প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের প্রতি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে সম্মান দেখিয়েছেন তা বিবেচনায় নিয়ে সরকার এখন অনেক ‘কাজ’ করতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের বিশতম রাষ্ট্রপতি কে হবেন, সে ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পৌঁছার উদ্দেশ্যে বিএনপির সঙ্গে একটি ‘সংলাপ’ শুরু করতে পারে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা উচিত নয়। বিএনপি যদি কোনো প্রার্থী দেয়ও, ওই প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্রপতি দলীয়ভাবে প্রার্থীও বিজয়ী হন বটে। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি আর দলীয় কার্যক্রমে থাকেন না। তিনি জাতির অভিভাবক। আস্থার প্রতীক, সেই সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীকও বটে। সুতরাং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সরকারের যেমনি উচিত বিএনপির মতামত নেয়া, ঠিক তেমনি বিএনপির উচিত সরকারি সমর্থনের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা প্রয়োজন। আর এ জন্য সরকারের উচিত সর্বগ্রহণযোগ্য, দলনিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেয়া।
আওয়ামী লীগ দলীয় কোনো প্রবীণ ব্যক্তিকে যদি রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেয়, তাতে বিতর্কের মাত্রা বাড়বে এবং জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টিতে তা কোনো অবদান রাখবে না। সামনের ‘কঠিন’ সময়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যাশা এটাই যে, সরকার এমন কাউকে মনোনয়ন দেবে, যিনি কি-না সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন। বিএনপি রাষ্ট্রপতির প্রয়াণে তিন দিনব্যাপী শোক প্রকাশ করেছে। বেগম জিয়া পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচিতে পরিবর্তন এনেছেন। বেগম জিয়া নিজে ছুটে গেছেন বঙ্গভবনে এবং শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেছেন। বিএনপি যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছে, তা ধরে রাখতে হবে। আগামী মে মাসে সংসদের ১৭তম অধিবেশন বসবে। ওই অধিবেশনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে শোক প্রস্তাব আনা হবে। বিএনপির উচিত হবে ওই শোক প্রস্তাবে অংশ নেয়া। এতে করে বিএনপির আন্তরিকতা আরো প্রমাণিত হবে। দ্বিতীয়ত, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এটা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে মতের অমিল আছে। সরকার একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’-এর ফর্মুলায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। কিন্তু বিরোধী দলের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফর্মুলায় বিএনপি রাজি হতে পারে, যদি প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন তাকে রেখেই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে, যেখানে প্রয়োজনে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে। আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে না। একজন নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন, তাহলে তার অধীনে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। এর বিকল্প হিসেবে সংসদের একজন সিনিয়র সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে তিন মাসের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়, যাদের দায়িত্ব হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা।
নির্বাচনে বিএনপি যাতে অংশ নেয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। তৃতীয়ত, গণজাগরণ মঞ্চ তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। যদিও শাহবাগ চত্বর তারা আর দখল করে রাখছে না। কিন্তু তারপরও তারা তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখলে ইসলামপ্রিয় হেফাজতে ইসলামও মাঠে তৎপর থাকবে। গণজাগরণ মঞ্চ ইতিহাসের এক যুগ সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন এদের পেছনে ছিল। কিন্তু আমার কাছে তরুণদের একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভাব গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। তাদের দায়িত্ব শেষ। এখন সরকারের হাতে বাকি কাজ সম্পাদনের দায়িত্বটি ছেড়ে দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি অব্যাহত থাকলে তাতে করে বিচার বিভাগের ওপর ‘প্রভাব বিস্তার করার’ অভিযোগে আরো শক্তিশালী হবে। তারা এখন ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে কাজ করুক। সমাজে নানা অসঙ্গতি, দুর্নীতি রয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চ এসব ব্যাপারে সোচ্চার হোক। চতুর্থত, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিটি একটি গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। কাজটি খুব সহজ নয়। এর সঙ্গে আইনগত প্রশ্ন জড়িত। জামায়াতের অতীত যাই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থা জামায়াতকে অনুমোদন দিয়েছে। বাস্তব সত্য যে, সংসদে ১৯৭৯ সালে, ১৯৮৬ সালে, ১৯৯১ সালে, ১৯৯৬ সালে এবং ২০০১ ও ২০০৮ সালে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল বা আছে। আইন করে যদি দলটি নিষিদ্ধ হয়, তাহলে অন্য নামে তারা আবির্ভূত হবে (তুরস্কের দৃষ্টান্ত আমাদের সম্মুখে আছে)। এ প্রশ্নে জনমত যাচাই করে দেখা যেতে পারে। পঞ্চমত, যেসব ব্লগে নবী করিমকে (সা.) নিয়ে বিদ্রƒপ করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু কমিটির কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে ইসলামিক দলগুলোর মাঝে সন্দেহ দানা বাঁধছে। সরকার যত দ্রুত এদেরকে অর্থাৎ বিদ্রƒপকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবে, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। মনে রাখতে হবে বেশকিছু ইসলামিক দল রয়েছে, তারা জামায়াতের রাজনীতির সমর্থক নয়; বরং বিরোধী। সরকার এসব ইসলামিক দলের সঙ্গে ‘সংযোগ’ বাড়াতে পারে। ষষ্ঠত, প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে (কালের কণ্ঠ, ২৩ মার্চ) জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য সংবিধানের ২ ক অনুচ্ছেদটি (রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম) বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। এ সমাজে অনেক মানুষ আছেন, যারা এ ধারণা পোষণ করেন। সরকার প্রয়োজন বোধ করলে এ ব্যাপারে একটি ‘জাতীয় সংলাপ’ আহ্বান করতে পারে।
মোট কথা, রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রয়াত জিল্লুর রহমান দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হলেও তিনি একটা সর্বজনগ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলেন। তার প্রতি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির আস্থা ছিল। অতীতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বড় ধরনের বিরোধ তৈরি হলে জাতির অভিভাবক হিসেবে তিনি সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি সব দলের সঙ্গে একটা গোলটেবিল বৈঠক করে একটি সমাধান দিয়েছিলেন। সাংবিধানিকভাবে তার এ ধরনের ক্ষমতা সংবিধানে লিপিবদ্ধ না থাকলেও তিনি জাতির বিবেক হিসেবে এ কাজটি করেছিলেন। বিএনপি রাষ্ট্রপতির সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। আজ আমরা প্রয়াত রাষ্ট্রপতির সেই স্পিরিটকে ধারণ করতে পারি। দেশজুড়ে যে সংঘাত, সংকট, রাজনীতি-অর্থনীতি-সামাজিক অশান্ত ও অনিশ্চিত যে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, তার দ্রুত সমাধান বাঞ্ছনীয়। দুই নেত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে গোটা জাতি। যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের কিছুটা সহিষ্ণু হওয়া প্রয়োজন। বিরোধী দলকে ‘শত্র“’ ভাবলে তা সংকট সমাধানে কোনো পথ তৈরি করে দেবে না। তাই দুটি বড় দলকেই আজ এগিয়ে আসতে হবে। কোনো কোনো মহল থেকে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে একটি সংলাপ শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি ভালো নয়। কেন তৃতীয় পক্ষ জড়িত হবে? সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে দেখা যায় ২০০৭ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে (সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে) নিজেদের মধ্যে সমস্যার সমাধানে যখন তারা ব্যর্থ হয়েছিল, তখন জাতিসংঘ একজন মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করে দিয়েছিল। তাতে একটা সমাধান পাওয়া গিয়েছিল। কোনো কোনো মহল কি সেদিকেই দৃষ্টি দিয়েছে (দেখুন, এবিএম মূসার সাক্ষাৎকার, ঐ)? এই ‘উদ্যোগ’কে আমরা সমর্থন করতে পারি না। এই উদ্যোগ বহির্বিশ্বে আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করবে। আমরা ‘কলহপ্রিয়’ এক জাতি হিসেবে পরিচিতি পাব। আমাদের এতদিনের যা ‘অর্জন’ তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তাই রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যু ও বিএনপির ‘এপ্রোচ’ একটি ক্ষেত্র তৈরি করল। উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। আর গোটা জাতি এটাই প্রত্যাশা করে যে, সংকট উত্তরণের পথ একটাই সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটা ‘সংলাপ’।
Daily MANOBKONTHO
01.04.13