খবরটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১২২টি দেশের
জন্য জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা পুনর্বহাল হলেও
তাতে বাংলাদেশের নাম নেই। এরই মধ্যে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি উদ্বেগের কারণ
হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি বা ট্রান্সপ্যাসিফিক
পার্টনারশিপ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে
বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে পারবে। এর অর্থ
পরিষ্কার-যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের যে চাহিদা রয়েছে,
তা এখন দখল করে নেবে ভিয়েতনাম। আর তখন বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে
যাবে। এমনিতেই বাংলাদেশি তৈরি পোশাকশিল্প প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা
ধসের পর থেকেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রে একটি
নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন ও সেই
সঙ্গে বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন অত্যন্ত শক্ত অবস্থানে গিয়েছিল, যা কি না
জিএসপি সুবিধা বাতিলের ব্যাপারে একটা 'ভূমিকা' রেখেছিল। যদিও এটা সত্য,
প্রায় ১৬ শতাংশ (১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ) শুল্ক পরিশোধ করেই আমরা যুক্তরাষ্ট্রে
তৈরি পোশাকের বাজার সৃষ্টি করেছি। এখন টিপিপি চুক্তির ফলে ভিয়েতনাম
শুল্কমুক্তভাবে তাদের তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাবে। ফলে
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। ইতিমধ্যেই চীনের পর ভিয়েতনাম হচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বড় রপ্তানিকারক। এখানে একটা
কথা বলা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন ধরেই প্যাসিফিক অঞ্চলভুক্ত ১১টি
দেশের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে আসছিল। এই দেশগুলো
হচ্ছে-অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো,
নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। এ আলোচনা এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে
এবং যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। তবে এই
টিপিপির বিরুদ্ধে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই একটি বড় বিরোধিতা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে এই ১২টি দেশ বিশ্বের ৪০ শতাংশ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক।
অভিযোগ আছে, বড় বড় করপোরেট হাউসগুলো এই চুক্তি থেকে লাভবান হবে। এতে
যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট হাউসগুলো ব্যাপক সম্প্রসারিত হবে। বিশেষ করে গ্যাট
চুক্তিতে TRIP বা Trade Related Intellectual Property Rights-এর আওতায়
উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশ (বাংলাদেশসহ) নিজস্ব 'প্যাটেন্ট' আইনের আওতায় উন্নত
বিশ্বের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছিল। টিপিপিতে 'বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধা'
অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখন বহুজাতিক কম্পানিগুলোর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থের
বিনিময়ে উন্নত প্রযুক্তি খরিদ করতে হবে। কৃষি খাত ও ওষুধ শিল্প এতে করে
ক্ষতিগ্রস্ত হবে। টিপিপি চুক্তিতে এমন কথাও বলা আছে যে বহুজাতিক
কম্পানিগুলো টিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত যেকোনো জাতীয় সরকারের বিরুদ্ধে
Investors- state dispute settlement (ISDS)-এর আওতায় মামলাও করতে পারবে।
বলা আছে, সরকারগুলো এমন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে না, যাতে টিপিপির মূল
স্পিরিটকে আঘাত করে। টিপিপি মূলত একটি 'ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট' হলেও
মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কর্তৃত্ব ও প্রভাব এতে স্বীকৃত।
যুক্তরাষ্ট্রের এই করপোরেট স্বার্থই এখানে বড়। এমনকি টিপিপি চুক্তির
‘legislative certification’-এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ওই সব দেশের আইনও বদল
করতে পারবে। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই এই চুক্তি নিয়ে বিতর্ক ছিল। চিলির মতো দেশও
আপত্তি জানিয়ে আসছিল। এই ১২টি দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা (যাঁদের
মধ্যে সংসদ সদস্যও আছেন) একটি খোলা চিঠিতে এই চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন।
অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন যে এ চুক্তিটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিরও পরিপন্থী।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তথাকথিত 'মুক্ত বাণিজ্য' আর পণ্যের শুল্কমুক্ত
প্রবেশাধিকারের 'লোভে' ভিয়েতনামের মতো দেশও এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
ছূড়ান্ত বিচারে এ চুক্তির টার্গেট হচ্ছে বিশ্ববাজারে তথা যুক্তরাষ্ট্রে
চীনের 'বাণিজ্যিক আধিপত্য' কমানো। ভিয়েতনাম তখন নিজের স্বার্থেই এই চুক্তি
স্বাক্ষর করল। পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাকে ভিয়েতনামের রপ্তানি বাড়ছে ১২
থেকে ১৩ শতাংশ হারে। টিপিপির ফলে এটা আরো বাড়বে। ২০১৫ সালেই ভিয়েতনামের
পোশাক রপ্তানি খাতে ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ভিয়েতনাম ২০২০ সালের মধ্যে
যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিক রপ্তানি ৫০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে
চায়। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া আট হাজার ১৭৮ কোটি
ডলারের মধ্যে চীনের দুই হাজার ৯৭৯ কোটি ডলার। তার পরের অবস্থানই
ভিয়েতনামের, ৯২৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া রয়েছে যৌথভাবে তৃতীয়
অবস্থানে। চতুর্থ ও পঞ্চম যথাক্রমে মেক্সিকো ও ভারত। দেশ দুটির রপ্তানি
যথাক্রমে ৩৭৩ ও ৩৪০ কোটি ডলার। বিজিএমইর দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৪ সালে
(জানুয়ারি-ডিসেম্বর) বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক
রপ্তানি করে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি
(যুক্তরাষ্ট্রে) কমেছে ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আমাদের শঙ্কার কারণটা এখানেই।
এমনিতেই যখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হলো না, তখন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের
সঙ্গে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর করল। এ ক্ষেত্রে টিপিপির ফলে আমাদের তৈরি
পোশাক খাত যে ঝুঁকির মুখে আছে, তা আমরা কিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারব, তা নিয়ে
চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।
জিএসপি সুবিধা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার শর্ত কার্যকর করতে রাজি হয়েছিল। এতে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে অনুন্নত বিশ্ব পশ্চিমা উন্নত দেশে তাদের পণ্যের আওতা বাড়াতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল, পণ্যের মান ও উৎস নির্ধারণ নিয়ে। এই দুটো বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে। হংকং সম্মেলনের দীর্ঘ আট বছর পর ৩-৭ ডিসেম্বর ২০১৩ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সর্বশেষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক)। বালি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বটে; কিন্তু 'বালি ঘোষণায়' কোন পক্ষ কী পেল কিংবা বাণিজ্য বৈষ্যমের শিকার অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের প্রশ্নে এ প্রশ্নগুলোই আবারও উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকে কোনো জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তার পরও অন্যান্য পণ্যে যতটুকু সুবিধা পেত বাংলাদেশ, তাও ২০১৩ সালের জুন থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে। জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র মূলত তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এক. শ্রমমান, দুই. শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের পুনঃ তদন্ত ও বিচার। তিন. ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। ঢাকায় টিকফার প্রথম বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র আকার-ইঙ্গিতে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ 'রুলস অব অরিজিন'-এর কঠিন শর্তে আটকে আছে। ধনী দেশগুলো এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৬১.৩ শতাংশ জিএসপি সুবিধার আওতায়। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশ সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে বাংলাদেশ। বলা ভালো, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৭৮ শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এই তৈরি পোশাকের ৬০ শতাংশ যায় ইউরোপে, আর ২৫ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাক আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত নানা 'প্রশ্ন'-এর ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে পারেনি। দরকষাকষিতে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। আমলানির্ভর আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমলারা 'বিদেশ সফর', 'সম্মেলনে অংশগ্রহণ' ইত্যাদিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। এখানে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিজিএমইএ-তারাও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাদের গবেষণা 'সেল'ও শক্তিশালী নয়। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সঙ্গে 'রুলস অব অরিজিন', 'এন্টি ডাম্পিং ও কাউন্টারভেইলিং ব্যবস্থা', 'প্রেফারেন্স ইরোসন', শ্রমমান ইত্যাদি নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন জড়িত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায়ও আমরা এসব প্রশ্নে শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।
২৮ এপ্রিল ২০১৪ ঢাকায় টিকফার প্রথম বৈঠক শেষ হয়েছিল। এতে আমাদের প্রাপ্তি কী ছিল? আমাদের প্রাপ্তির খাতাটা ছিল 'শূন্য'। জিএসপি সুবিধার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো 'কমিটমেন্ট' ছিল না। যদিও তখন বলা হয়েছিল, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে সমস্যার সমাধান করাই টিকফার লক্ষ্য। এটা একটা 'কূটনৈতিক জবাব'। যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা চুক্তির ১৬ অনুচ্ছেদের সবগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। কিন্তু যে প্রশ্নগুলো বিভিন্ন মহলে ইতিমধ্যে উঠেছে, তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব আমরা পাইনি। টিকফা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স সুবিধা দেবে। তাতে আমরা কতটুকু সুবিধা পাব? যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোকে আর্থিক নিরাপত্তা দেবে বাংলাদেশ। তাতে আমাদের স্বার্থ কতটুকু অর্জিত হবে? যুক্তরাষ্ট্র টেলিকমিউনিকেশন, জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ করবে। এতে এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। তাতে কী সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? সেবা খাত কী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জ্বালানি খাত ঝুঁকির মুখে থাকবে। বিশ্বের ৮৭টি দেশে আমরা ওষুধ সরবরাহ করি। এটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জিএসও ফুড নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বিতর্ক আছে। বহুজাতিক কম্পানিগুলো বাংলাদেশে জিএসও ফুডের বাজার সৃষ্টি করতে পারে, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। টিপিপি চুক্তি বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, তার কোনো সুষ্ঠু গবেষণা এখনো হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন, আমি নিশ্চিত নই। এখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল না হওয়ায় টিপিপি চুক্তিটিও আমাদের জন্য কোনো 'বিষফোড়া' হিসেবে সৃষ্টি হয় কি না, সেটাই দেখার বিষয়। জিএসপি পুনর্বহাল না হওয়ায় বাণিজ্যমন্ত্রী এটাকে 'রাজনৈতিক কারণ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক কারণ জড়িত নয়। বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা পেশ করেছিল, তার সবই বাস্তবায়ন হয়েছে-এটা বলা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভালো। এখন আমাদের টিপিপি নিয়েও সিরিয়াসলি ভাবতে কবে। বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও তাঁর কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু বরফ গলেনি। তৈরি পোশাকের জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক তথা আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা তাই জরুরি। Daily Kalerkontho 19.08.15
জিএসপি সুবিধা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার শর্ত কার্যকর করতে রাজি হয়েছিল। এতে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে অনুন্নত বিশ্ব পশ্চিমা উন্নত দেশে তাদের পণ্যের আওতা বাড়াতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল, পণ্যের মান ও উৎস নির্ধারণ নিয়ে। এই দুটো বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে। হংকং সম্মেলনের দীর্ঘ আট বছর পর ৩-৭ ডিসেম্বর ২০১৩ ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সর্বশেষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক)। বালি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বটে; কিন্তু 'বালি ঘোষণায়' কোন পক্ষ কী পেল কিংবা বাণিজ্য বৈষ্যমের শিকার অনুন্নত দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের প্রশ্নে এ প্রশ্নগুলোই আবারও উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকে কোনো জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তার পরও অন্যান্য পণ্যে যতটুকু সুবিধা পেত বাংলাদেশ, তাও ২০১৩ সালের জুন থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে। জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র মূলত তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এক. শ্রমমান, দুই. শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের পুনঃ তদন্ত ও বিচার। তিন. ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। ঢাকায় টিকফার প্রথম বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র আকার-ইঙ্গিতে এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ 'রুলস অব অরিজিন'-এর কঠিন শর্তে আটকে আছে। ধনী দেশগুলো এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৬১.৩ শতাংশ জিএসপি সুবিধার আওতায়। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশ সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে বাংলাদেশ। বলা ভালো, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৭৮ শতাংশ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এই তৈরি পোশাকের ৬০ শতাংশ যায় ইউরোপে, আর ২৫ শতাংশ যায় যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাক আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত নানা 'প্রশ্ন'-এর ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে পারেনি। দরকষাকষিতে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। আমলানির্ভর আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমলারা 'বিদেশ সফর', 'সম্মেলনে অংশগ্রহণ' ইত্যাদিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। এখানে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিজিএমইএ-তারাও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাদের গবেষণা 'সেল'ও শক্তিশালী নয়। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সঙ্গে 'রুলস অব অরিজিন', 'এন্টি ডাম্পিং ও কাউন্টারভেইলিং ব্যবস্থা', 'প্রেফারেন্স ইরোসন', শ্রমমান ইত্যাদি নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন জড়িত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায়ও আমরা এসব প্রশ্নে শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।
২৮ এপ্রিল ২০১৪ ঢাকায় টিকফার প্রথম বৈঠক শেষ হয়েছিল। এতে আমাদের প্রাপ্তি কী ছিল? আমাদের প্রাপ্তির খাতাটা ছিল 'শূন্য'। জিএসপি সুবিধার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো 'কমিটমেন্ট' ছিল না। যদিও তখন বলা হয়েছিল, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে সমস্যার সমাধান করাই টিকফার লক্ষ্য। এটা একটা 'কূটনৈতিক জবাব'। যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা চুক্তির ১৬ অনুচ্ছেদের সবগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। কিন্তু যে প্রশ্নগুলো বিভিন্ন মহলে ইতিমধ্যে উঠেছে, তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব আমরা পাইনি। টিকফা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স সুবিধা দেবে। তাতে আমরা কতটুকু সুবিধা পাব? যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোকে আর্থিক নিরাপত্তা দেবে বাংলাদেশ। তাতে আমাদের স্বার্থ কতটুকু অর্জিত হবে? যুক্তরাষ্ট্র টেলিকমিউনিকেশন, জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ করবে। এতে এসব খাতে সরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে। তাতে কী সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? সেবা খাত কী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জ্বালানি খাত ঝুঁকির মুখে থাকবে। বিশ্বের ৮৭টি দেশে আমরা ওষুধ সরবরাহ করি। এটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জিএসও ফুড নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বিতর্ক আছে। বহুজাতিক কম্পানিগুলো বাংলাদেশে জিএসও ফুডের বাজার সৃষ্টি করতে পারে, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। টিপিপি চুক্তি বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, তার কোনো সুষ্ঠু গবেষণা এখনো হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন, আমি নিশ্চিত নই। এখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল না হওয়ায় টিপিপি চুক্তিটিও আমাদের জন্য কোনো 'বিষফোড়া' হিসেবে সৃষ্টি হয় কি না, সেটাই দেখার বিষয়। জিএসপি পুনর্বহাল না হওয়ায় বাণিজ্যমন্ত্রী এটাকে 'রাজনৈতিক কারণ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক কারণ জড়িত নয়। বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা পেশ করেছিল, তার সবই বাস্তবায়ন হয়েছে-এটা বলা যাবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভালো। এখন আমাদের টিপিপি নিয়েও সিরিয়াসলি ভাবতে কবে। বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াশিংটন সফর করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও তাঁর কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু বরফ গলেনি। তৈরি পোশাকের জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক তথা আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা তাই জরুরি। Daily Kalerkontho 19.08.15
0 comments:
Post a Comment