রাজনীতিতে কিছুটা 'স্থিতিশীলতা' ফিরে আসায় কোনো কোনো মহল থেকে আবারও
মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। সংবাদপত্রগুলোতেও এ নিয়ে
লেখালেখি দেখছি। যদিও সরকারের নীতিনির্ধারকদের কারো মুখ থেকেই এটা স্পষ্ট
হয়নি যে সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে ইচ্ছুক! গেল ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একটি
নির্বাচন হয়ে গেছে। ওই নির্বাচনে বিএনপিসহ আরো বেশ কয়েকটি দলের অংশগ্রহণ
না থাকায় নির্বাচনটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবেও কোনো গ্রহণযোগ্যতা
পায়নি। এবং দাতাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বারবার 'সব দলের অংশগ্রহণে' একটি
নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। যদিও নির্বাচনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক
সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে বিদেশি দাতাগোষ্ঠী যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করে, তখন তা শুধু দৃষ্টিকটুই নয়; বরং অগ্রহণযোগ্যও।
আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো জাতীয় ইস্যুতেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি এবং এখনো
পারছি না।
মধ্যবর্তী নির্বাচন অসাংবিধানিক নয়। বরং সরকার নতুন করে 'ম্যান্ডেট' নেওয়ার জন্য আগাম নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী আগামী ২০১৯ সালের জানুয়ারির তিন মাস আগে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে সরকার পুনরায় জনগণের 'ম্যান্ডেট' নেওয়ার জন্য মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারে। এটা তো সত্য, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পাঁচ জেলায় আদৌ কোনো ভোট হয়নি, ৫২ শতাংশ ভোটার তাঁদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি কিংবা ১৫ জেলায় মাত্র একটি করে আসনে নির্বাচন হয়েছে। সুতরাং সরকার তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিলেও, তাতে করে কি 'সব দলের অংশগ্রহণ' নিশ্চিত হবে? আরো স্পষ্ট করে বলতে হয়, বিএনপি কি ওই নির্বাচনে অংশ নেবে? বিএনপি এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসেনি। বিকল্প হিসেবে তারা জাতিসংঘের তথা বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে একটি নির্বাচন চায়। কিন্তু এ দাবির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। এটা সত্য, সরকার অত্যন্ত 'কৌশলে' সংবিধান সংশোধন করেছে এবং উচ্চ আদালতের আংশিক রায়কে বিবেচনায় নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। সেই অর্থে এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপিকে এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনরায় চালু করার দাবি অব্যাহত রেখে, আগামী নির্বাচন অথবা মধ্যবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে একটি 'নয়া ফর্মুলা' নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটা সত্য, বিএনপি বড় দল। সংসদীয় রাজনীতিতেও দলটির অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। সুতরাং সংসদীয় রাজনীতিতে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া যে সংসদ কার্যকর হয় না কিংবা গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় না, বর্তমান সংসদ এর বড় প্রমাণ। কোনো জাতীয় ইস্যুতেই বর্তমান সংসদ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। 'নামকাওয়াস্তে' একজন বিরোধীদলীয় নেতা আছেন বটে; কিন্তু তাঁর ভূমিকা সংসদীয় রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে পারেনি। উপরন্তু তাঁর দল (জাতীয় পার্টি) একসঙ্গে বিরোধী দল ও সরকারের অংশ হওয়ায় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তিই শুধু বাড়েনি, বরং বাংলাদেশ এমন এক 'ব্যবস্থার' জন্ম দিয়েছে, যা বিশ্বের সংসদীয় রাজনীতিতে বিরল একটি ঘটনা। এ 'ঘটনা' জাতীয় পার্টিকে পুনরায় ভাঙন অথবা অস্তিত্বহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমার ধারণা, একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বর্তমান কাঠামো নিয়ে টিকে থাকবে না। একটি অংশ আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যাওয়া কিংবা আরেকটি জাতীয় পার্টির জন্ম নেওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এক সময় বিএনপির বিকল্প হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ভাবা হতো। এখন সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সুতরাং সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচনের সিদ্ধান্ত তখনই নেবে, যখন বিএনপি অথবা বিএনপির একটি বড় অংশ এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখাবে। প্রশ্ন এখানেই। তাহলে কি সরকার বিএনপিকে ভাঙার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে? বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত। কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়া এবং বেশ কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রীর এ ব্যাপারে মন্তব্য করা এই প্রশ্নটাকেই সামনে নিয়ে এলো যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের মধ্যে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ের অনেকেই এখন নিষ্ক্রিয়। অনেকেই জেলে আছেন, অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা আছে। আর যাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, এই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার- মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের 'ব্যস্ত' রাখতে চায় সরকার, যাতে করে তাঁরা 'আন্দোলনে' নিজেদের জড়িত করতে না পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নি- এত বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা! ফলে এসব নেতা-কর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারবেন না। খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসংক্রান্ত ধারা) বিচার কিংবা জিয়া চেরিটেবল ট্রাস্ট মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ড্যান্ডি ডায়িং মামলায় তারেক রহমানকে 'শাস্তি' দিয়ে তাঁকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে 'অযোগ্য ঘোষণা'(?) বিএনপি খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্ন হবে তখন অবান্তর। খালেদা জিয়াই বিএনপির মূল শক্তি। খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ না নেন, বিএনপির 'বিকল্প নেতৃত্ব' নির্বাচনে অংশ নেবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপি সংগঠিত হবে- এটাও আমার মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো কার্যকর 'ফল' দেবে না। 'আসল বিএনপি' কিংবা নাজমুল হুদার 'বেহুদা কথাবার্তায়' মানুষ খুব আস্থাশীল- এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি এখন অস্তিত্বহীনতার মুখে। ফলে সরকারের কাছে এখন বিকল্প পথ দুটি। এক. বিএনপিকে যেকোনোভাবে আস্থায় নিয়ে ২০১৬ সালের শেষের দিকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া। দুই. অথবা সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। যেকোনো সময়ের চেয়ে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। সরকার ওপরে উল্লিখিত যেকোনো একটি সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারে। তবে প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হবে। প্রথম ক্ষেত্রে সরকারকে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। বিএনপি যতই 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' কিংবা 'জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচনের' কথা বলুক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে কিছুটা নমনীয় হতে হবে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা না করলে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে না। আর আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা যাবে না। এখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে হলে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করাটা জরুরি। এটাকে ভিত্তি করে সংলাপ শুরু করা যেতে পারে এবং আমার ধারণা, এতে করে একটা পথ বের হওয়া সম্ভব। বিএনপির একটা ফর্মুলা বা প্রস্তাব উপস্থাপন করাও জরুরি, যাতে বর্তমান সংবিধানকে মেনেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে 'সব দলের অংশগ্রহণ' সম্ভব। এখানে বলা ভালো, 'সব পক্ষ' যদি রাজি না হয়, সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কোনো দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয় না। নেপাল, নামিবিয়া কিংবা কম্পুচিয়ায় জাতিসংঘ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। সেটা সম্ভব হয়েছিল সব বিবদমান গ্রুপের সম্মতির ভিত্তিতে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে বিভক্তি স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে কিভাবে বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আনা যায়, এটা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। খালেদা জিয়াকে 'মাইনাস' করে কোনো সমাধান খুঁজলে তা কোনো সমাধান দেবে না। বরং এতে করে আরো জটিলতা বাড়বে। একাধিক কারণে বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য জরুরি। প্রথমত, বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে, যেখানে ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত দেড় বছরের সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারছে না। ফলে সংসদকে আরো গ্রহণযোগ্য, আরো অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারে। তৃতীয়ত, বিএনপি সংসদে না থাকলেও, বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূল ধারার রাজনীতিতেই দেখতে চায়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থানও অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। চতুর্থত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। এই দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে, এই দুটি দলের একটি বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জমানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ না নেওয়ার কারণে। এ দুই দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই পঞ্চম সংসদ (১৯৯১), সপ্তম সংসদ (১৯৯৬), অষ্টম সংসদ (২০০১) ও নবম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে একাদশ সংসদ নির্বাচনেও, যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়। তাই সিদ্ধান্তটি এখন নিতে হবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন সব প্রশ্নের কোনো জবাব দেবে না। আস্থার সম্পর্ক যদি গড়ে না ওঠে, যদি 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস' তৈরি না হয়, তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়েও কোনো লাভ নেই। নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তাই বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চাকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে- আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এই উপলব্ধি বা বোধটুকু যদি না আসে তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়েও তাতে কোনো ফল আসবে না। মধ্যবর্তী নির্বাচন হোক; কিন্তু তাতে যেন 'সব দলের অংশগ্রহণ' থাকে। Daily Kalerkontho 04.08.15
মধ্যবর্তী নির্বাচন অসাংবিধানিক নয়। বরং সরকার নতুন করে 'ম্যান্ডেট' নেওয়ার জন্য আগাম নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী আগামী ২০১৯ সালের জানুয়ারির তিন মাস আগে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে সরকার পুনরায় জনগণের 'ম্যান্ডেট' নেওয়ার জন্য মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারে। এটা তো সত্য, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পাঁচ জেলায় আদৌ কোনো ভোট হয়নি, ৫২ শতাংশ ভোটার তাঁদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি কিংবা ১৫ জেলায় মাত্র একটি করে আসনে নির্বাচন হয়েছে। সুতরাং সরকার তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিলেও, তাতে করে কি 'সব দলের অংশগ্রহণ' নিশ্চিত হবে? আরো স্পষ্ট করে বলতে হয়, বিএনপি কি ওই নির্বাচনে অংশ নেবে? বিএনপি এখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে আসেনি। বিকল্প হিসেবে তারা জাতিসংঘের তথা বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে একটি নির্বাচন চায়। কিন্তু এ দাবির কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। এটা সত্য, সরকার অত্যন্ত 'কৌশলে' সংবিধান সংশোধন করেছে এবং উচ্চ আদালতের আংশিক রায়কে বিবেচনায় নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। সেই অর্থে এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপিকে এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনরায় চালু করার দাবি অব্যাহত রেখে, আগামী নির্বাচন অথবা মধ্যবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে একটি 'নয়া ফর্মুলা' নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এটা সত্য, বিএনপি বড় দল। সংসদীয় রাজনীতিতেও দলটির অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। সুতরাং সংসদীয় রাজনীতিতে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া যে সংসদ কার্যকর হয় না কিংবা গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় না, বর্তমান সংসদ এর বড় প্রমাণ। কোনো জাতীয় ইস্যুতেই বর্তমান সংসদ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। 'নামকাওয়াস্তে' একজন বিরোধীদলীয় নেতা আছেন বটে; কিন্তু তাঁর ভূমিকা সংসদীয় রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে পারেনি। উপরন্তু তাঁর দল (জাতীয় পার্টি) একসঙ্গে বিরোধী দল ও সরকারের অংশ হওয়ায় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তিই শুধু বাড়েনি, বরং বাংলাদেশ এমন এক 'ব্যবস্থার' জন্ম দিয়েছে, যা বিশ্বের সংসদীয় রাজনীতিতে বিরল একটি ঘটনা। এ 'ঘটনা' জাতীয় পার্টিকে পুনরায় ভাঙন অথবা অস্তিত্বহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমার ধারণা, একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বর্তমান কাঠামো নিয়ে টিকে থাকবে না। একটি অংশ আওয়ামী লীগে বিলীন হয়ে যাওয়া কিংবা আরেকটি জাতীয় পার্টির জন্ম নেওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এক সময় বিএনপির বিকল্প হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ভাবা হতো। এখন সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সুতরাং সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচনের সিদ্ধান্ত তখনই নেবে, যখন বিএনপি অথবা বিএনপির একটি বড় অংশ এই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখাবে। প্রশ্ন এখানেই। তাহলে কি সরকার বিএনপিকে ভাঙার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে? বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত। কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়া এবং বেশ কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রীর এ ব্যাপারে মন্তব্য করা এই প্রশ্নটাকেই সামনে নিয়ে এলো যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের মধ্যে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ের অনেকেই এখন নিষ্ক্রিয়। অনেকেই জেলে আছেন, অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা আছে। আর যাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন, এই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার- মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের 'ব্যস্ত' রাখতে চায় সরকার, যাতে করে তাঁরা 'আন্দোলনে' নিজেদের জড়িত করতে না পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নি- এত বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা! ফলে এসব নেতা-কর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারবেন না। খালেদা জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসংক্রান্ত ধারা) বিচার কিংবা জিয়া চেরিটেবল ট্রাস্ট মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ড্যান্ডি ডায়িং মামলায় তারেক রহমানকে 'শাস্তি' দিয়ে তাঁকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে 'অযোগ্য ঘোষণা'(?) বিএনপি খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্ন হবে তখন অবান্তর। খালেদা জিয়াই বিএনপির মূল শক্তি। খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ না নেন, বিএনপির 'বিকল্প নেতৃত্ব' নির্বাচনে অংশ নেবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপি সংগঠিত হবে- এটাও আমার মনে হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি 'মাইনাস ওয়ান' ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো কার্যকর 'ফল' দেবে না। 'আসল বিএনপি' কিংবা নাজমুল হুদার 'বেহুদা কথাবার্তায়' মানুষ খুব আস্থাশীল- এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি এখন অস্তিত্বহীনতার মুখে। ফলে সরকারের কাছে এখন বিকল্প পথ দুটি। এক. বিএনপিকে যেকোনোভাবে আস্থায় নিয়ে ২০১৬ সালের শেষের দিকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া। দুই. অথবা সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। যেকোনো সময়ের চেয়ে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। সরকার ওপরে উল্লিখিত যেকোনো একটি সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারে। তবে প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হবে। প্রথম ক্ষেত্রে সরকারকে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। বিএনপি যতই 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' কিংবা 'জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচনের' কথা বলুক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে কিছুটা নমনীয় হতে হবে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা না করলে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে না। আর আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা যাবে না। এখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে হলে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করাটা জরুরি। এটাকে ভিত্তি করে সংলাপ শুরু করা যেতে পারে এবং আমার ধারণা, এতে করে একটা পথ বের হওয়া সম্ভব। বিএনপির একটা ফর্মুলা বা প্রস্তাব উপস্থাপন করাও জরুরি, যাতে বর্তমান সংবিধানকে মেনেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে 'সব দলের অংশগ্রহণ' সম্ভব। এখানে বলা ভালো, 'সব পক্ষ' যদি রাজি না হয়, সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কোনো দেশে নির্বাচন সম্পন্ন করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয় না। নেপাল, নামিবিয়া কিংবা কম্পুচিয়ায় জাতিসংঘ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। সেটা সম্ভব হয়েছিল সব বিবদমান গ্রুপের সম্মতির ভিত্তিতে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে বিভক্তি স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে কিভাবে বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আনা যায়, এটা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। খালেদা জিয়াকে 'মাইনাস' করে কোনো সমাধান খুঁজলে তা কোনো সমাধান দেবে না। বরং এতে করে আরো জটিলতা বাড়বে। একাধিক কারণে বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য জরুরি। প্রথমত, বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে, যেখানে ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত দেড় বছরের সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারছে না। ফলে সংসদকে আরো গ্রহণযোগ্য, আরো অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারে। তৃতীয়ত, বিএনপি সংসদে না থাকলেও, বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূল ধারার রাজনীতিতেই দেখতে চায়। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের অবস্থানও অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। চতুর্থত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। এই দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে, এই দুটি দলের একটি বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জমানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ না নেওয়ার কারণে। এ দুই দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই পঞ্চম সংসদ (১৯৯১), সপ্তম সংসদ (১৯৯৬), অষ্টম সংসদ (২০০১) ও নবম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে একাদশ সংসদ নির্বাচনেও, যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়। তাই সিদ্ধান্তটি এখন নিতে হবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন সব প্রশ্নের কোনো জবাব দেবে না। আস্থার সম্পর্ক যদি গড়ে না ওঠে, যদি 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস' তৈরি না হয়, তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়েও কোনো লাভ নেই। নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তাই বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চাকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে- আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এই উপলব্ধি বা বোধটুকু যদি না আসে তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়েও তাতে কোনো ফল আসবে না। মধ্যবর্তী নির্বাচন হোক; কিন্তু তাতে যেন 'সব দলের অংশগ্রহণ' থাকে। Daily Kalerkontho 04.08.15
0 comments:
Post a Comment