রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তিনি এলেন কিন্তু জয় করতে পারলেন না

তিনি আবারো এলেন। কিন্তু জয় করতে পারলেন না। তিনি মমতা ব্যানার্জি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমবার এসেছিলেন ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে। আর এবার এলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরসঙ্গী হয়ে। তবে একসঙ্গে নয়, আলাদাভাবে। প্রথম যখন এসেছিলেন তখন বাংলাদেশের মানুষ তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়েছিল। কেননা বাংলায় কথা বলা একজন মানুষ, যার পারিবারিক রক্তের ধারা রয়েছে এই বাংলাদেশের যশোরে, তার কাছে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেবারও তিনি আমাদের হতাশ করেছিলেন। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আমাদের যে সমস্যা, তাতে একমাত্র প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন এই মমতা। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি অযাচিতভাবে পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিস্তায় বেশি পানি দাবি করেছিলেন। তার পরও বাংলাদেশের মানুষ তার ওপর আস্থা রেখেছিল। কিন্তু যার নাম মমতা, তিনি কিভাবে বাংলাদেশকে পানি দেন? ঢাকায় এসে তিনি বলেছিলেন তিনি 'কাঠবিড়াল হয়ে সেতুবন্ধের' মতো কাজ করে যেতে চান। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে চান। কিন্তু তিনি কি তা করেছেন? না, করেননি। ঢাকায় দ্বিতীয়বারের মতো আসার আগে তিনি বললেন নতুন এক কথা_ আত্রাই নদীতে বাংলাদেশ বাঁধ দিয়েছে। আর তাতে পশ্চিমঙ্গ কম পানি পাচ্ছে। এই হচ্ছেন মমতা। তিনি জানেন রাজনীতিকে কিভাবে জটিল করতে হয়। যেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চাচ্ছে তিস্তায় একটি সমঝোতা, সেখানে 'আত্রাই' প্রসঙ্গ নতুন করে উত্থাপন করে কৌশলী মমতা এখন চাচ্ছেন তিস্তার প্রসঙ্গটি 'ডিপ ফ্রিজে' পাঠাতে। এটাই তার কৌশল। তিনি তিস্তায় পানি দেবেন না, যাতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে সম্পর্কের 'নয়া অধ্যায়'-এর সূচনা হয়েছে তা একটি প্রশ্নের মধ্যে থাকুক! বাংলাদেশ ভারতের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলুক! তাতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে প্রশ্ন উঠুক এবং তিনি তাতে লাভবান হোন! ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন। তিনি চাইবেন না বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের 'নয়া অধ্যায়ে'র কারণে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়ুক। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে (তিস্তার পানির উপকারভোগী) তার জনপ্রিয়তা তলানিতে। অথচ বাংলাদেশে এসে তিনি এমন ভাব দেখালেন যে তিনিই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'হাসিনা দিদি' হিসেবে সম্বোধন করে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি কত আন্তরিক! প্রটোকল তার কাছে মুখ্য নয়, গৌণ। একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে এভাবে প্রকাশ্যে 'দিদি' বলে সম্বোধন করা যায় না মমতা ব্যানার্জির কাছে এটা বিবেচনায় আসেনি। এবার তার জন্য গণভবনে দুপুরের খাবারেরও আয়োজন করা হয়েছিল। ১২ পদের খাবারের তালিকায় ইলিশ ছিল তিন পদের। সবাই জানেন বাংলাদেশের ইলিশের প্রতি মমতার বিশেষ টান আছে। আগে মমতা যখন দিলি্লতে রেলমন্ত্রী ছিলেন তখন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে যারাই নয়া দিলি্ল গেছেন (বিশেষ করে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী) তারা অবধারিতভাবেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন 'পদ্মার ইলিশ'। তাই ইলিশ প্রসঙ্গ এসেছিল (আপাতত রপ্তানি বন্ধ)। কিন্তু সারা জাতি ও মিডিয়া এবার তাকিয়ে ছিল মমতা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার অনাপত্তির কথা জানিয়ে যাবেন। কেননা তিস্তায় পানিবণ্টনের সমস্যা একটাই_ আর তা হচ্ছেন মমতা। মমতার আপত্তির মুখে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখনো মমতার আসার কথা ছিল। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী এলেও শেষ মুহূর্তে মমতা তার আপত্তির কথা জানান। ফলে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আর করা হয়নি। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে মমতার দৃষ্টিভঙ্গির কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? সেবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি দুই দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন এ কথাটা। এর আগে ভারতীয় হাইকমিশনার কর্তৃক আয়োজিত 'বৈঠকী বাংলা'য়ও মমতা নিজেই বলেছিলেন তার ওপর 'আস্থা' রাখতে! স্থল সীমানা চুক্তি নিয়ে তার আপত্তি নেই, এটা অবশ্য তিনি প্রমাণ করেছেন। ঢাকায়ও এ কথাটা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন মমতা। কিন্তু তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার 'কমিটমেন্ট' কোথায়? সোজাসাপ্টা হিসাব হচ্ছে তিনি ঢাকায় এসে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আর কোনো 'কমিটমেন্ট' করে গেলেন না। এটাই মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক চরিত্র। যেখানে স্বার্থ রয়েছে সেখানে মমতা আছেন। তিস্তার পানির ব্যাপারে তার স্বার্থ অনেক বেশি। ২০১৬ সালে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। এটাকে তিনি বিজেপির হাতে তুলে দিতে চান না। উত্তরবঙ্গে পানির চাহিদা বেশি। মমতা এটা জানেন ও বোঝেন। বলা ভালো, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রাক্কালে তিস্তায় পানির সর্বনিম্ন প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছিল। এটা কাকতালীয় কি না জানি না। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে কটি বিষয় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে তিস্তার পানিবণ্টন অন্যতম। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটা আগ্রহ থাকলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। সেই মমতা ব্যানার্জিই এখন আবার ঢাকা ঘুরে গেলেন। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার ঢাকা আসার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। তিস্তায় পানিবণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় ওই মাসের প্রথম পাঁচ দিনে তিস্তায় পানিপ্রবাহ ছিল ৫০০ কিউসিকের নিচে। সেচ প্রকল্পে পানি দেয়া দূরের কথা, শুধু নদী বাঁচানোর জন্যই দরকার ১ হাজার কিউসেক। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা আজ মৃত্যুমুখে। গত নভেম্বর থেকেই তিস্তার পানিপ্রবাহ কমতে থাকে। বাংলাদেশের লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীতে ইতিহাসের সবচেয়ে কম পানিপ্রবাহ রেকর্ড হয়। ফেব্রুয়ারি, ২০১৫-এর প্রথম চার দিনের হিসাবে দেখা গেছে প্রথম দিন পাওয়া গেছে ৪২৬ কিউসেক, দ্বিতীয় দিন ৪৭৫ কিউসেক, তৃতীয় দিন ৪৪৫ কিউসেক, আর চতুর্থ দিন ৪১৬ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয় (সকালের খবর : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)। যৌথ নদী কমিশন সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানিপ্রবাহ ভালো কিছু বলে তুলনার জন্য ওই সময়কালের হিসাবকে ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ ধরা হয়। ওই ১২ বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম ১০ দিনে পানিপ্রবাহ ছিল ৫ হাজার ৯৮৬ কিউসেক। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে আসে ৯৬৩ কিউসেকে। এ বছর নামল ৫০০ কিউসিকের নিচে। অথচ নদী রক্ষার জন্যই দরকার ১ হাজার কিউসেক পানি। আর বিদ্যমান সেচ প্রকল্পের জন্য আরো সাড়ে ৩ হাজার কিউসেক পানি দরকার। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি 'নোট ভারবাল' পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
মমতা ব্যানার্জির প্রথম ঢাকা সফরের আগে আমরা অনেক প্রত্যাশার কথা শুনেছি। তবে এটা সত্য, তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে এটা সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন তাহলে এ দেশ বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে তিস্তায় পানিপ্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন এটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ীর কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা; লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ; রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা; কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরো একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি 'রাজনৈতিক ইস্যু'।

তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫ নাম্বার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এ 'যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তি'টি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নাম্বার নীতিতে বলা হয়েছে পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ 'জলপ্রবাহ কনভেনশন' নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এ নীতিমালার ৬ নাম্বার অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার' কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যাবহার অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এ 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা'র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরো আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নাম্বার অনুচ্ছেদ জলভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫ নাম্বার অনুচ্ছেদ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।
তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ এ নিরাপত্তার বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে পারে না। এখন ঢাকায় দেয়া মমতার আগের বক্তব্যকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? তার ওপর আমাদের আস্থা রাখতে বলেছেন। কিন্তু আমরা আস্থাটা রাখি কিভাবে? ভারতীয় রাজনীতিতে 'মোস্ট আনপ্রেডিকটেবল ক্যারেক্টার' হচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। তার কথার কোনো মূল্য নেই। তার অতীত বলে, তিনি একসময় কংগ্রেসের মিত্র ছিলেন। আবার বেরিয়ে গেছেন। বিজেপির মিত্র ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। আবার বেরিয়ে গেছেন। সুতরাং তার ওপর আস্থা রাখাটা কঠিন।
তিনি যদি সত্যিই আন্তরিক হন তাহলে তিনি কল্যাণ রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিজে এ কমিশন গঠন করেছিলেন। কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রুদ্র কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেয়া রিপোর্টে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গকে ক্ষতি না করেও বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব। তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন আরেকজন পানি বিশেষজ্ঞ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণবকুমার রায়। অধ্যাপক রায়ের অভিমত হচ্ছে তিস্তায় পানি নেই এ কথাটা ঠিক নয়। পানি মজুদ রাখা (বর্ষা মৌসুমে) ও ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
ঢাকায় তিনি এসেছিলেন শুধু নরেন্দ্র মোদির স্বার্থকে বিবেচনা করে। বাংলাদেশের স্বার্থ তার কাছে প্রাধান্য নয়। একটি 'প্যাকেজ ডিল'-এর আওতায় তিনি মোদিকে স্থল সীমানা চুক্তিতে সমর্থন জানিয়েছেন। মোদি তাকে আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই প্যাকেজ ডিল-এর আওতায় নরেন্দ্র মোদির সফরসঙ্গী হলেন তিনি।
এমনিতেই সারদা কেলেঙ্কারি ও তৃণমূলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন নিয়ে সিবিআইর নজরদারিতে তিনি আছেন। ফলে মোদির সঙ্গে সম্পর্কটা দৃঢ় করে তিনি 'সমস্যাগুলো' থেকে বের হয়ে আসতে চান। এ মুহূর্তে তিনি তিস্তা চুক্তি চান না। সম্ভবত মোদি ওটা বোঝেন ও উপলব্ধি করেন। মোদির অগ্রাধিকার তালিকায় তিস্তা নেই, আছে কানেকটিভিটি। ফলে মমতা ঢাকা ঘুরে গেলেও তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে আশাবাদী কিছু ঘটবে না আগামীতে। তিস্তার পানিবণ্টনকে ইস্যু করে মোদির কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নিতে চান মাত্র।
Daily jai Jai Din
11.06.15

0 comments:

Post a Comment