সেটা তাহলে কী? পাঠক স্মরণ করতে পারেন সাম্প্রতিককালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ এই জোটের সদস্য। জোটভুক্ত দেশের সেনাবাহিনী এই মার্চ মাসে একটি সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে সেখানে। একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ‘জধধফ-অষ-ঝযধসধধষ’ (ঘড়ৎঃয ঞযঁহফবৎ) নামে ওই মহড়ায় অংশ নিয়েছে জোটভুক্ত ২১ দেশের সেনাবাহিনী। আরও গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ গত ৯ মার্চ আলাদাভাবে সৌদি আরব সফর করেছেন। দুজনই সেখানে দুদিন অবস্থান করেন। ধারণা করা হয়, পাকিস্তান এখন নীতিগতভাবে এই জোটে যোগ দিতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ তাই কোনো ‘সামরিক কার্যক্রমে’ অংশ নেয় কিনা, সেটা দেখার বিষয়। এখানে বলা ভালো, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’ এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। এখন এই জোটে যোগ দেওয়ায় বাংলাদেশ এ নীতি থেকে সরে আসবে কিনাÑ সেটা একটা প্রশ্ন। উপরন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে ২৫তম অনুচ্ছেদে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা, সংহতি ও উন্নয়নের’ কথা বলা হয়েছে। ২৫ (ক)-তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও মাইন নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করবে।’ অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথাও বলা হয়েছে এ অনুচ্ছেদে। জোটে যোগ দিয়ে আগামীতে অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশ হস্তক্ষেপ করবে কিনা, ‘শক্তি প্রয়োগে’ অংশ নেবে কিনাÑ এ প্রশ্ন থাকলই। যদিও জোটের পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা কী হবে তা এ মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই জোটের উদ্যোগে রিয়াদে একটি কেন্দ্র হবে এবং এই কেন্দ্রে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী তথ্য-উপাত্ত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করবে। তবে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা এসপিএ আমাদের জানিয়েছে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামরিক অভিযান সমন্বয় ও তাতে সহায়তা করতে সৌদি নেতৃত্বাধীন এ জোট গঠন করা হয়েছে।’ বাংলাদেশ আরও যুক্তি দেখিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির অংশ হিসেবে অন্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ এই কেন্দ্রে থাকবে। তবে এই জোটের ভবিষ্যৎ ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জোটের অন্যতম শরিক পাকিস্তান প্রথমে কিছুটা অবাকই হয়েছিল এই জোট গঠনে এবং জোটে পাকিস্তানের নাম থাকায়। পাকিস্তানের বক্তব্যÑ তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই এই জোটের ঘোষণা করা হয়েছিল। আমি নিশ্চিত নই, এই জোট গঠনে বাংলাদেশের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা আদৌ হয়েছিল কিনা। সৌদি আরব এ ধরনের একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছে কিংবা বাংলাদেশের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রারম্ভিক আলোচনা হয়েছে এটাও আমাদের অনেকের জানা নেই। ফলে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান যখন গত ১৫ ডিসেম্বর এই জোট প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন, তখন বিষয়টি আমাদের অবাকই করেছিল। এমন হয়েছে কিনাÑ সৌদি আরব একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে তা জোটবদ্ধ দেশগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে শুধু? এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। জোট নিয়ে পাকিস্তানের প্রশ্ন তোলা এই সম্ভাবনাটাকেই সামনে নিয়ে এসেছিল। যদিও এখন মনে হচ্ছে পাকিস্তান তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে।
এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, যাদের নাগরিকদের প্রায় সবাই মুসলমান। ওই অঞ্চলের একটি দেশও জোটে যোগ দেয়নি। তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, কিরঘিজিস্তানÑ এ দেশগুলো এক সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ও সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে গেলে, এ দেশগুলো স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ যদি অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে থাকে জোটে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তাহলে মুসলমানপ্রধান এ দেশগুলো যোগ দিল না কেন? ইন্দোনেশিয়া বড় মুসলিম দেশ। এ দেশটিও নেই কেন? পাঠক, লক্ষ করুন কোন দেশগুলো যোগ দিয়েছে? বেনিন, সাদ, টোগো, জিবুতি, সুদান, সিয়েরালিওন, গ্যাবন, সোমালিয়া, কমোরোস, মালদ্বীপÑ এই দেশগুলোর সন্ত্রাস দমনে আদৌ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বরং জাতিসংঘ এই দেশগুলোকে কখনো বিশ্ব শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে আমন্ত্রণও জানায়নি। শুধু তাই নয়, সুদান, সিয়েরালিওন, সোমালিয়া, গিনি ইতোমধ্যে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এসব দেশে কোনো কেন্দ্রীয় সরকারও নেই। তাহলে এ দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হলো কেন? দেশগুলো গরিব। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল। ধনী দেশগুলোর আর্থিক সহযোগিতার ওপর দেশগুলো নির্ভরশীল। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই কী দেশগুলোকে সৌদি আরব তার জোটে রেখেছে?
বলা ভালো, সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন এই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী জোটে ৩৪ দেশ যোগ দিয়েছে। এ জোটকে বলা হচ্ছে ‘ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেরোরিজম’ (আইএমএএফটি)। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেই এ জোটের জন্ম। এখানে কোনো একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কথা বলা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া-ইরাকে জন্ম নেওয়া ইসলামিক স্টেট বা দায়েসের (আরবি নাম) বিরুদ্ধে আলাদাভাবে বিমান হামলা পরিচালনা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট ও রাশিয়া। অনেক আগেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে একটি জোটÑ ‘দি গ্লোবাল কোয়ালিশন টু কাউন্টার আইএসআইএল।’ এখানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, আইএসআইএল তথা ইসলামিক স্টেটের কথা। ৬৫টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটের মূল টার্গেট জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট। পরে এর পাশাপাশি গঠিত হয়েছিল আইএমএএফটি। একটির নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরটির নেতৃত্বে সৌদি আরব। উভয় জোটের স্বার্থ কী এক? অর্থাৎ উভয় জোট কী ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে? বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জোটে বাংলাদেশকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ এ জোটে যোগ দেয়নি। কিন্তু সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটে বাংলাদেশ যোগ দিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিল না কেন? নাকি ওই জোটে যোগ দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আগে সৌদি জোটে যোগ দিল? মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ না দেওয়ার পেছনে বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ নীতির কথা আমাকে বলতে চেয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এক টিভি টক শোতে তিনি আমাকে এ ব্যাখ্যাই দিয়েছিলেন। তবে জানিয়েছিলেন, ‘অসামরিক ও জাতিসংঘের উদ্যোগে যে কোনো উদ্যোগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে।’ অর্থাৎ আমি ধরে নিয়েছি যদি কোনো ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে সিরিয়ায় তাহলে বাংলাদেশ মার্কিন জোটকে সহযোগিতা করবে এবং প্রয়োজনে জোটে যোগ দেবে। তখন সৌদি জোটে, যার চরিত্র অনেকটা সামরিকÑ বাংলাদেশ এই জোটে যোগ দিল। ফলে সৌদি জোটে যোগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন যে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার হলো, বেশ কিছু দেশ রয়েছে যে দেশগুলো উভয় জোটেই আছে (জর্ডান, আরব আমিরাত, বাহরাইন, তুরস্ক, কুয়েত ইত্যাদি)। সৌদি আরব মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটেও আছে।
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হঠাৎ করে বাংলাদেশ সফর কিংবা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সৌদি আরব সফর প্রমাণ করে সৌদি আরব তার সামরিক জোট নিয়ে সিরিয়াস। সেখানে একটি সামরিক মহড়ার আয়োজন করাও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। বেশ কিছুদিন ধরেই সৌদি আরব সিরিয়ায় একটি ‘সামরিক আগ্রাসন’ চালাতে পারেÑ এমন কথা বলা হচ্ছে। এর প্রস্তুতি হিসেবে কী একটি সামরিক মহড়ার আয়োজন করেছে সৌদি আরব? তবে মূল প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কী আদৌ আগামীতে কোনো সামরিক কার্যক্রমে তার দেশের সেনাবাহিনী পাঠাবে? বাংলাদেশ বারবার বলে আসছে তারা কোনোরকমের ‘সেনা কার্যক্রমে’ অংশ নেবে না। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বাংলাদেশ বারবার বলে আসছে। এখন দেখতে হবে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশের নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসে কিনা? সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সৌদি বিনিয়োগেরও খুব একটা সম্ভাবনা আমি দেখছি না। সুতরাং সৌদি জোটের যে কোনো সামরিক কার্যক্রমে বাংলাদেশ অংশ নেবে কিনা, তা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের আলোকে বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
Daily Amader Somoy
13.03.16
0 comments:
Post a Comment