রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

নির্বাচনী সংলাপ






নির্বাচন কমিশন আজ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক মতবিনিময়সভায় মিলিত হচ্ছে। এই মতবিনিময়সভায় যোগ দেওয়ার জন্য প্রায় ৫৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের একটি আমন্ত্রণলিপি আমি নিজেও পেয়েছি। এর আগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যে ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়ন করেছিল, তাতে বলা হয়েছিল—কমিশন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় করে তাঁদের মতামত নেবে। আজ সেটা তারা শুরু করল। কিন্তু কতটুকু সফল হতে পারবে তারা? এই নির্বাচনী সংলাপকে সামনে রেখে কতগুলো ‘প্রশ্ন’ আছে। এসব প্রশ্নের জবাবের ওপরই নির্ভর করছে কমিশনের সাফল্য।
প্রথমত, বুদ্ধিজীবীরা কিছু মতামত আজ দেবেন, সন্দেহ নেই তাতে। তার কয়টি গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন? উপরন্তু সমস্যা রয়েছে আরো। তাঁদের নাম পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তাঁদের কারো কারো একটি ‘সুস্পষ্ট’ রাজনীতি আছে। সরকার, সরকারি দল ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁদের কারো কারো সংশ্লিষ্টতা আছে। দু-একটি নাম দেখলাম, যাঁরা নির্বাচন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া, নির্বাচনী সংস্কার, রাজনীতির গতিবিধি ইত্যাদি নিয়ে কোথাও কোনো দিন কোনো কিছু বলেছেন কি না সন্দেহ। ফলে তাঁদের ‘ডেকে’ ইসি কী মতামত পাবে? যাঁরা সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন এবং এখনো নিচ্ছেন, তাঁরা কী নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে সমালোচনা করতে পারবেন? আমার তা মনে হয় না। ফলে এই নির্বাচনী সংলাপ অনেকটা ‘লোকদেখানো’ হয়ে যেতে পারে এবং ফটোসেশনের মধ্য দিয়ে তা শেষ হওয়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে। সিইসি জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে এই মুহূর্তে তাঁর করণীয় কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা মুখ্য। সরকার চাইলে অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দলের ব্যাপারে কিছুটা নম্র আচরণ করতে পারে। জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে সরকার এটা করেছে। এইচ এম এরশাদ দিল্লি থেকে ফিরে এলে ঢাকায় গণসংবর্ধনা দিয়েছে দল। সরকার তাতে বাধা দেয়নি। বিএনপির ক্ষেত্রে এমনটি কি হবে? খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দুই মাস পর ফিরে এলে পার্টি যদি তাঁকে বিমানবন্দরে গণসংবর্ধনা দিতে চায়, সরকার কি তার অনুমতি দেবে? এটা সত্য, ইসির এ ক্ষেত্রে করার কিছু নেই। এটা সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। তবে ইসি বলতে পারে তফসিল ঘোষণার আগে কোনো বড় সমাবেশ নয় এবং কোনো নির্বাচনী জনসভাও নয়।

তৃতীয়ত, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নেই। আমরা খুব অতীতমুখী। অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি বেশি। দোষারোপের রাজনীতির বৃত্ত থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রায় ১৭ মাস আগে নির্বাচন কমিশন কি কোনো উদ্যোগ নিতে পারে? এমন কোনো ‘মেকানিজম’ কি ইসি বের করতে পারে, যেখানে দলগুলো এখন থেকে বিদ্বেষমূলক কোনো কথাবার্তা বলবে না! রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে সিইসি বিষয়টি উত্থাপন করতে পারেন। এতে কতটুকু ফল তিনি পাবেন, তা আমি নিশ্চিত নই। তবে এ ধরনের একটি উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন। বলা ভালো, ইসির সাত দফায় এসংক্রান্ত কিছু নেই। চতুর্থত, নির্বাচনে ‘সিল মারা সংস্কৃতি’, ‘ভোটকেন্দ্র দখলের সংস্কৃতি’ কিংবা ‘বিরোধী দলের প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না দেওয়া’—এই যে প্রবণতা বিগত দশম সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন কিংবা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমরা দেখেছি, এই প্রবণতা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে ইসির করণীয় কী? ইসি এ ক্ষেত্রে বেশ কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। যেমন—ক. স্থানীয়ভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি একটি ‘পর্যবেক্ষক টিম’ গঠন করতে পারে, যাঁদের কাজ হবে নির্বাচন কেন্দ্রগুলো মনিটর করা এবং সরাসরি কেন্দ্রে রিপোর্ট করা; খ. মিডিয়ার মাধ্যমে যেখান থেকেই জাল ভোট ও ভোটকেন্দ্র দখলের খবর আসবে, সেখানে ওই কেন্দ্র নয়, বরং পুরো নির্বাচনী এলাকার নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা; গ. মনোনয়নপত্র একই সঙ্গে স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ে গ্রহণ করা। এতে প্রার্থীর পক্ষে একাধিক জায়গায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে। মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার খবর এলে, ওই এলাকার নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করতে হবে।
পঞ্চমত, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সশস্ত্র বাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। ষষ্ঠত, নির্বাচনে ভোট গণনায় যদি প্রার্থীরা সমানসংখ্যক ভোট পান, তাহলে লটারির পরিবর্তে আবার নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং কোনো প্রার্থী যদি ৫০ শতাংশের নিচে ভোট পেয়ে বিজয়ী হন, তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করা যাবে না। সেখানেও আবার নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের নিয়ম আছে। সপ্তমত, সংসদ সদস্যের যোগ্যতার প্রশ্নে ন্যূনতম যোগ্যতা ‘গ্র্যাজুয়েশন’ হওয়া উচিত। দেশে উচ্চশিক্ষার হার বেড়েছে। যাঁরা দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন তাঁরা যদি শিক্ষিত না হন, তাহলে সঠিক ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করবেন কিভাবে? এতে সংসদ সদস্যরা বেশি মাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে যাবেন। আমলারা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাবেন। অষ্টমত, সুবিধাবাদী ও ধান্দাবাজ ঊর্ধ্বতন আমলা, সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা অবসরের তিন বছর পর নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। এটা একটা দুর্বল আইন। এটা পরিবর্তন করে ন্যূনতম পাঁচ বছর করা প্রয়োজন। অর্থাৎ একজন আমলা ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যাবেন এবং ৬৫ বছর বয়সে তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে শর্ত থাকবে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ওই সংসদীয় এলাকায় দল তাঁকে মনোনয়ন দেবে—এটা না হলে দেখা যাবে সুযোগসন্ধানী আমলারা সচিবালয়ে থাকাকালে মন্ত্রণালয়ের প্রভাব খাটিয়ে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। এতে পরোক্ষভাবে তিনি সরকারকে ব্যবহার করছেন। পাঁচ বছরের একটি গ্যাপ থাকলে এই কাজ করতে তিনি অপারগ হবেন।
এখন সময় এসেছে নির্বাচন কমিশনকে এটা প্রমাণ করতে যে তারা সত্যি সত্যিই ‘স্বাধীন’। বেশ কয়েকজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, একাধিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকার অর্থেই তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে। না হলে যে ‘বিতর্ক’ নিয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তার যাত্রা শুরু করেছিল, সেই ‘বিতর্ক’ আরো বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী গত ২৬ জুলাই ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। আমাদের সংবিধানের ১১৮(৪) ধারায়ও স্পষ্ট করে বলা আছে যে ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন’ এবং সংবিধানের ১২৬-এ বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য’। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের কথাবার্তা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। নির্বাচন কমিশন কখনোই স্বাধীন না এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কখনোই নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে না! বরং স্থানীয় পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা থাকেন (ডিসি, টিএনও ইত্যাদি), তাঁরা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অর্থাৎ এস্টাবলিশমেন্ট মন্ত্রণালয়ের কথা শোনেন। কাগজে-কলমে আছে ওই তিন মাস তাঁরা নির্বাচন কমিশনের কথা শুনবেন; কিন্তু তাঁরা তা শোনেন না! তাহলে এখন ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? বর্তমান সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখেই ২০১৯ সালের জানুয়ারির তিন মাস আগেই নির্বাচনটি হবে (একাদশ সংসদ নির্বাচন)। প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে যা করতে পারেন (২০১৪ সালেও তিনি তা করেছিলেন), তা হলো বিএনপিকে অন্তর্ভুক্ত করেই একটি মন্ত্রিসভা গঠন, যদিও কাজটি সহজ নয়। কেননা বিএনপি সংসদে নেই। নির্বাচনপূর্ব তিন মাস সময়ের জন্য যে মন্ত্রিসভা—এটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। বিএনপি বলছে একটি সহায়ক সরকারের কথা। আর আওয়ামী লীগ বলছে শেখ হাসিনাই সহায়ক সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। ওই সরকার রুটিন কাজ করবে। আর মূল প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকবে নির্বাচন কমিশন—এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। নির্বাচন কমিশনকে তার ওপর সাংবিধানিকভাবে প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করতে হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে আমরা ‘খাদের কিনারে’ নিয়ে গেছি। একটি ‘ধাক্কা’ দিলেই গভীর খাদে পড়ে যাবে! আমরা সে রকম একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। এর আগে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও (ষষ্ঠ সংসদ) কিন্তু সে রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই ‘পরিস্থিতি’ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) কিংবা নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ সেখানে নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে এটা বলা হয় যে বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই ছিল না। সাবেক সিইসি তাঁর শেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছিলেন। এ নিয়ে গত সাড়ে তিন বছরে অনেক কথাই হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। জাতিও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি এটাও সত্য গণতন্ত্রের স্বার্থে, গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে ন্যূনতম ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘ঐক্য’ প্রয়োজন। সেই ‘ঐক্য’ ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই তেমন একটি পরিস্থিতি আবার সৃষ্টি হোক, আমরা কেউ তা চাই না। সংগত কারণেই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাটি অনেক বড় ও ব্যাপক।
নির্বাচন কমিশন আজ আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাকে সম্মানিত করেছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পর্কে আমার ধারণা এর আগেও আমি প্রকাশ করেছি। এ কলামেও তার প্রতিফলন ঘটল কিছু কিছু। এ ক্ষেত্রে আমার বিশ্বাস, সুধীসমাজ নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এখানে বড়। তারাই মূল ‘স্টেকহোল্ডার’। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে, গ্রহণযোগ্য করতে এবং ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’কে নিশ্চিত করতে সুধীসমাজের ভূমিকার চেয়েও তাদের ভূমিকাকে ইসি বেশি গুরুত্ব দেবে—এটাই আমার প্রত্যাশা। বিএনপি ইসির সংলাপে যাবে। তবে তাদের উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে ইসির কোনো ‘ভূমিকা’ আছে বলে আমার মনে হয় না। ‘সহায়ক সরকার’ গঠনের ব্যাপারেও ইসির কিছু করণীয় নেই। তবে আজকের ‘নির্বাচনী সংলাপ’-এর ব্যাপারে ইসি যা করতে পারে—১. সুধীসমাজের প্রতিটি বক্তব্য কমিশন লিপিবদ্ধ করবে, বিবেচনায় নেবে এবং আইনের আওতায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে; ২. কমিশন কোনো বক্তব্য দেবে না এবং সুধীসমাজের কোনো বক্তব্য খণ্ডনও করবে না; ৩. সিইসি ও সদস্যরা যত কম কথা বলবেন, যত কম মিডিয়ায় আসবেন তত তাঁদের জন্য মঙ্গল। নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য তা বড় ভূমিকা রাখবে। একটি ‘কঠিন সময়ে’ সিইসি ও কমিশনাররা দায়িত্ব নিয়েছেন। অন্যান্যবারের তুলনায় এবার তাঁদের সবার দায়িত্ব অনেক বেশি। আমরা শুধু তাঁদের শুভকামনা করতে পারি।
Daily kaler Kontho
31.07.2017

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব এবং এ অঞ্চলের রাজনীতিতে এর প্রভাব


সাম্প্রতিককালে একাধিক ইস্যুতে ভারত ও চীনের মাঝে এক ধরনের সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। গেল ১৬ মে বেইজিংয়ে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবেওআর) শীর্ষক যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তাতে ভারত অংশ নেয়নি। অথচ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা মধ্য এশিয়ার প্রায় সব সরকারপ্রধানই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ওবেওআরের মাধ্যমে চীন তার দুই অঞ্চলের সঙ্গে প্রায় ৬১ দেশকে সমুদ্র, সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করছে। চীনের এ মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারত চলতি জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে একটি সামুদ্রিক নৌ মহড়া করেছে, যা চীন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছে। আর সর্বশেষ ঘটনায় ভুটানের পশ্চিমাংশে দোকলাম মালভূমি নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে চীন ও ভারত। দোকলাম চীন ও ভুটান উভয়ই দাবি করে। ১৮৯০ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, মাত্র ৮৯ বর্গকিলোমিটারের মালভূমিটি চীন তার নিজের বলে দাবি করে আসছে। ভুটানও মনে করে, এটা তাদের নিজেদের এলাকা। চীন সেখানে অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ শুরু করলে ভুটানের অনুরোধে ভারত সেখানে সেনা মোতায়েন করে। দ্বন্দ্বটা সেখান থেকেই শুরু। সীমান্তে দ্বন্দ্ব চীন ও ভারতের মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। ব্রিকস উন্নয়নেও এর প্রভাব পড়বে। এ দ্বন্দ্বে এ অঞ্চলের দেশগুলোও ‘আক্রান্ত’ হতে পারে! দুই দেশের মাঝে সম্পর্কোন্নয়নের একটা সম্ভাবনার জন্ম হলেও তা এখন বড় হুমকির মাঝে পড়েছে। এটা বলতেই হয়, বেশকিছু বিষয়ে পার্শ্ববর্তী এ দেশ দুইটির মাঝে দ্বিমত এবং বিভাজন আছে; কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্ক এ বিভাজন আর বিদ্বেষকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্য সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা ছিল, তা রয়েই গেছে। চীন অরুণাচল প্রদেশের একটা অংশকে তাদের নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে। এ দাবি চীন পরিত্যাগ করেনি। নরেন্দ্র মোদির বেইজিং উপস্থিতির সময় (মে ২০১৫) চীনা সরকারি টিভিতে ভারতের যে ম্যাপ দেখানো হয়েছিল, তাতে কাশ্মীর ও অরুণাচলকে ভারতীয় অংশ হিসেবে দেখানো হয়নি। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে চীন সড়ক নির্মাণ শেষ করছে ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও। চীন এ সড়ক নির্মাণ বন্ধ করেনি। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণ করছে, যা কিনা জাপানের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের কর্মকা- ভারতের নিরাপত্তা স্ট্রাটেজিস্টদের আতঙ্কিত করেছে। ভারত তার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও চীন তাতে সম্মান দেখায়নি। নেপাল ও মিয়ানমারে চীনা প্রভাব বাড়ছেÑ এটাও ভারতীয়দের উৎকণ্ঠার অন্যতম একটি কারণ। ২০১৫ সালে ভূমিকম্পকবলিত নেপালে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের ‘ঠা-া লড়াই’ও আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ভারত গেল বছরও ভারত মহাসাগরে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে একটি বড় ধরনের নৌ সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। এটা নিঃসন্দেহে চীনাদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ভারত একটি পারমাণবিক শক্তি। ভারত এখন পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। কিন্তু তাতে আপত্তি রয়েছে চীনের। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিপণ্য নিয়ে ভারত চীনা বাজারে ঢুকতে চায়। কিন্তু তাতে রয়েছে চীনাদের আপত্তি। আগামীতে চীনাদের একটা বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে ভারতের প্রাচীন ‘কটন রুট’ এর পুনরুত্থান। প্রাচীন যুগে ভারত ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে তার সুতি শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিল। প্রাচীন ভারতে বণিকরা ভারত মহাসাগরের কয়েকটি রুট ব্যবহার করে তাদের পণ্যসামগ্রী, বিশেষ করে ভারতীয় সুতি কাপড় নিয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত যেত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল এ পথ ধরেই। অথচ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনার সঙ্গে মোদির প্রস্তাবিত ‘কটন রুট’ এর ধারণা সাংঘর্ষিক। প্রাচীন ‘কটন রুট’কে নতুন করে সাজানোর মধ্য দিয়ে ভারত এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরে তার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন, মোদি ২০১৫ সালের মার্চে মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে যেখানে একটি ভারতীয় নৌঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত এবং এ জোটে মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। এটা যদি কার্যকর হয়, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ মধ্যাঞ্চলের সিসিলি, মরিশাস কিংবা সুদূরের ওমান-মোজাম্বিকও একই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এর অর্থ পরিষ্কারÑ বিশাল ভারত মহাসগরে ভারত তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় এবং ‘ইন্ডিয়ান ওশেন রিম’ বা ভারত মহাসগরভুক্ত অঞ্চলে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। অথচ চীন এরই মধ্যে তার ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। জিবুতিতে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ শেষ করেছে চীনÑ এ খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তবে চীনের জন্য একটি খারাপ খবর হচ্ছে, শ্রীলঙ্কায় তার যে প্রভাব ছিল, তা এখন কমতির দিকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজা পাকসের ‘অতি চীননির্ভর’ নীতির কারণে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল। সেখানে সিরিসেনার নেতৃত্বে একটি ‘ভারত বন্ধু’ সরকার সেখানে ক্ষমতাসীন হয়েছে। ফলে আগামী দিনে ভারত মহাসগরভুক্ত অঞ্চলে চীন ও ভারতের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা যে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। ফলে বাধাগ্রস্ত হবে ওবেওআরের বিকাশ।
ভারত এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় তার সীমান্তবর্তী যেসব দেশ রয়েছে, প্রতিটি দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুধু ভালোই নয়, বরং সর্বকালের সেরা সম্পর্ক রয়েছে এখন। এ অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক, সামরিক ও স্ট্রাটেজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতে ভারতের মনমোহন সিং সরকার যা করতে পারেনি, তা মোদি সরকার করে দেখিয়েছে। ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ এর অংশ হিসেবে ভারত এ অঞ্চলের দেশগুলোকে তার পতাকাতলে আনছে। এটা অনেকটা ‘মনরো ডকট্রিনের’ ভারতীয় সংস্করণ, অর্থাৎ ভারত চাইবে না এ অঞ্চলে অন্য কোনো শক্তি কর্তৃত্ব করুক অথবা প্রভাব বিস্তার করুক। চীন এ অঞ্চলের নিকটপ্রতিবেশী। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে চীনা সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই ভারত কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের আপত্তির কারণে ভুটানে এখন অবধি চীন তার দূতাবাস খুলতে পারেনি। তাই চীন-ভারত সম্পর্কটা অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। এ সম্পর্ককে অনেক পর্যবেক্ষক ‘ভারতের হাতি বনাম চীনের ড্রাগন’(Indian Elephant vs Chinese Dragon)হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ চীনের পরিচিতি যেখানে ড্রাগনকে দিয়ে, ঠিক তেমনই ভারতের পরিচিতি হাতিকে দিয়ে। ‘হাতি বনাম ড্রাগন’ দ্বন্দ্ব নিঃসন্দেহে একুশ শতকের মধ্যভাগে শুধু এ অঞ্চলেই নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে ভারতের একটা বিশাল এলাকা চীন দখল করে নিয়েছিল। এর আগে মধ্য পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’ সেøাগান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তিব্বতকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীন যে ‘পঞ্চশীলা নীতি’ গ্রহণ করেছিল, যা ন্যাম বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় একটি ভিত্তি দিয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ পঞ্চশীলা নীতি। যেমন বলা যেতে পারে ইন্দোনেশিয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রনীতিতে এ পঞ্চশীলার কথা বলা আছে। মধ্য পঞ্চাশের সেই ‘নেহরু-চৌ এন লাই’ ইমেজ আবার ফিরে এসেছিল ‘মোদি-শি জিনপিং’ বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে। এটি এখন কতটুকু কার্যকর হবে, মোদির সেপ্টেম্বরে বেইজিং সফর দুই দেশের সম্পর্ককে কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মানসিকতার। ভারতের ব্যুরোক্র্যাসি ভারতকে একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে দেখতে চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এ প্রভাব কাটানো কঠিন। মনমোহন সিং পারেননি। এখন দেখার পালা, মোদি কতটকু পারেন? তবে এটা তো সত্য, মোদির নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। তিনি রাজনীতিকে পাশে ঠেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। তার চাই উন্নয়ন। চাই বিনিয়োগ। চাই ব্যবসা। সে কারণে পুরনো বৈরিতা ভুলে গিয়ে তিনি প্রথম চীন সফরে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। তার বৈদেশিক নীতির এটাই বড় বৈশিষ্ট্য। তার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং সর্বশেষ চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরের উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে সফল করা।
এখন ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত দ্বন্দ্ব যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে মোদি তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নিয়ে বেশি দূর যেতে পারবেন না। তিনি ভারতবাসীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আগামী ২০২২ সালের মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা করবেন। প্রতি বছর ১২০ লাখ কর্র্মক্ষম মানুষ ‘জব মার্কেটে’ প্রবেশ করছে। এদের জন্য কাজ দরকার। চীনের মতোই ভারতকে একটি ‘পণ্যের উৎপাদনশীল’ দেশে পরিণত করতে চন মোদি। চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়লে সেনাবাহিনী চাইবে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ভার বাড়ানোর। ভারত তার নৌ ও বিমান বাহিনী আধুনিকীকরণ করছে। নৌবাহিনীতে মোট ২৮টি সাবমেরিন সংযোজনের (বর্তমানে আছে ১৫টি) উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। বিমান বাহিনীতে নতুন বিমান আসছে। ভারত এখন নিজেই তৈরি করবে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। লকহিডের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আগামীতে আরও বাড়বে। সীমান্ত সমস্যা, বিশেষ করে দোকলাম সমস্যার সমাধান যদি না হয়, তাহলে এ উত্তেজনা অন্য অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হবে। খুব সংগত কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাতে আক্রান্ত হবে, যা এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনা সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনার জন্ম হয়েছিল, গেল এক মাসেও তার কোনো সমাধান হয়নি; বরং দুই পক্ষ থেকেই উত্তেজনাকর কথাবার্তা বলা হচ্ছে। ভারতকে দ্বিতীয়বারের মতো ‘শিক্ষা’ দেয়ার কথা বলছে চীন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি এর উত্তরে বলেছেন, ১৯৬২ আর ২০১৭ এক নয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সীমান্ত নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও চীন বলছে, দোকলাম সীমান্ত থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না ভারত তার সেনাবাহিনী সরিয়ে নেবে, ততদিন কোনো আলোচনা নয়। এরই মধ্যে ২৭ ও ২৮ জুলাই বেইজিংয়ে ব্রিকসের নিরাপত্তাসংক্রান্ত একটি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর আর নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। বেইজিংয়ে তারা চীনের স্টেট কাউন্সিলর ইয়াং জিই চির সঙ্গে দেখা করেছিলেন বটে; কিন্তু সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে কোনো কথা হয়নি।
Daily Alokito Bangladesh
30.07.2017

আমরা কেমন মন্ত্রিসভা চাই


গত ১৩ জুলাই আমাদের সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছে। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, মন্ত্রিসভায় রদবদল আসন্ন। প্রতিবেদনটিতে এমন আভাস দেওয়া হয়েছে যে, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই মন্ত্রিসভায় বেশকিছু পরিবর্তন আসছে। ওই প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিতর্কিত কর্মকা-ের জন্য তারা বাদ পড়তে পারেন! মন্ত্রসিভায় রদবদল কিংবা কাউকে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করাÑ এসবই একটি রুটিন ওয়ার্ক। প্রধানমন্ত্রী তার প্রশাসনে গতি আনার জন্য মন্ত্রসিভায় পরিবর্তন আনতে পারেন। সংবিধান তাকে সে ক্ষমতা দিয়েছে। তবে আমার বিবেচনায় বর্তমানে যে পরিবর্তনটি তিনি করতে যাচ্ছেন তার গুরুত্ব অনেক। কেননা আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নৌকা মার্কার পক্ষে ভোট চাইতে শুরু করেছেন। তাই এমন একটি মন্ত্রিসভা তিনি গঠন করবেন, যাদের নিয়ে তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। সে জন্য দক্ষতা, দুর্নীতিমুক্ত, গ্রহণযোগ্য ও সৎ একটি মন্ত্রিসভা দরকার। অতীতে এমন একজন মন্ত্রীর কথা আমরা জানি, যিনি মাসের পর মাস অফিসে যেতেন না। বাসায় ফাইল নিয়ে যেত তার স্টাফরা। একজন মন্ত্রী হতে পারেন তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তিনি মন্ত্রণালয় পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি! আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক মন্ত্রীর নামও জানি না। চিনিও না। এটা আমার অপরাধ কিনা জানি না, কিন্তু ওইসব মন্ত্রী মহোদয় তাদের নিজ নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করে জনগণের সামনে হাজির হতে পারেননি। অনেক মন্ত্রীর পারিবারিক সদস্যদের দ্বন্দ্ব সরকারকে বিব্রত অবস্থার মধ্যেও ফেলে দিয়েছে! তাই পরিবর্তনটা প্রয়োজন। মন্ত্রিসভায় এমন সব ব্যক্তিকে স্থান দেওয়া উচিত, যারা জাতিকে সত্যিকার অর্থেই নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। শোনা যাচ্ছে কোরবানির পর মন্ত্রিসভায় রদবদল হবে। তখন আরও কিছু পূর্ণমন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হবেন। এটা প্রধানমন্ত্রীর মর্জির ওপর নির্ভরশীল। প্রধানমন্ত্রী ভালো মনে করলে তাই করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রীদের সংখ্যা বাড়িয়ে কি কেবিনেটে গতিশীলতা আনা যায়? কিংবা কেবিনেটের দক্ষতা বাড়ানো যায়? এর জবাব হচ্ছে, না। আমি তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে দেখাতে পারব, পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ছোট মন্ত্রিসভা নিয়ে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। যুক্তরাজ্যে কেবিনেট পদমর্যাদায় মন্ত্রী রয়েছেন মাত্র ২১ জন। জার্মানিতে তিনটি বড় দলের সমন্বয়ে রয়েছে একটি কেবিনেট। সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৬ জন। এর মাঝে চ্যান্সেলর (বা প্রধানমন্ত্রী) অ্যাজ্ঞেলা মের্কেলের সিডিইউ থেকে ৭ জন, এক সময়ের বিরোধী দল ও এখন কোয়ালিশনের অংশীদার এসপিডি থেকে ৬ জন, আর সিডিইউর ট্রেশিনাল পার্টনার সিএসইউ থেকে ৩ জন। জার্মানির মতো বড় অর্থনীতির দেশে কেবিনেটের সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৬ জন। চিন্তা করা যায়? যুক্তরাষ্ট্রের কথা চিন্তা করুন। সেখানে কেবিনেট পদমর্যাদার মন্ত্রীদের সংখ্যা ১৫ জন। তবে ভাইস প্রেসিডেন্টও সেখানে কেবিনেটের অংশ। ভারতের মতো বিশাল দেশে নরেন্দ্র মোদি মাত্র ৩৪ জন মন্ত্রী নিয়ে একটি কেবিনেট পরিচালনা করে আসছেন। অথচ বাংলাদেশে? বাংলাদেশে পূর্ণমন্ত্রী আছেন ৩২ জন, ১৮ জন রয়েছেন প্রতিমন্ত্রী ও ২ জন উপমন্ত্রী। গত ১৪ জুলাই (’১৬ সাল) ৩ জন পর্ণমন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রী আমরা পেয়েছি। পূর্ণমন্ত্রীর ২ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। আর একজন পূর্ণমন্ত্রী আমরা পেয়েছি নতুন। তিনি চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী। নুরুল ইসলাম বিএসসি স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে তার জীবন শুরু করলেও তিনি এখন চট্টগ্রামের একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে বেশ কিছুদিন যাবৎ ছোট্ট একটি কলাম লিখে আসছেন। নিয়মিত। তিনি চট্টগ্রাম-৮ আসনে জাতীয় সংসদে (৫ জানুয়ারির নির্বাচনে) নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার ফলে ওই আসনটি দেওয়া হয় তখনকার জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদককে। তখন প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে তাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে পূর্ণমন্ত্রী বানিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তার কথা রেখেছেন। এভাবেই প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেন। অতীতেও তিনি কথা রেখেছিলেন। এখন যিনি ধর্মমন্ত্রী তাকেও কথা দিয়েছিলেন। সে কথা তিনি রেখেছেন। দিলীপ বড়–য়ার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। জীবনে কোনো নির্বাচনে সাম্যবাদী দলের এই নেতা ৫০০ ভোটের বেশি পাননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। তার দলটি আবার ১৪ দলের শরিক দল। ফলে সঙ্গত কারণেই তার আসনটিতে অন্য কাউকে মনোনয়ন দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী তখন দিলীপ বড়–য়াকে কথা দিয়েছিলেন। জীবনে যিনি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যেতে পারেননি, তিনি শুধু এবং একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদে পূর্ণমন্ত্রী হয়েছিলেন। তবে দিলীপ বড়–য়া কথা রাখেননি। সারাজীবন বাম রাজনীতি করেও নানারকম দুর্নীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, কেউই প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সুযোগটি কাজে লাগাতে পারেননি। তবে নুরুল ইসলাম বিএসসি ৭৩ বছর বয়সে এসে মন্ত্রী হয়ে শেষ পর্যন্ত কতটুকু বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারবেন জানি না। একজন ব্যবসায়ী যখন মন্ত্রী হন, তিনি কখনই নিজেকে ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ঊর্ধ্বে রাখতে পারেন না। একজন ব্যবসায়ীকে মন্ত্রী না করাই মঙ্গল। প্রতিমন্ত্রীদের নিয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই। সাধারণত তরুণ প্রজন্মের ছোট মন্ত্রীরা সমাজের জন্য মডেল হন। তাদের দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হন। এ ক্ষেত্রে কারো পারিবারিক জীবন নিয়ে যদি স্ক্যান্ডাল হয়, যদি তিনি মিডিয়ার আলোচনার খোড়াক হন, তিনি তখন আর তরুণ সমাজের আদর্শ হতে পারেন না। বলতে নেই দু-একজন প্রতিমন্ত্রীর পারফরম্যান্স ভালো। মূলত মন্ত্রিসভায় যে কোনো রদবদল অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এতে গুণগত পরিবর্তন যেন হয়। আশাবাদী হওয়ার মতো ঘটনা যেন ঘটে। এটা কোনোমতেই যেন একটা ‘কসমিক চেঞ্জ’ না হয়। মানুষের প্রত্যাশা যেন পূরণ হয়। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি, কোরবানির পর বর্তমান মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণ ঘটবে। তখন হয়তো আমরা আরও বেশ কয়েকজন নতুন পূর্ণমন্ত্রী পাব। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার, তা হচ্ছে যোগ্যতা এবং বিতর্কিত নন, এমন ব্যক্তিদেরই যেন মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়। এক সময় যিনি ‘পাখির মতো’ সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন, বিদেশি মন্ত্রীদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেছেন এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে যিনি ছিলেন উদাসীন, তিনি দলের যত ‘বড়’ নেতাই হোন না কেন, মন্ত্রিসভার ভাবমূর্তির জন্য তিনি ‘যোগ্য’ ব্যক্তি নন। আরেকজনের কথা বলি। সিলেটের শিশু রাজন হত্যার জন্য তিনি দায়ী করেছিলেন খালেদা জিয়াকে। মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উত্থানের জন্যও তিনি দায়ী করেছিলেন খালেদা জিয়াকে। তার দুর্নীতি নিয়ে যখন যমুনা টিভি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, তখন খটকা লেগেছিল। এভাবে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে কী তিনি নিজের ‘যোগ্যতা’ প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? আমার অবজারভেশনটা হচ্ছে এখানেই। বড় মন্ত্রিসভার প্রয়োজন নেই। দরকার ছোট মন্ত্রিসভা। কিন্তু তারা হবেন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন। যতদূর জানি, অতীতে কোনো একটি কমিটির সুপারিশ ছিল এমনটাই ২০ থেকে ২৫ জনের মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্য সীমাবদ্ধ রাখা। এটাই সঠিক। সাধারণত ‘জেলা কোটা’, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইত্যাদি কারণে কেবিনেট সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রায় ক্ষেত্রেই যোগ্যতার বিষয়টি খুব একটা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। তবে বলতেই হবে, বর্তমান কেবিনেটে বেশ ক’জন সদস্য রয়েছেন, যারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয় পরিচালনায় যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। সাধারণত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নেওয়া হয়। তবে সংবিধানের ৫৬(২) ধারা মতে, টেকনোক্রেট কোটায়ও মন্ত্রী নেওয়া হয় (মোট সদস্যদের দশ ভাগের এক ভাগ)। এই ধারাটি পরিবর্তন প্রয়োজন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা যোগ্য এবং আন্তর্জাতিক আসরে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন, এমন কাউকে কাউকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া যায়। বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্যনির্ভর বিশ্বব্যবস্থায় যেখানে নেগোসিয়েশনের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কোনো কোনো মন্ত্রণালয় (বাণিজ্য, শিল্প, পররাষ্ট্র, মানবসম্পদ) পরিচালনায় দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মন্ত্রী প্রয়োজন। সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, দলকে তারা সংগঠিত করেন। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির অনেক জটিল প্যাঁচ ও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে তাদের ধারণা নাও থাকতে পারে। প্রয়োজনটা এ কারণেই। মন্ত্রিসভার সম্ভাব্য সম্প্রসারণ নিয়ে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে, উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি! কোনো কোনো মিডিয়ায় এমন আভাস দেওয়া হচ্ছে যে, পুনরায় দেশে কেবিনেটে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। উদ্দেশ্যÑ কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে আরও বড় দায়িত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই নাকি উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে! যদিও এর সত্যতা পওয়া যায়নি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দলের অভ্যন্তরে আরও বিতর্ক বাড়াবে। শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে, একসঙ্গে একাধিক উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে কাউকে কাউকে ‘অ্যাকোমোডেট’ করার জন্য! এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। জার্মানিতে একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী বা ভাইস চ্যান্সেলর আছেন বটে। যেহেতু তিনি কোয়ালিশনের অন্যতম অংশীদার, সেটা বিবেচনায় নিয়েই এসপিডির সভাপতিকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যেও অবশ্য একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী আছেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় কোনো উপ-প্রধানমন্ত্রী নেই। ভারতেও নেই। আমাদের সংবিধানে কোনো উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ নেই। যদি উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাউকে নিয়োগ দিতে হয়, তাহলে সংবিধানে সংশোধন আনতে হবে। সংসদে বিল আকারে তা উপস্থাপন করে পাস করাতে হবে। বলা ভালো, অতীতে বাংলদেশে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল, যা পরে অবলুপ্ত করা হয়। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও ভূমিকা বেড়েছে। ফলে বিশ্ব আসরে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে চাই দক্ষ, শিক্ষিত ও প্রতিনিধিত্বশীল একটি কেবিনেট। অযোগ্য ও বিতর্কিতদের বাদ দেওয়া হোক। আধুনিকমনস্ক একটি কেবিনেটই বাংলাদেশকে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের চেয়ে এই মুহূর্তে বড় প্রয়োজন মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করে ছোট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা।
Daily Amader Somoy
27.07.2017

চীন-ভারত সম্পর্ক কোন পথে


চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে চীন-ভারত সম্পর্ক এখন বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এ সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, দুই দেশের মধ্যে আবার যুদ্ধ হবে কি না, এসব এখন খোদ ভারতীয় মিডিয়ায়ও আলোচিত হচ্ছে। দোকা লা অঞ্চলে চীনের সড়ক নির্মাণ ও বিপুল সেনা মোতায়েনের পরিপ্রেক্ষিতে দু-দেশের মধ্যে উত্তেজনার জন্ম হয়েছে। দোকা লা মালভূমিটি ভুটান ও চীন উভয়েই নিজেদের অঞ্চল বলে দাবি করে আসছিল। সম্প্রতি ভুটান এ ব্যাপারে দিল্লির সাহায্য চাইলে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সিকিম থেকে সেখানে সেনা পাঠায়। ফলে চীন কৈলাসে যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়। এই কৈলাস হচ্ছে হিন্দু ও বৌদ্ধদের তীর্থস্থান। প্রতিবছর শত শত পুণ্যার্থী তিব্বতের মধ্যে দুর্গম অঞ্চল কৈলাসে যান। পথটি চীন বন্ধ করে দেওয়ায় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পায়; যদিও দোকা লা মালভূমিটি ভারতের নয়। তবে এ মালভূমির স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক বেশি। সীমান্তে এই উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে চীনের গণমাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারিও আমরা লক্ষ করেছি। সিকিম স্বাধীন করে দেওয়ার কথাও চীনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী চীন এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজার হাজার টন সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে। এটি যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য কি না তা নিয়েও ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেছেন সমাজবাদী দলের নেতা মুলায়ম সিং যাদব। তিনি লোকসভায় বলেছেন, ভারতের শত্রু পাকিস্তান নয়, ভারতের শত্রু চীন। লোকসভায় তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন যে ভারতের উচিত ছিল তিব্বত স্বাধীন করে দেওয়া! এ-ই যখন পরিস্থিতি এবং সীমান্ত উত্তেজনা যখন তুঙ্গে তখন ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল পেইচিং যাচ্ছেন ২৬ জুলাই। ২৭-২৮ জুলাই পেইচিংয়ে অনুষ্ঠিত ব্রিকস নিরাপত্তা ফোরামে তিনি যোগ দেবেন। সীমান্তে উত্তেজনার বিষয়টি সেখানে আলোচনা হওয়ার কথা। এখন দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ব্রিকস মুখ থুবড়ে পড়বে। অথচ পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির কারণে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিকসের গুরুত্ব বাড়ছে। চীন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি। এ অঞ্চলের দেশগুলোর উন্নয়নে চীন একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি থেকে ভারতও উপকৃত হতে পারে; যদিও ভারত এতে যোগ দেয়নি। এর পরও কথা থেকে যায়—ভারত এই বিশাল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে না।

চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০১০ সালে জিএনপির দিক থেকে জাপানকে ছাড়িয়ে যায় চীন। যেখানে ১৯৮০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান ছিল মাত্র ২.২ শতাংশ (যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ), সেখানে বলা হচ্ছে ২০২০ সালে PPP-র হিসাব অনুযায়ী (Purchasing, Price, Parity) চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। উৎপাদিত পণ্যের, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক পণ্যের দিক থেকে চীন এখন এক মহাশক্তি। বিশ্বের যত ফটোকপিয়ার, মাইক্রোওয়েভ ও জুতা উৎপাদিত হয়, তার তিন ভাগের দুই ভাগ চীন একা উৎপাদন করে। সেই সঙ্গে বিশ্বে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ৬০ শতাংশ, ডিভিডির ৫৫ শতাংশ, ডিজিটাল ক্যামেরার ৫০ শতাংশ, পারসোনাল কম্পিউটারের ৩০ শতাংশ, শিশুদের খেলনার ৭৫ শতাংশ চীন একা উৎপাদন করে। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনা পণ্যের একটি বাজার তৈরি হয়েছে। চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ তিন ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে। ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের বড় ৫০০ কম্পানির কথা উল্লেখ করেছে, যেখানে চীনের রয়েছে ৩৭টি কম্পানি। বিশ্বে যত জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে এককভাবে চীনে ব্যবহৃত হয় তার ১৬ শতাংশ। আর বিশ্বে জ্বালানি তেলের ব্যবহারের দিক থেকে তিন ভাগের এক ভাগ ব্যবহার করে চীন। এ কারণে চীনকে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশ দূষণকারী দেশ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। পরিবেশদূষণের কারণে চীনে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেড়েছে ২৯ শতাংশ। চীনে রয়েছে বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম, যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রতিবছর ২১ মিলিয়ন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়। আর প্রতিবছর তিন লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যায়। তারা ফিরেও আসে। ১৯৪৮ সালে (স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে) যেখানে চীনে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ২০ শতাংশ, এখন সেখানে ১০০ শতাংশ শিক্ষিত।
অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণে চীনে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, তাতে প্রায় ২০ কোটি মানুষকে চীন অতি দরিদ্রতম অবস্থা (প্রতিদিন জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ ডলার আয় হিসাবে) থেকে বের করে এনে কিছুটা সচ্ছলতা দিয়েছে; যদিও বলা হয়, এখনো প্রায় ২০৭ মিলিয়ন লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চীনে একদিকে যেমন ধনী ও গরিবের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখন কর্মজীবী মানুষের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। মানুষের আয় সেখানে বেশি। হাজার হাজার টাউনশিপ এখন তৈরি হয়েছে, যা বদলে দিয়েছে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনযাত্রা। চীনকে নিয়ে খারাপ খবরও আছে। যেখানে ২০০৯ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ, ২০১২ সালে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৭.৮ শতাংশে। মুদ্রাস্ফীতি ৩.৫ শতাংশ। আর শহুরে বেকারসংখ্যা ৪ থেকে ৬ শতাংশের নিচে। এই যে চীন, এই চীনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বটি এখন বর্তিয়েছে শি চিনপিংয়ের ঘাড়ে। কোন পথে এখন চীন? শি চিনপিংয়ের এজেন্ডায় রাশিয়া ও ভারতকে প্রাধান্য দিয়েও এটা সত্য, অভ্যন্তরীণ ইস্যুকে গুরুত্ব দিচ্ছে চীন। বেশ কিছু বিশ্লেষকের লেখা পড়ে যা মনে হয়েছে, তা হচ্ছে শি চিনপিং এখন প্রথমেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে। এক বিশাল দেশ চীন। প্রায় ৫৫ জাতি ও উপজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে চীন। ২২টি প্রদেশ, পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, চারটি বিশেষ অঞ্চল ও ১৪৭টি বিশেষ এলাকা নিয়ে যে চীনা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সেই রাষ্ট্রটি ভেঙেও যেতে পারে। এ কারণেই চীনা নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সতর্ক থাকছেন। যে ভুল করেছিলেন গর্বাচেভ, সেই ভুল করেননি চীনা নেতারা। সেনাবাহিনী এখনো পার্টির প্রতি অনুগত। তাই অর্থনৈতিক সংস্কারকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ফুজিয়ান, ঝে ঝিয়াং কিংবা সাংহাই প্রদেশগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক সমৃদ্ধিশালী।
চীন ও ভারত নিকট প্রতিবেশী দুটি দেশ। প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে দেশ দুটির মধ্যে এক ধরনের ‘যুদ্ধ’ থাকলেও পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির কারণে ভারতের যেমন প্রয়োজন রয়েছে চীনের সাহায্য ও সহযোগিতার, তেমনি চীনেরও প্রয়োজন রয়েছে ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতার। ব্রিকস ব্যাংক বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কর্তৃত্ব ও প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন চীন ও ভারত যদি নিজেদের মধ্যে বিরোধ অব্যাহত রাখে, তাহলে ব্রিকস ব্যাংক বিকশিত হবে না। ‘সিকিমকে স্বাধীন করার তথাকথিত যে বক্তব্য, তা-ও গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের শামিল। চীন এটা করতে পারে না। সাধারণত চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলায় না। এ ক্ষেত্রে সিকিম প্রশ্নে চীনা গণমাধ্যমের বক্তব্য ভারতের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের শামিল, যা নিন্দনীয়।
একুশ শতকে আমরা চীনকে দেখব অন্যতম এক শক্তি হিসেবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান বিশ্বের সব অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ বদলে দিয়েছে। ব্রিকসে চীন ও ভারত অন্তর্ভুক্ত হলেও এশিয়ার এই দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। ভারতে জনগোষ্ঠীর ৩৭.০২ শতাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করলেও আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। তখন সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয় ৯৪০ ডলার থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে। ২০০৭ সালে যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ শতাংশ, তখন অবদান রাখবে ১৭ শতাংশ। সুতরাং ভারতকে ফেলে দেওয়া যাবে না। তাই কোনো কোনো বিশ্লেষক (জনাথন হোলসলাগ, ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন) একটি সম্ভাব্য ‘Chindia’ ধারণার কথা বলেছিলেন, যেখানে চীন ও ভারত একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এই ধারণা অমূলক নয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনা নেতারা ভারত সফর করেছেন। সীমান্ত সমস্যা নিয়েও (অরুণাচল) এক ধরনের ‘স্থিতাবস্থা’ বিরাজ করছে। ক্ষমতা গ্রহণ করে শি চিনপিং ভারতবিরোধী তেমন কোনো কথা বলেননি। তিনি ভারত সফরও করেছেন। সদ্য সমাপ্ত জি-২০ (হামবুর্গ) সম্মেলনে শি চিনপিং-মোদির সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি উষ্ণ ছিল না। কিন্তু সাক্ষাৎকারটি না হলেই বরং নানা প্রশ্নের জন্ম দিত। এমনকি সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ারও আশঙ্কা ছিল।
চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যায় বলা মুশকিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের মতো আরেকটি ‘যুদ্ধ’ হোক, এটা বোধ করি উভয় দেশের নেতারা কেউই চাইবেন না। অজিত দোভালের পাশাপাশি পররাষ্ট্রসচিব জয়শংকরও পেইচিং যাচ্ছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে পেইচিংয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন। মোদি তখন চীনে যাবেন। আসলে উভয় দেশেই কট্টরপন্থী কিছু লোক আছে, যারা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বজায় রেখে সুবিধা নিতে চায়। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এ মুহূর্তে দোকা লা উপত্যকা থেকে উভয় দেশের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া জরুরি। এর বাইরে অন্য বিষয়গুলো আলোচনা না করাই মঙ্গল।
একদিকে অরুণাচল, অন্যদিকে কাশ্মীর—দুটি বিষয়ই খুব স্পর্শকাতর। মাঝেমধ্যে চীন অরুণাচল নিয়ে তার দাবি উত্থাপন করলেও সেখানে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রয়েছে। বিতর্কিত কাশ্মীরের ওপর দিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সড়কপথটি চলে গেছে, যা বেলুচিস্তানের গাওদারে গিয়ে শেষ হয়েছে। এই সড়কপথের ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। এ দুটি বিষয় বাদ রেখে এ মুহূর্তে সীমান্ত উত্তেজনা হ্রাস করা প্রয়োজন। সেখানে ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় থাকুক, আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি।
Daily Kaler kontho
23.07.2017

নির্বাচন কমিশন কি আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে




নির্বাচন কমিশনের দুইটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন রাজনীতিতে বড় ধরনের ‘ঝড়’ বইছে। প্রথমটি হচ্ছে কমিশন সাত দফার একটি ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়ন করেছে এবং তারা বলছে, এ ‘রোডম্যাপ’ ধরে তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নির্বাচন কমশন ডিসেম্বরের শেষে রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজন করবে এবং সেখানে দুই-একটি ওয়ার্ডে ইভিএম মেশিন পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হবে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন দেশে একটি ‘নির্বাচনী রাজনীতি’ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এ ‘রোডম্যাপ’ আর রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা কি আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে? অর্থাৎ ইসির এ কর্মকা- কি বড় রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন করেছে? প্রশ্নের জবাবটা হবে ‘না’। বিএনপি, সে সঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী অনেক পর্যবেক্ষক বলেছেন, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত ‘রোডম্যাপ’ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে বিএনপি মহাসচিব মিজা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলে আসছেন একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা, সেখানে একটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা আর সাত দফা কর্মপন্থা দিয়ে সবকিছু বিচার করা যাবে না। আস্থার যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে যদি বেরিয়ে আসা না যায়, তাহলে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মূল প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। সব দলের অংশগ্রহণ এখানে দরকার। ইসি কর্তৃক ঘোষিত সাত দফা দিয়ে তাই সবকিছু বিচার করা যাবে না কিংবা আমাদের সব প্রশ্নের জবাবও দেবে না। কতকগুলো সমস্যা তো এখানে আছেই। আওয়ামী লীগ বলে আসছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকারই’ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। সিইসির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়ে গেছে। তা তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সিইসি সব দলের আস্থা অর্জন করার কথা বলছেন বটে; কিন্তু তিনি তা কতটুকু পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারি দলের নেতারা বিএনপিবিরোধী বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। এ বিএনপিবিরোধী বক্তব্য আস্থার সম্পর্ক গড়তে কোনো অবদান রাখবে না। পত্রিকা খুললেই ইদানীং একটা কথা শোনা যায়, আর তা হচ্ছে বিএনপি যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে বিএনপি ভেঙে যাবে! যদি সত্যি সত্যিই এ ধরনের কিছু হয়, তাহলে এর দায় কি কিছুটা হলেও সিইসির ওপর বর্তাবে না? ৭০ বছর বয়সেও সিইসিকে শক্তসামর্থ্য বলেই মনে হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে তো প্রশ্ন একটা থাকলোই সিইসি হিসেবে তার এ নিযুক্তি তাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে কিনা? একটি কঠিন ‘জায়গায়’ তিনি এসেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার অতীত-সংশ্লিষ্টতা কতটুকু ছিল, তা তিনি জানেন। এখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে ব্যর্থ হলে তার সম্মান আরও বাড়বে না, বরং আরও কমবে।নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে আমরা ‘খাদের কিনারে’ নিয়ে গেছি। অনেকটা ‘ধাক্কা’ দিলেই গভীর খাদে পড়ে যাবে! আমরা সে ধরনের একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। এর আগে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও (ষষ্ঠ সংসদ) কিন্তু সে ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সে ‘পরিস্থিতি’ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) কিংবা নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ সেখানে নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে এটা বলা হয়, বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) অংশ না নেয়ায় নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই ছিল না। সাবেক সিইসি তার শেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছিলেন। এ নিয়ে গেল সাড়ে ৩ বছরে অনেক কথাই হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। জাতিও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সংবিধানের ১২৩(৪) ধারায় যে কথাটা উল্লেখ আছে, সে কথাটাও সত্য। এ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘দৈবদুর্বিপাকের কারণে এই দফায় নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান (যদি) সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ তবে এখানে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’ এর মতে কথাটা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশন যদি মনে করেন ‘দৈবদুর্বিপাকের’ কারণে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়! সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ এটা মনে করেননি। তাই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে, যা জাতিকে আরও ‘বিভক্ত’ করেছে এবং যা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারছি না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ‘নির্বাচন বয়কট’ কিংবা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি ‘দৈবদুর্বিপাকের’ শঙ্কার আওতায় পড়ে কিনা? এর জন্য সিইসি উচ্চ আদালতের একটি ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। এখন আমরা এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, সিইসি এ বিষয়ে যত কম কথা বলবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা চাই সামনের দিকে তাকাতে। আমরা চাই ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তাই সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সে ‘দায়িত্ব’ সিইসি কীভাবে পালন করেন, তার অপেক্ষায় থাকলাম। তবে একটা বিষয়ে বোধহয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহুমন্ত্রী বারবার বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের ৩ মাস আগে যে সরকার থাকবে, তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকারপ্রধান থাকলে সে সরকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিএনপি সে প্রশ্নটিই তুলেছে। এটা ঠিক, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ওই সরকারে যোগ দেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কি বিএনপিকে সে ধরনের একটি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ২০১৪ সালে বিএনপি পার্লামেন্টে ছিল; কিন্তু এখন তো তারা পার্লামেন্টে নেই। তাহলে মন্ত্রিসভায় বিএনপি অন্তর্ভুক্ত হবে কীভাবে? নাকি বিএনপিকে বাদ দিয়েই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে? বিএনপিকে যে আমন্ত্রণ জানানো হবে না, এ কথাটা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, যেহেতু অতীতে বিএনপি এ ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, সুতরাং এখন আর সে সুযোগ নেই। যদিও আমি তোয়ায়েল আহমেদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাই না। তিনি মন্ত্রী বটে; কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ নন। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে অন্য কারও বলার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে আছে পুরো জাতি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নির্বাচনের আগে দুইটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা আস্থার সম্পর্ক। যদি আস্থার সম্পর্ক স্থাপিত না হয়, তাহলে রোডম্যাপ কিংবা রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আয়োজন করে কিছু হবে না। রোডম্যাপ হচ্ছে রুটিন ওয়ার্ক। এটা প্রতিটি নির্বাচন কমিশনকে দিতে হয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও দিয়েছে। ধরে নিচ্ছি, তারা নির্বাচনটা ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ নিশ্চিত করতে চান। এটি নিশ্চিত করতে হলে সব দলকে সমান সুযোগ দিতে হবে। সরকারি দল বেশি সুযোগ পাবে, অন্যদল তেমন সুবিধা পাবে না, অথবা তাদের আদৌ কোনো সুযোগ দেয়া হবে না, এটা তো হতে পারে না। এটা বৈসাদৃশ্য। এতে নির্বাচনের মূল স্পিরিট ভ-ুল হবে। নির্বাচনের আগে যে সমান সুযোগের কথা বলা হয়, যে লেভেলপ্লেয়েং ফিল্ডের কথা বলা হয়, তা তো নিশ্চিত হবে না। নিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্বটিই নির্বাচন কমিশনের ওপর। ইসির রোডম্যাপে সেটি নিশ্চিত হয়নি। ইসি যে রোডম্যাপ দিয়েছে, তা কাগুজে এবং রুটিন ওয়ার্ক। যেমন বলা যেতে পারে, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, বিধিবিধান অনুসারে ভোট কেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা ইত্যাদি। এতে নতুনত্ব কই? এতে আস্থার সম্পর্কইবা স্থাপিত হবে কীভাবে? এগুলো সবই রোডম্যাপের অন্তর্ভুক্ত। এ রোডম্যাপে হুদা কমিশন কী দেবে জাতিকে? ৩১ জুলাই থেকে ইসি সুধী সমাজের সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে। এ সংলাপ ইসিকে কী দেবে? একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সুধী সমাজের বক্তব্য আমরা মোটামুটিভাবে জানি। সুধী সমাজও অনেকটা বিভক্ত। এক দল বিএনপিকে সমর্থন করে (যদিও তাদের সংখ্যা কম), আরেক দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বুদ্ধিজীবী কি জাতিকে কিছু দিতে পারবে? সুধী সমাজ নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসিকে একটা ‘সমঝোতায়’ যেতে হবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসির সাত দফাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বড় আলোচনায় যাওয়ার সুযোগ নেই। মূল আলোচনা হতে হবে বিএনপির সঙ্গে। এক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। যদিও এটা সত্য, ‘সহায়ক সরকার’ এর যে কথা বিএনপি বলে আসছে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন নয়। তবে দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নিতে পারে নির্বাচন কমিশন। এটা কঠিন কিছু নয়। সিইসির আর জীবনে পাওয়ার কিছু নেই। পূর্ণ সচিব না হয়েও কিংবা সচিব হিসেবে সচিবালয়ে কাজ না করেও তিনি সিইসি হয়েছেন। থাকবেন ৫ বছর। এরপর তো তার আর পাওয়ার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু জাতি তাকে মনে রাখবে যদি তিনি দুইটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক গড়ার উদ্যোগ নেন। একমাত্র তার আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি আদৌ এ উদ্যোগটি নেবেন কিনা? সবসময় সংবিধানের দোহাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সাংবিধানিকভাবে সরকারের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সরকারি দলের জন্য এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। তারপরও ‘যে কোনো ফর্মুলায়’ বিএনপিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে আনতে হবে। এরই মধ্যে আদালতের অনুমতি না নিয়ে খালেদা জিয়া দেশ ছেড়েছেন বলে দুদক আদালতের কাছে আরজি জানিয়েছে। খালেদা জিয়ার লন্ডন গমন নিয়ে মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ ধরনের কথাবার্তা না বলাই মঙ্গল। আমরা চাই আস্থার সম্পর্ক। এ আস্থার সম্পর্কই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। সাত দফা ‘রোডম্যাপ’ কিংবা রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে তা নিশ্চিত করা যাবে না।
নির্বাচন কমিশনের দুইটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন রাজনীতিতে বড় ধরনের ‘ঝড়’ বইছে। প্রথমটি হচ্ছে কমিশন সাত দফার একটি ‘রোডম্যাপ’ প্রণয়ন করেছে এবং তারা বলছে, এ ‘রোডম্যাপ’ ধরে তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নির্বাচন কমশন ডিসেম্বরের শেষে রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজন করবে এবং সেখানে দুই-একটি ওয়ার্ডে ইভিএম মেশিন পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হবে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন দেশে একটি ‘নির্বাচনী রাজনীতি’ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এ ‘রোডম্যাপ’ আর রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা কি আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে? অর্থাৎ ইসির এ কর্মকা- কি বড় রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন করেছে? প্রশ্নের জবাবটা হবে ‘না’। বিএনপি, সে সঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী অনেক পর্যবেক্ষক বলেছেন, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত ‘রোডম্যাপ’ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে বিএনপি মহাসচিব মিজা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলে আসছেন একটি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা, সেখানে একটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ঘোষণা আর সাত দফা কর্মপন্থা দিয়ে সবকিছু বিচার করা যাবে না। আস্থার যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে যদি বেরিয়ে আসা না যায়, তাহলে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মূল প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। সব দলের অংশগ্রহণ এখানে দরকার। ইসি কর্তৃক ঘোষিত সাত দফা দিয়ে তাই সবকিছু বিচার করা যাবে না কিংবা আমাদের সব প্রশ্নের জবাবও দেবে না। কতকগুলো সমস্যা তো এখানে আছেই। আওয়ামী লীগ বলে আসছে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকারই’ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। সিইসির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়ে গেছে। তা তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সিইসি সব দলের আস্থা অর্জন করার কথা বলছেন বটে; কিন্তু তিনি তা কতটুকু পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারি দলের নেতারা বিএনপিবিরোধী বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। এ বিএনপিবিরোধী বক্তব্য আস্থার সম্পর্ক গড়তে কোনো অবদান রাখবে না। পত্রিকা খুললেই ইদানীং একটা কথা শোনা যায়, আর তা হচ্ছে বিএনপি যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে বিএনপি ভেঙে যাবে! যদি সত্যি সত্যিই এ ধরনের কিছু হয়, তাহলে এর দায় কি কিছুটা হলেও সিইসির ওপর বর্তাবে না? ৭০ বছর বয়সেও সিইসিকে শক্তসামর্থ্য বলেই মনে হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে তো প্রশ্ন একটা থাকলোই সিইসি হিসেবে তার এ নিযুক্তি তাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে কিনা? একটি কঠিন ‘জায়গায়’ তিনি এসেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার অতীত-সংশ্লিষ্টতা কতটুকু ছিল, তা তিনি জানেন। এখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে ব্যর্থ হলে তার সম্মান আরও বাড়বে না, বরং আরও কমবে।
Daily Alokito Bangladesh
23.07.2017

এই ম্যাপে সুষ্ঠু নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে কি?



গত ১৬ জুলাই নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে। এ রোডম্যাপ প্রকাশের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন বাহ্যত একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিল। কিন্তু যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, এ রোডম্যাপ কি একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারবে? কিংবা কতটুকু নিশ্চিত হবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড? এক সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে প্রশ্ন ছিল বিএনপির। সিইসি কেএম নুরুল হুদার আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আপত্তি তুলেছিল বিএনপি। যদিও সেই আপত্তি আর থাকেনি। বর্তমান সিইসির সঙ্গে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল দেখাও করেছিল। তবে ঘোষিত রোডম্যাপ বিএনপির আস্থা অর্জন করতে পারেনি। অন্তত দলটির মহাসচিবের বক্তব্য যাচাই করে তাই মনে হয়েছে আমার।

যে প্রশ্নের কোনো সমাধান হয়নি তা হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য। এক্ষেত্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বেগম জিয়া লন্ডন থেকে ফিরে এসে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবেন। আর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনাই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন, যাতে আপত্তি রয়েছে বিএনপির। তবে সংবিধানে নির্বাচনের আগে তিন মাসের জন্য একটি সরকারের ধারণা দেয়া আছে। এটা ঠিক, সংবিধানে স্পষ্ট করে কোথাও নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে কোনো কথা বলা হয়নি। ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’ এর ব্যাখ্যা কী? একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীই স্বপদে বহাল থাকবেন। অর্থাৎ নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত (একাদশ সংসদে যার দল বিজয়ী হবে, রাষ্ট্রপতি তাকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানাবেন) বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বপদে থেকে যাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, এ ধরনের কথা সংবিধানের কোথাও লেখা নেই। সংবিধানের ১১৯(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ‘সংসদ সদস্যের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন।’

সংবিধানের একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে, ১২৩(৪) অনুচ্ছেদে নির্বাচনের জন্য ‘সংসদ ভাঙ্গিয়া যাবার ৯০ দিনের মধ্যে’ একটি কথা বলা আছে বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা কী হবে, তিনি নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনারের কাছে হস্তান্তর করবেন কিনা, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন।’ এবং ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।’ অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের কথাবার্তা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। নির্বাচন কমিশন কখনই স্বাধীন নয়। এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কখনই নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে না। বরং স্থানীয় পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা থাকেন (ডিসি, টিএনও ইত্যাদি), তারা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অর্থাৎ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কথা শোনেন। কাগজ-কলমে আছে, ওই তিন মাস তারা নির্বাচন কমিশনের কথা শুনবেন। কিন্তু তা তারা শোনেন না। তাহলে এখন ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখেই ২০১৯ সালের জানুয়ারির ৩ মাস আগেই নির্বাচনটি হবে (একাদশ সংসদ নির্বাচন)। প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে যা করতে পারেন (২০১৪ সালেও তিনি তা করেছিলেন) তা হচ্ছে, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ছোট সরকার তিনি গঠন করতে পারেন। তবে তিনি বাধ্য নন। সংবিধান অনুযায়ী তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তবে তিনি কাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, এ সিদ্ধান্তটি এককভাবেই প্রধানমন্ত্রীর। এ ক্ষেত্রে তিনি যদি মনে করেন নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত, তিনি সেটি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করারও প্রয়োজন নেই। তার আন্তরিকতাটাই হল আসল। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন তিনি। যেহেতু বিএনপি সংসদে নেই, তাই ৩ থেকে ৪টি সংসদীয় আসনে তিনি উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেন। এবং বিএনপি প্রার্থী উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে- যারা মন্ত্রিসভায় যোগ দেবেন, তারা নিরপেক্ষতার স্বার্থে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। একটি ছোট মন্ত্রিসভা (১০ সদস্যবিশিষ্ট) থাকবে। এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো থেকেই তাদের নেয়া হবে।

আর একটা কথা। জাতীয় পার্টি নিয়ে একটা অস্পষ্টতা আছে। দলটি বিরোধী দলে, নাকি সরকারি দলে এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যদি জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে সরকার দেখতে চায়, তাহলে দলটিকে বিরোধী দল হিসেবেই চলতে দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভায় তারা থাকতে পারবেন না। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারে তারা থাকতে পারেন। জাতীয় পার্টিকে ১৪ দলেও নেয়া যেতে পারে প্রয়োজনে। একদিকে সরকারে, অন্যদিকে বিরোধী দলে, এভাবে থাকার ফলে জাতীয় পার্টির যে সম্ভাবনা ছিল, তা নষ্ট হওয়ার পথে। জাতীয় পার্টি বিএনপির বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারত। সেটি হয়নি। এইচএম এরশাদ যদি বিরোধী দলের নেতা হতেন, আমার ধারণা, সেই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়ত। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি। একটি ব্যক্তিগত ইমেজ তার আছে। উপরন্তু তার নামেই জাতীয় পার্টি চলে। উত্তরাঞ্চলে তার নামের কারণেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ব্যক্তিগত ইমেজে এভাবে বিজয়ী হওয়া যেত না বলেই মনে হয়। সুতরাং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন- জাতীয় পার্টি সরকারি দলে থাকবে, নাকি বিরোধী দলে।

এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফ্ট পাওয়ার’ হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেনে’ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এই যে ‘অর্জন’, এই অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই আস্থার সম্পর্ক শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গলজনক নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন।

সাধারণ মানুষ চায় দুই বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি বিরল। নির্বাচনের বাকি আছে আরও কমপক্ষে ১৭ মাস। কিন্তু এরই মাঝে দুই বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখছেন। ফলে আস্থার যে ঘাটতি ছিল তা রয়েই গেছে। এ আস্থার ঘাটতি নিয়ে ইসি কীভাবে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে? গত ১৬ জুলাই সিইসি যেসব বক্তব্য রেখেছেন, তাতেও এই আস্থা নিশ্চিত হয়নি। একটি রোডম্যাপ দেয়া হয়েছে। এটি মূলত একটি রুটিন ওয়ার্ক। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই ইসিকে এ ধরনের কর্মসূচি দিতে হয়। এটি ইসির কাজেরই অংশ। এতে নতুনত্ব কিছু নেই। যেমন বলা যেতে পারে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, বিধিবিধান অনুসারে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা ইত্যাদি। এতে নতুনত্ব কই? এতে করে আস্থার সম্পর্কই বা স্থাপিত হবে কীভাবে? এগুলো সবই রোডম্যাপের অন্তর্ভুক্ত। এ রোডম্যাপ নিয়ে হুদা কমিশন কী দেবে জাতিকে?

আগামী ৩১ জুলাই থেকে ইসি সুধী সমাজের সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে। এ সংলাপ ইসিকে কী দেবে? একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সুধী সমাজের বক্তব্য আমরা মোটামুটিভাবে জানি। সুধী সমাজও অনেকটা বিভক্ত। একদল বিএনপিকে সমর্থন করে (যদিও তাদের সংখ্যা কম), আরেক দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব বুদ্ধিজীবী কি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন? এ বুদ্ধিজীবীরা, যাদের মধ্যে সরকারি দলের সমর্থক বেশি, তারা অপেক্ষায় থাকেন কখন তাদের ডাক পড়বে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো একটির উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে!

আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ ওই একই দিন অর্থাৎ ১৬ জুলাই, একদিন সময় না নিয়েই বললেন, রোডম্যাপ ভালো হয়েছে, সুন্দর হয়েছে। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বললেন, রোডম্যাপ কোনো সমাধান নয়, দরকার নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। এখন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তো কমিশনের সংলাপে গিয়ে দলীয় কথাই বলবেন। এ থেকে তাহলে কী পাবে নির্বাচন কমিশন? কিছুই না।

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। এতে করেইবা কী পাবে নির্বাচন কমিশন? নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪২। এর মধ্যে ৩ থেকে ৪টি দল বাদে অন্য দলগুলোর কোনো গণভিত্তি নেই। এসব ছোট ছোট দল বড় দল দুটির অপেক্ষায় থাকে। তাদের সংসদে যাওয়ার পথ একটাই- হয় নৌকা মার্কা, না হয় ধানের শীষ। কোনো একটি দলের প্রধান, যিনি ১৪ দলে আছেন, তিনি তার মার্কা নিয়ে জীবনে কোনো নির্বাচনেই ৫০০ ভোটও পাননি। তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন বটে, তবে এসব কাগুজে সংগঠন তাদের নিজেদের স্বার্থে জোটে ‘আশ্রয়’ নেয়। কাজেই এসব কাগুজে সংগঠনের সঙ্গে সংলাপ করে কী লাভ? সংলাপ করতে হবে মূলত তিনটি দলের সঙ্গে- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। কারণ বিগত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোতে এ তিনটি দলই বড় আসন পেয়েছে। জামায়াতের একটি ভোটব্যাংক রয়েছে বটে, কিন্তু নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় তারা ২০ দলীয় জোটে থাকলেও আসন বণ্টনের প্রশ্নে তাদের প্রতিনিধিত্ব কীভাবে নিশ্চিত হবে, এটা বেগম জিয়া এখনও খোলাসা করেননি।

আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে কিনা, সে ব্যাপারেও এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। সিইসি বলেছেন, ‘এখনও ইভিএম বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়নি’। এর অর্থ কী? ইভিএম ব্যবহার হতে পারে? ইভিএম নিয়ে বিতর্ক আছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সব রাজ্যের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয় না। ভারতেও সর্বত্র ব্যবহার হয় না। কাজেই ‘বিতর্ক এড়াতে’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না হওয়াই মঙ্গল।

রোডম্যাপ উপস্থাপনকালে সিইসির একটি বক্তব্য ছিল এরকম- ‘আমরা সবার প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বদ্ধপরিকর এবং আমরা তা করতে পারব।’ সিইসির এ আশাবাদকে আমি ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু তার একটা ‘অতীত’ আছে। এ নিয়ে কম ‘পানি ঘোলা’ হয়নি। কিন্তু সেসব ‘অভিযোগ’ও এখন অতীত। ইতিহাসের এক কঠিন সময়ে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে, নিরপেক্ষতার সঙ্গে এবং প্রভাবমুক্ত থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি যদি পরিচালনা করতে না পারেন, তাহলে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না। তিনি ওয়াদা করেছেন, তিনি ‘প্রভাবমুক্ত’ থাকবেন এবং নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনটি পরিচালনা করবেন। সংবিধান তাকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। সেই ক্ষমতা তিনি কতটুকু প্রয়োগ করতে পারবেন- সেটিই হচ্ছে মোদ্দা কথা। এটা করতে হলে তাকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় নিতে হবে। আমরা ২০১৪ সালের জানুয়ারির ঘটনা ভুলে যেতে চাই। আমরা চাই না ওরকম আরেকটি ‘ঘটনা’ ঘটুক। সংবিধানের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না, এটা সত্য। সেই সঙ্গে এটাও আকাক্সক্ষা, সংবিধান যেন আস্থার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। আমরা চাই এমন একটি নির্বাচন, যে নির্বাচন নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারব এবং তা আগামী নির্বাচনের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
Daily Jugantor
22.07.2017

সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসির রোডম্যাপ কতটুকু গ্রহণযোগ্য



নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করার পর যেসব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, তাতে করে একটা বড় প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে আর তা হচ্ছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে ইসির এই রোডম্যাপ কতটুকু গ্রহণযোগ্য। বিএনপি হয়ত রাজনৈতিক বিবেচনায় একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। কিন্তু যারা আদৌ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেব যাদের নাম-ডাক আছে, তাদের মন্তব্য থেকে এটাই আমার কাছে প্রতীয়মাণ হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যে ৭ দফা কর্ম পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে, তা গ্রহণযোগ্য ও সকল দলের অংশগ্রহণের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রথমত একটি 'লেভেল প্লেইং ফিল্ড' নিশ্চিত করার জন্য যে ধরনের কর্মসূচি নেয়া দরকার, তা এই ৭ দফাতে নেই। দ্বিতীয়ত, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক। বড় দলগুলো নেতারা যদি পরস্পরকে আক্রমণ করে তাদের বক্তব্য রাখা অব্যাহত রাখেন, তাহলে নির্বাচনের আগে সুস্থ পরিবেশ বিরাজ করবে না। আরও হানাহানি হবে। ইসি একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করতে পারত। কিন্তু ৭ দফাতে এ সংক্রান্ত কিছু নেই। তৃতীয়ত, ইসির ৭ দফায় যা আছে, তা মূলত একটি রুটিন ওয়ার্ক। নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সংসদীয় এলাকা পুনর্নির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন দলের নিবন্ধন এসবই তো রুটিন কাজ। নতুন তো কিছু নেই। তাহলে এই রোডম্যাপ নিয়ে আশাবাদী হই কীভাবে? চুতর্থত, ইসি সুধী সমাজ ও রানৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবেন। এই সংলাপ তো অর্থহীন। কেননা সুধী সমাজ নির্বাচন নিয়ে যা বলে আসছে, তা তো ইসির অজানা নয়। তারা সেইসব বক্তব্য যদি বিবেচনায় নিতেন, তাহলে ৭ দফায় তা অন্তর্ভুক্ত হতা; কিন্তু তা হয়নি। উপরন্তু নিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। তাতে 'ফটোসেশন' ছাড়া আর কী লাভ? ৪২ দল নিবন্ধিত। এদের সবার নিজস্ব কার্যালয় আছে কি? শুধু সরকারি দল নয়, সব বিরোধী দলগুলোকে আস্থায় নিতে হবে ইসির। সরকারের প্রভাবের বাইরে থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশন কতটুকু স্বাধীন, এটা নিয়ে জনমানসে প্রশ্ন আছে।
আমাদের সংবিধানে ১১৮(৪) ধারায় বলা আছে স্পষ্ট করে 'নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন' এবং সংবিধানের ১২৬ এ বলা আছে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে মহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। অতীত অভিজ্ঞতা বলে এ ধরনের কথাবার্তা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ নির্বাচন কমিশন কখনই স্বাধীন না। এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কখনই নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে না। বরং স্থানীয় পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা থাকেন (ডিসি, টিএনও ইত্যাদি), তারা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অর্থাৎ স্টাবলিশমেন্ট মন্ত্রণালয়ের কথা শোনেন। কাগজ কলমে আছে ওই তিনমাস তারা নির্বাচন কমিশনের কথা শুনবেন। কিন্তু তা তারা শোনেন না। তাহলে এখন ব্যাপারটা কী দাড়াচ্ছে? বর্তমান সরকার, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখেই-২০১৯ সালের জানুয়ারির ৩ মাস আগেই নির্বাচন হবে (একাদশ সংসদ নির্বাচন) প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে যা করতে পারেন (২০১৪ সালেও তিনি তা করেছিলেন) তা হচ্ছে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ছোট্ট সরকার তিনি করতে পারেন। তবে তিনি বাধ্য নন। সংবিধান অনুযায়ী তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। তবে তিনি কাকে কাকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, এই সিদ্ধান্তটি একান্তাভাবেই প্রধানমন্ত্রীর। এক্ষেত্রে তিনি যদি মনে করেন নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত, তিনি সেটি পারেন। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করারও প্রয়োজন নেই। তার আন্তরিকতা হলো আসল। এখন প্রধানমন্ত্রীই পারেন একটি উদ্যোগ নিতে। অতীতেও তিনি নিয়েছিলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও তিনি বিএনপিকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দিতে চেয়েছিলেন এবারেও তিনি তেমনটি করবেন কি-না জানি না; কিন্তু সিনিয়ার মন্ত্রীরা নানা কথা বলছেন। আতঙ্ক ছড়ানোর মতো কথাও তারা বলছেন। গত ১৬ জুলই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেছেন, নির্বাচনে জয়ী না হলে পরিস্থিতি ২০০১ সালের চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে (যুগান্তর, ১৭ জুলাই)। এভাবে জয়ী না হলে কথাটা বলা কতটুকু সঠিক হয়েছে, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমি দেব না। কিন্তু এ ধরনের কথা বলা কর্মীদের একটা ভিন্ন ম্যাসেজ পেঁৗছে দিতে পারে। জয়ী হওয়ার জন্য কর্মীরা তৎপর হয়ে উঠতে পারে। সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তখন দলীয় কর্মীরা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা তো আমরা বিগত নির্বাচনগুলোতে দেখেছি। 'ভোট কেন্দ্র দখল' 'সিলমারা সংস্কৃতি' থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি ও কথা নিশ্চয়ই মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বিশ্বাস করেন না। মূল বিষয় হচ্ছে একটাই আর তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক স্থাপন। দলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে দু'টো বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যদি আস্থার সম্পর্ক স্থাপিত না হয়, তাহলে রোড়ম্যাপ দিয়ে কিছু হবে না। রোডম্যাপ হচ্ছে একটি রুটিন ওয়ার্ক। এটা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হয়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও দিয়েছে। ধরে নিচ্ছি তারা নির্বাচনটা সকল দলের অংশগ্রহণে নিশ্চিত করতে চান। এটি নিশ্চিত করতে হলে সব দলে সমান সুযোগ দিতে হবে। সরকারি দল বেশি সুযোগ পাবে, অন্য দল তেমন সুমিষ্ট পাবে না, অথবা তাদের আদৌ কোনো সুযোগ দেয়া হবে না, এটা তো হতে পারে না। এটা বৈসাদৃশ্য। এতে করে নির্বাচনের মূল স্পিরিট ভ-ুল হবে। নির্বাচনের আগে যে সমান সুযোগের কথা বলা হয়, যে লেভেল প্লেইং ফিল্ডের কথা বলা হয় , তা তো নিশ্চিত হবে না। নিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্বটিই নির্বাচন কমিশনের ওপর। ইসির রোডম্যাপে সেটি নিশ্চিত হয়নি। ইসি যে রোডম্যাপ দিয়েছে, তা কাগুজে এবং রুটিন ওয়ার্ক। যেমন বলা যেতে পারে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, বিধি বিধান অনুসারে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা ইত্যাদি। এতে নতুনত্ব কৈ? এতে করে আস্থার সম্পর্কইবা স্থাপিত হবে কীভাবে? এগুলো সবই রোডম্যাপের অন্তর্ভুক্ত। এই রোডম্যাপ হুদা কমিশন কী দেবে জাতিকে?
আগামী ৩১ জুলাই থেকে ইসি সুধী সমাজের সঙ্গে সংলাপ শুরু করছে। এই সংলাপ ইসিকে কী দেবে? একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সুধী সমাজের বক্তব্য আমরা মোটামুটিভাবে জানি। সুধী সমাজও অনেকটা বিভক্ত। এক দল বিএনপিকে সমর্থন করে (যদিও তাদের সংখ্যা কম) আর একদল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। প্রশ্ন হচ্ছে এসব বুদ্ধিজীবী কী দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন? এসব বুদ্ধিজীবী, যাদের মাঝে সরকারি দলের সমর্থক বেশি তারা অপেক্ষায় থাকেন কখন তাদের ডাক পড়বে। ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো একটির উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ ওই একইদিন, অর্থাৎ ১৬ জুলাই, একদিন সময় না নিয়েই, বললেন রোডম্যাপ ভালো হয়েছে। সুন্দর হয়েছে। আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলও বললেন রোডম্যাপ কোনো সমাধান নয়। দরকার নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। এখন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তো কমিশনের সংলাপে গিয়ে দলীয় কথাই বলবেন। এ থেকে তাহলে কী পাবে নির্বাচন কমিশন? কিছুই না। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও সংলাপ করবেন ইসি। এতে করেও বা কী পাবে নির্বাচন কমিশন? নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংখ্যা ৪২টি। এর মাঝে ৩ থেকে ৪টি দল বাদে অন্য দলগুলোর কোনো গণভিত্তি নেই। এসব ছোট ছোট দল বড় দল দুটোর আশ্রয়ে থাকে। সংসদে যাবার যে গণভিত্তি, তা তাদের সেই। একটি দৃষ্টান্ত দেই। ইসিতে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের মতো 'দল'। এগুলোকে কী আমরা রাজনৈতিক দল বলব, নাকি একটি 'পাড়া কমিটি' বলব, আমি তাতে সন্দিহান। ছোট ছোট দলের সুবিধা অনেক। বড় দলের সঙ্গে জোট বাধা যায়। চাইলে কী মন্ত্রী হওয়া যায়। এমন একজন মন্ত্রীকে তো আমরা চিনি, যিনি নিজে সব নির্বাচনে অংশ নিয়েও ৫০০ ভোটের ওপরে পাননি কোনোদিন, জামানত হারিয়েছেন বারবার; কিন্তু মন্ত্রী হয়েছিলেন। আর মন্ত্রী হয়ে পূর্বাচলে ৭টি প্লট নিয়েছিলেন, এ খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। তার দলও নিবন্ধিত। প্রশ্ন হচ্ছে এদের সঙ্গে সংলাপ করে কী লাভ? এরা সংবাদপত্র অংশ নিয়ে মিডিয়ার সংবাদে পরিণত হবে, ফটোসেশন হবে। কিন্তু এতে করে সব দলের অংশগ্রহণ কী নিশ্চিত হবে? বড় দলগুলো কী নির্বাচনে অংশ নেবে?
ইভিএম মেশিন আগামী নির্বাচনে ব্যবহৃত হবে কিনা সে ব্যাপারেও এক ধরনের ধোয়াশা রয়েছে। সিইসি বলেছেন এখনও ইভিএম মেসিন বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়নি। এর অর্থ কী? ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হতে পারে? ইভিএম মেশিন নিয়ে বিতর্ক আছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও সব রাজ্যের নির্বাচনে ইভিএস মেশিন ব্যবহৃত হয় না। ভারতেও সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না ফলে বিতর্ক এড়াতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত না হওয়াই মঙ্গল। রোড ম্যাপ উপস্থাপনকালে সিইসির একটি বক্তব্য ছিল এরকম 'আমরা সবার প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বদ্ধপরিকর এবং আমরা তা করতে পারব। সিইসির এই আশাবাদকে আমি ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু তার একটা অতীত আছে। এ নিয়ে কম পানি ঘোলা হয়নি। কিন্তু সে সব অভিযোগও এখন অতীত। ইতিহাসের এক কঠিন সময়ে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন নিষ্ঠার সঙ্গে নিরপেক্ষতার সঙ্গে এবং প্রভাবমুক্ত থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি যদি পরিচালনা করতে না পারেন তাহলে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না। তিনি ওয়াদা করেছেন। সংবিধান তাকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। সেই ক্ষমতা তিনি কতটুকু যোগ করতে পারবেন সেটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। এটা করতে হলে তাকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে আস্থায় দিনে হবে। আমরা ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা ভুলে যেতে চাই। আমরা চাই না এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটুক। সংবিধানের বাইরে তিনি যেতে পারবেন না, এটা সত্য। সেই সঙ্গে এটাও সত্য সংবিধান যেন আস্থার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে।
আমরা চাই এমন একটি নির্বাচন যে নির্বাচন নিয়ে গর্ব করতে পারি এবং যা আগামী নির্বাচনের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব অনেক, শুধু রোডম্যাপ দিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সিইসি অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সেমিনার করার ব্যাপারে যে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা, সে ব্যাপারে এখনো তাদের করার কিছু নেই বলে তারা জানিয়েছেন। এটাও সত্য নয়। নির্বাচন কমিশন এখনই একটা অলিখিত বিধিনিষেধ জারি করতে পারে। শুরুটা করতে হবে এখনই। দেড় বছর পর নির্বাচন। কিন্তু দোষারোপের রাজনীতি আর পরস্পরকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। রোডম্যাপ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন মূলত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে এক ধাপ এগিয়ে গেল। কিন্তু যেতে হবে অনেক দূর। কাজটি ইসির জন্য যে খুব সহজ, তা বলা যাবে না।
Daily Jai jai Din21.07.2017

ট্রাম্প বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?



মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন কিংবা মার্কিন সমাজের জন্য কী মেসেজ তিনি দিচ্ছেন? সম্প্রতি তার একাধিক সিদ্ধান্ত তাকে যেমন বিতর্কিত করেছে, তেমনি তার পরিবারের সদস্যরা প্রেসিডেন্সির ভাবমূর্তিও নষ্ট করেছেন। ছয়টি আরব তথা মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা তিনি জারি করেছিলেন, তা একাধিক আদালতে বাতিল ঘোষিত হলেও শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের এক আদেশে সে নিষেধাজ্ঞার আংশিক বাস্তবায়নে তিনি সফল হয়েছেন। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই, ডোনাল্ড ট্রাম্প কম গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেছিলেন। জানুয়ারিতে (২০১৭) তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল শতকরা ৪০ ভাগ। অথচ ওবামা যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন (২০০৯), তখন তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল ৭৯ ভাগ। আর বুশের (২০০১) ছিল ৬২ ভাগ, ক্লিনটনের (১৯৯৩) ৬৮ ভাগ। আর গেল জুনে অর্থাৎ দায়িত্ব নেয়ার ৫ মাস পরও একটি পরিসংখ্যান আমরা দিতে পারি। পিউ রিসার্চের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, শতকরা ৩৯ ভাগ মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের কর্মকা- সমর্থন করছেন; অন্যদিকে ৫৬ ভাগ সমর্থন করছেন না। নির্বাচকম-লীর ভোটে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন সত্য; কিন্তু তিনি ৫ মাস পরও তার বিশ্বাসযোগ্যতার স্তর বাড়াতে পারেননি। পিউ রিসার্চের গবেষণায় উঠে এসেছে অতীতে প্রেসিডেন্টদের ওপর আস্থা রখার বিষয়টিও। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যখন দায়িত্ব নেন (১৯৯৩) তার ১ মাস পর ৬৩ ভাগ মানুষ তার ওপর আস্থা রেখেছিল। বুশের (২০০১) ওপর ৬০ ভাগ, ওবামার (২০০৯) ওপর ৭৬ ভাগ মানুষের আস্থা ছিল (ট্রাম্পের মাত্র ৩৯ ভাগ)। প্রথমে সাতটি মুসলমান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তিনি নির্বাহী আদেশ বলে জারি করেছিলেন। ইরাককে তিনি পরে এ তালিকা থেকে বাদ দেন। আদালত ওই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প বিষয়টি নিয়ে গিয়েছিলেন সুপ্রিমকোর্টে। সেখানে তিনি আংশিক বিজয়ী হন। ট্রাম্প থেমে থাকেননি। ট্রাম্প প্রশাসন নতুন একটি অভিবাসন নীতিমালার ব্লুপ্রিন্ট প্রকাশ করেছে। ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি থেকে ইস্যু করা দুইটি মেমোয় উল্লেখ করা হয়েছে, অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বের করে দেয়া হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। নতুন এ অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিমালা বা নির্দেশনামাকে দেখা হচ্ছে নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। এর অর্থ হচ্ছে ট্রাম্প অভিবাসনসংক্রান্ত তার অবস্থান থেকে এতটুকুও সরে আসছেন না। এরই মধ্যে তার দুই মন্ত্রী মেক্সিকো গেছেন এবং অবৈধ মেক্সিকান অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো নিয়ে কথা হয়েছে। ইউরোপে ট্রাম্পবিরোধী জনমত বাড়ছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
গেল জানুয়ারিতে ডাভোসে যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলন হয়ে গেল, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেখানে একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন মডেলের একটি সম্পর্ক শুরু করতে চায় বেইজিং। যদিও এ নয়া সম্পর্ক নিয়ে শি জিনপিং বিস্তারিত কিছু বলেননি, তবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যে আগামীতে অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে থাকবে, সে ব্যাপারে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। এরই মধ্যে ইউরোপ এমনকি জার্মানি সম্পর্কে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তা তাকে আরও বিতর্কিত করেছে। জার্মানিতে ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে সে দেশে আশ্রয় দেয়ার ঘটনাকে ট্রাম্প আখ্যায়িত করেছিলেন ‘সর্বনাশা ভুল’ হিসেবে। জার্মানরা এটা পছন্দ করেনি। জার্মান চ্যান্সেলর মকেল এর প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, তাদের ভাগ্য তাদের হাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, তাদের বাইরের কোনো লোকের উপদেশের প্রয়োজন নেই। ট্রাম্প ন্যাটোকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘সেকেলে’ হিসেবে। এটা নিয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোয় এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প ব্রেক্সিটকে সমর্থন করেছিলেন। ব্রিটেন এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অন্য ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলো ব্রিটেনকে অনুসরণ করুক, এটাও ট্রাম্প চান। ফলে ইইউর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ট্র্যাডিশনাল সম্পর্ক, তাতে এখন একটি অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে।
নির্বাচনে বিজয়ের পর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ‘ফোনালাপে’ একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন নীতি’ পরিত্যাগ করতে পারে! চীন বিষয়টিকে খুব সহজভাবে নেয়নি। চীন তার ‘টুইটার কূটনীতি’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তবে একটা বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন রেক্স টিলারসন, যিনি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী। টিলারসন বলেছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীন যে কৃত্রিম দ্বীপ বানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেখানে চীনাদের যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়া। এর প্রতিবাদে চীন বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তা করে, তাহলে তা এক ‘ভয়ংকর সংঘাতে’ রূপ নেবে। তবে রাশিয়া সম্পর্কে তিনি বরাবরই নরম মনোভাব দেখিয়ে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্র ওবামার শাসনামলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এমনকি রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। রাশিয়া এখন চাইছে ওই অবরোধ প্রত্যাহার হোক এবং জি-৮ এ আবার রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন করুক যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্পের জন্য কাজটি খুব সহজ নয়। গেল ৫ মাসে তিনি একের পর এক যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা তার নিজ দল তথা বিশ্ববাসীর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতাকে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছে। রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর ম্যাককেইন ট্রাম্পের ‘মুসলমান নিষিদ্ধ’ করার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করবেন বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে ওবামা প্রশাসনের দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জন কেরি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ও সুসান রাইস (জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা) সানফ্রান্সিসকোর আপিল কোর্টে একটি লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, ট্রাম্পের এ মুসলমান নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কোনোমতেই ‘গ্রহণযোগ্য’ নয়। তাদের ভাষায়, এসব দেশের নাগরিকরা কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতেও ছিলেন না। ফলে বোঝাই যায়, ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্ত খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এটা এখনও স্পষ্ট নয়, ট্রাম্প যে নয়া অভিভাসন কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, তাতে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করবেন। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তার নিজের অজ্ঞতা এবং তার প্রশাসনে যথেষ্ট যোগ্য লোকের অভাব থাকায় আগামী দিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত কপ-২১ চুক্তির (যা প্যারিসে ও জাতিসংঘে স্বাক্ষরিত হয়েছে) সমর্থন না করা, কিউবার সঙ্গে ‘সমঝোতা’কে অস্বীকার করা, চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’, ন্যাটোয় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমিয়ে আনা, ইরানের সঙ্গে সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতাকে অস্বীকার, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বাতিল ইত্যাদি আগামীতে বিশ্বে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে না; তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে। এখন আমাদের দেখতে হবে, তার এ ‘রাজনীতি’ ২১ শতকের তৃতীয় দশকে যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো সিদ্ধান্ত বিশ্বে বড় পরিবর্তন ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট। তার বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের যে ‘হতাশা’ এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তা যে কোনো প্রেসিডেন্টের জন্য খারাপ খবর। মানসিকভাবে তিনি কতটুকু সুস্থ, সে ব্যাপারে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। বহুল প্রচারিত ইকোনমিস্ট পত্রিকায় ৪ ফেব্রুয়ারি তাকে নিয়ে যে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে(An Insurgent in the White House), তা শুধু লজ্জাজনকই নয়, বরং একটি আতঙ্কের কারণও বিশ্ববাসীর জন্য। প্রচ্ছদের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প একটি ‘মনোটোভ ককটেল’ নিক্ষেপ করছেন! এ ‘ছবি’ অনেক কিছুই বলে।
সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের মন্তব্যও এখানে উল্লেখ করা যায়। সাময়িকীটি মন্তব্য করেছে এভাবেÔIt is not too late for him to conclude how much worse, to ditch his bomb-throwers and switch courses. The world should hope for that out come. But it must prepare for troubleবিশ্ব তৈরি থাকবে নতুন সংকটের জন্য! আমরা জানি না, এ ‘সংকট’টা নয়া বিশ্ব ব্যবস্থাকে কীভাবে প্রভাবিত করবে। তবে মাত্র ৫ মাসে তিনি যে একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছেন, তা আমাদের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক সিনিয়র এজেন্ট (সাবেক) জুরাল আভিভ। আভিভের মতে, ট্রাম্প আগামী কিছুদিন, ১ বছরের মধ্যে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র জন্য ‘ইমপিচ’ বা অভিশংসিত হতে পারেন! শুধু যে জুরাল আভিভের মুখ থেকে এ ধরনের কথা বেরিয়েছে তা নয়; বরং অনেক পর্যবেক্ষকের লেখায় আমি এ ধরনের আভাস পেয়েছি। অভিশংসনের মূল কারণ হচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি নির্বাচনের আগে (নভেম্বর ২০১৬) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তথা রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এ বিষয়টি এখন স্পষ্ট। ট্রাম্প ক্ষমতা নেয়ার আগেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, যারা এখন প্রশাসনে আছেন, তারা রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তাদের সে কল রেকর্ড মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের কাছে আছে। এর রেশ ধরেই ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
নিউইয়র্ক টাইমস আমাদের জানাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসনের চার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিয়মিত রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। নির্বাচনের আগে রাশিয়া ট্রাম্পের দুর্বলতা বুঝে তাকে রাশিয়ার স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। বিশ্লেষকরা এ ঘটনাকে এখন আখ্যায়িত করেছেন Russia Gate হিসেবে (Institute for policy studies)। অনেকটা নিক্সনের Water Gate কেলেঙ্কারির মতো। সর্বশেষ ঘটনায় তার বড় ছেলে ট্রাম্প জুনিয়র স্বীকার করেছেন, তিনি নির্বাচনের আগে রাশিয়ার সঙ্গে (জনৈক রাশিয়ান আইনজীবী, সম্ভবত রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত) যোগাযোগ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রচারণাসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা। এর আগে তার মেয়ের জামাই কুশনারের (হোয়াইট হাউস উপদেষ্টা) সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগের বিষয়টি জানা গিয়েছিল। ফলে এটা এখন স্পষ্ট, ট্রাম্প নিজে ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এবং রাশিয়ার সাহায্য নিশ্চিত করেছিলেন, যাতে ট্রাম্প নিজে নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেন। বিষয়টি এখন স্পষ্ট। ভবিষ্যতে এ বিষয়টি তার বিরুদ্ধে অভিশংসনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সম্প্রতি দুইটি বিষয়ে তিনি অভ্যন্তরীণভাবে ও বহির্বিশ্বে ব্যাপক বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছেন। প্রথমটি হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত কপ-২১ এর সিদ্ধান্ত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। জুলাই মাসে হামবুর্গে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জি-২০ এর শীর্ষ সম্মেলন। সেখানে জি-২০ ভুক্ত ১৯ দেশ (ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ) যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে কপ-২১ এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাদের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি আবার ব্যক্ত করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব আসরে একা হয়ে যাওয়া।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তার পরিবারের সদস্যদের ‘অবৈধ ক্ষমতা’ প্রয়োগ। হামবুর্গে তার মেয়ে ইভানকা ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসা, তার জ্যেষ্ঠ সন্তানের কাতারে ব্যবসায়িক স্বার্থ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করা, তার মেয়ের জামাই কুশনারের (যিনি এখন প্রশাসনের অংশ) অবৈধ ব্যবসায়িক ‘কানেকশন’। প্রতিটি বিষয় তিনি নিজেকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন। ফলে ট্রাম্পের আগামী দিনগুলো যে তাকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিবর্তন করবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। অতীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এভাবে বিতর্কিত হননি। এতে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য তা ভালো খবর নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন কিংবা মার্কিন সমাজের জন্য কী মেসেজ তিনি দিচ্ছেন? সম্প্রতি তার একাধিক সিদ্ধান্ত তাকে যেমন বিতর্কিত করেছে, তেমনি তার পরিবারের সদস্যরা প্রেসিডেন্সির ভাবমূর্তিও নষ্ট করেছেন। ছয়টি আরব তথা মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা তিনি জারি করেছিলেন, তা একাধিক আদালতে বাতিল ঘোষিত হলেও শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের এক আদেশে সে নিষেধাজ্ঞার আংশিক বাস্তবায়নে তিনি সফল হয়েছেন। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই, ডোনাল্ড ট্রাম্প কম গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেছিলেন। জানুয়ারিতে (২০১৭) তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল শতকরা ৪০ ভাগ। অথচ ওবামা যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন (২০০৯), তখন তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল ৭৯ ভাগ। আর বুশের (২০০১) ছিল ৬২ ভাগ, ক্লিনটনের (১৯৯৩) ৬৮ ভাগ। আর গেল জুনে অর্থাৎ দায়িত্ব নেয়ার ৫ মাস পরও একটি পরিসংখ্যান আমরা দিতে পারি। পিউ রিসার্চের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, শতকরা ৩৯ ভাগ মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের কর্মকা- সমর্থন করছেন; অন্যদিকে ৫৬ ভাগ সমর্থন করছেন না। নির্বাচকম-লীর ভোটে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন সত্য; কিন্তু তিনি ৫ মাস পরও তার বিশ্বাসযোগ্যতার স্তর বাড়াতে পারেননি। পিউ রিসার্চের গবেষণায় উঠে এসেছে অতীতে প্রেসিডেন্টদের ওপর আস্থা রখার বিষয়টিও। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যখন দায়িত্ব নেন (১৯৯৩) তার ১ মাস পর ৬৩ ভাগ মানুষ তার ওপর আস্থা রেখেছিল। বুশের (২০০১) ওপর ৬০ ভাগ, ওবামার (২০০৯) ওপর ৭৬ ভাগ মানুষের আস্থা ছিল (ট্রাম্পের মাত্র ৩৯ ভাগ)। প্রথমে সাতটি মুসলমান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তিনি নির্বাহী আদেশ বলে জারি করেছিলেন। ইরাককে তিনি পরে এ তালিকা থেকে বাদ দেন। আদালত ওই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প বিষয়টি নিয়ে গিয়েছিলেন সুপ্রিমকোর্টে। সেখানে তিনি আংশিক বিজয়ী হন। ট্রাম্প থেমে থাকেননি। ট্রাম্প প্রশাসন নতুন একটি অভিবাসন নীতিমালার ব্লুপ্রিন্ট প্রকাশ করেছে। ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি থেকে ইস্যু করা দুইটি মেমোয় উল্লেখ করা হয়েছে, অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বের করে দেয়া হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। নতুন এ অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিমালা বা নির্দেশনামাকে দেখা হচ্ছে নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। এর অর্থ হচ্ছে ট্রাম্প অভিবাসনসংক্রান্ত তার অবস্থান থেকে এতটুকুও সরে আসছেন না। এরই মধ্যে তার দুই মন্ত্রী মেক্সিকো গেছেন এবং অবৈধ মেক্সিকান অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো নিয়ে কথা হয়েছে। ইউরোপে ট্রাম্পবিরোধী জনমত বাড়ছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
Daily Alokito Bangladesh
16.07.2017

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ও ভবিষ্যৎ বিশ্বরাজনীতি



সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের বিষয়টি বহুল আলোচিত। সীমান্তে সৈন্য মোতায়েনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ দুটির মধ্যে যে উত্তেজনার জন্ম হয়েছিল, তার রেশ গিয়ে পড়েছিল জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে। গত ৮ জুলাই হামবুর্গে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। ওই শীর্ষ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদি ও শি জিনপিং যোগ দিয়েছিলেন। বৈঠকের এক ফাঁকে শি জিনপিং ও মোদি এক সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে উষ্ণতা ছিল না। এই যখন পরিস্থিতি তখন গত ৭ জুলাই থেকে বঙ্গোপসাগরে শুরু হয়েছে জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ নৌমহড়া। এ মহড়ায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী একাধিক যুদ্ধজাহাজ অংশ নিচ্ছে। এ মহড়া চলবে ১৭ জুলাই পর্যন্ত। পশ্চিমা গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ‘মালাবার ২০১৭’ নামে পরিচালিত এ তিনদেশীয় নৌমহড়া মূলত চীনকে লক্ষ্য করেই পরিচালিত হচ্ছে। কেননা ইদানীং বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে চীনা ডুবোজাহাজের তৎপরতা বেড়েছে। এ ধরনের ঘটনা ভারতের নীতিনির্ধারকদের জন্য চিন্তার কারণ।

সিকিম সীমান্তে টানাপোড়েনের মধ্যে সেখানে যুদ্ধের মতো এক ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি সিকিমের স্বাধীনতাকামীদের সমর্থন দেবে বলে হুমকি দিয়েছিল চীন। চীনের সরকারি পত্রিকা ‘স্পেশাল টাইমস’-এর সম্পাদকীয়তে সিকিমের স্বাধীনতাকামীদের সমর্থনের কথা বলা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তিব্বতে বিশাল সামরিক মহড়া আয়োজন করে চীন নাথুলা দিয়ে কৈলাস ও মানসসরোবরে তীর্থযাত্রীদের যাত্রা বন্ধও করে দিয়েছিল। ফলে একদিকে সিকিম সীমান্তে উত্তেজনা বজায় রাখা আর অন্যদিকে হামবুর্গে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মোদির সৌজন্য সাক্ষাৎ, দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কতটুকু উন্নত করতে পারবে, তা বলা মুশকিল।

চীন ও ভারত সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে উভয় শক্তিই এক ধরনের ‘প্রভাব বিস্তার করার’ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। প্রভাব বিস্তার করার এই যে প্রতিযোগিতা, তাতে এ অঞ্চলের দেশগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আর ভারত ইতিমধ্যে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফলে ভারত তার ‘ক্ষমতা প্রয়োগ’ করতে শুরু করছে। ফলে এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা আগামীতে চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারকরা এখন প্রকাশ্যেই বলছেন তারা এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ‘সহ্য’ করবেন না। ভুবনেশ্বর আইওআর সম্মেলনে (মার্চ ২০১৫) এ মেসেজটিই তারা দিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা নয়া দিক। সিসিলি ও মরিশাসের সঙ্গে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ও এ দুটি দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, শ্রীলংকায় ভারতীয় প্রভাব বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে এ ‘জাফনা কার্ড’ ব্যবহার করা প্রমাণ করে ভারত ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়। ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন ভারত প্রাচীনকালে তার ‘কটন রুট’ ব্যবহার করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতা বিকাশে ভারতীয় পণ্ডিতরা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। হাজার বছর আগে দক্ষিণের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে নৌবাণিজ্যে ভারত শক্তিশালী ছিল। ওই সময় ভারত মহাসাগরকে চোল হ্রদ বলা হতো। ভারতীয় নৌবাণিজ্যের যে প্রাচীন রুট, তাতে দেখা যায় ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, মিসর, আফ্রিকার মাদাগাস্কার, আবার অন্যদিকে শ্রীলংকা হয়ে সুমাত্রা, জাভা (মাল্লাকা প্রণালী), হংকং, জাপান পর্যন্ত ভারতীয় বাণিজ্য রুট সম্প্রসারিত ছিল। মোদি সরকার এ ‘কটন রুট’কেই নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চায়। প্রাচীনকালে ভারতীয় তুলা তথা সুতি এ সমুদ্রপথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেত। চীনা নেতা শি জিনপিং তার ‘সিল্ক রুট’-এর ধারণা নিয়ে ভারতীয় মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান, এর বিপরীতে ভারত তার পুরনো ‘কটন রুট’-এর ধারণা প্রমোট করছে। দ্বন্দ্বটা তৈরি হবে সেখানেই। বাণিজ্যনির্ভর এ দ্বন্দ্ব, শেষ অব্দি পরিণত হবে সামরিক দ্বন্দ্বে। চীন তার নৌবহরে বিমানবাহী জাহাজ আরও বাড়াচ্ছে। ভারত ও ভারত মহাসাগরে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী করছে। আন্দামানে নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে।

বলা হয় একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বৃহৎ শক্তি- চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে বৈকি! জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টার যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে। জাপানেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। সম্প্রতি শি জিনপিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলেছেন, তা ‘অন্য চোখে’ দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এ সিল্ক রোডটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ সিল্ক রোডের মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একইসঙ্গে একটি মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথাও আমরা জানি, যা কিনা চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, চীন থেকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে চীনারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, মালয়েশিয়ায় এসেছিল। পরে তারা স্থায়ী হয়ে যায়। এমন কথাও বলা হয়, ব্রুনাইয়ে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে চীনাদের অবদান ছিল বেশি। ২০১২ সালে আমি তুরস্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে চীনাদের এ সিল্ক রুটের আগ্রহের কথা জানতে পারি। এই সিল্ক রুটের যে অংশ তুরস্কে পড়েছে, আমি সেটার বেশ কিছুটা পথও পাড়ি দিয়েছি। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার প্রথম সফরে কাজাখস্তানে গিয়ে তার ঐতিহাসিক পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। এর পরের মাসে ইন্দোনেশিয়ার পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে তিনি দ্বিতীয় মেরিটাইম সিল্ক রুটের কথাও বলেন। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয় যে, চীন শুধু মধ্য ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিশাল এক অর্থনৈতিক সংযোগ কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। ইরানে চীনের যে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে, এটা নিশ্চয়ই অনেক পাঠকই জানেন। এখন যে প্রশ্নটি অনেক পর্যবেক্ষকই করেন তা হচ্ছে, চীনের এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের নীতি ভারতীয় স্বার্থের সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক? কেননা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার নিজস্ব মডেলে ভারতীয় মনরো ডকট্রিনের কাঠামো গড়ে তুলছে। অর্থনৈতিক প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। আর এ দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে আটলান্টিক ও প্যাসিফিকের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ‘ফায়দা’ উঠাতে চাইবে। আগামী দিনগুলো তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তখন চীন-ভারত দ্বন্দ্ব যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে এ অঞ্চলের দেশগুলো এতে করে ‘প্রভাবিত’ হবে। সবচয়ে বড় কথা ঝুঁকির মুখে থাকবে ব্রিকস ব্যাংক।

বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থাকে সামনে রেখে ব্রিকসভুক্ত ৫টি দেশ একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা যে কোনো বিবেচনায় গুরুত্বের দাবি রাখে। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো- চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া ও ব্রাজিল বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তথা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব হ্রাস করার উদ্দেশ্যেই ২০১৫ সালে আত্মপ্রকাশ করে ব্রিকস ব্যাংক বা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বা এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) গঠন করে। এ ব্যাংককে বলা হচ্ছে বিকল্প বিশ্বব্যাংক। মোট ৫৭টি দেশ নিয়ে এ ব্যাংকের যাত্রা শুরু। মোট মূলধনের পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন ডলার। এর মাঝে চীন জোগান দিয়েছে ২৯ দশমিক ৭৮ ভাগ অর্থ। এর পরের অবস্থান ভারতের। ভারতের অর্থের পরিমাণ ৮ দশমিক ৩৭ ভাগ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি ৪ দশমিক ৪৮ ভাগ। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের অবস্থান আরও অনেক পরে। বলাই বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্র যেমন এআইআইবির সদস্য হয়নি, ঠিক তেমনি জাপানও এর সদস্য নয়। বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশ এ ব্যাংকের সদস্য। ২০১৫-১৬ সালে গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে এবং রাষ্ট্রপতি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে উন্নয়নশীল বিশ্বে আইএমএফের ঋণনীতি আবারও আলোচনায় আসে। আইএমএফ শর্তসাপেক্ষে গ্রিসকে আরও ঋণ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রিস সরকার তাতে রাজি হয়নি। ফলে রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হয়ে যায়। ইউরো জোন থেকে দেশটির ছিটকে পড়ারও আশঙ্কা ছিল। এমনি একটি পরিস্থিতিতে এআইআইবির জন্ম বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন এক চমক সৃষ্টি করতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। কিন্তু যেভাবে ভারত মহাসাগরে এ দুই দেশের মাঝে এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তাতে করে এ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। এখন দেখার পালা যৌথভাবে একটি বিকল্প বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেও এ দুই দেশের মাঝে দ্বন্দ্ব কোন পর্যায়ে উপনীত হয়।

গত ৯ জুলাই মোদি-শি জিনপিংয়ের ছবি ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। ছবির সঙ্গে কলকাতার আনন্দবাজারের বক্তব্য ছিল এ রকম : ‘নয়াদিল্লির প্রশংসা করে ভারতের নেতৃত্বে ব্রিকসের মঞ্চ গতি পেয়েছে।’ এটা চীনা প্রেসিডেন্টর বক্তব্য, মোদির বক্তব্যও অনেকটা এরকম। এখন দেখার পালা সব কিছু ভুলে এ দুটি দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে কিনা। এখানে আস্থা ও বিশ্বাস রাখাটা জরুরি।
Daily Jugantor
11.07.2017

ইসির রোডম্যাপ, একটি সহায়ক সরকার ও বিবিধ প্রসঙ্গ


নির্বাচন কমিশন (ইসি) ৭টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এক দফা জাতীয় নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে আছে ৩১ জুলাই সুধীসমাজের সঙ্গে সংলাপ, আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নির্বাচনী আইন বাংলায় প্রণয়ন, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ ও বিতরণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ইত্যাদি। যে ৭টি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, তা সমন্বয় করতে ৪ কমিশনারের নেতৃত্বে ৪টি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে না এটি নিশ্চিত করেছে ইসি। কমিশন নিঃসন্দেহে এ জন্য সাধুবাদ পেতে পারে। ইভিএম মেশিন নিয়ে বিতর্ক আছে। আমি নিজে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক স্টেটের নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। ওইসব রাজ্যেও ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হয় না। কেননা এই মেশিন শতভাগ নিরাপদ নয়। আপাতত যে ৭টি বিষয় কমিশন চিহ্নিত করেছে এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করছে এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে প্রশ্ন যে নেই, তা নয়। প্রশ্ন আছে। প্রথমত, সুধীসমাজের সঙ্গে সংলাপ করে কমিশন কি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? অতীতেও ইসি সংলাপ করেছিল। কোনো একটি ‘সংলাপ’-এ আমিও আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। যারা নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন তাদের অনেককে নানা ‘সাজেশন’ দিতে দেখেছি। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, ওইসব ‘সাজেশন’-এর অনেকটিই গ্রহণ করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোই হচ্ছে নির্বাচনের প্রশ্নে মূল স্টেকহোল্ডার। তারাই নির্বাচনে যাবেন। জনগণকে নির্বাচনে যেতে উদ্বুদ্ধ করবেন। তাই তাদের বক্তব্য গ্রহণ করাই হচ্ছে মূল বিষয়। এর বাইরে অন্য যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, এগুলো নিছক ‘প্রশাসনিক কাজ’। এগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া অর্থহীন। রাজনৈতিক দলগুলোই মূল ‘অ্যাক্টর’। তাদের নানা এজেন্ডা আছে। এখন দেখার বিষয়, ইসি ওইসব এজেন্ডাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। একই সঙ্গে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলারই বা কী প্রয়োজন? অতীতের নির্বাচনী ইতিহাসে নিবন্ধিত অনেক দলেরই পারফরম্যান্স আশাপ্রদ নয়। এ জন্য একাদশ সংসদ নির্বাচনে তাদের ভূমিকাই বা কী থাকতে পারে? মূল ‘অ্যাক্টর’ হচ্ছ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। এর মধ্যে আবার জাতীয় পার্টি সরকারে আছে কিন্তু ১৪ দলের জোটে নেই। জোটকেন্দ্রিকভাবেই নির্বাচন হবে। এ ক্ষেত্রে জোটগতভাবে কমিশন ডাকতে পারে। মূল বিষয় বিএনপিকে নিয়ে। এ কারণে আস্থায় নিতে হবে বিএনপিকে। বিএনপি মনে করে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংবিধান অনুযায়ী যে সরকারটি গঠিত হবে, তা হতে হবে একটি নিরপেক্ষ সরকার। না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এক সময় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করত এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এখন ওই ‘অবস্থান’ থেকে কিছুটা সরে আসছে বিএনপি। তাদের দাবি এখন ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার’ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীকে সহায়তা করবে একটি সরকার তেমনটিই দাবি করে আসছে বিএনপি। অবশ্য এটি স্পষ্ট নয়, বিএনপি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে দলের অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি নির্বাচনকালীন সরকার চাচ্ছে কিনা, নাকি কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নন এমন এক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি সরকার চাচ্ছে বিএনপি। তাদের দাবি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখে তারা নির্বাচনে যাবেন না। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খুব শিগগিরই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে। তবে সংবিধানে এ ধরনের একটি সরকারের ধারণা দেওয়া আছে। সংবিধানে কোথাও স্পষ্ট করে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে কোনো কথা বলা হয়নি। ৫৭ (৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’ এর ব্যাখ্যা কী? একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীই স্বপদে বহাল থাকবেন অর্থাৎ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়া প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত (একাদশ সংসদে যার দল বিজয়ী হবে, রাষ্ট্রপতি তাকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানাবেন) স্বপদে থেকে যাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন এ ধরনের কথা সংবিধানে কোথাও লেখা নেই। সংবিধানের ১১৯ (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ‘সংসদ সদস্যের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন।’ সংবিধানের একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে, ‘নির্বাচনের জন্য সংসদ ভাঙ্গিয়া আবার ৯০ দিনের মধ্যে গড়ার ১২৩ (৪)-এ একটি কথা বলা আছে বটে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা কী হবে, তিনি নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তর করবেন কিনা এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। ১১৮ (৪)-এ বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন’ এবং ১২৬-এ বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।’ অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের কথাবার্তা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। ইসি কখনই স্বাধীন নয় এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কখনই ইসিকে সহায়তা করে না। বরং স্থানীয় পর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা থাকেন (ডিসি, ইউএনও প্রমুখ), তারা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অর্থাৎ স্টাবলিশমেন্ট মন্ত্রণালয়ের কথা শোনেন। কাগজ-কলমে আছে, ওই তিন মাস তারা ইসির কথা শুনবেন। কিন্তু তা তারা শোনেন না। তাহলে এখন ব্যাপারটি কী দাঁড়াচ্ছে? বর্তমান সরকার, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখেই ২০১৯ সালের জানুয়ারির ৩ মাস আগেই নির্বাচনটি হবে (একাদশ সংসদ নির্বাচন)। প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে যা করতে পারেন (২০১৪ সালেও তিনি তা করেছিলেন), তা হচ্ছে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ছোট সরকার করতে পারেন। তবে তিনি বাধ্য নন। সংবিধান অনুযায়ী তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। অবশ্য তিনি কাকে কাকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, এ সিদ্ধান্তটি একান্তভাবেই প্রধানমন্ত্রীর। এ ক্ষেত্রে তিনি যদি মনে করেন, নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত, তিনি সেটি পারেন। সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করারও প্রয়োজন নেই। তার আন্তরিকতাই হলো আসল। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন। যেহেতু বিএনপি সংসদে নেই, সেহেতু ৩ থেকে ৪টি সংসদীয় আসনে তিনি উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেন এবং বিএনপি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে যারা মন্ত্রিসভায় যোগ দেবেন, তারা নিরপেক্ষতার স্বার্থে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। একটি ছোট মন্ত্রিসভা (১০ সদস্যের) থাকবে এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো থেকেই তাদের নেওয়া হবে। আরেকটা কথা, জাতীয় পার্টিকে নিয়ে একটা ‘সংকট’ আছে। দলটি বিরোধী দলে, নাকি সরকারি দলে এ নিয়ে জনমানসে নানা প্রশ্ন আছে। এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যদি দলটিকে বিরোধী দলে সরকার দেখতে চায়, তাহলে দলটিকে বিরোধী দল হিসেবেই চলতে দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে মন্ত্রিসভায় তারা থাকতে পারবেন না। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারে তারা থাকতে পারেন। জাতীয় পার্টিকে ১৪ দলেও নেওয়া যেতে পারে প্রয়োজনে। একদিকে সরকারে, অন্যদিকে বিরোধী দলে এভাবে থাকার ফলে জাতীয় পার্টির যে সম্ভাবনা ছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে। বিএনপির বিকল্প হিসেবে জাতীয় পার্টি দাঁড়িয়ে যেতে পারত। তা হয়নি নীতিনির্ধারকদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। এমনকি বেগম রওশন এরশাদের পরিবর্তে এইচএম এরশাদ যদি বিরোধী দলের নেতা হতেন, আমার ধারণা ওই সংসদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়ত। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট। একটি ব্যক্তিগত ইমেজ তার আছে। উপরন্তু তার নামেই জাতীয় পার্টি চলে। উত্তরাঞ্চলে তার নামের কারণেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ব্যক্তিগত ইমেজে কেউই বিজয়ী হন না। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন জাতীয় পার্টি সরকারি দলে থাকবে, নাকি বিরোধী দলে থাকবে। এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুটি বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে ‘গণতন্ত্রের হাওয়া’ বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো। তা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেকটি সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধশিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটি পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, ওই ‘অর্জন’ মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়Ñ বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায়, দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। ইসি ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করে প্রকারান্তরে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করে দিল। কিন্তু যেতে হবে অনেক দূর। একটি ‘বিতর্ক’-এর মধ্য দিয়ে ‘হুদা কমিশন’ তার যাত্রা শুরু করেছিল। বিএনপি শুরু থেকে বিরোধিতা করলেও এই কমিশনকে মেনে নিয়েছে। কমিশনের জন্য এটি প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু ওই ‘আস্থা অর্জন’ই বড় কথা নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদোন বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ কাম্য (যুগান্তর, ৯ মে)। এ ধরনের কথা ইইউয়ের পক্ষ থেকে এর আগেও উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু এই ‘শিক্ষা’ কি বড় দলগুলো নিয়েছে? আমার মনে হয় না। যে কথাটি আমরা বারবার বলে আসছি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে একটা আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার। ২০১৪ সালের পর আজ পর্যন্ত ওই আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ফলে দিন যতই গড়াচ্ছে, ততই সংকটটি বাড়ছেÑ যদি আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হয়, তাহলে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা? পরিস্থিতি ২০১৮ সালের শেষ কিংবা ২০১৯ সালের জানুয়ারি আর ২০১৪ সালের জানুয়ারি নিশ্চয় এক নয়। এক হবেও না। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল। তারা তা পারেননি। এই ভুল এবার আর বিএনপি করবে না। তবে একই সঙ্গে এটিও সত্য, বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে হলে সরকারকে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের আন্তরিকতাই হলো আসল। সরকার যদি ইসিকে সহযোগিতা না করে, তাহলে ইসির পক্ষে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’-এ একটি নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে না এটিই হলো মোদ্দা কথা।
Daily Amader Somoy
11.07.2017