রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জিএসপি ফিরে পেতে হবে

প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী গত ২৪ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তি নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি স্পষ্ট করেই আমাদের জানিয়েছেন, শর্ত পূরণ করতে না পারার কারণেই পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা জিএসপি বাস্তবায়ন হয়নি। এর সঙ্গে কোনো রাজনীতি জড়িত নয়। ড. গওহর রিজভীর এ বক্তব্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যের ঠিক উল্টো। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১২২টি দেশের জন্য জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হলেও ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম ছিল না। এর প্রতিক্রিয়ায় তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, রাজনৈতিক কারণে এটি হয়েছে। যদিও ঠিক এর পরদিনই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, এর সঙ্গে কোনো রাজনেতিক কারণ জড়িত নয়। ২৪ আগস্ট গওহর রিজভীও বললেন সে কথা। ড. গওহর রিজভী আরও বলেছিলেন, জিএসপি ফিরে পেতে হলে শ্রমবাজারের উন্নয়নে আমরা যেসব অঙ্গীকার করেছি, তা পূরণ করতে হবে। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমরা জিএসপি ফিরে পাব। একই সঙ্গে ড. রিজভী আমাদের কাছে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিদেশীদের কাছে ধরনা না দিয়ে তিনি সবাইকে একসঙ্গে কাজ করারও আহ্বান জানান। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। আমরা জিএসপি সুবিধা ফিরে পাইনি। এর পেছনে রাজনীতি ছিল না। বরং যে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল, আমরা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। মনে রাখতে হবে, রানা প্লাজা ও তাজরীনের বিপর্যয়ের ঘটনা সারা যুক্তরাষ্ট্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এর প্রভাব পড়ে জিএসপি সুবিধা বাতিলের ক্ষেত্রে। যদিও এটা সত্য যে, শুধু তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ বেশি। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমরা ১৫ দশমিক ৬২ ভাগ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অবস্থান ধরে রেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী এখন ভিয়েতনাম। আর এ ভিয়েতনামের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র অতি সম্প্রতি টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি করেছে। এ চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম শুল্কমুক্তভাবে তার তৈরি পোশাক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যে যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঝুঁকির মুখে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা ভালো, চীনের পরই ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজরে তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বড় রফতানিকারক। অর্থাৎ চীন বেশি রফতানি করে। তারপর ভিয়েতনাম। পরিসংখ্যান বলছে, তৈরি পোশাকে ভিয়েতনামের রফতানি বাড়ছে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হারে। এখন টিপিপির ফলে এটা আরও বাড়বে। ২০১৫ সালেই পোশাক রফতানি খাতে ভিয়েতনামের ২৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ভিয়েতনাম ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিক রফতানি ৫০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া ৮ হাজার ১৭৮ কোটি ডলারের মধ্যে চীনের রফতানি ২ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলার। এর পরের অবস্থানই ভিয়েতনামের, ৯২৬ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া রয়েছে যৌথভাবে তৃতীয় অবস্থানে। চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে যথাক্রমে মেক্সিকো ও ভারত। দেশ দুটির রফতানি যথাক্রমে ৩৭৩ ও ৩৪০ কোটি ডলার। বিজিএমইএর দেয়া তথ্যমতে, ২০১৪ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি (যুক্তরাষ্ট্রে) কমেছে ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আমাদের শঙ্কার কারণটা এখানেই। এমনিতেই যখন জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল হল না, তখন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর করল। এ ক্ষেত্রে টিপিপির ফলে আমাদের তৈরি পোশাক খাত যে ঝুঁকির মুখে আছে, তা আমরা কীভাবে কাটিয়ে উঠতে পারব, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন।জিএসপি সুবিধা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সালের হংকংয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা শীর্ষ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কযুক্ত সুবিধা দেয়ার শর্ত কার্যকর করতে রাজি হয়েছিল। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল, অনুন্নত বিশ্ব পশ্চিমা উন্নত দেশে তাদের পণ্যের আওতা বাড়াতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন ছিল পণ্যের মান ও উৎস নির্ধারণ নিয়ে। এ দুটি বিষয় নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল আমদানিকারক দেশগুলোর হাতে। হংকং সম্মেলনের দীর্ঘ ৮ বছর পর ৩-৭ ডিসেম্বর (২০১৩) ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সর্বশেষ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক)। বালি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এসব বাণিজ্য সংস্থা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে বটে; কিন্তু বালি ঘেষণায় কোন্ পক্ষ কী পেল, কিংবা বাণিজ্য বৈষম্যের শিকার অনুগত দেশগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন হবে কি-না, সে প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নগুলোই আবারও উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের জিএসপি সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকে কোনো জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না। তারপরও অন্যান্য পণ্যে যতটুকু সুবিধা পেত বাংলাদেশ, তাও জুন ২০১৩ থেকে স্থগিত রাখা হয়েছে।জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে মূলত তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। এক. শ্রমমান, দুই. শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত ও বিচার এবং তিন. ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। ঢাকায় টিকফার প্রথম বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্র আকার-ইঙ্গিতে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ রুলস অব অরিজিনের কঠিন শর্তে আটকে আছে। ধনী দেশগুলো এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের মোট রফতানি ৬১.৩ ভাগ জিএসপি সুবিধার আওতায়। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে মোট রফতানির প্রায় ৬০ ভাগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারছে বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৭৮ ভাগ হচ্ছে তৈরি পোশাক। এ তৈরি পোশাকের ৬০ ভাগ যায় ইউরোপে আর ২৫ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাক আমাদের আয়ের অন্যতম উৎস হলেও এ খাতের সঙ্গে জড়িত নানা প্রশ্নের সার্বিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্য বাংলাদেশ উপস্থাপন করতে পারেনি। দরকষাকষিতে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। আমলানির্ভর আমাদের মন্ত্রণালয়ের আমলারা বিদেশ সফর, সম্মেলনে অংশগ্রহণ ইত্যাদিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। এখানে দক্ষ জনশক্তির বড় অভাব। বিজিএমইএও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারেনি। তাদের গবেষণা-সেলও শক্তিশালী নয়। শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধার সঙ্গে রুলস অব অরিজিন, অ্যান্টি ডাম্পিং, ও কাউন্টার ভেইলিং ব্যবস্থা, প্রেফারেন্স ইরোশন, শ্রমমান ইত্যাদি নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন জড়িত। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বণিজ্য আলোচনায়ও আমরা এসব প্রশ্নে শক্ত অবস্থানে যেতে পারিনি।আমাদের সমস্যা এখানেই। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত ইস্যুগুলোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আসরে আমরা আমাদের অবস্থান জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। প্রতিপক্ষ এ থেকে সুবিধা নিয়েছে। তৈরি পোশাকের ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। এখানে এক ধরনের শৈথিল্য কাজ করেছিল প্রথম থেকেই। যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিল, তার সব বাস্তবায়ন হয়েছে, এটা বলা যাবে না। তবে এটা সত্য, এই ১৬ দফার বেশ কটি আমরা ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কথাটা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, তারা ১৬ দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। আংশিক বাস্তবায়ন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এখন বাণিজ্যমন্ত্রী যদি রাজনীতির প্রশ্ন তুলে ওই ১৬ দফার পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতে চান, তাতে স্থানীয়ভাবে তিনি বাহ্বা পেতে পারেন; কিন্তু জিএসপি পাওয়ার ক্ষেত্রে তা কোনো অবদান রাখতে পারবে না।শুধু জিএসপি নয়, এখন আমাদের ভাবতে হবে টিপিপি নিয়েও। টিপিপি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বিতর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র যে ১২টি দেশ নিয়ে টিপিপি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, তাতে প্রস্তাবিত দেশগুলোর কারও কারও আপত্তি রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ১২টি দেশ বিশ্ব বাণিজ্যের ৪০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে বাংলাদেশ আগামীতে আরও একটি ঝুঁকির মুখে থাকবে, এ বিষয়টিও আমাদের সিরিয়াসলি ভেবে দেখা উচিত। সেখানে আমাদের স্বার্থ কীভাবে ক্ষুণ্ণ হবে এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, এসব নিয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা করা উচিত। ইতিমধ্যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা স্বাক্ষর করেছি। তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে? আমরা এর আগেও টিকফার নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। মূল বিষয় হচ্ছে একটাই- চুক্তি স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়েই জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয় না। আমরা যদি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমাদের দক্ষতা দেখাতে না পারি, তখন প্রতিপক্ষ তো সুবিধা নেবেই। জিএসপি সুবিধার বাস্তব দিকগুলো আমাদের ভেবে দেখা উচিত ছিল। পূর্ণ ১৬ দফা বাস্তবায়ন না করে আমরা বললাম, রাজনীতির কারণে জিএসপি বাতিল হয়েছে- এটা ঠিক নয়। এখন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা সত্য কথাটাই আমাদের জানান দিলেন। তিনি শিক্ষকতা করেছেন। গবেষক। উন্নয়ন, গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে তার গবেষণা রয়েছে। রাজনীতিকদের মতো তিনি কথা বলেন না। তিনি সত্য কথাটাই উল্লেখ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি অন্তত একটি মেসেজ দিলেন- দ্রুত ১৬ দফা কর্মপরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। জিএসপি সুবিধা ফিরে পেতে হলে এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে বাণিজ্যনির্ভর যে শিল্প ব্যবস্থা, সেখানে আমরা আমাদের দ্রুত বিকাশমান বাণিজ্য খাতকে কীভাবে সুরক্ষা দেব- তাও আমাদের ভাবা উচিত। বাস্তবতা মেনে নেয়ার মধ্যেই মঙ্গল নিহিত। Daily Jugantor ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

0 comments:

Post a Comment