রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শ্রীলঙ্কার রাজনীতি ও রাজাপাকসের প্রত্যাবর্তন

আজ ১৭ আগস্ট শ্রীলঙ্কার সংসদ নির্বাচন। যদিও শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান, তারপরও এ নির্বাচনকে ঘিরে সারা শ্রীলঙ্কা তথা দক্ষিণ এশিয়ায় একটি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেখানে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে হেরে যান। সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজাপাকসে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে চাচ্ছেন। তিনি হতে চান প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনের আগে বিবিসি’র সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রাজাপাকসে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। শ্রীলঙ্কায় সংসদের আসন সংখ্যা ২২৫। দু’টি মিত্র জোট এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহের ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি নেতৃত্বাধীন একটি জোট, অন্যদিকে রাজাপাকসের শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ফ্রিডম অ্যালায়েন্স। জানুয়ারির (২০১৫) নির্বাচনে বিজয়ী মিথ্রিপালা সিরিসেনা একসময় রাজাপাকসের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সিরিসেনা রাজাপাকসেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত করেন। অথচ রাজাপাকসে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সিরিসেনা রাজাপাকসের সমর্থন করেছিলেন। উপরন্তু তিনি রাজাপাকসের দল শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এক্ষেত্রে বিশেষ মহলের পরামর্শে সিরিসেনা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। মজার ব্যাপার, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির প্রার্থী রনিল বিক্রমাসিংহে নিজে প্রার্থী না হয়ে সিরিসেনাকে সমর্থন করেন। ধারণা করা হয়, ভারতের একটি মহল রাজাপাকসের নিশ্চিত বিজয় ঠেকাতেই সিরিসেনাকে সমর্থন করতে ইউপিএ নেতৃবৃন্দকে চাপ দেন। সিরিসেনা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে তার প্রথম বিদেশ সফরে দিল্লি যান। তাই বোঝাই যায় তিনি সরকার পরিচালনায় বেশিমাত্রায় ভারতের ওপর নির্ভরশীল হবেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। ২০০৭ সালের পর থেকে শ্রীলঙ্কা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার সমন্বয়ে এ অঞ্চলে যে ঐক্য গড়ে উঠছে এবং যা ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিত, তা একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থকে আঘাত করছে। চীনের এ অঞ্চল ঘিরে যে মুক্তার মালা নীতি তা ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্বকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই প্রণীত। ভারত মহাসাগরে চীনের শক্তি বৃদ্ধিকে তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপও মনে করছে ভারত। ফলে শ্রীলঙ্কায় একটা পরিবর্তন অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। মনে রাখতে হবে, চীন একদিকে বেলুচিস্তানের গাওদার বন্দর তৈরি করে দিয়েছিল, অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার হামবানতোতায়ও একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে দিয়েছে। ফলে ভারত এটা খুব সহজভাবে মেনে নেয়নি। অভিযোগ আছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। কেননা, হামবানতোতায় চীনা সাবমেরিনের উপস্থিতি ভারতের সমর নায়করা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করেছিলেন। এজন্যই দলে ভাঙন সৃষ্টি করে সিরিসেনাকেই রাজাপাকসের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয় এবং রাজাপাকসে হেরে যান। এর পরপরই সিরিসেনা নয়াদিল্লি যান। আর নরেন্দ্র মোদি শ্রীলঙ্কা সফর করেন গত মে মাসে, বাংলাদেশে আসার আগে। কিন্তু এখন সংসদ নির্বাচন হচ্ছে আজই। এক্ষেত্রে সিরিসেনার ভারতমুখিতা ভোটারদের আবার রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টিমুখী করতে পারে। তাই সিরিসেনাকে খুব হিসাব করে চলতে হচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় জাতীয়তাবাদী চেতনা অত্যন্ত শক্তিশালী। ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাক, এটা সিংহলিরা কখনোই ভালো চোখে দেখছেন না। অতীত ইতিহাসটা ভারতের জন্য কোনো ভাল সংবাদ নয়। তামিল বিদ্রোহীদের হাতে সেখানে মারা গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ললিত আথুলাথদালি, গামিনি দেশানায়েকে এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে তামিলদের অভিযোগ ছিল, শ্রীলঙ্কার শাসকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তিনি শ্রীলঙ্কার তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের একটি চুক্তির বিনিময়ে তামিল বিদ্রোহ দমন করতে ভারতীয় সেনারা তামিল অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করেছিল। ফলাফলটা অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন। ১২শ’ ভারতীয় সেনা মারা গিয়েছিল সেখানে। বাধ্য হয়ে ভারত ১৯৯০ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৮৭ সালে ভারত-শ্রীলঙ্কা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন রাজীব গান্ধী ও শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস জয়াবর্ধনে। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রেমাদাসা এর বিরোধিতা করেছিলেন। এ বিরোধিতাকে সামনে রেখেই প্রেমাদাসা ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিজয়ী হন। আজ শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সেই ‘দৃশ্যপট’ লক্ষণীয়। ভারতীয় প্রভাব সেখানে বাড়ছে। সিরিসেনা সেই ভারতীয় স্বার্থকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। নির্বাচনের আগে তিনি একাধিকবার চীনবিরোধী বক্তব্য রেখেছিলেন। এমনকি নয়া প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা দিয়েছিলেন চীনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১৫০০ কোটি ডলারের চুক্তি তিনি বাতিল করবেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে সত্যি সত্যিই তা করেছেন। ভারতের মোদি সরকারের সঙ্গে এখন অনেক ব্যবসায়ী শ্রেণী ভিড় করেছে। গত ১১-১৩ জানুয়ারি (২০১৫) গুজরাটে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ভাইব্রাই গুজরাট’ সম্মেলন। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব জন কেরি যোগ দিয়েছিলেন। ফলে মোদি সরকারকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছেন, সেই ব্যবসায়ী শ্রেণি (যেমন, আদানি গ্রুপ) চাইবে মোদি সরকারকে ব্যবহার করে ভারতের বাইরে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে। শ্রীলঙ্কায় দ্বন্দ্বটা এভাবেই তৈরি হতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে চীনের শুধু যে ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে তা নয়। বরং চীন যে ম্যারিটাইম সিল্করুটের কথা বলেছে, শ্রীলঙ্কা তার অংশ। বাংলাদেশের কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। সেটা এখন আর হচ্ছে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, রাজাপাকসের কিছু ভুলের কারণে শ্রীলঙ্কার জনগণ তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত তিনি অনেক সিদ্ধান্ত দিলেও তা তার নিজের ও দলের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেননি। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ তার ওপর শতভাগ সন্তুষ্ট ছিল না। শ্রীলঙ্কায় চীনের অর্থে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটলেও ভারতকে ‘উপেক্ষা’ করা এবং তামিল-মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া তার পতনকে ত্বরান্বিত করে। উপরন্তু ছিল পারিবারিক দুর্নীতি ও ক্ষমতা করায়ত্ত করার প্রচেষ্টা। এটা ছিল তার জন্য একটা শিক্ষা। নিশ্চয়ই সিরিসেনা এটা থেকে শিখেছেন। কিন্তু ভারত কী আদৌ চাইবে রাজাপাকসের প্রত্যাবর্তন? যদি রাজাপাকসের জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়, তাহলে তিনি সরকার গঠন করবেন। এক্ষেত্রে একটা বড় জটিলতা তৈরি হতে পারে। সিরিসেনার সঙ্গে এক ধরনের ‘জোট’-এ আবদ্ধ হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহে ও তার জোট। এখন সেই সংসদে যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত রাজাপাকসে ও তার সমর্থকরা চলে আসেন, সেটা খুব সুখের হবে না সিরিসেনার জন্য। আরো একটা সমস্যা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী বাতিল করবেন। ওই সংশোধনী বলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার। নির্বাচনে তার সমর্থক রানিল বিক্রমাসিংহে হেরে গেলে তাকে তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। সমস্যাটা তৈরি হবে নির্বাচনের পর পরই। সিরিসেনা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন নির্বাচনে রাজাপাকসে বিজয়ী হলেও তিনি তাকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন না। তিনি দলের সিনিয়র কাউকে এ দায়িত্বটা দিতে চান। এখানে বলা ভালো, রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি ভেঙে গেছে। এক অংশ প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার সঙ্গে রয়েছে, যারা একটি নির্বাচনী ঐক্য করেছে রানিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে। অন্য একটা অংশ, ধারণা করা হয় একটা বড় অংশ ফ্রিডম পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজাপাকসে। এটা স্পষ্ট নয় ফ্রিডম পার্টির কোন অংশটি জনপ্রিয়। সিরিসেনা ফ্রিডম পার্টির একটা অংশের চেয়ারম্যান, যিনি প্রার্থী তালিকায় রাজাপাকসের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে দেননি। অন্যদিকে রাজাপাকসে আলাদাভাবে ফ্রিডম পার্টির একটা অংশকে সংগঠিত করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এখানে বলা ভালো, রাজাপাকসে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন। এরপর ২০১০ সালেও বিজয়ী হন। সংবিধান সংশোধন করে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সিরিসেনার কাছে হেরে যান। এই নির্বাচন শ্রীলঙ্কার রাজনীতির জন্য অনেক কিছু। যদি রাজাপাকসে তার চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হন, তাহলে শ্রীলঙ্কা বড় ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী ভারত কী ভূমিকা নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। Daily Ajker Potrika 17.08.15

0 comments:

Post a Comment