ভব হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি, সেখানে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এ কারণে ইস্যু এবং সর্বশেষ নায়েক রাজ্জাকের অপহরণের ঘটনায় সম্পর্কে কিছুটা অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই অবিশ্বাসকে নিয়ে বেশি দূরে যাওয়া ঠিক হবে না। একমাত্র স্মার্ট ডিপ্লোমেসির মাধ্যমেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ককে আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে।
Ntv online
25.06.15

0 comments:

Post a Comment