রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিসিআইএম জোট কি তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে?

বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে বিসিআইএম জোটটি কি শেষ পর্যন্ত তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির ঢাকা সফর ও চার দেশীয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট বিবিআইএন গঠনের পর খুব সংগত কারণেই বিসিআইএমের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিসিআইএম হচ্ছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাতবোন রাজ্য) ও মিয়ানমারের সমন্বয়ে বাস্তবিত একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে যখন চীন সফরে যান, তখন এই উপ আঞ্চলিক সহযোগিতার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তিনি ওই সময় ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংও সফর করেছিলেন। বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে একটি কোর কমিটি এ ব্যাপারে কাজ করছে। এই কমিটি একাধিকবার মিলিত হয়েছে। এমনকি এই চার দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও একাধিকবার বৈঠকে মিলিত হয়ে করণীয় নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু অতি সাম্প্রতিককালে চীন-ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ব্যাপারে নরেদ্র মোদির বিশেষ আগ্রহের কারণে শেষ পর্যন্ত বিসিআইএম জোটটি আত্মপ্রকাশ করবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উপরন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশেরও একটি ‘ভুল বোঝাবুঝির’ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যে প্রত্যাশা নিয়ে বিসিআইএম জোট একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছিল, সেই সম্ভাবনার ‘মৃত্যু’ ঘটতে পারে আগামীতে। এবং শেষ পর্যন্ত সম্ভাবনায় এই জোটটি কাগজ-কলমেই থেকে যেতে পারে। উল্লেখ করা ভালো যে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে বেশ গুরুত্ব দেয়। এ কারণেই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই জোটের বিকাশের প্রয়োজন ছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কয়েকশ বছরের পুরোনো। ১৪২১ থেকে ১৪৩১ সাল পর্যন্ত ইউনান রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে একজন নাবিক মা হে (যিনি পরবর্তীকালে অ্যাডমিরাল ঝেং হে হিসেবে পরিচিতি পান) দু-দুবার বাংলার তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁও ভ্রমণ করেন। চীন তখন নাবিক মা হে-কে গুরুত্ব দেয়। চীন ২০০৩ সালে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। তখন চীন ‘কুনমিং উদ্যোগ’-এর কথা বলেছিল, যা এখন বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। মজার ব্যাপার হলো, ভারত এ ব্যাপারে আগ্রহী হওয়ার পরেই এই বিসিআইএম জোটের ধারণা শক্তিশালী হয়। এই জোটটি কার্যকরী হলে কুনমিং (ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ এবং ভারতেও আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেওয়া যাবে। এর ফলে চীনা পণ্যের দামও কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালের মধ্যে আসিয়ানে মুক্তবাজার সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। নর্থরুটে কুনমিং থেকে মিয়ানমারের মাইটকিহা হয়ে ভারতের লেডো পর্যন্ত সংযুক্ত হবে। এই রুটে বাংলাদেশ সংযুক্ত হবে না। এই রুটটি অনেক কঠিন। সাউথ রুটে ইউনান থেকে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর সোনাদিয়া পর্যন্ত সংযুক্ত ছিল। কুনমিং মান্দালয় (মিয়ানমার) ও অ্যাওয়ে হয়ে এই রুটটি চট্টগ্রামে প্রবেশ করবে। পরে ঢাকা হয়ে কলকাতা যাবে। এখন সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত না হওয়ায় (ভারতের আপত্তির কারণে) এই প্রস্তাবিত রুটটির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। তৃতীয় প্রস্তাবিত রুটটি হচ্ছে মিডল রুট। এই রুটটি ভালো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাই প্রাচীন সিল্ক রুট। কুনমিং Bhamo-Lashio-Tamu (মিয়ানমার), ইমফল (ভারত)-সিলেট-ঢাকা ও কলকাতা হচ্ছে এই রুট, যা কিনা K2K নামেও পরিচিত। অর্থাৎ কুনমিং থেকে কলকাতা। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, এই রুটে (২৮০০ কিলোমিটার) একটি মোটর র‌্যালি (২০১৩) চালু হয়েছিল। এই জোটের সম্ভাবনা ছিল বিশাল। কেননা এই চারটি দেশের (বিসিআইএম) রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) এবং সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যটি বদলে যেতে পারে আগামীতে যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি ছাড়াও বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও অনেক অংশে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এই জোট। এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কি না বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১.২ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৯০.২১ মিলিয়ন ডলারে। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা আর ৪৪০ মিলিয়ন মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশগুলোতে। পূর্বে রয়েছে কুনমিং, আর পশ্চিমে কলকাতা। ভেতরে মান্দালয় আর ঢাকা। ভারত ও জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এ কারণে যে, এতে করে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে সহজ হয়। ভারত ২০০৭ সালে আনিয়ানের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এরই মধ্যে ভারত আসিয়ানের ‘ডায়ালগ পার্টনার’-এর মর্যাদা লাভ করেছে (বাংলাদেশের অবস্থান আনিয়ান আঞ্চলিক ফোরামে)। ‘ডায়ালগ পাটর্নার’-এর পরবর্তী ধারা হচ্ছে পূর্ণ সদস্য। তাই ভারতের আগ্রহ ছিল, যাতে করে ভারত তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে নরেদ্র মোদি সরকার এই বিসিআইএম নিয়ে আদৌ এগিয়ে যাবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। তার আগ্রহ বেশি বিবিআইমের জোট নিয়ে। ফলে বিসিআইএম জোট নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে গেলই। এরই মধ্যে আমরা লক্ষ করেছি, ভারত মহাসাগরে প্রভাববলয় বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, নৌ তৎপরতা এবং জিবুতিতে একটি নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ, এমনকি হামবানটোটায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ফলে শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এমনকি ভারত মহাসাগরভুক্ত সিসিলি, মরিশাসে ভারত নৌ-ঘাঁটি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে ৬০টি দেশকে তিনি চীনের প্রভাব বিস্তারের আওতায় আনতে চান। ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোও এর মাঝে আছে। এটা সেই পুরনো ‘সিল্করোড’-এরই আধুনিক সংস্করণ। ভারত এতে উদ্বিগ্ন। ফলে ভারত তার সেই পুরোনো ‘কটন রুট’ নিয়েই চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও, এই প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা দেশ দুটির মাঝে এক আস্থাহীনতার সৃষ্টি করবে। এতে করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কর্তৃত্ব হারাতে বাধ্য। তাই বিবিআইএন জোট নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন, এ অঞ্চলে ভারতীয় কর্তৃত্ব বাড়াবে। চীনের প্রভাব এর মাঝে সংকুচিত হবে। তাই খুব স্পষ্ট করেই বলা যায়, বিসিআইএস বিকশিত হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে চীনের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়বে মনে করেন ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা। নিজেদের স্বার্থের বিপক্ষে কোন সিদ্ধান্তে যাবে না ভারত। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এ জোট তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে ভারতের প্রভাব বাড়বে। আগামীতে এ অঞ্চলের তিনটি দেশ (ভূটান, নেপাল ও বাংলাদেশ) আরো বেশি নির্ভরশীল হবে। বিশেষ করে জ্বালানি ও বাণিজ্য নির্ভরতা তাদেরকে ভারতমুখী করে তুলবে। আর এক্ষেত্রে ভারতের ষ্ট্রাটেজি হবে আইএন জোটকে গুরুত্ব দেয়া এবং বিসিআইএসকে নিস্ক্রিয় করা। NTV online ২১ জুন ২০১৫, ১৩:৩৮

0 comments:

Post a Comment