রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কোন পথে বিএনপি

১ সেপ্টেম্বর বিএনপি ৩৭ বছরে পা রাখল। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এই ৩৭ বছর একেবারে কম সময় নয়। দলটি একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া এই রাজনৈতিক দল বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বোধ করি অতীতে কখনোই দলটি এ ধরনের সংকটের মাঝে পড়েনি। যাঁরা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন তাঁরা জানেন বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দলটির একটি শক্ত অবস্থান আছে। তিনবার দলটি ক্ষমতায় ছিল (১৯৭৮-১৯৮২, ১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬)। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির একটি অবস্থান আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা থেকে বিএনপির উৎখাতের পর ওই সময় যখন বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে ছিল, ঠিক তখনই একজন গৃহবধূ থেকে (১৯৮৩) রাজনীতির পাদপ্রদীপে আসেন বেগম জিয়া। এখন তিনিই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী। তাঁকে কেন্দ্র করেই বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যে বেগম জিয়াকে দেখেছিল একজন অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে, সেই বেগম জিয়াকে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল! ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নেওয়া কিংবা পরবর্তী সময় সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম হয়েছে এ দেশে, তা ব্যক্তিগতভাবে বেগম জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতিকে উজ্জ্বল করেনি। বেগম জিয়াকে আমার এখন মনে হয়েছে 'নিঃসঙ্গ একজন নাবিক' হিসেবে, যিনি আদৌ জানেন না কোন দিকে এবং কোন পথে বিএনপি নামক 'জাহাজ'টিকে তিনি পরিচালনা করছেন! এক সন্তানহারা, অপর সন্তান অনেক দূরে, নেতাকর্মীরা জেলে। নিঃসঙ্গ বেগম জিয়া এখন একাই বিএনপি।
বর্তমানে বিএনপি নানা সমস্যায় আক্রান্ত-এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি দল গোছানোর কথা বলছে। তবে বিএনপির কয়েকজন নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপি ভাঙার 'গুজব' এ কারণেই! 'বেগম জিয়াকে দিয়ে হবে না' কিংবা 'জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে হবে'-এ ধরনের বক্তব্য যখন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হয় তখন গুজবের নানা ডালপালা গজায়। মির্জা ফখরুল জামিন পেলেও অনেকেই জেলে আছেন এখনো। অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা আছে। আর যাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার-মামলা, মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের 'ব্যস্ত' রাখতে চায় সরকার, যাতে তাঁরা 'আন্দোলনে' নিজেদের জড়িত করতে না পারেন! বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নি-এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা! ফলে এসব নেতাকর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারবে না। বেগম জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসংক্রান্ত ধারা) বিচার কিংবা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ড্যান্ডি ডাইং মামলায় তারেক রহমানকে 'শাস্তি' দিয়ে তাঁকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ ক্ষেত্রে বেগম জিয়াকে নির্বাচনে 'অযোগ্য ঘোষণা'(?) করা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচনের যোগ্য হবেন কি না জানি না। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্ন হবে তখন অবান্তর। বেগম জিয়াই বিএনপির মূলশক্তি। বেগম জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, বিএনপির 'বিকল্প নেতৃত্ব' নির্বাচনে অংশ নেবে-এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপি সংগঠিত হবে-এটাও আমার মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো কার্যকর 'ফল' দেবে না। 'আসল বিএনপি' কিংবা নাজমুল হুদার 'ফালতু কথাবার্তায়' মানুষ খুব আস্থাশীল, এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি এখন অস্তিত্বহীনতার মুখে। ফলে সরকারের কাছে এখন বিকল্প পথ দুটি। বিএনপিকে যেকোনোভাবে আস্থায় নিয়ে ২০১৬ সালের শেষের দিকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া। অথবা সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। যেকোনো সময়ের চেয়ে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। ওপরে উল্লেখিত দুটি সিদ্ধান্তের মাঝে একটি, অর্থাৎ প্রথমটির ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কম। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনটিই সরকার করতে চায়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে যদি ২০১৮ সালের নির্বাচন হয়, তাহলে সমস্যা যা ছিল তা-ই থেকে যাবে! বিএনপির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা যাবে না। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিকল্পই বিএনপি, জাতীয় পার্টি নয়। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি পারেনি। তাই যেকোনো বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য জরুরি। কেননা বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে, যেখানে ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত দেড় বছরে সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ফলে সংসদকে আরো গ্রহণযোগ্য, আরো অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্ব পালন করতে পারে। বলা ভালো, বিএনপি সংসদে না থাকলেও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূলধারার রাজনীতিতেই দেখতে চায়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থানও আমার ধারণা অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। এই দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে এই দুটি দলের একটিকে বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জামানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ না নেওয়ার কারণে। এ দুই দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই পঞ্চম সংসদ (১৯৯১), সপ্তম সংসদ (১৯৯৬), অষ্টম সংসদ (২০০১) ও নবম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি অনেক নমনীয় হয়েছে এবং তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া অনেক বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে, বিএনপি সরকারের সঙ্গে একটি 'শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে' যেতে চায় এবং যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। বিএনপি নেত্রী ও বিএনপির মুখপাত্রের চারটি বক্তব্য দুটি বড় দলের মাঝে একটি 'বরফগলা'র সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে বলে আমার ধারণা। এক. বেগম জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক নয়, বরং একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে। এর অর্থ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে এখন আর গুরুত্ব দিচ্ছে না। দুই. সৈয়দ আশরাফ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, তিনি দলনিরপেক্ষভাবেই এই মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। বিএনপির মুখপাত্র এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিন. ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে বিএনপি সমর্থন করেছে এবং বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ইস্যুতে তারা সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। চার. বিএনপির পক্ষ থেকে 'স্বাভাবিক রাজনীতি' করার দাবি জানানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন একটা ধর-পাকড়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বিএনপির মুখপাত্র নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করছেন। এখন দেখার পালা বিএনপিকে বড় সমাবেশ করতে সরকার দেয় কি না।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, আগামী দিনের রাজনীতি আবর্তিত হবে বিএনপির আচরণের ওপর। বেগম জিয়া দল পুনর্গঠন করে জানুয়ারির (২০১৬) দিকে নতুন করে আন্দোলনের কথা বলছেন। সরকার যদি বিএনপির সঙ্গে কোনো 'সমঝোতায়' যেতে না পারে, তাহলে সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি থাকবেই বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে। মানুষ সহিংস রাজনীতি পছন্দ করে না। তরুণ প্রজন্ম চায় উন্নয়ন। চায় সামাজিক নিরাপত্তা। চায় তাদের চাকরির গ্যারান্টি। সহিংস রাজনীতি অর্থনীতির চাকাকে আটকে দেয়। প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি আসে। মনে রাখতে হবে, আমাদের ভোটারদের একটা বড় অংশ হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। তাদের কাছে পৌঁছতে হলে নতুন কর্মসূচি নিয়ে বিএনপিকে আসতে হবে।
৩৭ বছরে দাঁড়িয়ে বিএনপি এক কঠিন সময় পার করছে। বিএনপির থিংকট্যাংক কোনো কর্মসূচি তৈরি করতে পারছে না। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁকে ঘিরে একটা দক্ষিণপন্থী গ্রুপ সক্রিয়, যাঁদের কেউই বিএনপির সদস্য নন। তাঁরা তাঁদের স্বার্থেই বিএনপিকে ব্যবহার করতে চান। তাই বিএনপির জন্য এই মুহূর্তে প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক ও সংবিধান অনুযায়ী আন্দোলন করা। সাধারণ মানুষের যে সমস্যা সে ব্যাপারে সক্রিয় হতে হবে দলটিকে। স্থায়ী কমিটি পুনর্গঠন করা জরুরি। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। বিএনপি যদি শুধু পল্টনকেন্দ্রিক হয়ে যায়, তা দলের ইমেজ বৃদ্ধিতে কোনো সাহায্য করবে না। দলীয় নেতাকর্মীদের, যারা এখনো জেলের বাইরে আছে তাদের যেতে হবে তৃণমূল পর্যায়ে। ৩৭ বছরে দাঁড়িয়ে যে দলটিকে নিয়ে সাধারণ মানুষের অনেক প্রত্যাশা, আগামী দিনগুলোতে সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারবে দলটি, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। Daily Kalerkontho 01.09.15

0 comments:

Post a Comment