রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

সরকার এখন যে কাজগুলো করতে পারে


প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের প্রতি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে সম্মান দেখিয়েছেন তা বিবেচনায় নিয়ে সরকার এখন অনেক ‘কাজ’ করতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশের বিশতম রাষ্ট্রপতি কে হবেন, সে ব্যাপারে একটি ঐকমত্যে পৌঁছার উদ্দেশ্যে বিএনপির সঙ্গে একটি ‘সংলাপ’ শুরু করতে পারে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা উচিত নয়। বিএনপি যদি কোনো প্রার্থী দেয়ও, ওই প্রার্থীর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্রপতি দলীয়ভাবে প্রার্থীও বিজয়ী হন বটে। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি আর দলীয় কার্যক্রমে থাকেন না। তিনি জাতির অভিভাবক। আস্থার প্রতীক, সেই সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীকও বটে। সুতরাং রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সরকারের যেমনি উচিত বিএনপির মতামত নেয়া, ঠিক তেমনি বিএনপির উচিত সরকারি সমর্থনের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা প্রয়োজন। আর এ জন্য সরকারের উচিত সর্বগ্রহণযোগ্য, দলনিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেয়া।
আওয়ামী লীগ দলীয় কোনো প্রবীণ ব্যক্তিকে যদি রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেয়, তাতে বিতর্কের মাত্রা বাড়বে এবং জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টিতে তা কোনো অবদান রাখবে না। সামনের ‘কঠিন’ সময়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যাশা এটাই যে, সরকার এমন কাউকে মনোনয়ন দেবে, যিনি কি-না সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন। বিএনপি রাষ্ট্রপতির প্রয়াণে তিন দিনব্যাপী শোক প্রকাশ করেছে। বেগম জিয়া পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচিতে পরিবর্তন এনেছেন। বেগম জিয়া নিজে ছুটে গেছেন বঙ্গভবনে এবং শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেছেন। বিএনপি যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছে, তা ধরে রাখতে হবে। আগামী মে মাসে সংসদের ১৭তম অধিবেশন বসবে। ওই অধিবেশনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে শোক প্রস্তাব আনা হবে। বিএনপির উচিত হবে ওই শোক প্রস্তাবে অংশ নেয়া। এতে করে বিএনপির আন্তরিকতা আরো প্রমাণিত হবে। দ্বিতীয়ত, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এটা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে মতের অমিল আছে। সরকার একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’-এর ফর্মুলায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। কিন্তু বিরোধী দলের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফর্মুলায় বিএনপি রাজি হতে পারে, যদি প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন তাকে রেখেই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে, যেখানে প্রয়োজনে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে। আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে না। একজন নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন, তাহলে তার অধীনে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। এর বিকল্প হিসেবে সংসদের একজন সিনিয়র সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে তিন মাসের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যায়, যাদের দায়িত্ব হবে শুধু নির্বাচন পরিচালনা করা।
নির্বাচনে বিএনপি যাতে অংশ নেয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। তৃতীয়ত, গণজাগরণ মঞ্চ তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। যদিও শাহবাগ চত্বর তারা আর দখল করে রাখছে না। কিন্তু তারপরও তারা তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখলে ইসলামপ্রিয় হেফাজতে ইসলামও মাঠে তৎপর থাকবে। গণজাগরণ মঞ্চ ইতিহাসের এক যুগ সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন এদের পেছনে ছিল। কিন্তু আমার কাছে তরুণদের একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভাব গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। তাদের দায়িত্ব শেষ। এখন সরকারের হাতে বাকি কাজ সম্পাদনের দায়িত্বটি ছেড়ে দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি অব্যাহত থাকলে তাতে করে বিচার বিভাগের ওপর ‘প্রভাব বিস্তার করার’ অভিযোগে আরো শক্তিশালী হবে। তারা এখন ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে কাজ করুক। সমাজে নানা অসঙ্গতি, দুর্নীতি রয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চ এসব ব্যাপারে সোচ্চার হোক। চতুর্থত, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবিটি একটি গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। কাজটি খুব সহজ নয়। এর সঙ্গে আইনগত প্রশ্ন জড়িত। জামায়াতের অতীত যাই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থা জামায়াতকে অনুমোদন দিয়েছে। বাস্তব সত্য যে, সংসদে ১৯৭৯ সালে, ১৯৮৬ সালে, ১৯৯১ সালে, ১৯৯৬ সালে এবং ২০০১ ও ২০০৮ সালে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল বা আছে। আইন করে যদি দলটি নিষিদ্ধ হয়, তাহলে অন্য নামে তারা আবির্ভূত হবে (তুরস্কের দৃষ্টান্ত আমাদের সম্মুখে আছে)। এ প্রশ্নে জনমত যাচাই করে দেখা যেতে পারে। পঞ্চমত, যেসব ব্লগে নবী করিমকে (সা.) নিয়ে বিদ্রƒপ করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু কমিটির কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে ইসলামিক দলগুলোর মাঝে সন্দেহ দানা বাঁধছে। সরকার যত দ্রুত এদেরকে অর্থাৎ বিদ্রƒপকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসবে, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। মনে রাখতে হবে বেশকিছু ইসলামিক দল রয়েছে, তারা জামায়াতের রাজনীতির সমর্থক নয়; বরং বিরোধী। সরকার এসব ইসলামিক দলের সঙ্গে ‘সংযোগ’ বাড়াতে পারে। ষষ্ঠত, প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে (কালের কণ্ঠ, ২৩ মার্চ) জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য সংবিধানের ২ ক অনুচ্ছেদটি (রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম) বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। এ সমাজে অনেক মানুষ আছেন, যারা এ ধারণা পোষণ করেন। সরকার প্রয়োজন বোধ করলে এ ব্যাপারে একটি ‘জাতীয় সংলাপ’ আহ্বান করতে পারে।
মোট কথা, রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রয়াত জিল্লুর রহমান দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হলেও তিনি একটা সর্বজনগ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলেন। তার প্রতি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির আস্থা ছিল। অতীতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে বড় ধরনের বিরোধ তৈরি হলে জাতির অভিভাবক হিসেবে তিনি সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি সব দলের সঙ্গে একটা গোলটেবিল বৈঠক করে একটি সমাধান দিয়েছিলেন। সাংবিধানিকভাবে তার এ ধরনের ক্ষমতা সংবিধানে লিপিবদ্ধ না থাকলেও তিনি জাতির বিবেক হিসেবে এ কাজটি করেছিলেন। বিএনপি রাষ্ট্রপতির সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। আজ আমরা প্রয়াত রাষ্ট্রপতির সেই স্পিরিটকে ধারণ করতে পারি। দেশজুড়ে যে সংঘাত, সংকট, রাজনীতি-অর্থনীতি-সামাজিক অশান্ত ও অনিশ্চিত যে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, তার দ্রুত সমাধান বাঞ্ছনীয়। দুই নেত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে গোটা জাতি। যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের কিছুটা সহিষ্ণু হওয়া প্রয়োজন। বিরোধী দলকে ‘শত্র“’ ভাবলে তা সংকট সমাধানে কোনো পথ তৈরি করে দেবে না। তাই দুটি বড় দলকেই আজ এগিয়ে আসতে হবে। কোনো কোনো মহল থেকে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে একটি সংলাপ শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি ভালো নয়। কেন তৃতীয় পক্ষ জড়িত হবে? সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে দেখা যায় ২০০৭ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের রাজনৈতিক সংকট সমাধানে (সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে) নিজেদের মধ্যে সমস্যার সমাধানে যখন তারা ব্যর্থ হয়েছিল, তখন জাতিসংঘ একজন মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করে দিয়েছিল। তাতে একটা সমাধান পাওয়া গিয়েছিল। কোনো কোনো মহল কি সেদিকেই দৃষ্টি দিয়েছে (দেখুন, এবিএম মূসার সাক্ষাৎকার, ঐ)? এই ‘উদ্যোগ’কে আমরা সমর্থন করতে পারি না। এই উদ্যোগ বহির্বিশ্বে আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করবে। আমরা ‘কলহপ্রিয়’ এক জাতি হিসেবে পরিচিতি পাব। আমাদের এতদিনের যা ‘অর্জন’ তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। তাই রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যু ও বিএনপির ‘এপ্রোচ’ একটি ক্ষেত্র তৈরি করল। উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। আর গোটা জাতি এটাই প্রত্যাশা করে যে, সংকট উত্তরণের পথ একটাই সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটা ‘সংলাপ’।
Daily MANOBKONTHO
01.04.13

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কোন্নয়নে উপকৃত হতে পারি







চীনে শি জিন পিংয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ এবং প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে রাশিয়াকে বেছে নেয়া, সেই সঙ্গে আফ্রিকার তিনটি দেশ সফরের মধ্য দিয়ে একটি প্রশ্নই এখন সামনে চলে এসেছে; আর তা হচ্ছে— কোন পথে এখন চীন? বৈদেশিক সম্পর্কের প্রশ্নে চীন এখন কোন বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে? শি জিন পিংয়ের ক্ষমতা গ্রহণ আমাদের জন্য কি কোনো বার্তা নিয়ে এসেছে? শি জিন পিংয়ের রাশিয়া ও আফ্রিকা সফরের উদ্দেশ্য রয়েছে একাধিক। প্রথমত. রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানো এবং একটা স্ট্রাটেজিক বা  কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলা। যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন, ওবামা প্রশাসন সাম্প্রতিক সময়ে চীনবিরোধী বেশকিছু কর্মসূচি নিয়েছে। এমনকি চীনকে ‘ঘিরে ফেলার’ একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তার সামরিক তত্পরতা সম্প্রসারিত করেছে ভারত মহাসাগরেও। ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ নৌবহর যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হবে। পূর্ব চীন সাগরভুক্ত বেশ কয়টি বিতর্কিত দ্বীপ রয়েছে, যেগুলোর মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে জাপান ও ফিলিপাইনের দ্বন্দ্ব চলছে। এখন এ অঞ্চলে মার্কিন নৌ-সেনা মোতায়েনের অর্থ হচ্ছে— চীনের ওপর পরোক্ষভাবে ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। একই সঙ্গে ভারত মহাসাগরে চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। চীন এ অঞ্চল ঘিরে যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করেছে (বন্দর স্থাপনা, রিফুয়েলিং স্টেশন প্রভৃতি), এটাও ভালো চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে চীনের স্বার্থ খর্ব করতে চায় তারা। স্ট্রাটেজিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগর (ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে রয়েছে বিশ্বের তেলের রিজার্ভের ৬০ শতাংশ আর গ্যাস রিজার্ভের তিন ভাগের এক ভাগ) আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বে চীনের প্রয়োজন রয়েছে রাশিয়ার সমর্থনের। ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ অনুযায়ী এ অঞ্চলে মস্কো, তেহরান, বেইজিং ও কলম্বোর মধ্যে যে ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছে, তাকে দৃঢ় করতেই শি জিন পিংয়ের মস্কো যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি মস্কো গেছেন। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শি জিন পিং যে বক্তব্য রাখেন, তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেখানে এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। চীনা রাষ্ট্রপ্রধান ২৬ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছেন। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকাও ব্রিকসের অন্যতম শক্তি। ব্রিকস বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক জোট। ২০৫০ সাল নাগাদ ব্রিকস দেশগুলোর মোট জিডিপির পরিমাণ দাঁড়াবে ১২৮ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থাকবে ৩৮ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে)। একই সময় ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য সম্পর্ক ৩৪০ বিলিয়ন ডলার (২০১২) থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়নে। প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে মস্কো গিয়ে শি জিন পিং রাশিয়ার সঙ্গে পুরনো সম্পর্ককে ঝালাই করে নিলেন। একই সঙ্গে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি প্রমাণ করলেন, চীন নতুন অর্থনৈতিক জোটকেও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনের জন্য এ সফর গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, দেশটির নয়া নেতৃত্ব ন্যূনতম ১০ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল পর্যন্ত চীনকে বিশ্ব আসরে নেতৃত্ব দেবে।
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০১০ সালে জিএনপির দিক থেকে জাপানকে ছাড়িয়ে যায় চীন। যেখানে ১৯৮০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ (যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ), সেখানে বলা হচ্ছে ২০১৬ সালে পিপিপির (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) হিসাব অনুযায়ী চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। উত্পাদনশীল পণ্য, বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস পণ্যের দিক থেকে চীন এখন এক মহাশক্তি। বিশ্বের যত ফটোকপিয়ার, মাইক্রোওয়েভ ও জুতা উত্পাদন হয়; তার তিন ভাগের দুই ভাগ চীন একা উত্পাদন করে। সেই সঙ্গে বিশ্বে উত্পাদিত সেলফোনের ৬০ শতাংশ, ডিভিডির ৫৫, ডিজিটাল ক্যামেরার ৫০, পার্সোনাল কম্পিউটারের ৩০, শিশুদের খেলনার ৭৫ শতাংশ চীন একা উত্পাদন করে। ফলে বিশ্বব্যাপী তাদের পণ্যের একটা বাজার তৈরি হয়েছে। চীনে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ওপর। ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের বড় ৫০০ কোম্পানির কথা উল্লেখ করেছে, সেখানে চীনের রয়েছে ৩৭টি কোম্পানি। বিশ্বে যত জ্বালানি ব্যবহূত হয়, তার মধ্যে এককভাবে চীনে ব্যবহার হয় ১৬ শতাংশ। আর বিশ্বে জ্বালানি তেলের ব্যবহারের দিক থেকে ৩ ভাগের ১ ভাগ ব্যবহার করে চীন। যে কারণে দেশটিকে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশ দূষণকারী রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরিবেশ দূষণের কারণে চীনে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেড়েছে ২৯ শতাংশ। তাদের রয়েছে বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম, যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রতি বছর ২১ মিলিয়ন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হয়। আর প্রতি বছর ৩ লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যায়। তারা ফিরেও আসে। ১৯৪৮ সালে (স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে) যেখানে চীনে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ২০ শতাংশ, এখন সেখানে ১০০ শতাংশ শিক্ষিত। সংস্কারের কারণে চীনে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, তাতে প্রায় ২০ কোটি মানুষকে চীন অতি দরিদ্রতম অবস্থা (প্রতিদিন জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ ডলার আয় হিসাবে) থেকে বের করে এনে কিছুটা সচ্ছলতা দিয়েছে। যদিও বলা হয়, এখানেও প্রায় ২০৭ মিলিয়ন লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একদিকে যেমন দেশটিতে ধনী ও গরিবের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখন কর্মজীবী মানুষের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। মানুষের আয় সেখানে বেশি। হাজার হাজার টাউনশিপ এখন তৈরি হয়েছে, যা বদলে দিয়েছে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনযাত্রা। চীনকে নিয়ে খারাপ খবরও আছে। যেখানে ২০০৯ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ, ২০১২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ কম। আর শহরে বেকারসংখ্যা ৪-৬ শতাংশের নিচে। এই যে চীন, এ চীনের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্বটি এখন বর্তিয়েছে শি জিন পিংয়ের ওপর। কোন পথে এখন চীন? শি জিন পিংয়ের এজেন্ডায় রাশিয়া ও ব্রিকস প্রাধান্য পেলেও এটা সত্য, অভ্যন্তরীণ ইস্যুকে গুরুত্ব দিতে হবে তাকে। বেশ কয়েকজন বিশ্লেষকের লেখা পড়ে যা মনে হয়েছে, তা হচ্ছে শি জিন এখন প্রথমেই অগ্রাধিকার দেবেন অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে। এক বিশাল দেশ চীন। প্রায় ৫৫ জাতি ও উপজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে চীন। ২২ প্রদেশ, পাঁচ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, চার বিশেষ অঞ্চল ও ১৪৭ বিশেষ এলাকা নিয়ে যে চীনা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সেটি ভেঙেও যেতে পারে। এ কারণেই চীনা নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সতর্ক থাকছেন। যে ভুল করেছিলেন গরবাচেভ, সে ভুল করেননি চীনা নেতারা। সেনাবাহিনী এখনো পার্টির প্রতি অনুগত। তাই অর্থনৈতিক সংস্কারকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। ফুজিয়ান, ঝে ঝিয়াং কিংবা সাংহাই প্রদেশগুলো তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী। প্রদেশে প্রদেশে যে বৈষম্য, গ্রাম আর শহরের মধ্যে যে পার্থক্য, তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে শি জিন পিং প্রশাসনকে। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রচুর বয়স্ক লোকের পেনশন ভাতা নিশ্চিত করা, পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা, অসমতা ও দারিদ্র্য দূর করা। এগুলো হবে নয়া প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজ। দুর্নীতির বিষয়টিও তার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে। পার্টির সিনিয়র নেতাদের ব্যাপক দুর্নীতি এখন চীন ও পশ্চিমা বিশ্বে আলোচনার অন্যতম বিষয়। অভিযোগ আছে, সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক হয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তা ব্যাপক আলোচিত হয়। অভিযোগে বলা হয়েছিল, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর মায়ের নামে একটি কোম্পানির ১২০ মিলিয়ন ডলারের শেয়ার আছে। প্রেসিডেন্ট নিজেও অভিযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমবার্গ গ্রুপের মতে, শি পরিবার ৩৭৬ মিলিয়ন ডলারের মালিক। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগ নয়া প্রেসিডেন্টের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
একুশ শতকে আমরা চীনকে দেখব অন্যতম শক্তি হিসেবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান বিশ্বের সব অর্থনীতির হিসাবনিকাশ বদলে দিয়েছে। ব্রিকসে চীন ও ভারত অন্তর্ভুক্ত হলেও এশিয়ার এ দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। ভারতে জনগোষ্ঠীর ৩৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করলেও ৩০ বছরের মধ্যে দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। তখন সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয় ৯৪০ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে।
২০০৭ সালে যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখত মাত্র ২ শতাংশ, তখন অবদান রাখবে ১৭ শতাংশ। সুতরাং ভারতকে ফেলে দেয়া যাবে না। তাই কোনো কোনো বিশ্লেষক (জনাথন হোলসলাগ, ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন) একটি সম্ভাব্য ‘পযরহফরধ’ ধারণার কথা বলেছেন, যেখানে চীন ও ভারত একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এ ধারণা অমূলক নয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় চীন-ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেড়েছে। চীনা নেতারা ভারত সফর করেছেন। সীমান্ত সমস্যা নিয়েও (অরুণাচল) এক ধরনের ‘স্থিতিবস্থা’ বিরাজ করছে। ক্ষমতা গ্রহণ করে শি জিন পিং ভারতবিরোধী তেমন কোনো কথা বলেননি।
চীনের নতুন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশী নেতাদের সম্পর্কে ধারণা রাখেন। ২০১২ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বেগম জিয়ার সঙ্গে তিনি গেল বছর বেইজিংয়ে সাক্ষাৎ করেছিলেন। চীন আমাদের প্রতিবেশী বলা যায়। আমাদের উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। অবকাঠামো উন্নয়নে দেশটি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সহায়তাকারীও। সম্প্রতি পদ্মা সেতু নির্মাণে চীন তাদের আগ্রহের কথা আমাদের জানিয়েছে। দেশটিতে শি জিন পিংয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে চীনকে গুরুত্ব দিলে আমরাই উপকৃত হব। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি এদিকে দৃষ্টি দেন, তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলই বয়ে আনবে।
BONIK BARTA
28.3.13

যে কারণে দলনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন



রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতে যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, কে হতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি? সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বিজয়ী দলই রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করে থাকে এবং তাদের মনোনীত প্রার্থীই সংসদ সদস্যদের ভোটে বিজয়ী হয়ে থাকেন। এটা গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যের একটা অংশ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ‘ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে বিরোধী দল কোন প্রার্থী দেয় না। ২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারিতে সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচনের জন্য মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান যখন প্রার্থী হন, তখন বিরোধী দল কোন প্রার্থী দেয়নি। দেশের এক চরম সংকটের সময় তিনি চলে গেলেন এবং রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে এবং আগামী ১৮ জুনের মধ্যে আমরা একজন নয়া রাষ্ট্রপতি পাব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আগ্রহ এ কারণেই। মহাজোট সরকার তাদের একজন প্রার্থী মনোনয়ন দেবে, যিনি চূড়ান্ত বিচারে বিজয়ী হবেন। কারণ সংসদে মহাজোট সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তারা যাকে মনোনয়ন দেবেন, তিনিই রাষ্ট্রপতি হবেন। বিরোধী দলের প্রার্থী থাকা, না থাকা সমান কথা। বিরোধী দল আদৌ কোন প্রার্থী দেবে বলেও মনে হয় না। সুতরাং সরকারের সিদ্ধান্ত অনেক গুরুত্ব বহন করে। সময়টা যদি সরকারের প্রথম দিক হতো, তাতে কেউ কোন প্রশ্ন করত না। কিন্তু এখন সরকারের শেষ সময়। সংবিধান অনুযায়ী আগামী জানুয়ারিতে (২০১৪) সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ সবকিছু ঠিক থাকলে অক্টোবর-নভেম্বরেই (২০১৩) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অথচ ওই নির্বাচনের আগেই সরকারকে একজন নয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একজন দলনিরপেক্ষ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রপতি না হন, তাহলে নতুন নতুন জটিলতা তৈরি হবে। এ মুহূর্তে জাতির এমন একজন অভিভাবক দরকার, যিনি বিবদমান সব রাজনৈতিক দলকে এক পতাকাতলে সমবেত করতে পারবেন। জাতি এখন বিভক্ত। বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। গণজাগরণ মঞ্চ প্রথম দিকে সব মহলের সমর্থন পেলেও ধীরে ধীরে তাদের সেই সমর্থন ফিকে হয়ে আসছে। দেখা গেছে, মূলত বামমনা ১৪ দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা এবং ছাত্রলীগের প্রচ্ছন্ন মদদে এ গণজাগরণ মঞ্চের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। ইসলামপন্থী দলগুলো (জামায়াত বাদে) মাঠে সক্রিয় রয়েছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও এ প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। জাতির মাঝে বিভাজন স্পষ্ট। রাজনৈতিক সহিংসতায় ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১৫০ জন সাধারণ মানুষ। এ মুহূর্তে তাই প্রয়োজন এমন একজন নেতার, যিনি তার নেতৃত্বের গুণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন এবং দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা উপহার দেবেন।
দ্বিতীয়ত, বড় প্রশ্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। ওই নির্বাচনে বিএনপি তথা ১৮ দল অংশ নেবে, যদি একটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারে’র অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সরকারের অবস্থান হচ্ছে সংবিধানকে অনুসরণ করে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে’র অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা। বর্তমান মহাজোট সরকারের শেষ তিন মাস হচ্ছে এই ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী থাকবেন! সম্ভবত একটি ক্ষুদ্র মন্ত্রিসভাও থাকবে এবং নির্বাচিত (নবম সংসদে) এমপিরাও থাকবেন। এদের প্রশাসনে রেখেই এই নির্বাচন! এই নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল অংশ নেবে না। আর বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতাও থাকবে না। এমনই এক পরিস্থিতিতে দরকার এমন একজন রাষ্ট্রপতির, যিনি বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে তার ‘ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা’ ব্যবহার করবেন।
তৃতীয়ত, বিএনপির জনসভায় প্রকাশ্যে গুলি করা, নেতৃবৃন্দকে আহত করা এবং বিএনপির অফিস ভেঙে নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতার করার ঘটনা আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটি খারাপ সংবাদ। এতে করে একটি বড় ধরনের আস্থাহীনতার জš§ হয়েছে। এ ঘটনায় দুটি বড় দলের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ‘ক্ষত’ সৃষ্টি হয়েছে, তা সারিয়ে তোলার দায়িত্ব একজন রাষ্ট্রপতি নেবেন। কিন্তু কে হবেন সেই রাষ্ট্রপতি? দলীয় ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রপতি হন, তা সাংবিধানিকভাবে শুদ্ধ, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা কাম্য নয়। একজন দলীয় রাষ্ট্রপতি বিভক্ত জাতির মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না।
চতুর্থত, দলীয়ভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে তা বিরোধী দল তথা জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। উপরন্তু সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত এই রাষ্ট্রপতি আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। সেক্ষেত্রে একটা বড় সংকট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। যদি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোট বিজয়ী হয় তাহলে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির দ্বন্দ্ব অনিবার্য। যদিও সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ভূমিকা সীমিত। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া ছাড়া সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে বাধ্য। তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা তার ক্ষমতাকে সীমিত করে দিলেও প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেন। এ ইতিহাস বাংলাদেশে আছে। এ বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রী যে জানেন না, বোঝেন না, তা নয়। খুব কম লোকই আছেন, যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার চেয়ে ভালো জানেন।
নিঃসন্দেহে প্রয়াত জিল্লুর রহমান ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন। তিনি দলীয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বটে, কিন্তু চেষ্টা করেছেন সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে। সব সময় থাকতে পেরেছেন, এটা আমি বলব না (যেমন, দলীয় বিবেচনায় খুনের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মাফ করে দেয়া!)। তবে তার মাঝে এক ধরনের সরলতা কাজ করত। এক-এগারোর সময় তার দলীয় আনুগত্য, সভানেত্রীর প্রতি তার নির্মোহ সমর্থন, কট্টর কোন বক্তব্য না দেয়া, উগ্রতা পরিহার করা ইত্যাদি তাকে সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর আস্থা তো তিনি পেয়েছিলেনই, বিরোধী দলও তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করত। যখন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে একটি জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তখন রাষ্ট্রপতি উদ্যোগী হয়েছিলেন এর সমাধান করতে। একজন অভিভাবকের ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে তিনি সব দলের পরামর্শ নিয়েছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল সেদিন বঙ্গভবনে গিয়েছিল। বিএনপির এই ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল। আজও ঠিক এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ৯ জন যুদ্ধাপরাধীর (তিনজনের প্রাথমিক বিচার সম্পন্ন) বিচার দীর্ঘ ৪১ বছর পর শুরু হলেও এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে জাতি আজ একরকম বিভক্ত। গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা একদিকে অবস্থান নিয়েছেন, যারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন এখনও অব্যাহত রেখেছেন, অন্যদিকে ইসলামপন্থীরা হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে নাস্তিকদের বিচারের দাবিতে সব ইসলামপ্রিয় মানুষকে একত্রিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। পরস্পরবিরোধী এই অবস্থান মানুষের মাঝে শংকা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি করেছে। বিদেশী দাতাগোষ্ঠী ও দেশীয় সুশীলরা একটা ‘সংলাপে’র কথা বলেছেন বটে কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই উদ্যোগটি কে নেবে? রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বেঁচে থাকলে তিনি সেই উদ্যোগটি নিতে পারতেন এবং নিশ্চিত করে বলতে পারি, আরেকটি ‘গোলটেবিল’ বৈঠক আমরা দেখতে পেতাম বঙ্গভবনে। এখন সেটা স্বপ্নই থেকে গেল।
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়া প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে যে সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, তা প্রশংসাযোগ্য। বিএনপির এই এপ্রোচ সংলাপের একটি ক্ষেত্র তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। খালেদা জিয়া নিজে বঙ্গভবনে গেছেন। তার নিজের বগুড়া ও জয়পুরহাটের প্রোগ্রাম পিছিয়ে দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার বিএনপি ঢাকা জেলায় যে হরতাল ডেকেছিল, তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিএনপির এই এপ্রোচকে সরকার ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলে ভালো করবে। জাতি এটাই প্রত্যাশা করে। কিন্তু সরকার কিছুটা নমনীয় হবে, এই আস্থা রাখতে পারছি না। বিএনপির অফিস থেকে গ্রেফতারকৃত ১৫১ জন নেতাকর্মীকে নজিরবিহীনভাবে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। জামিন পাননি ফারুক, রিজভী কিংবা আমানের মতো নেতারা। শীর্ষস্থানীয় এই তিন নেতাকে রিমান্ডে নেয়া হয়নি সত্য, কিন্তু তাদের জেলে রেখে বিএনপি কোন সংলাপে যাবে, এটা আমার মনে হয় না। সরকার হার্ড লাইনে গেছে। পুলিশের কর্মকাণ্ডের দেশে ও বিদেশে প্রতিবাদ হচ্ছে। কোথাও কোথাও মানুষ পুলিশের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদী’ হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রবণতাকে ‘মৌলবাদীদের অপতৎপরতা’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও বিবিসির বাংলা বিভাগকে সাধারণ মানুষ বলেছেন, তারা কোন জঙ্গিবাদ তথা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। এমনই এক পরিস্থিতিতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মতো একজন অভিভাবকের প্রয়োজন ছিল, যিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে পারতেন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে মহাজোট সরকার, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ‘রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ’ থেকে দেখবে। আমি তাতে দোষের কিছু দেখি না। শেখ হাসিনা প্রথম যখন প্রধানমন্ত্রী হন (১৯৯৬-২০০১), তখন তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেদিন তার সেই সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ সব সময় প্রধানমন্ত্রীর কথামতো চলেননি। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে তাকে নানা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার পর প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেননি। এই ইতিহাস প্রধানমন্ত্রী জানেন ও উপলব্ধি করেন। সুতরাং সব ধরনের ‘বিতর্ক’ এড়াতে তিনি কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মনোনীত করবেন, এই আস্থাটা রাখতে পারছি না। দু’জন প্রবীণ রাজনীতিকের নাম উঠেছে। রাজনীতিতে তাদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি এবং যোগ্যতার মাপকাঠিতে কেউ কারও চেয়ে কম নন। কিন্তু সময়টা বড় খারাপ। পরিস্থিতি মহাজোট সরকারের অনুকূলে, তা বলা যাবে না। এমনকি মহাজোটের অন্যতম শরিক এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি যে কোন সময় মহাজোট ত্যাগ করতে পারে। এরশাদকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ‘চমক’ দিতে পারেন। কিন্তু তিনি এটা করবেন, তা বোধকরি জাতীয় পার্টির কোন সদস্যও বিশ্বাস করেন না। তাই ঘুরেফিরে ওই দুই ব্যক্তির দিকেই দৃষ্টি অনেকের। একটি ইংরেজি দৈনিক তো ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকেই চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে।
তারপরও আমরা আশা করব, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রশ্নে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটা ‘আলোচনা’ হোক। তাদের মতামত নেয়া হোক। কেননা রাষ্ট্রপতি কোন দলের নন। তিনি বাংলাদেশের এক নম্বর ব্যক্তি। তিনি জাতির ঐক্যের প্রতীক। তিনি হবেন সবার রাষ্ট্রপতি। শেখ হাসিনা অতীতে অনেক উদারতা দেখিয়েছেন। আজ তেমন একটি সময় এসেছে তার কাছে। তিনি ইতিহাসে আবারও নন্দিত হতে পারেন, যদি তিনি একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেন। তিনি দেশের এক ‘কঠিন সময়ে’ দল ও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়াতে পারবেন, যদি তিনি এ কাজটি করেন। তাই ৯০ দিনের এ সময়সীমাটা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সবার দৃষ্টি থাকবে এখন বঙ্গভবনের দিকে। শেষ পর্যন্ত একজন রাজনীতিকই এই আসনটি অলংকৃত করেন কিনা, সেটাই হবে আলোচনার মূল বিষয়।
Daily JUGANTOR
27,03.13

আস্থার জায়গাটা কি আবার ফিরে আসছে




রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূমিকা একটি প্রশ্নই সামনে নিয়ে এসেছে; আর তা হচ্ছে, আস্থার জায়গাটা কি আবার ফিরে আসছে? খালেদা জিয়া নিজে এবং দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে করে বঙ্গভবনে গেছেন, শোকবইতে স্বাক্ষর করেছেন। বিএনপি তিন দিনের শোক পালন করেছে। খালেদা জিয়ার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। একজন রাষ্ট্রপতি, যিনি মহাজোট সরকার কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁর প্রতি বিএনপির এই শ্রদ্ধাবোধ নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। দলীয় কার্যালয়ের সামনে গণজমায়েতে পুলিশের গুলিবর্ষণ, বিএনপির অফিসে পুলিশি হামলা এবং মহাসচিবের কক্ষ ভাঙচুর করা, সেই সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত। হরতালের পর হরতাল হয়েছে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ মার্চ শুধু ঢাকা জেলায় যে হরতাল ডেকেছিল বিএনপি, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতির প্রতি বিএনপির এই শ্রদ্ধাবোধকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি। সরকারের দায়িত্ব হবে এখন 'সব বাধা' অপসারণ করে বিএনপির সঙ্গে 'শান্তিপূর্ণ অবস্থানের' পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিএনপির যে ১৫১ জন নেতা-কর্মীকে নজিরবিহীনভাবে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তা এ দেশের সুধীসমাজ ভালোভাবে নেয়নি। সংসদ সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুকের জামিন না পাওয়া একটি দুঃখনজক ঘটনা। এখন আইনি প্রক্রিয়ায় যত দ্রুত তাঁদের মুক্ত করা যায়, ততই আমাদের সবার জন্য মঙ্গল। আমরা আশা করব, বরফ গলবে।
সামনের দিনগুলো যে ভালো, তা দিব্যি দিয়ে বলতে পারছি না। গণজাগরণ মঞ্চ ও হেফাজতে ইসলামের পাল্টাপাল্টি অবস্থান আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। এরই মধ্যে আবার গঠিত হয়েছে একটি নাগরিক সমাজ, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। তাদের এই দাবির প্রতি কারো কোনো দ্বিমত নেই। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি, তাতে সমর্থন আছে অনেকেরই। কিন্তু যে প্রশ্নটি অনেকেই করার চেষ্টা করেন তা হচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী ও অব্যাহতভাবে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি চলতে থাকে, তাতে নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে এবং একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে বলার যে বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব ফেলতেই এ আন্দোলন। আইন অনুযায়ী বিচারপ্রক্রিয়া চলছে। আইন তার নিজ গতিতে চলুক। আমরা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নই।
এই মুহূর্তে আমাদের সামনে অনেকগুলো রাজনৈতিক বিষয় রয়েছে। এসব বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। বিশেষ করে দুটি বিষয়ে এই ঐকমত্য খুবই জরুরি- এক. দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমরা কোন প্রক্রিয়ায় করব, দুই. বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি কে হবেন, সে ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছা। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আইন আছে, সংসদ আছে, সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব নীতিমালাও আছে। সুতরাং সরকার একটি সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে একটি গণভোটও দেওয়া যায়। কিন্তু বড় প্রশ্ন, নির্বাচন হবে কোন সরকারের অধীনে? সরকারের মেয়াদ শেষ হবে জানুয়ারিতে (২০১৪)। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে যেকোনো এক সময় এই নির্বাচন হতে হবে। এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ধারণা করছি, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর- এই সময়সীমার মধ্যেই নির্বাচন হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে 'অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী' হিসেবে রেখে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনে তো বিএনপি অংশ নেবে না! তাহলে সমাধান হবে কোন পথে? বিএনপির দাবি করা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হোক, একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার গঠিত হলে বিএনপি তাতে অংশ নেবে এবং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তাতে বাড়বে। এখন বিএনপির অবস্থান কিছুটা নমনীয় হওয়ায় বিএনপির সঙ্গে এ ব্যাপারে সংলাপ করা যায়। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রশ্নটিও আছে। এখানেও ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে মহাজোট সরকার, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ 'রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ' থেকে দেখবে। আমি তাতে দোষের কিছু দেখি না। শেখ হাসিনা প্রথম যখন প্রধানমন্ত্রী হন (১৯৯৬-২০০১), তখন তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সেদিন তাঁর সেই সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সব সময় প্রধানমন্ত্রীর কথামতো চলেননি। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে তাঁকে নানা গঞ্জনা সইতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার পর প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করতে এতটুকু দ্বিধা বোধ করেননি। এই ইতিহাস প্রধানমন্ত্রী জানেন ও উপলব্ধি করেন। সুতরাং সব ধরনের 'বিতর্ক' এড়াতে তিনি কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে পুনরায় মনোনীত করবেন- এই আস্থাটা রাখতে পারছি না। দুজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের নাম উঠেছে। রাজনীতিতে তাঁদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি এবং যোগ্যতার মাপকাঠিতে কেউ কারো চেয়ে কম নন। কিন্তু সময়টা বড় খারাপ। পরিস্থিতি মহাজোট সরকারের অনুকূলে তা বলা যাবে না। এমনকি মহাজোটের অন্যতম শরিক এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি যেকোনো সময় মহাজোট ত্যাগ করতে পারে। এরশাদকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি 'চমক' দিতে পারেন! কিন্তু তিনি সেটা করবেন, তা বোধ করি জাতীয় পার্টির কোনো সদস্যও বিশ্বাস করেন না। তাই ঘুরেফিরে ওই দুই ব্যক্তির দিকেই দৃষ্টি অনেকের। একটি ইংরেজি দৈনিক তো ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকেই চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছে। তার পরও আমরা আশা করব, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রশ্নে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে একটা 'আলোচনা' হোক। তাদের মতামত নেওয়া হোক। কেননা রাষ্ট্রপতি কোনো দলের নন। তিনি বাংলাদেশের এক নম্বর ব্যক্তি। তিনি জাতির ঐক্যের প্রতীক। তিনি হবেন সবার রাষ্ট্রপতি। শেখ হাসিনা অতীতে অনেক উদারতা দেখিয়েছিলেন। আজ তেমনি একটি সময় এসেছে তাঁর কাছে। তিনি ইতিহাসে আবারও নন্দিত হতে পারেন, যদি একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেন। তিনি দেশের এক 'কঠিন সময়ে' দল ও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়াতে পারবেন, যদি এ কাজটি করেন। তাই ৯০ দিনের এই সময়সীমাটা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সবার দৃষ্টি থাকবে এখন বঙ্গভবনের দিকে। শেষ পর্যন্ত একজন রাজনীতিবিদই আসনটি অলংকৃত করেন কি না, সেটাই হবে আলোচনার মূল বিষয়।
রাজনীতিতে একটা কথা আছে- 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস'। এটি হচ্ছে একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনীতিতে বিভেদ-দ্বন্দ্ব থাকবেই; কিন্তু তা যেন সংঘাতময় হয়ে না ওঠে। এ জন্যই বিরোধীপক্ষকে বিশ্বাস ও আস্থায় নেওয়াটা জরুরি। আর উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই। আমি মনে করি, বিএনপি কর্তৃক প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। উদ্যোগটা এখন নিতে হবে সরকারকেই। সৈয়দ আশরাফ এখন মির্জা ফখরুলের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। ক্ষতি কী, সৈয়দ আশরাফ যদি মির্জা ফখরুলকে ফোন করেন। হুট করে মিডিয়াকে এড়িয়ে তাঁর বাসায় চলে যেতেও পারেন। আগামী এপ্রিল মাসেই বসছে সংসদের ১৭তম অধিবেশন। যদি এপ্রিলে না হয়, তাহলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৫ মের মধ্যে সংসদ অধিবেশন ডাকতে হবে। এই অধিবেশনেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর রাষ্ট্রপতি যেহেতু ঐক্যের প্রতীক, সেহেতু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাম্য নয়। বিএনপির সেই শক্তিও নেই সংসদে প্রার্থী দেওয়ার। সুতরাং মহাজোটের প্রার্থী একটি ঐকমত্যের প্রার্থী হবেন, আমরা তেমনটি চাই। একটি আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব এখন এই আস্থার জায়গাটাকে একটি স্থায়ী রূপ দেওয়া। সমগ্র জাতি তাকিয়ে আছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দিকে- সবাই মিলে বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করবেন, যা সুষ্ঠুভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পথ প্রশস্ত করবে।
Daily KALERKONTHO25.03.13

দোদুল্যমানতা ছেড়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিন


সরকারের নীতি নির্ধারকদের মাঝে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দিনে দিনে বাড়ছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা তোফায়েল আহমেদ যখন মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, তখনই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যেভাবে সরকার পরিচালিত হচ্ছে, দলের অনেক সিনিয়র নেতা তা চান না। দলের নীতি নির্ধারণীতে এখন সাবেক ‘মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট’ হিসেবে পরিচিতদের প্রাধান্য বাড়ছে। এই প্রাধান্যের কারণে আওয়ামী লীগের মূল ধারার নেতা হিসেবে পরিচিতরা এক রকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। জীবদ্দশায় আবদুল জলিল সম্মান পাননি। অথচ তিনি ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণ সভায় আওয়ামী লীগের নেতারাই স্বয়ং এ কথা বলেছেন। এমনকি তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমুর মতো ঝানু নেতারাও মস্কোপন্থীদের কারণে দলের নীতিনির্ধারণীতে ঠাঁই পাচ্ছেন না। সঙ্কটকালীন সময়ে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তোফায়েল আহমদের সম্মতি তাতে ছিল না। দক্ষ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ জানেন, সরকারের পড়ন্ত বেলায় ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিতে চান না। নাসিম বা আমুর মতো নেতারাও প্রধানমন্ত্রীর নজরে পড়ার জন্য নানা কৌশল করে যাচ্ছেন। কিন্তু মন্ত্রিসভায় জায়গা তাদের হয়নি এবং আগামী নির্বাচনের আগে হবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই। অতি সম্প্রতি শাহবাগিদের উত্থান, বিএনপির জনসভায় গুলিবর্ষণ এবং সর্বশেষ গত ১১ মার্চ বিএনপি অফিসে পুলিশি অভিযান ও একই সাথে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতারের ঘটনায় দলের মাঝে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দলের যুগ্ম মহাসচিব যিনি কার্যত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন, সেই মাহবুব-উল-আলম হানিফের একটি বক্তব্য এই বিরোধকে উসকে দিয়েছে। হানিফ বলেছেন, ১১ মার্চের ঘটনায় পুলিশ আরো কৌসুলি হতে পারত। তারা এ পর্যায়ে না গেলে তারা খুশি হতেন। রাজনৈতিক দলের নেতাদের এভাবে আটক করা প্রত্যাশিত নয় (যায় যায় দিন, ১৩ মার্চ)। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর বলেছেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের অভিযান ‘যৌক্তিক’ ছিল (ঐ)। শুধুতাই নয় বিবিসির বাংলা বিভাগের সাথে সাক্ষাৎকারে ম খা আলমগীর জনাব হানিফের বক্তব্যের শুধু সমালোচনাই করেননি, বরং ইঙ্গিতপূর্ণ কটূক্তি করেছেন। ম খা আলমগীর সনাতন রাজনীতিবিদ নন। স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি করে তিনি শীর্ষ পদে উঠে আসেননি। শহীদ জিয়ার খাল কাটা কর্মসূচির উপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পাকিস্তান আমলে  সেন্ট্রাল সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন তিনি অন্যান্য বাঙালি সিএসপি অফিসারের মতো মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে তিনি ‘পাকিস্তানের সেবা’ করে গেছেন। এমনকি ওই সময় তিনি টাঙ্গাইলে এডিসি থাকাকালীন সময়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের রিক্রুট করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। বোধকরি এটা বিবেচনায় নিয়েই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তাকে রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমরা খুশি হতাম যদি তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করতেন। কিন্তু আমার জানা মতে তিনি তা করেননি। বরং উল্টো কাদের সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন। সেই মখা আলমগীর এখন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার আমলে প্রধান বিরোধী দলের অফিস তছনছ করা হলো। অফিস থেকে টাকা লুটেরও অভিযোগ করেছে বিএনপি। গত ১৪ মার্চের বিবিসির সঙ্গে বেলার অনুষ্ঠানেও জানা গেল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা নাকি এই পুলিশি অভিযানের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট। পুলিশের সাম্প্রতিক আচরণে আমি উৎকণ্ঠিত। এর আগেও বিএনপির এক সমাবেশে পুলিশ ছররা গুলি ছুঁড়েছিল। ওই গুলিতে  আহত হয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এখন হাসপাতালে। পুলিশের বক্তব্য তারা আক্রান্ত হন বলেই গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হন। এর পেছনে ‘সত্যতা’ একদমই নেই। পুলিশকে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। পুলিশ উত্তেজিত হতে পারে না। প্রশিক্ষণের সময় তো তাদের এ কথাই শেখানো হয়। এর আগে গত ৭ মার্চ পুলিশ চারজন বিএনপি দলীয় মহিলা সংসদ সদস্যকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর এক পর্যায়ে গাড়ি থেকে পরে আহত হন সংসদ সদস্য শাম্মী আখতার। তার ফাট হয়ে শুয়ে থাকার ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল পরদিন। একজন সংসদ সদস্যের সাথে পুলিশ কী এভাবে আচরণ করতে পারে? ‘ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি’ অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্যের অবস্থান তো একজন পুলিশ অফিসারের চাইতে অনেক ওপরে। আর বিএনপি অফিসে ‘ককটেল আবিষ্কারের’ কাহিনী টিভি চ্যানেলে দেখিয়ে পুলিশ আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও, এটা কী বিশ্বাসযোগ্য যে, ‘টয়লেটের পাশেই’ বিএনপির কর্মীরা ‘ককটেল রাখবে’! প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মুসা তো এ প্রশ্নটাই করেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত পুলিশ বিএনপির শীর্ষ তিন নেতাকে জেলে পাঠায়নি। কিন্তু জেলে পাঠিয়েছে এবং মামলা করেছে জয়নুল আবদীন ফারুকের মতো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। যিনি এর আগেও পুলিশ কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছিলেন। পুলিশ বাকি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করায় ১৮ ও ১৯  মার্চ সারা দেশব্যাপী ও ২১ মার্চ ঢাকায় হরতাল হয়েছে। সরকার হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। শুধু লোক দেখানো একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা বলেছে। আগামীতে আরো হরতাল হতে পারে। এখন সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি  উপলব্ধি না করেন, তাহলে এ ধরনের হরতাল হতেই থাকবে। হরতাল নিষিদ্ধের আইন করেও কিছু হবে না। হরতাল হতেই থাকবে। হরতাল সাধারণ মানুষ তো বটেই, সরকার ও বিরোধী দল, কারো জন্যই কোনো মঙ্গল ডেকে আনে না। বিগত কয়েকদিনের হরতালে সাধারণ নিরীহ প্রচুর (এ সংখ্যা ১৭০) মানুষ মারা গেছেÑ এই ক্ষতি তো রাষ্ট্রেরই। পুলিশের আরো মানবিক ও সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিকাশমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ (সিবিএম) ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সিবিএম, বা আস্থার সম্পর্ক গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। সিবিএম না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। বিঘিœত হবে সুশাসন। আর রাষ্ট্র ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে। এ দেশে অনেক সম্ভাবনা আছে। এই সম্ভাবনাকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। রাজনীতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, তা দেখার দায়িত্ব সকলের। এখানে বিরোধী দল, ‘শত্রু’ নয়, বিরোধী দল গণতন্ত্রের ভাষায় ‘সরকারের একটি অংশ”। একজন সংসদ সদস্যকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে নিজ অফিস থেকে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করে বিরোধী দল যে ‘সরকারের একটি অংশ’, তা প্রমাণ করা যাবে না। বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়াটা জরুরি।  আর অফিসে হামলা ও নেতাদের গ্রেফতার, সঙ্কটকে আরো গভীরতর করবে মাত্র।
‘মহাসঙ্কটে দেশ’, এই অভিমত অনেকের। এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক সঙ্কেটের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি (২০১৩) মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ব্যাপকহারে বেড়েছে ‘খাদ্য মূল্যস্ফীতি’। পয়েন্ট টু পয়েন্টে ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ (জানুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ)। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ (জানুয়ারিতে ছিল ৫ দশমিক ০২ শতাংশ)। ঢাকায় অবস্থিত বিদেশী কূটনীতিকরা চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এখন সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়, থানা আক্রমণ করা হয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। কারা করে এসব? এসব আলামত আমাদের জন্য ভালো কোনো খবর নয়। তাই বিদেশী কূটনীতিকরা যখন উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তখন সরকারের উচিত এই উদ্বেগকে বিবেচনায় নেয়া। ডা. দীপুমনি কূটনীতিকদের সাথে কথা বলেছেন। তিনি পুরো ঘটনার জন্য বিরোধী দলের ওপর দোষ না চাপিয়ে পারতেন বিরোধী দলীয় নেত্রীর সাথে দেখা করতে। তা তিনি করেননি। ‘ব্লেম গেম’ এর রাজনীতিতে আক্রান্ত এ দেশ। সরকারের অভিযোগ বিরোধী দলের উপর। আর বিরোধী দলকে নির্মূল করতে চায়, সরকার। আর এটা  তো সত্য একটা গণতান্ত্রিক সমাজে পুলিশ এভাবে তাণ্ডবতা চালাতে পারে না। নিঃসন্দেহে মাহবুব-উল আলম হানিফের বক্তব্য একটি ভালো দিক। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের এভাবে আটক প্রত্যাশিত নয়।’ এই বক্তব্যে রাজনৈতিক পরিপক্বতা আছে। এখন অভিযুক্ত পুলিশের একজন এডিসি যদি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে থাকেন, তাহলে তার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। তাকে অন্যত্র বদলী করা যায়।
আজ অনেকগুলো বিষয় যুক্ত হয়েছে রাজনীতিতে। এক. জামায়াতকে  আস্থায় নেয়া দরকার। দুই. যারা ফেসবুক ও ব্লগে নবী করিম (সা.) সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছে, তাদেরকে চিহ্নিত করে, বিচারের ব্যবস্থা করা। তিন. রাজনীতিতে পেশী শক্তির মহড়া প্রদর্শন বন্ধ করা। চার. একটি নিরপেক্ষ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামো উপস্থাপন করা।  তরুণ প্রজন্ম, যারা জামায়াতের রাজনীতিকে ধারণ করেছে, তাদের দোষ দেয়া যাবে না। বিচার প্রক্রিয়া চলছে। আর শাহবাগিরা বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করে বিচার বিভাগকে ধ্বংস করছে। এটা নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত থাকলে তা ভিন্ন ‘সিগন্যাল’ পৌঁছে দেবে সর্বত্র। সরকার একটি কমিটি করেছে, যারা অনলাইনে নবী করিম (সা.)কে নিয়ে কটূক্তি করেছে, সে বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে। পত্রিকায় এদের নাম-ধাম বেড়িয়েছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আশ্রয়ে নেয়া হোক।কিন্তু সহিংসতা রোধে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নামে দলীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বিএনপি তথা ১৮ দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে জননিরাপত্তা কমিটি গঠন করার। দুই পক্ষের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানে দেশে সংঘাত ও সহিংসতা আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে। এখানে প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক পরিপক্বতার। তা নেই। সরকারকে সহনশীল হতে হবে। সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা কোনো ভালো খবর নয়। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই মানুষের মাঝে শঙ্কা বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু তার জট খোলেনি। এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। প্রধানমন্ত্রীকে রেখে কোনো ‘সমাধান কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। স্পিকারের সম্ভাবনাও কম। কেননা শোনা যাচ্ছে আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন। সুতরাং তার ওপর আস্থা রাখা যায় না।  আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু দল ত্যাগ করেননি।  এ ক্ষেত্রে নেপালের অতি সম্প্রতি নেয়া একটি সিদ্ধান্তকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। নেপালের চারটি বড় দল সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। আগামী জুনে সেখানে সাধারণ নির্বাচন। চূড়ান্ত বিচারে আমরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
বিরোধী দলকে নির্মূল করা, কিংবা বিএনপির অফিসে পুলিশি অভিযানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ভেতরে যে ‘মিশ্র’ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তাকে আমি ‘পজিটিভলি’ নিচ্ছি, অর্থাৎ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি। এখন সরকার যদি দমন-পীড়ন বন্ধ করে এবং আগামী দশম নির্বাচনের ব্যাপারে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা করে, তাহলে আমরা একটা বড় ধরনের সংঘাত থেকে মুক্তি পাব। সেই সাথে ইসলামবিরোধী তথাকথিত ব্লগারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়াও প্রয়োজন।  চট্টগ্রামের ‘ঘটনা’ সরকারের জন্য একটা ‘সিগন্যাল’। সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
22.03.13

বিদ্যমান পরিস্থিতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে


যারা গত ১২ মার্চের সংবাদপত্রগুলো পাঠ করেছেন তাদের মাঝে এ প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক যে, দেশের চলমান রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। সংবাদপত্রের ভাষায় গত ১১ মার্চ সন্ধ্যা বেলায় পুলিশ বিএনপি অফিসে যে গ্রেফতার অভিযান চালায়, তা ছিল ইতিহাসের জঘন্যতম পুলিশি অ্যাকশন। দৈনিক মানবকণ্ঠেও ছিল সাত কলামব্যাপী একটি হেডিং। সংবাদপত্রজুড়ে শুধু পুলিশি অ্যাকশনের ছবি। পুলিশ হাতুড়ি দিয়ে ভাঙছে বিএনপি অফিসের মহাসচিবের রুমের তালা। কোনো ছবিতে আবার মহাসচিবকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কোনো ছবিতে আছে পুলিশের প্রতি ঢিল নিক্ষেপের ছবিও। আছে সাংবাদিক ও সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের ওপর বোমা নিক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত তার গাড়ির ছবিও। বিএনপির সমাবেশ ছিল ১১ মার্চ। বক্তৃতা করছিলেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ১২ মার্চের হরতালের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ককটেল ফুটল গুনে গুনে ১০টি। এতক্ষণ পর্যন্ত পুলিশ চুপচাপ ছিল। এরপর শুরু হলো পুলিশি অ্যাকশন। গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো শতাধিক কর্মীকে। কিন্তু তারপর? ১৮ ও ১৯ মার্চও পালিত হলো হরতাল। এই হরতালের রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রাজনীতি কেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে বার বার? যদিও ইতিমধ্যে ফখরুলসহ তিন নেতা মুক্তি পেয়েছেন। বাকিরা জেলে।
আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন বাংলাদেশে কী হতে যাচ্ছে আগামীতে? নিউইয়র্কে বসবাসকারী এক বাংলাদেশি যিনি আমার লেখার পাঠক, ফোন করলেন সোমবার রাতে। তার প্রশ্ন কী হতে যাচ্ছে দেশে? আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু কামাল। থাকে জার্মানীতে। জার্মান নাগরিক। ই-মেইলে তার উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায় প্রতিবার। আমার ছাত্ররা অপেক্ষায় থাকে। ক্লাস আদৌ হকে কি? আমি ‘বন্দিজীবন’ যাপন করি। বলতে পারি না কবে ক্লাস নিতে পারব। একটি অস্থিরতা সব জায়গায়, ক্যাম্পাসে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, প্রতিটি সেক্টরে।
একটি সংলাপের কথা বলেছিলেন সৈয়দ আশরাফ! কোথায় সেই সংলাপ? দীপু মনির একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে ১২ মার্চের পত্রিকায়। তিনি বলেছেন, ‘যে কোনো আলোচনায় পরিষ্কার হাত নিয়ে আসতে হয়।’ তার বক্তব্য মানবকণ্ঠে ছাপা হয়েছে এভাবে, ‘বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার পথ সব সময় খোলা। কারণ, গণতন্ত্রে  পার্থক্য থাকবে। মতের ভিন্নতা থাকবে। জনগণের স্বার্থে জনগণের অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে বিএনপির কথা বলার জায়গা আছে। সেটির ভালো জায়গা সংসদ। সেটি না হলে আলোচনার পথই সর্বোত্তম পথ। সহিংসতা নয়। বর্তমানে আরো সহিংসতা করছে তারা কোনো সমাধান চায় না। তারা সহিংসতা করে তার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করছে। তারা চায় না আলোচনার মাধ্যমে কোনো কিছুর সমাধান করতে।’
মিথ্যা বলেননি দীপু মনি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? দীপু মনির বক্তব্য আর মির্জা ফখরুলের গ্রেফতারের ছবি কি পরস্পরবিরোধী নয়? মির্জা ফখরুলকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ‘আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অজুহাতে। এর আগে তিনি জামিন পেয়েছিলেন চার সপ্তাহের জন্য। এখন তাকে আবার ছেড়ে দেয়া হলো। কিন্তু বাকিদের জেলে রেখে সংলাপ হবে কীভাবে? তবে পুলিশের সাম্প্রতিক আচরণে আমি উৎকণ্ঠিত। এর আগেও বিএনপির এক সমাবেশে পুলিশ ছররা গুলি ছুড়েছিল। ওই গুলিতে আহত হয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এখনও হাসপাতালে।
পুলিশের বক্তব্য তারা আক্রান্ত হন বলেই গুলি ছুড়তে বাধ্য হন। এর পেছনে ‘সত্যতা’ যাই থাকুক না কেন, পুলিশকে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। পুলিশ উত্তেজিত হতে পারে না। প্রশিক্ষণের সময় তো তাদের এ কথাটাই শেখানো হয়। এর আগে গত ৭ মার্চ পুলিশ চার বিএনপিদলীয় মহিলা সংসদ সদস্যকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর একপর্যায়ে গাড়ি থেকে পরে আহত হন সংসদ সদস্য শাম্মী আখতার। তার অচেতন দেহ ফ্লাট হয়ে শুয়ে থাকার ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল পরদিন। একজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে পুলিশ কি এভাবে আচরণ করতে পারে?’ ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি’ অনুযায়ী এক সংসদ সদস্যের অবস্থান তো একজন পুলিশ অফিসারের চাইতে অনেক ওপরে। আর বিএনপি অফিসে ‘ককটেল আবিষ্কারের’ কাহিনী চ্যানেলে দেখিয়ে পুলিশ আত্মতুষ্টিতে ভুগলেও এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে ‘টয়লেটের পাশেই’ বিএনপির কর্মীরা ‘ককটেল রাখবে!’ প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা তো এ প্রশ্নটাই করেছিলেন।
একটি ‘ভালো খবর’ অবশ্যি আমরা পেয়েছি। ১১ মার্চ চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের জনসভা হওয়ার কথা ছিল। পাল্টা জনসভা ডেকেছিল হেফাজতে ইসলাম নামে আরেকটি সংগঠন। ফলে সরকারকে বাধ্য হয়ে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছিল। এমনকি গণজাগরণ মঞ্চের নেতাদের চট্টগ্রামে প্রবেশ করতেও দেয়নি পুলিশ। লক্ষণটা ভালো। আমরা আরো খুশি হতাম যদি সর্বক্ষেত্রে পুলিশ এই আচরণ করত। বিএনপি অফিসে পুলিশি অভিযানের সিদ্ধান্তটি ছিল ভুল। পরিণতিতে আবার ডাকা হলো হরতাল। কেন বারবার হরতাল হয়, কেন ইসলামপ্রিয় মানুষরা, যারা জামায়াত করে না, অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তা যদি সরকারের নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি না করেন, তাহলে এ ধরনের হরতাল হতেই থাকবে। হরতাল নিষিদ্ধের আইন করেও কিছু হবে না। হরতাল হতেই থাকবে।
হরতাল সাধারণ মানুষ তো বটেই, সরকার ও বিরোধী দল, কারো জন্যই কোনো মঙ্গল ডেকে আনে না। গত কয়েকদিনের হরতালে গাড়ি পুড়েছে, ট্রেনের বগি পুড়েছে, মানুষ মারা গেছে এই ক্ষতি তো রাষ্ট্রেরই। পুলিশকে আরো মানবিক ও সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিকাশমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ (সিবিএম) ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সিবিএম বা আস্থার সম্পর্ক গণতন্ত্রের পূর্ব শর্ত। সিবিএম না থাকলে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। বাধাগ্রস্ত হবে সুশাসন। আর রাষ্ট্র ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে। এদেশে অনেক সম্ভাবনা আছে। এই সম্ভাবনাকে আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। রাজনীতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, তা দেখার দায়িত্ব সবার। এখানে বিরোধী দল ‘শত্র“’ নয়, বিরোধী দল গণতন্ত্রের ভাষায় ‘সরকারের একটি অংশ।’ একজন সংসদ সদস্যকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে নিজ অফিস থেকে শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করে বিরোধী দল যে সরকারের একটি অংশ, তা প্রমাণ করা যাবে না। বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়াটা জরুরি।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা করতে হলে বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়েই এগুতে হবে। আর অফিসে হামলা ও নেতাদের গ্রেফতার, সংকটকে আরো গভীরতর করবে মাত্র। ‘মহাসংকটে দেশ’, এই অভিমত অনেকের। এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক সংকটের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ফেব্র“য়ারিতে (২০১৩) মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ব্যাপকহারে বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। পয়েন্ট টু পয়েন্টে ফেব্র“য়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ (জানুয়ারিতে ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ)। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। (জানুয়ারিতে ছিল ৫ দশমিক ০২ শতাংশ)। ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকরা চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
যখন সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়, থানা আক্রমণ করা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ  পুড়িয়ে দেয়া হয় এসব আলামত আমাদের জন্য ভালো কোনো খবর নয়। তাই বিদেশি কূটনীতিকরা যখন উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তখন সরকারের উচিত এই উদ্বেগকে বিবেচনায় নেয়া। ডা. দীপু মনি কূটনীকিতদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি পুরো ঘটনার জন্য বিরোধী দলের ওপর দোষ না চাপিয়ে পারতেন বিরোধী দল নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। তা তিনি করেননি।
‘ব্লেমগেম’ এর রাজনীতিতে আক্রান্ত এদেশ। সরকারের অভিযোগ বিরোধী দলের ওপর, আর বিরোধী দল অভিযোগ করেছে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে। আর এটা তো সত্য একটা গণতান্ত্রিক সমাজে পুলিশ এভাবে তাণ্ডব চালাতে পারে না। নিঃসন্দেহে মাহবুব-উল আলম হানিফের বক্তব্য একটি ভালো দিক। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের এভাবে আটক প্রত্যাশিত নয়।’ এই বক্তব্যে রাজনৈতিক পরিপক্বতা আছে। তখন অভিযুক্ত পুলিশের একজন এডিসি যদি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে থাকেন, তাহলে তার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। তাকে অন্যত্র বদলি করা যায়।
আজ অনেক বিষয় যুক্ত হয়েছে রাজনীতিতে। এক. জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা, দুই. যারা ফেসবুক ও ব্লগে নবী করিম (সা.) সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করা, তিন. রাজনীতিতে পেশি শক্তির মহড়া প্রদর্শন বন্ধ করা, চার. একটি নিরপেক্ষ ও অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাঠামো উপস্থাপন করা।
জামায়াতের নিবন্ধনে যদি ত্র“টি থাকে, তাহলে আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ করা যায়। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। তরুণ প্রজন্ম, যারা জামায়াতের রাজনীতিকে ধারণ করেছে, তাদের দোষ দেয়া যাবে না। বিচার প্রক্রিয়া চলছে যারা একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের। জামায়াতের নিষিদ্ধের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হোক। তাই বলে এটা নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত থাকলে তা ভিন্ন ‘সিগন্যাল’ পৌঁছে দেবে সর্বত্র। সরকার একটি কমিটি করেছে, যারা অনলাইনে নবী করিম (সা.) কে নিয়ে কটূক্তি করেছে, সে বিষয়টি তদন্ত করে দেখার। পত্রিকায় এদের নাম-ধাম বেড়িয়েছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ করা হোক। জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা রোধে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নামে দলীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বিএনপি তথা ১৮ দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে জননিরাপত্তা কমিটি গঠন করার। দুইপক্ষের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থান দেশে সংঘাত ও সহিংসতা আরো ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। এখানে প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক পরিপক্বতার। তা নেই। সরকারকে সহনশীল হতে হবে। সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা কোনো ভালো খবর নয়। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই মানুষের মাঝে শঙ্কা বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী একটি অন্তবর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছিলেন বটে। কিন্তু তার জট খোলেনি। এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। প্রধানমন্ত্রীকে রেখে কোনো ‘সমাধান’ কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সংসদের একজন প্রবীণ ও গ্রহণযোগ্য সংসদ সদস্যকে অন্তবর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী করে একটা সমাধান বের করা যায়।
স্পিকার এই দায়িত্বটি নিতে পারতেন। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও তিনি দশম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। সংসদের একমাত্র নির্দলীয় সংসদ সদস্যকে নিয়েও এই সরকার হতে পারে। আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ সদস্য, যিনি আগামীতে প্রার্থী হবেন না, তিনিও পারেন দায়িত্বটি নিতে। তবে এতে বিএনপির সম্মতি প্রয়োজন। তাই সংলাপটি প্রয়োজন। সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই এবং রাজনীতির জটও খুলবে না।  যে অবস্থা চলছে তা কোনোভাই আর দীর্ঘায়িত হতে দেয়া কারোরই উচিত হবে না। রাষ্ট্র, সমাজ, জনজীবনে এর চরম বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মানুষ আর সহ্য করতে পারছে না। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে রাজনীতিকরা গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নিলেই মঙ্গল। জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা, সম্পদহানি ইত্যাদি কোনো কিছুই প্রীতিকর কোনো চিত্র নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতি আমাদের কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে এটি সময়ের উদ্বেগজনক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন বৈরী পরিস্থিতির অবসান ঘটনানোর দায় কমবেশি সবারই।
Daily Manobkontho
21.3.13

ভিসি ও শিক্ষক নিয়োগে এখনও দলীয়করণ?


সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে যেসব সংবাদ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, তা কোন আশার কথা বলে না। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতির সংবাদ ছাপা হলেও ভিসি বহাল তবিয়তে এখনও আছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করলে শিক্ষকরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। পরিণামে তাদের ছাত্রলীগের এসিড সন্ত্রাসের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পিটিয়েছিল ছাত্রলীগের কর্মীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিণত হয়েছে অনিয়মের আখড়ায়। উপাচার্য মেসবাহউদ্দিনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন ভিসি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে এখন। ভিসি হিসেবে মেসবাহউদ্দিন শুধু দলীয় বিবেচনায় মাত্র দেড় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে কলেজ শিক্ষকদের অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিয়েছিলেন। যেখানে গবেষণামূলক প্রবন্ধের দরকার, সেখানে তার কোন তোয়াক্কা করেননি ভিসি মহোদয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যারা অধ্যাপক হয়েছেন, তাদের প্রকাশনা না থাকলেও আমার ছাত্র যারা প্রভাষক হিসেবে ওই বিভাগে যোগ দিয়েছেন, তাদের গ্রন্থ ও গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা কথাÑ মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র দু’দিন আগে মেসবাহউদ্দিন জগন্নাথে ১১৪ জন চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীকে পদোন্নতি ও স্থায়ী নিয়োগ দিয়ে গেছেন। এসব ক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে (সকালের খবর, ২৭ ফেব্র“য়ারি)।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়। সদ্যবিদায়ী ভিসি সেখানে নিয়োগ-বাণিজ্য করে গেছেন। অতিসম্প্রতি বিভিন্ন নিয়োগে ২০০ জন শিক্ষকের বিপরীতে তিনি দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছেন ৩৫০ জনকে, যাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কোন অনুমতি ছিল না। আর সর্বশেষ ২০ ফেব্র“য়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪৭তম সিন্ডিকেটে তৃতীয় শ্রেণীর ১৪৫টি পদের বিপরীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৮৪ জনকে। এ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন একজন শিক্ষক ১ মার্চের যুগান্তরের উপসম্পাদকীয় পাতায়। সবচেয়ে অবাক করা একটি কাণ্ড করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ ছাপা হওয়ায় আমি লজ্জিত ও দুঃখিত। আমার সব আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। তার কাছে আমার প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান বাড়াবেন, এ প্রত্যাশা ছিল আমাদের সবার। কিন্তু যখন সংবাদপত্রের দিকে তাকাই, তখন আমি আশাহত হই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সংবাদটি ছাপা হয়েছে ২ ফেব্র“য়ারি একটি জাতীয় দৈনিকের পাতায়। এতে বলা হয়েছে, যিনি কোনদিন গণযোগাযোগ বিষয়ে পড়াশোনা করেননি, তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগের সুপারিশ করেছে নির্বাচন কমিটি। সিন্ডিকেট তার এই সুপারিশ অনুমোদন করেনি এখন অবধি। বাতিলও হয়নি। এ সুপারিশের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে তা শিক্ষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং একপর্যায়ে শিক্ষক সমিতি ভিসিকে আলটিমেটাম দেয়। মজার ব্যাপার হল, ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, যাকে ওই পদে সুপারিশ করা হয়েছিল, তিনি অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে। তবে গণযোগাযোগে তিনি একটি পিএইচডি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মাস্টার্সে তার একটি তৃতীয় শ্রেণীও রয়েছে। তিনি বর্তমানে সরকারের তথ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান তথ্য অফিসার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য।
একজন সরকারি কর্মকর্তাকে সহযোগী অধ্যাপক পদে সুপারিশের বিষয়টি নানা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। প্রথমত, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ওই নির্বাচনী কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী সভায় তিনি কী করে এমন এক ব্যক্তিকে সহযোগী অধ্যাপক পদে সুপারিশ করলেন, যিনি আদৌ কোনদিন জার্নালিজম বা মিডিয়া নিয়ে পড়াশোনা করেননি। অধ্যাপক হোসেন তো আমাদের শুনিয়েছিলেন, তিনি জাহাঙ্গীরনগরকে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে চান। আমি কিছুটা বিভ্রান্ত এই ভেবে যে, এটা তিনি কেন করলেন? দ্বিতীয়ত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩৮তম সিন্ডিকেটে (১৯৮৯) শিক্ষকদের পদোন্নতি তথা আপগ্রেডিং চূড়ান্ত করা হয়েছিল। তাতে (২ক) স্পষ্ট বলা আছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সহকারী অধ্যাপক পদে ৪ বছরের অভিজ্ঞতা ও ৩টি প্রকাশনা (পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে) বাঞ্ছনীয়। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে তার প্রয়োজন ৭ বছরের অভিজ্ঞতা ও ৩টি প্রকাশনা। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, তথ্য অধিদফতর কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠান নয় এবং তার আদৌ কোন গবেষণামূলক প্রবন্ধ নেই। তাহলে তিনি সুপারিশকৃত হলেন কিভাবে? তৃতীয়ত, অভিযোগ উঠেছে, ড. জাহাঙ্গীর ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে ভিসিকে প্রভাবিত করেছেন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তিনি অন্যায় করেছেন। চতুর্থত, এই সুপারিশটি করে ভিসি মহোদয় যদি অভিযুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে নির্বাচন কমিটির সদস্যরাও একই অভিযোগে অভিযুক্ত। তারাও সমান দোষী। পঞ্চমত, নিয়োগটি নতুন। এখানে সিনিয়র শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সেই বিবেচনায় ভিসি সিনিয়র শিক্ষক নিয়োগ দিতে চেয়েছেন। এজন্য তিনি সাধুবাদ পেতেই পারেন। কিন্তু সুপারিশটি সঠিক হয়নি। আমার জানা মতে, কলা অনুষদেই মিডিয়া স্টাডিজে লন্ডন থেকে পিএইচডি করা অধ্যাপকও রয়েছেন। প্রয়োজনে তাকে সাময়িকভাবে বিভাগটি গড়ার দায়িত্ব দেয়া যায়। তবে অবশ্যই অতি দ্রুত এ বিভাগে সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। নতুবা শুরুতেই বিভাগটি মুখথুবড়ে পড়বে। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি জানেন একটি বিভাগ কিভাবে দাঁড় করাতে হয়। পঞ্চমত, এই সুপারিশটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষাকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে। একজন ভিসিকে যে কত চাপের মুখে কাজ করতে হয়, এটা তার বড় প্রমাণ। আমার ধারণা ছিল অধ্যাপক হোসেন কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী হবেন। অনেক আশার কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছেন। আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা কেন ‘চাপে’র কাছে মাথানত করবেন? তিনি কেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেন না? আগামীতে তার ওপর আরও চাপ আসবে। প্রোভিসির টার্ম শেষ, ট্রেজারারের টার্মও শেষ হয়ে আসছে। নতুন যারাই আসবেন, তাদের অবশ্যম্ভাবীভাবেই জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষক হতে হবে। যে কোন একটি ভুল ‘চয়েস’ নতুন আরও অনেক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ষষ্ঠত, শেষ পর্যন্ত ভিসি মহোদয় ওই সুপারিশটি সিন্ডিকেটে তোলেননি। এজন্য তিনি ধন্যবাদার্হ। এখন খোদ ড. জাহাঙ্গীরই পারেন সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে। তিনি যদি তার প্রার্থী পদ প্রত্যাহার করে নেন, তিনি নিজেও ধন্যবাদের পাত্র হবেন। ভিসি মহোদয়কেও বিতর্কের হাত থেকে বাঁচাবেন। তিনি যদি ‘গোঁ’ ধরে থাকেন, আমার বিশ্বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্প্রদায়ের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য হবেন না। এতে করে বিতর্কের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।
সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাকে একটি বড় ধরনের হতাশায় পেয়ে বসেছে। একজন উপাচার্য কিভাবে বিতর্কের জালে জড়িয়ে যান, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা তার বড় প্রমাণ। পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন উপাচার্যকে নিয়ে একের পর এক যেসব সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, তাতে করে এই পদটির প্রতি আমি আর আস্থা রাখতে পারছি না। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নতুন ওই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের কোন ‘ভিশন’ নেই। আগামী শতকে কেমন গ্রাজুয়েট আমরা চাই, তার রূপকল্প তাদের জানা নেই। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়ে নানা প্রশ্ন সংবাদপত্রেই ছাপা হচ্ছে। একটা ভয় আমার মাঝে কাজ করেÑ কারা আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্ব দেবেন? এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনেক পেছনে পড়ে যাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে কলেজ থেকে অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের নিয়ে। একই সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু তরুণ শিক্ষকের পার্টটাইম চাকরি (যা অনেকটা ফুলটাইমের মতো) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে টিকিয়ে রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভাল করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মঞ্জুরি কমিশনকে ভেঙে হায়ার এডুকেশন কমিশন করবে। সিদ্ধান্তটি ভালো। কিন্তু কাদের হাতে থাকবে এই কমিশন! এখানে যদি যোগ্য ও দৃঢ়তাসম্পন্ন শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া না হয়, তাহলে সরকারের উদ্দেশ্য কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। উচ্চশিক্ষায় কোন পরিবর্তন আসবে না। এতদিন আমরা অভিযোগ করে আসছি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে। কিন্তু এখন তো এই প্রশ্ন উঠবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়েও। ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ৩৫ জন ভিসি। ক’জনকে আমরা চিনি? ক’জন উচ্চশিক্ষায় অবদান রাখতে পারছেন? শত শত ‘শিক্ষক’ নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। তারা কতটুকু যোগ্যতাসম্পন্ন, সে প্রশ্ন না হয় নাইবা করলাম। আমার আস্থার জায়গাটা তাই নষ্ট হয়ে যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি ‘রিভিউ’ করা দরকার। শত শত কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। এখানে কী ধরনের শিক্ষা হচ্ছে, নিয়মিত ক্লাস হয় কি-না, ছাত্র-শিক্ষকদের পারফরম্যান্স রিভিউ করা দরকার। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস। সেনাবাহিনীর একজন মেজর জেনারেল এর উপাচার্য। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানসহ অনেক দেশেই আছে। এটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি আটকে যাই এক জায়গায়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি আবার এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রিও দিচ্ছে। এটা কিভাবে সম্ভব? যাদের নিজস্ব কোন ফ্যাকাল্টি নেই, অর্থাৎ সিনিয়র শিক্ষক নেই, তারা কিভাবে ডিগ্রি দেন? বাইরে থেকে ‘ভাড়ায়’ শিক্ষক এনে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার অর্থ কী? প্রয়োজনীয়তাটাই বা কী? যদি পিএইচডি ও এমফিল ডিগ্রি দিতে হয়, তাহলে ওই বিভাগে সিনিয়র শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। সেনা নেতৃত্ব নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন। তবে এখানে পড়াশোনার মান, নিয়মানুবর্তিতা প্রশংসার যোগ্য।
ক’বছর পর শিক্ষকতায় আমরা থাকব না। আমি নিজেও থাকতে চাচ্ছি না আর। বিকল্প কোন সুযোগ থাকলে আমি চলে যেতে চাই। কারণ যে আস্থা ও বিশ্বাস রেখে একদিন সিভিল সার্ভিসে যোগ না দিয়ে শিক্ষকতায় এসেছিলাম, আজ এত বছর পর আমার সেই আস্থায় চিড় ধরেছে। অযোগ্য শিক্ষকদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আর ভিসিরা দায়িত্ব পেয়েই প্রথম যে কাজটি করছেন, তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। শিক্ষকের স্ত্রী, ভাই, ছেলে, মেয়ে, মেয়ের জামাই শিক্ষক হচ্ছেন। তাদের সন্তানরা শিক্ষক হচ্ছেন। ভিসির দায়িত্ব ছেড়ে বিভাগীয় প্রধান ও ডিন হচ্ছেন। উদ্দেশ্য একটাইÑ নিজের সন্তানকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া। এ প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোথায় নিয়ে যাবে, আমরা তা জানি না। ইউজিসির চেয়ারম্যান নিজেকে ‘স্টেট মিনিস্টার’ পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। কিন্তু তিনি কি পারেন না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে? তার দায়িত্বটা কী? কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে ভাবেন না। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীও তার দায়িত্বটি পালন করছেন না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের টাকায় পরিচালিত হয়। এখানে বারবার অনিয়ম হবে, তা কাম্য হতে পারে না। সরকারের শেষ সময়ে এসে একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সরকার তাও করল না। জগন্নাথে যাকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে, তিনি এখনও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। এমন একজন সক্রিয় ‘রাজনীতিক’ যদি উপাচার্য হন, তাহলে দলীয়করণ আমরা বন্ধ করব কিভাবে?
একই কথা প্রযোজ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। সেখানে যাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিজ সন্তানকে নিয়োগ দিতে চেয়ে তা পারেননি। এক পর্যায়ে প্রোভিসি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর আগে সমাজবিজ্ঞানে ডিন থাকাকালীন অবৈধভাবে তার মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন। পরে সংবাদটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে তিনি তার মেয়ের ভর্তি বাতিল করতে বাধ্য হন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এই সদস্য এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। আমরা দলীয়করণ বন্ধ করব কিভাবে। এই দলীয়করণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একুশ শতকের উপযোগী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে না।
Daily JUGANTOR
19.03.13

চীনে ক্ষমতার পটপরিবর্তন


চীনে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলো। গত বৃহস্পতিবার চীনের পিপলস কংগ্রেসের (পার্লামেন্ট) ভোটাভুটিতে শি জিন পিং নয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এটা অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল। গেল বছরের নভেম্বরে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাধারণ সম্পাদকরাই রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। কংগ্রেসের দুই হাজার ৯৫৬ জন সদস্যের মধ্যে তিনজন অনুপস্থিত ছিলেন। আর একটি ভোট পড়ে তাঁর বিপক্ষে। আর এই ভোটটি তিনি নিজেই দিয়েছেন। এই পালাবদলের মধ্য দিয়ে শি জিন পিং হু জিন তাওয়ের স্থলাভিষিক্ত হলেন। এই পালাবদল শি জিন পিংকে ন্যূনতম ১০ বছর ক্ষমতায় রাখবে। ২০১৭ সালে পরবর্তী পার্টি কংগ্রেস। বলা হয়, চীনে যাঁরা দায়িত্ব নিলেন রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার, তাঁরা 'পঞ্চম জেনারেশন'-এর রাজনীতিবিদ। শি জিন পিংয়ের পাশাপাশি লি ইউয়ান চাও ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং লি খোয়াছিয়াং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই তিন ব্যক্তি আলোচনায় থাকবেন বেশ কিছুদিন।
চীনে নয়া নেতৃত্ব দায়িত্ব নেওয়ায় যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কেমন হবে এখন চীনের রাজনীতি? সংস্কারপ্রক্রিয়া নিয়ে চীন কতদূর যেতে পারবে? যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কই বা কী হবে? চীন-রাশিয়া সম্পর্ক, চীনের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশ, বিশেষ করে তাইওয়ান, জাপান কিংবা ফিলিপাইনের সঙ্গে চীনের সম্পর্কই বা কেমন হবে? বলা ভালো, বিতর্কিত বেশ কয়টি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে এই দেশগুলোর বিরোধ রয়েছে। চীন গেল বছর এই অঞ্চলে যুদ্ধ জাহাজও পাঠিয়েছিল। তবে শি জিন পিংয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি, আমাদের জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। কেননা ব্যক্তিগতভাবে তিনি বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরিচিত। গেল বছর তিনি বাংলাদেশেও এসেছিলেন। বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া যখন গেল বছর চীনে গিয়েছিলেন, তখন শি জিন পিং তাঁকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার মধ্য দিয়ে চীন প্রমাণ করেছিল, তারা বাংলাদেশকে একটি 'ঘনিষ্ঠপ্রতিম বন্ধুরাষ্ট্র' হিসেবেই মনে করে। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ অনেক বেশি। চীন আমাদের উন্নয়নের অংশীদার। নিকট-প্রতিবেশী দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের একজন মনীষী অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য সুদূর চীনেও গিয়েছিলেন। অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতেই দেহত্যাগ করেছিলেন। অন্যদিকে চীনের কূটনীতির জনক হিসেবে যাঁকে চিহ্নিত করা হয়, সেই অ্যাডমিরাল হো প্রায় চার শ বছর আগে এই এলাকা সফর করে গেছেন, যা আজ বাংলাদেশ নামে পরিচিত।
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০১০ সালে জিএনপির দিক থেকে জাপানকে ছাড়িয়ে যায় চীন। যেখানে ১৯৮০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ ভাগ (যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ ভাগ), সেখানে বলা হচ্ছে ২০১৬ সালে ppp- এর হিসাব অনুযায়ী (purchasing, price, parity) চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। উৎপাদনশীল পণ্যের, বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস পণ্যের দিক থেকে চীন এখন এক মহাশক্তি। বিশ্বের যত ফটোকপিয়ার, মাইক্রোওয়েভ ও জুতা উৎপাদিত হয়, তার তিন ভাগের দুই ভাগ চীন একা উৎপাদন করে। সেই সঙ্গে বিশ্বে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ৬০ শতাংশ, ডিভিডির ৫৫ শতাংশ, ডিজিটাল ক্যামেরার ৫০ শতাংশ, পারসোনাল কম্পিউটারের ৩০ শতাংশ, শিশুদের খেলনার ৭৫ শতাংশ চীন একা উৎপাদন করে। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনা পণ্যের একটা বাজার তৈরি হয়েছে। চীনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দুই ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে। ফরচুন ম্যাগাজিন বিশ্বের বড় ৫০০ কম্পানির কথা উল্লেখ করেছে, সেখানে চীনের রয়েছে ৩৭টি কম্পানি। বিশ্বে যত জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে এককভাবে চীনে ব্যবহৃত হয় তার ১৬ শতাংশ। আর বিশ্বে জ্বালানি তেল ব্যবহারের দিক থেকে ৩ ভাগের ১ ভাগ ব্যবহার করে চীন। যে কারণে চীনকে বিশ্বের অন্যতম পরিবেশদূষণকারী দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরিবেশদূষণের কারণে চীনে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেড়েছে ২৯ শতাংশ হারে। চীনের রয়েছে বিশাল এক তরুণ প্রজন্ম, যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রতিবছর ২১ মিলিয়ন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়। আর প্রতিবছর তিন লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যায়। তারা ফিরেও আসে। ১৯৪৮ সালে (স্বাধীনতার ঠিক এক বছর আগে) যেখানে চীনে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ২০ শতাংশ, এখন সেখানে এক শ শতাংশ শিক্ষিত। অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণে চীনে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, তাতে প্রায় ২০ কোটি মানুষকে চীন অতি দরিদ্রতম অবস্থা (প্রতিদিন জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত ১.২৫ ডলার আয় হিসেবে) থেকে বের করে এনে কিছুটা সচ্ছলতা দিয়েছে। যদিও বলা হয়, এখনো প্রায় ২০৭ মিলিয়ন লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটিতে একদিকে যেমনি ধনী ও গরিবের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো এখন কর্মজীবী মানুষের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। মানুষের আয় সেখানে বেশি। হাজার হাজার টাউনশিপ এখন তৈরি হয়েছে, যা বদলে দিয়েছে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জীবনযাত্রা। চীনকে নিয়ে খারাপ খবরও আছে। যেখানে ২০০৯ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশ, ২০১২ সালে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে। মুদ্রাস্ফীতি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ কম। আর শহরে বেকারত্বের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশের নিচে। এই যে চীন, এই চীনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বটি এখন বর্তিয়েছে শি জিন পিংয়ের ঘাড়ে। শেষ পথে এখন চীন? শি জিন পিংয়ের এজেন্ডায় এখন কোন বিষয়টি প্রাধান্য পাবে বেশি- অভ্যন্তরীণ ইস্যু না বৈদেশিক সম্পর্ক? বেশকিছু বিশ্লেষকের লেখা পড়ে যা মনে হয়েছে, তা হচ্ছে- শি জিন এখন প্রথমেই অগ্রাধিকার দেবেন অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে। এক বিশাল দেশ চীন। প্রায় ৫৫ জাতি ও উপজাতি নিয়ে গড়ে উঠেছে চীন। ২২টি প্রদেশ, পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, চারটি বিশেষ অঞ্চল ও ১৪৭টি বিশেষ এলাকা নিয়ে যে চীনা রাষ্ট্র, রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সেই রাষ্ট্রটি ভেঙেও যেতে পারে। এ কারণেই চীনা নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সতর্ক থাকছেন। যে ভুল করেছিলেন গর্বাচেভ, সেই ভুল করেননি চীনা নেতারা। সেনাবাহিনী এখনো পার্টির প্রতি অনুগত। তাই অর্থনৈতিক সংস্কারকেই তাঁরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ফুজিয়ান, ঝে ঝিয়াং কিংবা সাংগাই প্রদেশগুলো তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি সমৃদ্ধিশালী। প্রদেশে প্রদেশে যে বৈষম্য, গ্রাম আর শহরের মধ্যে যে পার্থক্য, তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে শি জিন পিং প্রশাসনকে। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রচুর বয়স্ক লোকের পেনশন-ভাতা নিশ্চিত করা, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা, অসমতা ও দরিদ্রতা দূর করা। এটা হবে নয়া প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজ। দুর্নীতির বিষয়টিও তার অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে। পার্টির সিনিয়র নেতাদের ব্যাপক দুর্নীতির ব্যাপারে এখন চীন ও রাশিয়া বিশ্বে আলোচনার অন্যতম বিষয়। অভিযোগ আছে, সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়া বাও ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের সম্পদের মালিক হয়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তা ব্যাপক আলোচিত হয়। অভিযোগে বলা হয়েছিল, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর মায়ের নামে একটি কম্পানির ১২০ মিলিয়ন ডলারের শেয়ার আছে। খোদ প্রেসিডেন্ট নিজেও অভিযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের সুমবার্গ গ্রুপের মতে, শি পরিবার ৩৭৬ মিলিয়ন ডলারের মালিক। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগ নয়া প্রেসিডেন্টের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে শি জিন পিং বেছে নিয়েছেন আফ্রিকাকে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত 'ব্রিকস' দেশগুলোর (চীন, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন ও আরো দুটি আফ্রিকান দেশ সফর করবেন। অনেকেই জানেন, আফ্রিকায় প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে চীনের। আফ্রিকার জ্বালানিসম্পদ উত্তোলনে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে। চীন আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করে। আর 'ব্রিকস' হচ্ছে বড় অর্থনীতির দেশগুলোর একটি গ্রুপ, যারা আগামী দুই দশকের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। চীনের গুরুত্ব এ কারণেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক যা ছিল, তাতে কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। বেশ কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মনে করে Responsible stakeholder। আর জেমস স্ট্রাইনবার্গের ভাষায়- Strategic reassurance হচ্ছে এই সম্পর্কের ভিত্তি। ওবামা বলেছিলেন, as important as any in the world- যুক্তি হিসেবে এটা ঠিক আছে। অবশ্যই চীন বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কিন্তু প্যাসিফিক অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে দেশ দুটো বিপদে জড়িয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যে Trans Pacific partnership-এর কর্মসূচি বহন করেছে, তা চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে জটিলতা তৈরি করতে পারে। অনেকেই জানেন, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে তার সামরিক (বিশেষ করে নৌবাহিনীর উপস্থিতি) উপস্থিতি বাড়িয়েছে (বাংলাদেশ এই স্ট্র্যাটেজির আওতায়)। ফলে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এবং ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করবে যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে অর্থাৎ ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। ২০০৭ সালের পর থেকে শ্রীলঙ্কা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার সমন্বয়ে এ অঞ্চলে যে 'ঐক্য' গড়ে উঠেছে (প্রিমাকভ ডকট্রিন), তা মার্কিন স্বার্থকেও আঘাত করছে। গেল সপ্তাহে ওবামা বলেছেন, ইরান আগামী এক দশকের মধ্যে পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির মূল কারণ দুটি- একদিকে ইরানের উত্থানকে চ্যালেঞ্জ করা, অন্যদিকে ধীরে ধীরে চীনকে ঘিরে ফেলা। অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার যে নীতি (ফনটেইনমেন্ট থিওরি) যুক্তরাষ্ট্র বহন করেছিল, তার মতো। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে শি জিন পিং নিজে অবগত। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন। তখন তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, 'এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো কোনো ভালো কূটনীতির পরিচয় দেয় না।' এ বক্তব্য প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকাকে চীন ভালো চোখে দেখছে না।
চীন অনেক বদলে গেছে। চীন এখন আর মার্কসবাদী-মাওবাদী আদর্শে বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্র নয়। তবে মাওবাদকে তারা পুরোপুরি পরিত্যাগ করছে- তাও বলা যাবে না। জীবনযাত্রার মানের উন্নতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাদের কাছে এখন প্রধান্য। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর Neo Authoritarianism নেতৃত্ব, লাতিন আমেরিকার Corporatism এবং পশ্চিম ইউরোপের Social Democracy-র সমন্বয়ে চীন এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। এই রাজনীতি থেকে ফেরার আর পথ নেই। তাই শি জিন পিংয়ের নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে থাকবে সারা বিশ্ব। তিনি চীনে আরো সংস্কার আনেন কি না সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।Daily KALERKONTHO18.03.13

এ কী কথা বললেন প্রণব মুখার্জি


প্রণব মুখার্জি ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেও, আমাদের ‘জামাইবাবু’। বাংলাদেশে তার ‘হাই প্রোফাইল ভিজিটের’ পর এখন অনেক কথা আকাশে-বাতাসে ভাসছে। ৫ মার্চ ঢাকা থেকে নয়াদিল্লি যাবার পথে বিমানে ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে যেসব মন্তব্য তিনি করলেন, তা নিয়েও নানা কথা। তার ঢাকা সফরের পর ভারতীয় বাংলা সংবাদপত্রে যেসব কথা লেখা হয়েছে, কিংবা মমতা ব্যানার্জির যে মন্তব্য ছাপা হয়েছে, তা স্পষ্ট করেই আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে প্রণব মুখার্জি ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ নিয়েই ঢাকায় এসেছিলেন এবং দ্বি-পাক্ষিক সমস্যা সমধানের ব্যাপারে তার আগ্রহ তেমন ছিল না। প্রণব মুখার্জি একটি দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বলতে পারেন না। অনেক সময় এটা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ বলে গণ্য করা হয়। জাতিসংঘের চার্টারে এ ধরনের হস্তক্ষেপ পরিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, প্রণব মুখার্জি বিমানে ফিরে যাবার সময় ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে এমন সব মন্তব্য করলেন, যা তিনি করতে পারেন না এবং যা ‘হস্তক্ষেপ’ হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। শাহবাগীদের ব্যাপারে তিনি যা বলেছেন, তা সংবাদ প্রতিদিনের (৫ মার্চ) গৌতম লাহিড়ী লিখেছেন, ‘আমি প্রাণবন্ত জনতার উল্লাস দেখেছি। এরা গণতন্ত্র, সহনশীলতা, এক অনন্তমুখী সমাজ, মুক্ত সংবাদ মাধ্যম এবং এক আধুনিক প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়তে বদ্ধপরিকর’। প্রণব মুখার্জির বক্তব্য উদ্ধৃতি করে লাহিড়ী আরো লিখেছেন, এরা  মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় এবং সেই আদর্শে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সুসংহত করতে চায়। একি কথা বললেন তিনি!  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সরকারের ভেতরকার দুর্নীতি, পদ্মা সেতুর কেলেঙ্কারি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে যে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে চালিত করার জন্যই এই নাটক। শাহবাগে যারা অংশ নিয়েছেন, সংগঠিত করেছেন, তারা সবাই সরকার তথা মহাজোটের (জাতীয় পার্টি বাদে) শরিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ছাত্র সংগঠনের নেতা ও কর্মী। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির সহযোগিতায় তারা দিনের পর দিন অবস্থান করেছেন। এই ঘটনা প্রণব বাবুর জানার কথা। তিনি কী করে বললেন, শাহবাগীরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর? তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তি নিয়ে তিনি যা বলেছেন, সেটাও একটা নাটক। তিস্তা চুক্তি হবে, এ কথা বললেও, তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতার সাথে তার কথা হয়নি। সে কথা মমতা নিজেই ফাঁস করে দিয়েছেন। মমতা যে অসন্তুষ্ট, সে কথাটাও তিনি জানিয়েছেন। ৩ মার্চ ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সালমান খুরশীদের বক্তব্য উদ্ধৃতি করে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। উক্ত সংবাদে বলা হয়েছে প্রয়োজনে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে নয়াদিল্লি সংবিধান সংশোধন করতেও রাজি। রাজ্যের মতামতের গুরুত্ব থাকায় কেন্দ্র কখনো এককভাবে কোনো চুক্তি করতে পারে না। কিন্তু এই সংবিধান সংশোধন করাও সহজ হবে না। কেননা বিজেপির সমর্থন এতে পাওয়া যাবে না। এমনকি ভারতের রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সীমান্ত সমস্যার সমাধান হবে বলে মন্তব্য করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এটি নিয়েও সমস্যা রয়েছে। সীমান্ত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে সংবিধান সংশোধন জরুরি। বাংলাদেশ-ভারত একটি সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল ১৯৭৪ সালে। বাংলাদেশ ওই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে সংবিধানে সংশোধনী এনেছে (তৃতীয় সংশোধনী, ১৯৭৪)। কিন্তু দীর্ঘ ৩৯ বছরেও ভারত তাদের সংবিধানে সংশোধনী এনে চুক্তিটি ‘রেটিফাই’ করেনি। ফলে সিটমহলগুলো নিয়ে যে সমস্যা তা রয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আছে ১৭ হাজার ১৪৯ একর ভারতীয় ভূমি। আর ভারতের ভূখণ্ডে আছে ৭ হাজার ১১১ একর বাংলাদেশী ভূমি। এসব অঞ্চলের মানুষ এক মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জি সীমান্ত সমস্যার সমাধানের কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। দীর্ঘদিন পর ভারতীয় মন্ত্রিসভায় ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদিত হলেও সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নটি এর সাথে জড়িত। সংবিধান সংশোধনে কংগ্রেস সমর্থন পাবে না প্রধান বিরোধী দল বিজেপির। মন্ত্রিসভায় মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদন ও কংগ্রেস কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও, বিজেপি বলছে, তারা এই সংশোধনীর বিরোধিতা করবে। ফলে সমস্যা যা ছিল তা রয়ে যাবে। বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের পর এ কথাটা জানাতে ভোলেননি।
প্রণব মুখার্জির আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন নেই। হয়তো তিনি সত্যি সত্যিই চান সমস্যাগুলোর সমাধান হোক! কিন্তু সমস্যা ভারতের আমলাতন্ত্র নিয়ে। সেই সাথে রয়েছে ভারতের নীতি নির্ধারকদের ‘মাইন্ড সেটআপ’। তারা বাংলাদেশকে কখনো সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেছে, এটা আমি মনে করি না। ভারত বড় দেশ। আগামি ৩০ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি হবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। ভারতে প্রচণ্ড দারিদ্র্যতা থাকলেও, আগামি ৩০ বছরের মধ্যে মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলার। ভারতের এই অর্থনীতি আমাদের অর্থনীতিকেও গ্রাস করবে। আমাদের উন্নয়নে ভারত একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে তেমনটি হচ্ছে না। দেখা গেছে দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজালে ভারত এককভাবে সুবিধা নিচ্ছে। বিভিন্ন ইস্যুতে যে সমস্যা রয়েছে তা সমাধানে ভারতের আগ্রহ কম। সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়ায় তা বাংলাদেশী মানুষদের ভারত বিদ্বেষী করে তুলেছে। ভারতীয় ঋণে ১৩টি প্রকল্প নির্ধারিত হলেও গত ২ বছরে মাত্র ২টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশী পণ্যের আমদানি বাড়ায়নি ভারত। নানা ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাঁধায় বাংলাদেশী পণ্য চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। বন্দী প্রত্যার্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তাতে ভারতের স্বার্থ বেশি। কানেকটিভিটির আড়ালে ভারতকে ট্রানজিট বা করিডোর দিলেও, নেপাল ও ভূটানের জন্য তা সম্প্রসারিত হয়নি। পানি ব্যবস্থাপনার কথা প্রণব মুখার্জি বলেছেন বটে, কিন্তু এখানে ভারতের কোনো উদ্যোগ কখনও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ২০১১ সালে মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূটান, ভারত, নেপাল ও চীনকে নিয়ে ‘গঙ্গা নদী অববাহিকা সংস্থা’ ও ‘ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা সংস্থা’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ভারত তাতে সাড়া দেয়নি। বাংলাদেশের প্রচণ্ড বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাতে সিকিম থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথা বাংলাদেশ বললেও, ভারত তাতে সম্মতি দেয়নি (ভারতীয় এলাকার উপর দিয়ে এই বিদ্যুৎ আনতে হবে)। ‘কুনমিং উদ্যোগ’ এর ব্যাপারেও ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প কিংবা টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে শঙ্কা, সে শঙ্কা দূর করতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি ভারত। স্বয়ং একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। সমুদ্রসীমা নিয়েও ভারতের সাথে আমাদের বিপদ আছে, যা এখন হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন।
তাই প্রণব বাবুর ঢাকা সফরের পর যে প্রশ্নটি থেকেই গেল, তা হচ্ছে এই সফরের পর সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা আছে, তা কী কাঁটবে? এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। ভারতীয় ‘মাইনড সেটআপ’-এ যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উন্নতি আসবে না। ভারতকে উদার মনোভাব নিয়ে আসতে হবে। আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাধিক ভারতীয় মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন। বাংলাদেশের একাধিক মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা একধাকিবার ভারত সফর করেছেন। এর মধ্যে দিয়ে ভারত আমাদের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানা কারণে। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজনীতি, তাতে ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ‘ঐক্য’ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশ সেই প্রভাবের বাইরে থাকতে পারে না। উপরন্তু ভারত একটি অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্ব ব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলীর মতে আগামি ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। তখন মাথাপিছু আয় ৯৪০ ডলার থেকে ২২ হাজার ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত যেখানে অবদান রাখতো মাত্র ২ ভাগ, তখন অবদান রাখবে ১৭ ভাগ। সুতরাং এই অর্থনীতির প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশের উপর পড়বেই। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন একটি বড় দেশের পাশে যদি একটি ছোট দেশ থাকে, তাহলে ওই বড় দেশ ছোট দেশের উপর প্রভাব খাটায়। মেদভেদেভ (সাবেক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী) এর ধারণা ‘তড়হব ড়ভ চৎরারষবমবফ ওহঃবৎবংঃ’ অনেকটা এ ধারণাকেই সমর্থন করে। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে অতিমাত্রায় ‘ভারতমুখীতা’ সাম্প্রতিককালে বিতর্কের মাত্রা বাড়ালেও, বাস্তবতা হচ্ছে আমরা ভারতের ‘প্রভাব’ থেকে বের হয়ে আসতে পারছি না। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা এক জায়গাতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি। আমাদের ‘প্রাপ্তি’ এখানে কম, ভারতের ‘প্রাপ্তি’ অনেক বেশি। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ২০১০ সালেই প্রধানমন্ত্রী ভারত গেছেন। ফিরতি সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসেন ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। এ ধরনের সফর ও পাল্টা সফরের মধ্যে দিয়ে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি ‘ফ্যাক্টর’। বেগম জিয়া এটাকে বিবেচনায় নিয়েই ভারতে গিয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বেগম জিয়া ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। চীন সফরের সময় চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শিন জিন পিং, যিনি মার্চে (২০১৩) প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, বেগম জিয়াকে সাক্ষাৎকার দেন। সুতরাং দেখা গেল বেগম জিয়া যখন ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে আস্থায় নিতে চেয়েছিলেন, তখন উল্টো ভারতীয় নেতৃবৃন্দ মহাজোট সরকারকেই ‘প্রমোট’ করছে। প্রণব বাবুর ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে ‘শাহবাগ নাটকের’ দ্বিতীয় অংশ মঞ্চস্থ হলো। প্রণব বাবু প্রকারান্তরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকেই সমর্থন করে গেলেন।  প্রণব বাবুর সফরের পুরোটা সময় মানুষ দেখেছে লাশের মিছিল। কিন্তু একবারও তিনি এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করলেন না। সাধারণ মানুষের হত্যাকাণ্ড তার কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি, বড় হয়ে দেখা দিয়েছে শাহবাগীদের আন্দোলন। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে তরুণ প্রজন্মকে উস্কে দিয়েছে মহাজোট সরকার। ১৯৭৩ সালে যাদেরকে আমরা দেখেছিলাম তিন দলীয় ঐক্যজোট গঠন করতে (যা বাকশালে রূপান্তরিত হয়েছিল), সেইসব মুখগুলো ও তাদের ছাত্র সংগঠন আজ শাহবাগে তৎপর। উদ্দেশ্য একটাই ১৯৭৫ সালের মতোই দেশ থেকে সব বিরোধী দলকে উৎখাত করা। প্রণব বাবুকে বাংলাদেশের মানুষ সম্মান জানিয়েছে। ‘জামাই’ হিসেবে তাকে বরণ করে নিয়েছে।  তার পদের প্রতি তিনি সুবিচার করেননি।
15.03.13

ইতিহাস কীভাবে চাভেজকে স্মরণে রাখবে






ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট উগো চাভেজের মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি এখন বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে তা হলো, ইতিহাস এখন কীভাবে চাভেজকে স্মরণে রাখবে? একজন সমাজ সংস্কারক, যিনি ভেনিজুয়েলার Mestizo বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে একটি নতুন জীবন দিয়েছিলেন? নাকি একজন ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্রী’, যিনি সিমন বলিভারের আদর্শ অনুসরণ করে পুরো লাতিন আমেরিকা থেকে মার্কিন স্বার্থ উত্খাত করতে চেয়েছিলেন? সত্যিই একজন বিপ্লবী, যিনি লেনিন, মাও জে ডং, হো চে মিন আর কাস্ত্রোর পাশে নিজের নামটিও লেখাতে চেয়েছিলেন? এক ধরনের ‘পপুলিজমে’র জন্ম দিয়েছিলেন চাভেজ। লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে এ ধরনের ‘পপুলিজম’ বা জনস্বার্থ-সম্পর্কিত আন্দোলন নতুন কোনো ঘটনা নয়। আর্জেন্টিনায় পেরেন, কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো কিংবা ব্রাজিলের লুলা ডিসিলভা এক ধরনের ‘পপুলিজমে’র জন্ম দিয়েছিলেন, যা তাদেরকে নিজ নিজ দেশে তো বটেই, পুরো লাতিন আমেরিকায় একেকজন প্রবাদ পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ কাতারে যোগ হলো চাভেজের নাম। তবে কিছুটা পার্থক্য তো রয়েছেই। এরা সবাই ছিলেন জাতীয়তাবাদী। নিজ দেশের স্বার্থ তাদের কাছে ছিল বড়। আর চাভেজ নিজ দেশের বাইরে গিয়ে সমগ্র লাতিন আমেরিকার ‘মুক্তির’ স্বপ্ন দেখতেন। ভেনিজুয়েলার বিপুল জ্বালানি সম্পদ ও এর ব্যবহার তাকে এ স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করেছিল। তাই আর্জেন্টিনায় পেরেন যা পারেননি, লুলা ব্রাজিলে যা পারেননি কিংবা ফিদেল কাস্ত্রো যেখানে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে উগো চাভেজ ছিলেন সার্থক। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। এমনকি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের অপতত্পরতারও বিরোধী ছিলেন তিনি। একসময় ভেনিজুয়েলা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০০৭ সালে তিনি সব ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে তিনি গঠন করেছিলেন ‘ব্যাংক অব সাউথ’। উদ্দেশ্য ছিল, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ‘দুষ্টচক্র’ থেকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে বের করে আনা। এ ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে অর্থের জোগান যেত গরিব দেশগুলোয়। শুধু তাই নয়, তার দেশ লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলোয় কম দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ করত। এত দিন মনে করা হতো, সৌদি আরবে রয়েছে বিশ্বের জ্বালানি তেলের বড় ভাণ্ডার। এখন জানা গেল, এ ভাণ্ডার রয়েছে ভেনিজুয়েলায়। এ অঞ্চলের দেশগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভেনিজুয়েলার জ্বালানি তেল পালন করছে একটি বড় ভূমিকা। গ্রহীতা দেশগুলো পণ্যের বিনিময়ে এ অর্থ পরিশোধ করে। উগো চাভেজ ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নে একটি কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। সেখানে কাজ করছেন কিউবার ডাক্তার, নার্স, শিক্ষকসহ ইঞ্জিনিয়াররা। আর এ প্রকল্পের পুরো অর্থ বহন করছে ভেনিজুয়েলা। কিন্তু তাই বলে উগো চাভেজ তার নিজের রাজনীতি চাপিয়ে দেননি ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর ওপর।
১৫ বছর আগেও ভেনিজুয়েলা ছিল একটি বস্তির নগরী। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক। সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ছিল বড় বৈষম্য। চাভেজ ক্ষমতায় এসে বদলে দিলেন সবকিছু। তিনি এমন এক গণতান্ত্রিক সমাজের জন্ম সেখানে দিয়েছেন; যেখানে গরিব মানুষ, যাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় boli bourgeoisie, তারা এখন ক্ষমতার অংশ। ভেনিজুয়েলার ৯০ শতাংশ মানুষ এখন তিনবেলাই খেতে পারে। বিশ্বের পঞ্চম সুখী দেশ হচ্ছে ভেনিজুয়েলা। সরকারি জমি তিনি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। খাদ্যনিরাপত্তা গড়ে তুলেছেন। ২০০৪ সালের পর থেকে মাথাপিছু জিডিপি ২৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১১ সময়সীমায় তিনি দেশটির দারিদ্র্য কমিয়েছেন তিন ভাগের দুই ভাগ। বেকারত্ব যেখানে ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ, তা তিনি ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছিলেন।
যারা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন, তারা দুটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত— Ecomomic Democracy ও participatiory Democracy. চাভেজ এ দুুটিরই সফল প্রয়োগ করেছিলেন ভেনিজুয়েলায়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত; সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিনে পয়সায় কলেজে পড়া, ওষুধ প্রাপ্তিসহ সবার জন্য ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান, নারীর অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভেনিজুয়েলার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, যার সঙ্গে বোধকরি স্ক্যান্ডেনেভিয়ার সোস্যাল ডেমোক্রেসির মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। চাভেজ তার এ পরিবর্তনের আন্দোলনকে বলতেন Bolivarian Revolution। বলিভিয়ার সাধারণ মানুষ তাকে মুক্তিদাতা হিসেবে মনে করত। মেরুন রঙ ছিল তার সিম্বল। তার ডাকে হাজার হাজার মানুষ মেরুন রঙের শার্ট পরে রাস্তায় বের হতো। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। গণতান্ত্রিক সমাজে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু ভেনিজুয়েলায় Bolivarian Revolution-এর ব্যাখ্যাটা ভিন্ন। কলকাতায় এসেছিলেন তিনি ২০০৬ সালে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি রেভলিউশনে বিশ্বাসী। এটা এক নতুন ধরনের বিপ্লব, যার সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো বিরোধ থাকবে না। আমি মনে করি, রেভলিউশনারি ডেমোক্রেসি— এটাই আজকের নতুন পথ।’ গণতন্ত্রকে লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে নতুন একটি রূপ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। আর এটা করতে গিয়ে তিনি সিমন বলিভারকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। চাভেজ মনে করতেন, কোনো দেশ কারো মডেল হতে পারে না। তিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী ভাবলেও চীন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মডেল নয়, এটাও তিনি বলেছেন একাধিকবার। কিন্তু তার এই মেসেজ পৌঁছে দিয়েছিল পুঁজিবাদী বিশ্বে। আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো ছিল তার বিরুদ্ধে। তারা চাভেজের সামাজিক প্রোগ্রামগুলোর ব্যাপারেও অসন্তুষ্ট ছিল। শুধু বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোই নয়, বরং মার্কিন বিলিয়নেয়ার কচ ব্রাদার্স ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হাইনজ (Heinz)-এর সঙ্গেও তিনি বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অনেকেই হয়তো জানেন না, এ কোম্পানির মালিক মিসেস হাইনজ হচ্ছেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির স্ত্রী। হাইনজ কোম্পানির (যারা কেচআপ তৈরি করে) বিশাল বিনিয়োগ ছিল ভেনিজুয়েলায়। শত শত বিঘা সরকারি সম্পত্তি হাইনজ তাদের নামে বন্দোবস্ত নিয়েছিল এবং সেখানে টমেটোর বাগান করেছিল। চাভেজ ক্ষমতায় এসে ওই বন্দোবস্ত বাতিল করে দেন। ফলে হাইনজ কোম্পানি তার কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে এবং শ্রমিকদের বরখাস্ত করে ২০০১ সালে। চাভেজ বন্ধ কারখানা জাতীয়করণসহ সব শ্রমিককে পুনর্বহাল করেছিলেন।
চাভেজের একটা বড় অবদান হচ্ছে— দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে তিনি ভেনিজুয়েলার নাগরিকদের বের করে আনতে পেরেছিলেন। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে ভেনিজুয়েলার জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ, যারা negro e indio (Black and Indian) হিসেবে পরিচিত (জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ), তারা থাকত অনেকটা বস্তিঘরে। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ছিল না। আজ প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধ, সব ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, শিক্ষা নিশ্চিত করেছেন চাভেজ। দারিদ্র্য কমিয়ে এনেছেন। ১৯৯৮ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ, সেখানে ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে। এ পরিসংখ্যান জাতিসংঘের। ১৮টি লাতিন আমেরিকাভুক্ত দেশের মধ্যে ভেনিজুয়েলার আর্থসামাজিক অবস্থা সবচেয়ে ভালো। রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও আয় বণ্টনের দিক দিয়ে ভেনিজুয়েলার অবস্থান তৃতীয়। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুয়ায়ী, ভেনিজুয়েলায় বর্তমানে ৫০ মিলিয়ন মধ্যবিত্ত রয়েছে, যারা এক নতুন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে সেখানে। তাকে বলা হয় এ যুগের ‘সিমন বলিভার’। সিমন বলিভার স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলেন। আর চাভেজ যুদ্ধ করে গেছেন বিশ্বব্যাপী মার্কিন আগ্রাসানের বিরুদ্ধে। এটা করতে গিয়ে কিংবা বলা যেতে পারে তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকার কারণে বলিভিয়ার মোরালেস, ইকুয়েডরের রাফায়েল কিংবা নিকারাগুয়ার ওর্তেগার সঙ্গে তার রাজনৈতিক সখ্য তৈরি হলেও বিপরীত রাজনীতির অধিকারী ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল চমত্কার। জীবিতকালে তিনি লিবিয়ার প্রয়াত নেতা গাদ্দাফির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। একই সঙ্গে শেষ দিন পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকেও সমর্থন করে গেছেন তিনি। এর পেছনে কাজ করেছিল তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা। লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে তিনি গঠন করেছিলেন The Bolivarian Alliance For the peoples of our America (ALBA) নামক সংগঠনটি, যার সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১০। সিমন বলিভার সমগ্র লাতিন আমেরিকার জনগণকে American হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছিলেন। চাভেজও বলতেন সে কথা। একই সঙ্গে The commuinity of latin American and caribbean states (CELAC) গঠনের উদ্যোক্তাও তিনি। দরিদ্র, বস্তিবাসী সাধারণ মানুষকে নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তার দর্শন ছিল সামাজিক ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করা। এটা করতে গিয়ে তিনি সিমন বলিভারের মতো বিপ্লবীকে বেছে নিয়েছেন আদর্শ হিসেবে। বলতেন,
‘Bolivar is the fight that does not end, he is born everyday in ourselves, in his people, in the children, in the fight for life and social justice.’ কেউ কেউ তার এ আন্দোলনকে চিহ্নিত করেছেন Chavismo হিসেবে। কিন্তু একটি প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই উঠেছে। Bolivarian revolution or Chavismo যে নামেই এ আন্দোলনকে চিহ্নিত করা হোক না কেন, তার এখন কী হবে? এ আন্দোলন কি ভেঙে যাবে? শয়তান হিসেবে আখ্যায়িত করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক রকম যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন চাভেজ। চীন থেকে ইরান, যেখানেই মার্কিন বিরোধিতা আছে সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন সংহতি প্রকাশের জন্য। কিন্তু এখন? নিকোলাস মাদুরো এখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। একটা সংকট থেকেই গেল। বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো এখন সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান কিংবা সংঘাত, হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি করে সুযোগ নিতে পারে। কেননা ভেনিজুয়েলায় রয়েছে তাদের বড় স্বার্থ। মাদুরো কিংবা বিরোধী পক্ষকে তারা ব্যবহার করতে চাইবে। মাদুরোকে চাভেজই বেছে নিয়েছিলেন। একজন সামান্য বাস ড্রাইভার থেকে মাদুরো এখন রাষ্ট্রপ্রধান। চাভেজের মতো তার সেই ক্যারিশমা নেই, তবে বাস্তবতা হচ্ছে— লাতিন আমেরিকায় বিশেষ করে বলিভিয়া, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে এই Bolivarian Revolution। একুশ শতক প্রত্যক্ষ করছে এক নতুন ধরনের ‘পপুলিজম’। Kevin zeese and Margaret Flowers এর ভাষায়, This Revolution Which is not limited to Venezuela, is likely to show to itself and the world that it is deep and strong, the people powered transformation with which Chavez was in solidarity will continue. এটাই হচ্ছে আসল কথা। যে আন্দোলন চাভেজ শুরু করেছেন, তা অব্যাহত থাকবে।
Daily BONIK BARTA
15.03.13