রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

কোন পথে বিএনপি

১ সেপ্টেম্বর বিএনপি ৩৭ বছরে পা রাখল। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এই ৩৭ বছর একেবারে কম সময় নয়। দলটি একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া এই রাজনৈতিক দল বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বোধ করি অতীতে কখনোই দলটি এ ধরনের সংকটের মাঝে পড়েনি। যাঁরা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন তাঁরা জানেন বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দলটির একটি শক্ত অবস্থান আছে। তিনবার দলটি ক্ষমতায় ছিল (১৯৭৮-১৯৮২, ১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬)। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির একটি অবস্থান আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা থেকে বিএনপির উৎখাতের পর ওই সময় যখন বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ছিল, ঠিক তখনই একজন গৃহবধূ থেকে (১৯৮৩) রাজনীতির পাদপ্রদীপে আসেন বেগম জিয়া। এখন তিনিই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী। তাঁকে কেন্দ্র করেই বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যে বেগম জিয়াকে দেখেছিল একজন অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে, সেই বেগম জিয়াকে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল! ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নেওয়া কিংবা পরবর্তী সময় সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম হয়েছে এ দেশে, তা ব্যক্তিগতভাবে বেগম জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতিকে উজ্জ্বল করেনি। বেগম জিয়াকে আমার এখন মনে হয়েছে 'নিঃসঙ্গ একজন নাবিক' হিসেবে, যিনি আদৌ জানেন না কোন দিকে এবং কোন পথে বিএনপি নামক 'জাহাজ'টিকে তিনি পরিচালনা করছেন! এক সন্তানহারা, অপর সন্তান অনেক দূরে, নেতাকর্মীরা জেলে। নিঃসঙ্গ বেগম জিয়া এখন একাই বিএনপি।
বর্তমানে বিএনপি নানা সমস্যায় আক্রান্ত-এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি দল গোছানোর কথা বলছে। তবে বিএনপির কয়েকজন নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপি ভাঙার 'গুজব' এ কারণেই! 'বেগম জিয়াকে দিয়ে হবে না' কিংবা 'জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে হবে'-এ ধরনের বক্তব্য যখন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হয় তখন গুজবের নানা ডালপালা গজায়। মির্জা ফখরুল জামিন পেলেও অনেকেই জেলে আছেন এখনো। অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা আছে। আর যাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার-মামলা, মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের 'ব্যস্ত' রাখতে চায় সরকার, যাতে তাঁরা 'আন্দোলনে' নিজেদের জড়িত করতে না পারেন! বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নি-এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা! ফলে এসব নেতাকর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারবে না। বেগম জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসংক্রান্ত ধারা) বিচার কিংবা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ড্যান্ডি ডাইং মামলায় তারেক রহমানকে 'শাস্তি' দিয়ে তাঁকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেগম জিয়াকে নির্বাচনে 'অযোগ্য ঘোষণা'(?) করা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচনের যোগ্য হবেন কি না জানি না। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্ন হবে তখন অবান্তর। বেগম জিয়াই বিএনপির মূলশক্তি। বেগম জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, বিএনপির 'বিকল্প নেতৃত্ব' নির্বাচনে অংশ নেবে-এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপি সংগঠিত হবে-এটাও আমার মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো কার্যকর 'ফল' দেবে না। 'আসল বিএনপি' কিংবা নাজমুল হুদার 'ফালতু কথাবার্তায়' মানুষ খুব আস্থাশীল, এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি এখন অস্তিত্বহীনতার মুখে। ফলে সরকারের কাছে এখন বিকল্প পথ দুটি। বিএনপিকে যেকোনোভাবে আস্থায় নিয়ে ২০১৬ সালের শেষের দিকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া। অথবা সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। যেকোনো সময়ের চেয়ে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। ওপরে উল্লেখিত দুটি সিদ্ধান্তের মাঝে একটি, অর্থাৎ প্রথমটির ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কম। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনটিই সরকার করতে চায়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে যদি ২০১৮ সালের নির্বাচন হয়, তাহলে সমস্যা যা ছিল তা-ই থেকে যাবে! বিএনপির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা যাবে না। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিকল্পই বিএনপি, জাতীয় পার্টি নয়। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি পারেনি। তাই যেকোনো বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য জরুরি। কেননা বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে, যেখানে ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত দেড় বছরে সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ফলে সংসদকে আরো গ্রহণযোগ্য, আরো অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্ব পালন করতে পারে। বলা ভালো, বিএনপি সংসদে না থাকলেও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূলধারার রাজনীতিতেই দেখতে চায়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থানও আমার ধারণা অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। এই দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে এই দুটি দলের একটিকে বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জামানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ না নেওয়ার কারণে। এ দুই দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই পঞ্চম সংসদ (১৯৯১), সপ্তম সংসদ (১৯৯৬), অষ্টম সংসদ (২০০১) ও নবম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি অনেক নমনীয় হয়েছে এবং তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া অনেক বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে, বিএনপি সরকারের সঙ্গে একটি 'শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে' যেতে চায় এবং যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। বিএনপি নেত্রী ও বিএনপির মুখপাত্রের চারটি বক্তব্য দুটি বড় দলের মাঝে একটি 'বরফগলা'র সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে বলে আমার ধারণা। এক. বেগম জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক নয়, বরং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে। এর অর্থ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে এখন আর গুরুত্ব দিচ্ছে না। দুই. সৈয়দ আশরাফ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, তিনি দলনিরপেক্ষভাবেই এই মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। বিএনপির মুখপাত্র এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিন. ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে বিএনপি সমর্থন করেছে এবং বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ইস্যুতে তারা সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। চার. বিএনপির পক্ষ থেকে 'স্বাভাবিক রাজনীতি' করার দাবি জানানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন একটা ধর-পাকড়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির মুখপাত্র নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করছেন। এখন দেখার পালা বিএনপিকে বড় সমাবেশ করতে সরকার দেয় কি না।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, আগামী দিনের রাজনীতি আবর্তিত হবে বিএনপির আচরণের ওপর। বেগম জিয়া দল পুনর্গঠন করে জানুয়ারির (২০১৬) দিকে নতুন করে আন্দোলনের কথা বলছেন। সরকার যদি বিএনপির সঙ্গে কোনো 'সমঝোতায়' যেতে না পারে, তাহলে সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি থাকবেই বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে। মানুষ সহিংস রাজনীতি পছন্দ করে না। তরুণ প্রজন্ম চায় উন্নয়ন। চায় সামাজিক নিরাপত্তা। চায় তাদের চাকরির গ্যারান্টি। সহিংস রাজনীতি অর্থনীতির চাকাকে আটকে দেয়। প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি আসে। মনে রাখতে হবে, আমাদের ভোটারদের একটা বড় অংশ হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। তাদের কাছে পৌঁছতে হলে নতুন কর্মসূচি নিয়ে বিএনপিকে আসতে হবে।
৩৭ বছরে দাঁড়িয়ে বিএনপি এক কঠিন সময় পার করছে। বিএনপির থিংকট্যাংক কোনো কর্মসূচি তৈরি করতে পারছে না। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁকে ঘিরে একটা দক্ষিণপন্থী গ্রুপ সক্রিয়, যাঁদের কেউই বিএনপির সদস্য নন। তাঁরা তাঁদের স্বার্থেই বিএনপিকে ব্যবহার করতে চান। তাই বিএনপির জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক ও সংবিধান অনুযায়ী আন্দোলন করা। সাধারণ মানুষের যে সমস্যা সে ব্যাপারে সক্রিয় হতে হবে দলটিকে। স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন করা জরুরি। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। বিএনপি যদি শুধু পল্টনকেন্দ্রিক হয়ে যায়, তা দলের ইমেজ বৃদ্ধিতে কোনো সাহায্য করবে না। দলীয় নেতাকর্মীদের, যারা এখনো জেলের বাইরে আছে তাদের যেতে হবে তৃণমূল পর্যায়ে। ৩৭ বছরে দাঁড়িয়ে যে দলটিকে নিয়ে সাধারণ মানুষের অনেক প্রত্যাশা, আগামী দিনগুলোতে সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারবে দলটি, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। Daily Kalerkontho 01.09.15

জিএসপি ফিরে পেতে হবে

প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী গত ২৪ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তি নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি স্পষ্ট করেই আমাদের জানিয়েছেন, শর্ত পূরণ করতে না পারার কারণেই পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা জিএসপি বাস্তবায়ন হয়নি। এর সঙ্গে কোনো রাজনীতি জড়িত নয়। ড. গওহর রিজভীর এ বক্তব্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যের ঠিক উল্টো। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১২২টি দেশের জন্য জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হলেও ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম ছিল না। এর প্রতিক্রিয়ায় তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, রাজনৈতিক কারণে এটি হয়েছে। যদিও ঠিক এর পরদিনই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, এর সঙ্গে কোনো রাজনেতিক কারণ জড়িত নয়। ২৪ আগস্ট গওহর রিজভীও বললেন সে কথা। ড. গওহর রিজভী আরও বলেছিলেন, জিএসপি ফিরে পেতে হলে শ্রমবাজারের উন্নয়নে আমরা যেসব অঙ্গীকার করেছি, তা পূরণ করতে হবে। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা জিএসপি ফিরে পাব। একই সঙ্গে ড. রিজভী আমাদের কাছে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিদেশীদের কাছে ধরনা না দিয়ে তিনি সবাইকে একসঙ্গে কাজ করারও আহ্বান জানান। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। আমরা জিএসপি সুবিধা ফিরে পাইনি। এর পেছনে রাজনীতি ছিল না। বরং যে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল, আমরা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। মনে রাখতে হবে, রানা প্লাজা ও তাজরীনের বিপর্যয়ের ঘটনা সারা যুক্তরাষ্ট্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর প্রভাব পড়ে জিএসপি সুবিধা বাতিলের ক্ষেত্রে। যদিও এটা সত্য যে, শুধু তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ বেশি। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমরা ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অবস্থান ধরে রেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী এখন ভিয়েতনাম। আর এ ভিয়েতনামের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র অতি সম্প্রতি টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি করেছে। এ চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে তার তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঝুঁকির মুখে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা ভালো, চীনের পরই ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজরে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বড় রফতানিকারক। অর্থাৎ চীন বেশি রফতানি করে। তারপর ভিয়েতনাম। পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাকে ভিয়েতনামের রফতানি বাড়ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হারে। এখন টিপিপির ফলে এটা আরও বাড়বে। ২০১৫ সালেই পোশাক রফতানি খাতে ভিয়েতনামের ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ভিয়েতনাম ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিক রফতানি ৫০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া ৮ হাজার ১৭৮ কোটি ডলারের মধ্যে চীনের রফতানি ২ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলার। এর পরের অবস্থানই ভিয়েতনামের, ৯২৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া রয়েছে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে যথাক্রমে মেক্সিকো ও ভারত। দেশ দুটির রফতানি যথাক্রমে ৩৭৩ ও ৩৪০ কোটি ডলার। বিজিএমইএর দেয়া তথ্যমতে, ২০১৪ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি (যুক্তরাষ্ট্রে) কমেছে ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আমাদের শঙ্কার কারণটা এখানেই। এমনিতেই যখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হল না, তখন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর করল। এ ক্ষেত্রে টিপিপির ফলে আমাদের তৈরি পোশাক খাত যে ঝুঁকির মুখে আছে, তা আমরা কীভাবে কাটিয়ে উঠতে পারব, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।জিএসপি সুবিধা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালের হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা শীর্ষ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কযুক্ত সুবিধা দেয়ার শর্ত কার্যকর করতে রাজি হয়েছিল। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল, অনুন্নত বিশ্ব পশ্চিমা উন্নত দেশে তাদের পণ্যের আওতা বাড়াতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল পণ্যের মান ও উৎস নির্ধারণ নিয়ে। এ দুটি বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে। হংকং সম্মেলনের দীর্ঘ ৮ বছর পর ৩-৭ ডিসেম্বর (২০১৩) ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সর্বশেষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক)। বালি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এসব বাণিজ্য সংস্থা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বটে; কিন্তু বালি ঘেষণায় কোন্ পক্ষ কী পেল, কিংবা বাণিজ্য বৈষম্যের শিকার অনুগত দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন হবে কি-না, সে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নগুলোই আবারও উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকে কোনো জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তারপরও অন্যান্য পণ্যে যতটুকু সুবিধা পেত বাংলাদেশ, তাও জুন ২০১৩ থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে।জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে মূলত তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এক. শ্রমমান, দুই. শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত ও বিচার এবং তিন. ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। ঢাকায় টিকফার প্রথম বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র আকার-ইঙ্গিতে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ রুলস অব অরিজিনের কঠিন শর্তে আটকে আছে। ধনী দেশগুলো এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের মোট রফতানি ৬১.৩ ভাগ জিএসপি সুবিধার আওতায়। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে মোট রফতানির প্রায় ৬০ ভাগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৭৮ ভাগ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এ তৈরি পোশাকের ৬০ ভাগ যায় ইউরোপে আর ২৫ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাক আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত নানা প্রশ্নের সার্বিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে পারেনি। দরকষাকষিতে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। আমলানির্ভর আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমলারা বিদেশ সফর, সম্মেলনে অংশগ্রহণ ইত্যাদিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। এখানে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিজিএমইএও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাদের গবেষণা-সেলও শক্তিশালী নয়। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সঙ্গে রুলস অব অরিজিন, অ্যান্টি ডাম্পিং, ও কাউন্টার ভেইলিং ব্যবস্থা, প্রেফারেন্স ইরোশন, শ্রমমান ইত্যাদি নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন জড়িত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বণিজ্য আলোচনায়ও আমরা এসব প্রশ্নে শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।আমাদের সমস্যা এখানেই। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত ইস্যুগুলোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আসরে আমরা আমাদের অবস্থান জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। প্রতিপক্ষ এ থেকে সুবিধা নিয়েছে। তৈরি পোশাকের ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। এখানে এক ধরনের শৈথিল্য কাজ করেছিল প্রথম থেকেই। যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিল, তার সব বাস্তবায়ন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। তবে এটা সত্য, এই ১৬ দফার বেশ কটি আমরা ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কথাটা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, তারা ১৬ দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। আংশিক বাস্তবায়ন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এখন বাণিজ্যমন্ত্রী যদি রাজনীতির প্রশ্ন তুলে ওই ১৬ দফার পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে চান, তাতে স্থানীয়ভাবে তিনি বাহ্বা পেতে পারেন; কিন্তু জিএসপি পাওয়ার ক্ষেত্রে তা কোনো অবদান রাখতে পারবে না।শুধু জিএসপি নয়, এখন আমাদের ভাবতে হবে টিপিপি নিয়েও। টিপিপি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বিতর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র যে ১২টি দেশ নিয়ে টিপিপি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, তাতে প্রস্তাবিত দেশগুলোর কারও কারও আপত্তি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ১২টি দেশ বিশ্ব বাণিজ্যের ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে বাংলাদেশ আগামীতে আরও একটি ঝুঁকির মুখে থাকবে, এ বিষয়টিও আমাদের সিরিয়াসলি ভেবে দেখা উচিত। সেখানে আমাদের স্বার্থ কীভাবে ক্ষুণ্ণ হবে এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, এসব নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা করা উচিত। ইতিমধ্যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা স্বাক্ষর করেছি। তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে? আমরা এর আগেও টিকফার নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। মূল বিষয় হচ্ছে একটাই- চুক্তি স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়েই জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয় না। আমরা যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমাদের দক্ষতা দেখাতে না পারি, তখন প্রতিপক্ষ তো সুবিধা নেবেই। জিএসপি সুবিধার বাস্তব দিকগুলো আমাদের ভেবে দেখা উচিত ছিল। পূর্ণ ১৬ দফা বাস্তবায়ন না করে আমরা বললাম, রাজনীতির কারণে জিএসপি বাতিল হয়েছে- এটা ঠিক নয়। এখন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা সত্য কথাটাই আমাদের জানান দিলেন। তিনি শিক্ষকতা করেছেন। গবেষক। উন্নয়ন, গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে তার গবেষণা রয়েছে। রাজনীতিকদের মতো তিনি কথা বলেন না। তিনি সত্য কথাটাই উল্লেখ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি অন্তত একটি মেসেজ দিলেন- দ্রুত ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে হলে এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে বাণিজ্যনির্ভর যে শিল্প ব্যবস্থা, সেখানে আমরা আমাদের দ্রুত বিকাশমান বাণিজ্য খাতকে কীভাবে সুরক্ষা দেব- তাও আমাদের ভাবা উচিত। বাস্তবতা মেনে নেয়ার মধ্যেই মঙ্গল নিহিত। Daily Jugantor ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইউরোপে বড় ধরনের অভিবাসী সমস্যা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথমবারের মতো ইউরোপের দেশগুলো অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েছে। অতীতে এমনটি কখনোই হয়নি। সাম্প্রতিককালে ইউরোপে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা বেড়েছে। প্রধানত দুটি রুট ব্যবহার করে সিরীয় ও আফ্রিকার অভিবাসীরা ইউরোপে প্রবেশ করছে। একটি রুট হচ্ছে সিরিয়া থেকে তুরস্ক, তার পর সেখান থেকে গ্রিস। অন্যদিকে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে ইতালিতে যাওয়ার চেষ্টা। যাঁরা গ্রিসে ঢুকছেন, তাঁরা মূলত পূর্ব ইউরোপের হাঙ্গেরি-সার্বিয়া সীমান্ত অতিক্রম করেই গ্রিসে প্রবেশ করছেন। গ্রিসে প্রবেশ করার পর তাঁদের একটি দ্বীপে ‘ডিটেনশন সেন্টারে’ রাখা হচ্ছে। আগস্টের শেষ সপ্তাহে অস্ট্রিয়ার সীমান্তে একটি পরিত্যক্ত লরিতে ৭১ অভিবাসীর মৃতদেহ উদ্ধার কিংবা লিবিয়া সীমান্তে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রায় দুই হাজার অভিবাসীর মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এই অভিবাসী সমস্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে একটি মহাসম্মেলন ডেকেছেন।
ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীকে ইউরোপে প্রবেশ ও প্রবেশের চেষ্টা সেখানে বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীর অনুপ্রবেশ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে প্রশ্নটি অনেকেই করার চেষ্টা করেন তা হচ্ছে, হাজার হাজার অভিবাসী ইউরোপকে বেছে নিল কেন? ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক আশ্রয়ধারীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। গত ২০-৩০ বছরে হাজার হাজার শরণার্থী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে সেখানে বসবাস করে আসছেন এবং সেখানকার নাগরিকত্বও অর্জন করেছেন। ইউরোপের নাগরিকরা, বিশেষ করে জার্মানি কিংবা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলো বরাবরই শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল ছিল। ফলে আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা কিংবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে এঁরা এসব দেশে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিলেন। ফলে এসব দেশ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য এক-একটি স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। মানবপাচারকারীরা এটাকেই ব্যবহার করেছিল এবং তারা এই সুযোগ গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে মানবপাচারের উদ্যোগ নেয়। এটা সত্য, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, লিবিয়া থেকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের ইউরোপে অভিবাসন ঘটেছে অবৈধভাবে। তবে আফ্রিকা থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁরা মূলত অর্থনৈতিক সচ্ছল, উন্নত জীবন, ইউরোপের জীবনযাত্রা, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন অবৈধ উপায়ে। এমন খবরও শরণার্থীদের মুখ থেকে বের হয়েছে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা দুই থেকে তিন হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করেছেন অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য। আবার এমনও দেখা গেছে, দালাল চক্র এসব শরণার্থীকে জিম্মি করে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করছে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপে যাওয়ার ব্যাপারে অভিবাসীদের আগ্রহ বেশি কেন? এর একটা কারণ আমরা খুঁজে পেয়েছি যে, ইউরোপের নেতৃবৃন্দ এসব অভিবাসীর ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহী। এর কারণ হচ্ছে, সেখানে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার শূন্যতে নেমে এসেছে, অর্থাৎ পরিবারপ্রতি জনসংখ্যা বাড়ছে না। তরুণ প্রজন্ম তাদের স্ব-স্ব পেশার প্রতি এত বেশি মনোযোগী যে, পৃথিবীতে সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম। ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস পাওয়ায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা চালানোর জন্য লোকের প্রচণ্ড অভাব অনুভূত হয়। জার্মানি একটি শিল্পোন্নত দেশ। তাদের ফ্যাক্টরিগুলো চালাতে লোক দরকার। ফলে তারা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করত শরণার্থীদের অনুপ্রবেশের। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় অর্জন করলেই তা মঞ্জুর করা হতো। আশির দশকে হাজার হাজার আফগান নাগরিক জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাঁরা সেখানকার অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছেন। আজকে ঘুরেফিরে সেই পরিস্থিতি থেকে জার্মানি বেরিয়ে আসতে পেরেছে, এটা মনে হয় না। তাদের শ্রমিক দরকার কারখানাগুলো চালানোর জন্য। যদিও এটা সত্য, ১৯৯০ সালের পর পূর্ব ইউরোপ থেকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটেছে জার্মানিতে। এরা শ্বেতাঙ্গ, এরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কোনো কোনো দেশের নাগরিক (যেমন—চেক, পোল্যান্ড)। এরা আইনগতভাবেই জার্মানিতে থাকার ও চাকরি করার অধিকার রাখেন। কিন্তু তারপরও জার্মানিতে শ্রমিক সংকট রয়েছে। ফলে আজকে শরণার্থীরা অবৈধভাবে ইউরোপ ঢোকার চেষ্টা করছেন, তাঁদের সবার টার্গেট থাকে জার্মানিতে যাওয়ার। তৃতীয়ত, ইউরোপে এই অভিবাসী সমস্যা কোনো একটি দেশের সমস্যা নয়; বরং সমস্যাটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)। এর সমাধান ইউরোপীয় ইউনিয়নকেই খুঁজে বের করতে হবে।
এরই মধ্যে জার্মানির উদ্যোগে বলবান রাষ্ট্রগুলোর একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল অংশ নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, কী করে অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ করা যায়। কিন্তু ভিয়েনা সম্মেলনে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জার্মানি চাইছে ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করা। কিন্তু ইইউর নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভক্তি আছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, শেনজেন জোনের সুযোগ গ্রহণ করে এ অঞ্চলে একটি পাচারকারী চক্র অত্যন্ত সক্রিয়। এই ‘জোন’-এ অন্তর্ভুক্ত যেকোনো একটি দেশে প্রবেশ করলে অন্য দেশে ভিসা ছাড়াই যাওয়া যায়। ফলে পাচারকারীরা হাঙ্গেরি সীমান্ত ব্যবহার করছে। প্রতিদিন হাঙ্গেরিতে পা রাখছে প্রায় তিন হাজার মানুষ। হাঙ্গেরি সার্বিয়ার সঙ্গে ১৭৫ কিলোমিটার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে, যাতে করে সার্বিয়া থেকে অবৈধ অভিবাসীরা হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করতে না পারে। একবার হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করলে ইইউভুক্ত যেকোনো দেশে যাওয়ার সুযোগ তাদের জন্য তৈরি হয় এবং হাঙ্গেরিতে প্রবেশ করামাত্র ইইউর সব সুযোগ-সুবিধা তারা পাবে। জার্মানি এরই মধ্যে ইউরোপে প্রবেশ করা প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার শরণার্থীকে (জাতিসংঘের তথ্যমতে) ইইউভুক্ত প্রতিটি দেশে অভিবাসনের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেও অনেক দেশই তাতে আপত্তি জানিয়েছে। হাঙ্গেরি ভিয়েনা সম্মেলনে অংশ নেয়নি। ফলে অভিবাসীদের নিয়ে একটা সমস্যা রয়েই গেছে। চতুর্থত, ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীর অনুপ্রবেশ ইউরোপে একটি শক্তিশালী ‘অভিবাসনবিরোধী’ মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জার্মানিতে উগ্র নাৎসিবাদের আবার জন্ম হয়েছে। অভিবাসীদের আশ্রয়কেন্দ্রে হাতবোমা নিক্ষেপ ও আগুন দেওয়ার ঘটনাও সেখানে ঘটেছে। সুইডেনে অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে। আর হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন, আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের কারণে হাঙ্গেরি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। প্রায় প্রতিটি দেশই অভিবাসীদের ঠেকাতে নতুন নতুন নিয়ম করার উদ্যোগ নিচ্ছে। যুক্তরাজ্য যে নতুন অভিবাসী নীতি প্রণয়ন করছে, তাতে অভিবাসীদের জেল, অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের অভিবাসনের পরিসংখ্যান থেকে জানানো হয়েছে, ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা এখন ৮০ লাখ। ২০০৪ সালে দেশটিতে মোট জনসংখ্যার ২৮ ভাগ ছিল অভিবাসী, যা এখন ৩৫ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এসব অভিবাসীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ভারতের। আর প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।
অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের সীমান্তে বেড়া তৈরি হচ্ছে। ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের পতন নতুন এক ইউরোপের জন্ম দিয়েছিল। আজ ২৬ বছর পর নতুন করে আবার দেয়াল উঠছে—এ দেয়াল অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে। কিন্তু আদৌ কি এই অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করা যাবে? হাঙ্গেরিতে অভিবাসীদের ওপর পুলিশের টিয়ার সেল নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি চেক রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী শুধু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের গ্রহণ করা হবে, এমন মন্তব্য দিয়ে একটি বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এই অভিবাসন প্রক্রিয়া কীভাবে বন্ধ হবে? প্রথমত, যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে (সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন) যদি স্থিতিশীলতা ফিরে না আসে, তাহলে মানুষ আশ্রয়ের জন্য দেশ ত্যাগ করবেই।
দ্বিতীয়ত, মানবপাচারকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় না আনা হলে এই অবৈধ তৎপরতা বন্ধ হবে না। তৃতীয়ত, যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা জরুরি, বিশেষ করে সিরিয়ায়। সেখানে একদিকে রয়েছে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা, অন্যদিকে রয়েছে সরকারি বাহিনী। মার্কিন বোমা বর্ষণ সত্ত্বেও আইএসকে নির্মূল করা যায়নি। এরই মধ্যে সিরিয়া ও ইরাকের কিছু এলাকা নিয়ে ‘জিহাদি রাষ্ট্রের’ জন্ম হয়েছে। এখানে যাঁরা থাকছেন, তাঁদের বাধ্য করা হচ্ছে আইএসের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে। যাঁরা নিচ্ছেন না, তাঁরা অবৈধ পথে তুরস্ক হয়ে দেশ ত্যাগ করছেন। চতুর্থত, অর্থনৈতিক অভিবাসন ঠেকাতে আফ্রিকায় বিনিয়োগ বাড়ানো ও কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা জরুরি। মানুষ যদি বেকার থাকে, তখন উন্নত জীবনের আশায় তারা বের হবেই। এ মুহূর্তে যেসব অভিবাসী ইউরোপে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের আশ্রয় দেওয়া জরুরি। অন্যদিকে অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে ভূমধ্যসাগরে নৌ তৎপরতা বাড়ানো এবং যেসব স্থান থেকে তারা ছোট ছোট নৌকায় ওঠে, ওই সব স্থানে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা জরুরি। একটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে ইউরোপ, যদি না খুব দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
Ntv Online
31.08.15

থানচির ঘটনাবলি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক

বান্দরবানের থানচির বলিপাড়া মদক ও বাতংপাড়া এলাকায় বিজিবির সঙ্গে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির গোলাবিনিময়ের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এ ঘটনা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে এটা বলা যাবে না। রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে কিংবা বিজিবির নায়েক আবদুর রাজ্জাকের অপহরণ ও পরে ফেরত দেয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্পর্ক কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সাগরে ভাসা বেশ কিছু বাংলাদেশিকে মিয়ানমার থেকে ফেরত আনার ঘটনায় দুই দেশের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক কিছুটা ফিরে এসেছে, এটাও সত্য। তবে আরাকান আর্মির গুলিবর্ষণের ঘটনার সঙ্গে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপির কোনো সম্পর্ক নেই। এবং আরাকান আর্মি ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিজিপি তথা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। ফলে এ ক্ষেত্রে আরাকান আর্মি বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে তাদের অপতৎপরতা চালাবে, এটা চলতে দেয়া যায় না। বিজিবি ইতোমধ্যে সীমান্তে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ১১৭ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন আরো ৮৫টি বিওপি বা সীমান্ত ঘাঁটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত ভালো এবং তা আমাদের সীমান্ত রক্ষায় বড় অবদান রাখবে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, আরাকান আর্মি মিয়ানমারে একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট থেইন মেইন যে ১৫টি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন, তার মাঝে আরাকান আর্মির নাম নেই। ইতোমধ্যে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যৌথ সীমান্ত টহলের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ এতে নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। মিয়ানমারকে আমাদের আস্থায় নিতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে মিয়ানমার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশ, পশ্চিম ও উত্তরে ভারত, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে চীন, পূর্বে থাইল্যান্ড ও লাওস। মিয়ানমারের ওই ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে যে সড়ক যোগাযোগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, তাতে বাংলাদেশ তার পক্ষ নিয়ে সড়কপথে কেবল মিয়ানমারের বাজারেই নয় বরং মিয়ানমার সরকারের সহযোগিতা নিয়ে পূর্বের অন্যান্য দেশের বাজারেও প্রবেশ করতে পারে, বিশেষ করে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর বাজারে। ঘুমধুম-মুসে হাইওয়ে চালু হলে সড়কপথেই চীনে যাওয়া সম্ভব। ঘুমধুম বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশি এলাকা। আর মুসে হচ্ছে চীনের সীমান্ত শহর।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উভয় দেশই বিমসটেক (ইওগঝঞঊঈ, পরিবর্তিত নাম ইইওগঝঞঊঈ) এবং ইঈওগ জোটের সদস্য। যদিও প্রস্তাবিত ইঈওগ জোটটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভুটান ও নেপাল বিমসটেক জোটে যোগ দেয়ায় এ জোটটি শক্তিশালী হয়েছে। এ জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ডে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক ব্যাপক শিল্প কারখানা স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিভিত্তিক মিয়ানমারে বাংলাদেশি সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন চট্টগ্রাম এলাকায় বেশ কিছু সার কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশ মিয়ানমারে সার রপ্তানি করতে পারে। মিয়ানমারের আকিয়াব ও মংডুর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এসব কাঁচামালের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারে। মিয়ানমারে প্রচুর জমি অনাবাদি রয়েছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারের ভূমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের জন্য চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। মান্দালয়-ম্যাগওয়ের তুলা আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার ক্রমবর্ধিষ্ণু গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল হিসেবে তুলা মিয়ানমারের এ অঞ্চল থেকে আমদানি করতে পারে। গবাদিপশু আমদানি করার সম্ভাবনাও হয়েছে। বাংলাদেশিরা মিয়ানমারে গবাদিপশুর খামারও গড়ে তুলতে পারে। মিয়ানমারের সেগুন কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। আমাদের ফার্নিচার শিল্পের চাহিদা মেটাতে পারে এ সেগুন কাঠ, যার ওপর ভিত্তি করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপে আমাদের ফার্নিচার শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারি। মিয়ানমারের মূল্যবান পাথর যেমন_ রুবি, জেড, বোম আর মারবেল সমৃদ্ধ। এমন মূল্যবান পাথর আমাদের জুয়েলারি শিল্পকে সমৃদ্ধ করে ভ্যালুওভিশনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স মিয়ানমারের গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। ওই গ্যাস তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে নিয়ে যেতে চায়। অতীতে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। তখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশ মিয়ানমারের গ্যাস ব্যবহার করে সেখানে বিদ্যুৎ তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, যা পরে বাংলাদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের যে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি, সেখানে মিয়ানমার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এ কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সর্বশেষ নায়েক রাজ্জাকের অপহরণের ঘটনায় এ সম্পর্কে কিছুটা অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এ অবিশ্বাসকে নিয়ে বেশি দূর যাওয়া ঠিক হবে না। একমাত্র ঝসধৎঃ উরঢ়ষড়সধপু-এর মাধ্যমেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ককে আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। একদিকে মিয়ানমারের পরর 'চাপ' প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে, অন্যদিকে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে রোহিঙ্গা সম্পর্কের বিষয়টির সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই মিয়ানমারের 'চাপ'-এর কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করা যাবে না। তবে ইতোমধ্যে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। আন্দামান সাগরে রোহিঙ্গা তথা বাংলাদেশিদের নৌকায় করে পাচারের খবর আমরা তেমন একটা পাচ্ছি না।
বাংলাদেশ যখন মিয়ানমারের সঙ্গে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগী হয়েছে তখনই এলো এই আরাকান আর্মির কথা। গোলাগুলির ঘটনায় বড় ধরনের কোনো 'দুর্ঘটনা' ঘটেনি, এটা সত্য। কিন্তু ওই ঘটনা আমাদের কিছু শিক্ষা দেয়। এক. বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অরক্ষিত। সীমান্তে বিজিবি তথা সেনা মোতায়েন বাড়ানো জরুরি। প্রয়োজনে বিজিবির জন্য আরো ফান্ড দেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে বৃহত্তর বান্দরবান এলাকায় আরো সেনা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা এখন প্রমাণিত হলো যে, পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার অথবা গুটিয়ে নেয়ার কারণে সেখানে 'আশ্রয়' নিয়েছে দেশি ও বিদেশি সন্ত্রাসীরা। বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আমাদের সীমান্তে ভিনদেশি কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেবে না। সুতরাং দ্রুত থানচি এলাকায় 'চিরুনি অভিমান' চালানো প্রয়োজন এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে উৎখাত করা দরকার। দুই. একটা অভিযোগে এসেছে যে, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন এ এলাকায় তৎপর। এ সংগঠনটির তৎপরতা ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং এ অভিযোগটি তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। তিন. বৃহত্তর থানচি এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা খুব খারাপ। ফলে সীমান্তরক্ষীদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ জন্য দ্রুত সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করতে হবে। থানচি এলাকায় সেনা ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ এলাকায় গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে। যোগাযোগের সুবিধার জন্য একাধিক হেলিপ্যাড নির্মাণও জরুরি। চার. অভিযোগ আছে, থানচিতে নিরাপত্তার কারণে ইউএনও সেখানে থাকেন না। তিনি অফিস করেন বান্দরবান জেলা প্রশাসকের অফিসে। ফলে খুব সংগত কারণেই ওই এলাকায় সরকারি কর্মকা- তেমন একটা থাকে না। সেখানে দ্রুত ইউএনওর নিরাপত্তাসহ তাকে থাকার ব্যবস্থা ও সেই সঙ্গে সেনা ও পুলিশ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
থানচির ঘটনা আমাদের চোখ খুলে দিল। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন চিহ্নিত। কিন্তু বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এখনো অরক্ষিত। সন্ত্রাসীরা ওই সীমান্ত এলাকা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া তাই জরুরি। কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আমাদের এলাকা ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাবে, তা আমরা হতে দিতে পারি না। Daily Jai Jai Din 31.08.15

শ্রীলঙ্কায় পরিবর্তনের ধারা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ভাবনা

গত ১৭ আগস্ট শ্রীলঙ্কার সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেখানে যে ‘পরিবর্তনের’র ধারা সূচিত হয়েছিল তা অব্যাহত রইল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারতপন্থি বলে পরিচিত মিথ্রিলা সিরিসেনার বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেখানে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল। এরই অব্যাহত ধারা লক্ষ্য করা গেল সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। সিরিসেনা শ্রীলঙ্কার প্রো-চীনা নীতি পরিত্যাগ করে একটি প্রো-ইন্ডিয়ানীতি গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে এখন ভারতের প্রভাব বাড়ছে। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে সিরিসেনা নয়াদিল্লি সফর করেছেন। এর পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কলম্বো সফর করেছেন। এর মধ্যে দিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন দক্ষিণাঞ্চলের তামিলনাড়– রাজ্য এবং শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সমন্বয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠনের সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হলো। পাঠক স্মরণ করতে পারেন নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ভুটান, বাংলাদেশ, ভারতের সাতবোন রাজ্য ও নেপালকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গঠিত হয়েছে, যা বিবিআইএন নামে পরিচিত। একই সঙ্গে রামগর সাব রুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য এখন এই সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। একই সঙ্গে ভারত আগামীতে মংলা পোর্টও ব্যবহার করতে পারবে। যে কারণে খুলনা-মংলা সড়ক সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারত ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে তাদের ৯২টি কনটেইনার পণ্য তাদের তিনটি বন্দর, চেন্নাই, কোচিন ও নভোসেবা বন্দরে নিয়ে গেছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এ জন্য কোনো শুল্ক আদায় করেনি। এগুলো সবই হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। এমনকি গত ১৫ জুন (২০১৫) বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর ভুটানের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে একটি চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির অধীনে আগামী বছরের শুরুতে এই চারটি দেশের মাঝে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলাচল করতে পারবে। তবে ট্রানজিট ও চলাচলের অনুমতি সংক্রান্ত ফি নির্ধারণ হবে আলোচনার মাধ্যমে। ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট বা কানেকটিভিটি আমরা যে নামেই বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করি না কেন, মূল বিষয় হচ্ছে একটি এই মুহূর্তে ভারতের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপন। আর এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ড। পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের কানেকটিভিটি ঠিক এ রকমটি নয়। সেখানে এক দেশ অন্য দেশে সড়ক, নৌ অথবা রেলপথে যাওয়া যায়, আমরা প্রায়ই ইউরোপের কথা বলি। এটা সত্য সড়কপথে ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া যায়। আমি বহুবার জার্মানি থেকে ইংল্যান্ড গেছি বেলজিয়ামের ওপর দিয়ে। এখানে শুল্ক দিতে হয়। আমাদের নীতি-নির্ধারকদের অনেকেই বলছেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিবেচনা করেই শুল্ক নির্ধারণ হবে। অর্থাৎ শুল্ক এখন অবধি নির্ধারিত হয়নি! ইতোমধ্যে দুই রুটে বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। তবে পুরো উদ্যমে এই সার্ভিসটি চালু হতে আরো ২-৩ মাস লাগবে। এখানে অনেক প্রশ্ন আছে। এক. বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে যে উন্নতি করতে হবে, তার ব্যয়ভার কে বহন করবে? দুই. এই দুই রুটে কি বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব বাস চালাতে পারবে? প্রশ্নগুলোর জবাব ইতোমধ্যে আমরা অনেকেই পেয়ে গেছি। এ ক্ষেত্রে পাঠকদের কিছু তথ্য দিতে চাই। ২০১২ সালে ট্যারিফ কমিশনের দেয়া রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে (যা কানেকটিভিটির জন্য প্রয়োজন হবে) প্রয়োজন হবে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর মাঝে রেলপথে ব্যয় হবে ১৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা, সড়কপথে ৯ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা, নৌপথে ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা, মংলা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ২ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন স্থলবন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে বাকি ৪৮৯ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের হার আরো বাড়বে। এতে বাংলাদেশের লাভ কতটুকু? পরিসংখ্যান ও বিভিন্ন সূত্র বলছে ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পণ্য পরিবহনে সর্বোচ্চ ৭৬ থেকে সর্বনি¤œ ১২ শতাংশ খরচ সাশ্রয় হবে। লাভটা ভারতের বেশি, আমাদের কম। কিন্তু ব্যয়ভার আমাদের। বিআইডিসির গবেষক কেএএস মুরশিদ তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ লাভ সীমিত। তবে বিনিয়োগটা করতে হবে বাংলাদেশকেই। মোদির ঢাকা সফরের সময় ভারত যে আমাদের ২০০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব দিয়েছে, তার একটা অংশ ব্যয় হবে এ খাতে। বাংলাদেশকে সুদসহ মূল টাকা ফেরত দিতে হবে। এই ঋণের ধরন নিয়ে ইতোমধ্যে নানা প্রশ্ন উঠলেও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জানিয়ে দিয়েছেন, ওই ঋণের সঙ্গে কোনো শর্ত যুক্ত নেই। আমরা আশ্বস্ত হতে পারিনি। কেননা ভারতের এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদুভেন্দ্র মাথুরের বক্তব্য যখন টাইমস অব ইন্ডিয়ায় পাঠ করি (যা বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে), তখন কিছুটা খটকা লাগে বৈকি! মাথুর উল্লেখ করেছেন ভারত যে ঋণ দেয়, এই ঋণ চুক্তির শর্তানুযায়ী ঋণের অর্থে নেয়া প্রকল্পগুলোর অন্তত ৭৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে নিতে হবে। এসব পণ্য ও সেবার উৎপাদন প্রক্রিয়া হবে ভারতেই। শুধু বাংলাদেশই নয়, এই শর্তে নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপও মোট ৬০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে। আর টাইমস অব ইন্ডিয়া আমাদের জানাচ্ছে, নতুন ঋণের টাকায় বাংলাদেশে নেয়া প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে ভারতের নতুন করে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমরা কানেকটিভিটির বিরুদ্ধে নই। কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। এখানে আমরা আমাদের স্বার্থ দেখতে চাই। আমরাও চাই সড়কপথে আমাদের পণ্য নেপাল ও ভুটানে যাক। চুক্তি একটা হয়েছে বটে, তাতে আমরা কতটুকু উপকৃত হলাম এর হিসাব-নিকাশ করা যাবে আরো কিছুদিন পর, যখন পুরোপুরো কানেকটিভিটি ব্যবহƒত হবে। এই কানেকটিভিটি যদি মাত্র দু’পক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলেই প্রশ্ন উঠবে। কানেকটিভিটির আওতায় আমরা চীনের কুনমিংও যেতে চাই। কিন্তু তা কি সম্ভব হবে আদৌ? শ্রীলঙ্কায় পরিবর্তনের ধারা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ভাবনাএই দ্বিপক্ষীয় কানেকটিভিটি ও থিম্পুতে চারদলীয় ‘মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্ট’ (এফভিএ) স্বাক্ষরিত হওয়ায় এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ভারত এ অঞ্চলে চারদলীয় উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএনকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা এখন সার্কের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে কিনা, এটা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছে এটাও একটা প্রশ্ন যে, ভারত বিবিআইএনকে বেশি গুরুত্ব দেয়ায় ও তা কার্যকরী করায় বিসিআইএম জোটের ভবিষ্যৎ কী? ভারত কি এখন চাইবে বিসিআইএম নিয়ে এগিয়ে যেতে? বিসিআইএম হচ্ছে আবার একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই জোটে আছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ), ভারত (সাতবোন রাজ্য) এবং মিয়ানমার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তার চীন সফরের সময় এই বিসিআইএম করিডরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটাকে অনেকে ‘কুনমিং উদ্যোগ’ও বলেন। এখানে চীনের স্বার্থ বেশি সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু বাংলাদেশেরও স্বার্থ রয়েছে। চীন ২০০৩ সালে প্রথম ‘কুনমিং উদ্যোগ’ এর কথা বলেছিল, যা পরিবর্তিত হয়ে বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই বিবিআইএন জোট নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হলে এ অঞ্চলে ভারতীয় কর্তৃত্ব বাড়বে। চীনের প্রভাব এর মাঝ দিয়ে সঙ্কুচিত হবে। তাই খুব স্পষ্ট করেই বলা যায়, বিসিআইএম জোটের বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে চীনের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়বে, এটাই মনে করেন ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা। ভারতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ হয় এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না ভারত। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বিসিআইএস জোট তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে ভারতের প্রভাব বাড়ছে। আগামীতে এ অঞ্চলের তিনটি দেশ (ভুটান, নেপাল ও বাংলাদেশ) ভারতের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হবে। বিশেষ করে জ্বালানি ও বাণিজ্যনির্ভরতা এই দেশগুলোকে ভারতমুখী করে তুলবে। আর এ ক্ষেত্রে ভারতের স্ট্রাটেজি হবে বিবিআইএন জোটকে গুরুত্ব দেয়া এবং বিসিআইএমকে নিষ্ক্রিয় করা। এতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, এ প্রশ্ন এখন উঠেছে। বিবিআইএনের গুরুত্ব যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে বিসিআইএমেরও গুরুত্ব। এমনকি আমেড-৮ কেও অস্বীকার করা যায় না। বাংলাদেশের বিপুল জ্বালানি ও পানি সমস্যার সমাধান করতে হলে বিবিআইএন জোটকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা এ অঞ্চলে বিশাল এক জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু ভারতের সাতবোন রাজ্যে ৭০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ভুটান ও নেপালেও রয়েছে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা ভারত এখন দ্বিপাক্ষিকভাবে ব্যবহার করছে, যেখানে বাংলাদেশের দাবি উপেক্ষিত ছিল। একই কথা প্রযোজ্য পানি জলাধারের মাধ্যমে সংরক্ষণের একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও। শুকনো মৌসুমে ভারতের যেমনি পানির প্রয়োজন, ঠিক তেমনি প্রয়োজন আমাদেরও। এ ক্ষেত্রে বর্ষার সময় পানি ধরে রেখে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। এমনকি বাংলাদেশ যে গঙ্গা ব্যারাজ করতে যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রেও ভারতের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। রাজবাড়ীর পাংশা থেকে ভারতের সীমান্তের পাংখ্যা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকায় জলাধার নির্মাণ করা যায়। যাতে বছরে ২৫ লাখ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সমস্যা হচ্ছে ভারত এ বিষয়টি দেখছে দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির অ্যাপ্রোচটা ভিন্ন বলেই মনে হয়। তিনি বাংলাদেশে এসেও বলে গেলেন সবাইকে নিয়েই তিনি চলতে চান। এই ‘চলাটা’ শুধু দ্বিপাক্ষিক হয় কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। এখন শ্রীলঙ্কায় সিরিসেনা ও বিক্রমসিংহের বিজয়ের ফলে ভারত শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে নিয়ে তার পুরনো চিন্তাধারা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। এখানে আরো একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার জš§ হতে পারে। মনে রাখতে হবে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের ব্যাপারে ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এই স্বার্থটি মূলত কীভাবে চীনের প্রভাবকে সঙ্কুচিত করা যায়, তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। অভিযোগ আছে চীনের ডুবোজাহাজ কলম্বো গভীর সমুদ্রে নোঙ্গর করেছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের শাসনামলে। এমনকি মালদ্বীপেও চীনা ডুবোজাহাজ দেখা গেছে। ভারত এটাকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিল। ফলে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেকে চলে যেতে হয়েছিল। যদিও রাজাপাকসের দল ফ্রিডম পার্টি নির্বাচনে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে এখন সরকারের অংশ। ফলে শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় প্রভাব কতটুকু থাকবে কিংবা কীভাবে থাকবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। রাজাপাকসেকে ‘প্রো-চীন’ রাজনীতিবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কায় চীনের স্বার্থ দেখেছেন। এখন সরকারের অংশ হিসেবে এই স্বার্থ তিনি কীভাবে দেখবেন, বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলেও তিনি যে একটি ফ্যাক্টর হিসেবে রয়ে গেলেন, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে দ্রুত দক্ষিণ এশিয়া বদলে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের সর্বশেষ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানে যে অস্থিতিশীলতা রাষ্ট্রটিকে ভেঙে যাওয়ার মুখে ঠেলে দিয়েছে, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ায় এক ধরনের স্থিতিশীলতা বিদ্যমান। আর এই স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম এক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। Daily Manobkontho 30.08.15

কেন এই বিতর্ক

শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- ও তাতে জাসদের জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে বিতর্কের মাত্রা বাড়ছেই। এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। আর এ বিতর্কে বিএনপি নিজেকেও জড়িত করেছে। এবং ২৪ আগস্ট সাবেক জাসদপন্থী ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী পরিষদের সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় একটি ‘রাজনৈতিক বোমা’ও ফাটিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই শোকের মাসে কেন এই বিতর্ক, এই বিতর্কের আদৌ কী কোনো প্রয়োজন ছিল? এই বিতর্ক থেকে লাভবান হবে কারা? টিভি চ্যানেলগুলো এ বিষয়টিকে লুফে নিয়েছে। গত বেশ কয়েকদিন টিভি চ্যানেলগুলোতে এই বিতর্কও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই বিতর্কে স্বাধীনতা-পরবর্তী জাসদের ভূমিকাটি আবারও সামনে চলে এলো। নতুন করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ে জাসদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। গত ২৩ আগস্ট রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘জাসদের কর্মীরা মুজিব বাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও গণবাহিনীতে ছিল। স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনো বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানতে পারত না, যদি এই গণবাহিনী ও জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি, মানুষ হত্যা ও এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করত।’ এখানেই থেমে থাকেননি শেখ সেলিম। তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যেদিন মারা যান, সেদিন কর্নেল তাহেরও রেডিও স্টেশনে যান। শেখ সেলিম আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা। উপরন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের সঙ্গে জাসদকে জড়িয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন তা মিডিয়ায় এবং গণমানুষে যথেষ্ট উৎসাহের সৃষ্টি করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ ধরনের কথাবার্তা যে এই প্রথম উঠল তা নয়। বরং এর আগেও উঠেছে। যারা সিরিয়াস পাঠক ও গবেষক তারা স্মরণ করার চেষ্টা করবেন ২০১৪ সালের ৩ জুলাই জাতীয় সংসদে কী ঘটেছিল। ওইদিন জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে জাসদের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। বিশেষ করে গণবাহিনী গঠন এবং হত্যা, লুটপাটের ঘটনার সঙ্গে জাসদের জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছিলেন। সেদিন এর প্রত্যুত্তরে জাসদের কার্যকরী সভাপতি ও সংসদ সদস্য মাঈনউদ্দীন খান বাদল কী বলেছিলেন তাও সংসদের কার্যবিবরণী ঘাঁটলে পাওয়া যাবে। জাসদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে জনাব বাদল তখন সংসদে বলেছিলেন, ‘আমরা বলিনি যা করেছি তা সঠিক ছিল। ইতিহাসই বিচার করবে কে ভুল ছিল, কে সঠিক ছিল।’ সেদিন এক টক শোতেও দেখলাম জনাব বাদল একই সুরে কথা বলেছেন। ইতোমধ্যে জনাব সেলিমের সুরে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলাম। ২৫ আগস্ট গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জনাব হানিফ বলেছেন, জাসদ-ন্যাপসহ যারা বাম রাজনীতি করতেন, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, তারা হাটবাজার লুটপাট, ডাকাতি, ব্যাংক ডাকাতি, সাধারণ মানুষকে হত্যা, আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা, এমনকি ঈদের নামাজের জামাত শেষে আওয়ামী লীগের এমপিদের হত্যা পর্যন্ত করেন। এর লক্ষ্য ছিল একটাইÑ বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অস্থিতিশীল করা। জাসদ সমালোচনায় সর্বশেষ যোগ দিয়েছেন ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, জাসদের কারণেই ১৫ আগস্ট কিছু সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সাহস পেয়েছিল। ধারণা করছি, আগামীতে আরও শীর্ষ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জাসদ সমালোচনায় শরিক হবেন। জাসদ নেতৃবৃন্দ এর জবাবও দিয়েছেন। জনাব হাসানুল হক ইনু, যিনি জাসদ সভাপতি এবং তথ্যমন্ত্রীও। ২৬ আগস্ট তিনিও এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু জাসদের কোনো নেতাকর্মী মোশতাকের সঙ্গে যাননি। তিনি মনে করেন একটি ‘শক্তি’ ১৪-দলীয় জোট বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে ফাটল ধরাতে চায়। এর ফলে বিএনপি-জামায়াত জোট লাভবান হবে বলে তিনি মনে করেন। অন্যদিকে জাসদের পক্ষ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, শেখ সেলিম ও বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপনের বক্তব্যে ‘অভিন্ন ভাষার যোগসূত্র’ রয়েছে। বিবৃতিতে আরও অভিযোগ করা হয়Ñ শেখ সেলিমের বক্তব্য সত্যের অপলাপই নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও। তার এই বক্তব্যে শত্রুপক্ষের হাতকে শক্তিশালী করবে। আওয়ামী লীগ ও জাসদ নেতৃবৃন্দ যখন পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখছেন, তখন একটি ‘রাজনৈতিক বোমা’ ফাটিয়েছেন গয়েশ্বরচন্দ্র রায়, যিনি দাবি করেছেন তিনি ১৯৭২-৭৫ সময়ে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। একটি অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেছেন, ১৯৭৪ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা ঘেরাওয়ের অভিযানে জনাব ইনু ও আনোয়ার হোসেনকে (জাহাঙ্গীরনগরের সাবেক ভিসি) নিজে গুলি চালাতে দেখেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র রাজনীতি শুরু করেছিলেন জনাব হাসানুল হক ইনু। ‘নিখিল বোমার’ জন্ম দিয়ে জাসদই এ দেশে বোমাবাজির রাজনীতি শুরু করেছিল (শীর্ষ নিউজ, ২৫ আগস্ট)। জাসদকে নিয়ে এই রাজনীতির কারণে জাসদ এখন সঙ্গত কারণেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের সঙ্গে আদৌ জাসদ জড়িত ছিল কি না কিংবা জড়িত থাকলে কতটুকু জড়িত ছিল, এটা নিঃসন্দেহে সাধারণ একটি বক্তব্য নয়, বরং এটা প্রমাণ করতে হলে একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর এ কারণেই বোধকরি সিপিবির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার আংশিকভাবে হয়েছে। তার হত্যাকা-ে নিজ দলসহ বিভিন্ন দল ও অন্যান্য দেশি-বিদেশি শক্তি জড়িত ছিল (একটি জাতীয় দৈনিক, ২৬ আগস্ট)। বাস্তবতা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দীর্ঘ তদন্ত শেষে আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের জেরা, আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণে কোথাও বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জাসদের সংশ্লিষ্টতার সামান্যতম প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্তত সংবাদপত্রে এ-সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু অভিযোগ তো আছেই। রাজনীতিবিজ্ঞান নিয়ে যারা চর্চা করেন, গবেষণা করেন, তাদের কাছে জাসদের উত্থান, এর রাজনীতি, জাসদের জন্মের পেছনে যিনি সেই সিরাজুল আলম খানের (দাদা) ‘রহস্যজনক’ ভূমিকা বরাবরই একটি আলোচনার বিষয়। জাসদের রাজনীতি নিয়ে আরও গবেষণা, গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ফলে অনেক প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব আমাদের কাছে নেই। রাজনীতিবিদরা অনেক কথাই বলেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাতে সত্যতার রেশ থাকে না। এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বিতর্কিত অনেক রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী জাসদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে জাসদের জন্ম হয়। স্বাধীনতার পরপরই অর্থনীতি যেখানে ছিল বিধ্বস্ত, যুদ্ধ-পরবর্তী দেশে যেখানে স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্যের বড় প্রয়োজন ছিল, সেখানে জাসদ জন্মের পরপরই ‘সশস্ত্র বিপ্লবের’ ডাক দেয়। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশ কী ওই সময় প্রস্তুত ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য? একজন সাধারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রও জানেন এটা ছিল হটকারী সিদ্ধান্ত। চিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতা করেছিল। অথচ জাসদ নেতৃবৃন্দ ওই সময় ‘চিনা মডেলে’ বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। আর জাসদ বেছে নিয়েছিল এমন একটা সময়, যখন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গড়তে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন পাকিস্তানের কারগার থেকে ১৯৭২ সালে। তিনি কি সময় পেয়েছিলেন দেশকে গড়ার? জাসদ যদি ওই সময় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করত, যদি একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সংসদ ও সংসদের বাইরে তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখত আমার বিশ্বাস জাসদই বিএনপির বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অবস্থান রাখতে পারত। বাংলাদেশে বিএনপির জন্ম ও উত্থান মূলত আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। যে কারণেই মানুষ মনে করে এখনো আওয়ামী লীগের বিকল্প হচ্ছে বিএনপি। এই জায়গাটাতে জাসদ থাকতে পারত। তা পারেনি তাদের ভুল রাজনীতি, ভুল স্ট্র্যাটেজি, দলের ভেতরকার অন্তর্দ্বন্দ্ব, সুস্পষ্টনীতি না থাকা ইত্যাদির কারণে। স্বাধীনতার পর একটা তরুণ প্রজন্ম, মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ, সেনাবাহিনীর কিছু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার জাসদের রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু ভুল ও হঠকারী রাজনীতি এসব তরুণ প্রজন্মকে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। রাজনীতির ওপর এরা আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ফলে দেখা যায় জাসদ কয়েক ডজন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর মাত্র দুই বছরের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করার সিদ্ধান্তটি ছিল ভুল। বাড়ি ঘেরাওয়ের সময় কারা গুলি ছুড়েছিল এর সাক্ষী ও প্রমাণ এত বছর পর না পাওয়ারই কথা। কিন্তু ইতিহাস কী ওই ঘটনাকে অস্বীকার করতে পারবে? কিংবা অস্বীকার করতে পারবে কি ওই সময় তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণ করার ব্যর্থ উদ্যোগকে? কোন দল, কোন কোন ব্যক্তি ওই ঘটনায় জড়িত ছিল, সেসব ‘কাহিনি’ অনেকেই জানেন। কেউ কেউ এখনো তৎপর রাজনীতিতে। জাসদের ওই সব ঘটনার জন্য কি না জানি না, জাসদের একসময়ের তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খান (দাদা) এবং সাবেক জাসদ সভাপতি ও জাসদ ত্যাগকারী আসম আবদুর রব আমাকে বলেছেন, জাসদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সুতরাং জাসদ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জাসদের জড়িত থাকার অভিযোগ (?) কিংবা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যেভাবে বলছেন জাসদের কর্মকা- বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পথ প্রশস্ত করেছিল (?), এসব বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এসব বিতর্ক যত কম হবে, ততই সরকারের জন্য মঙ্গল। আওয়ামী লীগ ও জাসদ উভয়ই ১৪ দলের শরিক। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে জাসদের অবস্থান খুবই নাজুক। দীর্ঘ ৪৩ বছর যে দলটির বয়স, সেই দলটি সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কখনোই বাড়াতে পারেনি। নির্বাচনে দলের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ বারবার জামানত হারিয়েছেন। দলের সভাপতি, কার্যকরী সভাপতি এদের সবারই নির্বাচনী বৈতরণী হচ্ছে ‘নৌকা’। নৌকা মার্কা না হলে তাদের সংসদে আসা কৈলাস পর্বতে ওঠার সমান। সুতরাং জাসদ নেতৃবৃন্দ যত কম ‘ষড়যন্ত্র’-এর কথা বলবেন ততই মঙ্গল। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গাতেই থাকতে দেওয়া মঙ্গল। ইতিহাসকে নতুন করে লেখা যায় না। বদলানোও যায় না। ইতিহাস তার জায়গাতেই থাকুক। জনৈক মহিউদ্দীন আহমদ জাসদের উত্থান নিয়ে একটি বই লিখেছেন। একসময় তিনি জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি অনেক গোপন কথা তথ্য-উপাত্তসহ গ্রন্থে সংযোজন করেছেন। গ্রন্থটি ইতোমধ্যে সুধী সমাজে বেশ আলোড়ন তুলেছে। সেখানে জাসদের ’৭২-৭৫ রাজনীতির অনেক তথ্য আছে, যা জাসদ অস্বীকার করেনি। ফলে জাসদ যদি তার অতীত রাজনীতির জন্য ‘ভুল’ স্বীকার করে, তাহলে জাসদ নেতৃবৃন্দের মাহাত্ম্যই প্রকাশ পাবে। মাঈনউদ্দীন খান বাদল টিভি টক শোতে ‘ব্যর্থ’ হয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু ‘ভুল’ স্বীকার করেননি। জাসদের এখন প্রায় প্রতিদিনই পাল্টা বক্তব্য দেওয়া শোভন নয়। এতে করে বিতর্ক আরও বাড়বে। ১৪ দলের জাসদ নিয়ে অস্বস্তি আরও বাড়বে। এই মুহূর্তে এটি কাম্য নয়। Daily Amader Somoy 30.08.15

পারলেন না রাজাপক্ষে

এখন সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলো। নির্বাচন প্রাক্কালে ধারণা করা হয়েছিল, রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার অতিমাত্রায় ভারতমুখিতাকে ব্যবহার করে ব্যাপক ভোট পাবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল তা হলো না। শ্রীলংকায় জাতীয়তাবাদী চেতনা অত্যন্ত শক্তিশালী। ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাক, এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি নাগরিকরা কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। অতীত ইতিহাসও ভারতের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। অনেকেই জানেন, তামিল বিদ্রোহীদের হাতে সেখানে মারা গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ললিত আথুলাথাদালি, গামিনি দেশনায়েকে এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে তামিলদের অভিযোগ ছিল যে, শ্রীলংকার শাসকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তিনি শ্রীলংকার তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলংকার সঙ্গে ভারতের একটি চুক্তির বিনিময়ে তামিল বিদ্রোহ দমন করতে ভারতীয় সৈন্য তামিল অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করেছিল। ফলাফলটা অনেকেই স্মরণ করতে পারবেনÑ ১ হাজার ২০০ ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিল সেখানে। বাধ্য হয়ে ভারত ১৯৯০ সালে শ্রীলংকা থেকে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৮৭ সালে ভারত-শ্রীলংকা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন রাজীব গান্ধী ও শ্রীংলকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস জয়াবর্ধনে। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রেমাদাসা এর বিরোধিতা করেছিলেন। এই বিরোধিতা সামনে রেখেইে প্রেমাদাসা ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিজয়ী হন। আজ শ্রীলংকার রাজনীতিতে সেই ‘দৃশ্যপট’ লক্ষণীয়। ভারতীয় প্রভাব সেখানে বাড়ছে। সিরিসেনা সেই ‘ভারতীয় স্বার্থ’কেই প্রতিনিধিত্ব করছেন! নির্বাচনের আগে তিনি একাধিকবার ‘চিনবিরোধী’ বক্তব্য রেখেছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, চিনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের চুক্তি তিনি বাতিল করবেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে সত্যি সত্যিই তা করেছেন। ভারতের মোদি সরকারের সঙ্গে এখন অনেক ব্যবসায়ীশ্রেণি ভিড় করেছে। গত ১১-১৩ জানুয়ারি (২০১৫) গুজরাটে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ভাইব্রাই গুজরাট’ সম্মেলন। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি যোগ দিয়েছিলেন। ফলে মোদি সরকারকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেই ব্যবসায়ীশ্রেণি (যেমন আদানি গ্রুপ) চাইবে মোদি সরকারকে ব্যবহার করে ভারতের বাইরে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে। শ্রীলংকায় দ্বন্দ্বটা এভাবেই তৈরি হতে পারে! ভুলে গেলে চলবে না শ্রীলংকার ব্যাপারে চিনের শুধু যে ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে তা নয়, বরং চিন যে ‘ম্যারিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথা বলেছে, শ্রীলংকা তার অংশ। বাংলাদেশের কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল চিন। সেটা এখন আর হচ্ছে না।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে রাজাপক্ষের কিছু ভুলের কারণে শ্রীলংকার জনগণ তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। শ্রীলংকার স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত তিনি অনেক সিদ্ধান্ত নিলেও তা তার নিজের ও দলের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেননি। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ তার ওপর একশ ভাগ সন্তুষ্ট ছিল না। শ্রীলংকায় চিনের অর্থে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটলেও ভারতকে ‘উপেক্ষা’ করা এবং তামিল-মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া, তার পতনকে ত্বরান্বিত করে। উপরন্তু ছিল পারিবারিক দুর্নীতি ও ক্ষমতা করায়ত্ত করার প্রচেষ্টা। এটা ছিল তার জন্য একটা শিক্ষা। নিশ্চয়ই সিরিসেনা এটা থেকে শিখবেন। তিনি পারিবারিককরণের কোনো উদ্যোগ নিশ্চয়ই নেবেন না।
এখন শ্রীলংকার ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে এবং নির্বাচনে বিজয়ী হলেও রনিল বিক্রমাসিংহে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবেন না। সংসদে সরকার গঠন করার জন্য ১১৩ জন সদস্য তার দলে নেই। তামিলরা ১৬টি আসন পেয়ে সংসদে একটি শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে আবির্র্ভূত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জন্য এখন সম্ভাবনা দুটি। তামিলদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা অথবা রাজাপক্ষের দলের সমর্থন নিয়ে একটা ঐকমত্যের সরকার গঠন করা। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর-পরই তিনি বলেছেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জাতি গঠনে তিনি কাজ করতে চান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীলংকার ফ্রিডম পার্টি তার সরকারে যোগ দেবে কি না? দুই. মোট ২২টি জেলার মধ্যে তামিলদের জন্য নির্ধারিত তিনটি জেলার সব কয়টি আসনে তামিল সমর্থিত সংগঠনগুলোর প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এর অর্থ পরিষ্কার শ্রীলংকার মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো তামিলদের এখনো আস্থায় নিতে পারেনি। তামিলা আরও স্বায়ত্তশাসন চায়। প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে তামিলদের স্বায়ত্তশাসনে রাজি হবেন, এটা মনে হয় না। তিন. শ্রীলংকার রাজনীতি বরাবরই দুটি রাজনৈতিক দলই নিয়ন্ত্রণ করছে। একদিকে ফ্রিডম পার্টি, অন্যদিকে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি। ২০১৫ সালের সংসদ নির্বাচনে এই দুই দলের কর্তৃত্ব আবার প্রমাণিত হলো। এখন দুই দলের মাঝে সমঝোতা ও আস্থার সম্পর্ক শ্রীলংকায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। চার. প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সিরিসেনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী বাতিল করবেন। ওই সংশোধনী বলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেলেন প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারব্যবস্থায় তিনি ফিরে যাবেন। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে এটা চাইলেও, সংসদে ফ্রিডম পার্টির বড় উপস্থিতির কারণে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। পাঁচ. শ্রীলংকায় ক্রমবর্ধমান চিনা উপস্থিতি ও প্রভাব সেখানে বড় বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। ইতোমধ্যে চিনা বিনিয়োগ স্থগিত রাখা হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগের প্রশ্নে ভারত কখনো চিনের বিকল্প হতে পারবে না। ভারতের সেই ক্ষমতা নেই। সিরিসেনার চিনবিরোধী কথাবার্তা বলার পর খুব সঙ্গত কারণেই শ্রীলংকা-চিন সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে থাকবে।
এটা ঠিক রাজাপক্ষে শক্ত হাতে তামিল বিদ্রোহ দমন করলেও আন্তর্জাতিক আসরে শ্রীলংকার ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। শ্রীলংকার বিগত সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। তামিল সাধারণ নাগরিকদের (৪০ হাজার) হত্যার অভিযোগ উঠেছিল রাজাপক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ একটি তদন্ত দল পাঠাতে চাইলেও তৎকালীন সরকার তার অনুমতি দেয়নি। এখন নির্বাচিত সরকার কী করে সেটাই দেখার বিষয়। সবকিছু নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ সরকার কেমন হয় তার ওপর। যদি ঐকমত্যের সরকার হয়, তাহলে এটা করা যাবে না। কিন্তু তামিলরা যদি সরকার গঠন করতে তাদের সমর্থন দেয়, তাহলে সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যাচাই করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। এ ধরনের তদন্ত কমিটি শ্রীলংকার জন্যও ভালো। কেননা শ্রীলংকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে জিএসপি সুবিধা পায়, তাও ঝুঁকির মুখে আছে। সুতরাং নয়া সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি।
গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনার বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটি পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল। সাত মাস পর সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির বিজয়ের মধ্য দিয়ে এ পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত রইল এখন।
Daily Amader Somoy
23.08.15

শ্রীলংকার নির্বাচন এবং চীনা ফ্যাক্টর

১৭ আগস্ট শ্রীলংকার সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, শ্রীলংকায় ভারতীয় ‘প্রভাব’ বেড়ে যাওয়ায় ভারত মহাসাগরভুক্ত এলাকায় এর প্রভাব কতটুকু পড়বে? শ্রীলংকায় গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসে হেরে গেছেন। তখন ভারত ও শ্রীলংকার সংবাদপত্রে গুরুত্ব দিয়ে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল : নির্বাচনে রাজাপাকসের হেরে যাওয়ার পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে! এর পেছনে যে যুক্তি ছিল তা হচ্ছে, কলম্বোতে শ্রীলংকার গভীর সমুদ্র বন্দরে (যা চীনা অর্থে ও চীনাদের দ্বারা নির্মিত) চীনা ডুবোজাহাজের উপস্থিতি। ভারত এটাকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেছিল। এটাকে ‘বিবেচনায়’ নিয়েই মিথ্রিলা সিরিসেনাকে রাজাপাকসের বলয় থেকে বের করে এনে তাকেই নির্বাচনে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়। ওই সময় প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে সিরিসেনাকে সমর্থন করেছিলেন। একই সঙ্গে আরও একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল- মার্চে ভুবনেশ্বরে ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রিমে’র শীর্ষ সম্মেলন। সেখানে ভারতের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান আরএন রবি যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তা যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে ভারতের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে আমাদের কাছে। সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশ ভারতের কাছে কাক্সিক্ষত নয়। আর শীর্ষ গোয়েন্দা কর্তা আরএন রবি বলেছিলেন, ভারত মহাসাগরকে কোনোভাবেই শক্তিশালী দেশগুলোর দাবার বোর্ড বানাতে দেয়া যাবে না। তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভারতের কর্তৃত্ব থাকলে এ অঞ্চলে শান্তি বজায় থাকবে (আনন্দবাজার, ২১ মার্চ)। বার্তাটা স্পষ্ট, এ অঞ্চলে ভারত কাউকে প্রভাব বিস্তার করতে দেবে না। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ভুবনেশ্বর শীর্ষ সম্মেলনের আগে নরেন্দ্র মোদি মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলংকা সফর করেছিলেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে সেখানে একটি ভারতীয় ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার- দিল্লি ভারত মহাসাগরে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ ব্যাপারে মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত। এবং ওই জোটে মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। ফলে ভারত মহাসাগরে আগামী দিনে যে ভারতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, শ্রীলংকার সবশেষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হল। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল তথা ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। এ দুই অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু ‘সামরিক তৎপরতা’ লক্ষণীয়। দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক ঐক্য জোট গঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য, চীনের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মাল্লাক্কা প্রণালী হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। কারণ এটি তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। এদিকে ভারতও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতের নৌবাহিনীর ‘নিউ ইস্টার্ন ফ্লিটে’ যুক্ত হয়েছে বিমানবাহী জাহাজ। রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। আন্দামান ও নিকোবরে রয়েছে তাদের ঘাঁটি। ফলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা এরই মধ্যে চীন ও ভারতের মধ্যে শুরু হয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে চীন ও ভারতের অবস্থান এখন অনেকটা পরস্পরবিরোধী। যেখানে চীনা নেতৃত্ব একটি নয়া ‘মেরিটাইম সিল্ক রুটে’র কথা বলছে, সেখানে মোদি সরকার বলছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোরে’র কথা। স্বার্থ মূলত অভিন্ন- এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই এশিয়ার এ দুটি বড় দেশের মাঝে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। আর এটাকেই কাজে লাগাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।একসময় মার্কিন গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চীন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনাথন হোলসলাগ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে লিখিত এক প্রবন্ধে Chindia-এর (অর্থাৎ চীন-ভারত) ধারণা দিয়েছিলেন। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের পর ধারণা করা হয়েছিল, দেশ দুটি কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং চীনা প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, এ সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনে’র ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এই ইন্ডিয়া ডকট্রিন মনরো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারও কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। একসময় এ এলাকা, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিনে’র (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলংকা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার ঐক্য) যে ধারণা ছিল, শ্রীলংকায় সিরিসেনার বিজয়ের পর এ ধারণা এখন আর কাজ করবে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরও শক্তিশালী করতে বিসিআইএমের (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাতবোন, মিয়ানমার) প্রতি যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে এখন শ্লথগতি আসতে পারে। সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে ‘প্রমোট’ করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চীন ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে এ ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে না। ভারত এখন উপআঞ্চলিক জোট বিবিআইএনের কথা বলছে।ভারতের কর্তৃত্ব করার প্রবণতা এ অঞ্চলের দৃশ্যপটকে আগামী দিনে বদলে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও লক্ষণীয়। ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। সেখানে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ছে। ফলে সেখানে মার্কিন স্বার্থ থাকবেই। এ অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থের অপর একটি কারণ চীন। চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’র একটি অপকৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘কৌশলগত সম্পর্কে’ নিজেদের জড়িত করেছে। এ দুই দেশের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। তবে ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই দেশের মাঝে অবিশ্বাস সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলের এই যখন পরিস্থিতি, ঠিক তখনই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল শ্রীলংকার সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে রাজাপাকসের পরাজয় শুধু যে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাকেই স্বস্তি এনে দেবে তা নয়, বরং ভারতীয় নীতিনির্ধারকদেরও স্বস্তি দেবে। কিন্তু শ্রীলংকার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে যাবে? শ্রীলংকায় চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। রাজাপাকসে সরকার চীন থেকে ওই ঋণ গ্রহণ করে কলম্বোর আশপাশের এলাকা আরও সম্প্রসারিত করেছিল। সমুদ্র থেকে জমি উদ্ধারের এক মহাপরিকল্পনাও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু সিরিসেনা প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করে এ কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। অভিযোগ করা হয়েছে, চীনা কোম্পানি সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে ও তার সহযোগীদের প্রায় ১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছিল। রাজাপাকসে কলম্বোকে দুবাইয়ের মতো উন্নত করতে চেয়েছিলেন সাগর থেকে জমি উদ্ধার করে। এতে করে পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে- এই অভিযোগে এ পরিকল্পনা স্থগিত রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজাপাকসের নিজের এলাকা হামবানতোতাকে চীনা অর্থে একটি আন্তর্জাতিক নগরীতে পরিণত করেছেন রাজাপাকসে। সেখানে এখন একাধিক ফাইভ স্টার হোটেলসহ আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম রয়েছে। ২০১৬ সালে সেখানে কমনওয়েলথ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু চীনা এ বিনিয়োগকে খুব ভালো চোখে দেখেননি প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনি বারবার চীনা বিনিয়োগের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, চীনা ঋণের বোঝা শ্রীলংকাকে দাসত্বের জাতিতে পরিণত করতে পারে। সিরিসেনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় যে ‘নির্বাচনী ঘোষণাপত্র’ তৈরি করা হয়েছিল, তাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বক্তব্য আছে। যেমন বলা আছে, 'The land that the Whiteman took over by means of military strength is now being obtained by foreigners by paying ransom to a handful of persons. If these trend continues for another six years, our country would become a colony and we would become slaves.' নির্বাচনী ঘোষণাপত্রের কোথাও চীনের কথা বলা হয়নি। কিন্তু ইঙ্গিতটা বোঝা যায়।তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধের অবসানের পর রাজাপাকসে শ্রীলংকাকে বিভিন্ন পণ্যের রফতানিকারক দেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। এ জন্যই তিনি কলম্বোভিত্তিক গভীর সমুদ্র বন্দরটি ব্যবহার করে শ্রীলংকাকে অন্যতম একটি রফতানিকারক দেশে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি রফতানির তালিকায় চা, তৈরি পোশাক আর রবারের ওপর নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলেন। এ জন্যই দরকার ছিল চীনা বিনিয়োগের। কিন্তু চীনা বিনিয়োগের সূত্র ধরে কলম্বো গভীর সমুদ্র বন্দরে চীনা ডুবোজাহাজের উপস্থিতি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করে। ফলে সরকারের পতন ঘটে। তবে এটা বলা যায়, শ্রীলংকার ব্যাপারে চীনের যথেষ্ট আগ্রহ থাকলেও ভারত কখনোই চীনের বিকল্প হতে পারেনি বা আগামীতেও পারবে না। ভারতের আর্থিক ভিত্তি অত শক্তিশালী নয়। এ জন্যই দরকার একটা ভারসাম্যমূলক নীতি- ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে নিজের স্বার্থ আদায় করে নেয়া। শ্রীলংকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে রয়েছে একটি দক্ষ জনশক্তি। বৈদেশিক বিনিয়োগ সেখানে প্রয়োজন। এটা সত্য, ২০০০ সালে যেখানে জিডিপিতে রফতানি খাতের অবদান ছিল ৪০ ভাগ, ২০১৩ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় মাত্র ২২ ভাগে। শ্রীলংকা সরকার বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে টার্গেট করেছে। কিন্তু এটা করা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। যদিও একটা আশার কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে। তিনি সিরিসেনার মতো চীনা বিনিয়োগকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেননি।এটা এখন স্পষ্ট, সংসদ নির্বাচনে রাজাপাকসের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ায় শ্রীলংকা-চীন সম্পর্ক প্রশ্নের মুখে থাকল। এ দ্বীপদেশটিতে ভারতের প্রভাব আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে নরেন্দ্র মোদি শ্রীলংকা সফর করে গেছেন। আগামী দিনগুলোতে ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীনের দ্বন্দ্ব কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেদিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। বিশ্বের সমুদ্রপথে যত কনটেইনার পরিবাহিত হয়, তার অর্ধেক হয় ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে। অন্যদিকে বিশ্বের পেট্রোলিয়ামের চাহিদার ৭০ ভাগ এই সমুদ্রপথ ব্যবহার করেই বিভিন্ন দেশে যায়। ফলে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব যে থাকবেই, তা অস্বীকার করা যাবে না। শ্রীলংকার গুরুত্ব যে শুধু চীনারাই উপলব্ধি করেছিল তা নয়, বরং ভারতও এখন তা উপলব্ধি করছে। ভারত নতুন করে যে তার ‘কটন রুট’কে সামনে নিয়ে আসছে, সেখানে শ্রীলংকা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।আপাতত শ্রীলংকার সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার হাতই শক্তিশালী হল। তবে সিরিসেনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহের সম্পর্ক আগামীতে কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, তা লক্ষ্য করার বিষয়। কেননা সিরিসেনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্টের অনেক ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেবেন। তিনি সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী বাতিল ও পুনরায় সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে যাওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এটা যদি রক্ষিত না হয়, তাহলে তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দ্বন্দ্ব অনিবার্য। তিনটি তামিল জেলায় তামিলদের প্রতিনিধিত্বকারী তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (টিএনএ) ১৫টি আসন পেয়েছে। টিএনএ বলছে, তারা ইস্যুভিত্তিকভাবে প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহকে সমর্থন করবে। কিন্তু এতে করে স্পষ্ট হয়নি তারা আগামীতে সরকারে যোগ দেবে কি-না। তামিল অধ্যুষিত এলাকায় আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন এবং তামিলদের ‘গণহত্যার’ (৪০ হাজার সাধারণ মানুষ) অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ একটি তদন্ত তথা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে (জাতিসংঘ ও ইইউ) দ্রুত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের দাবি রয়েছে। এর আগে রাজাপাকসে অনুসন্ধানের অনুমতি দেননি। এখন তামিলদের সমর্থন পেতে হলে জাতিসংঘকে রিপোর্ট প্রকাশের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে হবে সরকারকে।রাজনীতিতে কতদিন রাজাপাকসে থাকবেন, এটাও একটা প্রশ্ন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, তার ছেলের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। সংসদ সদস্য হিসেবে এখন তিনি কি আদৌ বিচারকে প্রভাবিত করতে পারবেন? কিংবা সরকার যদি তাকে বিচারের মুখোমুখি করে, তাহলে ‘জটিলতা’ বাড়তে পারে। প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে বলেছেন, তিনি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করতে চান। তার এই ‘এপ্রোচটি’ ভালো। কট্টরপন্থী জনতা ভিমুক্তি প্যারামুনা (জেভিপি) নির্বাচনে ৫টি আসন পেয়েছে। তাদের ভূমিকার দিকেও লক্ষ্য থাকবে অনেকের।জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল। এখন সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ পরিবর্তনটি সম্পন্ন হল। Daily Jugantor ২৩ আগস্ট, ২০১৫

ভারত স্বাধীনতার ৬৮ বছরে এগোতে পারল কতটুকু

ভারত স্বাধীনতার ৬৮ বছর পার করেছে এই আগস্টে। কিন্তু যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে এই ৬৮ বছরে কতটুকু এগোতে পারল ভারত? এটা অস্বীকার করা যাবে না যে ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে বিজেপির উত্থান ও নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ ভারতকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান আগের চেয়ে যেমন আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে, ঠিক তেমনি বিশ্ব আসরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা আরো বেড়েছে। কিন্তু ভারতের দারিদ্র্য দূরীকরণে গত এক বছরে মোদির তেমন সাফল্য চোখে পড়ে না। ঋণের দায় এড়াতে কৃষকদের আত্মহত্যা তিনি বন্ধ করতে পারেননি। ভারতের জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক ৩০৮ ট্রিলিয়ন ডলার (পিপিপি অর্থাৎ ক্রয় ক্ষমতার হিসেবে ৭ দশমিক ৯৯৬ ট্রিলিয়ন ডলার)। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ ভাগ। বিশ্বের সপ্তম বড় অর্থনীতি ভারতের (পিপিপিতে এর পরিমাণ তৃতীয়)। কিন্তু ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মহত্যা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি নরেন্দ্র মোদি।
ভারতের কৃষক আত্মহত্যার 'কাহিনী' নতুন নয়। খরা, কিংবা প্রচুর বৃষ্টি ইত্যাদির কারণে প্রচুর কৃষক আত্মহত্যা করে থাকেন। মোদি যখন ২০১৪ সালের মে মাসে ভারতের বিধানসভার নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। তখন তিনি এক স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে ৪৭৭টি জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। ৩ লাখ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করেছিলেন। ৫,১৮৭টি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ৩৯ লাখ অনুসারী তার টুইটারে। আর ফেসবুকে নির্বাচনের আগে তার 'লাইক'-এর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি খুব কমই গ্রামে গেছেন। তবে ১৯ দেশ সফর করে বিশ্ব নেতাদের কাতারে তার নামকে স্থান দিতে পেরেছেন। কী পরিমাণ বদলে গেছেন মোদি, তার বড় প্রমাণ ১০ লাখ রুপির স্যুট পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে নয়াদিলি্লতে আমন্ত্রণ। এক সময় ট্রেনে ট্রেনে চা বিক্রি করে যিনি কৈশোরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, সেই মোদি কৃষক লাল সিংয়ের জন্য গত এক বছরে কোনো আশার বাণী নিয়ে আসেননি। গরিব ঘরের সন্তান হয়েও মোদি এখন অভিজাততন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন। জাত-পাতে বিভক্ত ভারতীয় সমাজের জন্য তিনি কোনো 'মডেল' হতে পারেননি এখনো। জমি অধিগ্রহণ বিল নিয়েও একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে ভারতে। কংগ্রেস এটাকে পুঁজি করে গ্রামে গ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করছে। এরকম একটি ছবি যেখানে রাহুল গান্ধী আমেথিতে (তার নির্বাচনী এলাকা) কৃষকদের নিয়ে ঘরোয়া সভা করছেন, তা ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাতেও। যদিও এটা এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না মোদির জনপ্রিয়তায় আদৌ ধস নেমেছে কিনা? কিংবা মোদি তার জনপ্রিয়তাকে আরো বাড়াতে পেরেছেন কিনা? কেননা এ ধরনের কোনো সার্ভে রিপোর্ট আমাদের কাছে নেই। নিঃসন্দেহে গত এক বছরে মোদি নিজেকে একজন উদ্যমী ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দলে আদভানির (যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন) মতো নেতাকে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বড়, তা হচ্ছে তিনি 'গরিব দেশের ধনী প্রধানমন্ত্রী'। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে স্বাগত জানাতে (জানুয়ারি ২০১৫) ১০ লাখ রুপির স্যুট পরিধান করে প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ধনিক শ্রেণিরই প্রতিনিধি!
এক সময় যে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কৈশোরে ট্রেনের কামরায় কামরায় চা বিক্রি করতেন, মা পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতেন (মে মাসের টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদকের কাছে তা তিনি স্বীকারও করেছেন), সেই মোদির সঙ্গে এখন করপোরেট জগতের বাসিন্দাদের সম্পর্ক বেশি। ট্রেনে চা বিক্রেতাদের মতো সাধারণ ভারতীয়দের কাছে এখন তিনি 'অনেক দরের মানুষ'। তিনি যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে যান ব্যবসায়ীরা, যান করপোরেট হাউসের প্রতিনিধিরা। কিন্তু গত এক বছরে তার শরীরে দশ লাখ রুপির স্যুট উঠেছে সত্য, কিন্তু দরিদ্র ভারতের চেহারা তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি। কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি। ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রামের মতো জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল, আজ তৃতীয় অবস্থানে (কারো কারো দ্বিমত এতে আছে) আর গত সপ্তাহেই জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ২০১৬ সালে ভারতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে বেশি হবে। যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে ভারতের হবে ৭ দশমিক ৭ ভাগ। নরেন্দ্র মোদি এই ভারতকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে_ ভারতের জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ এখনো গরিব। ৫৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো টয়লেট নেই, যারা প্রকাশ্যেই এ 'কাজটি' নিত্য সমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায় প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় শুধু অপুষ্টির কারণে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)। পাঁচ বছর আগের এই পরিসংখ্যানে খুব পরিবর্তন এসেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু দরিদ্র্যতা কেন বলি প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ২ দশমিক ৫০ ডলারের মতো। ৭০ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করে। নারী-পুরুষের পার্থক্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৮৬-কে হিসেবে ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণ এত ঘটনা ঘটার পরও বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি (যা বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি) গুলাব গ্যাংয়ের (উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখ-ে গ্রামের সত্য কাহিনী) কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মোদি গত এক বছরে এদের জন্য কী করেছেন? যদিও মাত্র এক বছরে দরিদ্রতা কমানো সম্ভব নয়। কিংবা বিপুল তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দরিদ্রতা কমানো তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তার 'গুজরাট মডেল' নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি সড়ক, মহাসড়ক করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ভারতের প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলো তার এক বছরের পারফরম্যান্স নিয়ে নানা প্রবন্ধ লিখেছে। তবে বেশিরভাগ সংবাদপত্রের ভাষ্য একটাই_ তিনি যে নির্বাচনের আগে 'আচ্ছে দিন'-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা এখনো অধরা। প্রাপ্তির ঘরটা এখনো শূন্যই। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১২৫ কোটি মানুষের প্রত্যেকের ব্যাংক একাউন্টে ১৫ লাখ রুপি করে জমা হবে। কিন্তু তা হয়নি। ভবিষ্যতে হবে, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কালো টাকা উদ্ধার করার প্রতিশ্রুতিও ছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানিয়ে দিয়েছেন কালো টাকার প্রশ্নটা ছেলে খেলা নয়। কাজেই অমন হুটোপুটি করলে চলবে না। আর অমিত শাহ বলেছেন, কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা_ এটা কথার কথা। এ ধরনের কথা বলতে হয়। এটা কথার কথা, এটাকে সিরিয়াসলি নিতে নেই_ এটা অমিত শাহের সাফ কথা। তাই নরেন্দ্র মোদির সেই প্রতিশ্রুতি 'আচ্ছে দিন', অর্থাৎ সুসময় কবে আসবে, বলা মুশকিল। তবে এটা তো ঠিক, সুসময় এসেছে ব্যবসায়ীদের জন্য। তারা এখন মোদির সঙ্গে সারা বিশ্বময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের চাই ব্যবসা। চাই বিনিয়োগ। আর সেই ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করছেন মোদি। জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াতে তিনি প্রচুর আশ্বাস পেয়েছেন। ভারতকে তিনি চীনের বিকল্প হিসেবে 'পণ্যের উৎপাদন কারখানায় পরিণত করতে চান। বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন ভারতে আসছে। কিন্তু কৃষক যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তাদের কোনো উন্নতি হয়নি।
সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মোদি একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাতেও তা ছাপা হয়েছে। এখানে তিনি কতগুলো বিষয় স্পষ্ট করেছেন। এমনকি বিজেপি এক সংবাদ সম্মেলনও করেছে গত ২৬ মে। মোদির চিঠি ও বিজেপির সংবাদ সম্মেলনে কতগুলো বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। এক. রামমন্দির প্রতিষ্ঠা কিংবা শরিয়া আইন বাতিল তারা করবেন না। কেননা লোকসভায় তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট নয়। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ, মুসলিমদের শরিয়া আইন বাতিল, জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাবাহী সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল_ এগুলো ছিল বিজেপির প্রধান নির্বাচনী ইস্যু। দুই. মোদি বলেছেন, তিনি গত এক বছরে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি প্রধান পাহারাদার, দেশের সম্পদের পাহারাদার। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে মোদির 'মেক ইন ইন্ডিয়া' (ভারত নির্মাণ) অভিযানকে অতিরঞ্জিত প্রচার বলে মন্তব্য করা হয়েছে। মোদি সরকারের কাছে বিপুল প্রত্যাশা থাকলেও কর্মসংস্থানের হাল যথেষ্ট খারাপ বলেও মন্তব্য করেছে তারা। প্রভাবশালী দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে মোদি সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতে 'মোদির এক বছর উচ্ছ্বাসের বাঁধ শেষ, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতে মোদি এক বছর আগে পরিবর্তন ও আর্থিক পুনরুজ্জীবনের আশায় নরেন্দ্র মোদি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু এবার চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে মোদি সরকার। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে, 'মেক ইন ইন্ডিয়া' অভিযান শুরু করলেও, ভারতের অর্থনীতি খুঁড়িয়েই চলছে। আর নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, মোদির অধিকাংশ কর্মসূচি এখনো কথার কথাই রয়ে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার এখনো বেহাল। ব্যবসায়িক উদ্যোগেও তেমন দানা বাঁধছে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও চাপে পড়েছেন মোদি।
এসব মূল্যায়ন মোদি সম্পর্কে কোনো ভালো ধারণা দেয় না। নিশ্চয়ই গত এক বছরে মোদি অনেক কিছু শিখেছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত একাই নেন। এখানেই মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার পার্থক্য। মনমোহন সিং বেশি মাত্রায় সোনিয়া গান্ধীনির্ভর ছিলেন। নরেন্দ্র মোদির প্লাস পয়েন্ট এটাই। দলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। তারপরও তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ আছে। দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এটা মনে করে কিনা জানি না, গত শনিবার ভারতের ৬৯তম স্বাধীনতা দিবসে এক ভাষণে তিনি বলেছেন, 'দুর্নীতি ভারতকে ঘুণপোকার মতো খেয়ে ফেলেছে। ওপরের পর্যায় থেকে আমাদের এ কাজ শুরু করতে হবে।' ভাষণে তিনি কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর মধ্যে আছে ১০০০ দিনের মধ্যে সব গ্রামে বিদ্যুৎ। তিনি বলেছেন, 'স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া। নতুন ভারত গড়ার এখনই সময়।' তিনি কৃষকদের সেনাবাহিনীর জোয়ানদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
প্রশ্ন এখানেই_ যে দেশে এখনো কৃষক ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, সে দেশে কৃষকদের 'সাহসী সৈনিক' হিসেবে উল্লেখ করা অর্থহীন! ভারতে ক্ষুদ্রঋণের তেমন প্রচলন নেই। কৃষকদের প্রণোদনা দেয়ার জন্য ব্যাংকও এগিয়ে আসে না। ফলে মোদির বক্তব্য ওই কাগজ-কলমে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। দশ লাখ টাকা দামের স্যুট পরে আর যাই হোক, কৃষকবান্ধব হওয়া যায় না। Daily Jai Jai Din 20.08.15

জিএসপি সুবিধার পাশাপাশি টিপিপি চুক্তি নিয়েও ভাবতে হবে

খবরটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১২২টি দেশের জন্য জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা পুনর্বহাল হলেও তাতে বাংলাদেশের নাম নেই। এরই মধ্যে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি বা ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারবে। এর অর্থ পরিষ্কার-যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের যে চাহিদা রয়েছে, তা এখন দখল করে নেবে ভিয়েতনাম। আর তখন বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাবে। এমনিতেই বাংলাদেশি তৈরি পোশাকশিল্প প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন ও সেই সঙ্গে বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন অত্যন্ত শক্ত অবস্থানে গিয়েছিল, যা কি না জিএসপি সুবিধা বাতিলের ব্যাপারে একটা 'ভূমিকা' রেখেছিল। যদিও এটা সত্য, প্রায় ১৬ শতাংশ (১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ) শুল্ক পরিশোধ করেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের বাজার সৃষ্টি করেছি। এখন টিপিপি চুক্তির ফলে ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে তাদের তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাবে। ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। ইতিমধ্যেই চীনের পর ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বড় রপ্তানিকারক। এখানে একটা কথা বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন ধরেই প্যাসিফিক অঞ্চলভুক্ত ১১টি দেশের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছিল। এই দেশগুলো হচ্ছে-অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। এ আলোচনা এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। তবে এই টিপিপির বিরুদ্ধে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই একটি বড় বিরোধিতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে এই ১২টি দেশ বিশ্বের ৪০ শতাংশ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক। অভিযোগ আছে, বড় বড় করপোরেট হাউসগুলো এই চুক্তি থেকে লাভবান হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট হাউসগুলো ব্যাপক সম্প্রসারিত হবে। বিশেষ করে গ্যাট চুক্তিতে TRIP বা Trade Related Intellectual Property Rights-এর আওতায় উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশ (বাংলাদেশসহ) নিজস্ব 'প্যাটেন্ট' আইনের আওতায় উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছিল। টিপিপিতে 'বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা' অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখন বহুজাতিক কম্পানিগুলোর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে উন্নত প্রযুক্তি খরিদ করতে হবে। কৃষি খাত ও ওষুধ শিল্প এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। টিপিপি চুক্তিতে এমন কথাও বলা আছে যে বহুজাতিক কম্পানিগুলো টিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত যেকোনো জাতীয় সরকারের বিরুদ্ধে Investors- state dispute settlement (ISDS)-এর আওতায় মামলাও করতে পারবে। বলা আছে, সরকারগুলো এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে না, যাতে টিপিপির মূল স্পিরিটকে আঘাত করে। টিপিপি মূলত একটি 'ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট' হলেও মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কর্তৃত্ব ও প্রভাব এতে স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্রের এই করপোরেট স্বার্থই এখানে বড়। এমনকি টিপিপি চুক্তির ‘legislative certification’-এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ওই সব দেশের আইনও বদল করতে পারবে। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই এই চুক্তি নিয়ে বিতর্ক ছিল। চিলির মতো দেশও আপত্তি জানিয়ে আসছিল। এই ১২টি দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা (যাঁদের মধ্যে সংসদ সদস্যও আছেন) একটি খোলা চিঠিতে এই চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন। অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন যে এ চুক্তিটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিরও পরিপন্থী। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তথাকথিত 'মুক্ত বাণিজ্য' আর পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের 'লোভে' ভিয়েতনামের মতো দেশও এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ছূড়ান্ত বিচারে এ চুক্তির টার্গেট হচ্ছে বিশ্ববাজারে তথা যুক্তরাষ্ট্রে চীনের 'বাণিজ্যিক আধিপত্য' কমানো। ভিয়েতনাম তখন নিজের স্বার্থেই এই চুক্তি স্বাক্ষর করল। পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাকে ভিয়েতনামের রপ্তানি বাড়ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হারে। টিপিপির ফলে এটা আরো বাড়বে। ২০১৫ সালেই ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি খাতে ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ভিয়েতনাম ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিক রপ্তানি ৫০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া আট হাজার ১৭৮ কোটি ডলারের মধ্যে চীনের দুই হাজার ৯৭৯ কোটি ডলার। তার পরের অবস্থানই ভিয়েতনামের, ৯২৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া রয়েছে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে। চতুর্থ ও পঞ্চম যথাক্রমে মেক্সিকো ও ভারত। দেশ দুটির রপ্তানি যথাক্রমে ৩৭৩ ও ৩৪০ কোটি ডলার। বিজিএমইর দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৪ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি (যুক্তরাষ্ট্রে) কমেছে ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আমাদের শঙ্কার কারণটা এখানেই। এমনিতেই যখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হলো না, তখন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর করল। এ ক্ষেত্রে টিপিপির ফলে আমাদের তৈরি পোশাক খাত যে ঝুঁকির মুখে আছে, তা আমরা কিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারব, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।
জিএসপি সুবিধা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার শর্ত কার্যকর করতে রাজি হয়েছিল। এতে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে অনুন্নত বিশ্ব পশ্চিমা উন্নত দেশে তাদের পণ্যের আওতা বাড়াতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল, পণ্যের মান ও উৎস নির্ধারণ নিয়ে। এই দুটো বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে। হংকং সম্মেলনের দীর্ঘ আট বছর পর ৩-৭ ডিসেম্বর ২০১৩ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সর্বশেষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক)। বালি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বটে; কিন্তু 'বালি ঘোষণায়' কোন পক্ষ কী পেল কিংবা বাণিজ্য বৈষ্যমের শিকার অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের প্রশ্নে এ প্রশ্নগুলোই আবারও উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকে কোনো জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তার পরও অন্যান্য পণ্যে যতটুকু সুবিধা পেত বাংলাদেশ, তাও ২০১৩ সালের জুন থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে। জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র মূলত তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এক. শ্রমমান, দুই. শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের পুনঃ তদন্ত ও বিচার। তিন. ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। ঢাকায় টিকফার প্রথম বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র আকার-ইঙ্গিতে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ 'রুলস অব অরিজিন'-এর কঠিন শর্তে আটকে আছে। ধনী দেশগুলো এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৬১.৩ শতাংশ জিএসপি সুবিধার আওতায়। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশ সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে বাংলাদেশ। বলা ভালো, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৭৮ শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এই তৈরি পোশাকের ৬০ শতাংশ যায় ইউরোপে, আর ২৫ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাক আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত নানা 'প্রশ্ন'-এর ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে পারেনি। দরকষাকষিতে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। আমলানির্ভর আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমলারা 'বিদেশ সফর', 'সম্মেলনে অংশগ্রহণ' ইত্যাদিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। এখানে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিজিএমইএ-তারাও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাদের গবেষণা 'সেল'ও শক্তিশালী নয়। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সঙ্গে 'রুলস অব অরিজিন', 'এন্টি ডাম্পিং ও কাউন্টারভেইলিং ব্যবস্থা', 'প্রেফারেন্স ইরোসন', শ্রমমান ইত্যাদি নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন জড়িত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায়ও আমরা এসব প্রশ্নে শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।
২৮ এপ্রিল ২০১৪ ঢাকায় টিকফার প্রথম বৈঠক শেষ হয়েছিল। এতে আমাদের প্রাপ্তি কী ছিল? আমাদের প্রাপ্তির খাতাটা ছিল 'শূন্য'। জিএসপি সুবিধার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো 'কমিটমেন্ট' ছিল না। যদিও তখন বলা হয়েছিল, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে সমস্যার সমাধান করাই টিকফার লক্ষ্য। এটা একটা 'কূটনৈতিক জবাব'। যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা চুক্তির ১৬ অনুচ্ছেদের সবগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। কিন্তু যে প্রশ্নগুলো বিভিন্ন মহলে ইতিমধ্যে উঠেছে, তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব আমরা পাইনি। টিকফা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স সুবিধা দেবে। তাতে আমরা কতটুকু সুবিধা পাব? যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোকে আর্থিক নিরাপত্তা দেবে বাংলাদেশ। তাতে আমাদের স্বার্থ কতটুকু অর্জিত হবে? যুক্তরাষ্ট্র টেলিকমিউনিকেশন, জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ করবে। এতে এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। তাতে কী সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? সেবা খাত কী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জ্বালানি খাত ঝুঁকির মুখে থাকবে। বিশ্বের ৮৭টি দেশে আমরা ওষুধ সরবরাহ করি। এটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জিএসও ফুড নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বিতর্ক আছে। বহুজাতিক কম্পানিগুলো বাংলাদেশে জিএসও ফুডের বাজার সৃষ্টি করতে পারে, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। টিপিপি চুক্তি বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, তার কোনো সুষ্ঠু গবেষণা এখনো হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন, আমি নিশ্চিত নই। এখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল না হওয়ায় টিপিপি চুক্তিটিও আমাদের জন্য কোনো 'বিষফোড়া' হিসেবে সৃষ্টি হয় কি না, সেটাই দেখার বিষয়। জিএসপি পুনর্বহাল না হওয়ায় বাণিজ্যমন্ত্রী এটাকে 'রাজনৈতিক কারণ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক কারণ জড়িত নয়। বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা পেশ করেছিল, তার সবই বাস্তবায়ন হয়েছে-এটা বলা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভালো। এখন আমাদের টিপিপি নিয়েও সিরিয়াসলি ভাবতে কবে। বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও তাঁর কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু বরফ গলেনি। তৈরি পোশাকের জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক তথা আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা তাই জরুরি। Daily Kalerkontho 19.08.15

ভবিষ্যতের পথ মসৃণ নয়

গত ১৪ আগস্ট ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মাঝে ‘নয়া সম্পর্ক’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি দিন। ওইদিন কিউবার রাজধানী হাভানায় দীর্ঘ ৫৪ বছর পর আবারো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ওড়ানো হয়। ১৯৬১ সালে এই পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়েছিল। আবার এই পতাকা উঠল। গত ডিসেম্বর (২০১৪) থেকেই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। ১৭ ডিসেম্বর বারাক ওবামা পুনরায় কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার কথা বলেন। এরই ফলে ২১ জানুয়ারি থেকে আলোচনা শুরু হয় এবং গত ২০ জুলাই ওয়াশিংটনে কিউবা তার দূতাবাস খোলে। এর আগে গত ১২ এপ্রিল (২০১৫) মধ্য আমেরিকার দেশ পানামায় আমেরিকান দেশগুলোর তিনদিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলনে ওবামা ও কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রো এক ঐতিহাসিক বৈঠক করেছিলেন। দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়েছে, এটা ভালো দিক। কিন্তু যেতে হবে অনেকদূর। মার্কিন কংগ্রেস এখন নিয়ন্ত্রণ করে রিপাবলিকানরা। তারা যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ককে কীভাবে দেখে, সেটাই বড় প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক অনেকদিন ধরেই আলোচনার একটি বিষয় হয়েছিল। কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিত্যাগ করবে, নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘আবারো’ হাভানায় সরকারের উৎখাতের উদ্যোগ নেবে এসব প্রশ্ন বারবার মিডিয়ায় ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের লেখনীতে উঠে আসছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ইউরোপে ‘সোভিয়েত ধাঁচের’ সমাজতন্ত্রের পতনের রেশ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল তখন বলতে গেলে সারাবিশ্বের দৃষ্টি এক রকম নিবদ্ধ ছিল কিউবার দিকে। কেননা কিউবা ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অন্যতম ক্ষেত্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল কিউবার অর্থনীতির অন্যতম উৎস সেই সঙ্গে নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কিউবা টিকে থাকতে পারবে কিনা এ প্রশ্নটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আগ্রাসনের’ মুখে থেকে কিউবা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা, এ নিয়েও প্রশ্ন ছিল। আরো একটি প্রশ্ন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিলÑতা হচ্ছে কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে? কেননা চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পরিবর্তন এসেছে। এই দুটি দেশ এখন আর ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। তাই খুব সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন ছিল কিউবা চীন বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করবে কিনা? কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল কিউবার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনই কিউবায় একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। বরং কিউবায় বিপ্লবের পর (১৯৫৯) কিউবা সরকার যখন লাতিন আমেরিকাজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চাইল, চে গুয়েভারা যখন ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করার জন্য কিউবা সরকারের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে বলিভিয়ায় গেলেন (সেখানেই তাকে পরে হত্যা করা হয়), তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ভিন্ন একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনই চায়নি ‘তার প্রভাবাধীন এলাকায়’ অন্য কোনো ‘শক্তি’ প্রভাব খাটাক। ‘মনরো ডকট্রিন’ এর আদলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে এ এলাকায় তথা লাতিন আমেরিকায় তার পূর্ণ কর্তৃত্ব। কিন্তু কিউবার বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘হিসাব-নিকাশ’-এ বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র কিউবা বিপ্লবের মাত্র দু’বছরের মধ্যে ১৯৬১ সালে ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। সিআইয়ের অর্থে পরিচালিত এই অভিযান ‘বে অব পিগস’-এর অভিযান হিসেবে খ্যাত। বলাই বাহুল্য ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। ঠিক এর পরের বছর ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ‘কিউবা সংকট’ একটি পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনার জš§ দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে, এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ অবরোধ আরোপ করে যাতে কিউবায় কোনো ধরনের সামাজিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করা না যায়। ওই নৌ অবরোধ অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ভবিষ্যতের পথ মসৃণ নয়সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন ওই নৌ অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে ওই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা ‘যুদ্ধ’ করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্পর্ক উন্নয়নের ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বললেও এটি খুব সহজ হবে না। কেননা ওবামাকে এ সংক্রান্ত একটি আইন পাস করাতে হবে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে কংগ্রেসে তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ এখন নিয়ন্ত্রণ করে রিপাবলিকানরা। রিপাবলিকানরা ওবামার উদ্যোগের ব্যাপারে খুশি নন। একাধিক কংগ্রেস সদস্য তথা সিনেটরের বক্তব্য শুনেছি, যেখানে তারা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওবামার এই উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন। সিনেটর জন মেককেইন ও সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার এই সিদ্ধান্ত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সংকুচিত করবে। অন্যদিকে সিনেটর রয় ব্লান্ট মনে করেন, এই ঘোষণা রাহুল ক্যাস্ট্রোকে ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে। ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটর রবার্ট মেনডেজ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার এই সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিউবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ও স্বৈরশাসনকে স্বীকার করে নেয়া। সিনেটর মেনডেজ নিজে কিউবা-আমেরিকান। এতে ধারণা করা স্বাভাবিক যে, কিউবার ওপর থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সংক্রান্ত কোনো আইনকে কংগ্রেসকে অনুমোদন দেবে না। ফলে ওবামার ঘোষণা ও উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ‘একটি ঘোষণা’ হিসেবেই থেকে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের দাবি কিউবায় আরো বেশি গণতন্ত্রায়ণ। আরো বেশি অর্থনৈতিক উদারীকরণ। মানবাধিকার পরিস্থিতির আরো উন্নতি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কার। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে কিউবা সব কিছু ‘উš§ুক্ত’ করে দেবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে গর্বাচেভের সংস্কার কর্মসূচির ফলাফল তাদের অজানা নয়। সংস্কার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আনতে গিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। চীন ও ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কার কর্মসূচির ‘পেরেস্ক্রোইকা’ বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু ‘গ্লাসনোস্ট’ কার্যকরী হয়নি। রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। কিউবাতে কোনোটাই আসেনি। চীন তার সংস্কার কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে এখন ঋণ গ্রহণ করছে। ভিয়েতনামও কম যায়নি। যে ভিয়েতনাম প্রায় ৪০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তারাই আজ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের যে বিশাল চাহিদা তার একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম সরবরাহ করছে। এখানে ‘রাজনীতি’ অগ্রাধিকার পায়নি। পেয়েছে বাণিজ্য। এখন কিউবা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাও দেখার বিষয়। তবে হুট করে দু’দেশের সম্পর্কে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে না। প্রেসিডেন্ট রাহুল ক্যাস্ট্রো ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে কিউবার রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিউবার জনগণ এখনো কিউবার সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এটাও ঠিক বিশ্বায়নের এই যুগে কিউবা ‘একা একা’ চলতে পারবে না। দেশটিকে ‘দুয়ার উš§ুক্ত’ করে দিতে হবেই। দেশের অর্থনীতির শতকরা ৮০ ভাগ এখনো সরকার নিয়ন্ত্রিত। কিছু কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সারাদেশে এ সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ট্যুরিজম খাত। এ খাত কিছুটা উš§ুক্ত করা হয়েছে। আরো উš§ুক্ত করা হলে, যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেন ব্যবসায়ীরা এই খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিউবাতে সীমিত আকারে ‘ডলারবাণিজ্য’ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিউবার আমেরিকান পাঠানো অর্থ এখন নিয়মিত কিউবাতে আসছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহƒত হচ্ছে। তবে একটা সমস্যা রয়েছে। কিউবা প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল ‘অত্যন্ত কম মূল্যে’ ভেনিজুয়েলা থেকে পেয়ে আসছে। এর বিনিময়ে কিউবা ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক দিচ্ছে। এসব ডাক্তার, নার্স আর শিক্ষক এখন ভেনিজুয়েলার হয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কাজ করছেন। পুরো ব্যয়ভার বহন করছে ভেনিজুয়েলা। প্রয়াত হুগো শ্যাভেজ এই পরিকল্পনা শুরু করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো এই পরিকল্পনা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, এ প্রশ্ন ইতোমধ্যেই উঠেছে। কেননা ভেনিজুয়েলার রমরমা তেল ব্যবসার দিন শেষ। অর্থনীতি আগের মতো আর শক্তিশালী নয়। রাজধানী কারাকাসে বিশাল বিশাল ভবন খালি পড়ে আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভেনিজুয়েলার ওপর বাণিজ্যিক, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যখন ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন, তার ঠিক একদিন পর ১০ ডিসেম্বর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর মেনডেজ ‘ভেনিজুয়েলার জনগণের বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। গত এপ্রিল থেকেই সেখানে অসন্তোষ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেশ কয়েকজন ভেনিজুয়েলার ভিআইপির ব্যাপারে। সম্পদ আটক থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, ভেনিজুয়েলার মারাত্মক মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির। এটা সত্য, হুগো শ্যাভেজের মৃত্যুর পর ভেনিজুয়েলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর চাইতেও খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে কলম্বিয়ায় কিংবা মেক্সিকোতে, যেখানে গেল বছর ৪৩ স্কুলশিক্ষার্থীকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। ভেনিজুয়েলার বিষয়টি যে পরিপূর্ণ রাজনৈতিক, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। এখন খুব সংগত কারণেই ভেনিজুয়েলার ওপর মার্কিনী ‘চাপ’ যদি বাড়ে তাহলে কিউবাকে দেয়া তাদের আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তা কিউবার অর্থনীতিকে আঘাত করবে। কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে খোদ যুুক্তরাষ্ট্রও উপকৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাত মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স, কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে পারছে না। স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ আসছে বাইরে থেকে। এ ক্ষেত্রে কিউবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জগদ্বিখ্যাত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই চাহিদা পূরণ করতে পারে। ২০০২ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রো এ ধরনের একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। গেল বছর পশ্চিম আফ্রিকায় মারাত্মক ইবোলো রোগ ছড়িয়ে পড়ায়, কিউবার স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে গেছেন। এখন কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নত হলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাতে উপকৃত হতে পারে। তবে মূল সমস্যাটিই হচ্ছে মানসিকতার। যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের মানসিকতায় কী পরিবর্তন আসে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। গত ১৪ আগস্ট হাভানায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে মার্কিন পতাকা উত্তোলনকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব জনকেরি বলেছেন, কিউবা এখন আর শত্রু নয়, বন্ধু। বাস্তব ক্ষেত্রে এই ‘বন্ধুত্ব’ কতটুকু প্রতিফলিত হয়, তাও দেখার বিষয় এখন। তবে সম্পর্ক জোরদারকরণের পথটা মসৃণ নয় এবং এ ক্ষেত্রে বেশি প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার। Daily Manobkontho 19.08.15