অনেকটা অজান্তেই পার হয়ে গেল ঢাকার মিরপুরের কালশীর হত্যাকা-ের ঘটনা।
খুব কম সংবাদপত্রেই ওই হত্যাকা-ের ফলোআপ প্রকাশ করা হয়েছে। গত বছরের ১৪
জুন শবেবরাতের রাতে কালশীর বিহারি ক্যাম্পে একটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এতে
একই পরিবারের ৯ সদস্যসহ মারা যান ১০ ব্যক্তি। ওই সময় সংবাদপত্রে প্রকাশ
করা হয়েছিলÑ মৃত ব্যক্তিরা যাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে না পারেন, সে জন্য
বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেীয়া হয়েছিল। স্থানীয় লোকদের অভিযোগ ছিলÑ ওই
হত্যাকা-ের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য জড়িত। পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল
স্থানীয় বাসিন্দা। এরপর দুটি মামলা হয়েছিল। এক বছর পর ডিবির অতিরিক্ত
উপকমিশনার (পশ্চিম) সাইফুল ইসলাম একটি সংবাদপত্রে (একটি জাতীয় দৈনিক, ১৩
জুন) বলেছেন, কে আগুন দিয়েছে, তা জানা যায়নি। তবে সংবাদপত্রটিকে তিনি
জানাতে ভোলেননি যে, ‘তদন্ত চলছে’। একটি হত্যাকা-ে যখন ১০ ব্যক্তি মারা যান,
এর তদন্ত করতে যদি এক বছর লাগে, তখন পুলিশের ওপর আমাদের আস্থাটা থাকে কই?
পুলিশে যে অভিজ্ঞ ব্যক্তি নেই, তা তো নয়। পুলিশ পারে। অতীতেও পেরেছে। এই
হত্যাকা-টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ছিল।কালশী কোনো বিচ্ছিন্ন
ঘটনা নয়। যেমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় ২৭ এপ্রিল (২০১৪) নারায়ণগঞ্জের অপহরণোত্তর
৭ খুনের ঘটনা কিংবা একই বছরের ২০ মে ফেনী শহরে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে গুলি
করে ও আগুনে পুড়িয়ে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামের
হত্যাকা-ের ঘটনা। এগুলো সবই মূলত একসূত্রে গাঁথা। আমাদের নষ্ট রাজনীতির
প্রতিফলন ঘটেছে এসব হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে। আর এসব হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে
সুশাসনের অভাব প্রচ-ভাবে অনুভূত হচ্ছে দেশে! যারা নীতিনির্ধারক তারা
সুশাসনের এই অভাবটি অনুভব করেন কি না জানি না; কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা
যাচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক হত্যাকা- হচ্ছে এবং প্রতিটি
হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়ভাবে সরকারদলীয় কর্তাব্যক্তিরা। আর
প্রশাসন পালন করছে নির্লিপ্ত ভূমিকা। দেশে সুস্থ গণতন্ত্রচর্চা, আইনের শাসন
প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ ধরনের হত্যাকা- আমাদের কোনো আশার বাণী শোনায় না।
আমাদের সংবিধানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার স্বীকৃত। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ এখন যে ঘটনা কালশীতে ঘটেছিল, যেখানে শিশু ও নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, সেখানে সংবিধান বর্ণিত মানবসত্তার মর্যাদা থাকল কোথায়? বিহারিরা উর্দুভাষী। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সংগঠনের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তাতে করে উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতেই পারেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৩ বছর পরও উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মূল ধারায় আসেনি। এখানে ব্যর্থতা কার, সে প্রশ্ন খুব সহজেই উঠতে পারে। বিহারিরা নিজেদের এখনো পাকিস্তানি মনে করেন এবং পাকিস্তানে যেতে চান। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় যেসব সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে পুনর্বাসন। অতীতে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হলেও অগ্রগতি হয়েছে কম। মাত্র একটি ব্যাচ পাকিস্তানে ফিরে গেছে। গত ১০ বছর এ নিয়ে তেমন আলোচনার খবর আমাদের জানা নেই। এক সময়ে নওয়াজ শরিফ এদের পাকিস্তানে নিয়ে যেতে রাজি হলেও প্রচ- আপত্তি ছিল প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর। বেনজির এদের পাকিস্তানি না বলে বিহারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন এরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, প্রায় ৫-৬ লাখ পাকিস্তানি নাগরিককে (সরকারিভাবে সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার) আমরা পাকিস্তানে যেতে অথবা পাকিস্তানকে গ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারিনি। এসব পাকিস্তানি নাগরিক বিভিন্ন ক্যাম্পে (ঢাকা ও সৈয়দপুর) মানবেতর জীবনযাপন করেন। শিক্ষাদীক্ষাহীন এসব নাগরিকের কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন ঢাকার কালশীর যে এলাকায় তারা থাকেন এবং যেটা তাদের স্থায়ী ঠিকানা, এটা তাদের অপরাধ হতে পারে না। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এদের অনেকেই জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের নিজস্ব জমি থেকে উচ্ছেদের একটা ষড়যন্ত্রের কথা পত্রপত্রিকায় তখন প্রকাশ করা হয়েছিল। আর ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় তখন ছাপা হয়েছিল। বিহারিরা প্রকাশ্যেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। যে তদন্ত হচ্ছে এক বছর ধরে তাতে প্রকৃত সত্য আদৌ বেরিয়ে আসবে কি না, আমার মতো অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে তাতে। তবে এই সংসদ সদস্য সম্পর্কে দৈনিক পত্রিকাটি আমাদের যে তথ্য দিয়েছিল (১৮ জুন ২০১৪) তাতে করে তার বিহারিদের ওই জমির ওপর লোলুপ দৃষ্টি থাকা অমূলক নয়। এই ব্যক্তি, যিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তার এসব অপকর্ম ঢাকতে। আমাদের দুঃখ এখানেই যে, এসব ‘ভূমিখোর’কে আমরা রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছি। দলের ছত্রচ্ছায়ায় ও প্রভাবে তারা নিজেদের পরিণত করেছেন এক একজন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবে’। একজন ব্যক্তি কী করে মিরপুরের গৃহায়নের দুয়ারীপাড়ার ৪৭৪টি প্লট, চিড়িয়াখানার ৩০০ কোটি টাকার সম্পত্তি, এমডিসি মডেল স্কুল, তুরাগ নদী কিংবা দুয়ারীপাড়ার জলাশয়ের জমি দখল করেন ভাবতেই অবাক হতে হয়। তার ক্ষমতার উৎস কোথায়? এই নষ্ট রাজনীতিই তাকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। একজন ইলিয়াস মোল্লা, নিজাম হাজারী কিংবা শামীম ওসমানের উত্থান তাই একই সূত্রে গাঁথা। তারা রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তাদের সব অপকর্মের একটা সিঁড়ি হিসেবে। আর রাজনীতির কারণেই হয়তো দেখা যাবে হত্যাকা-ের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও সবাই পার পেয়ে যাবেন। যদিও ওই সংসদ সদস্য তখন তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এক বছরেও তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়ায় জানা গেল না অনেক কিছুই।এই নষ্ট রাজনীতি আমাদের দেশে ত্যাগী রাজনীতিবিদদের জন্ম দিতে পারেনি। একুশ শতক উপযোগী যে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ আমাদের দরকার, সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি আমাদের তা উপহার দিতে পারছে না। রাজনীতি বেশি মাত্রায় পেশি ও সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত নূর হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এ বিশ্বাস করেন, তারা নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে পারেনÑ তিনি জেনেশুনেই কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাতে করে তাকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো সহজ না হয়। এটা সত্য, তাকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া জটিল। এর সঙ্গে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া জড়িত। ভারতীয় আইনে তার বিচার হচ্ছে। শাস্তি হবে। তিনি সেখানে শাস্তি ভোগ করবেন। তারপর ফেরত পাঠানোর প্রশ্ন। তাই ৭ খুনের বিচার হবে, খুনিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবেÑ এটা আমরা আশা করতেই পারি। কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন! আমার দুঃখবোধ ফেনীর ফুলগাজীর প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকের জন্য। তার হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত নিজাম হাজারী তখন ছিলেন সৌদি আরবে। এখন বাংলাদেশে। আর কালশী হত্যাকা-ে যার দিকে আঙুল নির্দেশ করা হয়েছিল, তার টিকিটি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি কেউ। সংসদে তিনি আছেন দিব্যি, যদিও সংসদের কোনো আলোচনায় তিনি কখনো অংশ নিচ্ছেনÑ এ রকমটি আমার জানা নেই।কালশী হত্যাকা- আমাদের আস্থার জায়গায় একটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধিরা নানা বিতর্কে নিজেদের জড়িত করে একটা বড় ধরনের আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছেন। এর বিচার যদি না হয়, তাহলে ‘আরেকটা কালশী’র জন্ম হবে। আরও একটা হত্যাকা- হবে, যা আমরা রোধ করতে পারব না। কালশী হত্যাকা- আমাদের বেশকিছু আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। বিহারিরা বাংলাদেশে থাকলেও এরা পাকিস্তানের নাগরিক। ফলে পাকিস্তানের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সোচ্চার হতে পারে! এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী একটি প্রোপাগান্ডায় নামতে পারে। তাতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং সেখানকার মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেকদিন থেকেই সোচ্চার। আগামীতে কালশীর হত্যাকা-কে তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসে বিষয়টি যদি বাংলাদেশবিরোধী শক্তিগুলো উত্থাপনের চেষ্টা করে, আমি তাতে অবাক হব না। যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশের যে সাহায্য পাওয়ার কথা, তাতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কালশী হত্যাকা- নিয়ে সংসদের যে ভূমিকা পালন করার কথা, সংসদ তা পালন করেনি। ফলে নয়া নির্বাচনের পক্ষে জনমত আরও শক্তিশালী হবে। সরকারি দলে একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি থাকায় সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ তখন ভাবমূর্তি-সংকটে পড়বে। দলটির জনপ্রিয়তাও এতে করে হ্রাস পেতে পারে! দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা যত দ্রুত এই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন, ততই দলের জন্য মঙ্গল। কালশী হত্যাকা-ের বিচার হোক। অন্তত একটি ক্ষেত্রে হলেও যেন আমরা বলতে পারি, ‘আমরা পেরেছি’। শুধু বিহারি বলে, ভিন্ন ভাষায় কথা বলে বিধায়, এই হত্যাকা-ের বিচার যদি না হয়, তাহলে তা হবে চরম মানবতা লঙ্ঘনের শামিল। আর একজন ব্যক্তি যখন দলকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেন, তখন দল এ ক্ষেত্রে উপকৃত হয় না। দলের জন্য তিনি হয়ে যান বোঝাÑ দলের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত যদি এটা বোঝেন, তাতে সবার মঙ্গলই নিহিত। এক বছর পর কালশী হত্যাকা- নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে এসব হত্যাকা-ের বিচার না করে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে আমরা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছি, তা দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল ডেকে আনছে না Daily Amader Somoy 20.06.15
আমাদের সংবিধানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার স্বীকৃত। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ এখন যে ঘটনা কালশীতে ঘটেছিল, যেখানে শিশু ও নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, সেখানে সংবিধান বর্ণিত মানবসত্তার মর্যাদা থাকল কোথায়? বিহারিরা উর্দুভাষী। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সংগঠনের যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তাতে করে উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতেই পারেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৩ বছর পরও উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মূল ধারায় আসেনি। এখানে ব্যর্থতা কার, সে প্রশ্ন খুব সহজেই উঠতে পারে। বিহারিরা নিজেদের এখনো পাকিস্তানি মনে করেন এবং পাকিস্তানে যেতে চান। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় যেসব সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে পুনর্বাসন। অতীতে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হলেও অগ্রগতি হয়েছে কম। মাত্র একটি ব্যাচ পাকিস্তানে ফিরে গেছে। গত ১০ বছর এ নিয়ে তেমন আলোচনার খবর আমাদের জানা নেই। এক সময়ে নওয়াজ শরিফ এদের পাকিস্তানে নিয়ে যেতে রাজি হলেও প্রচ- আপত্তি ছিল প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর। বেনজির এদের পাকিস্তানি না বলে বিহারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন এরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, প্রায় ৫-৬ লাখ পাকিস্তানি নাগরিককে (সরকারিভাবে সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার) আমরা পাকিস্তানে যেতে অথবা পাকিস্তানকে গ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারিনি। এসব পাকিস্তানি নাগরিক বিভিন্ন ক্যাম্পে (ঢাকা ও সৈয়দপুর) মানবেতর জীবনযাপন করেন। শিক্ষাদীক্ষাহীন এসব নাগরিকের কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছেন। এখন ঢাকার কালশীর যে এলাকায় তারা থাকেন এবং যেটা তাদের স্থায়ী ঠিকানা, এটা তাদের অপরাধ হতে পারে না। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এদের অনেকেই জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের নিজস্ব জমি থেকে উচ্ছেদের একটা ষড়যন্ত্রের কথা পত্রপত্রিকায় তখন প্রকাশ করা হয়েছিল। আর ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় তখন ছাপা হয়েছিল। বিহারিরা প্রকাশ্যেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। যে তদন্ত হচ্ছে এক বছর ধরে তাতে প্রকৃত সত্য আদৌ বেরিয়ে আসবে কি না, আমার মতো অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে তাতে। তবে এই সংসদ সদস্য সম্পর্কে দৈনিক পত্রিকাটি আমাদের যে তথ্য দিয়েছিল (১৮ জুন ২০১৪) তাতে করে তার বিহারিদের ওই জমির ওপর লোলুপ দৃষ্টি থাকা অমূলক নয়। এই ব্যক্তি, যিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তার এসব অপকর্ম ঢাকতে। আমাদের দুঃখ এখানেই যে, এসব ‘ভূমিখোর’কে আমরা রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছি। দলের ছত্রচ্ছায়ায় ও প্রভাবে তারা নিজেদের পরিণত করেছেন এক একজন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবে’। একজন ব্যক্তি কী করে মিরপুরের গৃহায়নের দুয়ারীপাড়ার ৪৭৪টি প্লট, চিড়িয়াখানার ৩০০ কোটি টাকার সম্পত্তি, এমডিসি মডেল স্কুল, তুরাগ নদী কিংবা দুয়ারীপাড়ার জলাশয়ের জমি দখল করেন ভাবতেই অবাক হতে হয়। তার ক্ষমতার উৎস কোথায়? এই নষ্ট রাজনীতিই তাকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। একজন ইলিয়াস মোল্লা, নিজাম হাজারী কিংবা শামীম ওসমানের উত্থান তাই একই সূত্রে গাঁথা। তারা রাজনীতিকে ব্যবহার করছেন তাদের সব অপকর্মের একটা সিঁড়ি হিসেবে। আর রাজনীতির কারণেই হয়তো দেখা যাবে হত্যাকা-ের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও সবাই পার পেয়ে যাবেন। যদিও ওই সংসদ সদস্য তখন তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এক বছরেও তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়ায় জানা গেল না অনেক কিছুই।এই নষ্ট রাজনীতি আমাদের দেশে ত্যাগী রাজনীতিবিদদের জন্ম দিতে পারেনি। একুশ শতক উপযোগী যে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ আমাদের দরকার, সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি আমাদের তা উপহার দিতে পারছে না। রাজনীতি বেশি মাত্রায় পেশি ও সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত নূর হোসেন কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এ বিশ্বাস করেন, তারা নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে পারেনÑ তিনি জেনেশুনেই কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাতে করে তাকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো সহজ না হয়। এটা সত্য, তাকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া জটিল। এর সঙ্গে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া জড়িত। ভারতীয় আইনে তার বিচার হচ্ছে। শাস্তি হবে। তিনি সেখানে শাস্তি ভোগ করবেন। তারপর ফেরত পাঠানোর প্রশ্ন। তাই ৭ খুনের বিচার হবে, খুনিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবেÑ এটা আমরা আশা করতেই পারি। কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন! আমার দুঃখবোধ ফেনীর ফুলগাজীর প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকের জন্য। তার হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত নিজাম হাজারী তখন ছিলেন সৌদি আরবে। এখন বাংলাদেশে। আর কালশী হত্যাকা-ে যার দিকে আঙুল নির্দেশ করা হয়েছিল, তার টিকিটি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি কেউ। সংসদে তিনি আছেন দিব্যি, যদিও সংসদের কোনো আলোচনায় তিনি কখনো অংশ নিচ্ছেনÑ এ রকমটি আমার জানা নেই।কালশী হত্যাকা- আমাদের আস্থার জায়গায় একটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধিরা নানা বিতর্কে নিজেদের জড়িত করে একটা বড় ধরনের আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছেন। এর বিচার যদি না হয়, তাহলে ‘আরেকটা কালশী’র জন্ম হবে। আরও একটা হত্যাকা- হবে, যা আমরা রোধ করতে পারব না। কালশী হত্যাকা- আমাদের বেশকিছু আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। বিহারিরা বাংলাদেশে থাকলেও এরা পাকিস্তানের নাগরিক। ফলে পাকিস্তানের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সোচ্চার হতে পারে! এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশবিরোধী একটি প্রোপাগান্ডায় নামতে পারে। তাতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং সেখানকার মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেকদিন থেকেই সোচ্চার। আগামীতে কালশীর হত্যাকা-কে তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারে। মার্কিন কংগ্রেসে বিষয়টি যদি বাংলাদেশবিরোধী শক্তিগুলো উত্থাপনের চেষ্টা করে, আমি তাতে অবাক হব না। যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশের যে সাহায্য পাওয়ার কথা, তাতে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কালশী হত্যাকা- নিয়ে সংসদের যে ভূমিকা পালন করার কথা, সংসদ তা পালন করেনি। ফলে নয়া নির্বাচনের পক্ষে জনমত আরও শক্তিশালী হবে। সরকারি দলে একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি থাকায় সরকারি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ তখন ভাবমূর্তি-সংকটে পড়বে। দলটির জনপ্রিয়তাও এতে করে হ্রাস পেতে পারে! দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা যত দ্রুত এই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন, ততই দলের জন্য মঙ্গল। কালশী হত্যাকা-ের বিচার হোক। অন্তত একটি ক্ষেত্রে হলেও যেন আমরা বলতে পারি, ‘আমরা পেরেছি’। শুধু বিহারি বলে, ভিন্ন ভাষায় কথা বলে বিধায়, এই হত্যাকা-ের বিচার যদি না হয়, তাহলে তা হবে চরম মানবতা লঙ্ঘনের শামিল। আর একজন ব্যক্তি যখন দলকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেন, তখন দল এ ক্ষেত্রে উপকৃত হয় না। দলের জন্য তিনি হয়ে যান বোঝাÑ দলের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত যদি এটা বোঝেন, তাতে সবার মঙ্গলই নিহিত। এক বছর পর কালশী হত্যাকা- নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে এসব হত্যাকা-ের বিচার না করে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে আমরা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছি, তা দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল ডেকে আনছে না Daily Amader Somoy 20.06.15
0 comments:
Post a Comment