গেল নভেম্বরে মিয়ানমারের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি
(এনএলডি) গত ১০ মার্চ দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য নিুকক্ষ থেকে
টিন কিয়াউকে (Htin kyaw) এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে হেনরি ভ্যান থিওকে
উচ্চকক্ষ থেকে মনোনয়ন দিয়েছে। নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রেসিডেন্ট থেইন
সেইনের নেতৃত্বাধীন ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিও
(ইউএসডিপি) তাদের প্রার্থী দিয়েছে। সেনাবাহিনীও প্রার্থী দেবে। মোট তিনজন
প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট
দায়িত্ব নেবেন ৩১ মার্চ, থেইন সেইনের টার্ম শেষ হওয়ার পর। এনএলডি-প্রধান অং
সান সু চি দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না, এটা আগেই জানা গিয়েছিল। এবং
বলা হচ্ছিল, সু চির খুব ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসভাজন কেউ একজন প্রেসিডেন্ট হতে
যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত তা-ই হল। সংসদের উভয় কক্ষে এনএলডির সংখ্যাগরিষ্ঠতা
রয়েছে। ফলে তাদের প্রার্থীই বিজয়ী হবে। ধারণা করা হচ্ছে, সু চির খুব ঘনিষ্ঠ
টিন কিয়াউ হতে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। টিন কিয়াউ সু চির মায়ের নামে
পরিচালিত একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। তার স্ত্রী এনএলডির
একজন এমপি এবং তার শ্বশুর এনএলডির কো-ফাউন্ডার ছিলেন।
এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের সেনাশাসনের অবসান হতে যাচ্ছে বটে; কিন্তু মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্র নিয়ে রয়ে গেছে নানা প্রশ্ন। টিন কিয়াউ প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি কি একজন ‘পুতুল প্রেসিডেন্ট’ হবেন? তার সঙ্গে অং সান সু চির সম্পর্ক কী হবে কিংবা সেনাবাহিনীর সঙ্গেই বা তার সম্পর্ক কী হবে- এসব প্রশ্ন আলোচিত হতে থাকবে বারবার। বলা হচ্ছে, সু চি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পারেন! তিনি ভারতের ‘সোনিয়া গান্ধীর’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন কিনা- এসব প্রশ্নও এখন পশ্চিমা মিডিয়ায় তোলা হচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রধানের চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তার ভূমিকার দিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্র একটি প্রশ্নের মুখে থাকল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি (বিএসপিপি) গঠন করেছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। জেনারেল থেইন সেইন ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এ দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এখনও তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সু চিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল থেকেই সামরিক জান্তা জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে আসছিল। এবং ২০১০ সালের আগেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী যিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি কোনো বিদেশীকে বিয়ে করতে পারবেন না। এক নাগাড়ে ২০ বছরের ওপর বিদেশে থাকলে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য হবেন না। এবং যিনি প্রার্থী হবেন, তার সন্তান, বাবা ও মাকে মিয়ামনারে জন্মগ্রহণকারী নাগরিক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সু চি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হননি। অবশ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না। সংসদ প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন করে। এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হন (৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন), পরে তাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
মিয়ামনারের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়েছে অনেকটা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো জমানার (১৯৬৬-১৯৯৮) ‘গোলকার’ মডেলের মতো। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট- House of Representative (Pyithu Hluttaw, নিম্নকক্ষ) ও House of Nationalities (Amyotha Hluttaw, উচ্চকক্ষ)। নিুকক্ষের সদস্য সংখ্যা ৪৪০, যেখানে সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১১০ জনের, যাদের নিয়োগ দেন সেনাপ্রধান। আর উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ২২৪, যার মাঝে ৫৬ জন সেনাবাহিনীর। এখানে বলা ভালো, অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল থেইন সেইন ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে চলে এসেছেন। প্রথমে এসপিডিসির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল থান সু। কিন্তু থান সুকে একসময় সরিয়ে দিয়ে থেইন সেইন চলে আসেন মূল ক্ষমতায়। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থেইন সেইন। পরে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন। তার সঙ্গে অং সান সু চির সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। নির্বাচনে বিজয়ের পর সু চি একাধিকবার থেইন সেইনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। এমনকি সেনাপ্রধানের সঙ্গেও সু চির একাধিক বৈঠকের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেনাপ্রধান সংবিধানের বাইরে যেতে রাজি হননি। তিনি সেনাবাহিনীর গোষ্ঠীস্বার্থ দেখবেন, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সামনে মিসরের দৃষ্টান্ত আছে। সাময়িক সময়ের জন্য সেনাবাহিনী সেখানে বেসামরিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে তারা আবার ক্ষমতায় এসেছে। এটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারে এখন প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদও নেই। নির্বাচনের পরপরই সু চি বলেছিলেন, ‘সংবিধানে যাই লেখা থাকুক, তিনিই হবেন মূল ব্যক্তি।’ প্রশ্ন এখানেই। সংবিধান অনুযায়ী এই প্রথমবারের মতো একজন বেসামরিক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা নিতে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় ক্ষমতার বাইরে থেকে সু চি যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যান, সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ‘বিচক্ষণ’ সু চি কি তা করবেন? তিনি দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যারা গত এক বছর এনএলডি নেত্রী অং সান সু চির ভূমিকা ও বক্তব্য খেয়াল করেছেন, তারা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনাবাহিনীর আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এ উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। প্রচণ্ড মুসলমানবিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মাবাথা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে ১ হাজার ৭১১ আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। সরকারি দল এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি সেখানে কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ্য করে থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা এবং শত শত রোহিঙ্গার নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক। অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে।
উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এ প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতা পেতে হলে তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি যে কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল সুবিধাবাদিতায় ভরা। তাই বলা যাবে না তিনি সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থানে’ গিয়েছিলেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছিলেন। এতে করে তিনি নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়েছেন সত্য। কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। তিনি যদি কঠোর অবস্থানে যান এবং ক্ষমতা ‘পরিচালনা’ করতে চান, তাহলে তা সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের প্ররোচিত করতে পারে। তিনি ‘রিয়েল পলিটিকসের’ পরিচয় দেবেন, এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করা, গণতন্ত্রকে সংহত করা এবং শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করা। অনেকটা ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো-পরবর্তী মডেল অনুসরণ করতে পারেন তিনি। সেখানে সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ‘কমিটেড’। একই সঙ্গে সু চি প্রেসিডেন্টের পদটিকে একটি ‘নিয়মতান্ত্রিক পদে’ পরিণত করার উদ্যোগ নিতে পারেন। সাংবিধানিকভাবে এটা এখন সম্ভব নয়। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে যে ‘লিখিত সুবিধা’ ভোগ করে আসছে তা ছেড়ে দেবে, এটা মনে হয় না।
মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় রাষ্ট্রই বিসিআইএম ও বিবিআইএমএস জোটের সদস্য। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য এ দুটি জোটের গুরুত্ব অনেক বেশি। যদিও সেখানে দীর্ঘ সেনাশাসন থাকায় দু’দেশের মাঝে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়নি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য মিয়ানমারে রফতানি করে আমদানি করে তার চেয়ে বেশি। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল ৫ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ১৩ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন), আর আমদানি করেছিল ২৯ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ৮৪ মিলিয়ন)। অথচ বিশাল এক সম্ভাবনার দেশ মিয়ানমার। বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের অন্যতম উৎস হতে পারে মিয়ানমার। সুতরাং সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভাবনার অনেক দুয়ার খুলতে পারে।
এখন অনেক কিছুই নির্ভর করছে সু চির ওপর। ‘রিয়েল পলিটিকস’ নাকি সরাসরি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদ- কোনটা বেছে নেবেন সু চি? দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি অন্তরীণ ছিলেন। তিনি জানেন সেনাবাহিনী মিয়ানমারে কত শক্তিশালী। ক্ষমতা পেতে হলে সেনাবাহিনীকে আস্থায় নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তার সামনে মিসরের দৃষ্টান্ত আছে। সাময়িকভাবে সেখানে ড. মুরসিকে ক্ষমতা দিয়েছিল সেনাবাহিনী। সুযোগ বুঝে তারা আবার ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে। সুতরাং ‘বিচক্ষণ’ সু চি কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদে গিয়ে তার তেমন কোনো লাভ হবে না। ক্ষমতা পেতে তিনি স্বামীকে হারিয়েছেন। স্বামীর মৃতদেহ তিনি দেখতেও পারেননি। দুই ছেলে ব্রিটেনে, যাদের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ নেই। ফলে সু চির আগামী দিনগুলো সত্যিকার অর্থেই লক্ষ্য রাখার বিষয়। নিঃসন্দেহে তার ভূমিকার ওপর মিয়ানমারে গণতন্ত্রের অনেক কিছু নির্ভর করছে। জন ফিসার বিবিসির অনলাইনে লিখেছেন (৯ মার্চ), যারা সু চির মাঝে ‘একজন নেলসন ম্যান্ডেলাকে’ খুঁজতে চেয়েছিলেন, তারা আশাহত হবেন। ফিসার লিখেছেন, শেষদিন পর্যন্ত সু চি চেষ্টা করেছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা ‘সমঝোতায়’ যেতে। তিনি চেয়েছিলেন সেনাবাহিনী আপাতত সংবিধান ‘স্থগিত’ করুক। বিনিময়ে সু চি সেনাবাহিনীকে ১৪ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা দিতে চেয়েছিলেন। আর নিক ডেভিস গার্ডিয়ানে (৯ মার্চ) লিখেছেন, সেনাবাহিনী যে ‘ক্ষমতা’ ভোগ করছে, তা তারা ছাড়বে না। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ক্যাবিনেটে তিনটি পদে সেনাবাহিনী মনোনয়ন দেবে সাংবিধানিক নিয়মে। এ তিনটি পদ হচ্ছে স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষা। এর অর্থ হচ্ছে, মিয়ানমারে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা কাউন্সিল নিয়ন্ত্রণ করবে সেনাবাহিনী। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব না নিলে (অথবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকারে না থাকলে) সু চি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলেও থাকতে পারবেন না। কাজেই সরকারে একটি ‘রাজনৈতিক আবহ’ তৈরি হল বটে; কিন্তু পর্দার অন্তরালে ‘মূল ক্ষমতা’ থেকে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর হাতে। টিন কিয়াউ একজন ‘প্রক্সি প্রেসিডেন্ট’ হলেও সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতেও পারবেন না কিংবা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও করতে পারবেন না। Daily Jugantor 14.03.16
এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের সেনাশাসনের অবসান হতে যাচ্ছে বটে; কিন্তু মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্র নিয়ে রয়ে গেছে নানা প্রশ্ন। টিন কিয়াউ প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি কি একজন ‘পুতুল প্রেসিডেন্ট’ হবেন? তার সঙ্গে অং সান সু চির সম্পর্ক কী হবে কিংবা সেনাবাহিনীর সঙ্গেই বা তার সম্পর্ক কী হবে- এসব প্রশ্ন আলোচিত হতে থাকবে বারবার। বলা হচ্ছে, সু চি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পারেন! তিনি ভারতের ‘সোনিয়া গান্ধীর’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন কিনা- এসব প্রশ্নও এখন পশ্চিমা মিডিয়ায় তোলা হচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রধানের চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তার ভূমিকার দিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের বিকাশমান গণতন্ত্র একটি প্রশ্নের মুখে থাকল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু থাকলেও ১৯৬২ সালের পর থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জেনারেল নে উইন সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি (বিএসপিপি) গঠন করেছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় ১৯৮৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন গঠন করা হয়েছিল ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি। এরই ধারাবাহিকতায় পরে গঠন করা হয়েছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। জেনারেল থেইন সেইন ২০১০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে এ দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এখনও তিনি দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে সামরিক বাহিনী অত্যন্ত কৌশলে সু চিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে সংবিধান প্রণয়ন করেছে। সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সাল থেকেই সামরিক জান্তা জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে আসছিল। এবং ২০১০ সালের আগেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী যিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হবেন, তিনি কোনো বিদেশীকে বিয়ে করতে পারবেন না। এক নাগাড়ে ২০ বছরের ওপর বিদেশে থাকলে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য হবেন না। এবং যিনি প্রার্থী হবেন, তার সন্তান, বাবা ও মাকে মিয়ামনারে জন্মগ্রহণকারী নাগরিক হতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সু চি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হননি। অবশ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও কথা আছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয় না। সংসদ প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন করে। এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হন (৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন), পরে তাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
মিয়ামনারের সংবিধান অনুযায়ী রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়েছে অনেকটা ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো জমানার (১৯৬৬-১৯৯৮) ‘গোলকার’ মডেলের মতো। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট- House of Representative (Pyithu Hluttaw, নিম্নকক্ষ) ও House of Nationalities (Amyotha Hluttaw, উচ্চকক্ষ)। নিুকক্ষের সদস্য সংখ্যা ৪৪০, যেখানে সেনা প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ১১০ জনের, যাদের নিয়োগ দেন সেনাপ্রধান। আর উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা ২২৪, যার মাঝে ৫৬ জন সেনাবাহিনীর। এখানে বলা ভালো, অত্যন্ত ক্ষমতালিপ্সু জেনারেল থেইন সেইন ধীরে ধীরে ক্ষমতার শীর্ষে চলে এসেছেন। প্রথমে এসপিডিসির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল থান সু। কিন্তু থান সুকে একসময় সরিয়ে দিয়ে থেইন সেইন চলে আসেন মূল ক্ষমতায়। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন থেইন সেইন। পরে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হন। তার সঙ্গে অং সান সু চির সম্পর্ক কখনোই ভালো ছিল না। নির্বাচনে বিজয়ের পর সু চি একাধিকবার থেইন সেইনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। এমনকি সেনাপ্রধানের সঙ্গেও সু চির একাধিক বৈঠকের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেনাপ্রধান সংবিধানের বাইরে যেতে রাজি হননি। তিনি সেনাবাহিনীর গোষ্ঠীস্বার্থ দেখবেন, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সামনে মিসরের দৃষ্টান্ত আছে। সাময়িক সময়ের জন্য সেনাবাহিনী সেখানে বেসামরিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে তারা আবার ক্ষমতায় এসেছে। এটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারে এখন প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদও নেই। নির্বাচনের পরপরই সু চি বলেছিলেন, ‘সংবিধানে যাই লেখা থাকুক, তিনিই হবেন মূল ব্যক্তি।’ প্রশ্ন এখানেই। সংবিধান অনুযায়ী এই প্রথমবারের মতো একজন বেসামরিক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা নিতে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় ক্ষমতার বাইরে থেকে সু চি যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যান, সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ‘বিচক্ষণ’ সু চি কি তা করবেন? তিনি দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যারা গত এক বছর এনএলডি নেত্রী অং সান সু চির ভূমিকা ও বক্তব্য খেয়াল করেছেন, তারা দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু সেনাবাহিনীর আস্থা কতটুকু তিনি পেয়েছেন, তা নিশ্চিত নয়। মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরাও একটি ফ্যাক্টর। সেনাবাহিনী এ উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। প্রচণ্ড মুসলমানবিদ্বেষী ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা মাবাথা (অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রটেকশন অব রেস অ্যান্ড রিলিজিয়ন) সংগঠনের ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে। এদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য সু চি নির্বাচনে ১ হাজার ৭১১ আসনের (সংসদের উভয় কক্ষ, ১৪টি রাজ্যের সংসদ ও বিভিন্ন অঞ্চল) একটিতেও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেননি। সরকারি দল এসপিডিসিও কোনো মুসলমান প্রার্থী দেয়নি। এমনকি নির্বাচনের আগে সু চি রাখাইন স্টেট সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সমর্থনে তিনি সেখানে কোনো বক্তব্য দেননি। সিরিয়াস পাঠকরা লক্ষ্য করে থাকবেন, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা এবং শত শত রোহিঙ্গার নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও সু চির কোনো বক্তব্য নেই। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক। অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে।
উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এ প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতা পেতে হলে তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি যে কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল সুবিধাবাদিতায় ভরা। তাই বলা যাবে না তিনি সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থানে’ গিয়েছিলেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছিলেন। এতে করে তিনি নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়েছেন সত্য। কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি সমাজব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। তিনি যদি কঠোর অবস্থানে যান এবং ক্ষমতা ‘পরিচালনা’ করতে চান, তাহলে তা সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের প্ররোচিত করতে পারে। তিনি ‘রিয়েল পলিটিকসের’ পরিচয় দেবেন, এটাই সবাই প্রত্যাশা করে। এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করা, গণতন্ত্রকে সংহত করা এবং শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করা। অনেকটা ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো-পরবর্তী মডেল অনুসরণ করতে পারেন তিনি। সেখানে সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ‘কমিটেড’। একই সঙ্গে সু চি প্রেসিডেন্টের পদটিকে একটি ‘নিয়মতান্ত্রিক পদে’ পরিণত করার উদ্যোগ নিতে পারেন। সাংবিধানিকভাবে এটা এখন সম্ভব নয়। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু বিষয়টি অত সহজ নয়। সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে যে ‘লিখিত সুবিধা’ ভোগ করে আসছে তা ছেড়ে দেবে, এটা মনে হয় না।
মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সরকার আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় রাষ্ট্রই বিসিআইএম ও বিবিআইএমএস জোটের সদস্য। বাংলাদেশের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির জন্য এ দুটি জোটের গুরুত্ব অনেক বেশি। যদিও সেখানে দীর্ঘ সেনাশাসন থাকায় দু’দেশের মাঝে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়নি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য মিয়ানমারে রফতানি করে আমদানি করে তার চেয়ে বেশি। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশ রফতানি করেছিল ৫ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ১৩ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন), আর আমদানি করেছিল ২৯ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০১২-১৩ সালে এর পরিমাণ ৮৪ মিলিয়ন)। অথচ বিশাল এক সম্ভাবনার দেশ মিয়ানমার। বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের অন্যতম উৎস হতে পারে মিয়ানমার। সুতরাং সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার সম্ভাবনার অনেক দুয়ার খুলতে পারে।
এখন অনেক কিছুই নির্ভর করছে সু চির ওপর। ‘রিয়েল পলিটিকস’ নাকি সরাসরি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদ- কোনটা বেছে নেবেন সু চি? দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি অন্তরীণ ছিলেন। তিনি জানেন সেনাবাহিনী মিয়ানমারে কত শক্তিশালী। ক্ষমতা পেতে হলে সেনাবাহিনীকে আস্থায় নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তার সামনে মিসরের দৃষ্টান্ত আছে। সাময়িকভাবে সেখানে ড. মুরসিকে ক্ষমতা দিয়েছিল সেনাবাহিনী। সুযোগ বুঝে তারা আবার ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে। সুতরাং ‘বিচক্ষণ’ সু চি কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদে গিয়ে তার তেমন কোনো লাভ হবে না। ক্ষমতা পেতে তিনি স্বামীকে হারিয়েছেন। স্বামীর মৃতদেহ তিনি দেখতেও পারেননি। দুই ছেলে ব্রিটেনে, যাদের সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ নেই। ফলে সু চির আগামী দিনগুলো সত্যিকার অর্থেই লক্ষ্য রাখার বিষয়। নিঃসন্দেহে তার ভূমিকার ওপর মিয়ানমারে গণতন্ত্রের অনেক কিছু নির্ভর করছে। জন ফিসার বিবিসির অনলাইনে লিখেছেন (৯ মার্চ), যারা সু চির মাঝে ‘একজন নেলসন ম্যান্ডেলাকে’ খুঁজতে চেয়েছিলেন, তারা আশাহত হবেন। ফিসার লিখেছেন, শেষদিন পর্যন্ত সু চি চেষ্টা করেছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা ‘সমঝোতায়’ যেতে। তিনি চেয়েছিলেন সেনাবাহিনী আপাতত সংবিধান ‘স্থগিত’ করুক। বিনিময়ে সু চি সেনাবাহিনীকে ১৪ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা দিতে চেয়েছিলেন। আর নিক ডেভিস গার্ডিয়ানে (৯ মার্চ) লিখেছেন, সেনাবাহিনী যে ‘ক্ষমতা’ ভোগ করছে, তা তারা ছাড়বে না। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ক্যাবিনেটে তিনটি পদে সেনাবাহিনী মনোনয়ন দেবে সাংবিধানিক নিয়মে। এ তিনটি পদ হচ্ছে স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষা। এর অর্থ হচ্ছে, মিয়ানমারে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা কাউন্সিল নিয়ন্ত্রণ করবে সেনাবাহিনী। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব না নিলে (অথবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকারে না থাকলে) সু চি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলেও থাকতে পারবেন না। কাজেই সরকারে একটি ‘রাজনৈতিক আবহ’ তৈরি হল বটে; কিন্তু পর্দার অন্তরালে ‘মূল ক্ষমতা’ থেকে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর হাতে। টিন কিয়াউ একজন ‘প্রক্সি প্রেসিডেন্ট’ হলেও সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতেও পারবেন না কিংবা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও করতে পারবেন না। Daily Jugantor 14.03.16
0 comments:
Post a Comment