রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অভিবাসী সমস্যার সমাধান কোন পথে

সাম্প্রতিক আন্দামান সাগরে ভাসমান অভিবাসীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক আসরে বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এ সমস্যার সমাধান কোন পথে, তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। এ সমস্যা নিয়ে ২৯ মে ব্যাংককে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেও মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে কোনো সুস্পষ্ট সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। সাগরে ভাসমান জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ যেখানে মুসলমান ও রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবে পরিচিত, সেখানে মিয়ানমার সরকার এ সঙ্কটের দায় নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে সঙ্কট যেভাবে ছিল, সেভাবেই রয়ে গেছে। ভাসমান নাগরিকদের কারও কারও ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের আশ্রয় শিবিরে সাময়িকভাবে আশ্রয় মিলেছে সত্য; কিন্তু একটি অংশ সাগরে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। গণকবরেও স্থান হয়েছে কারও কারও- যাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের নাগরিক এবং যারা পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দি জীবনযাপন করতেন। তারপর মুক্তিপণ না দেয়ায় তাদের হত্যা করা হয়। ২ জুন ঢাকায় সার্ক ও আসিয়ানভুক্ত আট দেশের পুলিশ এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মিলিত হয়। সম্মেলনে পাচারকারীদের ধরতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হলেও মূল সমস্যা রয়েই গেছে। অর্থাৎ মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে রাজি করানো যায়নি। তাই প্রশ্ন অনেক। এ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি চক্র। এরা যেমন আছে বাংলাদেশে, মিয়ানমারে, ঠিক তেমনি আছে থাইল্যান্ড আর মালয়েশিয়ায়। পাচারকারীরা মূলত টার্গেট করেছিল রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের, যারা মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের বাসিন্দা। মিয়ানমারে বেশ ক’বছর ধরেই এক ধরনের ‘এথনিক ক্লিনসিং’ অর্থাৎ অত্যন্ত সুকৌশলে মুসলমানদের আরাকান থেকে উৎখাত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। মিয়ানমারকে একটি ‘বৌদ্ধ রাষ্ট্রে’ পরিণত করতে চায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। আর এদের মদদ জোগাচ্ছে মিয়ানমারের শাসকচক্র। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম। এরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু আরাকানে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের কর্মকা- তা প্রমাণ করে না। যারা সংবাদপত্রের নিয়মিত পাঠক, তারা লক্ষ করেছেন বেশ কিছুদিন ধরেই আরাকানে জন্ম নেয়া ও সেখানে বসবাসরত মুসলমান নাগরিকদের (যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত) ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এক বছর ধরে মিয়ানমারে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হচ্ছে না। মিয়ানমারের শাসকচক্র মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত চট্টগ্রামের অধিবাসী এবং তারা ‘অবৈধভাবে’ আরাকানে বসবাস করছেন। অত্যন্ত কৌশলে এদের বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে একাধিকবার। এরপর একটি ‘চক্র’ এদের কৌশলে মালয়েশিয়ায় পাচার করার উদ্যোগ নেয়। এর সঙ্গে যোগ হয় বাংলাদেশের মানব পাচারকারীরা। বাংলাদেশীরাও চাকরির আশায় যেতে চান মালয়েশিয়ায়। কৌশলে পাচারকারীরা এদের বড় সাম্পানে তুলে দিয়ে পরে থাইল্যান্ডের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয় এবং মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সমস্যাটি তৈরি হয়েছে এভাবেই। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশীদেরও নেয়া হয় এবং পরে তাদের কাছে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। রোহিঙ্গাদের বলা হয়েছিল মালয়েশিয়ায় আশ্রয় দেয়ার কথা। এখানে মিয়ানমার সরকারের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা হচ্ছে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদের যোগসাজশে এ মানব পাচার চলে আসছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা নিয়েও খবর বের হয়েছে। এ মানব পাচারের ঘটনা যে এই প্রথম ঘটল, তা নয়। এর আগেও ঘটেছে। কিন্তু তা প্রকাশ পেয়েছে কম। এবারই সম্ভবত ব্যাপক মানব পাচারের ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে স্থান পেয়েছে। এখানে আরও একটি বিষয় দৃষ্টিকটু- এ মানব পাচারের ঘটনা নৌবাহিনী কিংবা কোস্টাল গার্ডের চোখ এড়িয়ে গেল কীভাবে? কোস্টাল গার্ডের না হয় সমুদ্রে থাকার বড় জাহাজ নেই। কিন্তু নৌবাহিনী? সমুদ্রসীমায় টহল দেয়া, বিদেশি মাছ ধরা ট্রলারকে বাংলাদেশী সমুদ্রসীমায় প্রবেশে বাধাদান, সমুদ্র সীমান্তরক্ষা এসবই তো নৌবাহিনীর কাজ। তাদের তো গভীর সমুদ্রে থাকার জাহাজ রয়েছে। অতি সম্প্রতি নতুন নতুন জাহাজ নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে। লেবাননে শান্তি মিশনেও গিয়েছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনী। তাহলে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে সাগর পথে যে মানব পাচার হচ্ছে, তা তাদের দৃষ্টিতে এলো না কেন? স্থানীয় কমান্ডার কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছিলেন? আরও দুর্ভাগ্য আমাদের যে, এ ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। ভাবমূর্তি উদ্ধারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা নেয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন। যারা সাগর থেকে উদ্ধার হয়েছেন তাদের সবার নাগরিকত্ব এখনও চিহ্নিত হয়নি। যারা শরণার্থী শিবিরে আছেন এবং যাদের নাগরিকত্ব চিহ্নিত হয়েছে, তাদের অবিলম্বে ফিরিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া উচিত। যারা রোহিঙ্গা এবং সাগরে ভাসছেন, ১৯৫১ সালের শরণার্থী সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন ও ১৯৯৮ সালের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত আইন, এমনকি এ সংক্রান্ত ১৯৬৭ সালের প্রটোকল অনুযায়ী সাগরে ভাসমান মানুষগুলো এখন ‘শরণার্থী’ হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। জাতিসংঘ এদের দায়িত্ব নেবে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলো (এক্ষেত্রে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া) এসব শরণার্থীকে গ্রহণ করতে বাধ্য। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় কিছু নেই। আসিয়ানের দায়িত্ব এক্ষেত্রে বেশি। মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার দায়িত্বটি নিতে হবে আসিয়ানকে। মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে রোহিঙ্গাদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ করতে। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন যদি বন্ধ হয়, তাহলে মানব পাচার হ্রাস পাবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একটি সিদ্ধান্তের দিকেও আমরা তাকাতে পারি। ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে প্রায় এক বছর ধরে শত শত আফ্রিকান অভিবাসী ইতালিতে প্রবেশ করছে এবং করার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে যারা ঢুকে পড়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট একটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। অর্থাৎ এদের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ২৮টি দেশের সর্বত্র পুনর্বাসন করা হবে (যদিও ব্রিটেনের টোরি সরকারের তাতে আপত্তি রয়েছে)। আসিয়ান এ ধরনের একটি কর্মসূচি নিতে পারে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা, বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে, আমি জানি না। কিন্তু এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পরও তাদের কোনো কর্মকা- আমার চোখে পড়েনি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের প্রচুর সমস্যা। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এখন কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। এদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। একাধিকার দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। তাতে ফল শূন্য। এখন মানব পাচারের ঘটনার পর বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে অতি দ্রুত আলোচনা শুরু করবে কিনা, তাও অস্পষ্ট। এটা সত্য, আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কোন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। বিসিআইএম জোট কিংবা বিমসটেক জোটে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারও আছে। আমাদের স্বার্থ আছে। কিন্তু মানব পাচারের ঘটনায় আমরা কি চুপ করে থাকব? এর দায়ভার বাংলাদেশ একা কেন নেবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অতি দ্রুত বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বিষয়টি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে জানান। মিয়ানমারের একটি প্রোপাগান্ডা আছে যে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী। এরা যে বাংলাদেশী নয়, তা স্পষ্ট করা এবং আসিয়ান নেতাদের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা। অবিলম্বে মিয়ানমারের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটি ‘সংলাপ’ শুরু করা; প্রয়োজনে বিমসটেক জোটকে এক্ষেত্রে ব্যবহার করা; ইইউর স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করে আসিয়ান নেতাদের এ ব্যাপারে রাজি করানো এবং রোহিঙ্গাদের আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোয় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে আরও সক্রিয় করা ও বাংলাদেশ থেকে সব মানব পাচার রুট মনিটর করা এবং বন্ধ করা; বাংলাদেশীরা যারাই এ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের মুখোমুখি করা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। মানব পাচার সংক্রান্ত যে আইনটি রয়েছে, তা বেশ দুর্বল। এ আইনটি সংশোধন করে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর ব্যবস্থা সংবলিত আইন প্রণয়ন করা জরুরি। মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে মালয়েশিয়ায় যে অবৈধ কাজের সুযোগ নেই, তা বারবার বলা। সরকার উপজেলা চেয়ারম্যানদের এ কাজে ব্যবহার করতে পারে। এতে করে মালয়েশিয়া সম্পর্কে সব বিভ্রান্তি দূর হতে পারে। একটি বিশাল তরুণ প্রজন্ম এখন বেকার। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে এদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া দরকার। ক্ষুদ্র ঋণের সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। মিয়ানমার তাদের নাগরিক রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চালাচ্ছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে আজ স্বীকৃত। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ক’বছর আগে এ সমস্যাটিকে প্রাধান্য করে বৌদ্ধদের সন্ত্রাসী কর্মকা- নিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছিল। এটি আজ অনেকের কাছেই স্পষ্ট যে, মিয়ানমার সরকার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান, তাদের আরাকানছাড়া করা। এমনিতে রোহিঙ্গাদের জন্য সেখানে কোনো নাগরিক সুবিধা নেই। এখন অত্যন্ত কৌশলে তাদের দেশছাড়া করছে। আর এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করছে পাচারকারীদের। বাংলাদেশী বলে এরা শত শত নাগরিককে নৌকায় তুলে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের টনক কিছুটা নড়েছে বটে, এখন মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে এ সমস্যাটি আন্তর্জাতিক পরিসরে উপস্থাপন করতে হবে। একইসঙ্গে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ককে বিবেচনায় নিয়ে চীনকে ব্যবহার করেও মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। এ মানবিক সমস্যায় বাংলাদেশ চুপ করে থাকতে পারে না। Daily Alokito Bangladesh 07.06.15

0 comments:

Post a Comment