রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিএনপির কাউন্সিল ও আগামীর রাজনীতি

গত ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কাউন্সিলকে ঘিরে দলের কর্মীদের মাঝে নতুন এক কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। হাজার হাজার কর্মীর উপস্থিতি প্রমাণ করে বিএনপি একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। কাউন্সিলে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন এবং আমার বিবেচনায় ওই ভাষণে বেগম জিয়া কার্যত বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতির একটি রূপকল্প উপস্থাপন করলেন। তার বক্তব্যের দুটি বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। এক. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট। দুই. রূপকল্প ২০৩০। এই রূপকল্প হচ্ছে বিএনপির পরিকল্পনার ছক অর্থাৎ কীভাবে বিএনপি ২০৩০ সালে বাংলাদেশকে দেখতে চায়। এই কাউন্সিল বিএনপির নেতা ও কর্মীদের উজ্জীবিত করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৫ জানুয়ারি (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়া এবং নির্বাচন বয়কট করার ডাক দিয়ে বড় ধরনের ‘সংকটের’ মাঝে পড়ে দলটি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ‘সহিংস রাজনীতির’ জš§ হয় এবং এর জন্য অভিযুক্ত করা হয় বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে। শত শত নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়। শীর্ষ স্থানীয় নেতাকর্মীদের নামে শত শত মামলা হয়। এমনকি আজো শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ ‘বাস পোড়ানোর’ মামলা থেকে নিষ্কৃৃতি পাননি। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এভাবে কোনো দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অতীতে কখনো মামলা-মোকদ্দমা ও জেল-জুলুম মোকাবিলা করেননি। এতকিছুর পরও বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির অবর্তমানে জাতীয় পার্টি ‘বিএনপির অবস্থান’টা নিতে পারেনি। বিএনপি এখনো প্রধান বিরোধী দল। ফলে সঙ্গত কারণেই বিএনপি যখন এ রকম একটি বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের কাউন্সিল সম্পন্ন করল তখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি তাদের দিকেই থাকবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। তাই সংবাদপত্র যখন মন্তব্য করে ‘বিএনপি কি ঘুুরে দাঁড়াতে পারবে’ তখন তা যুক্তিসঙ্গত বৈকি! তবে এই কাউন্সিলের পর অনেক কিছু নির্ভর করছে। দলটিকে গোছানো দরকার। নেতৃত্বের সারিতে পরিবর্তনও আসছে। বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে চ্যালেঞ্জ করার দলে কেউ নেই বটে; কিন্তু শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন, যারা দল ত্যাগ করেছিলেন কিংবা বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তাদের ফিরিয়ে আনা এই মুহূর্তে বিএনপির জন্য এগুলোই জরুরি। সেটা কাউন্সিলের পর সম্পন্ন হবে বলে আমার ধারণা।
গত পহেলা সেপ্টেম্বরে বিএনপি ৩৭ বছরে পা রেখেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এই ৩৭ বছর একেবারে কম সময় নয়। দলটি একাধিকবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জš§ নেয়া এই রাজনৈতিক দলটি বর্তমানে কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বোধ করি অতীতে কখনোই দলটি এ ধরনের সংকটের মাঝে পড়েনি। যারা রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে দলটির একটি শক্ত অবস্থান আছে। তিনবার দলটি ক্ষমতায় ছিল (১৯৭৮-১৯৮২, ১৯৯১-৯৬, ২০০১-২০০৬)। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে দলটির একটি অবস্থান আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা থেকে বিএনপির উৎখাতের পর ওই সময় যখন বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল ঠিক তখনই একজন গৃহবধূ থেকে (১৯৮৩) রাজনীতির পাদপ্রদীপে আসেন বেগম জিয়া। এখন তিনিই বিএনপির অবিসংবাদিত নেত্রী। তাকে কেন্দ্র করে বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ বেগম জিয়াকে দেখেছিল একজন অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে, সেই বেগম জিয়াকে এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল! বয়স বেড়েছে। অসুস্থ তিনি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে অংশ না নেয়া কিংবা পরবর্তীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে যে সহিংস রাজনীতির জš§ হয়েছে এ দেশে তা ব্যক্তিগতভাবে বেগম জিয়া তথা বিএনপির রাজনীতির ক্ষতি করছে। বেগম জিয়াকে আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে ‘নিঃসঙ্গ একজন নাবিক’ হিসেবে, যিনি আদৌ জানেন না কোন দিকে এবং কোন পথে বিএনপি নামক ‘জাহাজ’টিকে তিনি পরিচালনা করবেন। এক সন্তান হারা, অপর সন্তান অনেক দূরে, নেতাকর্মীরা জেলে। ‘নিঃসঙ্গ বেগম জিয়া এখন একাই বিএনপি। বর্তমানে বিএনপি নানা সমস্যায় আক্রান্ত এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি দল গোছানোর কথা বলছে। তবে অতীতে বিএনপির কয়েক নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে শীর্ষ স্থানীয় বিএনপি নেতাদের মাঝে এক ধরনের হতাশা আছে। বিএনপি ভাঙার ‘গুজব’ ছিল এ কারণেই। বেগম জিয়াকে দিয়ে হবে না কিংবা জিয়ার আদর্শে ফিরে যেতে হবেÑএ ধরনের বক্তব্য যখন বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মুখ থেকে বের হয়, তখন গুজবের নানা ডালপালা গজায়। মির্জা ফখরুল জামিন পেলেও কেউ কেউ জেলে আছেন এখনো। অনেকের বিরুদ্ধেও মামলা আছে। আর যারা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এর অর্থ পরিষ্কার মামলা, মোকদ্দমা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ‘ব্যস্ত’ রাখতে চায় সরকার যাতে তারা ‘আন্দোলনে’ নিজেদের জড়িত করতে না পারেন! বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অতীতে এমনটি কখনোই দেখা যায়নি। এত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়নি। ফলে এসব নেতাকর্মী আর রাজপথে সক্রিয় হতে পারবেন না। বেগম জিয়াকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ২৭ ধারা অনুযায়ী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনসংক্রান্ত ধারা) বিচার, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা কিংবা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় শাস্তি দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা, একই সঙ্গে ডান্ডি ডায়িং মামলায় তারেক রহমানকে ‘শাস্তি’ দিয়ে তাকেও অযোগ্য ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। এক্ষেত্রে বেগম জিয়ার নির্বাচনে ‘অযোগ্য ঘোষণা’(?) করা হলে আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি নির্বাচনের জন্য যোগ্য হবেন কিনা জানি না। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্ন হবে তখন অবান্তর। বেগম জিয়াই বিএনপির মূল শক্তি। বেগম জিয়া যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, বিএনপির ‘বিকল্প নেতৃত্ব’ নির্বাচনে অংশ নেবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বেগম জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে কেউ যদি বিএনপিকে সংগঠিত করে এটাও গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের নীতি নির্ধারকরা যদি ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা কার্যকর করতে চান, আমার ধারণা তা কোনো ইতিবাচক ‘ফল’ দেবে না। ‘আসল বিএনপি’ কিংবা নাজমুল হুদার কথাবার্তায় মানুষ খুব আস্থাশীল এটা আমার মনে হয় না। জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে বসিয়েও সরকার খুব লাভবান হয়নি। জাতীয় পার্টি এখন নানা ‘জটিলতার’ মুখে। ফলে সরকারের কাছে এখন বিকল্প পথ দুটি। এক. বিএনপিকে যে কোনোভাবে আস্থায় নিয়ে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়া। দুই. সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষের দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। যে কোনো সময়ের চাইতে সরকারের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। উল্লেখিত দুটি সিদ্ধান্তের মাঝে একটি অর্থাৎ প্রথমটির ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কম। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনটিই সরকার করতে চায়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে যদি ২০১৮ সালের শেষে নির্বাচন হয় তাহলে সমস্যা যা ছিল তাই থেকে যাবে!
বিএনপির সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা যাবে না। সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দলও বলে গেছে ‘সব দলের অংশগ্রহণের স্বার্থে’ নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এখনই ‘সংলাপ’ শুরু হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকার তাতে সায় দেবে বলে মনে হয় না। বেগম জিয়াও কাউন্সিলে একটি ‘সংলাপ’-এর কথা বলেছেন। এটা স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশে একটি দ্বি দলীয় ব্যবস্থার জš§ হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিকল্পই বিএনপি ঘুরেফিরে এটা প্রমাণিত। দশম সংসদে জাতীয় পার্টি পারেনি। তাই যে কোনো বিবেচনায় বিএনপির সঙ্গে একটা আস্থা সম্পর্ক গড়ে তোলা সরকারের জন্য জরুরি। কেননা বাংলাদেশ নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের ওপরে। ইউরোপে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি এসেছে। এখন নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেতে হলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। আর এর পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এটা সবাই বলেন, সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল থাকা দরকার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু গত প্রায় দুই বছরের সংসদীয় রাজনীতির কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টি সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারছে না। জাতীয় পার্টিতে দ্বন্দ্ব আছে সরকারে থাকা না থাকা নিয়ে। ফলে সংসদকে আরো গ্রহণযোগ্য, আরো অর্থবহ এবং সর্বোপরি একটি সঠিক জাতীয় নীতি প্রণয়নে সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা বাঞ্ছনীয়। আর বিএনপিই সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারে। বলা বাহুল্য, বিএনপি সংসদে না থাকলেও বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ, দাতাগোষ্ঠী এটা স্বীকার করে এবং তারা সবাই বিএনপিকে মূল ধারার রাজনীতিতেই দেখতে চায়। ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের অবস্থানও আমার ধারণা অনেকটা সে রকম। সরকারের ভূমিকা তাই এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্যতম দুটি শক্তি। এই দুটি দল দুটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে। অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে এই দুটি দলের একটিকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল জনগণের ভোটে। এর আগে ১৯৮৬ সালে এরশাদীয় জামানায় যে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল তাতে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় ওই সংসদ টিকে থাকেনি। ১৯৮৮ সালের সংসদও টেকেনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অংশ না নেয়ার কারণে। এ দু’দলের অংশগ্রহণ থাকার কারণেই ৫ম সংসদ (১৯৯১), ৭ম সংসদ (১৯৯৬), ৮ম সংসদ (২০০১) ও ৯ম সংসদ (২০০৮) গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির অংশগ্রহণ না থাকায় ৫ জানুয়ারির (২০১৪) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপি অনেক নমনীয় হয়েছে এবং তাদের আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া অনেক বক্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে বিএনপি সরকারের সঙ্গে একটি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে’ যেতে চায় এবং যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। গত ১৯ মার্চের বিএনপির কাউন্সিল সে রকম একটি মেসেজ দিয়েছে বলে ধারণা করি। বেগম জিয়া তার ভাষণে ‘নির্বাচন বয়কট’ এর কোনো কথা বলেননি। দল পুনর্গঠন হবে, এ রকম ইঙ্গিত আমরা আগেই পেয়েছি। কিন্তু এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি নতুন সাংগঠনিক কাঠামোর রূপ কী হবে। কাউন্সিলের দল পুনর্গঠনের পুরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বেগম জিয়াকে। ধারণা করছি স্থায়ী কাঠামোতেও পরিবর্তন আসবে। বেগম জিয়া তার ভাষণে ‘শেখ হাসিনাকে বাদ রেখে নির্বাচন হবে’ বলে যে মন্তব্য করেছেন তাও গুরুত্বের দাবি রাখে। এটা কি শুধু ‘কথার কথা’ কিংবা ‘কর্মীদের উজ্জীবিত করার জন্য বলা?’ আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। কিন্তু ‘শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে’ নির্বাচন কীভাবে হবে তার কোনো ফর্মুলা তিনি উপস্থাপন করতে পারেননি। আশা করছি এ ব্যাপারে তিনি একটি ফর্মুলা দেবেন। ভারতের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি চায় না অন্য কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলাক।’ এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ স্টেটমেন্ট। এই বক্তব্য জাতিসংঘের নীতিমালাকে সমর্থন করে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা তিনি বলেছেন। এটাও ভালো। তিনি ‘কানেকটিভিটি’র কথা বলেছেন বটে কিন্তু সার্কের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেননি। চীন ও মুসলিম বিশ্বের সম্পর্কের কথাও বলেননি অথচ জিয়াউর রহমানের বৈদেশিক নীতির অন্যতম দিক ছিল মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা ও চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ককে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক অভিযানকে সমর্থন করেছেন বটে কিন্তু আইএস জঙ্গিদের গণহত্যা, সিরিয়ার শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপনের কথা উল্লেখ করেননি। তিনি সুনীতি, সুশাসন ও সুসরকারের কথা বলছেন। কিন্তু এর বিস্তারিত উল্লেখ করেননি। ধারণা করছি তার রূপকল্প ২০৩০-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ পাবে।
বেগম জিয়ার ওই ভাষণ নিঃসন্দেহে কর্মীদের উজ্জীবিত করবে। কর্মীরা নতুন করে অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন এক দিকনির্দেশনা পাবেন। কিন্তু কিছু ‘ত্রুটি’ বাদ দিলে বিএনপির এই কাউন্সিল সফল হয়েছে, এটা বলা যায়। তবে খটকা লেগেছে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একটা কথায়। সৈয়দ আশরাফ বলেছেন তিনি বিএনপির কাউন্সিলে দাওয়াত পাননি বলে যাননি। এর পেছনে কতটুকু সত্যতা আছে বলতে পারব না। যত দূর জানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আরো একটা কথা। বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাও শোভন নয়। এর মধ্য দিয়ে দুটি বড় দলের মাঝে কোনো আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। বিএনপির এই কাউন্সিল কর্মীদের আরো উৎসাহিত করবে সন্দেহ নেই তাতে। এখন দেখতে হবে বিএনপি আগামীতে ‘সুস্থ’ রাজনৈতিক চর্চা করে কিনা। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি বড় দল। বিএনপিকে আস্থায় নিয়েই এ দেশে গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। Daily Manobkontho 22.03.16

0 comments:

Post a Comment