- মাহিন্দ রাজাপক্ষে দীর্ঘ নয় বছর ছিলেন শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট। ২০০৫
থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। সংবিধান সংশোধন করে আরও একবার প্রেসিডেন্ট হতে
চেয়েছিলেন। কিন্তু জানুয়ারির (২০১৫) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি হেরে যান
একসময় তারই সহকর্র্মী, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও নিজ দল শ্রীলংকা ফ্রিডম
পার্টির সাধারণ সম্পাদক মিথ্রিলা সিরিসেনার কাছে। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে
দেননি। ১৭ আগস্ট সংসদ নির্বাচনে তিনি দলগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
কিন্তু নির্বাচনী ফলে দেখা গেছেÑ প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের
নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে
বিজয়ী হয়েছে (২২৫ আসনবিশিষ্ট সংসদে ১০৬ আসন)। কিন্তু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা
পায়নি। অন্যদিকে রাজাপক্ষের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ফ্রিডম অ্যালায়েন্স
(ইউপিএফএ) পেয়েছে ৯৪ আসন। তামিলরা পেয়েছে ১৬ আসন। এখন প্রধানমন্ত্রী রনিল
বিক্রমাসিংহকে ছোট দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠন করতে হবে। রাজাপক্ষের
প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়নি বটে, কিন্তু তিনি যে শ্রীলংকার
রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে থেকে যাবেন, তা বলার আর
অপেক্ষা রাখে না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
প্রাক্কালে সিরিসেনা ওই সময় বিরোধী দল ইউএনপির সমর্থন পান। প্রধানমন্ত্রী
বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে
সিরিসেনাকে সমর্থন করেন। বিনিময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ধারণা করা হয়,
ভারতের একটি ‘মহল’ রাজাপক্ষের নিশ্চিত বিজয় ঠেকাতেই জানুয়ারিতে সিরিসেনাকে
সমর্থন করতে ইউএনপি নেতৃবৃন্দকে ‘চাপ’ দেয়। সিরিসেনা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব
গ্রহণ করে তার প্রথম বিদেশ সফরে নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন। তাই বোঝাই যায় তিনি
সরকার পরিচালনায় বেশি মাত্রায় ভারতের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক
সম্পর্কের ছাত্ররা ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। ২০০৭
সালের পর থেকে শ্রীলংকা, চিন, ইরান ও রাশিয়ার সমন্বয়ে এ অঞ্চলে যে ‘ঐক্য’
গড়ে উঠেছিল এবং যা প্রিমাকভ ডকট্রিন (চৎরসধশড়া উড়পঃৎরহব) হিসেবে পরিচিত, তা
একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থকে আঘাত করেছিল। চিনের এ অঞ্চল
ঘিরে যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি তা ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্বকে নিশ্চিত করার
লক্ষ্যেই প্রণীত। ভারত মহাসাগরে চিনের শক্তি বৃদ্ধিকে ভারত তার নিরাপত্তার
প্রতি হুমকিস্বরূপ হিসেবেও মনে করছে। ফলে শ্রীলংকায় একটা পরিবর্তন অত্যন্ত
প্রয়োজন ছিল। মনে রাখতে হবে চিন একদিকে বেলুচিস্তানের গাওদার বন্দর তৈরি
করে দিয়েছিল, অন্যদিকে শ্রীলংকার হামবানতোতায়ও একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি
করে দিয়েছে। ফলে ভারত এটা খুব সহজভাবে মেনে নেয়নি। অভিযোগ আছেÑ ভারতের
গোয়েন্দা সংস্থা শ্রীলংকায় সরকার পরিবর্তনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। কেননা
হামবানতোতায় চিনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারতের সমর-নায়করা ভারতের নিরাপত্তার
জন্য হুমকি বলে মনে করেছিলেন। এ জন্যই দলে ভাঙন সৃষ্টি করে সিরিসেনাকেই
রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড় করা হয় এবং রাজাপক্ষে ওই সময় হেরে যান। এর পর-পরই
সিরিসেনা নয়াদিল্লি যান। আর নরেন্দ্র মোদি শ্রীলংকা সফর করেন গত মে মাসে,
বাংলাদেশে আসার আগে।
এখন সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলো। নির্বাচন
প্রাক্কালে ধারণা করা হয়েছিল, রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার অতিমাত্রায়
ভারতমুখিতাকে ব্যবহার করে ব্যাপক ভোট পাবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা
গেল তা হলো না। শ্রীলংকায় জাতীয়তাবাদী চেতনা অত্যন্ত শক্তিশালী। ভারত তাদের
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাক, এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি নাগরিকরা কখনোই
ভালো চোখে দেখেনি। অতীত ইতিহাসও ভারতের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। অনেকেই
জানেন, তামিল বিদ্রোহীদের হাতে সেখানে মারা গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট
প্রেমাদাসা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ললিত আথুলাথাদালি, গামিনি দেশনায়েকে এবং
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে তামিলদের
অভিযোগ ছিল যে, শ্রীলংকার শাসকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তিনি শ্রীলংকার
তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলংকার সঙ্গে
ভারতের একটি চুক্তির বিনিময়ে তামিল বিদ্রোহ দমন করতে ভারতীয় সৈন্য তামিল
অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করেছিল। ফলাফলটা অনেকেই স্মরণ করতে পারবেনÑ ১ হাজার
২০০ ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিল সেখানে। বাধ্য হয়ে ভারত ১৯৯০ সালে শ্রীলংকা
থেকে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই,
১৯৮৭ সালে ভারত-শ্রীলংকা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন রাজীব গান্ধী ও
শ্রীংলকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস জয়াবর্ধনে। কিন্তু তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রী প্রেমাদাসা এর বিরোধিতা করেছিলেন। এই বিরোধিতা সামনে রেখেইে
প্রেমাদাসা ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং
বিজয়ী হন। আজ শ্রীলংকার রাজনীতিতে সেই ‘দৃশ্যপট’ লক্ষণীয়। ভারতীয় প্রভাব
সেখানে বাড়ছে। সিরিসেনা সেই ‘ভারতীয় স্বার্থ’কেই প্রতিনিধিত্ব করছেন!
নির্বাচনের আগে তিনি একাধিকবার ‘চিনবিরোধী’ বক্তব্য রেখেছিলেন। এমনকি
প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, চিনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১ হাজার ৫০০
কোটি ডলারের চুক্তি তিনি বাতিল করবেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে সত্যি সত্যিই তা
করেছেন। ভারতের মোদি সরকারের সঙ্গে এখন অনেক ব্যবসায়ীশ্রেণি ভিড় করেছে। গত
১১-১৩ জানুয়ারি (২০১৫) গুজরাটে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ভাইব্রাই গুজরাট’
সম্মেলন। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি যোগ
দিয়েছিলেন। ফলে মোদি সরকারকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেই ব্যবসায়ীশ্রেণি
(যেমন আদানি গ্রুপ) চাইবে মোদি সরকারকে ব্যবহার করে ভারতের বাইরে তাদের
ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে। শ্রীলংকায় দ্বন্দ্বটা এভাবেই তৈরি হতে পারে! ভুলে
গেলে চলবে না শ্রীলংকার ব্যাপারে চিনের শুধু যে ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে
তা নয়, বরং চিন যে ‘ম্যারিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথা বলেছে, শ্রীলংকা তার অংশ।
বাংলাদেশের কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে
চেয়েছিল চিন। সেটা এখন আর হচ্ছে না।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে
রাজাপক্ষের কিছু ভুলের কারণে শ্রীলংকার জনগণ তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে
নিয়েছিল। শ্রীলংকার স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত তিনি অনেক সিদ্ধান্ত নিলেও
তা তার নিজের ও দলের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেননি। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ তার
ওপর একশ ভাগ সন্তুষ্ট ছিল না। শ্রীলংকায় চিনের অর্থে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটলেও
ভারতকে ‘উপেক্ষা’ করা এবং তামিল-মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া, তার
পতনকে ত্বরান্বিত করে। উপরন্তু ছিল পারিবারিক দুর্নীতি ও ক্ষমতা করায়ত্ত
করার প্রচেষ্টা। এটা ছিল তার জন্য একটা শিক্ষা। নিশ্চয়ই সিরিসেনা এটা থেকে
শিখবেন। তিনি পারিবারিককরণের কোনো উদ্যোগ নিশ্চয়ই নেবেন না।
এখন
শ্রীলংকার ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে এবং নির্বাচনে
বিজয়ী হলেও রনিল বিক্রমাসিংহে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবেন না। সংসদে
সরকার গঠন করার জন্য ১১৩ জন সদস্য তার দলে নেই। তামিলরা ১৬টি আসন পেয়ে
সংসদে একটি শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে আবির্র্ভূত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জন্য
এখন সম্ভাবনা দুটি। তামিলদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা অথবা রাজাপক্ষের
দলের সমর্থন নিয়ে একটা ঐকমত্যের সরকার গঠন করা। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর
একটি বক্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর-পরই তিনি বলেছেন,
সবাইকে সঙ্গে নিয়ে জাতি গঠনে তিনি কাজ করতে চান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,
শ্রীলংকার ফ্রিডম পার্টি তার সরকারে যোগ দেবে কি না? দুই. মোট ২২টি জেলার
মধ্যে তামিলদের জন্য নির্ধারিত তিনটি জেলার সব কয়টি আসনে তামিল সমর্থিত
সংগঠনগুলোর প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এর অর্থ পরিষ্কার শ্রীলংকার মূলধারার
রাজনৈতিক দলগুলো তামিলদের এখনো আস্থায় নিতে পারেনি। তামিলা আরও
স্বায়ত্তশাসন চায়। প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে
তামিলদের স্বায়ত্তশাসনে রাজি হবেন, এটা মনে হয় না। তিন. শ্রীলংকার রাজনীতি
বরাবরই দুটি রাজনৈতিক দলই নিয়ন্ত্রণ করছে। একদিকে ফ্রিডম পার্টি, অন্যদিকে
ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি। ২০১৫ সালের সংসদ নির্বাচনে এই দুই দলের কর্তৃত্ব
আবার প্রমাণিত হলো। এখন দুই দলের মাঝে সমঝোতা ও আস্থার সম্পর্ক শ্রীলংকায়
স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। চার. প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সিরিসেনা
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী বাতিল করবেন। ওই
সংশোধনী বলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল।
প্রতিশ্রুতি দিয়েছেলেন প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারব্যবস্থায় তিনি ফিরে
যাবেন। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে এটা চাইলেও, সংসদে ফ্রিডম পার্টির
বড় উপস্থিতির কারণে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব
নাও হতে পারে। পাঁচ. শ্রীলংকায় ক্রমবর্ধমান চিনা উপস্থিতি ও প্রভাব সেখানে
বড় বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। ইতোমধ্যে চিনা বিনিয়োগ স্থগিত রাখা হয়েছে।
কিন্তু বিনিয়োগের প্রশ্নে ভারত কখনো চিনের বিকল্প হতে পারবে না। ভারতের সেই
ক্ষমতা নেই। সিরিসেনার চিনবিরোধী কথাবার্তা বলার পর খুব সঙ্গত কারণেই
শ্রীলংকা-চিন সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে থাকবে।
এটা ঠিক রাজাপক্ষে শক্ত হাতে
তামিল বিদ্রোহ দমন করলেও আন্তর্জাতিক আসরে শ্রীলংকার ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট
হয়েছে। শ্রীলংকার বিগত সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
তামিল সাধারণ নাগরিকদের (৪০ হাজার) হত্যার অভিযোগ উঠেছিল রাজাপক্ষে সরকারের
বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ একটি তদন্ত দল পাঠাতে চাইলেও তৎকালীন সরকার তার অনুমতি
দেয়নি। এখন নির্বাচিত সরকার কী করে সেটাই দেখার বিষয়। সবকিছু নির্ভর করছে
ভবিষ্যৎ সরকার কেমন হয় তার ওপর। যদি ঐকমত্যের সরকার হয়, তাহলে এটা করা যাবে
না। কিন্তু তামিলরা যদি সরকার গঠন করতে তাদের সমর্থন দেয়, তাহলে সরকার
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যাচাই করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে
পারে। এ ধরনের তদন্ত কমিটি শ্রীলংকার জন্যও ভালো। কেননা শ্রীলংকা ইউরোপীয়
ইউনিয়নের যে জিএসপি সুবিধা পায়, তাও ঝুঁকির মুখে আছে। সুতরাং নয়া সরকারের
দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি।
গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে
সিরিসেনার বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটি পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল। সাত মাস পর
সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির বিজয়ের মধ্য দিয়ে এ
পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত রইল এখন।
Daily Amader Somoy
23.08.15
0 comments:
Post a Comment