রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ছিটমহলগুলো এখন ইতিহাসের অংশ

ছিটমহলগুলো এখন ইতিহাসের অংশ
 
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা ১৬২টি ছিটমহল এখন ইতিহাসের অংশ। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির সময় কৃত্রিমভাবে এবং অযৌক্তিকভাবে ছিটমহলগুলো এই দুটি দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশ এই ছিটমহলগুলো পায়। ১৬২টি ছিটমহলের মধ্যে ১১১টি ছিল বাংলাদেশের ভেতরে। কিন্তু এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের ছিল না। গত ৩১ জুলাই রাত ১২টা অর্থাৎ ১ আগস্ট ২০১৫ সাল থেকে এই অঞ্চল বাংলাদেশের। সেখানে এখন প্রথমবারের মতো উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। অন্যদিকে বাকি ৫১টি ছিটমহল ছিল বাংলাদেশের, যা ছিল ভারতের ভেতরে। এখন সেই অঞ্চলটি ভারতের।
দীর্ঘ ৬৮ বছর এই দুটি অঞ্চলের মানুষ অর্থাৎ ১৬২টি ছিটমহলের মানুষ এক অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে আসছিল। তাদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। স্বাস্থ্যসেবা সেখানে নিশ্চিত করা যায়নি। শিক্ষা যেখানে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার, সেই অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল তারা। ফলে দেখা গেছে শিশু বয়সেই অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কৈশোরেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল তাদের স্বপ্নগুলো। এসব এখন ইতিহাসের অংশ। ১ আগস্ট থেকে ১১১টি ছিটমহলের বাসিন্দারা এক ‘নতুন স্বাধীনতার’ স্বাদ উপভোগ করছেন। তারা অনেকেই ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে বলেছেনÑ তারা এখন ‘স্বাধীন’ হয়েছেন। তাদের মধ্যে দেখা গেছে উল্লাস আর বাঁধভাঙা আহাদ। এখানে বলা ভালোÑ ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি একটি স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ওই চুক্তির আওতায় ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে বেরুবাড়ী লাভ করে। বাংলাদেশ পেয়েছিল দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা এবং সেখানে যাওয়ার জন্য তিনবিঘা করিডোর। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে সংবিধান সংশোধন করে ওই চুক্তিটি অনুমোদন করলেও ভারত দীর্ঘদিন এই চুক্তিটি অনুমোদন করেনি। ফলে ছিটমহলগুলোতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবে ১৯৯২ সালে ভারত বাংলাদেশকে তিনবিঘা করিডোর ইজারা দিয়েছিল।
ভারতের পক্ষ থেকেও একটা সমস্যা ছিল সংবিধান সংশোধনের। ১৯৭৪ সালের পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারতে যতগুলো সরকারই ছিল, তারা এই সংবিধান সংশোধনের দোহাই তুলে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিটি অনুমোদন করেনি। ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় এই চুক্তিটি পাস হওয়া এবং চুক্তি পাস হওয়ার সঙ্গে সংবিধান সংশোধনী অনুমোদন হওয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে এটা ঠিক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং সরকার ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর সংবিধান সংশোধন বিলটি ভারতের রাজ্যসভায় উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তখন তা পাস হয়নি। এর আগে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে একটি প্রটোকল স্বাক্ষর হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাদের নিজ নিজ নাগরিকত্ব বেছে নেওয়ার এবং ছিটমহলগুলো দুদেশের মধ্যে বিনিময়েরও একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। বাকি কাজগুলো পরে সম্পন্ন করে নরেন্দ্র মোদি সরকার। মোদি সরকার ছিটমহল বিনিময়ের ব্যাপারে ‘কমিটেড’ ছিল। ফলে ৫ মে (২০১৫) ভারতের মন্ত্রিসভায়, ৬ মে রাজ্যসভায় ও ৭ মে লোকসভায় বিলটি অনুমোদন হয়। তবে ছোট্ট একটি ত্রুটি থাকায় (শততম সংবিধান সংশোধন), তা পরে আবার ১১ মে রাজ্যসভায় উত্থাপন করা হয় এবং অনুমোদন হয়। ২৮ মে ভারতের রাষ্ট্রপতি বিলটিতে স্বাক্ষর করলে তা সংবিধান সংশোধন আকারে গৃহীত হয়। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় (৬ জুন) এটা ছিল বাংলাদেশের জনগণের জন্য তার ‘উপহার’।
দীর্ঘ ৬৮ বছর পর কোনো বড় ধরনের সংঘর্ষ ছাড়াই ছিটমহলগুলো নিজ নিজ রাষ্ট্রের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই জানেন ১৯৭৪ সালে ভারত মহাদেশ বিভক্তির আগে তৎকালীন কুচ রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের কিছু জমিদারি-স্বত্ব ছিল বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার মধ্যে। একইভাবে রংপুর ও দিনাজপুরের জমিদারদের কিছু তালুক ছিল কুচবিহার সীমানার ভেতরে। এ নিয়ে তারা সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হওয়ায় এই ছিটমহলগুলোর জন্ম হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ভারত বিভক্তির সময় হায়দরাবাদের নিজামের মতো কুচ রাজারাও ‘প্রিসলি স্টেট’-এর মর্যাদা ভোগ করতেন। পরে ১৯৪৯ সালে কুচবিহারের রাজা ভারতে যোগ দেন এবং তার রাজ্যটি পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়। কিন্তু সমস্যা থেকে গিয়েছিল। ১৯৫৮ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের উদ্যোগে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ছিটমহলগুলোকে মূল ভূখ-ের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। বিষয়টি তখন ভারতের আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। পাকিস্তান শাসনামলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রাষ্ট্রই পরে আর নেহেরু-নুন চুক্তি নিয়ে এগিয়ে যায়নি। এরপর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং ১৯৭৩ সালের পর থেকেই ছিটমহল বিনিময় নিয়ে আলোচনা চলে আসছিল। এখন সেই আলোচনার ইতি ঘটল এবং একটি দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে ছিটমহলের বাসিন্দারা মুক্তি পেলেন। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজনÑ ছিটমহলগুলো চিহ্নিত হলেও ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমান্ত ও অপদলীয় ভূমির ব্যাপারেও একটা ফয়সালা হয়েছে।
স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অগ্রগতি। ১১১টি ছিটমহলের ৪০ হাজার ৪৭০ নাগরিক এখন বাংলাদেশের নাগরিক, যাদের মধ্যে মাত্র ৯৭৯ জন ভারত যেতে চেয়েছেন। অন্যদিকে ৫১টি ছিটের ১৪ হাজার নাগরিক এখন ভারতের নাগরিক। এতে ১৭১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ৭১১০ দশমিক ০২ একর জমি। এই সংযুক্তির মধ্য দিয়ে ছিটের বিলুপ্তি ঘটল বটে, কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছে নানা ‘প্রশ্ন’। যে উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে গর্ব করছেন, তাদের উৎসাহে ভাটা পড়তে পারে, যদি আমরা তাদের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে এখনই নজর না দিই। এ খাতে ১১১টি ছিটমহলে অতি দ্রুত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। উচ্চশিক্ষার (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক) পাশাপাশি তাদের জন্য স্থানীয়ভাবে চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার স্বার্থে ডাক্তারদের সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ‘সামাজিক বেষ্টনী’র আওতা এ এলাকায় সম্প্রসারিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে এ অঞ্চলে অধিক পুলিশ স্টেশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা যাতে এ অঞ্চলে নিয়মিত যান, তার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জমির পরিমাণ, দখল ও মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় আইন সেখানে কার্যকর ছিল না সেহেতু স্থানীয়ভাবে দলিলের ভিত্তিতে জমি ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে। এসব কাগজ-দলিল যাচাই-বাছাই করে তার বৈধতা দিতে হবে। ছিটমহলের জমির সব রাজস্ব-কর মওকুফ করতে হবে। রাষ্ট্রের উদ্যোগে জমিসংক্রান্ত সিএস পর্চা ও তৎপরবর্তী রেকর্ড পর্চা নাগরিকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করতে হবে। যারা জমি সার্ভে করেন তারা যাতে অসৎ না হোন, সেদিকে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা রাখতে হবে। তৃতীয়ত, ২০১১ সালে জনগণনায় যারা নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি, অথচ তারা ছিটমহলের নাগরিকÑ তাদের দ্রুত নাগরিকত্ব দিতে হবে এবং যারা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে ভারতে যেতে চেয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ যদি আসতে চান তাদেরও একটি সুযোগ দিতে হবে। চতুর্থত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পাশ কাটিয়ে অতিদ্রুত এ অঞ্চলের জন্য থোক বরাদ্দ দিতে হবে। মনে রাখতে হবেÑ এ অঞ্চলের মানুষ বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের মানুষের মতো ছিল না। তাদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। আজ তারা এই অধিকার পেয়েছে। আজ সবার উচিত এই অঞ্চলের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। ইতোমধ্যে জমিসংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের একটি ইতিবাচক মনোভাব আমরা লক্ষ করেছি। জমিসংক্রান্ত বিবাদ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ-সংক্রান্ত খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তবে আশার কথাÑ সরকার বলছে, অতিদ্রুত সেখানে জমি জরিপ শুরু হবে। স্থানীয়দের নিয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা কমিটিও গঠিত হবে। যারা জমি বিক্রি করতে চান, তারা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তা বিক্রি করতে পারবেন। এমনকি আরও একটি উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেসব জমির রেকর্ড ভারতের কুচবিহার রাজ্যের ভূমি অফিসে রয়ে গেছে, সেসব রেকর্ড ভারত থেকে আনা হবে। এদিকে পল্লি বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাঈন উদ্দিন বলেছেন, সাবেক ছিটমহলগুলোতে বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা এ এলাকার বাসিন্দাদের ভোটার করার চিন্তা করছে। এগুলো সবই ‘পজিটিভ’ দিক। এখন যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা হচ্ছে এসব প্রতিশ্রুতি যেন কাগজ-কলমে থেকে না যায়। যদি দ্রুত ‘উদ্যোগ’ নেওয়া না হয়, তাহলে সাবেক ছিটমহলবাসীদের মাঝে হতাশা নেমে আসবে। আমরা চাই না তেমনটি হোক। এত বড় একটি অর্জন, তা যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ‘নষ্ট’ হয়ে না যায়।

1 comments:

  1. So informative!! Thank you sir. Slight editing is needed. "1947" instead of 1974.
    Thank you once again.

    ReplyDelete