রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

সাভার ট্র্যাজেডির পোস্টমর্ট

সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের বিবেক ও রাষ্ট্রকে একটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। এই ঝাঁকুনি আমাদের ভবিষ্যৎ পথকে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কতটুকু প্রভাবিত করবে এটা এই মুহূর্তে বলা না গেলেও এটা বলা যায়, এই ঘটনার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে যাবেই। এই ঘটনায় কত মানুষ মারা গেল, কত মানুষকে উদ্ধার করা হলো, বিষয়গুলো খুব মানবিক এবং সন্দেহ নেই এই মর্মান্তিক ঘটনা অর্থাৎ সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের জন্য একটি মেসেজ পৌঁছে দিল। নীতি-নির্ধারকরা এ ব্যাপারে যদি সিদ্ধান্ত নেন তা জাতির জন্য মঙ্গলই বয়ে আনবে। প্রথমত, এ ধরনের একটি মানবিক বিপর্যয়ে যে সাধারণ মানুষ, ছাত্র, সেনাবাহিনী, পুলিশ, নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাসহ সবাই এক হয়ে যেতে পারেন তা আবার প্রমাণিত হলো। এনাম মেডিকেল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাষ্ট্র এই দুই প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পদকে সম্মানিত করুক এবং অংশগ্রহণকারীদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করা হোক। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের একটি মানবিক বিপর্যয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর যে ব্যর্থ তা প্রমাণিত হলো। অধিদফতরের কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে যান ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জনের জন্য। কিন্তু দেশের কাজে তারা সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের তিরস্কৃত করা হোক। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটি ছেড়ে দেয়া হোক সেনাবাহিনীর কাছে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ সেনাকর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সেনাবাহিনীর ভেতরেই আলাদা একটি ইউনিট তৈরি করা হোক। তৃতীয়ত, স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ট্র্যাজেডির পর আমরা ২০০ কোটি টাকা দিয়ে ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছিলাম। এখন দেখা গেল সেগুলো কোনো কাজে লাগল না। আমাদের এখন জোর দিতে হবে ছোট ছোট যন্ত্রপাতি ক্রয় করার বিষয়ে, যা দিয়ে দ্রুত পাথর (কংক্রিট) কাটা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সাভারে রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় আমরা হাতুড়ি আর হ্যাঁচকো ব্লেড দিয়ে পাথর ও রড কেটে গর্ত করে করে মানুষ উদ্ধার করতে দেখেছি। তাতে সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা না পৌঁছার কারণে মানুষ মারা গেছে। চতুর্থত, সাভার ট্র্যাজেডিতে আমরা দেখেছি আমাদের নেতারা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি এবং তাদের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেননি। অথচ এসব ক্ষেত্রে ভারত ও জাপানের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখন প্রয়োজন ওইসব দেশের বিশেষ বিশেষ সংস্থার সঙ্গে ‘হটলাইন স্থাপন’ করা, যাতে প্রয়োজনে দ্রুত তাদের পরামর্শ নেয়া যায়। পঞ্চমত, এটা এখন স্পষ্টতই প্রমাণিত যেসব ভবনে গার্মেন্টস রয়েছে, সেই ভবনগুলো সুরক্ষিত নয়। প্রায় ৪০০০ গার্মেন্টস রয়েছে, যার মাঝে প্রায় ৩৫০০টি গার্মেন্টসে নিয়মিত কাজ হয়। এখন খুব দ্রুত প্রতিটি ভবন পরীক্ষা করা হোক। বুয়েটের সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক ও সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হোক একাধিক কমিটি। এক সপ্তাহের মধ্যে তারা সরকারের কাছে রিপোর্ট দেবে। যেসব ভবন সুরক্ষিত নয় কিংবা বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে তৈরি করা হয়নি, সেসব ভবন বন্ধ করে দেয়া হোক। এখানে কোনো শৈথিল্য দেখানো যাবে না। প্রতিটি ভবনে একাধিক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, অক্সিজেন সিলিন্ডার, উন্মুক্ত যাতায়াতের পথের ব্যবস্থা করা হোক। প্রতিটি পোশাক কর্মীর জীবন বীমা (১০ লাখ টাকা ন্যূনতম) বাধ্যতামূলক করা হোক। ষষ্ঠত, তৈরি পোশাক শিল্প আমাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস। এই খাতকে প্রায়োরিটি দেয়া হোক। বছরে প্রায় ২০ কোটি ডলারের বাজার এই তৈরি পোশাকের। সস্তা শ্রমের কারণে ও তৈরি পোশাকের কম মূল্য হওয়ায় বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা থাকবেই। তাই এখানে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে যদি ‘কমপ্লায়েন্স’-এর নীতিমালা অনুসরণ করা না হয়, তাহলে অচিরেই যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসবে। সাভারের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে, কানাডার টরেন্টোতে বিক্ষোভ হয়েছে। মার্কিন ট্রেড ইউনিয়নগুলো তৎপর হয়েছে। বাংলাদেশ যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে বাংলাদেশ এক কঠিন সময়ের মধ্যে পড়বে। সপ্তমত, একসময় যে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে আমরা সক্ষম হব। কিন্তু ক্ষত রয়ে যাবে। পা হারানো, হাত কাটা পঙ্গু পোশাক কর্মীদের পুনর্বাসন খুবই জরুরি। সরকার একটি ফান্ড গঠন করুক, যাতে সহযোগিতা করবেন ব্যাংকাররাসহ সব ব্যবসায়ী। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে যেসব সেনা অফিসার প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের পরিবারের জন্য এককালীন ও মাসোহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সে রকম ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রেও করা হোক। ব্যাংকগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় এই ফান্ডে নিয়মিত টাকা দিয়ে যাচ্ছে। সাভার ট্র্যাজেডিতে যারা প্রাণ হারিয়েছেন এবং যারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের এককালীন ও প্রতি মাসে একটা ভাতার ব্যবস্থা করা হোক। আর বাচ্চাদের জন্য ব্যবস্থা করা হোক সরকারি বৃত্তির। আমার ধারণা এদেশের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি রয়েছেন, বিশেষ করে যারা তৈরি পোশাক রফতানি করে ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়েছেন; তারা এই বৃত্তির টাকা দিতে পারেন। তাদের নামে বৃত্তি চালু হতে পারে। উদ্যোগটি নিতে হবে বিজিএমইএকেই। অষ্টমত, সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের জন্য একটা ‘ওয়েকআপ’ কল। ঢাকা শহরে এখন হাইরাইজ ভবনের সংখ্যা অনেক। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে জাপান গার্ডেন সিটি। একাধিক বহুতল ভবন রয়েছে এখানে। আমার নিজের চোখে দেখা দশ বছর আগেও ছিল এটি ইটখোলা, ডোবানালা বৈশিষ্ট্য পরিত্যক্ত একটি এলাকা। যে কোনো সময় এখানে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সাভার ট্র্যাজেডি প্রমাণ করল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো প্রশিক্ষিত জনশক্তি এবং যন্ত্রপাতি আমাদের নেই। এটা এখন আমাদের সবার জন্যই ভাবনার ব্যাপার। সরকার একটি ‘ন্যাশনাল ডিজেস্টার ফোর্স’ গঠন করতে পারে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে, যাতে তারা দুর্যোগের সময় এগিয়ে আসতে পারে। সেই সঙ্গে এদের প্রাথমিক চিকিৎসায় অভিজ্ঞ করে তুলতে হবে। নবমত, সরকার ‘রানা প্লাজার’ জায়গা অধিগ্রহণ করুক এবং সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হোক, যারা মারা গেছেন তাদের স্মরণে। এ ধরনের স্মৃতিস্তম্ভ আমি ওয়াশিংটনে দেখেছি। দেখেছি জার্মানিতেও। সেখানে নতুন প্রজšে§র মানুষ তাদের ইতিহাস জানে। তারা কেন শহীদ হয়েছিলেন, তারা স্মৃতিস্তম্ভ থেকে সেসব ইতিহাস জানতে পারে। ওয়াশিংটন ডিসির ভিয়েতনাম ভ্যাটার্ন মেমোরিয়ালের কথা বলতেই হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেসব আমেরিকান সৈন্য নিহত বা নিখোঁজ হয়েছিলেন, তাদের স্মরণে এটি নির্মিত হয়েছে। আমাকে যা অবাক করেছে, তা হচ্ছে মোট ৫৮ হাজার সৈন্যের নাম গ্রানাইট পাথরে খোদাই করা আছে, যারা ওই যুদ্ধে মৃত অথবা নিখোঁজ। হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। মহিলাদের স্মরণে পাশে আরেকটি স্টাচুও আছে। বলা ভালো, ভিয়েতনাম যুদ্ধে মোট ১১,৫০০ মহিলা অংশ নিয়েছিলেন। তাদের প্রতি সম্মান জানাতেই ওই ভ্যাটার্ন মেমোরিয়াল। আমরা কি পারি না সাধারণ এই পোশাক কর্মীদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে রাখার জন্য একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে। রানা প্লাজা যেখানে তৈরি করা হয়েছে, ওই জায়গার মূল মালিক রবীন্দ  নাথ সাহা। জোর করে সোহেল রানা রবীন্দ  নাথ সাহার নিজস্ব পুকুরটি দখল করে ও ভরাট করে রানা প্লাজা তৈরি করেছিলেন। সরকারের পক্ষে তাই অধিগ্রহণ করা সহজ। স্মৃতিস্তম্ভের বিষয়টি জরুরি এ কারণে যে, জাতি এবং আগামী প্রজন্ম জানবে কিছু সাধারণ মানুষ দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। তাদের সবার নামও থাকুক।
আমরা সব কিছুতেই ‘রাজনীতি’ খুঁজি। এটা ভালো লক্ষণ যে, প্রধান বিরোধী দল এখন অবধি সাভার ট্র্যাজেডি নিয়ে কঠিন কোনো ‘রাজনীতি’ শুরু করেনি। তবে হরতাল করছে ১৮ দল এবং বামপন্থী কয়েকটি দল। আগামী ২ মে। তবে কেউ কেউ আবার তা স্থগিতও করেছে। অনেকের মতো আমিও মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ‘ঝাঁকুনি তত্ত্ব’-এ হতবাক ও বিস্মিত। কী করে তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারেন, তা আমি ভেবে পাই না। তারপরও আমি তাকে এমপি রনির মতো ‘বুদ্ধি ও প্রতিবন্ধী’ কিংবা বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মযহারের মতো ‘অপ্রকৃতিস্থ’ বলব না। তবে বলব তিনি ক্ষমতায় থাকার, অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তিনি স্বউদ্যোগে পদত্যাগ করলে বরং তার দলের লোকেরাই খুশি হবেন। আরো একটা ব্যাপারে আমি বিব্রত। একটি জনপ্রিয় দৈনিক গত ২৬ এপ্রিল ঢাকায় একটি তথাকথিত ‘তারকা-মহাতারকাদের মিলনমেলা’র আয়োজন করেছিল। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে মানুুষ একটু পানির জন্য, অক্সিজেনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছিল, সেখানে এ ধরনের অনুষ্ঠান করার মানসিকতা কীভাবে হয়? এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের একশ্রেণীর মানুষ কতটা বিকৃত মানসিকতার অধিকারী। যারা এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের প্রতি আমি ঘৃণা প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে সাধুবাদ জানাই শিল্পী হাসান মাসুদকে, তিনি ‘প্রতিবাদ’ করে এই অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলেন। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তৈরি পোশাক কর্মীদের ঠেলে দেয়ার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকে আমরা মেলাতে পারব না। শত শত তৈরি পোশাক কর্মীর জীবনের বিনিময়ে যে বৈদেশিক মুদ্রা তা আমাদের প্রয়োজন নেই। একটি জীবনের মূল্য কখনো লাখ টাকা হতে পারে না। যে জীবন চলে যায় লাখ টাকা দিয়ে কেন, কোনো কিছু দিয়েই সে জীবনের মূল্য পরিশোধ করা যায় না।
রাশেদ খান মেনন এই হত্যাকাণ্ডকে একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমি মেনন ভাইয়ের আবেগকে সমর্থন করি। তিনি তো আইনপ্রণেতা। কী করেছেন তিনি গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য? কোনো আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ কী তিনি কখনো নিয়েছেন? আমরা কতগুলো দৃশ্য ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। এক একটা তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লাগে (অথবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তৎপর হন। টিভি ক্যামেরার সামনে গর্ব করে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের বিচার করা হবে।’ কিন্তু সেই ‘বিচার’ আর কোনো দিন হয় না। বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে দুঃখ প্রকাশ করে। মাথাপিছু এক লাখ (কিংবা দু’লাখ) করে ‘মৃত্যু সম্মানী’ দেয়। তদন্ত কমিটি গঠিত হয় একাধিক। তারপর এক সময় মানুষ ভুলে যায় সব। মনেও রাখে না। হাজারটা ‘সমস্যা’র ভিড়ে আমরা মনেও করতে পারি না তাজরীনে কিংবা স্পেকট্রামে ক’জন ‘সেলাই শিল্পী’ মারা গিয়েছিল। আমাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দেয় সংবাদপত্রগুলো। তবে আমাদের অনেকেরই মনে আছে তাজরীন গার্মেন্টস মালিকের কোনো শাস্তি হয়নি। স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের মালিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়নি। ১৯৯৭ সালের পর প্রায় অর্ধশত ভবন ধসে পড়েছে, যার মাঝে ৮টি ভয়াবহ। কোনো একটি ক্ষেত্রেও একজন মালিক তথা ভবন নির্মাণের দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার হয়নি। তারা দায়মুক্তি পেয়ে গেছেন। আজ রানা প্লাজার মালিকও দায়মুক্তি পাবেন, এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। আমরা এখন অপেক্ষা করব একটি অনুষ্ঠানের জন্য, সেখানে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। বিজিএমইএ’র নেতারা থাকবেন। উপস্থিত থাকবেন ‘পোশাক কন্যার’ মা অথবা বাবা। এক লাখ টাকার একটি চেক তারা পাবেন। টিভি সে দৃশ্য ধারণ করবে। সন্তুষ্ট চিত্তে প্রয়াত পোশাক কন্যার মা বা বাবা ফিরে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। এক একটি মৃত্যুর ‘মূল্য’ এক লাখ টাকা। কী পরিহাস! ‘চিত্রনাট্য’ এভাবেই তৈরি করা আছে। তাজরীনের ঘটনায় এভাবেই ‘চিত্রায়িত’ হয়েছিল দৃশ্য। স্পেকট্রামেও তাই হয়েছিল। এখন শুধু রানা প্লাজার জন্য অপেক্ষা!
আমরা কী পারি না একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে? আমরা কী পারি না অভিযুক্তদের সবাইকে গ্রেফতার করে একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আইনি পন্থায় নিশ্চিত করতে? অতীতে হয়নি বলে এবারো হবে না, তা তো হতে পারে না। দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি, ‘রানা প্লাজায়’ হত্যাকাণ্ডের যদি বিচার না হয়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে। কতগুলো বিষয়ে সরকারও যদি আরো ‘কঠিন’ না হয়, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তির জন্য তা আগামীতে কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় রানা প্লাজার মালিক রানাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে আইনি সংস্থাগুলো ঘটনার ৪ দিন পর। গার্মেন্টস মালিক ও প্রকৌশলীদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। তাদের বিচার এবং যথাযথ দণ্ড নিশ্চিতকল্পে সব ধরনের উদ্যোগ ও জোরদার ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো ছাড় নয় এ ব্যাপারে। দায়িত্বে অবহেলার জন্য সাভার উপজেলার নির্বাহী অফিসার (যিনি সার্টিফিকেট দিয়ে ছিলেন ভবন ভেঙে পড়বে না বলে), রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার, এমনকি সাভারের ক্ষমতাসীন দলের এমপি, যার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আছে রানাকে উদ্ধার ও আশ্রয় দেয়ার জন্য। এদের সবাইকে আইনের আওতায় নেয়া হোক।  সরকারের কারখানা অধিদফতরকে আরো শক্তিশালী করা হোক। এখানে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কোনো অবস্থাতে বিজিএমইএ’র ‘চাপ’-এর কাছে মাথানত করা যাবে না। তারা বৈদেশিক মুদ্রা ‘আয়’ করেন বলে সবসময় ছাড় পেয়ে যেতে পারেন না। সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের দেখিয়ে দিল সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। অসংখ্য মানুষ তাদের স্বজনদের খোঁজে আইডি কার্ড নিয়ে আর্তনাদ করছে, অন্তত লাশটা তারা ফেরত পেতে চায়। এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি রোধে যা যা করণীয় তা করতে হবে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করে।
Daily MANOBKONTHO
30.04.13

হত্যাযজ্ঞের তালিকায় আরেকটি নাম


হত্যাযজ্ঞের তালিকায় আরেকটি নাম যোগ হলো। রানা প্লাজা। এত মৃত্যু আগে কেউ কখনো দেখেনি। তাজরীন গার্মেন্ট ২০১২, স্পেকট্রাম ২০০৫, তেজগাঁওয়ে ফিনিক্স ভবন ২০০৬, বেগুনবাড়ীতে ভবনধস ২০১০। কিন্তু রানা প্লাজায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব রেকর্ডকে। কত মৃত্যু হলো রানা প্লাজায়? শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ২৯০ ছাড়িয়ে গেছে। এ সংখ্যা আরো বাড়বে। কিন্তু এই মৃত্যু কি আমাদের বিবেককে এতটুকুও স্পর্শ করেছে? করলে কতটুকু করেছে? রাশেদ খান মেনন বললেন, 'রানা প্লাজায় হত্যাকাণ্ড গণহত্যার সমতুল্য' (নতুন বার্তা)। বাম ঘরানার রাজনীতিবিদ মেনন। শ্রমিকদের নিয়েই তাঁর আজীবনের কাজ। তিনি তুলনা করতেই পারেন। কিন্তু একি কথা শুনলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে! বললেন, 'কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে- ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে' (বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকার, আরটিএন)। বিজ্ঞ মানুষ ম খা আলমগীর। পাকিস্তানি জামানার সিএসপি, একটা পিএইচডিও আছে। কিন্তু তিনি যেমন অবিবেচকের মতো কথা বললেন, এটা আশা করিনি। তবু ভাগ্য ভালো, তিনি 'নাড়াচাড়ার ঘটনাকে' 'সম্ভাব্য একটা কারণ' বলেছেন- 'একমাত্র কারণ' বলেননি! আমাদের দুর্ভাগ্য, এ ধরনের কথা আমাদের শুনতে হয় বারবার। আর এর মধ্য দিয়েই পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। জানা যায়, সেদিন গার্মেন্টকর্মীদের জোর করে কাজে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। গার্মেন্টকন্যারা ছুটি চাইলেও তাদের ছুটি দেওয়া হয়নি। এই মৃত্যুর দায়ভার পোশাক কারখানার মালিকরা এড়াতে পারেন না। পোশাক রপ্তানিকারকরা আমাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আনেন- সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু 'নিশ্চিত মৃত্যুর' মুখে তৈরি পোশাককর্মীদের ঠেলে দেওয়ার সঙ্গে এই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকে আমরা মেলাতে পারব না।
আমরা কতগুলো দৃশ্য ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। একেকটি তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লাগে (অথবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটে), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন তৎপর হন। টিভি ক্যামেরার সামনে গর্ব করে বলেন, 'আইন অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের বিচার করা হবে।' কিন্তু সেই 'বিচার' আর কোনো দিন হয় না। বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে দুঃখ প্রকাশ করে। মাথাপিছু এক লাখ (কিংবা দুই লাখ) করে 'মৃত্যু সম্মানী' দেয়। তদন্ত কমিটি গঠিত হয় একাধিক। এরপর এক সময় মানুষ ভুলে যায় সব। হাজারটা 'সমস্যার' ভিড়ে আমরা মনেও করতে পারি না তাজরীনে কিংবা স্পেকট্রামে কজন গার্মেন্টশ্রমিক মারা গিয়েছিল। আমাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দেয় সংবাদপত্রগুলো। আমাদের হতাশ করে যখন দেখি তাজরীন গার্মেন্ট মালিকের কোনো শাস্তি হয়নি। স্পেকট্রাম গার্মেন্টের মালিককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি। ১৯৯৭ সালের পর প্রায় অর্ধশত ভবন ধসে পড়েছে, যার মধ্যে আটটি ভয়াবহ। কোনো একটি ক্ষেত্রেও একজন মালিক তথা ভবন নির্মাণের দুর্নীতির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শাস্তি হয়নি। তাঁরা দায়মুক্তি পেয়ে গেছেন। আজ রানা প্লাজার মালিকও দায়মুক্তি পাবেন- এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি। আমরা তখন অপেক্ষা করব একটি অনুষ্ঠানের জন্য- সেখানে মন্ত্রীরা থাকবেন। বিজিএমইএর নেতারা থাকবেন। উপস্থিত থাকবেন পোশাককন্যার মা অথবা বাবা। এক লাখ টাকার একটি চেক তাঁরা পাবেন। টিভি সে দৃশ্য ধারণ করবে। 'সন্তুষ্টচিত্তে' প্রয়াত পোশাককন্যার মা বা বাবা ফিরে যাবেন গ্রামের বাড়িতে। একেকটি মৃত্যুর 'মূল্য' এক লাখ টাকা! কী পরিহাস! 'চিত্রনাট্য' এভাবেই তৈরি করা আছে। তাজরীনের ঘটনায় এভাবেই 'চিত্রায়িত' হয়েছে দৃশ্য। স্পেকট্রামেও তাই হয়েছিল।
আমরা কি পারি না একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে? আমরা কি পারি না অভিযুক্তদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে? অতীতে হয়নি বলে এবারও হবে না, তা তো হতে পারে না। দৃঢ়ভাবেই বলতে পারি, রানা প্লাজায় হত্যাকাণ্ডের যদি বিচার না হয়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে। কতগুলো বিষয় এখন বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। ১. রানা প্লাজার মালিক কোনোভাবেই দায়মুক্তি পেতে পারেন না। তিনি অন্যায়ভাবে ছয়তলা ভবনকে ৯ তলায় উন্নীত করেছেন। রাজউকের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা হওয়া সত্ত্বেও তিনি অনুমতি নিয়েছেন সাভার পৌরসভা থেকে। এটা অবৈধ। অন্যায়। ২. পৌরসভার অনুমতি নিয়েই ভবনটি হয়েছে। কিন্তু রাজউক কেন এর তদারকির দায়িত্বটি পালন করল না? সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকেও এ মৃত্যুর দায়ভার নিতে হবে। ৩. মঙ্গলবার ভবনে ফাটল দেখা দেওয়ায় ব্র্যাক ব্যাংক যদি তাদের শাখা বন্ধ করে দিতে পারে, তাহলে গার্মেন্ট মালিকরা কেন কারখানাগুলো বন্ধ করলেন না? তাঁদেরও বিচার করতে হবে হত্যাকাণ্ডের অপরাধে। ৪. সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবীর হোসেন সরদারের বক্তব্য ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। তিনি মঙ্গলবার ফাটল পরিদর্শন করে বলেছেন, 'ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই।' মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে তিনি একটা অপরাধ করেছেন। অদক্ষতা ও অকর্মণ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রশাসনে এ ধরনের অযোগ্য লোক যত দিন থাকবে, তত দিন প্রশাসন সাধারণ মানুষের কাছে যেতে পারবে না। মৃত্যুর দায়ভার তাঁরও। দ্রুত তাঁকে চাকরিচ্যুত করতে হবে। ৫. বারবার নগর উন্নয়ন আইন ১৯৫৩ ও ইমারত বিধিমালা ২০০৮-এর ব্যত্যয় ঘটেছে। এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। এই আইন কেউ মানে না। ৬. পোশাক কারখানাগুলো তদারকির জন্য একটি 'কমিটি' রয়েছে কাগজে-কলমে। হয়তো কর্মকর্তাও রয়েছেন, যাঁরা কাজ না করেই বেতন নিচ্ছেন। এ কমিটিকে আরো তৎপর হতে হবে। ৭. যেহেতু রানা প্লাজার ঘটনায় অনেক মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে, সেহেতু মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। উচ্চ আদালতের কাছে হত্যাকাণ্ডের বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাইতে হবে। ৮. নারী সংগঠনগুলোও তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য এড়াতে পারে না। পোশাককন্যাদের জীবনের নিরাপত্তার দাবিতে তারা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। ৯. পোশাক কারখানাগুলোয় 'কমপ্লায়েন্স'-এর কথা বারবার বলা হচ্ছে। যেসব কারখানা কমপ্লায়েন্সের নীতিমালা অনুসরণ করবে না, সেই কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। ১০. রানা প্লাজার ঘটনা বিদেশে আমাদের পোশাক শিল্পকে আবারও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিল। যুক্তরাষ্ট্র তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে এখন 'বাংলাদেশি পোশাক বয়কট'-এর আরো হুমকি আসতে পারে।
রাশেদ খান মেনন যে গণহত্যার কথা বলেছেন, এটিকে আমি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে চাই। এই গণহত্যার বিচার হওয়া প্রয়োজন। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে কিংবা সরকারি আনুকূল্য নিয়ে অপরাধীরা যদি পার পেয়ে যায়, তা হবে দুঃখজনক একটি ঘটনা। শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নাম করে আমরা আমাদের সন্তানদের বারবার মৃত্যুকূপে ঠেলে দিতে পারি না।Daily KALERKONTHO27.04.13

জনগণ কখনও ভুল করেনি করবে না


স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এ কোন বাংলাদেশকে আমরা দেখছি? সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের দুর্নীতির খবর যখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১২তে বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুমের ভয়াবহ খবর তুলে ধরা হয়েছে। দুর্নীতিতে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এই সরকার। গত ২১ এপ্রিলের একটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকে বিশ্বব্যাংকের সূত্র উল্লেখ করে বলা হয়েছে পদ্মা সেতুতে শতকরা ১২ ভাগ ঘুষ হিসেবে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কানাডীয় একটি কোম্পানি এসএনসি লাভালিন পদ্মা সেতুর কাজ পাবার জন্য শতকরা ১২ ভাগ টাকা সরকারের ৫ ব্যক্তিকে ঘুষ হিসেবে দিতে রাজি হয়েছিল। পত্রিকার খবর অনুযায়ী এই ১২ ভাগের মধ্যে ২ ভাগ পাবার কথা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের পাবার কথা ৪ ভাগ। আবুল হাসান চৌধুরী লাভালিনের কর্মকর্তাদেরকে সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ঘুষের ২ ভাগ পাবার কথা নিক্সন চৌধুরীর, যিনি প্রধানমন্ত্রীর ফুফাত ভাই’র ছেলে এবং হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ছোট ভাই। অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানের পাবার কথা ১ ভাগ, সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার পাবার কথা ১ ভাগ। আরও ২ ভাগ পাবার কথা এমন এক ব্যক্তির যার কথা উল্লেখ করা হয়নি। বিশ্বব্যাংক লাভালিনের সাবেক কর্মকর্তা রমেশ শাহ’র ডায়রিতে এ নামগুলো পেয়েছে। যদিও সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন ও অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বারবার দুর্নীতি তথা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি বলে জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক আবুল হোসেন ও মশিউর রহমানের ব্যাপারে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করলেও দুদক যে মামলা করেছে তাতে তাদের আসামি করা হয়নি। বলা ভালো কানাডার অন্টারিওর সুপিরিয়ার কোর্ট অব জাস্টিস -এ লাভালিনের ঘুষ-দুর্নীতির মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ২১ মে পরবর্তী বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। দৈনিক প্রথম আলো যেদিন এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সেদিন অপর একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১২। উক্ত প্রতিবেদনে গুম, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য, দুর্বল কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার, বিচার বহির্ভূত হত্যা, অপহরণ এবং দুর্নীতিকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য ঘটনার মধ্যে গণগ্রেফতার, আটক ও পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে দুর্বল বিচারব্যবস্থা এবং বিচারপূর্ব দীর্ঘ কারাবাসকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকার বাকস্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ করার অধিকার সীমিত করারও নির্দেশ দিয়েছে।
সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক সহিংসতা ও অব্যাহত দুর্নীতি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির যারা কিছুটা খোঁজ খবর রাখেন, তারা জানেন এই প্রতিবেদনে মিথ্যা কিছু বলা হয়নি। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা, জামিন দিতে অস্বীকৃতি, জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার, ‘শিবির দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ ইত্যাদি ঘটনাবলী প্রমাণ করে দেশ আজ এক চরম সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কী এ জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? একজন সম্পাদককে আজ তার অধিকারের জন্য অনশন ধর্মঘট পালন করতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৯৭১ সালে নিশ্চয়ই এই বাংলাদেশকে চাননি। পরিস্থিতি আজ এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, ১৮ দলকে বারবার হরতাল দিতে হচ্ছে। অর্থনীতি আজ বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে। সিপিডি অর্থনীতিতে অশনি সঙ্কেতের কথা বলেছে। বিদেশী পোশাক আমদানিকারকরা আস্তে আস্তে বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তারা নতুন বাজার পেয়েছেন ভিয়েতনাম আর লাওস-এ। মিয়ানমার ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যাওয়ায় মার্কিনীদের একটা বড় বাজার হতে যাচ্ছে মিয়ানমারে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু মার্কিন কোম্পানি মিয়ানমারে তাদের অফিস খুলেছে। সেখানে বিনিয়োগের সম্ভাবনাও বাড়ছে। বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এটা তো সত্য সরকারের রাজনৈতিক ‘দস্যুতার’ কারণে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। এডিবি তাদের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ বলা হয়েছিল প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এখন সেটা কল্পনাতেই থেকে গেল। বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। প্রায় ষোল কোটি মানুষের এই দেশটিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক কোটি। প্রতিবছরই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করতে পারতাম। এদেরকে যদি সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ দেয়া যেতো, তাহলে এরা অর্থনীতিতে একটা বড় অবদান রাখতে পারতো। যেখানে ইউরোপে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমছে, সেখানে আমাদের বাড়ছে। চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু চীনে বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, তারা উৎপাদনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না।
এই বয়ষ্ক নাগরিকদের পেনশনসহ সামাজিক নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের যে অবস্থান (বর্তমানে দ্বিতীয়) তা আগামী কয়েক দশক পর চীন আর তা ধরে রাখতে পারবে না। এক সময় BRIC দেশগুলো অন্যতম একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা BRIC-এ যোগ দেয়ায় এই জোট শক্তিশালী হয়েছিল, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু গোল্ডম্যান ম্যাকস এর অর্থনীতিবিদ জিম ও’ নীল এর মতে (যিনি ২০০১ সালে ব্রিকস এর উত্থান নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন) BRICS আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই দুর্বল একটি অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হবে। তার যুক্তি, ‘Economic growth in Russia & China would be hampered by shrinlling working age population, so India and Brazil would be placed with countries that boat growing economics and populations’। তিনি মিথ্যা বলেননি। জিম ও’ নীল নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট MIKT-এর কথা বলেছেন, আর জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জ্যাক প্লোডস্টোন বলেছেন, অপর একটি জোট TIMBI’র কথা। বাংলাদেশের বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত শ্রেণীর উত্থান বাংলাদেশকে আগামী দশকে MIKT অথবা TIMBI জোটে নিয়ে যেতে পারতো। বলা ভালো প্রতিটি দেশের প্রথম অক্ষর নিয়ে নতুন জোটকে পরিচিত করান হচ্ছে, অনেকটা BRIC-এর মতো। যেমন MIKTতে রয়েছে মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক। আর TIMBI জোটে রয়েছে তুরস্ক, ভারত, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে এসব দেশের প্রতিটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। ভারতে দারিদ্র্যতা থাকলেও (২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী জনগোষ্ঠীর ৩৭ দশমিক ২ ভাগ লোক দরিদ্র), বিশ্বব্যাংকের মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে।
তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ (২০০৭ সালে মাত্র ২ ভাগ)। মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। তুরস্কের প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগের উপরে। ইউরোপে যেখানে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে, সেখানে তুরস্কের অর্থনীতিতে তা এতটুকু প্রভাব ফেলেনি। ভারত ও তুরস্ক এটা করতে পেরেছে। কারণ সেখানে রয়েছে বিপুল শিক্ষিত এক জনগোষ্ঠী। রয়েছে রাজনৈতিক সহনশীলতা। আমরা যদি আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারতাম, আমরাও ভারত ও তুরস্কের কাতারে নিজেদের নিয়ে যেতে পারতাম। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের বড় অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। এখন আমাদের ক্ষমতাসীন সরকারই সিদ্ধান্ত নেবেন তারা একুশ শতকে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চান।
কিন্তু সরকারের ‘চাপাবাজি’ এখন জনগণের কাছে পরিষ্কার। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে কিছু ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার জন্য। সংবাদপত্রে হলমার্ক কেলেঙ্কারি বা বিসমিল্লাহ গ্রুপ-এর কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হলেও ‘পর্দার অন্তরালে’ ক্ষমতাবান লোকদের গ্রেফতার করা হয়নি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে সরকারি সোনালী ব্যাংক এখন দেউলিয়া হয়ে যাবার উপক্রম। বর্তমান সরকার অর্থনীতিকে যেখানে নিয়ে গেছেন, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন চার বছর। এই মূল্যায়ন গবেষণা সংস্থা সিপিডির। সিপিডির মতে টানা কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ মন্দা চলছে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের জটিলতার মধ্যে আছে। সিপিডির গবেষণা কর্মকে ফেলে দেয়া যাবে না।
এখন পরিস্থিতি আমাদের যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক National Intelligence Council (NIC) ২০১২ সালের যে Global trends রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে যে ১৫টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। ওই তালিকায় এশিয়ার যে ৩টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মাঝে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। অপর দু’টি দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। যুক্তি হিসেবে ঘওঈ উল্লেখ করেছে সংঘাতময় পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আমরা কোনোভাবে মেলাতে পারবো না, এটা সত্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১৭০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু, বিরোধীদলেংুর নেতাদের উপর গুলিবর্ষণ, তাদের আহত করা ও গ্রেফতার, গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে জনতার প্রতিবাদ প্রমাণ করে সরকার দমন পীড়নের আশ্রয় নিলেও তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে আসছে। সরকারের ‘বিদায়’ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইতিহাস থেকে এই সরকার কিছু শেখেনি। জোর করে ক্ষমতায় থাকার কোনো ইতিহাস নেই। জনগণ কোনো ভুল করেনি। আগামীতেও করবে না।
26.04.13

রাষ্ট্রপতি কি জাতির অভিভাবক হতে পারবেন?



গতকাল বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ শপথ গ্রহণ করার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি হামিদ কি জাতির অভিভাবক হতে পারবেন? সবার প্রত্যাশা ছিল মহাজোট সরকার এমন কোন নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করবেন, যিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন। আবদুল হামিদ নির্দলীয় ব্যক্তি নন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সেই ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংসদ সদস্য হিসেবে বিজয়ী হওয়ার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি কখনও দলত্যাগ করেননি, এমনকি তথাকথিত ‘এক-এগারো’র সময়ও তিনি সংস্কারবাদীর খাতায় নিজের নাম লেখাননি। একজন বিজ্ঞ ও সৎ রাজনীতিক হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসিন হলেন।
রাষ্ট্রপতির এ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যদি জোটের শরিক দল ও বিরোধী দলকে সম্পৃক্ত করা বা তাদের মতামত নেয়া হতো, তাহলে সেটা শোভন হতো। ভালো হতো। কিন্তু তা হয়নি। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির নেতা এইচএম এরশাদ তার উষ্মা ঢেকে রাখতে পারেননি। আর বিএনপির মতামত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি সরকারের নীতিনির্ধারকরা। তবে আমার ধারণা, আবদুল হামিদের ব্যাপারে বিএনপির ‘না’ থাকার কথা নয়। কারণ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা যে ভাষায় বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলেন, আবদুল হামিদ সে ভাষায় অতীতে কখনও কথা বলেননি। সংসদে বিএনপির উপস্থিতি ছিল কম। তবুও তিনি বারবার চেষ্টা করে গেছেন বিএনপিকে সংসদে নিয়ে আসতে। কিন্তু পারেননি, এটা সত্য। স্পিকার হিসেবে মাঝেমধ্যে সংসদ ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখতে ব্যর্থ হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ব্যাপারে তিনি বারবার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে গেছেন। যতদূর জানি, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভালো। এখন এক কঠিন সময়ে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বটি গ্রহণ করলেন। তিনি কি পারবেন ‘সনাতন আওয়ামী রাজনীতির মানসিকতা’ থেকে বেরিয়ে এসে বিএনপির ব্যাপারে একটি ‘নমনীয় মনোভাব’ গ্রহণ করতে? একজন ‘রাজনৈতিক ব্যক্তি’ যখন রাষ্ট্রপতি হন, তখন তার পক্ষে পারাটা কঠিন। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী পারেননি। তার নিজ দলই তাকে অভিশংসনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে একজন ‘পুরাদস্তুর আওয়ামী লীগার’ আবদুল হামিদ পারবেন, তা মনে করারও কোন কারণ নেই। তবে এ কথাটাও আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত।
আমাদের সংবিধানের চতুর্থ ভাগে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে রাষ্ট্রপতির কোন ক্ষমতা নেই। ৪৮(৩) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, তার মূল কাজ মূলত দুটি : ক. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ (সংসদে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিদের নেতা) ও খ. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। এর বাইরে তিনি যেসব কাজ করবেন, তা ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ’ অনুযায়ীই করবেন। এবং দায়িত্ব নেয়ার দিন থেকে (অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল ২০১৩ থেকে) তিনি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। সাবেক সিনিয়র আমলা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খানের ভাষায় ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা একজন সচিবালয়ের সেকশন অফিসারের চেয়েও কম।’ তিনি খুব একটা মিথ্যা বলেননি। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘কবর জেয়ারতে’র কথাটা নিশ্চয়ই অনেকের মনে থাকার কথা। এখন আবদুল হামিদ যখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন, তখন সঙ্গত কারণেই বেশকিছু প্রশ্ন সামনে এসে যায় : ১. বর্তমানে দেশে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার ব্যাপারে তিনি আদৌ কোন উদ্যোগ নেবেন কি-না? ২. যদি যুক্তি হিসেবে ধরে নেই, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৮ দল বিজয়ী হবে, তাহলে ওই সরকার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে দেখতে চাইবে কি-না?
এটা সত্য, মানুষের প্রত্যাশা নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সংকট নিরসনে একটি উদ্যোগ নেবেন। জাতির অভিভাবক হিসেবে তার এ কাজটি করা উচিত। কিন্তু তিনি তখনই তা করবেন, যখন এ ধরনের ‘সংলাপে’ প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া তিনি এক চুলও যেতে পারবেন না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি একজন বহুল আলোচিত ও কোন কোন ক্ষেত্রে বিতর্কিত বিচারপতির আপিল বিভাগে পদোন্নতির ফাইলে স্বাক্ষর করেছিলেন। অথচ মাত্র কিছুদিন আগে স্পিকার হিসেবে তিনি ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে একটি রুলিং দিয়েছিলেন। সেই বিচারপতির পদোন্নতির ফাইল যখন তার সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখন তিনি ‘বিবেক দ্বারা’ চালিত হতে পারেননি। উত্থাপিত ফাইলে তিনি স্বাক্ষর করতে ‘বাধ্য’। রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে এ ধরনের বাধ্যবাধকতা আছে। তার স্বউদ্যোগে করার কিছু নেই। অতীতে যারাই ‘কিছু’ করতে গেছেন, তারাই বিতর্কিত হয়েছেন। বিতর্কিত হয়েছিলেন অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীও। এমনকি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে নিয়োগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সমালোচনা করতে এতটুকুও দ্বিধাবোধ করেননি। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। ওই ‘সংলাপে’ বিএনপিও যোগ দিয়েছিল। তবে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রপতির ওই উদ্যোগের পেছনে ব্যক্তি জিল্লুর রহমানের চেয়ে সরকার তথা সরকারপ্রধানের আগ্রহ ছিল বেশি। তাই তিনি ‘সংলাপ’ করতে পেরেছিলেন।
এখন সে ধরনের একটি ‘সংলাপে’র সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও রাষ্ট্রপতি ওই ‘সংলাপ’ করবেন যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি ‘গ্রিন সিগনাল’ পাওয়া যায়। বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে তিনি আদৌ কোন উদ্যোগ নেবেন, এটা মনে হয় না। তবে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি বিরোধী দল জয়ী (?) হয়, তাহলে একটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। তার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে তখন। সংবিধানের ৫২(১) ধারায় রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের বিধান রয়েছে বটে, কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যদের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। ৫৩(১) ধারায় রাষ্ট্রপতিকে ‘অসামর্থ্যরে’ কারণে অপসারণ করা যায়। রাষ্ট্রপতি যদি শারীরিক বা মানসিকভাবে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন, তাহলে তাকে অপসারণ করা যায়। এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজন ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ সংসদ সদস্যের সমর্থন (এক্ষেত্রে অবশ্য দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থনের কথা বলা হয়নি)। তবে এ প্রক্রিয়াও জটিল। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি একটি ‘চিকিৎসা পর্ষদ’ গঠন করবেন। ‘চিকিৎসা পর্ষদ’ সব ক্ষেত্রে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের পক্ষে থাকবে, তা বলা যাবে না। সুতরাং একটি জটিলতা আছেই। তাই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যে আগামী দিনগুলোতে আলোচনায় থাকবেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
তিনি স্থানীয় পর্যায় থেকে উঠে এসেছেন। একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগ নেই। অত্যন্ত সৎ ও সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এ মানুষটি আমাদের রাজনীতিকদের জন্য একটি ‘প্রেরণার উৎস’ হয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ জাতির। আমাদের রাজনীতিকরা, বিশেষ করে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অনেকেই নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে যান। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান মহাজোট সরকারের বেশ ক’জন মন্ত্রী ও উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাম ঘরানার এক মন্ত্রী, যিনি কোনদিন সংসদ নির্বাচনে ২ থেকে ৩ হাজারের বেশি ভোট পাননি, তিনি মন্ত্রী হয়ে একাধিক প্লট ও গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়ে গেলেন! তাদের কাছে আবদুল হামিদ কোন আদর্শ নন। তার সন্তানরা কোনদিন আলোচনায়ও আসেননি। তবে প্রশ্ন তো থেকেই যায়Ñ নির্লোভ মানুষটি বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মুখে আদৌ হাসি ফোটাতে পারবেন কি-না?
এ দেশটির সম্ভাবনা প্রচুর। বিপুল জনশক্তির এ দেশে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ হবে আগামী দশকের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। গওকঞ ও ঞওগই অর্থনৈতিক জোট নিয়ে যে সম্ভাবনা দেখছেন অর্থনীতিবিদরা, বাংলাদেশ খুব সহজেই এ দুটি জোটে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। এজন্য চাই যোগ্য নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এ দুটিতে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ক্ষমতায় থাকবেন ২০১৮ সাল পর্যন্ত। তার ক্ষমতা সীমিত, আমরা জানি। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের তিনি বোঝাতে পারেন, এ মুহূর্তে সংঘাত নিরসনে একটি উদ্যোগ নেয়া বড় প্রয়োজন। আর দায়িত্বটি সরকারের ঘাড়েই বর্তায়। বিরোধী দল অসহযোগ আন্দোলনের কথা বলেছে। হেফাজতে ইসলাম ৫ মে ঢাকা অবরোধের ডাক দিয়েছে। এর আগে তাদের ঢাকা অবরোধ সরকারের বাধার কারণে সফল হয়নি। কিন্তু ঢাকার শাপলা চত্বরে কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতি জানান দিয়ে গিয়েছিল,পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা একটি ‘শক্তি’। তাদের এ উত্থান পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভিন্ন ‘ব্যাখ্যা’ পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান (?) নিয়েও শংকিত পশ্চিমা বিশ্ব।
এমনই এক পরিস্থিতিতে নির্বাচনের দিন এগিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার যদি কিছুটা ‘নমনীয়’ না হয়, তাহলে সংঘাত বাড়বে বৈ কমবে না। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন তাই জরুরি। রাষ্ট্রপতিকে ‘সুযোগ’ দেয়া হলে তিনি একটি ‘সংলাপ’ শুরু করতে পারেন। আমার বিশ্বাস বিএনপি ওই ‘সংলাপে’ যোগ দেবে এবং তাদের মতামত তুলে ধরবে, যেমনটি করেছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রশ্নে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই।
Daily JUGANTOR
24.04.13

ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রত্যা

বাংলাদেশের এক ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন আবদুল হামিদ। স্থানীয় পর্যায় থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিবিদ দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হলেন শুধু তার ন্যায়নিষ্ঠা, সততা আর সর্বজনগ্রহণযোগ্যতার কারণে। কিন্তু এক কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ। দুর্নীতিতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যখন ভূলুণ্ঠিত, সরকার ও বিরোধী দল যখন এক চরম আস্থাহীনতার মধ্যে রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন সৃষ্টি হয়েছে বড় অনিশ্চয়তা, তখন গোটা জাতি যে রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে থাকবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তিনি দায়িত্ব নিলেন এমন একটা সময়, যখন বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালিন পদ্মা সেতুর কাজ পাওয়ার জন্য শতকরা ১২ ভাগ টাকা সরকারের ৫ ব্যক্তিকে ঘুষ হিসেবে দিতে রাজি হয়েছিল। পত্রিকার খবর অনুযায়ী এই ১২ ভাগের মধ্যে ২ ভাগ পাওয়ার কথা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের পাওয়ার কথা ৪ ভাগ। আবুল হাসান চৌধুরী লাভালিনের কর্মকতাদের সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ঘুষের ২ ভাগ পাওয়ার কথা নিক্সন চৌধুরীর, যিনি প্রধানমন্ত্রীর ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে এবং হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ছোটভাই। অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পাওয়ার কথা ১ ভাগ, সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার পাওয়ার কথা ১ ভাগ। আরো ২ ভাগ পাওয়ার কথা এমন এক ব্যক্তির, যার কথা উল্লেখ করা হয়নি। বিশ্বব্যাংক লাভালিনের সাবেক কর্মকর্তা রমেশ শাইর ডায়রিতে এ নামগুলো পেয়েছে। যদিও সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন ও অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বারবার দুর্নীতি তথা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি বলে জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক আবুল হোসেন ও মসিউর রহমানের ব্যাপারে তাদের অভিযোগ উপস্থাপন করলেও দুদক যে মামলা করেছে তাতে তাদের আসামি করা হয়নি। বলা ভালো, কানাডার অন্টারিওর সুপিরিয়র কোর্ট অব জাস্টিস-এ লাভালিনের ঘুষ দুর্নীতির মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আগামী ২১ মে পরবর্তী বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। দৈনিক প্রথম আলো যে দিন এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে, সেদিন অপর একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১২। ওই প্রতিবেদনে গুম, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য, দুর্বল কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ এবং দুর্নীতিকে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য ঘটনার মধ্যে গণগ্রেফতার, আটক ও পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে দুর্বল বিচার ব্যবস্থা এবং বিচার-পূর্ব দীর্ঘ কারাবাসকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকার বাক-স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ করার অধিকার সীমিত করারও নির্দেশ দিয়েছে। অভিযোগ আছে, সাংবাদিকরা সেল্ফ সেন্সরশিপে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় রাজনৈতিক সহিংসতা ও অব্যাহত দুর্নীতি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির যারা কিছুটা খোঁজ-খবর রাখেন, তারা জানেন এই প্রতিবেদনে মিথ্যা কিছু বলা হয়নি। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা, জামিন দিতে অস্বীকৃতি, জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার, শিবির দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ইত্যাদি ঘটনাবলি প্রমাণ করে দেশ আজ এক চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কী এ জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? একজন সম্পাদককে আজ তার অধিকারের জন্য অনশন- ধর্মঘট পালন করতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৯৭১ সালে নিশ্চয়ই এই বাংলাদেশকে চাননি।
পরিস্থিতি আজ এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, ১৮ দলকে বারবার হরতাল দিতে হচ্ছে। অর্থনীতি আজ বড় ধরনের হুমকির মুখে। সিপিডি অর্থনীতিতে অশনি সংকেতের কথা বলেছে। বিদেশি পোশাক আমদানিকারকরা আস্তে আস্তে বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তারা নতুন বাজার পেয়েছেন ভিয়েতনাম আর লাওসে। মিয়ানমার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় মার্কিনিদের একটা বড় বাজার হতে যাচ্ছে মিয়ানমার। ইতিমধ্যে বেশকিছু মার্কিন কোম্পানি মিয়ানমারে তাদের অফিস খুলেছে। সেখানে বিনিযোগের সম্ভাবনাও বাড়ছে। বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এটা তো সত্য, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। এডিবি তাদের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে বলেছে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ বলা হয়েছিল প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এখন সেটা কল্পনাতেই থেকে গেল। বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। প্রায় ষোলো কোটি মানুষের এই দেশটিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক কোটি। প্রতি বছর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করতে পারতাম। তাদের যদি সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ দেয়া যেত, তাহলে তারা অর্থনীতিতে একটা বড় অবদান রাখতে পারত। যেখানে ইউরোপে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমছে, সেখানে আমাদের বাড়ছে। চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু চীনে বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা উৎপাদনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। এই বয়স্ক নাগরিকদের পেনশনসহ সামাজিক নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের যে অবস্থান (বর্তমানে দ্বিতীয়), তা আগামী কয়েক দশক পর চীন আর তা ধরে রাখতে পারবে না। এক সময় বিআরআইসি দেশগুলো অন্যতম একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিআরআইসি-এ যোগ দেয়ায় এ জোট শক্তিশালী হয়েছিল, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদ জিম ও নীলের মতে (যিনি ২০০১ সালে ব্রিকসের উত্থান নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন) বিআরআইসিএস আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই দুর্বল একটি অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হবে। জিম ও নীল নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট এমআইকেটি-এর কথা বলেছেন আর জর্জ ম্যাগন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জ্যাক গ্লোডস্টোন বলেছেন, অপর একটি জোট টিআইএমবিআই’র কথা। বাংলাদেশের বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত শ্রেণীর উত্থান বাংলাদেশকে আগামী দশকে এমআইকেটি অথবা টিআইএমবিআই জোটে নিয়ে যেতে পারত। বলা ভালো, প্রতিটি দেশের প্রথম আসর নিয়ে নতুন জোটকে পরিচিত করা হচ্ছে, অনেকটা বিআরআইসিএস-এর মতো। যেমন এমআইকেটিতে রয়েছে মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক। আর টিআইএমবিআই জোটে রয়েছে তুরস্ক, ভারত মেক্সিকো, ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে এসব দেশের প্রতিটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। ভারতে দারিদ্র্য থাকলেও (২০১০ সালের হিসাব আনুযায়ী জনগোষ্ঠীর ৩৭ দশমিক ০২ ভাগ লোক দরিদ্র), বিশ্বব্যাংকের মতে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। তখন বিশ্বঅর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ (২০০৭ সালে মাত্র ২ ভাগ)। মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। তুরস্কের প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগের ওপর। ইউরোপে যেখানে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে, সেখানে তুরস্কের অর্থনীতিতে তা এতটুকু প্রভাব ফেলেনি। ভারত ও তুরস্ক এটা করতে পেরেছে। কারণ সেখানে রয়েছে বিপুল শিক্ষিত এক জনগোষ্ঠী। রয়েছে রাজনৈতিক সহনশীলতা। আমরা যদি আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারতাম, আমরাও ভারত ও তুরস্কের কাতারে নিজেদের নিয়ে যেতে পারতাম। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের বড় অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। এখন আমাদের ক্ষমতাসীন সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে তারা একুশ শতকে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সরকারের নির্লিপ্ততা এখন জনগণের কাছে পরিষ্কার মনে হচ্ছে। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে কিছু ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার জন্য। সংবাদপত্রে হলমার্ক কেলেঙ্কারি বা বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হলেও ‘পর্দার অন্তরালে’ ক্ষমতাবান লোকদের গ্রেফতার করা হয়নি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে সরকারি সোনালী ব্যাংক এখন দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বর্তমান সরকার অর্থনীতিকে যেখানে নিয়ে গেছে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন চার বছর। এই মূল্যায়ন গবেষণা সংস্থা সিপিডির। সিপিডির মতে টানা কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বড় ধরনের জটিলতার মধ্যে আছে। সিপিডির গর্বেষণাকর্মকে ফেলে দেয়া যাবে না।
এখন পরিস্থিতি আমাদের যে দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স কাউন্সিল ২০১২ সালের যে গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে যে ১৫টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। ওই তালিকায় এশিয়ায় যে ৩টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের কথাও রয়েছে। অপর দুটি দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। যুক্তি হিসেবে এনআইসি উল্লেখ করেছে সংঘাতময় পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আমরা কোনোভাবে মেলাতে পারব না, এটা সত্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১৭০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু, বিরোধী দলের নেতাদের ওপর গুলিবর্ষণ, তাদের আহত করা ও গ্রেফতার, গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের গাড়িতে আগুন (আওয়ামী লীগের হরতালবিরোধী মিছিলে) কিংবা ১২ এপ্রিল খুলনায় ভারতীয় হাইকমিশনারের গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা এ কথাই প্রমাণ করে বাংলাদেশ বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই অস্থিরতা একদিকে যেমনি গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে তেমনি জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে। এর সঙ্গে এখন যোগ হলো লাগাতার হরতালের বিষয়টি।
এমনি এক পরিস্থতিতে দেশের বিশতম রাষ্ট্রপতির দায়িত্বটি গ্রহণ করলেন আব্দুল হামিদ। রাজনীতিতে যথেষ্ট অভিজ্ঞ তিনি। ১৯৭০ সালে তরুণ বয়সে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই থেকে তাকে আর পিছু তাকাতে হয়নি। তিনি তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, সরলতা নিয়ে বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করবেন, এটাই মানুষের প্রত্যাশা। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বিরোধী সব দলের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন। আজো তিনি সে রকম একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে জাতি আজ বিভক্ত। দেশের সুশীল সমাজ, এমনকি মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে তাদের অভিমত দিলেও সরকার এখনো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে আন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রেখেই নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু বিরোধী দল এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা আগামী অক্টোবরে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এই পরিস্থিতি পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান কোনো আশার কথা বলে না। প্রতিনিয়ত মানুষ এক আশঙ্কার মধ্যে থাকে। থাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে। যদিও সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত এবং সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া তিনি কোনো কিছুই করতে পারবেন না আগামীতে। তারপরও তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতি। তিনি জাতির অভিভাবক। সাংবিধানিকভাবে না হলেও সংকটকালীন সময়ে তিনিই পালন করতে পারেন একটি বড় ভূমিকা। এই বাংলাদেশকে আমরা চাইনি। হরতাল আজ আমাদের জন্য একটি অভিশাপ। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। পরস্পর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের রাজনীতি শুরু করা দরকার। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, দারিদ্র্য বিমোচন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আমাদের কাম্য। আমাদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু রাজনৈতিক অনৈক্য আমাদের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। দীর্ঘ ৪২ বছর পার করার পর আমাদের উপলব্ধিতে যদি পরিবর্তন না আসে, তা হলে আমরা বিশ্ব আসরে এক সময় একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিতি পাব। তাই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আমরা জানি সাংবিধাকভাবে তার ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু জাতির অভিভাবক হিসেবে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আমরা জানি ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকেরই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বেগম জিয়ার সঙ্গেও তার সম্পর্ক চমৎকার। সনাতন আওয়ামী লীগের নেতাদের মতো তিনি অতীতে কখনো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কটূক্তি করেননি। জাতীয় নেতা হিসেবে তিনি সবসময় তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন। এটা অনেকেই জানেন সংসদে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের এমপিরা যখন সোচ্চার হতেন একসঙ্গে, তখন একপর্যায়ে অনেকটা অসহায়ের মতো তিনি সংসদকে মাছের বাজারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
এই মুহূর্তে আমার বিবেচনায় কয়েকটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। ক. পুলিশের ভূমিকাকে ‘আগ্রাসী’ অবস্থান থেকে ‘মানবিক’ অবস্থানে নিয়ে আসা। পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মারবে, বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত মামলা করে তাদের জেলে পুড়বে, তা কাম্য নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলেন, তাও শোভন নয়। খ. একটি নির্বাচন হবে। সরকার চাচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘আন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে রেখে নির্বাচনের আয়োজন করতে। এটা যে কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না, তা সরকারের নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি করতে পারছেন না। বর্তমান ফর্মুলায় নিবার্চন হলে বিএনপি তাতে অংশ নেবে না। বিদেশিরাও এই নির্বাচনকে স্বীকার করে নেবে না। বিদেশি দাতাগোষ্ঠীও সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের পক্ষে।
কিন্তু সরকার এককভাবে নির্বাচন করলে সংকট আরো গভীরতর হবে, যা চূড়ান্ত বিচারে ক্ষমতাসীন মহাজোটের জন্যও কোনো ভালো খবর হবে না। গ. একটি ইসলামপ্রিয় শক্তির উত্তান ঘটেছে বাংলাদেশ। হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড. তাদের ঢাকা অবরোধ ও ঢাকার শাপলা চত্ব¡রে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি জানান দিয়ে গেল তারা একটি ‘শক্তি’ এই শক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশে ‘আস্তিক’ ও ‘নাস্তিক’-এর একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এটা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। হঠাৎ করে হেফাজতে ইসলাম কেন রাজনৈতিক ময়দানে আবির্ভূত হলো, এটাও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। খুব সহজেই হেফাজতের ১৩ দফা নিয়ে আলোচনা করা যায়। জাতির অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এই তিনটি সমস্যা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তিনি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না সত্য, তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উপদেশ ও পরামর্শ দিতে পারেন এবং সরকারের সম্মতি সাপেক্ষে একটি ‘সংলাপ’-এর উদ্যোগ নিতে পারেন। ইতিহাস অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদকে সে রকম একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবেই দেখতে চায়, যিনি চরম সংকটের মুহূর্তে ‘হাল’ ধরেছেন এবং সংকট সমাধানের উদ্যোগী হয়েছেন।
তিনি কতটুকু পারবেন আমরা জানি না। কিন্তু জাতি তার কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশা করে। তিনি সংকট সমাধানে উদ্যোগী হবেন না, এটা প্রত্যাশিত নয়। সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও উচিত হবে রাষ্ট্রপতিকে এই দায়িত্বটি দেয়া। আমার ধারণা রাষ্ট্রপতির যে কোনো উদ্যোগকে বিএনপি ইতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে গ্রহণ করবে। বাংলাদেশ তার ইতিহাসে এক কঠিন সময় পার করছে। রাজনীতি ‘নো রিটার্নের’ পর্যায়ে চলে গেছে। কেউই তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সরে আসছে না। জাতি উৎকণ্ঠিত। হরতালের পর হরতাল আমাদের জনজীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। তাই রাষ্ট্রপতির একটি ‘উদ্যোগ’ প্রত্যাশিত। গোটা জাতি এখন তাকিয়ে আছে বঙ্গভবনের দিকে।
Daily Manobkontho
25.04.13

তত্ত্বাবধায়ক সরকারে বাধা কোথায়

 


দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ পাকিস্তান ও নেপাল আগামী সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও বাংলাদেশে আগামী দশম সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, সে ব্যাপারে এখনও একটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এ প্রশ্নে সরকার, বিরোধী দল আর সুশীল সমাজের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সরকারের অবস্থান পরিষ্কার_ সংবিধানে যেখানে একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের' কথা বলা হয়েছে, সেখানে নির্বাচন হবে 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে'র আওয়ায়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে যাবেন। বিরোধী দলের দাবি একটি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্যথায় নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে না। আর সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে টিআইবি একটি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব করেছে। তবে সরকার এতটুকুও নমনীয় হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি বর্তমান সরকার। এখন একটি 'সমঝোতা' যদি না হয়, তাহলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। বিরোধী দল বলছে, তারা অক্টোবর থেকে অসহযোগ আন্দোলনে যাবে। বিরোধী দল তত্ত্বাবধাক সরকারের দাবিতে হরতাল করেছে। ২৩ ও ২৪ এপ্রিল আবারও হরতাল। কিন্তু হরতালে সরকারের মনোভাবে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখন 'অসহযোগ আন্দোলনের' হুমকিতে সরকারের মনোভাবে পরিবর্তন আসবে, তা মনে করারও কোনো কারণ নেই। সরকার স্পষ্টতই হার্ডলাইনে গেছে।
পাকিস্তান ও নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো পার্থক্য নেই। পাকিস্তানে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগের (নওয়াজ শরিফ) মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার সেখানে সরকারের পতন ঘটেছে। পিপিপি নেত্রী বেনজির ভুট্টো দু'দু'বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু টার্ম পূরণ করতে পারেননি। ঠিক তেমনি মুসলিম লীগ নেতা নওয়াজ শরিফও দু'দু'বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও কোনোবারই তার টার্ম শেষ করতে পারেননি। এমনি এক পরিস্থিতিতে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু ২০০৮ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেনজির ভুট্টো নিহত হলে দৃশ্যপট বদলে যায়। নির্বাচনে পিপিপি বিজয়ী হয়। গত ১৭ মার্চ পিপিপি তাদের ৫ বছরের টার্ম শেষ করেছে। একই কথা প্রযোজ্য নেপালের ক্ষেত্রে। নেপালে রাজতন্ত্র অবসানের পর সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে যে সাংবিধানিক পরিষদ গঠিত হয়েছিল, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে কোনো ঐক্য ছিল না। সাংবিধানিক পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই নয়া সংসদ নির্বাচনের জন্য তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তানে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বটে। কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ গত ২৪ মার্চ পাকিস্তানে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু তার ফিরে আসাটা খুব সুখের হয়নি। নির্বাচন কমিশন তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। শুধু তাই নয়, কোর্ট তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। তাকে তার নিজ বাড়িতেই অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। তাকে ১৪ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় আরও একবার প্রমাণিত হলো, সাবেক বিচারপতি মির হাজার খান খোসোর নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সত্যিকার অর্থেই 'নিরপেক্ষ' থাকার চেষ্টা করছে। নির্বাচন কমিশন যে কোনো ধরনের প্রভাবের বাইরে থেকে আইন অনুযায়ী তাদের 'অধিকার' প্রয়োগ করছে। নির্বাচনে কী হবে, সেটা বলা কঠিন। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা যাচ্ছে, তারা নিরপেক্ষভাবেই কার্য সম্পাদন করছেন।
নেপালে গঠিত হয়েছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আগামী ২১ জুন সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর এ লক্ষ্যে গত ১৪ মার্চ একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন নেপাল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি খিলরাজ রেগমি। প্রায় ১০ মাস ধরে সেখানে রাজনীতিতে অচলাবস্থা চলে আসছিল। নেপালে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছিল। মূলত চারটি প্রধান দলের পক্ষ থেকেই গত দশ মাসে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু পার্লামেন্টের সমর্থন না পাওয়ায় কেউই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেননি। গত মে মাসে পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু ওই সময় নেপালের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রধান চারটি দল একটি অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকারের পক্ষে নীতিগতভাবে একমত হয় ও বিচারপতি রেগমিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করে। রেগমি ইতিমধ্যে শপথও নিয়েছেন। তার প্রধান ও একমাত্র কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা। এখানে মূল সমস্যা ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছিলেন না। এমনকি মাওবাদীদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছিল। যারা বিশ্ব রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন অতি সম্প্রতি ইউরোপের একটি দেশ বুলগেরিয়ায় সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট রোজেন প্লোভনেলিয়েভ সাবেক কূটনীতিক মারিয়ান রায়কভকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। রায়কভ মে মাস পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন এবং মে মাসে তিনি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করবেন। অনেকের মনে থাকার কথা, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গ্রিসে পাপেন্দ্র সরকারের পতন ঘটেছিল। পরে সেখানে একজন বিচারপতি পাপাদেমাসের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং তিনি ইতিমধ্যে একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছেন।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বেমানান। কিন্তু কখনো-সখনো রাষ্ট্রকে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। গ্রিসে যেখানে এক সময় গণতন্ত্রের বীজ রোপিত হয়েছিল, সেখানেও পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা গ্রহণ করতে। ২০০৭ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছিল, অথচ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না। বৃহত্তর ঐক্য ও সংকট এড়াতে সরকারকে সংবিধানবহির্ভূত অনেক সিদ্ধান্তই নিতে হয়। এসব ঘটনা থেকে আমরা কী শিখেছি? বাংলাদেশে আন্দোলনের ফলশ্রুতি ছিল এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেটা ১৯৯৩-এর পরবর্তী সময়ের কথা। জামায়াতও সেদিন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। খালেদা জিয়া প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীকালে সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, যা সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়। এরপর সংবিধানে সংশোধনী এনে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের একটি রায় একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, দশম সংসদ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে? সরকার সংবিধান অনুসরণ করবে_ এটাই স্বাভাবিক। আর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোনো সুযোগ নেই। এটাও সত্য, সকল দলের বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না হোক, একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানে কোনো সংশোধনী না এনেও একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। এটা নিয়ে সংলাপ প্রয়োজন। সংলাপে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে_ ১. নবম সংসদে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার বয়স হবে মাত্র ৩ মাস। এই তিন মাসের মধ্যে ওই সরকার নির্বাচন পরিচালনা সম্পন্ন করতে বাধ্য থাকবে; ২. প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন মাস আগে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন; ৩. দুটি প্রধান দলের পক্ষ থেকে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে ওই সরকার গঠিত হবে; ৪. নিরপেক্ষতার স্বার্থে সংসদের একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্যকে এ দায়িত্বটি দেওয়া যায়। অথবা সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পেঁৗছলে তিনি শূন্য আসনে বিজয়ী হয়ে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এই দায়িত্বটি পালন করবেন। নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি আরপিওতে থাকতে হবে, যা সম্প্রতি বাতিল করা হয়েছে; ৫. নির্বাচন-পূর্ব তিন মাস প্রধান দুই দলের নেত্রী সমমর্যাদা ভোগ করবেন। মোটা দাগে যে কথাটা বলা যায় তা হচ্ছে, নির্বাচন-পূর্ব তিন মাস প্রধানমন্ত্রী নিজেকে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে ঘোষণা করলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীকে রেখে কোনো ফর্মুলাই জট খুলবে না। নেপালে রাজনীতিবিদরা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাকিস্তানেও সেই পথে গেছে। এখন আমরা যদি এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিই, আমরা বড় ধরনের একটা সংকট এড়াতে পারব।
Daily SAMAKAL
23.04.13

এ দেশে এখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই


মাহমুদুর রহমানের পর এবার তার মা মাহমুদা বেগম। তাঁর বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা হয়েছে। মামলা হয়েছে দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধেও। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি অবৈধভাবে  সংগ্রামের (?) প্রেস থেকে দৈনিক আমার দেশ ছাপার অনুমতি দিয়েছিলেন। আর মাহমুদা বেগম, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি আমার দেশ কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে বিনা অনুমতিতে (?) সংগ্রামের প্রেস থেকে দৈনিক আমার দেশ ছেপেছেন। অথচ যতটুকু জানা গেছে মাহমুদা বেগম তথা আমার দেশ কর্তৃপক্ষ আইন মেনেই আল-ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে পত্রিকাটি ছেপেছেন। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। এমনি এক পরিস্থিতিতে বয়োবৃদ্ধা মাহমুদা বেগমের নামে মামলা, সম্পাদক আবুল আসাদকে জড়ানো মুক্তচিন্তার জগতের জন্য একটি অশনি সঙ্কেত। অতীতে কখনো এ রকমটি হয়নি। আরো দুঃখজনক খবর হচ্ছে আমার দেশ এর ছাপাখানা, যা এখন সিলগালা করা, সেখানকার ১৯ জন সাধারণ কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে কোনো কারণ ছাড়াই। আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের পর তাঁকে ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এই খবরের রেশ ফুরিয়ে যাবার আগেই দৈনিক সংগ্রামের ছাপাখানা থেকে ছাপা হওয়া আমার দেশের কয়েক হাজার কপি জব্দ এবং মামলা করল পুলিশ। এর আগে আমার দেশ-এর ছাপাখানা সিলগালা করে দিয়েছিল পুলিশ। কর্তৃপক্ষ এরপর প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ১০ ধারা মতে আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে পত্রিকাটি সীমিত আকারে প্রকাশ করে আসছিল। এটাও সহ্য হলো না সরকারের।  ১লা বৈশাখ পত্রিকাটি বাজারে যাবার আগেই জব্দ করল ছাপা হওয়া কয়েক হাজার সংখ্যা। এই প্রবণতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭৩-৭৪ সালের কথা। ওই সময় বিরোধী দলের মুখপত্র গণকণ্ঠ অফিসে পুলিশ হামলা করে পত্রিকা অফিস বন্ধ করে দিয়েছিল। পত্রিকার প্লেট ভেঙে ফেলেছিল। গ্রেফতার করেছিল ওই পত্রিকার সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে। ওই সময়ও ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। আজো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ওই সময় শেখ মুজিব মস্কোপন্থীদের প্ররোচণায় সিপিবি ও মস্কোপন্থী ন্যাপ (মো.)কে নিয়ে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠন করেছিলেন। আজো মস্কোপন্থীরা মন্ত্রিসভায় এবং প্রেসিডিয়ামে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। নীতিনির্ধারণীতে তারা পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অনেকেই এখন প্রশ্ন করেন বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে?
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান ‘ধর্মীয় উন্মাদনা’ সৃষ্টিতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। আসলে কী তিনি তাই করেছেন? এ দেশের সিনিয়র আইনজীবীরা বলেছেন তিনি কোনো অন্যায় করেননি। তাঁকে গ্রেফতার করে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে, এমন অভিযোগও উঠেছে। ব্যারিস্টার রফিক উল হক মনে করেন মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন মনে করেন জনাব রহমানকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থা ও সংবাদপত্রের অধিকার ুণœ করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী মনে করেন সরকার অসাংবিধানিকভাবে সংবাদমাধ্যমের মত প্রকাশের অধিকারকে নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতার করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুলের অভিযোগ হচ্ছে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও নির্যাতন সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক ও গণবিরোধী নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলেছেন, ‘যে সরকার সংসদ সদস্যের নিজের পিস্তলের গুলিতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে গ্রেফতার করে না, শর্টগান উচিয়ে গুলি করা বা দুর্নীতির  প্রমাণ্য অভিযোগে অভিযুক্ত দলের নেতাদের আটক করে না, নির্মম খুনি ও প্রমাণিত দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদান করেন, তার মুখে একজন সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতার করা আইনের শাসন, এটি শুনলে হাস্যকরই শোনায়। মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার বরং স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্বকারী একটি পদক্ষেপ।’ আর তরুণ আইনজীবী তাজুল ইসলাম মনে করেন মাহমুদুর রহমানকে ১৩ দিনের রিমান্ডে দিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা ৫৫ ডিএলআর ভঙ্গ করা হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ আইনজীবীদের একটা বড় অংশ যখন পত্র-পত্রিকায় তাদের মনোভাব এভাবে প্রকাশ করেন, তখন মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আইনজীবীদের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, একজন সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতার করা আইনসঙ্গত হয়নি। এখানে বলা ভালো গণজাগরণ মঞ্চ মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছিল।
সমাজ উন্নয়নে, সমাজ বিকাশে সংবাদপত্র একটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। যুগে যুগে সংবাদপত্রের এ ভূমিকা স্বীকৃত। বস্তুত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও স্বাধীন সংবাদপত্র পরস্পর পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের সংবিধানেও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ এই অনুচ্ছেদের ৩৯ (২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দু’টো আরো স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে। প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার কথা এব ‘খ’তে রয়েছে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’। অর্থাৎ সংবিধানের পুরো ৩৯ নং ধারাটিতে একজন সংবাদ কর্মীকে যেমনি অধিকার দিয়েছে তার মত প্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সাথে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হবার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এই ধারাটি একটি রক্ষাকবজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের ঘটনায় এই ধারাটি লঙ্ঘিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাকে রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনারও স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে আইনজীবীরা মনে করছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা হচ্ছে ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলায় নিম্ন আদালতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোনো ব্যক্তিকে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারবে।’ কিন্তু দেখা গেল নিম্ন আদালতে মাহমুদুর রহমানের ক্ষেত্রে ১৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। উচ্চ আদালতের ওই রায়টি ছিল ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল। ব্লাট বনাম বাংলাদেশ মামলায় বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন একটি ডিভিশন বেঞ্চ ওই সময় রায়টি দিয়েছিলেন। যা ডিএলআর ৫৫ নামে পরিচিত। ‘তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর সংক্রান্ত’ হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলে আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়। আপিল বিভাগও হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। উক্ত রায়ে বলা হয়েছিল : ১. আটকাদেশ দেয়ার উদ্দেশ্যে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে না; ২. কাউকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে; ৩.  অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয় বা কাছের কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করতে হবে; ৪. গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে; ৫. গ্রেফতারের ৩ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে কারণ জানাতে হবে; ৬. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃতর নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তা বাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে; ৭. গ্রেফতারকৃতকে  তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে; ৮. জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আইনজীবী বা পরিচিত কারও উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে; ৯. কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রযোজনীয় তথ্য না পাওয়া গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্টেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। আইনজীবীরা বলেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের এসব নির্দেশনার একটিও মানা হয়নি।
মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তিনি বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপি সংলাপ (বেলজিয়ামে বসবাসকারী একজন আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমদ জিয়াউদ্দীনের সাথে) প্রকাশ করেছেন ধারাবাহিকভাবে। এই সংলাপের বিষয়বস্তু তো আমার দেশে প্রকাশিত হবার আগেই  লন্ডনের সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট প্রকাশ করেছিল এবং সেই সাথে তা ইউটিউবেও প্রকাশিত হয়েছিল। সবাই জানেন দীর্ঘ প্রায় চার মাস তিনি আমার দেশ পত্রিকায় একরকম বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় তার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগে তিনি গত ১৩ ডিসেম্বর ফার্মগেট এলাকায় গিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করেছেন! এর আগেও ‘আদালত অবমাননা’ মামলায় তিনি দীর্ঘ প্রায় দশ মাস জেল খেটেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ৬০টিরও অধিক মামলা করা হয়েছিল। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার মনে করেন ‘অন্যায় দুর্নীতির সমালোচনা করায় মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে’। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, মাহমুুদুর রহমানের সাথে সাথে তাঁর মা মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদও অভিযুক্ত হলেন।
আমরা আমাদের সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এই দেশটিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আজ এত বছর পর এসে দেখা গেল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। আমার দেশ প্রকাশনাও এখন বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক ঘটনার পর এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি। বহিঃবিশ্বে মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের ঘটনাটি ভালো চোখে দেখেনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে এর নিন্দা জানানো হয়েছে। এখন সরকারের উচিত হবে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে সকল মামলা প্রত্যাহার করা ও তাঁকে মুক্তি দেয়া।
19.04.13

একটি সুপারিশ ও কিছু প্রশ্ন


প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় একটি সুপারিশ করা হয়েছে গত ১৫ এপ্রিল। সংসদীয় এই কমিটি তাগিদ দিয়েছে, সংলাপের মাধ্যমে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংঘাতের গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছতে। একই সঙ্গে যেকোনো উপায়ে যাতে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চালু থাকে, সেদিকে নজর রাখার কথাও তারা বলেছে। ১৫ এপ্রিলের এই সভাটি ছিল স্থায়ী কমিটির ২২তম সভা। সশস্ত্র বাহিনীর (সেনা, নৌ ও বিমান) তিন প্রধানও ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখতে শপথ অনুযায়ী কাজ করবেন বলে কমিটিকে জানিয়েছেন- এ-সংক্রান্ত খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। একাধিক কারণে ১৫ এপ্রিলের সভাটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, দেশের চলমান সংকটের গভীরতা বাড়ছে। বিভিন্ন মহল থেকে একটি সংলাপের কথা বলা হলেও তার জট খুলছে না। এমনি একটি সময়ে ওই সুপারিশটি এলো। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর হাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটি ন্যস্ত। এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্বটি বর্তায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ওপর। তৃতীয়ত, তিন বাহিনীর প্রধানের সভায় উপস্থিতি এবং প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধির সভায় উপস্থিতি এই সভার গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন এইচ এম এরশাদ, যিনি সাবেক সেনাপ্রধান ও একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেলও বটে। চতুর্থত, এর আগে সেনাবাহিনী নিয়ে প্রথমে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও পরে প্রধানমন্ত্রী একটি মন্তব্য করেছিলেন। এ ধরনের মন্তব্যের পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠক ও সেখানে উপস্থিত তিন বাহিনীর প্রধানের 'সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা ও শপথ'-এর অঙ্গীকার চলমান রাজনীতিকে নতুন একটি মাত্রা দিয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির এই সভা একটি 'মেসেজ' পৌঁছে দিয়েছে। আর তা হচ্ছে, সংঘাত এড়াতে সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু আদৌ কি সংলাপ হবে? সংলাপ হলে 'এজেন্ডা' কী? একই সঙ্গে প্রশ্ন আরো আছে- হেফাজতে ইসলাম অন্যতম 'শক্তি' হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এখন সরকার কী তাদের সঙ্গেও সংলাপ করবে? রাজনীতিতে মূল 'স্টেকহোল্ডার' সরকার ও বিরোধী দল। আর এজেন্ডা একটিই- সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে এমন একটি পদ্ধতি বের করা, যাতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। সরকার সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে রেখে আগামী নির্বাচনের কথা বলছে। যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। কেননা সংবিধান এভাবেই সংশোধিত হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী যদি 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে থেকে যান, এতে আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রশাসন প্রভাবান্বিত হতে পারে। গেল চার বছরে প্রশাসনে যেভাবে দলীয়করণ হয়েছে এবং শীর্ষ আমলারা যেভাবে 'দলীয় আনুগত্য' প্রদর্শন করেছেন, তাতে প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী'নির্ভর হয়ে পড়বে। এমনকি নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির যে ট্র্যাডিশন, তাতেও ব্যত্যয় ঘটেছে। আরপিওতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি থাকছে না। আরো একটি বিষয়, যা বেশ হাস্যকর। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই (তিন মাস আগে) নির্বাচন হতে হবে। এর অর্থ- নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের রেখেই নির্বাচন হবে। এই ধারায় যদি পরিবর্তন আনা না হয়, তাহলে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ক্ষমতাসীন এমপিরা নির্বাচনে প্রভাব খাটাবেন আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে পড়বে অকার্যকর। তাই 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার'-এর ফর্মুলা কাজ করবে না। এখানে একটা ঐকমত্যে পৌঁছা দরকার। টিআইবি একটি ফর্মুলা দিয়েছে; যদিও তাদের ফর্মুলায় বেশ ত্রুটি রয়েছে। টিআইবি অনেকটা দায়সারা গোছের একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করেছে। এ ব্যাপারে তাদের আরো 'কাজ' করার সুযোগ ছিল। বিএনপি এখনো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে, যা এখন আর সংবিধান অনুমোদন করে না। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কিছুটা নমনীয় হতে পারে। তারা তাদের 'থিংক ট্যাংকে'র মাধ্যমেও একটি ধারণাপত্র উপস্থাপন করতে পারে, যাতে একটা সংলাপ শুরু করা যায়। সরকার যে 'গোঁ' ধরে রেখেছে, তা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এমনকি সরকারের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক যেভাবে আগ্রাসী মনোভাব প্রদর্শন করছেন, তাতে সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়েছে। সরকার যদি তার একক সিদ্ধান্তে এককভাবে নির্বাচন করে, সেটাও তার জন্য সুখের হবে না। আমাদের দেশে এককভাবে নির্বাচন করার কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নেই। এরশাদীয় জমানায় ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিলেও শুধু বিএনপির অংশ না নেওয়ার কারণে সেই সংসদ পাঁচ বছর স্থায়ী হয়নি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ অংশ না নেওয়ায় চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশ পুনরায় একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে কি না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে বলতেই হবে, সরকারের দায়দায়িত্ব এখানে অনেক বেশি। শুধু সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার যদি 'গোঁ' ধরে থাকে, তাতে জনসমর্থন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তোফায়েল আহমেদের মতো সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও মনে করছেন, আদৌ সংলাপ হবে না! কেননা কোনো পক্ষই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে তা-ই মনে হওয়া স্বাভাবিক। 'কিছু না হলেও' সংলাপ করতে হবে এবং সংলাপের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রায় সবাই যদি জেলে থাকেন, তাহলে সংলাপ যে হবে না, তা বলাই বাহুল্য। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকেও কিছু ছাড় দিতে হবে। 'সব কিছু ভুলে' জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে মুক্ত মন নিয়ে বিএনপিকেও এগিয়ে আসতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সিপিডি, টিআইবি এবং সর্বশেষ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ প্রমাণ করে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান চান সবাই। একটি বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। অতীত ভুলে সামনে তাকানো খুবই জরুরি। রাজনীতিতে এরই মধ্যে আবির্ভূত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, হেফাজত মূলত জামায়াতে ইসলামীরই সৃষ্টি। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমি বলতে পারব না। কিন্তু কালের কণ্ঠের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হেফাজতের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফী যখন বলেন, তাঁদের এই আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই, তখন এই আন্দোলনকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। ঢাকায় যে বিশাল সমাবেশ তারা করেছে, তা নিঃসন্দেহে ১৮ দলীয় জোট ও সরকারের মধ্যে চিন্তার কারণ। জামায়াত বা ১৮ দলীয় জোট এই আন্দোলন থেকে ফায়দা ওঠাতে পারে। সরকারের দায়িত্বটি এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি। হেফাজতে ইসলাম মূলত একটি ধর্মীয় সংগঠন। ইসলাম ও আকিদা নিয়েই এদের কর্মকাণ্ড। এরা ১৩ দফা দিয়েছে। ওই ১৩ দফার মধ্যে কোথাও 'ব্লাসফেমি' শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, এই ১৩ দফাটিই হচ্ছে 'ব্লাসফেমি'। একুশ শতকে এসে 'ব্লাসফেমি' আইন যে করা যায় না কিংবা পাকিস্তানের মতো দেশে যেখানে 'ব্লাসফেমি' আইনের অপব্যবহার হয়েছে, সেখানে এই মেসেজটি হেফাজতের নেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। তবে ১ নম্বর ধারা (আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন) কিংবা ১২ ও ১৩ নম্বর ধারা (কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের মুক্তি) নিয়ে হেফাজতের সঙ্গে আলোচনা করা যায়। সরকারের উচিত হবে না আরেকটি 'ফ্রন্ট' ওপেন করার।
রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বাড়ছে সংঘাত। এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংলাপের সুপারিশ সংলাপের জন্য একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। মূল বিষয় একটি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? তবে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা যদি নিশ্চিত হয়, তাহলে যেকোনো নামেই হোক না কেন, বিএনপি তা মেনে নেবে। তাই আলোচনাটা জরুরি। আর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই।Daily Kalerkontho21.4.13

হেফাজতের তের দফা এবং প্রসঙ্গ কথা

সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক অঙ্গনে আন্দোলনের একটি অন্যতম বিষয় হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন ও তাদের তের দফা। সংগঠনটির বয়স মাত্র তিন বছর। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন এটি। এতদিন তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ছাত্রদের মাঝে। ঈমান-আকিদা নিয়েই মূলত এদের কাজ। কিন্তু গত ৬ এপ্রিল ঢাকায় বিশাল জনসসমাবেশ করে তারা বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে অন্যতম একটি ‘শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যদিও তারা নিজেরা কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের মনে করেন না। তাদের ভাষায় ‘ইসলাম রক্ষা’ ও মহানবী (সা.)-এর প্রতি কটূক্তি করার প্রতিবাদেই তাদের এই সমাবেশ। যদিও তারা লংমার্চ করে ঢাকায় আসতে চেয়েছিল, বাধার কারণে তাদের লংমার্চ সফল হয়নি, কিন্তু গণজমায়েত সফল হয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফাকে সামনে রেখেই এই সমাবেশ করেছিল। তাদের এই ১৩ দফা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে একটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। বিষয়টি হচ্ছে ‘ব্লাসফেমি’ আইন। এ নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও ৮ এপ্রিল কথা বলেছেন বিসিবির সঙ্গে। আসলেই কী হেফাজত একটি ‘ব্লাসফেমি’ আইন চায়? হেফাজতের নেতারা কী ‘ব্লাসফেমি’ আইন সম্পর্কে অবগত? আমি ১৩ দফায় কোথাও ‘ব্লাগফেমি’ শব্দটি খুঁজে পাইনি। কিন্তু হেফাজতের এক নেতার বক্তব্যও ছাপা হয়েছে গত ১০ এপ্রিল। তিনি হচ্ছেন হেফাজতের সাহিত্য ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মুফতি হারুন ইজহার। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যদি জনগণের ম্যান্ডেট বুঝে থাকেন, তাহলে ক্ষমতায় থাকতে হলে তাকে ‘ব্লাসফেমি’ আইন করতে হবে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন পবিত্র কোরান ও হাদিসের একাধিক বাণীতে নাস্তিক-মুরতাদদের ন্যায্য শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের কথা আছে। তাই এ দাবি নতুন কিছু নয়। মুফতি ইজহার সরাসরি ‘ব্লাসফেমি’র কথা বললেও মাওলানা শফী, যিনি হেফাজতে ইসলামের প্রধান, তিনি তার বক্তব্যে কোথাও ‘ব্লাসফেমি’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তার বক্তব্য স্পষ্ট। ঢাকার গণজমায়াতের পরেও তিনি বলেছেন, ‘তৌহিদি জনতা ইসলামের ওপর আঘাত মেনে নেবে না।’ তিনি চেয়েছেন যারা ইসলামের ও নবী করিম (সা.)-এর অবমাননা করেছে, তাদের কঠিন শাস্তি দেয়া হোক। তবে প্রধানমন্ত্রী বিসিবির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এই ‘ব্লাসফেমি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এই ‘ব্লাসফেমি’ শব্দটি ব্যবহার করায় আপত্তি জানিয়েছেন মুফতি ফয়জুল্লাহ, যিনি হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব। দৈনিক মানজমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘নাস্তিক-মুরতাদদের জন্য ব্লাসফেমি আইন করার প্রয়োজন নেই। শরিয়তের বিধানমতে এ ব্যাপারে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে’। তবে এটা কার্যকর করতে জাতীয় সংসদে একটি আইন প্রণয়ন করার জন্য তিনি দাবি জানান (১০ এপ্রিল)। এসব বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, হেফাজতে ইসলামের নেতাদের মধ্যে এই ‘ব্লাসফেমি’ আইন নিয়ে একটি বিভ্রান্তি রয়েছে। মুফতি ফয়জুল্লাহর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় তারা আদৌ ব্লাসফেমি আইন চান না। হেফাজতের প্রথম তিনটি দাবির মধ্যেই একটি আইন করার কথা রয়েছে, যা কিনা মুফতি ফয়জুল্লাহর বক্তব্য সমর্থন করে। এখানে ‘ব্লাসফেমি’র কথা বলা হয়নি। ১নং দাবিতে বলা হয়েছে সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরান-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করতে হবে। আগে এটি ছিল। সংবিধান সংশোধনে এটি বাতিল করা হয়েছে। আমি মনে করি এই অংশটুকু সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে সরকার হেফাজতকে আস্থায় নিতে পারে। সরকার প্রয়োজনে নতুন একটি কমিটি গঠন করতে পারে, যেখানে হেফাজতের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এই কমিটি বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারলে ভালো। পরিবর্তিত সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ রেখে দেয়া হয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হয়েছে। আবার একই সঙ্গে অষ্টম অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূল নীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যেহেতু রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখা ও সেই সঙ্গে প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ থাকার কারণে সরকার খুব সঙ্গতকারণেই সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ শব্দটি পুনঃস্থাপন করতে পারে। ২নং দফায় বলা হয়েছে ‘আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসারোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।’ সম্ভবত এটিকেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, হেফাজত ‘ব্লাসফেমি’ আইন চায়।
এখানে ব্লাসফেমি আইন নিয়ে কিছু বলা দরকার। ব্লাসফেমি শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘অশালীন ভাষায় ঈশ্বর বা ধর্মকে আক্রণম করা।’ এক সময় ইউরোপে ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করার জন্য এ ধরনের একটি আইন তৈরি করেছিল। এই আইনটি দীর্ঘদিন ধর্ম অবমানকারী, বিশেষ করে খ্রিস্টীয় ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। শাসকরা এটা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে গত তিন-চার দশক ধরে ‘ব্লাসফেমি’ আইনের প্রসঙ্গ ও দাবিটি উঠেছে ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে। ইউরোপে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে যখন লেখালেখি শুরু হয়, যখন মহানবী হজরত মুহম্মদকে (সা.) নিয়ে মিডিয়ায় কটূক্তি করা হয়, কার্টুন আঁকা হয়, তখন ব্লাসফেমির আইনটি নতুন একটি মাত্রা পায়। একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন, ইসলাম ধর্ম অবমাননাকারীদের শাস্তির প্রশ্নেই এই দাবি সাম্প্রতিককালে সোচ্চার ছিল। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম কিংবা হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম অবমাননা হয়েছে, এ রকম ঘটনা আদৌ ঘটেনি। আর ঘটলেও খুব একটা প্রচার পায়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সব দেশে কী এই ব্লাসফেমি আইন আছে? সৌদি আরব, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও মিসরের মতো দেশে ব্লাসফেমি আইন আছে, যে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আবার আলজেরিয়ার মতো দেশে ব্লাসফেমি আইন নেই, যদিও আলজেরিয়ায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও দেশটি একটি ইসলামিক দেশ। এভাবে অনেক মুসলিম দেশে কোনো ব্লাসফেমি আইন নেই। আমি একটু খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছি ইউরোপের প্রায় সব দেশে, বিশেষ করে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডে কোনো ব্লাসফেমি আইন নেই। এমনকি ব্রাজিলের মতো দেশেও নেই। ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশেও ব্লাসফেমি আইন নেই। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলেও ধর্ম অবমাননাকারী ব্লাসফেমি আইন নেই। যুক্তরাষ্ট্রেও নেই। যুক্তরাজ্যে ২০০৮ সালে এ সংক্রান্ত একটি আইন বাতিল করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫২ সালে সুপ্রিম কোর্ট Jopepah Burstyn Inc বনাম Wilson মামলায় যে ঐতিহাসিক রায়টি দিয়েছিল এবং তাতে বলা হয়েছিল কেউ যদি ধর্ম সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করে তা কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। ওই সময় The Miracle (ফেল্লিনি অভিনীত) নামে একটি ছবিতে ধর্মকে অপমান করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল।
 তবে প্রতিটি দেশেই ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। যেমন ভারতের পেনাল কোডের ধারা ২৯৫-এ, ইন্দোনেশিয়ায় পেনাল কোডের ১৫৬ ধারা, ইসরাইলের পেনাল কোডের ১৭০ ও ১৭৩ ধারা, ডেনমার্কের পেনাল কোডের ১৪০ ধারায় ধর্ম অবমাননাকারীদের শাস্তির বিধান রয়েছে। হেফাজতের ৩নং ধারায় কুৎসা রটনাকারী ব্লগারদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে। সরকার তো ইতিমধ্যে কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেফতারও করেছে। ৯নং দফায় টিভিতে ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধের দাবি করা হয়েছে। এটা মনিটর করা কঠিন কিছু নয়। ১৩নং দফায় গ্রেফতারকৃত মাদ্রাসা ছাত্রদের মুক্তির দাবি করা হয়েছে এটাও সরকার করতে পারে। ১১নং দফায় আলেম-ওলামাদের ওপর হামলা বন্ধের দাবি রয়েছে। ৮নং দফায় বায়তুল মোকাররমে মুসল্লিদের নির্বিঘেœ নামাজ আদায় করার দাবিও রয়েছে। এগুলো মানা সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়। তবে ৪নং দফায় ‘নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ’ বন্ধের যে দাবি করা হয়েছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক আরব দেশে (মিসর ও তিউনিশিয়া) নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকাও ব্যাপক। হেফাজতে ইসলামের নেতারা নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন। ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধের যে দাবি করা হয়েছে (৭নং), তাও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা অনেক ইসলামিক রাষ্ট্রেও ভাস্কর্য রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশি এনজিওদের কর্মকাণ্ড বন্ধের যে দাবি (১০নং দাবি) করা হয়েছে এ ক্ষেত্রেও সরকার উদ্যোগী হয়ে বিষয়টি মনিটর করে দেখতে পারে। মোট কথা ১৩ দফায় বেশকিছু দাবি রয়েছে, যা সরকার ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে এবং বাকিগুলো বাস্তবায়নের পথে। আল্লামা শফীর সঙ্গে আলোচনায় সরকারের অবস্থানকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। আলোচকদের ব্যর্থতা সেখানেই। একই সঙ্গে হেফাজতে ইসলামকে জামায়াতের সঙ্গে তুলনা করে সরকারের মন্ত্রীরা আগে থেকেই এই সংগঠনটিকে ‘শত্র“’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এটাও ছিল ভুল কৌশল। ৬ এপ্রিলের গণজমায়েতের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইসলামিক গণজাগরণের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। এরা প্রমাণ করেছে এদের গ্রহণযোগ্যতায় নিতে হবে। সরকারের উচিত হবে না আরেকটি ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করার। এখন একটি ‘সংলাপ’ই পারে সব ধরনের বিভ্রান্তি দূর করতে ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে যেতে। ৬ এপ্রিলের পরও যদি সরকার গণজাগরণ মঞ্চ ও ঘাদানিককে গুরুত্ব দেয়, তাহলে সরকার আবারো ‘ভুল’ করবে। ইতিমধ্যে ব্লাসফেমি আইনটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এটা নিয়ে মন্তব্য করেছেন বটে, কিন্তু ১৩ দফায় যেহেতু বিষয়টি (ব্লাসফেমি) নেই, সেহেতু এটা নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য না করাই শ্রেয়। আমাদের দেশে ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইন (৫৭ ধারা) বিশেষ ক্ষমতা আইন, ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে (২৯৫-এ) স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কেউ যদি ধর্ম অবমাননা করে, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন প্রয়োজনে এসব আইনে আরো কিছু সংশোধনী আনতে পারে সরকার, যাতে করে ধর্ম অবমাননাকারী কিংবা রাসুলে করিম (সা.) সম্পর্কে অপমানজনক উক্তিকারীদের কঠিন শাস্তি দেয়া যায়। হেফাজতে ইসলামের দাবি মূলত এটিই। তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন (কালেরকণ্ঠ, ১১ এপ্রিল) সরকার ও হেফাজতকে একটি মুখোমুখি অবস্থানে ঠেলে দিতে পারে। ওই প্রতিবেদনে আইন মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্রের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘হেফাজতের দাবি অযৌক্তিক ও সংবিধান পরিপন্থী।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সেই অবস্থানপত্রটি তৈরি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এটা সত্য, আমাদের সংবিধানের বেশকিছু ধারার সঙ্গে ১৩ দফার কিছু কিছু ধারা সাংঘর্ষিক। যেমন সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৬নং ধারা (চলাফেরার স্বাধীনতা), ৩৭নং ধারা (সমাবেশের স্বাধীনতা), ৩৮নং ধারা (সংগঠনের স্বাধীনতা), ৩৯নং ধারা (চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা) কিংবা ৪০নং ধারা (পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা), ৪১নং ধারায় (ধর্মীয় স্বাধীনতা) আমাদের অধিকার স্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে হেফাজতের ১৩ দফার বিরুদ্ধে এসব ধারা উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাই কাম্য। এ মুহূর্তে এ ধরনের একটি অবস্থানপত্র তৈরি করার আদৌ প্রয়োজন ছিল না। কেননা সরকার যখন হেফাজতের সঙ্গে কথাবার্তা বলার কথা বলছে এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিবিসির সঙ্গে আলাপে যে কোনো সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি, সে ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘নীরবতা’ অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকাণ্ড নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। সরকার যে দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হেফাজতে ইসলামকে ‘শান্ত’ করার জন্য যথেষ্ট। প্রথমটি হচ্ছে সরকার চার ব্লগারকে গ্রেফতার করেছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। এখন তদন্তেই  বেরিয়ে আসবে তারা ধর্ম অবমাননার সঙ্গে কতটুকু জড়িত ছিল। যদি তারা সত্যি সত্যিই ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করে থাকে কিংবা মহানবী (সা.) সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা অন্যায় করেছে। মুক্ত চিন্তার নামে যা কিছু ব্লগে লেখার অধিকার তাদের কেউ দেয়নি। এখন প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হতে পারে। দ্বিতীয় যে কাজটি সরকার করেছে তাও প্রশংসার যোগ্য। সরকারের কাছে ফেসবুক পেজ ‘বাঁশের কেল্লা’ ও ‘ব্লগ নুরানী চাপা’ পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ধর্মীয় অবমাননা’ পর্যবেক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত বিশেষ কমিটি এই সুপারিশটি করেছে। এছাড়া কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না বলেও কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘বাঁশের কেল্লা’ ও ‘নুরানী চাপা’ নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। কমিটির ‘বন্ধ করে দেয়ার’ সুুপারিশ গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে গণমাধ্যমে এ ধরনের মন্তব্য প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তও মঙ্গল। কেননা যে কোনো মন্তব্য কোনো গণমাধ্যমে যদি প্রকাশ পায় তা ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতে প্রণোদনা জোগাতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক ও ব্লগারের পক্ষে। আধুনিক যুগে এগুলো যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। এর সুফল অনেক। আমরা এ সুফল থেকে বঞ্চিত হতে চাই না। তবে ব্লগে লেখালেখি মনিটর করা যেতে পারে। আর আইন যদি কঠোর হয়, আমার ধারণা অনেকেই আর ধর্ম সম্পর্কে ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে সাহস পাবে না।
এমনিতেই রাজনীতিতে নানা সংকট চলছে। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় সব নেতা এখন জেলে। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশ ও রাষ্টদ্রোহের অভিযোগে। তাকে ১৩ দিনের রিমান্ডেও নেয়া হয়। এদেশে অনেকেই আছেন, যারা এই গ্রেফতারকে পছন্দ করবেন না। আমরা বারবার বলছি সরকার আর বিরোধী দলের মাঝে একটা সমঝোতার কথা। কিন্তু কোনো সমঝোতাও হচ্ছে না। কোনো সংলাপও হচ্ছে না। সরকার ধীরে ধীরে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে, যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ ও ঢাকায় মহাসমাবেশ জানান দিয়ে গেল তারা একটি ‘শক্তি।’ তারা কারো ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বটে, কিন্তু তাদের ‘উপস্থিতিকে’ অস্বীকার করা যাবে না। সুতরাং তারা যে ১৩ দফা দিয়েছে, সেই দফা নিয়ে আলোচনা হোক। বনমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে আল্লামা শফীর আত্মীয়। সরকার এই ‘আত্মীয়তাকে’ ব্যবহার করতে পারে। তাদের কিছু ভালো পরামর্শও সরকার গ্রহণ করতে পারে। এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আস্থায় নেয়া জরুরি। একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে আল্লামা শফী নিজে এবং তার সংগঠন জামায়াতবিরোধী। সরকার এটা কাজে লাগাতে পারে। তারা ৫ মে ঢাকা অবরোধের কথা বলেছে। তার আগেই হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সংলাপ ‘ওপেন’ করা প্রয়োজন।
Manobkontho
20.4.13

হরতালের রাজনীতি, অর্থনীতিতে হরতাল





হরতালের রাজনীতি যেন এখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। হরতাল হচ্ছে। গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে। অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে স্থবিরতা। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বিশেষ করে গার্মেন্ট সেক্টরের ব্যবসায়ীদের আকুল মিনতি সংবাদপত্রে ছাপা হলেও যারা হরতাল আহ্বান করেছেন, তাদের কর্ণকুহুরে তা আদৌ প্রবেশ করেছে বলে মনে হয় না। হরতালে একটি দেশের অর্থনীতিতে যে কী ক্ষতি ডেকে আনে, এটা যেমন সরকারের নীতিনির্ধারকরা বোঝেন— ঠিক তেমন বোঝেন যারা হরতাল ডাকেন, তারাও। কোন দল অতীতে কতবার হরতাল করেছে, এ তথ্য একাধিকবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাতে কি কারো যায় আসে? যারা হরতাল ডাকার, তারা হরতাল ডাকবেনই। আর যারা ক্ষমতায়, যারা হরতালের বিরুদ্ধে, তারা হরতালের বিরুদ্ধে কথা বলবেনই। মাঝখানে আমরা যারা আমজনতা, তারাই হরতালে পিষ্ট হচ্ছি!
প্রশ্ন হচ্ছে হরতাল কেন? হরতাল ডেকে একটি পক্ষ (এক্ষেত্রে বিরোধী দল) অন্য পক্ষের (এক্ষেত্রে সরকার) ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করে সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। সরকারের পতন চায়। কিন্তু হরতাল ডেকে কি অতীতে কখনো সরকারের পতন ঘটানো গেছে? ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পর সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনী এনে আমরা ‘গণতন্ত্রের দ্বিতীয় যাত্রাপথে’ হাঁটতে শুরু করেছিলাম। পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে গিয়ে আমরা সত্যিকার অর্থে উদারমনা গণতন্ত্র বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলাম! বিশ বছর পার হয়েছে। চারটি সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু কত দূর এগোতে পেরেছি আমরা? হরতালের পর হরতাল হয়েছে। বিরোধী দলের সংসদ বর্জন (যে যখন বিরোধী দলে থাকে) যেন এক ধরনের ‘গণতান্ত্রিক ফ্যাশনে’ পরিণত হয়েছে। উদার গণতন্ত্রে যে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’, অর্থাত্ বিরোধী পক্ষকে আস্থায় নেয়ার কথা, তা গত বিশ বছরেও তৈরি হয়নি। ‘আমিত্ব’ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। তাই বিরোধী দলের কাছে অর্থ একটাই— হরতালের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো!
হরতালে সরকারের পতন হয় না। কিন্তু ক্ষতি হয় সবার; সাধারণ একজন মুদি দোকানি ও ফুটপাতের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় রফতানিকারক, সবার। ক্ষতির একটা পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। তা অনেকটা এ রকম: ক্ষুদ্র ব্যবসা ৫০০ কোটি টাকা, পোশাকশিল্পে ৩৬০ কোটি, রাজস্ব খাতে ২৫০ কোটি, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ৫০ কোটি, শিক্ষা খাতে ৫০ কোটি, বীমা খাতে ১৫ কোটি ও পেট্রল পাম্পে ১০০ কোটি টাকা। এটা প্রতিদিনের হিসাব। এ হিসাব নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু ক্ষতি তো হয়ই। সাধারণ মানুষও তা বোঝে। বোঝেন আমাদের রাজনীতিবিদরাও। এরই মধ্যে বাংলাদেশ একটি ‘হরতালের রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে। পোশাক আমদানিকারকরা আস্তে আস্তে বাংলাদেশের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তারা নতুন বাজার পেয়েছেন ভিয়েতনাম আর লাওসে। মিয়ানমার ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যাওয়ায়, মার্কিনদের একটা বড় বাজার হতে যাচ্ছে দেশটি। এরই মধ্যে বেশকিছু মার্কিন কোম্পানি দেশটিতে তাদের অফিস খুলেছে। সেখানে বিনিয়োগের সম্ভাবনাও বাড়ছে। বাংলাদেশের এ রাজনৈতিক অস্থিরতা এখন পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে। গণমাধ্যমে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এটা তো সত্য, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না এবারও। এডিবি তাদের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। অথচ চলতি বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এখন সেটা কল্পনায়ই থেকে গেল। বাংলাদেশের একটা বিশাল সম্ভাবনা ছিল। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এ দেশটিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কয়েক কোটি। প্রতি বছরই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা এ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উত্পাদনশীল কাজে ব্যবহার করতে পারতাম। এদের যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া যেত, তাহলে এরা অর্থনীতিতে একটা বড় অবদান রাখতে পারত। যেখানে ইউরোপে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমছে, সেখানে আমাদের বাড়ছে। চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্যতম শক্তি হিসেবে পরিণত হয়েছে। তবে চীনে বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, তারা উত্পাদনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। এ বয়স্ক নাগরিকদের পেনশনসহ সামাজিক নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের যে অবস্থান (বর্তমানে দ্বিতীয়), আগামী কয়েক দশক পর দেশটি আর তা ধরে রাখতে পারবে না। একসময় ব্রিক দেশগুলো অন্যতম অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকে যোগ দেয়ায় এ জোট শক্তিশালী হয়েছিল, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিলের মতে, (যিনি ২০০১ সালে ব্রিকসের উত্থান নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন), ব্রিকস আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই দুর্বল একটি অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হবে। তার যুক্তি, ‘Economic growth in Russia or China would be hampered by shrinking working age population, so India and Brazil would be placed with countries that boat growing economics and population’। তিনি মিথ্যা বলেননি। জিম ও’নিল নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট MIKT-এর কথা বলেছেন, আর জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জ্যাক প্লেডস্টোন বলেছেন অন্য একটি জোট TIMBI-এর কথা। বাংলাদেশের বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, শিক্ষিত শ্রেণীর উত্থান এ দেশকে আগামী দশকে MIKT অথবা TIMBI জোটে নিয়ে যেতে পারত। বলা ভালো, প্রতিটি দেশের প্রথম অক্ষর নিয়ে নতুন জোটকে পরিচিত করানো হচ্ছে, অনেকটা ব্রিকসের মতো। যেমন MIKT-তে রয়েছে মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক। আর TIMBI জোটে আছে তুরস্ক, ভারত, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, এসব দেশের প্রতিটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। ভারতে দারিদ্র্য থাকলেও (২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী জনগোষ্ঠীর ৩৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ লোক দরিদ্র); বিশ্বব্যাংকের মতে, আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখবে ১৭ শতাংশ (২০০৭ সালে মাত্র ২ শতাংশ)। মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। তুরস্কের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপর। ইউরোপে যেখানে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে, সেখানে তুরস্কের অর্থনীতিতে তা এতটুকু প্রভাব ফেলেনি। ভারত ও তুরস্ক এটা অর্জন করতে পেরেছে। কারণ সেখানে রয়েছে বিপুল শিক্ষিত এক জনগোষ্ঠী। রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারতাম, আমরাও ভারত ও তুরস্কের কাতারে নিজেদের নিয়ে যেতে পারতাম। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের বড় অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায়। এখন আমাদের রাজনীতিবিদরাই সিদ্ধান্ত নেবেন, তারা একুশ শতকে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চান।
এখন পরিস্থিতি যেদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা আমাদের কোনো আশার কথা বলে না। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা নিক (National Intelligence Council— NIC) বৈশ্বিক প্রবণতার ওপর ২০১২ সালে যে Global Trends রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে যে ১৫টি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, তার একটি তালিকা রয়েছে। ওই তালিকায় এশিয়ায় যে তিনটি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। অন্য দুটি দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। যুক্তি হিসেবে নিক উল্লেখ করেছে সংঘাতময় পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশকে আমরা কোনোভাবে মেলাতে পারব না, এটা সত্য।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের গুলিতে প্রায় ১৭০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু, পুলিশের মৃত্যু, বিরোধী দলের নেতাদের ওপর গুলিবর্ষণ, তাদের আহত করা ও গ্রেফতার, গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে দেড়শতাধিক গাড়িতে আগুন (আওয়ামী লীগের হরতালবিরোধী মিছিলে) কিংবা ১২ এপ্রিল খুলনায় ভারতের হাইকমিশনারের গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা একথাই প্রমাণ করে— বাংলাদেশ বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অস্থিরতা একদিকে গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে লাগাতার হরতালের বিষয়টি।
হরতাল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বেমানান। কিন্তু বিরোধীদলীয় জোটের কাছে হরতাল ছাড়া এ মুহূর্তে বিকল্প আছে বলেও মনে হয় না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্যও এটা মঙ্গল হরতালের ব্যাপারে একটা ঐকমত্যে পৌঁছানো, যাতে আমরা ভবিষ্যতে হরতাল পরিহার করতে পারি। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এজেন্ডা বাস্তবায়নের একটা কৌশল হিসেবে হরতাল ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু হরতালকে কেন্দ্র করে সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ছে। এ প্রেক্ষাপটে হরতালের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। যেহেতু হরতাল হচ্ছে এক ধরনের প্রতিবাদ, সেক্ষেত্রে এর অংশ হিসেবে কোনো একটি জায়গায় গণজমায়েত হতে পারে, মানববন্ধন হতে পারে, এক ঘণ্টার জন্য সবকিছু বন্ধ থাকতে পারে। হরতালের বিকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজিবাদী সমাজেও ‘শাটডাউন’ অর্থাত্ ধর্মঘটের মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশের মতো দীর্ঘস্থায়ী সবকিছু বন্ধ থাকে না। সহিংস ঘটনাও সেখানে ঘটে না। হয়তো দেখা গেছে, কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের সামনে শ্রমিকরা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে একটি সীমিত এলাকায় ঘুরে ঘুরে শ্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এটাই তাদের প্রতিবাদের ধরন। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মালিকপক্ষ কিছু দাবিদাওয়া মেনে নেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে হরতাল বা শাটডাউনের ঘটনা ঘটেছে খুব কম ক্ষেত্রেই। এখানে আর্থিক বিষয়টা প্রাধান্য পেয়েছে কম, একদমই না। আদৌ তা প্রাধান্য পায়নি। এখানে হরতালের বিষয়টা পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক। সরকারের পতন, রাষ্ট্র কাঠামোয় পরিবর্তন প্রভৃতি প্রাধান্য পায় হরতালের ক্ষেত্রে। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব বিষয়, যেমন— দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ বা দুর্নীতি প্রতিরোধকে একমাত্র ‘দাবি’ হিসেবে সামনে রেখে হরতাল আহ্বান করা হয়েছে, এ রকম ঘটনা ঘটেনি। দ্রব্যমূল্যকে কখনো সখনো যুক্ত করা হয়েছে মাত্র। সুতরাং বাংলাদেশের বিকাশমান গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে হরতাল আদৌ থাকবে কিনা এ ব্যাপারে বড় দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রয়োজন। বাংলাদেশে যেভাবে হরতাল হয়, একুশ শতকে এসে এ সংস্কৃতি আমাদের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারবে না। আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে এ শুভবুদ্ধির উদয় হোক, আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
Bonik Barta
20.4.13