দীর্ঘ ৫৪ বছর পর মিয়ানমার একজন সিভিলিয়ান
প্রেসিডেন্ট পেয়েছে। তাঁর নাম তিন কিয়াও। তিনি এনএলডি নেতা অং সান সু চির
ঘনিষ্ঠ এবং ধারণা করা হচ্ছে তিনি হতে যাচ্ছেন একজন ‘প্রক্সি প্রেসিডেন্ট’।
মূল ক্ষমতা পরিচালনা করবেন সু চি স্বয়ং। মিয়ানমার একজন ভাইস প্রেসিডেন্টও
পেয়েছে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মিন্ট সয়েও। তিনি সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি।
মিয়ানমারে একটি পরিবর্তন এলেও সেনাবাহিনীর যে প্রভাব, তা থেকে যাবে। তাদের
প্রভাব হ্রাস হবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে সেনাবাহিনীর একটি
নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন ছিল। সেটা তারা দিয়েছে। কিন্তু তারা ব্যারাকে ফিরে
যাবে, এটা আমার মনে হয় না। একটি মিসরের মতো পরিস্থিতিরও
জন্ম হতে পারে মিয়ানমারে! ‘আরব বসন্ত’ মিসরে পরিবর্তন ডেকে এনেছিল। সেনা
নিয়ন্ত্রিত একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ভেঙে পড়েছিল কায়রোর ‘তাহরির স্কয়ার’-এর
দীর্ঘ ১৭ দিনের গণ-অবস্থানের কারণে। তার পরের ঘটনা সবাই জানেন। হোসনি
মুবারকের ক্ষমতা হস্তান্তর, একটি নির্বাচন, নির্বাচনে ড. মুরসির বিজয় (জুন
২০১২) এবং পরে (২০১৩) সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফিল্ড মার্শাল সিসির
ক্ষমতা গ্রহণ। আরব বসন্ত মিসরে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এখন
মিয়ানমার কি সেদিকেই হাঁটছে? সেনাবাহিনী নির্বাচন ও সংসদকে মেনে নিয়েছে।
কিন্তু সব ‘সুযোগ-সুবিধা’ তারা ছেড়ে দেবে, এটা মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে সু
চিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সহাবস্থানে যেতে হবে। নতুবা তিনি ‘পর্দার
অন্তরালে’ থেকেও ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার, সেনা
সমর্থন নিশ্চিত হতে হবে। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিন কিয়াওকে সামনে নিয়ে
এসেছিলেন। তিনি নিজে প্রার্থী না হয়ে সংবিধান মেনে নিলেন। এর মাধ্যমে তিনি
সেনাবাহিনীর এক ধরনের ‘কর্তৃত্ব’ স্বীকার করে নিয়েছেন। সরকারে তাঁর
‘ভূমিকা’ নিয়েও এখন প্রশ্ন থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনি একটি
‘পদ’ পেতে পারেন। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো।
নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বিচ্ছিন্নতাবাদী আটটি গ্রুপের সঙ্গে
একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু চুক্তির বাইরে আরো বিচ্ছিন্নতাবাদী
গ্রুপ রয়েছে। এদেরও চুক্তির আওতায় আনা দরকার। অর্থনৈতিক সংস্কারটা খুবই
জরুরি। বৈদেশিক বিনিয়োগ দীর্ঘদিন এ দেশে বন্ধ ছিল। এখন এটি উন্মুক্ত। বিশেষ
করে গভীর সমুদ্রে বিপুল জ্বালানিসম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈদেশিক
বিনিয়োগ এলেই এই সম্পদ আহরণ সম্ভব। মার্কিন বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমারে আসতে
শুরু করেছেন। এখন ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির’ কারণে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা আরো
উৎসাহিত হবেন। রোহিঙ্গা সমস্যা বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট
করেছে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এক অমানবিক জীবন যাপন
করছে। সু চি এদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি উগ্র বৌদ্ধ
মানসিকতায় নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, ভোটপ্রাপ্তি
নিশ্চিত করা। সেটা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর কাছ
থেকে মানুষ আরো বেশি কিছু প্রত্যাশা করে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া,
তাদের চলাচলে বাধানিষেধ প্রত্যাহার করে নেওয়া কিংবা তাদের নিজ বাসভূমে
বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। নয়া সরকার এ কাজ করবে—এটিই মানুষ
প্রত্যাশা করে।
১৯৬২ সালের পর মিয়ানমার এই প্রথমবারের মতো একজন সিভিলিয়ান প্রেসিডেন্ট পাচ্ছে। নয়া প্রেসিডেন্টের কাছে দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। দীর্ঘ ৫৪ বছর সামরিক বাহিনী সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। ফলে সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। সংবাদপত্র সেখানে স্বাধীন নয়। বিচার বিভাগও স্বাধীন নয়। এগুলোর সবই একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন। এখন একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা নিতে যাচ্ছে। ১ এপ্রিল নয়া প্রেসিডেন্ট তাঁর দায়িত্ব নেবেন। একটি সরকারও গঠিত হবে তখন। ফলে নতুন এক মিয়ানমারকে আমরা দেখতে পাব। সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটা সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। একটি ‘নয়া মিয়ানমার’ আমাদের জন্য অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। মিয়ানমার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি অতীতে। এমনকি দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্কও আশাব্যঞ্জক নয়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১-১২ সময়সীমায় বাংলাদেশ মিয়ানমারে রপ্তানি করেছিল ১৩ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ মিয়ানমার থেকে আমদানি করেছে ৬৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। কিন্তু পরের বছর আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ কমে যায়। ২০১২-১৩ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানির পরিমাণ মাত্র ৮৭ হাজার ডলারের পণ্য। তুলনামূলক বিচারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা নিকট প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে আমাদের বিশাল বাণিজ্য। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একেবারেই গড়ে ওঠেনি। অথচ বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে সিমেন্ট, ওষুধ, বিস্কুট, আয়রন, টিন ও সফট ড্রিংকসের বেশ চাহিদা রয়েছে মিয়ানমারে। এখন নতুন একটি সিভিলিয়ান সরকার সেখানে গঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উদ্যোগ নিতে পারে এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো উন্নত করতে। বিসিআইএম জোটেরও বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে দেখা যায় ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের দেশটির বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৯.৯৩ শতাংশ, আর ২০১১ সালে মাত্র ২.৬৩ শতাংশ। এখানে মিয়ানমারের অংশ কমেছে, এটা সত্য। এখন একটি সিভিলিয়ান সরকার এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো বাড়াতে পারে। বিশ্ববাণিজ্যে পরিবর্তন আসছে। আঞ্চলিক বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে মিয়ানমার আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে।
সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেভাবে গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে, মিয়ানমার এ থেকে পার্থক্য নয়। ধ্রুপদী গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তা বলতে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশেই নেই। এ ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারেও এক ধরনের গণতন্ত্র বিকশিত হতে যাচ্ছে, যার সঙ্গে বিশ্বের অন্যত্র গণতন্ত্র যেভাবে বিকশিত হয়েছে তার সঙ্গে মেলানো যাবে না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা লক্ষ করি। মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন জোটে গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরে একদলীয় (পিপলস অ্যাকশন পার্টি) শাসন বজায় রয়েছে; যদিও জনগণই তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। কম্পুচিয়ায় সমাজতন্ত্র-পরবর্তী রাষ্ট্র কাঠামোয় একদলীয় (পিপলস পার্টি) শাসন বর্তমান। থাইল্যান্ডে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সেখানে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলের প্রভাব অনেক বেশি। তাঁর নামেই তাঁর বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সরকারও গঠন করেছিলেন। সমাজতন্ত্র-পরবর্তী মধ্য এশিয়ার প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। এখন অং সান সু চির দল কি সেদিকেই যাচ্ছে? তাঁর রয়েছে বিশাল জনপ্রিয়তা। পারিবারিক রাজনীতি ধারণ করেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন না বটে; কিন্তু তাঁর একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে বহির্বিশ্বেও তিনি সমান সমান জনপ্রিয়। একটি সরকার গঠিত হবে এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তিন কিয়াও পার্লামেন্টে ২২ সদস্যের কেবিনেটে ১৯ জন কেবিনেট মন্ত্রী নিয়োগ করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনজন মন্ত্রী (প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা) নিয়োগ করবে সেনাবাহিনী। তিন কিয়াও নতুন মন্ত্রিসভা নিয়োগ দেবেন। এতে অং সান সু চি পররাষ্ট্র, জ্বালানি, শিক্ষা এবং প্রেসিডেন্ট অফিস সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। এ মুহূর্তে তিনি যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেবেন তা হচ্ছে : ১. সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা। সংবিধান পরিবর্তনটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে একটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। সংবিধানের বর্তমান কাঠামো ঠিক রেখেও সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। ২. সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানগতভাবেই এবং সিনিয়র জেনারেলদের স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজন নানাভাবে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, যাঁরা মিয়ানমারের অর্থনীতির অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেন। নয়া সরকার এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে সেনাবাহিনী এটা ভালো চোখে দেখবে না। দুটি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করি, যার মাধ্যমে সেনাবাহিনী ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। ইউনিয়ন অব মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস ও মিয়ানমার ইকোনমিক কো-অপারেশন। সিনিয়র জেনারেলরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও সেনাবাহিনী স্থানীয় অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে (যেমন—চীনের ইউনান প্রদেশের পাশে মিয়ানমারের শান (shan) রাজ্যে মোতায়েনকৃত নর্থ ইস্টার্ন কমান্ড)। অভিযোগ আছে, স্থানীয় সেনা কমান্ডাররা মাদক ব্যবসা ও বিখ্যাত ‘টিক’ (কাঠ)-এর অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কৃষি উত্পাদন ও বিপণনের সঙ্গেও সেনাবাহিনী জড়িত। সেনা নেতৃত্ব এটা অনুমোদন করেছে। বলা হয়, স্থানীয় সেনাবাহিনীর খরচ তারা এভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে মেটায়। এর বাইরে সিনিয়র জেনারেলদের স্ত্রীরা মূল্যবান পাথর (রুবি, জেড, স্যাফায়ার, মার্বেল ইত্যাদি) ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ইউরোপ তথা যুক্তরাষ্ট্রে এই মূল্যবান পাথরের ভালো ব্যবসা। ২০১৪ সালে এ খাতে ব্যবসা করে মিয়ানমার আয় করেছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার। ভূগর্ভ থেকে এসব পাথর উত্তোলন করা হয় এবং মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় এসব পাথরের বিশাল রিজার্ভ রয়েছে। এই রিজার্ভ ঘিরে ওই অঞ্চলে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। এ ব্যবসায় সিনিয়র জেনারেলরা জড়িত। সুতরাং এ সেক্টরে যদি ‘স্টেটাস কো’ বজায় রাখা না হয়, তাহলে দ্রুত সিভিল প্রশাসন সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাবে। ৩. সিভিল প্রশাসনকে তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হলে ১৪ রাজ্যে যে বিদ্রোহী গ্রুপ রয়েছে, তাদের আস্থায় নিতে হবে। শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সঙ্গে একটি সহাবস্থান প্রেসিডেন্ট তিন কিয়াওকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। ৪. ভৌগোলিকভাবে মিয়ানমারের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চল ঘিরে একটি চীন ও ভারত দ্বন্দ্ব ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। মিয়ানমারে চীনা স্বার্থ দীর্ঘদিনের। ভারতও মিয়ানমারের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। ভারতের বিনিয়োগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে তিন কিয়াওকে একটি ভারসাম্যমূলক নীতি অবলম্বন করতে হবে। ওবামার এশীয় নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে এই মিয়ানমার। ওবামা দুইবার মিয়ানমার সফর করেছেন। হিলারি ক্লিনটনও এসেছিলেন ২০১১ সালে। মার্কিনিদের আগ্রহের কারণে মিয়ানমারের স্বার্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকটাও বিবেচনায় নিতে হবে নয়া সরকারকে।
মিয়ানমার একটি সিভিলিয়ান সরকার পেতে যাচ্ছে; কিন্তু এ সরকার সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কী অবদান রাখতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। Daily Kaler kontho 29.03.16
১৯৬২ সালের পর মিয়ানমার এই প্রথমবারের মতো একজন সিভিলিয়ান প্রেসিডেন্ট পাচ্ছে। নয়া প্রেসিডেন্টের কাছে দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। দীর্ঘ ৫৪ বছর সামরিক বাহিনী সেখানে ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। ফলে সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। সংবাদপত্র সেখানে স্বাধীন নয়। বিচার বিভাগও স্বাধীন নয়। এগুলোর সবই একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজন। এখন একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা নিতে যাচ্ছে। ১ এপ্রিল নয়া প্রেসিডেন্ট তাঁর দায়িত্ব নেবেন। একটি সরকারও গঠিত হবে তখন। ফলে নতুন এক মিয়ানমারকে আমরা দেখতে পাব। সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটা সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। একটি ‘নয়া মিয়ানমার’ আমাদের জন্য অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। মিয়ানমার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি অতীতে। এমনকি দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্কও আশাব্যঞ্জক নয়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১-১২ সময়সীমায় বাংলাদেশ মিয়ানমারে রপ্তানি করেছিল ১৩ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অথচ মিয়ানমার থেকে আমদানি করেছে ৬৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। কিন্তু পরের বছর আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ কমে যায়। ২০১২-১৩ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর আমদানির পরিমাণ মাত্র ৮৭ হাজার ডলারের পণ্য। তুলনামূলক বিচারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা নিকট প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে আমাদের বিশাল বাণিজ্য। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একেবারেই গড়ে ওঠেনি। অথচ বাংলাদেশি পণ্য, বিশেষ করে সিমেন্ট, ওষুধ, বিস্কুট, আয়রন, টিন ও সফট ড্রিংকসের বেশ চাহিদা রয়েছে মিয়ানমারে। এখন নতুন একটি সিভিলিয়ান সরকার সেখানে গঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উদ্যোগ নিতে পারে এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো উন্নত করতে। বিসিআইএম জোটেরও বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে দেখা যায় ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের দেশটির বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৯.৯৩ শতাংশ, আর ২০১১ সালে মাত্র ২.৬৩ শতাংশ। এখানে মিয়ানমারের অংশ কমেছে, এটা সত্য। এখন একটি সিভিলিয়ান সরকার এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো বাড়াতে পারে। বিশ্ববাণিজ্যে পরিবর্তন আসছে। আঞ্চলিক বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে মিয়ানমার আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে।
সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেভাবে গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে, মিয়ানমার এ থেকে পার্থক্য নয়। ধ্রুপদী গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তা বলতে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশেই নেই। এ ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারেও এক ধরনের গণতন্ত্র বিকশিত হতে যাচ্ছে, যার সঙ্গে বিশ্বের অন্যত্র গণতন্ত্র যেভাবে বিকশিত হয়েছে তার সঙ্গে মেলানো যাবে না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ আমরা লক্ষ করি। মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন জোটে গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরে একদলীয় (পিপলস অ্যাকশন পার্টি) শাসন বজায় রয়েছে; যদিও জনগণই তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। কম্পুচিয়ায় সমাজতন্ত্র-পরবর্তী রাষ্ট্র কাঠামোয় একদলীয় (পিপলস পার্টি) শাসন বর্তমান। থাইল্যান্ডে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলেও সেখানে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলের প্রভাব অনেক বেশি। তাঁর নামেই তাঁর বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সরকারও গঠন করেছিলেন। সমাজতন্ত্র-পরবর্তী মধ্য এশিয়ার প্রতিটি দেশে গণতন্ত্রের নামে একদলীয় কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। এখন অং সান সু চির দল কি সেদিকেই যাচ্ছে? তাঁর রয়েছে বিশাল জনপ্রিয়তা। পারিবারিক রাজনীতি ধারণ করেই তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। তিনি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন না বটে; কিন্তু তাঁর একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে বহির্বিশ্বেও তিনি সমান সমান জনপ্রিয়। একটি সরকার গঠিত হবে এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তিন কিয়াও পার্লামেন্টে ২২ সদস্যের কেবিনেটে ১৯ জন কেবিনেট মন্ত্রী নিয়োগ করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনজন মন্ত্রী (প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা) নিয়োগ করবে সেনাবাহিনী। তিন কিয়াও নতুন মন্ত্রিসভা নিয়োগ দেবেন। এতে অং সান সু চি পররাষ্ট্র, জ্বালানি, শিক্ষা এবং প্রেসিডেন্ট অফিস সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। এ মুহূর্তে তিনি যে বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেবেন তা হচ্ছে : ১. সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা। সংবিধান পরিবর্তনটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে একটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হলে সেনাবাহিনীর সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। সংবিধানের বর্তমান কাঠামো ঠিক রেখেও সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। ২. সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানগতভাবেই এবং সিনিয়র জেনারেলদের স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজন নানাভাবে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত, যাঁরা মিয়ানমারের অর্থনীতির অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করেন। নয়া সরকার এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে সেনাবাহিনী এটা ভালো চোখে দেখবে না। দুটি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করি, যার মাধ্যমে সেনাবাহিনী ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। ইউনিয়ন অব মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংস ও মিয়ানমার ইকোনমিক কো-অপারেশন। সিনিয়র জেনারেলরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও সেনাবাহিনী স্থানীয় অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে (যেমন—চীনের ইউনান প্রদেশের পাশে মিয়ানমারের শান (shan) রাজ্যে মোতায়েনকৃত নর্থ ইস্টার্ন কমান্ড)। অভিযোগ আছে, স্থানীয় সেনা কমান্ডাররা মাদক ব্যবসা ও বিখ্যাত ‘টিক’ (কাঠ)-এর অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কৃষি উত্পাদন ও বিপণনের সঙ্গেও সেনাবাহিনী জড়িত। সেনা নেতৃত্ব এটা অনুমোদন করেছে। বলা হয়, স্থানীয় সেনাবাহিনীর খরচ তারা এভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্য করে মেটায়। এর বাইরে সিনিয়র জেনারেলদের স্ত্রীরা মূল্যবান পাথর (রুবি, জেড, স্যাফায়ার, মার্বেল ইত্যাদি) ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ইউরোপ তথা যুক্তরাষ্ট্রে এই মূল্যবান পাথরের ভালো ব্যবসা। ২০১৪ সালে এ খাতে ব্যবসা করে মিয়ানমার আয় করেছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার। ভূগর্ভ থেকে এসব পাথর উত্তোলন করা হয় এবং মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় এসব পাথরের বিশাল রিজার্ভ রয়েছে। এই রিজার্ভ ঘিরে ওই অঞ্চলে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। এ ব্যবসায় সিনিয়র জেনারেলরা জড়িত। সুতরাং এ সেক্টরে যদি ‘স্টেটাস কো’ বজায় রাখা না হয়, তাহলে দ্রুত সিভিল প্রশাসন সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাবে। ৩. সিভিল প্রশাসনকে তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হলে ১৪ রাজ্যে যে বিদ্রোহী গ্রুপ রয়েছে, তাদের আস্থায় নিতে হবে। শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সঙ্গে একটি সহাবস্থান প্রেসিডেন্ট তিন কিয়াওকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। ৪. ভৌগোলিকভাবে মিয়ানমারের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চল ঘিরে একটি চীন ও ভারত দ্বন্দ্ব ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। মিয়ানমারে চীনা স্বার্থ দীর্ঘদিনের। ভারতও মিয়ানমারের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। ভারতের বিনিয়োগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে তিন কিয়াওকে একটি ভারসাম্যমূলক নীতি অবলম্বন করতে হবে। ওবামার এশীয় নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে এই মিয়ানমার। ওবামা দুইবার মিয়ানমার সফর করেছেন। হিলারি ক্লিনটনও এসেছিলেন ২০১১ সালে। মার্কিনিদের আগ্রহের কারণে মিয়ানমারের স্বার্থ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকটাও বিবেচনায় নিতে হবে নয়া সরকারকে।
মিয়ানমার একটি সিভিলিয়ান সরকার পেতে যাচ্ছে; কিন্তু এ সরকার সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কী অবদান রাখতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। Daily Kaler kontho 29.03.16
0 comments:
Post a Comment