বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের পদত্যাগ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায়
ছিল না। খোদ অর্থমন্ত্রীর অসন্তুষ্টি এবং সরকারদলীয় শীর্ষ নেতাদের
পদত্যাগের আহ্বানের পর তার পক্ষে আর ওই পদে থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ড.
আতিউরের পদত্যাগ এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণের পরও অনেক
প্রশ্ন রয়ে গেছে, যার কোনো জবাব এ মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। এর জবাব পাওয়া
না গেলে তা বারবার আলোচিত হতে থাকবে এবং বিরোধী পক্ষ এটাকে পুঁজি করে
রাজনীতি করবে। মূল প্রশ্ন একটিই- যে রিজার্ভ নিয়ে আমরা এত গর্ব করি, তার
নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত? লুট হয়ে যাওয়া টাকা আদৌ ফেরত পাব কি-না?
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি সেকশন কতটুকু নিরাপদ? ৮০৮ কোটি টাকা লোপাট হয়ে
যাওয়ার পর সংবাদপত্রে যেসব প্রতিবেদন ও মন্তব্য ছাপা হয়েছে, তা কোনো আশার
কথা বলে না। আমরা যেন ভুলে না যাই, মার্কিন রিজার্ভ ব্যাংকে শুধু আমরাই
আমাদের রিজার্ভের টাকা আমানত রাখছি না। বিশ্বের প্রতিটি দেশই তাদের
রিজার্ভের একটা অংশ সেখানে রাখে। পৃথিবীতে রাষ্ট্রের সংখ্যা অনেক। দু’শর
ওপরে রাষ্ট্র তাদের রিজার্ভের একটা অংশ ডলারে মার্কিন রিজার্ভ ব্যাংকে জমা
রেখেছে। এখানে ‘ডলার রাজনীতি’ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। অনেকের স্মরণ
থাকার কথা, ইরাকের সাবেক শাসক সাদ্দাম হোসেন জীবদ্দশার শেষের দিনগুলোতে তার
দেশের রিজার্ভের একটা অংশ ইউরোতে পরিবর্তন করার চিন্তা করেছিলেন। এবং
যতদূর জানি, ডলারের পরিবর্তে ইউরোতে একটি রিজার্ভ তিনি গড়ে তুলেছিলেন।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশ তার রিজার্ভের সবটুকু মার্কিন ফেডারেল
রিজার্ভ ব্যাংকে রাখেনি। অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও একটা অংশ রেখেছিল। এখন
সেখান থেকেই হ্যাকাররা কিছু ডলার সরিয়ে নিল। এ ক্ষেত্রে আমরা ফেডারেল
রিজার্ভ ব্যাংককে অভিযুক্ত করতে পারব বটে; কিন্তু দায়ী করতে পারব কতটুকু,
সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।
আমাদের দায়ভারটা কি বেশি নয়? বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে গভর্নর ‘নৈতিক দায়িত্ব’ নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। দু’জন ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে আইডিগুলো থেকে ‘অ্যাডভাইজ’ পাঠানো হয়েছে, সেই আইডিগুলো কারা পরিচালনা করতেন? কিংবা অ্যাডভাইজ পাঠানোর পর যে কম্পিউটার থেকে পরে অনুমোদন দেয়া হয়, তা কাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল? যিনি ‘ডাটাবেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, তিনি কি তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন? সার্ভার কাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল? সেখানে ‘ফায়ার ওয়াল’ কেন ইনস্টল করা হয়নি? এটা কি শুধুই উদাসীনতা?
হ্যাকারদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী আজ এক ধরনের আতংক বিরাজ করছে। বাংলাদেশে এর আগেও আমরা দেখেছি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাক্ড হয়েছে। এ থেকে কি আমরা কিছুই শিখিনি? যদি বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের আইটি সেক্টরকে সুরক্ষা করতে বা রাখতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আইটি সেক্টরকে সুরক্ষায় রাখতে পারল না কেন? এটা শুধু এক ধরনের উদাসীনতা বলে আমার মনে হয় না। নিশ্চয়ই তদন্ত কমিটি বিষয়গুলো দেখবে এবং জাতিকে তা জানাবে। আমি চাই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ হিসেবে চিহ্নিত না করে তা প্রকাশ করা হবে। সেই সঙ্গে আমরা নিশ্চিত হতে চাই আমাদের রিজার্ভ আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না, পদত্যাগকারী গভর্নরের খুব কাছের কিছু লোক তাকে সামনে রেখেই সেখানে একটা বলয় তৈরি করেছিলেন। এরা নানা সুযোগ-সুবিধা নিতেন। বিদেশ ভ্রমণে ব্যস্ত থাকতেন বেশি। তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখতে পারে কতজন কর্মকর্তা গত কয়েক বছরে কতবার বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। এ বিদেশ ভ্রমণে তারা কী ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জন করেছেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনায় সেই অভিজ্ঞতা কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছেন? এদের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, এটাও আমাদের জানা দরকার।
ড. আতিউরের জন্য আমার দুঃখ হয়। তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ভালো ‘নেতা’ ছিলেন না। তার দুর্বল নেতৃত্বের কারণে অনেক ফাঁকফোকর তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাংলাদেশের জনগণের ৮০৮ কোটি টাকা যখন ‘হাওয়া’ হয়ে গেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘ঘুম’ যখন হারাম হয়ে গিয়েছিল, ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে তিনি নয়াদিল্লি যান কীভাবে? এটা সত্য, তিনি অনুমতি নিয়েই গিয়েছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় তাকে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়কে ‘টাকা চুরির’ বিষয়টি অবহিত করেননি।
তিনি সজ্জন ব্যক্তি সন্দেহ নেই তাতে। ঘনিষ্ঠ অনেককেই তিনি সাহায্য করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে অনেক ভালো কাজ করেছেন, এটা সত্য। কিন্তু তিনি যখন বলেন, বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বিদায় নিয়েছি, আমি চাই না আমার কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হোক- এটা ঠিক মানতে পারছি না। কেননা তিনি ‘বীরের বেশে’ যেতে পারেননি। কলংক মাথায় নিয়ে গেছেন। অতীতে কোনো গভর্নরকেই এভাবে যেতে হয়নি। কেউ এভাবে অভিযুক্তও হননি। আর দেশের ভাবমূর্তি? ৮০৮ কোটি টাকার চুরি ঠেকাতে ব্যর্থতার পরও তিনি যদি মনে করে থাকেন, তার কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি, তাহলে আর বলার কী আছে!
আমি দুঃখিত, যখন দেখি সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেল হলমার্ক, তখন তিনি নিশ্চুপ। বেসিক ব্যাংক থেকে যখন ৬ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেল, তখনও তাকে সোচ্চার হতে আমরা দেখিনি। অথচ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে আমরা প্রতিবাদী হতে দেখেছি। কিন্তু দেশের গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থা যখন তার হাতে, তখন স্বভাবতই মানুষ চেয়েছিল তিনি এ ব্যাপারে সোচ্চার হবেন। হননি। সাধারণ কৃষকদের জন্য ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করার উদ্যোগের কথা শুনেছি। তাতে কৃষক কি লাভবান হয়েছে? বর্গাচাষীদের ঋণের ব্যবস্থা কিংবা কারেন্সি মিউজিয়াম করা আর্থিক ব্যবস্থায় কি কোনো অবদান রেখেছে? সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে কমিয়ে আনা, কিংবা ব্যাংকিং সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। বারবার সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তখন তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত।
অর্থমন্ত্রী একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে পদত্যাগী গভর্নরের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার অবদান ছিল শূন্য। অর্থমন্ত্রী ওই সাক্ষাৎকারে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সেটা হল, গত অর্থবছরে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তিনি এর কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যানকে। বলেছেন, এনবিআর চেয়ারম্যান কাজ করেন না। তিনি কেবল বক্তৃতা দেন। একজন অর্থমন্ত্রী যখন এনবিআর চেয়ারম্যান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন, তখন সেই কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির ঘটনা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। এক. আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের আরও মতামত নেয়া প্রয়োজন। তাদের দিয়ে আমাদের দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে যা ক্ষতি হয়ে গেছে, তা পুষিয়ে ওঠা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। আর যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। দুই. প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশ যেহেতু আইসিটি খাতে যথেষ্ট উন্নতি করেছে, সেহেতু আন্তর্জাতিক হ্যাকারদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এখানেই রয়েছে আসল কথাটি। আমরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি। কিন্তু আমাদের আইসিটি সেক্টর সুরক্ষিত নয়। আমার ভয়টা এখানেই- হ্যাকাররা আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ‘গোপন ফাইল’ হাতিয়ে নিতে পারে। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সেক্টর কতটুকু সুরক্ষিত আমি নিশ্চিত নই। পুরো সিস্টেমগুলো এখন খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্য-সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। তিন. আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের ব্যাপারে একটা অভিমত আমরা শুনেছি গত কয়েকদিনে। বলা হচ্ছে, এদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কারণ এরাও ‘তথ্য’ হাতিয়ে নিতে পারে। একটা অভিযোগ উঠেছে- বাংলাদেশ ব্যাংকে সার্ভার স্থাপন করা হয়েছিল ফিলিপিনো বিশেষজ্ঞদের দিয়ে। আর ফিলিপিনো হ্যাকাররাই এ বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করল। এদের মাঝে কোনো যোগসূত্র আছে কি-না তা তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখতে পারে। ইতিমধ্যে রাকেশ আস্তানা নামে এক ভারতীয় আমেরিকান বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আস্তানা আবার নিজের প্রতিষ্ঠান ফায়ার আইকে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন থাকবে আস্তানার সততা নিয়ে। তার কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি থাকা প্রয়োজন। চার. রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিলে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে- বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনা এর বড় প্রমাণ। সাবেক আমলা ফজলে কবীরকে নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কেউ অর্থনীতিবিদ হলেই যে ভালো গভর্নর হতে পারেন না, কলংক নিয়ে ড. আতিউরের বিদায় এর বড় প্রমাণ। সাবেক দুই আমলা ড. ফরাস উদ্দিন ও ড. সালেহউদ্দীন সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক চালিয়েছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। এখন এক কঠিন সময়ে ফজলে কবীর দায়িত্ব নিলেন। তিনি যে দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন, এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। পাঁচ. অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে সিরিয়াস রিফর্ম প্রয়োজন। এ উপলব্ধিটুকু আরও আগে হলেই ভালো হতো। তবে দু’জন ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি এবং ব্যাংকিং সচিবকে ওএসডির বিষয়টি বিভ্রান্তি বাড়াতে পারে। দু’জন ডেপুটি গভর্নর যদি ‘দোষী’(?) হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি দু’জনকে বাইরে রাখা হল কেন? অব্যাহতি পাওয়া দু’জন যদি ব্যর্থ হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি দু’জনও ব্যর্থ। এ ক্ষেত্রে চারজনের মাঝে একটা বিভেদ রেখা টানা কোনো ভালো খবর নয়। অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে সংস্কার জরুরি, তখন পুরো সেটআপই পরিবর্তন প্রয়োজন। অন্যায় করলে শুধু গভর্নর এবং অব্যাহতি পাওয়া দু’জন ডেপুটি গভর্নরই করেননি। বাকি দু’জন ডেপুটি গভর্নরও একই অপরাধে অপরাধী। তাদের স্বপদে বহাল রাখা বিভ্রান্তি ছড়াবে মাত্র। আরও একটি কথা। অব্যাহতি পাওয়া একজন ডেপুটি গভর্নরকে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। মাত্র ৪ ঘণ্টার ব্যবধানে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কেন? যদি তাকে অব্যাহতি দিতে হয়, তাহলে তাকে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল কেন?
আরও একটি কথা। প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুততার সঙ্গে গভর্নরের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ব্যবহার করে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পার পেয়ে যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি এটা একটা ভালো দিক।
রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ৮০৮ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এ টাকা আদৌ বাংলাদেশে ফিরে আসবে এমন আস্থা রাখতে পারছি না। কেননা এ টাকা আর ব্যাংকিং চ্যানেলে নেই। হ্যাকাররা পরিকল্পিতভাবেই এ টাকা ক্যাসিনোর মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। তদন্ত কমিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কতটুকু চিহ্নিত করতে পারবে জানি না। তবে সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে পুরো ঘটনাটা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারে। ফিলিপাইনের সিনেট যদি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে পারে, তাহলে আমাদের জাতীয় সংসদ এ ব্যাপারে নিশ্চুপ কেন? এ ঘটনা একটি কালো অধ্যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি যেই হোক, তাদের বিচার হবে- এ প্রত্যাশা আমাদের সবার। Daily Jugantor 20.03. 2016
আমাদের দায়ভারটা কি বেশি নয়? বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে গভর্নর ‘নৈতিক দায়িত্ব’ নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। দু’জন ডেপুটি গভর্নরকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে আইডিগুলো থেকে ‘অ্যাডভাইজ’ পাঠানো হয়েছে, সেই আইডিগুলো কারা পরিচালনা করতেন? কিংবা অ্যাডভাইজ পাঠানোর পর যে কম্পিউটার থেকে পরে অনুমোদন দেয়া হয়, তা কাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল? যিনি ‘ডাটাবেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, তিনি কি তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন? সার্ভার কাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল? সেখানে ‘ফায়ার ওয়াল’ কেন ইনস্টল করা হয়নি? এটা কি শুধুই উদাসীনতা?
হ্যাকারদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী আজ এক ধরনের আতংক বিরাজ করছে। বাংলাদেশে এর আগেও আমরা দেখেছি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাক্ড হয়েছে। এ থেকে কি আমরা কিছুই শিখিনি? যদি বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের আইটি সেক্টরকে সুরক্ষা করতে বা রাখতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের আইটি সেক্টরকে সুরক্ষায় রাখতে পারল না কেন? এটা শুধু এক ধরনের উদাসীনতা বলে আমার মনে হয় না। নিশ্চয়ই তদন্ত কমিটি বিষয়গুলো দেখবে এবং জাতিকে তা জানাবে। আমি চাই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ হিসেবে চিহ্নিত না করে তা প্রকাশ করা হবে। সেই সঙ্গে আমরা নিশ্চিত হতে চাই আমাদের রিজার্ভ আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকে দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না, পদত্যাগকারী গভর্নরের খুব কাছের কিছু লোক তাকে সামনে রেখেই সেখানে একটা বলয় তৈরি করেছিলেন। এরা নানা সুযোগ-সুবিধা নিতেন। বিদেশ ভ্রমণে ব্যস্ত থাকতেন বেশি। তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখতে পারে কতজন কর্মকর্তা গত কয়েক বছরে কতবার বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। এ বিদেশ ভ্রমণে তারা কী ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জন করেছেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনায় সেই অভিজ্ঞতা কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছেন? এদের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, এটাও আমাদের জানা দরকার।
ড. আতিউরের জন্য আমার দুঃখ হয়। তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ভালো ‘নেতা’ ছিলেন না। তার দুর্বল নেতৃত্বের কারণে অনেক ফাঁকফোকর তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাংলাদেশের জনগণের ৮০৮ কোটি টাকা যখন ‘হাওয়া’ হয়ে গেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘ঘুম’ যখন হারাম হয়ে গিয়েছিল, ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে তিনি নয়াদিল্লি যান কীভাবে? এটা সত্য, তিনি অনুমতি নিয়েই গিয়েছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় তাকে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়কে ‘টাকা চুরির’ বিষয়টি অবহিত করেননি।
তিনি সজ্জন ব্যক্তি সন্দেহ নেই তাতে। ঘনিষ্ঠ অনেককেই তিনি সাহায্য করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে অনেক ভালো কাজ করেছেন, এটা সত্য। কিন্তু তিনি যখন বলেন, বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বিদায় নিয়েছি, আমি চাই না আমার কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হোক- এটা ঠিক মানতে পারছি না। কেননা তিনি ‘বীরের বেশে’ যেতে পারেননি। কলংক মাথায় নিয়ে গেছেন। অতীতে কোনো গভর্নরকেই এভাবে যেতে হয়নি। কেউ এভাবে অভিযুক্তও হননি। আর দেশের ভাবমূর্তি? ৮০৮ কোটি টাকার চুরি ঠেকাতে ব্যর্থতার পরও তিনি যদি মনে করে থাকেন, তার কারণে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি, তাহলে আর বলার কী আছে!
আমি দুঃখিত, যখন দেখি সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেল হলমার্ক, তখন তিনি নিশ্চুপ। বেসিক ব্যাংক থেকে যখন ৬ হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে গেল, তখনও তাকে সোচ্চার হতে আমরা দেখিনি। অথচ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে আমরা প্রতিবাদী হতে দেখেছি। কিন্তু দেশের গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থা যখন তার হাতে, তখন স্বভাবতই মানুষ চেয়েছিল তিনি এ ব্যাপারে সোচ্চার হবেন। হননি। সাধারণ কৃষকদের জন্য ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করার উদ্যোগের কথা শুনেছি। তাতে কৃষক কি লাভবান হয়েছে? বর্গাচাষীদের ঋণের ব্যবস্থা কিংবা কারেন্সি মিউজিয়াম করা আর্থিক ব্যবস্থায় কি কোনো অবদান রেখেছে? সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে কমিয়ে আনা, কিংবা ব্যাংকিং সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। বারবার সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তখন তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত।
অর্থমন্ত্রী একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে পদত্যাগী গভর্নরের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন। তিনি এ কথাও বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার অবদান ছিল শূন্য। অর্থমন্ত্রী ওই সাক্ষাৎকারে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সেটা হল, গত অর্থবছরে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তিনি এর কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যানকে। বলেছেন, এনবিআর চেয়ারম্যান কাজ করেন না। তিনি কেবল বক্তৃতা দেন। একজন অর্থমন্ত্রী যখন এনবিআর চেয়ারম্যান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন, তখন সেই কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির ঘটনা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। এক. আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। এ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের আরও মতামত নেয়া প্রয়োজন। তাদের দিয়ে আমাদের দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে যা ক্ষতি হয়ে গেছে, তা পুষিয়ে ওঠা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। আর যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। দুই. প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশ যেহেতু আইসিটি খাতে যথেষ্ট উন্নতি করেছে, সেহেতু আন্তর্জাতিক হ্যাকারদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এখানেই রয়েছে আসল কথাটি। আমরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি। কিন্তু আমাদের আইসিটি সেক্টর সুরক্ষিত নয়। আমার ভয়টা এখানেই- হ্যাকাররা আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ‘গোপন ফাইল’ হাতিয়ে নিতে পারে। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সেক্টর কতটুকু সুরক্ষিত আমি নিশ্চিত নই। পুরো সিস্টেমগুলো এখন খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্য-সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। তিন. আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের ব্যাপারে একটা অভিমত আমরা শুনেছি গত কয়েকদিনে। বলা হচ্ছে, এদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কারণ এরাও ‘তথ্য’ হাতিয়ে নিতে পারে। একটা অভিযোগ উঠেছে- বাংলাদেশ ব্যাংকে সার্ভার স্থাপন করা হয়েছিল ফিলিপিনো বিশেষজ্ঞদের দিয়ে। আর ফিলিপিনো হ্যাকাররাই এ বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করল। এদের মাঝে কোনো যোগসূত্র আছে কি-না তা তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখতে পারে। ইতিমধ্যে রাকেশ আস্তানা নামে এক ভারতীয় আমেরিকান বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আস্তানা আবার নিজের প্রতিষ্ঠান ফায়ার আইকে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন থাকবে আস্তানার সততা নিয়ে। তার কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি থাকা প্রয়োজন। চার. রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিলে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে- বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনা এর বড় প্রমাণ। সাবেক আমলা ফজলে কবীরকে নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কেউ অর্থনীতিবিদ হলেই যে ভালো গভর্নর হতে পারেন না, কলংক নিয়ে ড. আতিউরের বিদায় এর বড় প্রমাণ। সাবেক দুই আমলা ড. ফরাস উদ্দিন ও ড. সালেহউদ্দীন সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক চালিয়েছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। এখন এক কঠিন সময়ে ফজলে কবীর দায়িত্ব নিলেন। তিনি যে দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন, এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। পাঁচ. অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে সিরিয়াস রিফর্ম প্রয়োজন। এ উপলব্ধিটুকু আরও আগে হলেই ভালো হতো। তবে দু’জন ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি এবং ব্যাংকিং সচিবকে ওএসডির বিষয়টি বিভ্রান্তি বাড়াতে পারে। দু’জন ডেপুটি গভর্নর যদি ‘দোষী’(?) হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি দু’জনকে বাইরে রাখা হল কেন? অব্যাহতি পাওয়া দু’জন যদি ব্যর্থ হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি দু’জনও ব্যর্থ। এ ক্ষেত্রে চারজনের মাঝে একটা বিভেদ রেখা টানা কোনো ভালো খবর নয়। অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে সংস্কার জরুরি, তখন পুরো সেটআপই পরিবর্তন প্রয়োজন। অন্যায় করলে শুধু গভর্নর এবং অব্যাহতি পাওয়া দু’জন ডেপুটি গভর্নরই করেননি। বাকি দু’জন ডেপুটি গভর্নরও একই অপরাধে অপরাধী। তাদের স্বপদে বহাল রাখা বিভ্রান্তি ছড়াবে মাত্র। আরও একটি কথা। অব্যাহতি পাওয়া একজন ডেপুটি গভর্নরকে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। মাত্র ৪ ঘণ্টার ব্যবধানে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কেন? যদি তাকে অব্যাহতি দিতে হয়, তাহলে তাকে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল কেন?
আরও একটি কথা। প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুততার সঙ্গে গভর্নরের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ব্যবহার করে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পার পেয়ে যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি এটা একটা ভালো দিক।
রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ৮০৮ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এ টাকা আদৌ বাংলাদেশে ফিরে আসবে এমন আস্থা রাখতে পারছি না। কেননা এ টাকা আর ব্যাংকিং চ্যানেলে নেই। হ্যাকাররা পরিকল্পিতভাবেই এ টাকা ক্যাসিনোর মাধ্যমে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। তদন্ত কমিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কতটুকু চিহ্নিত করতে পারবে জানি না। তবে সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে পুরো ঘটনাটা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারে। ফিলিপাইনের সিনেট যদি বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে পারে, তাহলে আমাদের জাতীয় সংসদ এ ব্যাপারে নিশ্চুপ কেন? এ ঘটনা একটি কালো অধ্যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি যেই হোক, তাদের বিচার হবে- এ প্রত্যাশা আমাদের সবার। Daily Jugantor 20.03. 2016
0 comments:
Post a Comment