রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেমন চলছে মোদির ভারত

এ কোন ভারতকে আমরা দেখছি? প্রথম ঘটনাটি হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ভেমুলা দলিত শ্রেণীর প্রতিনিধি। খুব কম দলিত শ্রেণীর প্রতিনিধিই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান। ভেমুলা পেয়েছিলেন। কিন্তু এ উচ্চশিক্ষাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে এবং সেই সঙ্গে তার চার বন্ধুকে ‘সন্ত্রাসী ও ভারতবিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কার করে। এর প্রতিবাদে ভেমুলা ও তার বন্ধুরা ক্যাম্পাসের ভেতরে তাঁবু টানিয়ে বসবাস করতে থাকেন শুধু এ আশায় যে, কর্তৃপক্ষ তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করায় রোহিত ভেমুলা গত ১৭ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যা করার আগে একটি ‘সুইসাইড নোটে’ তিনি লিখে যান- দলিত শ্রেণীতে জন্মই তার মৃত্যুর কারণ! দ্বিতীয় ঘটনা গত ১২ ফেব্রুয়ারি দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের। ওইদিন ক্যাম্পাসে উগ্রপন্থী আফজাল গুরুর ফাঁসির বিরুদ্ধে একটি ছাত্রসভার আয়োজন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র ইউনিয়ন। সভায় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি কানহাইয়া বক্তৃতা করেন। ওই সভায় কাশ্মীরের বেশ কিছু ছাত্র উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ ওঠে কানহাইয়া ‘দেশদ্রোহী’ এবং ওই সভায় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান উঠেছিল। এ অভিযোগে তাকে পেটানো হয় এবং পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এরপর আরও দুই ছাত্র উমর খালিদ ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগ মাথায় নিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এ ঘটনায় ভারতের পার্লামেন্ট উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল এবং রাজ্যসভার অধিবেশন চারবার মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছিল। সর্বশেষ ঘটনাটি হরিয়ানার। সেখানে জঠরা আন্দোলন গড়ে তুলে দিল্লিতে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। জঠদের এ আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল আরও বেশ কয়েকটি রাজ্যে। জঠরা মূলত কৃষিজীবী। কৃষি শ্রমিক। কিন্তু তারা ভারতে ওবিসি অর্থাৎ ‘আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস’ হিসেবে স্বীকৃত নন। তারা নিঃসন্দেহে একটি অনগ্রসর শ্রেণী। তাদের জন্য কোনো কোটা নেই চাকরি ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ওবিসি ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য তারা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এখানে সমস্যা হচ্ছে উচ্চ আদালতের একটি রায়। এতে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা ও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়াটাকে অনগ্রসরতা বলা যাবে না।’ দলিতরা যে কোটা সুবিধা পায়, জঠরা সেই সুবিধা পায় না। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর গত দেড় বছরে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তা বহির্বিশ্বে দেশটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে না। ভারত আজ বিশ্বের অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত তার সামাজিক অবস্থার উন্নতি করতে পারেনি। ভারতে কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করে- এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিদিন অন্তত ৩ জন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হন, অথচ তারা জনগোষ্ঠীর ৫ ভাগের ১ ভাগ। জাতপাতের সমস্যা ভারতে অনেক বেশি। দীর্ঘ প্রায় ৬৯ বছরেও এ সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। নিঃসন্দেহে গত দেড় বছরে মোদি নিজেকে একজন উদ্যমী ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দলে আদভানীর (যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন) মতো নেতাকে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বড় তা হচ্ছে, তিনি ‘গরিব দেশের ধনী প্রধানমন্ত্রী।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামাকে স্বাগত জানাতে (জানুয়ারি ২০১৫) তিনি ১০ লাখ রুপির স্যুট পরিধান করে প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ধনিক শ্রেণীরই প্রতিনিধি! যে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কৈশোরে ট্রেনের কামরায় কামরায় চা বিক্রি করতেন, মা পরের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে সংসার চালাতেন (মে, ২০১৫ সংখ্যা টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদকের কাছে তা তিনি স্বীকারও করেছেন), সেই মোদির সঙ্গে এখন কর্পোরেট জগতের বাসিন্দাদের সম্পর্কই বেশি। ট্রেনের চা বিক্রেতাদের মতো সাধারণ ভারতীয়দের কাছে এখন তিনি ‘অনেক দূরের মানুষ’। তিনি যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে যান ব্যবসায়ীরা, যান কর্পোরেট হাউসের প্রতিনিধিরা। কিন্তু গত দেড় বছরে তার শরীরে দশ লাখ রুপির স্যুট উঠলেও দরিদ্র ভারতের চেহারা তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি। কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি। ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রামের মতে, জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল, আজ তৃতীয় অবস্থানে (সাধারণ নিয়মে এ অবস্থান সপ্তম)। আর গত বছর জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে বেশি হবে। যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে শতকরা ৭ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে ভারতের হবে ৭ দশমিক ৭ ভাগ। নরেন্দ্র মোদি এ ভারতকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের জনগোষ্ঠীর ৩৭ শতাংশ মানুষ এখনও গরিব। জনগোষ্ঠীর ৫৩ শতাংশের কোনো টয়লেট নেই, যারা প্রকাশ্যেই এ কাজটি নিত্য সম্পন্ন করেন। পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায়, প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০)! পাঁচ বছর আগের এ পরিসংখ্যানে খুব পরিবর্তন এসেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রায় ৮০ কোটি মানুষের দৈনিক আয় ২ দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করে। শুধু দারিদ্র্যের কথা কেন বলি, নারী-পুরুষের পার্থক্যের ক্ষেত্রে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৮৬ হিসাবে ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণ এত ঘটনা ঘটার পরও বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি (যা বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি) ‘গুলাব গ্যাং’য়ের (উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখণ্ডে গ্রামের সত্য কাহিনী) কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মোদি গত দেড় বছরে এদের জন্য কী করেছেন? যদিও মাত্র দেড় বছরে দারিদ্র্য কমানো সম্ভব নয়, কিংবা বিপুল তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দারিদ্র্য কমানো তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মোদির গুজরাট মডেল নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি সড়ক-মহাসড়ক করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে গুজরাটে তার আমলে কম ছিল, মাত্র ১৩ দশমিক ৪ ভাগ (২০১২-১৩ সালে আসামে ছিল ২১.১ ভাগ, উত্তরখণ্ডে ২০.৮ ভাগ, মহারাষ্ট্রে ১৯.৮ ভাগ)। শিশু মৃত্যুর হার গুজরাটে হাজারে ৩৮, অথচ কেরালায় ১২, তামিলনাড়–তে ২১, মহারাষ্ট্রে ২১। শিশুজন্ম দেয়ার সময় মাতৃ মৃত্যুর হার গুজরাটে ৯.৫, কেরালায় ৩.৩, তামিলনাড়–তে ৫, মহারাষ্ট্রে ৫.২ ভাগ। যেখানে গুজরাটে খাবার পানি নিশ্চিত করা হয়েছে জনগোষ্ঠীর ৮৪ দশমিক ১ ভাগ মানুষের, সেখানে পাঞ্জাবে এ হার ৯৭.৬, উত্তর প্রদেশে ৮৭.৮, দিল্লিতে ৯৭.২ শতাংশ। পাকা ঘর রয়েছে হরিয়ানায় ৯৪.৮, দিল্লিতে ৯৪.৭, উত্তরখণ্ডে ৯৩.৯ ভাগ মানুষের। অথচ গুজরাটে এ হার মাত্র ৭৫.৭ ভাগ। ইন্ডিয়ান সেনসাস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কাজেই ‘গুজরাট মডেল’ কীভাবে সারা ভারতের জন্য একটা মডেল হবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। আসলে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব একটি অর্থনৈতিক সংস্কৃতি তিনি গড়ে তুলেছেন গুজরাটে। কিন্তু এতে করে সাধারণ মানুষের প্রতি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখন তিনি এই মানসিকতায় যদি ভারতকে পরিচালনা করতে চান, তিনি ভুল করবেন। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা নরেন্দ্র মোদি এখন আর ভারতের দরিদ্রতম মানুষগুলোকে স্মরণ করেন না। কাজ-পাগল মানুষ তিনি, সন্দেহ নেই তাতে। মাত্র ৩ ঘণ্টা তিনি ঘুমান এ কথাটা নিজেই স্বীকার করেছেন টাইম প্রতিবেদকের কাছে। ‘কম সরকার, অনেক বেশি প্রশাসন’- এই হচ্ছে তার দৃষ্টিভঙ্গি। এতে করে ভারতকে কতটুকু বদলে দিতে পারবেন তিনি? টাইম মোদিকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল। শিরোনাম ছিল Why Modi Matters। মোদি কেন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলেই গোধরায় ট্রেনে ৫৪ জন হিন্দু পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে গুজরাটে হাজারের মতো মুসলমান হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় চীনা প্রেসিডেন্ট ছুটে গিয়েছিলেন আহমেদাবাদে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং মাত্র দেড় বছরে শীর্ষ বিশ্ব নেতাদের তালিকায় নিজের নামটাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন (টাইম সাময়িকীর মতে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী নেতার একজন তিনি)। তাই খুব সঙ্গত কারণেই মোদি বারবার আলোচনায় থেকেছেন। তবে তিনি দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সমাজে বৈষম্য দূরীকরণের ব্যাপারে কোনো বড় উদ্যোগ নিতে পারেননি। তাই অসন্তোষ বাড়ছে। মোদির জমানায় দলিত শ্রেণী প্রতিনিয়ত কীভাবে নিগৃহীত হচ্ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইন্ডিয়া টুডের উল্লিখিত প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, দলিত শ্রেণীর স্কুল ত্যাগের হার শতকরা ৫০ ভাগ। প্রতিদিন দু’জন করে দলিত খুন হচ্ছেন। দুটি করে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মোদি নিজে নিম্নশ্রেণী থেকে উঠে এলেও এ শ্রেণীর মানুষদের তিনি এখন আর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি এখন উচ্চশ্রেণীর প্রতিনিধি। মোদি বলেছেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর গত এক বছরে তিনি দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ উপহার দিতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি প্রধান পাহারাদার, দেশের সম্পদের পাহারাদার। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ (ভারত নির্মাণ) অভিযানকে অতিরঞ্জিত প্রচার বলে মন্তব্য করা হয়েছে। মোদি সরকারের কাছে বিপুল প্রত্যাশা থাকলেও কর্মসংস্থানের হাল যথেষ্ট খারাপ বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। দেশটির প্রভাবশালী দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল গেল বছর মোদি সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতে ‘মোদির এক বছর : উচ্ছ্বাসের পর্ব শেষ, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, “ভারতে এক বছর আগে পরিবর্তন ও আর্থিক পুনরুজ্জীবনের আশায় নরেন্দ্র মোদি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু এবার চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে মোদি সরকার। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযান শুরু করলেও ভারতের অর্থনীতি খুঁড়িয়েই চলছে।” আর নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, মোদির অধিকাংশ কর্মসূচি এখনও কথার কথাই রয়ে গেছে। পত্রিকাটির মতে, দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার এখনও বেহাল। ব্যবসায়িক উদ্যোগও তেমন দানা বাঁধছে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও চাপে পড়েছেন মোদি। সমাজের দলিত শ্রেণী তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে এখন। এসব মূল্যায়ন মোদি সম্পর্কে কোনো ভালো ধারণা দেয় না। নিশ্চয়ই গত দেড় বছরে মোদি অনেক কিছু শিখেছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত একাই নেন। মনমোহন সিং বেশি মাত্রায় সোনিয়া গান্ধীনির্ভর ছিলেন। এখানেই মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে মোদির পার্থক্য। নরেন্দ্র মোদির প্লাস পয়েন্ট এটাই। দলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। তারপরও তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ আছে। দলের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, গত আগস্টে (২০১৫) ভারতের ৬৯তম স্বাধীনতা দিবসে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি ভারতকে ঘুণপোকার মতো খেয়ে ফেলেছে। উপরের পর্যায় থেকে আমাদের এ কাজ শুরু করতে হবে।’ ভাষণে তিনি কিছু প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। এর মধ্যে আছে ১০০০ দিনের মধ্যে সব গ্রামে বিদ্যুৎ। তিনি বলেছিলেন, ‘স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া’। নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছিলেন। একসময়ের ট্রেনের কামরার চা বিক্রেতা মোদির শরীরে ১০ লাখ টাকা দামের স্যুট উঠেছে সত্য; কিন্তু রোহিত ভেমুলাদের মতো দলিত শ্রেণীর প্রতিনিধিদের নিরাপত্তা তিনি এতটুকু নিশ্চিত করতে পারেননি। ভারতে সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে। বাড়ছে নারী ধর্ষণ আর মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব। মোদির জমানায় হিন্দুত্ববাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দুত্ববাদ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেন এসব হচ্ছে? রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের (কলকাতা) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক পবিত্র সরকারের মতে এর কারণ দুটি। এক. জওহরলাল নেহেরুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকার বা বিজেপি দলের নিয়ন্ত্রণ চাপানোর প্রবল ‘গৈরিক’ ইচ্ছা, আর দুই. ওখানকার এবং সারা দেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের শায়েস্তা করা। এর পেছনে কারণ যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, যে প্রতিশ্র“তি দিয়ে মোদি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই প্রতিশ্র“তি ফিকে হয়ে আসছে। হিন্দুত্ববাদ, মাস্তানি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ভারতের রাষ্ট্রীয় চরিত্রকে কলংকিত করছে বারবার। ভারতকে একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ পরিণত করার সংঘ পরিবারের দাবি আবারও উঠছে। গণতান্ত্রিক ভারতের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। Daily Jugantor 06.03.16

0 comments:

Post a Comment