ভারতের কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর ঢাকা সফরের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। যদিও এটা কোন রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। সোনিয়া গান্ধী ভারতে ইউপিএ সরকারের মূল ব্যক্তি হলেও, তিনি সরকারে নেই। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না পর্দার অন্তরালে তিনিই সরকার চালান। সাধারণত তিনি খুব একটা বিদেশ সফর করেন না। নীতি নির্ধারণী ভাষণও দেন না। এ কারণেই বাংলাদেশে অটিজম সম্মেলনে যোগদান, এই সম্মেলনের গুরুত্বই শুধু বাড়িয়ে দেয়নি, বাংলাদেশ তাঁকে যে সম্মান দিয়েছে, তাও উল্লেখ করার মত। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীনতার সম্মাননা দিয়েছে। সোনিয়া গান্ধী তা গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সম্মাননাও সোনিয়া গান্ধীর সফর দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। ইন্দিরা গান্ধী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। একাত্তুরের সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে ইন্দিরা গান্ধী নিজে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেছিলেন। দেরীতে হলেও, এ জাতি তার অবদানকে স্মরণ করলো। এখন দেখতে হবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে, তার সমাধানের ব্যাপারে ভারত কী উদ্যোগ নেয়।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে একাধিক ভারতীয় ভিআইপি বাংলাদেশ সফর করেছেন। ৮ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণর ঢাকা সফরের পর এলেন সোনিয়া গান্ধী। ২৯ জুলাই আসছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরাম। আগস্ট মাসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসছেন। আর ৬ সেপ্টেম্বর আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড: মনমোহন সিং। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর (জানুয়ারি ২০১০) ভারতের ভিআইপিদের একের পর এক বাংলাদেশ সফর দু’ দেশের সম্পর্ককে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিরাজমান সমস্যার সমাধানে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বরং সমস্যা যা ছিল, তাই রয়ে গেছে। গত ১৬ মে ছিল ফারাক্কা দিবস। পানির ন্যায্য হিস্যা ও ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ফারাক্কা মিছিল করেছিলেন প্রয়াত মাওলানা ভাসানী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মত (১৯৯৬) ক্ষমতায় এসেই নয়াদিল্লী ছুটে গিয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন (ডিসেম্বর ১৯৯৬)। কিন্তু যতটুকু পানি আমাদের পাবার কথা, পানি চুক্তি স্বাক্ষরের পর কোনদিনই আমরা সেই পরিমাণ পানি পাইনি। অথচ সেই চুক্তি নিয়ে অনেক ‘পজিটিভ’ কথা বলা হচ্ছে। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও কোন খবর নেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে যখন আমরা সোচ্চার, তখন আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা গেল বছর টিপাইমুখ গিয়েছিলেন। হেলিকপ্টারে ঘুরলেন। জানালেন তারা কিছুই দেখতে পাননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার কথা যখন পত্রিকাগুলো প্রকাশ করছে, তখন মিজোরামের মানুষ ওই বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করেছিল। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে বারে বারে আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। ভারতের উচ্চমহল থেকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিলাম। কিন্তু আমরা বা নেপাল ও ভুটান এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারত থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আমরা ভারতীয় হেভী ট্রাক চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করছি। ওই রাস্তা দিয়ে ভারতীয় হেভী ট্রাক যাবে কোন ধরনের শুল্ক না দিয়েই। আর আমরা বছরের পর বছর গুনতে থাকবো সুদ। বলা হয়েছিল বিদ্যুত্ আসবে ভারত থেকে। কৈ সেই বিদ্যুত্? ভারতের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কোন উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা ভারতে থাকলেও, তা নানা ট্যারিফ ও প্যারা ট্যারিফের কারণে ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। জানা গেছে, আগামী ৩ বছরের জন্য ভারত শুল্কমুক্ত আরো ১০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২২৪টি পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করার অনুমতি চেয়েছে। অথচ ভারতে বাংলাদেশী ৬১টি পণ্য শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশের অনুমতির কথা রয়েছে যা দীর্ঘসূত্রতার জন্য আটকে আছে। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত সিমেন্টের ওপর অতিরিক্ত ১৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। জানা গেছে, দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী ভারতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নানা ধরনের সুবিধা পাবার কথা (দিনকাল, ১৭মে)। বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বল্পোন্নত। এ জন্য বাংলাদেশের বিশেষ সুবিধা পাবার কথা। কিন্তু ভারত সেই সুবিধা বাংলাদেশকে কখনই দেয়নি। এ ক্ষেত্রে মমতা বা প্রণব মুখার্জির মত নেতারা কোনদিন বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। কেননা তারা বাঙালি হয়েও স্বার্থ দেখেছে ভারতের। অথচ আমাদের নেতৃবৃন্দ বার বার ভারতীয় বাঙালি নেতৃবৃন্দের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। বলতে দ্বিধা নেই শুধু ভারতের কারণেই সার্ক ঠিকমত বিকশিত হতে পারছে না। এর মূল কারণ মূলত ভারতীয় দ্বি-পাক্ষিক নীতি। নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ড প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছেন যে তার অপসারণের পেছনে ভারতের হাত ছিল। যারা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির কিছুটা খোঁজ খবর রাখেন, তারা জানেন ভারত নেপালের রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব খাটায়। ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থা নেপালে অত্যন্ত সক্রিয়। শ্রীলংকার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা প্রভাকরণকে তারাই সৃষ্টি করেছিল। আসলে ভারত তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই তার পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ তথা দক্ষিণ এশিয়াকে দেখতে চায়। অর্থনীতিতে অনেক বড় শক্তি ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য দূরীকরণে তথা উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এই প্রভাব বিস্তারের রাজনীতির কারণেই ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বন্ধুশূন্য’ হতে যাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জী, প্রণব মুর্খাজী-এরা সবাই মূলত এই প্রভাব বিস্তারের রাজনীতিকেই সমর্থন করছেন। সুতরাং আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিজয়ী মমতাকে ফোন করে যত আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা বলেন না কেন, এই আঞ্চলিক সহযোগিতা কোনদিনই প্রতিষ্ঠিত হবে না, যতদিন না ভারত তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সাহায্য করেছিল। কিন্তু সেই সাহায্য ও সহযোগিতা ম্লান হয়ে গেছে ভারতের প্রভাব বিস্তারের মনোভাবের কারণে। ফেলানি যেন এক টুকরা বাংলাদেশ। যখন লাশ হয়ে ঝুলে থাকে ফেলানিরা, তখন ভারতের ‘বন্ধুত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে এ দেশের জনগণের। বাংলাদেশকে তারা কীভাবে দেখে, ফেলানির ঝুলে থাকা লাশ এর বড় প্রমাণ। তাই মমতা ব্যানার্জী যখন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজয়ী হন,তখন আমাদের উত্সাহিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকলেও,এটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। মানুষ সেখানে পরিবর্তন চেয়েছে। আর সেই পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আদৌ কোন উন্নতি পরিলক্ষিত হবে না। যারা সম্পর্ক উন্নত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তাদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন তত্কালীন ভারতীয় সরকারের সাথে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষর করছিল, তখন মমতা এর প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিলেন। মমতা হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে মোস্ট আনপ্রেডেকটিবল পারসন, যার উপর আস্থা রাখা যায় না। যে কোন সময় তিনি ভোল পাল্টাতে পারেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে তার আঁঁতাত কতদিন স্থায়ী হয়, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন এখন। মমতা ব্যানার্জীর কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা করার কিছু নেই। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী তিনি মনমোহন সিং-এর সাথে ঢাকায় আসছেন। কেননা তিস্তার পানি বন্টনের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ একটি ফ্যাক্টর। তিস্তার পানি বন্টনের ব্যাপারে একটি সমঝোতা হয়েছে সচিব পর্যায়ের বৈঠকে। যদিও আমরা জানি না বাংলাদেশের স্বার্থ তাতে রক্ষিত হবে কী-না। মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরের সময় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে। আমরা চাই না গঙ্গার পানি চুক্তির মত তিস্তার পানি চুক্তিটিও বিতর্কিত হোক। সিটমহল ও সীমান্ত চিহ্নিতকরণও জরুরি। গত ৪০ বছরে সিটমহল ও সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়নি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধ করা প্রয়োজন। এটি এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে। দায়িত্বটা ভারতের। কেননা আজ অব্দি একজন ভারতীয়কেও হত্যা করেনি বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী। পৃথিবীর কোন সীমান্তেই এভাবে মানুষ মারা হয় না। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ নিয়েও কথা বলা উচিত। এখানে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নেই। সোনিয়া গান্ধীর সফরের সময় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নিয়ে দু’দেশ এক সাথে কাজ করতে পারে বলে তিনি অভিমত দিয়েছেন। শেখ হাসিনার নয়াদিল্লী সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সন্ত্রাস আজ গোটা দক্ষিণ এশিয়ারই সমস্যা। সন্ত্রাসের কারণে পাকিস্তান আজ ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। আর আফগানিস্তানে সন্ত্রাস তো নিত্যদিনের ঘটনা। সুতরাং সন্ত্রাস দমনে দ্বি-পাক্ষিক নয়,বরং প্রয়োজন বহু পাক্ষিক সহযোগিতা। বহু পাক্ষিক যোগাযোগের আলোকে আমরা যদি ভারতের সাথে ট্রানজিট চুক্তি করতে পারি, তাহলে বহু পাক্ষিকতার আলোকে পানি বন্টন ও এর ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ও ভুটান চুক্তি হতে পারে। চুক্তি হতে পারে বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষেত্রেও।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আসছেন। সমস্যাগুলো আমরা জানি। এগুলো নিয়ে সেমিনারে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। এখন চাই বাংলাদেশের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও ভারতের আন্তরিকতা। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। চারটি নব্য উন্নত দেশ (‘ব্রিক’) এর একটি ভারত। যুক্তরাষ্ট্র চায় ভারত আঞ্চলিক পরিসরে বড় ভূমিকা পালন করুক। ভারতকে এ ভূমিকা পালন করতে হলে তাকে আন্তরিক হতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সোনিয়া গান্ধীর সফরের মধ্য দিয়ে একটি ক্ষেত্র তৈরি হল। এখন দেখার পালা, সম্পর্ক আরো উন্নত করার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেই সম্ভাবনা বাস্তবে কতটুকু রূপ পায়।
দৈনিক ইত্তেফাক
শনি, ৩০ জুলাই ২০১১, ১৫ শ্রাবণ ১৪১৮অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
tsrahmanbd @ yahoo.com