পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঢাকায় আসছেন, এটা একটা বড় খবর এই মুহূর্তে। এতে করে একটা ধারণার জš§ হয়েছে যে, মমতার দ্বিতীয়বার ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে তিস্তার পানি বণ্টনের একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে! কতটুকু আস্থা রাখা যায় মমতার ওপর? তিনি বাংলাদেশকে কতটুকুইবা ছাড় দেবেন! অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা গেল একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সৌজন্য সাক্ষাতে তিনি কলকাতায় ইলিশ রফতানির কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কৌতুক করে বলেছিলেন তিস্তায় পানি দেয়ার কথা। তার জন্য খাবারের তালিকায় ইলিশ ছিল ৪ পদের। ইলিশের প্রতি তার একটি বিশেষ টান আছে। এর আগে মমতা যখন দিল্লিতে রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে যারাই নয়াদিল্লি গেছেন (বিশেষ করে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী), তারা অবধারিতভাবেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন ‘পদ্মার ইলিশ।’ তাই ইলিশ প্রসঙ্গ এসেছিল (আপাতত রফতানি বন্ধ)। কিন্তু পুরো জাতি ও মিডিয়া তখন তাকিয়ে ছিল যে মমতা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার অনাপত্তির কথা জানিয়ে যাবেন। কেননা তিস্তায় পানি বণ্টনের সমস্যা একটাই আর তা হচ্ছে মমতা। মমতার আপত্তির মুখে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখনো মমতার আসার কথা ছিল। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী এলেও শেষ মুহূর্তে মমতা তার আপত্তির কথা জানান। ফলে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আর করা হয়নি। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে মমতার দৃষ্টিভঙ্গির কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? প্রধানমন্ত্রী কৌতুক করে বলেছিলেন তিস্তায় পানি দেয়ার কথা। তার জন্য খাবারের তালিকায় ইলিশ ছিল ৪ পদের। ইলিশের প্রতি তার একটি বিশেষ টান আছে। এর আগে মমতা যখন দিল্লিতে রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে যারাই নয়াদিল্লি গেছেন (বিশেষ করে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী), তারা অবধারিতভাবেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন ‘পদ্মার ইলিশ।’ তাই ইলিশ প্রসঙ্গ এসেছিল (আপাতত রফতানি বন্ধ)। কিন্তু পুরো জাতি ও মিডিয়া তখন তাকিয়ে ছিল যে মমতা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার অনাপত্তির কথা জানিয়ে যাবেন। কেননা তিস্তায় পানি বণ্টনের সমস্যা একটাই আর তা হচ্ছে মমতা। মমতার আপত্তির মুখে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখনো মমতার আসার কথা ছিল। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী এলেও শেষ মুহূর্তে মমতা তার আপত্তির কথা জানান। ফলে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আর করা হয়নি। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে মমতার দৃষ্টিভঙ্গির কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি ‘দু’দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানের আশ্বাস’ দিয়েছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন এ কথাটা। এর আগে ভারতীয় হাইকমিশন কর্তৃক আয়োজিত ‘বৈঠকী বাংলা’য়ও মমতা নিজেই বলেছিলেন তার ওপর ‘আস্থা’ রাখতে! স্থলসীমানা চুক্তি নিয়ে তার আপত্তি নেইÑএটা অবশ্য তিনি প্রমাণ করেছেন। ঢাকাতেও এ কথাটা পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন মমতা। কিন্তু তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে তার ‘কমিটমেন্ট’ কোথায়? সোজা সাপটা হিসাব হচ্ছে তিনি ঢাকায় এসে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে এবারো কোনো ‘কমিটমেন্ট’ করে যাবেন না। এটাই মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক চরিত্র। যেখানে স্বার্থ রয়েছে, সেখানে মমতা আছেন। তিস্তার পানির ব্যাপারে তার স্বার্থ অনেক বেশি। ২০১৬ সালে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। এটাকে তিনি বিজেপির হাতে তুলে দিতে চান না। উত্তরবঙ্গে পানির চাহিদা বেশি। মমতা এটা জানেন ও বোঝেন। বলা ভালো, ১৯ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রাক্কালে তিস্তায় পানির সর্বনি¤œ প্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছিল। এটা কাকতলীয় কিনা জানি না। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ক’টি বিষয় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে তার মাঝে তিস্তার পানি বণ্টন অন্যতম। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটা আগ্রহ থাকলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। সেই মমতা ব্যানার্জিই এখন আবার ঢাকায় আসছেন। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার ঢাকা আসার কথা থাকলেও তিনি আসেননি। তিস্তায় পানি বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেক বেশি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি (২০১৫) সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় ওই মাসের প্রথম ৫ দিনে তিস্তার পানি প্রবাহ ৫০০ কিউসেকের নিচে নেমে যায়। সেচ প্রকল্পে পানি দেয়া দূরের কথা; শুধু নদী বাঁচানোর জন্যই দরকার এক হাজার কিউসেক। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা আজ মৃত্যুমুখে। গত নভেম্বর থেকেই তিস্তার পানি প্রবাহ কমতে থাকে। বাংলাদেশের লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীতে ইতিহাসের সবচেয়ে কম পানি প্রবাহ রেকর্ড হয়। ফেব্রুয়ারি (২০১৫) মাসের প্রথম চার দিনের হিসাবে দেখা গেছে প্রথম দিন পাওয়া গেছে ৪২৬ কিউসেক, দ্বিতীয় দিন ৪৭৫ কিউসেক, তৃতীয় দিন ৪৪৫ কিউসেক আর চতুর্থ দিন ৪১৬ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয় (সকালের খবর, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। যৌথ নদী কমিশন সূত্র জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি প্রবাহ ভালো ছিল বলে তুলনার জন্য এই সময়কালের হিসাবকে ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ ধরা হয়। ওই ১২ বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম ১০ দিনে পানি প্রবাহ ছিল ৫৯৮৬ কিউসেক। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা নেমে আসে ৯৬৩ কিউসেকে। এ বছর নামল ৫০০ কিউসেকের নিচে। অথচ নদী রক্ষার জন্যই দরকার ১ হাজার কিউসেক পানি। আর বিদ্যমান সেচ প্রকল্পের জন্য আরো সাড়ে ৩ হাজার কিউসেক পানি দরকার। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি ‘নোট ভারবাল’ পাঠানো হয়েছে, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
মমতা ব্যানার্জির প্রথম ঢাকা সফরের আগে আমরা অনেক প্রত্যাশার কথা শুনেছি। তবে এটা সত্য, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে এটা সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতি-নির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে তিস্তায় পানি প্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থন এটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু’দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরো একটা বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচ কাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু।’
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন’কে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তি’টি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরো আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমি বিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদে প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।
তিস্তায় পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ এই নিরাপত্তার বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে পারে না। এখন ঢাকায় দেয়া মমতার আগের বক্তব্যকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? তার ওপর আমাদের আস্থা রাখতে বলেছেন। কিন্তু আমরা আস্থাটা রাখি কিভাবে? ভারতীয় রাজনীতিতে ‘মোস্ট আনপ্রেডিকটেবল ক্যারেক্টার’ হচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। তার কথার কোনো মূল্য নেই। তার অতীত বলে, তিনি এক সময় কংগ্রেসের মিত্র ছিলেন। আবার বেরিয়ে গেছেন। বিজেপির মিত্র ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। আবার বেরিয়ে গেছেন। সুতরাং তার ওপর আস্থা রাখাটা কঠিন। তিনি যদি সত্যিই আন্তরিক হন, তাহলে তিনি কল্যাণ রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিজে এই কমিশন গঠন করেছিলেন। কলকাতার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রুদ্র কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেয়া রিপোর্টে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গকে ক্ষতি না করেও বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব। তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন আরেকজন পানি বিশেষজ্ঞ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক প্রণব কুমার রায়। অধ্যাপক রায়ের অভিমত হচ্ছে তিস্তায় পানি নেই কথাটা ঠিক নয়। পানি মজুদ রাখা (বর্ষা মৌসুমে) ও ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
ঢাকায় মমতা ব্যানার্জি আসছেন শুধু নরেন্দ্র মোদির স্বার্থকে বিবেচনা করে। বাংলাদেশের স্বার্থ তার কাছে প্রাধান্য নয়। একটি ‘প্যাকেজ ডিল’-এর আওতায় তিনি মোদিকে স্থলসীমানা চুক্তিতে সমর্থন জানিয়েছেন। মোদি তাকে আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এখন সেই ‘প্যাকেজ ডিল’-এর আওতায় নরেন্দ্র মোদির সফরসঙ্গী হবেন। এমনিতেই সারদা কেলেঙ্কারি ও তৃণমূলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন নিয়ে সিবিআই-এর নজরদারিতে তিনি আছেন। ফলে মোদির সঙ্গে সম্পর্কটা দৃঢ় করে তিনি ‘সমস্যাগুলো’ থেকে বের হয়ে আসতে চান। এই মুহূর্তে তিনি তিস্তা চুক্তি চান না। সম্ভবত মোদি এটা বোঝেন ও উপলব্ধি করেন। মোদির অগ্রাধিকার তালিকায় তিস্তা নেই, আছে কানেকটিভিটি। ফলে মমতা এলেও তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আশাবাদী কিছু ঘটবে না।
Daily Manobkontho
01,06.15
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In his Office at UGC Bangladesh
Prof Rahman With US Congressman Joseph Crowley
here you go!!!
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
During his stay in Germany
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
At Fatih University, Turkey during his recent visit.
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In front of an Ethnic Mud House in Mexico
মোদি ম্যাজিক ও ভারতের বাস্তবতা
17:08
No comments
২৬
মে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার এক বছর পার
করেছেন। ঠিক একই সময় বাংলাদেশের কোনো কোনো সংবাদপত্রে একটি ছোট্ট সংবাদ
ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতের মধ্য প্রদেশের একজন কৃষক লাল সিং
কৃষিঋণ শোধ করতে না পারায় তার দুই সন্তানকে ৩৫ হাজার রুপিতে এক বছরের জন্য
রাখাল হিসেবে বিক্রি করেছেন! কৃষক লাল সিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ঋণশোধ ও
পরের মৌসুমে ফসল চাষের টাকা জোগাতে সন্তান বিক্রি করা ছাড়া তার কাছে কোনো
বিকল্প ছিল না। ভারতে মধ্যপ্রদেশসহ বেশ ক’টি রাজ্যে কৃষক ঋণের টাকা শোধ
করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কৃষক লাল সিং আত্মহত্যা করেননি বটে,
কিন্তু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের জনসভায় প্রকাশ্যেই একজন কৃষক
আত্মহত্যা করেছিলেন। ওই ঘটনা তখন ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল।
ভারতে
কৃষক আত্মহত্যার ‘কাহিনী’ নতুন নয়। খরা, কিংবা প্রচুর বৃষ্টি ইত্যাদির
কারণে প্রচুর কৃষক আত্মহত্যা করে থাকেন। মোদি যখন ২০১৪ সালের মে মাসে
ভারতের বিধানসভার নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন, তখন তিনি এক
স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে ৪৭৭টি জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। ৩
লাখ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করেছিলেন। ৫ হাজার ১৮৭টি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।
৩৯ লাখ অনুসারী তার টুইটারে। আর ফেসবুকে নির্বাচনের আগে তার ‘লাইক’ এর
সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ। কিন্তু নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি খুব কমই
গ্রামে গেছেন। তবে ১৯টি দেশ সফর করে বিশ্ব নেতাদের কাতারে তার নামকে স্থান
দিতে পেরেছেন। কী পরিমাণ বদলে গেছেন মোদি, তার বড় প্রমাণ ১০ লাখ রুপির
স্যুট পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ। একসময়
ট্রেনে ট্রেনে চা বিক্রি করে যিনি কৈশোরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, সেই মোদি
কৃষক লাল সিংয়ের জন্য গত এক বছরে কোনো আশার বাণী নিয়ে আসেননি। গরিব ঘরের
সন্তান হয়েও মোদি এখন অভিজাততত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করছেন। জাত-পাতে বিভক্ত
ভারতীয় সমাজের জন্য তিনি কোনো ‘মডেল’ হতে পারেননি এখনও। জমি অধিগ্রহণ বিল
নিয়েও একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে ভারতে। কংগ্রেস এটাকে পুঁজি
করে গ্রামে গ্রামে কৃষককে সংগঠিত করছে। এরকম একটি ছবি, যেখানে রাহুল গান্ধী
আমেথিতে (তার নির্বাচনী এলাকা) কৃষকদের নিয়ে ঘরোয়া সভা করছেন, তা ছাপা
হয়েছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও। যদিও এটা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না,
মোদির জনপ্রিয়তায় আদৌ ধস নেমেছে কিনা? কিংবা মোদি তার জনপ্রিয়তাকে আরও
বাড়াতে পেরেছেন কিনা? কেননা এ ধরনের কোনো সার্ভে রিপোর্ট আমাদের কাছে নেই।
তবে
এক বছরে তার পারফরম্যান্সকে, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণভাবে বিরোধীদের ‘হাত’
করা- তাতে তিনি সফল। মমতা ব্যানার্জির মতো আঞ্চলিক নেতাকে তিনি আস্থায় নিতে
পেরেছেন। এটা তার জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। মমতাকে কিছুটা আস্থায় নিতে
পেরেছেন বিধায় রাজ্যসভায় স্থলসীমানা চুক্তি তিনি সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন
নিতে পেরেছিলেন। কেননা রাজ্যসভায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে মমতা
সমর্থন না দিলে রাজ্যসভায় তা অনুমোদিত হতো না। মোদির জন্য এ বিলটি পাস হওয়া
জরুরি ছিল। না হলে তাকে ‘খালি হাতে’ ঢাকায় আসতে হতো। তিনি জানেন, ঢাকার
আস্থা নিতে হলে এটা দরকার। তবে কৃষকদের আস্থা তিনি পাননি।
তিনি
যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে যান ব্যবসায়ীরা, যান করপোরেট হাউসের
প্রতিনিধিরা। কিন্তু গত এক বছরে তার শরীরে ১০ লাখ রুপির স্যুট উঠেছে সত্য,
কিন্তু দরিদ্র ভারতের চেহারা তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি। কৃষকের আত্মহতার
প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি। ইন্টারন্যাশনাল কম্পারিজন প্রোগ্রামের মতে,
জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত।
২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল, আজ তৃতীয় অবস্থানে (কারও
কারও দ্বিমত এতে আছে)। আর গত সপ্তাহেই জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন ছাপা
হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে বেশি
হবে। যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ, সেখানে ভারতের হবে ৭
দশমিক ৭ ভাগ। নরেন্দ্র মোদি এ ভারতকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা
হচ্ছে ভারতের জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ মানুষ এখনও গরিব। ৫৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো
টয়লেট নেই, যারা প্রকাশ্যেই এ ‘কাজটি’ নিত্য সমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে,
বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক
নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায়, প্রতিদিন ভারতে ৫
হাজার শিশু মারা যায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে। (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ৮
সেপ্টেম্বর ২০১০)। ৫ বছর আগের এ পরিসংখ্যানে খুব পরিবর্তন এসেছে, এটা মনে
করার কোনো কারণ নেই। শুধু দরিদ্রতা কেন বলি, প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ২
দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ শতাংশ লোক গ্রামে বসবাস করে। নারী-পুরুষের পার্থক্যের
ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৮৬-কে
হিসেবে ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণ এত ঘটনা
ঘটার পরও বন্ধ হয়নি। নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি (যা বাস্তব
ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি) গুলাব গ্যাং (উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখন্ড
গ্রামের সত্য কাহিনী) এর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মোদি গত এক বছরে এদের
জন্য কী করেছেন? যদিও মাত্র এক বছরে দরিদ্রতা কমানো সম্ভব নয়, কিংবা বিপুল
তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন,
বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দরিদ্রতা কমানো তার জন্য একটা বড়
চ্যালেঞ্জ। তার ‘গুজরাট মডেল’ নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি
সড়ক-মহাসড়ক করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে তিনি
ব্যর্থ হয়েছিলেন। ভারতের প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলো তার এক বছরের
পারফরম্যান্স নিয়ে নানা প্রবাদ লিখেছে। তবে বেশিরভাগ সংবাদপত্রের ভাষ্য
একটাই- তিনি যে নির্বাচনের আগে ‘আচ্ছে দিন’ এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এখনও
তা অধরা। প্রাপ্তির ঘরটা এখনও শূন্যই। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ১২৫
কোটি মানুষের প্রত্যেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ রুপি করে জমা হবে।
কিন্তু তা হয়নি। ভবিষ্যতে হবে, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কালো টাকা উদ্ধার করার
প্রতিশ্রুতিও ছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানিয়ে দিয়েছেন, কালো
টাকার প্রশ্নটা ছেলেখেলা নয়। কাজেই অমন হুটোপুটি করলে চলবে না। আর অমিত শাহ
বলেছেন, কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা- এটা কথার কথা। এ ধরনের কথা বলতে
হয়। এটা কথার কথা, এটাকে সিরিয়াসলি নিতে নেই- এটা অমিত শাহের সাফ কথা তাই
নরেন্দ্র মোদির সেই প্রতিশ্রুতি ‘আচ্ছে দিন’, অর্থাৎ সুসময় কবে আসবে, বলা
মুশকিল। তবে এটা তো ঠিক, সুসময় এসেছে ব্যবসায়ীদের জন্য। তারা এখন মোদির
সঙ্গে বিশ্বময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের চাই ব্যবসা। চাই বিনিয়োগ। আর সেই
ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিশ্চিত করছেন মোদি। জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় তিনি
প্রচুর আশ্বাস পেয়েছেন। ভারতকে তিনি চীনের বিকল্প হিসেবে পণ্যের উৎপাদন
কারখানায় পরিণত করতে চান। বড় বড় কোম্পানিগুলো এখন ভারতে আসছে। কিন্তু কৃষক
যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। তাদের কোনো উন্নতি হয়নি।
সরকারের
বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মোদি একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। বাংলাদেশের
পত্রপত্রিকায়ও তা ছাপা হয়েছে। এখানে তিনি কতকগুলো বিষয় স্পষ্ট করেছেন।
এমনকি বিজেপি এক সংবাদ সম্মেলনও করেছে ২৬ মে। মোদির চিঠি ও বিজেপির সংবাদ
সম্মেলনে কতকগুলো বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। এক. রামমন্দির প্রতিষ্ঠা কিংবা শরিয়া
আইন বাতিল তারা করবেন না। কেননা লোকসভায় তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট
নয়। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ, মুসলিমদের শরিয়া আইন বাতিল, জম্মু ও
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাবাহী সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল- এগুলো ছিল বিজেপির
প্রধান নির্বাচনি ইস্যু। দুই. মোদি বলেছেন, তিনি এক বছরে দুর্নীতিমুক্ত
একটি সমাজ উপহার দিতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি
প্রধান পাহারাদার, দেশের সম্পদের পাহারাদার। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন
কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যমে মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ (ভারত নির্মাণ)
অভিযানকে অতিরঞ্জিত প্রচার বলে মন্তব্য করা হয়েছে। মোদি সরকারের কাছে বিপুল
প্রত্যাশা থাকলেও কর্মসংস্থানের হাল যথেষ্ট খারাপ বলেও মন্তব্য করেছে
তারা। প্রভাবশালী দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে মোদি সরকারের এক বছর পূর্তি
উপলক্ষে ভারতে ‘মোদির এক বছর উচ্ছ্বাসের পর্ব শেষ, সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ’
শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতে এক বছর আগে
পরিবর্তন ও আর্থিক পুনরুজ্জীবনের আশায় নরেন্দ্র মোদি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে
ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু এবার চূড়ান্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছে মোদি
সরকার। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযান শুরু করলেও ভারতের
অর্থনীতি খুঁড়িয়েই চলছে। আর নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, মোদির অধিকাংশ কর্মসূচি
এখনও কথার কথাই রয়ে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, দেশের অভ্যন্তরে আর্থিক
অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার এখনও বেহাল।
ব্যবসায়িক উদ্যোগেও তেমন দানা বাঁধছে না। একইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও চাপে
পড়েছেন মোদি।
এসব মূল্যায়ন মোদি সম্পর্কে কোনো ভালো ধারণা
দেয় না। নিশ্চয়ই এক বছরে মোদি অনেক কিছু শিখেছেন। তবে এটা স্বীকার করতেই
হবে, তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত একাই নেন।
এখানেই মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তার পার্থক্য। মনমোহন সিং বেশি মাত্রায় সোনিয়া
গান্ধীনির্ভর ছিলেন। দ্বিতীয় বছরের শুরুতে বাংলাদেশ সফর দিয়ে তিনি শুরু
করলেন। তিনি যদি চলতি বছর অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর দিকে বেশি নজর দেন, তাহলে
ভালো করবেন। কেননা তাকে ভারতের সাধারণ মানুষই ক্ষমতায় বসিয়েছে। তিনি তাদের
প্রতি দৃষ্টি না দিলে ২০১৯ সালে তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে।
বাস্তবতা এটাই। তাই মোদি ম্যাজিক নিয়ে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তা রয়েই
গেছে।
Daily Alokito Bangladesh
31.05.15
মোদি আসছেন
17:15
No comments
শেষ পর্যন্ত তারিখটি নির্ধারিত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি আসছেন। ৬ জুন থেকে তার সফর শুরু হবে। এই সফরকে ঘিরে অনেকগুলো ‘কিন্তু’ ও ‘এবং’ আছে। অনেকদিন থেকেই তার এই ঢাকা সফর প্রত্যাশিত ছিল। তিনি সময় করে উঠতে পারছিলেন না। উপরন্তু তার প্রয়োজন ছিল স্থলসীমানা চিহ্নিত করার বিষয়টির সাংবিধানিক সমাধান। এখন ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে বিলটি অনুমোদিত হওয়ায় একটা বড় বাধা মোদি অতিক্রম করলেন। এখন আর ভারতীয় সংবিধান সংশোধনে কোনো বাধা নেই। কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভায় পাসকৃত বিলটি অনুস্বাক্ষরিত হবে এবং অতঃপর ভারতীয় রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর করবেন এবং তা সংবিধানের অংশ হবে। নরেন্দ্র মোদি এই দিনটির জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন। এখন তিনি বাংলাদেশের জনগণকে বলতে পারবেন ‘তিনি করেছেন’। অতীতের কোনো ভারতীয় সরকার এটি করেনি।
বাংলাদেশ সেই ১৯৭৪ সালে বেরুবাড়ী ভারতকে দিয়েছিল এবং সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী এনে তা আইনসিদ্ধ করেছিল। এখন মোদির জমানায় এবং তার দূরদর্শিতার কারণেই ভারতীয় সংসদে এটি অনুমোদিত হলো। এ জন্য নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জনগণ তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরও চার মুখ্যমন্ত্রী ঢাকায় আসছেন। এর মধ্য দিয়ে তিস্তার পানি বণ্টনের একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। নরেন্দ্র মোদি মমতাকে সফরসঙ্গী করে এই মেসেজটা দিতে চেয়েছেন যে, তিনি তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে সিরিয়াস
মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা আমাদের জন্য একটা ভালো খবর এ জন্য যে, আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ভারত বড় অবদান রাখতে পারে। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। ভারতীয় সহযোগিতায় আমরা আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারব। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতকে বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। ভারতকে দেখতে হবে উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে। ভারত যদি বাংলাদেশে শুধু তার পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত করতে চায়, তাতে করে সমমর্যাদা নিশ্চিত হবে না। বরং ভারতীয় বন্ধুত্বকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে। ভারতকে বাংলাদেশেরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। কিন্তু সেখানে তৈরি হয়ে আছে নানা জটিলতা। তাই সংগতকারণেই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে নরেন্দ্র মোদি তার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়ে সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেবেন। ভারতীয় গণমাধ্যম ও ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা রয়েছে, সে সম্পর্কে আদৌ অবগত নন, তা আমি বিশ্বাস করি না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, জিটুজি পর্যায়ে বাংলাদেশ ‘শক্ত’ অবস্থানে যেতে না পারলেও ‘ট্রাকটু ডিপ্লোম্যাসির’ আওতায় যেসব সেমিনার হয়, অর্থাৎ বেসরকারি পর্যায়ে দুদেশে যেসব সভা-সেমিনার হয়, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান কতটুকু তুলে ধরা হয়, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে। মোদির সফরের প্রাক্কালে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন নয়াদিল্লিতে একটি যৌথ সভার আয়োজন করে। ওই সভায় বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি যোগ দেন। তারা ওই সভায় বাংলাদেশের অবস্থান কতটুকু তুলে ধরতে পেরেছেন আমি জানি না। তবে আমি এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সেখানে আদৌ উত্থাপিত হয়নি। মোদির সফরের প্রাক্কালে এ ধরনের একটি সেমিনারের গুরুত্ব অনেক। কেননা ভারতের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই ওই সভায় বক্তব্য রেখেছেন। তাদের বক্তব্য থেকে ভারতের বর্তমান সরকারের মনোভাব বোঝা গেছে।
মূলত চারটি বিষয়ের আলোকে মোদির ঢাকা সফরকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এই চারটি বিষয় হচ্ছেÑ অর্থনীতি, নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন ও কানেকটিভিটি। এর মাঝে অর্থনীতি ও কানেকটিভিটির বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির খাতে দেখা যাচ্ছে ভারত বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ভারতের কাছে ২৯৪ কোটি ডলারের সাহায্য চাইবে। ইতোমধ্যে ১৫টি প্রকল্পও ভারতের কাছে পাঠানো হয়েছে। এখানে সমস্যাটা হচ্ছে ভারতের ঋণের ধরন নিয়ে। ভারত এই ঋণ দিচ্ছে ‘সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট’-এর আওতায়। ভারত নিজে কখনো সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটে ঋণ গ্রহণ করে না (সর্বশেষ মোদির দক্ষিণ কোরিয়া সফরের সময় ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করা যায়)। সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট এখন বিশ্বে অচল। কোনো রাষ্ট্রই সাধারণত এর আওতায় কোনো ঋণ গ্রহণ করে না। কেননা তাতে নানা শর্ত থাকে। যেমন বলা যায় সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটে ঋণ নিলে এই ঋণের আওতায় শতকরা ৭৫ ভাগ পণ্য আমাদের ওই দেশ (এ ক্ষেত্রে ভারত) থেকে কিনতে হবে। ঠিকাদার নিয়োগ হবে ওই দেশ থেকে। সুদ দিতে হবে শতকরা ১ ভাগ হারে। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প শেষ না হলে বাংলাদেশকে জরিমানা গুনতে হবে শতকরা ৫ ভাগ হারে। এটা কোনো ভালো ঋণ নয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুযোগ আছে ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে আরও আলোচনা করার। এর আগে ভারতের কাছ থেকে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটের আওতায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছিলাম। এ ব্যাপারে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে যেসব প্রকল্পে এই ঋণ ব্যয় হবে, তাতে আমাদের চাইতে ভারতই উপকৃত হবে বেশি। ভারতের স্বার্থ এখানে বেশি। দুটি প্রকল্পের কথা আমি উল্লেখ করলামÑ একটি হচ্ছে আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়ক চার লেনে উন্নীত করা, যা কি না সাতবোন রাজ্যগুলোতে ভারতীয় পণ্য সরবরাহে সুবিধা হবে। এই ঋণের আওতায় ৫০০টি ভারতীয় ডবল ডেকার ও আর্টিকুলেটেড বাস আমরা কিনব। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সড়কগুলো, বিশেষ করে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে এই বাসগুলো চলাচল করতে পারবে কি না? এমনিতেই প্রচুর যানবাহনের কারণে এবং রাস্তা না থাকায় যানজট এখন নগরবাসীর এক নম্বর সমস্যা। সুতরাং প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই ৫০০ ভারতীয় টাটা বাসকে আমরা জায়গা করে দিতে পারব কি না? ভারত নতুন করে ১৫টি ট্রানজিট রুট চাইছে, যা কি না বাংলাদেশের এক অংশ থেকে ভারতের অন্য অংশকে সংযুক্ত করবে। অবকাঠামো উন্নয়নে এই ঋণ ব্যয় হবে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীও এবার মোদির সঙ্গে আসছেন। তিনি বাংলাদেশের কাছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে চাইবেন। এর আগে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে ৫০ দফা প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে ভারত কর্তৃক চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছিল। এখন বাংলাদেশ নীতিগতভাবে ত্রিপুরাকে যদি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দেয়, তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো ‘জটিলতা’ সৃষ্টি করবে কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে। এখানে প্রায়ই কনটেইনার জট লেগে থাকে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হলে আমরা ভারতের সাতবোন রাজ্যগুলোতে এই সুযোগ দিতে পারতাম। কিন্তু সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হচ্ছে না ভারতের আপত্তির কারণে। এ ব্যাপারে আরও গবেষণা প্রয়োজন। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে শতকরা ৯০ ভাগই পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। মংলা বন্দরটি ব্যবহৃত হয় না নানা কারণে।
তবে মোদির এই সফর নানা সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে আমাদের জন্য। মনে রাখতে হবে ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার মোট আয়তনের মধ্যে ৭২ ভাগ একা ভারতের, মোট জনসংখ্যার ৭৭ ভাগ ভারতের, ভারতের অর্থনীতির অবস্থান বিশ্বে তৃতীয় ও চতুর্থ। জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৭ ভাগে গিয়ে দাঁড়াবে, যখন চিনের অর্থনীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ। সুতরাং ভারতের এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে আমরা উপকৃত হতে চাই। অনেকগুলো সম্ভাবনা রয়েছে। এক. বাংলাদেশ-ভারত নৌ প্রটোকলের আওতায় নদী খনন করা যেতে পারে, যাতে করে ভারতীয় পণ্য আমদানিতে আমরা নৌপথ ব্যবহার করতে পারি। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। ২. নদীপথে সব ধরনের পণ্য সরবরাহ করা যায় না। এটা পরিবর্তন প্রয়োজন। রাতের বেলা নৌযান চলাচলের অনুমতি এবং দক্ষ নাবিক নিয়োগ করাও জরুরি। ৩. সমুদ্র পথে কানেকটিভি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে ভারতের তিনটি সমুদ্রবন্দর সংযুক্ত সংক্রান্ত একটি চুক্তি হতে যাচ্ছে। এটা ভালো। ৪. আইটি সেক্টরে এবং আইটি পার্ক গড়ার ক্ষেত্রে আমরা ভারতীয় দক্ষতা ও সহযোগিতাকে কাজে লাগাতে পারি। ৫. সমুদ্র অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশ দুটো একসঙ্গে কাজ করতে পারে। এখানে সমুদ্র অর্থনীতির কথা উল্লেখ করা যায়। একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে এখানে, যা ‘ব্লু অর্থনীতি’ হিসেবে পরিচিত। আমাদের দক্ষ জনশক্তি নেই। এই দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে আমরা ভারতের সহযোগিতা নিতে পারি। ৬. বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। শুধু ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৫৫৮ কোটি ডলার। দিনে দিনে এই ঘাটতি বাড়ছেই। বাংলাদেশ এই ঘাটতি কমাতে পারছে না। কারণ নানা ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। এই বাধা অপসারণের কথা বলা হলেও ভারতীয় আমলাতন্ত্রের কারণে তা দূর হচ্ছে না। ৭. তিস্তা চুক্তি নিয়ে একটা জটিলতা আছে জানি। ভবিষ্যতে যে কোনো এক সময় এই চুক্তিটি হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে করে মোদি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা পেতে পারেন। তবে একই সঙ্গে ৫৪ নদীর ব্যাপারে একটি যৌথ ব্যবস্থাপনা চালু করা প্রয়োজন। শুধু গঙ্গার পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়েছে। অথচ ভারত ফেনী নদী থেকেও পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। একটি যৌথ ব্যবস্থাপনা চালু হলে উভয় দেশই ৫৪ নদীর পানির সুবিধা পাবে। এ ক্ষেত্রে ভারত যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু করতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারেও একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য। ৮. দক্ষিণ এশিয়া ভবিষ্যতে দুটো বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে। জ্বালানি ও পানি সংকটের মুখে পড়বে পুরো দক্ষিণ এশিয়া। উভয় ক্ষেত্রেই একটি আঞ্চলিক সহযোগিতার এপ্রোচ গড়ে তুলতে হবে। ভুটান, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের সমন্বয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে জ্বালানি সংকট ও পানি সংকটের সমাধান সম্ভব। ভারত এটা করে না। ভারত দ্বিপাক্ষিকভাবে এসব সমস্যার সমাধান করতে চায়। দ্বিপাক্ষিকতা কখনই কোনো ভালো এপ্রোচ হতে পারে না। ৯. বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোদি সরকার একটি ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে। এটা আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে কম। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে ভারতের ব্যবসায়ীদের আমরা উৎসাহিত করতে পারি সেখানে বিনিয়োগ করতে। আমরা ‘দোকানদারদের জাতি’তে পরিণত হতে চাই না! আমরা শুধু ভারতীয় পণ্যই বিক্রি করব না, ভারতীয়রাও এখানে পণ্য উৎপাদন করুক। ১০. দুদেশের মাঝে ভিসা ব্যবস্থা আরও সহজীকরণ ও রেলব্যবস্থার আরও উন্নয়ন দরকার, যাতে করে দুদেশের সাধারণ মানুষ সহজে দুদেশ ভ্রমণ করতে পারেন।
নরেন্দ্র মোদি আসছেন। তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। বিশাল এক জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি এসেছেন। ভারতের জনগণের মতো বাংলাদেশের মানুষের কাছেও সমান জনপ্রিয় হবেন যদি তিনি সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে আন্তরিক হন। তিনি শুধু আশ্বাস দিয়ে যাবেন, এটা আমরা চাই না। মনমোহন সিং আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও বারবার সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমনকি গত সপ্তাহেও বিএসএফ একজন বাংলাদেশিকে পিটিয়ে মেরেছে। এর স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। যদি সমস্যাগুলোর সমাধান না হয় এবং ভারত যদি নিজ স্বার্থের আলোকে সব বিষয় দেখে, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আর এর সুযোগ নেবে অসাংবিধানিক ও উগ্র সংগঠনগুলো। আমরা তা চাই না। এ কারণেই নরেন্দ্র মোদির এই সফরের গুরুত্ব অনেক বেশি।
Daily Amader Somoy
30.05.15
কেমন কাটল মোদির এক বছর
17:00
No comments
গত
এক বছর কেমন কাটল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির? আজ ২৬ মে তিনি তার
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার এক বছর পার করবেন। তার এ এক
বছরের অর্জন কী? এক বছরের কর্মকাণ্ড দিয়ে একটি সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা
বিচার করা যায় না। তবে এটা তো সত্য, মোদি একটা নিজস্ব ‘ইমেজ’ তৈরি করতে
পেরেছেন, খোদ দেশের ভেতরে ও বাইরে। তাতে কতটুকু তিনি সফল, কতটুকু ব্যর্থ,
তার একটা হিসাব করাই যায়। তার সরকারের দর্শন হচ্ছে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-
অর্থাৎ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, সবার ভাগ্য উন্নয়নে। ভারতবাসীর কতটুকু ‘ভাগ্য
উন্নয়ন’ করতে পেরেছেন তিনি? তার জমি অধিগ্রহণ বিলের বড় বিরোধিতায় নেমেছে
কংগ্রেস। কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। তার নিজ
নির্বাচনী এলাকা আমেথিতে কৃষকদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে একটি ঘরোয়া সভা
করার ছবিও প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়। একজন কৃষক যখন
কেজরিওয়ালের সভায় প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করল, মোদি সরকার তার পরিবারের কাছে
ছুটে যায়নি- এ ধরনের অভিযোগ রাহুলের। এতে করে মোদি যে ‘কৃষকবান্ধব’ নন, এমন
একটি অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করছেন তিনি। এর ফল কতটুকু পাওয়া যাবে, তা
দেখা যাবে চার বছর পর ২০১৯ সালে পরবর্তী নির্বাচনে।
তবে
গত এক বছরে মোদির সরকার পরিচালনার বেশ কয়েকটি দিক লক্ষণীয়। এক. যে
‘হিন্দুত্ববাদে’র ধুঁয়া তুলে তিনি ২০১৪ সালের মে মাসে লোকসভা নির্বাচনে
বিজয়ী হয়েছিলেন, সেই ‘হিন্দুত্ববাদ’কে এখন তিনি ব্যবহার করছেন না। তবে উগ্র
হিন্দুবাদীরা আছে এবং তার প্রশাসনের ওপর মাঝেমধ্যে প্রভাব খাটানোর চেষ্টাও
করছে। তিনি নিজে এ ‘হিন্দুত্ববাদে’র কথা খুব একটা বলছেন না। দুই. তিনি
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ‘এক ভারতের পতাকাতলে’ নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন।
অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কর্তৃত্ব, প্রভাব বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন এবং
তাতে অনেকটা সফলও তিনি। তার এ অ্যাপ্রোচ এক ‘নয়া ভারতীয় মনরো ডকট্রিনের’
জন্ম দিয়েছে, ভবিষ্যতে যা ‘মোদি ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। এ অঞ্চলে
ভারত চায় না অন্য কোনো দেশের (বিশেষ করে চীনের) কর্তৃত্ব বাড়–ক। ভারত নিজে
এখন এ অঞ্চলের উন্নয়নের মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তিন. অভ্যন্তরীণভাবে
মোদির নিজস্ব স্টাইলের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার বিরোধীরাও হার মানছেন।
এর বড় প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি।
লোকসভায় তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। কিন্তু রাজ্যসভায় নেই (২৪৫ আসনের
রাজ্যসভায় বিজেপি তথা এনডিএ জোটের আসন মাত্র ৬৩)। অর্থাৎ কোনো আইন পাস করতে
হলে লোকসভা ও রাজ্যসভার সমর্থন প্রয়োজন। মোদির নিজস্ব স্টাইলের কারণে
(আর্থিক প্যাকেজকে তিনি ব্যবহার করছেন) অনেক ইস্যুতে মমতা ব্যানার্জির
সমর্থনও তিনি নিশ্চিত করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি
অনুমোদন, আবাসন বিলে তৃণমূলের নমনীয় অবস্থান, কয়লা ও খনি বিলে তাদের সমর্থন
কিংবা তৃণমূলের সংসদে অনুপস্থিত থেকে বীমা বিল অনুমোদন কিংবা বিরোধিতা
থেকে সরে এসে পণ্য ও পরিষেবা কর চালু- এসবই মোদির নিজস্ব স্টাইল। এভাবেই
বিরোধীদের আস্থায় এনেছেন তিনি। আর্থিক প্যাকেজ হোক আর সারদা কেলেংকারিতে
সিবিআইয়ের ফাঁস ঢিলে করা- যেভাবেই হোক না কেন, তিনি তো মমতা ব্যানার্জিকে
‘আস্থায়’ নিতে পেরেছেন! শুধু পারেননি তিস্তার পানিবণ্টন ক্ষেত্রে। এ
ক্ষেত্রে মোদির অ্যাপ্রোচ (সিকিমকে সঙ্গে নিয়ে) জুনে তার ঢাকা সফরের সময়
তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা না জাগালেও ২০১৬ সালের পর (পশ্চিমবঙ্গে
বিধানসভার নির্বাচন) এ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। চার.
অভ্যন্তরীণভাবে তিনি যতটা না আলোচিত হয়েছেন, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে
আলোচিত হয়েছেন বেশি। এ ক্ষেত্রে তার নিজস্ব একটি স্টাইল আছে। অতীতে কোনো
ভারতীয় সরকারপ্রধান যা করেননি, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে তিনি তার নিজ
শহর গুজরাটের আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছিলেন। শি জিন পিং
নয়াদিল্লির পরিবর্তে আহমেদাবাদ থেকেই ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তার ভারত সফর
শুরু করেছিলেন। ঠিক একই ঘটনা ঘটল মোদির চীন সফরের সময় (১৪ মে ২০১৫)। তিনি
শুরু করলেন বেইজিংয়ের বদলে শিয়ান হয়ে, যা শি জিন পিংয়ের জন্মস্থান। ‘টেম্পল
অব হেভেনে’ (বেইজিং) তিনি চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কে কিয়াংয়ের সঙ্গে একটি
‘সেলফি’ও তুলেছেন, যা ছিল সাম্প্রতিককালে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি। গত এক
বছরে তিনি ১৯ দেশ সফর করেছেন, যা অতীতের কোনো সরকারপ্রধান করেননি। তার এসব
সফরে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটাই উদ্দেশ্য কাজ করেছে, আর তা হচ্ছে
ব্যবসা। চাই বৈদেশিক বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘দ্বিমুখী’ নীতি (দক্ষিণ
কোরিয়া থেকে ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ নিয়েছেন। আবার মঙ্গোলিয়াকে ১০০ কোটি
ডলার ঋণ দিয়েছেন) থাকলেও তার উদ্দেশ্য একটাই- তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’
কর্মসূচিকে সফল করা।স্মরণ করা যেতে
পারে, জাপান সফরের সময়ও তিনি সর্বোচ্চ ৩৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস
পেয়েছিলেন। তিনি ভারতকে বিশ্বের ‘ম্যানুফেকচারিং হাব’ বা শিল্পকেন্দ্র
হিসেবে তৈরি করতে চান। ২৫টি খাতকে সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করে মোদি
দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রচারণা শুরু করেছেন। ভারত যে দীর্ঘদিন ধরে
বিনিয়োগ খরায় ভুগছিল, তা থেকে দেশটিকে তিনি বের করে আনতে চান। পরিসংখ্যানই
বলে তিনি এতে সফল। গত পাঁচ মাসে ভারতে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৫
শতাংশ। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত বিনিয়োগ এসেছে
৬ হাজার ৯১৭ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের এ সময়ে ছিল ৪ হাজার ৭৭১ মিলিয়ন
ডলার। মোদি তার ‘গুজরাট মডেল’ সামনে রেখেই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারণায়
নেমেছেন। সফলও হচ্ছেন। ভারতে গাড়ি বাণিজ্যেবিনিয়োগ
দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি কোম্পানি ফোর্ড মোটরস।
কোম্পানিটি মনে করে, ২০২০ সাল নাগাদ ভারত হবে বিশ্বের গাড়ি উৎপাদনকারী
তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। সম্প্রতি পশ্চিম ভারতে একটি নতুন প্লান্ট উদ্বোধন করেছে
ফোর্ড। এ কারখানার ফলে দেশটিতে ফোর্ডের ইঞ্জিন উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে হবে ৬
লাখ ১০ হাজার এবং গাড়ি উৎপাদন হবে ৪ লাখ ৪০ হাজার। এতে করে সেখানে
কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে এবং অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। অনেক বিশ্লেষকই এটা
বলার চেষ্টা করছেন যে, ভারতের বিনিয়োগ পরিবেশ আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়ায়বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। এটা নিঃসন্দেহে মোদির পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সাফল্য।চীন
সফরে মোদি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারত-চীনের
পুনরুত্থান একবিংশ শতাব্দীর মাইলফলক। যে কোনো বিবেচনায় এটা একটা
গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। এ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি এটা বোঝাতে চাচ্ছেন যে,
ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে
মোদ্দাকথা। প্রশ্ন সেখানেই। যেখানে দু’দেশের মাঝে এক ধরনের সামরিক
প্রতিযোগিতা তথা প্রভাব বিস্তার করার মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়, সেখানে এ
দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আগামী দিনগুলোতে? এর জবাব
পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব
রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে। সেই পরিবর্তনে ভারতকে তিনি কোথায় নিয়ে যান,
সেদিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। চীনকে সঙ্গে নিয়ে ভারত ব্রিকস ব্যাংক গড়ে
তুলছে। ইউরোপের অনেক দেশ এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিকল্প এ
ব্যাংক উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য আদৌ কোনো মডেল হয় কি-না, সেটাই এখন দেখার
বিষয়।নিঃসন্দেহে গত এক বছরে মোদি
নিজেকে একজন উদ্যমী ও শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দলে আদভানির
(যিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন) মতো নেতাকে পাশে সরিয়ে রেখে তিনি তার
অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি বড় তা হচ্ছে,
তিনি ‘গরিব দেশের ধনী প্রধানমন্ত্রী’। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে স্বাগত জানাতে
(জানুয়ারি ২০১৫) তিনি ১০ লাখ রুপির স্যুট পরিধান করে প্রমাণ করেছিলেন তিনি
আসলে ধনী শ্রেণীরই প্রতিনিধি! একসময় যে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি কৈশোরে
ট্রেনের কামরায় কামরায় চা বিক্রি করতেন, মা পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে
সংসার চালাতেন (মে মাস সংখ্যা টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদকের কাছে তা তিনি
স্বীকারও করেছেন), সেই মোদির সঙ্গে এখন কর্পোরেট জগতের বাসিন্দাদের
সম্পর্ক বেশি। ট্রেনের চা বিক্রেতাদের মতো সাধারণ ভারতীয়দের কাছে এখন তিনি
‘অনেক দূরের মানুষ’। তিনি যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে যান ব্যবসায়ীরা,
যান কর্পোরেট হাউসের প্রতিনিধিরা। তবে গত এক বছরে তার শরীরে দশ লাখ রুপির
স্যুট উঠেছে সত্য; কিন্তু দরিদ্র ভারতের চেহারা তিনি পরিবর্তন করতে
পারেননি। কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতা তিনি দূর করতে পারেননি।
ইন্টারন্যাশনাল ও কম্পারিজন প্রোগ্রামের মতে জাপানকে হটিয়ে বিশ্বের তৃতীয়
বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে ভারত। ২০০৫ সালে ভারত দশম বৃহত্তম
অর্থনীতির দেশ ছিল, আজ অবস্থান তৃতীয় (কারও কারও দ্বিমত আছে এতে)। আর গত
সপ্তাহেই জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ভারতের জিডিপি
প্রবৃদ্ধি চীনের চেয়ে বেশি হবে। যেখানে চীনের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ ভাগ,
সেখানে ভারতের হবে ৭ দশমিক ৭ ভাগ।নরেন্দ্র
মোদি এই ভারতেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের
জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ মানুষ এখনও গরিব। ৫৩ ভাগ জনগোষ্ঠীর কোনো টয়লেট নেই, যারা
প্রকাশ্যেই এ ‘কাজটি’ নিত্য সমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে বিশ্বের
দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক
নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। চিন্তা করা যায়, প্রতিদিন ভারতে ৫
হাজার শিশু মারা যায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৮
সেপ্টেম্বর ২০১০)। পাঁচ বছর আগের এ পরিসংখ্যানে খুব পরিবর্তন এসেছে, এটা
মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু দরিদ্রতা কেন বলি, প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক
আয় ২ দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করে। নারী-পুরুষের
পার্থক্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র
১৮৬-এ হিসাব ধরে) ১৪৬, ভারতের সেখানে ১৩৬। এত ঘটনা ঘটার পরও বন্ধ হয়নি নারী
নির্যাতন আর নারী ধর্ষণ। নারী নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে তৈরি ছবি (যা বাস্তব
ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি) ‘গুলাব গ্যাং’য়ের (উত্তর প্রদেশের
বুন্দেলখণ্ডে গ্রামের সত্য কাহিনী) কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মোদি গত এক
বছরে এদের জন্য কী করেছেন? যদিও মাত্র এক বছরে দারিদ্র্য কমানো সম্ভব নয়।
কিংবা বিপুলসংখ্যক তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির সংস্থান করাও সম্ভব নয়। তিনি
মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু দারিদ্র্য কমানো তার
জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।মোদির
‘গুজরাট মডেল’ নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। গুজরাটে তিনি সড়ক-মহাসড়ক করেছেন।
কিন্তু সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। শিক্ষা
খাতে বরাদ্দ অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে গুজরাটে তার আমলে কম ছিল, মাত্র ১৩.৪
ভাগ (২০১২-১৩ সালে আসামে ছিল ২১.১ ভাগ, উত্তরখণ্ডে ২০.৮, মহারাষ্ট্র ১৯.৮
ভাগ)। শিশু মৃতুর হার গুজরাটে হাজারে ৩৮, যেখানে কেরালায় ১২, তামিলনাড়–তে
২১, মহারাষ্ট্রে ২১। শিশু জন্ম দেয়ার সময় মাতৃমৃত্যুর হার গুজরাটে ৯.৫,
কেরালায় ৩.৩, তামিলনাড়ুতে ৫, মহারাষ্ট্রে ৫.২। যেখানে গুজরাটে খাবার পানি
নিশ্চিত করা হয়েছে জনগোষ্ঠীর ৮৪.১ ভাগ মানুষের জন্য, সেখানে পাঞ্জাবে এ
সংখ্যা ৯৭.৬, উত্তর প্রদেশে ৮৭.৮, দিল্লিতে ৯৭.২। পাকাঘর রয়েছে হরিয়ানায়
৯৪.৮ ভাগ মানুষের, দিল্লিতে ৮৪.৭, উত্তরখণ্ডে ৯৩.৯, অথচ গুজরাটে এ হার
মাত্র ৭৫.৭ ভাগ। ইন্ডিয়ান সেনসাস থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করা। ফলে ‘গুজরাট
মডেল’ কীভাবে সারা ভারতের জন্য একটা মডেল হবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। আসলে
সড়ক-মহাসড়কনির্মাণ করে ব্যবসা ও
বিনিয়োগবান্ধব একটি অর্থনৈতিক সংস্কৃতি তিনি গড়ে তুলেছেন গুজরাটে। কিন্তু
এতে করে সাধারণ মানুষের প্রতি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখন এ মানসিকতায় তিনি
যদি ভারতকে পরিচালনা করতে চান, তাহলে তিনি ভুল করবেন।দারিদ্র্য
থেকে উঠে আসা নরেন্দ্র মোদি এখন আর দরিদ্রতম মানুষদের স্মরণ করেন না। কাজ
পাগলা মানুষ তিনি, সন্দেহ নেই তাতে। মাত্র ৩ ঘণ্টা তিনি ঘুমান- এটা নিজেই
স্বীকার করেছেন তিনি টাইম প্রতিবেদকের কাছে। ‘কম সরকার, অনেক বেশি
প্রশাসন’- এই হচ্ছে তার অ্যাপ্রোচ। এতে করে ভারতকে কতটুকু বদলে দিতে পারবেন
তিনি? টাইমস মোদিকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছে। শিরোনাম হচ্ছে Why Modi Matters।
মোদি কেন গুরুত্বপূর্ণ? তিনি গুরুত্বপূর্ণ বলেই গোধরায় ট্রেনে ৫৪ জন হিন্দু
পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে, গুজরাটে হাজারের মতো মুসলমান হত্যার অভিযোগে
অভিযুক্ত এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ওবামা তাকে
হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় চীনা
প্রেসিডেন্ট ছুটে গিয়েছিলেন আহমেদাবাদে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং মাত্র এক
বছরে শীর্ষ বিশ্ব নেতাদের তালিকায় নিজের নামটাকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন (টাইম
সাময়িকীর মতে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী নেতার একজন তিনি)। তাই খুব সঙ্গত
কারণেই মোদি বারবার আলোচনায় থাকবেন। নির্বাচনের আগের মোদি, আর নির্বাচন
পরবর্তী মোদি এক ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। ‘রিয়েল পলিটিকসে’র বাস্তব উদাহরণ হচ্ছেন
নরেন্দ্র মোদি।
Daily Jugantor
26.05.15
ভাসছে মানুষ ভাসছে মানবতা
03:13
No comments
এই মুহূর্তে কতজন মানব সন্তান মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া উপকূল এবং আন্দামান সাগরে ভাসছেন এর পরিসংখ্যান কারো কাছেই জানা নেই। এদের মাঝে কতজন রোহিঙ্গা, কতজন বাংলাদেশি এটাও আমরা জানি না। তবে সংবাদপত্রে নিত্যদিন বের হচ্ছে এদের খবর। বের হচ্ছে দু’ মাসেরও অধিক এরা সাগরে ভাসছেন, ছোট ডিঙি নৌকায় পানি, খাদ্য ছাড়া। যাদের ভাগ্য ভালো, তাদের আশ্রয় মিলেছে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের শরণার্থী শিবিরে। আর দুর্ভাগ্য যাদের, তাদের অনেকেই চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছেন সাগরে। কিন্তু এর সমাধান কোন পথে আমরা কেউই জানি না। সংবাদপত্রগুলো আমাদের জানাচ্ছে উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের মাঝে মালয়েশিয়ায় ৮০৩ জন এবং ইন্দোনেশিয়ায় ২৩৮ জন বাংলাদেশির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর যারা সাগরে ভাসছেন, তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত ১৮ মে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফাহ আমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, ৩১ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু হতভাগ্য বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তন কিংবা সাগরে ভাসা মানব সন্তানদের উদ্ধারের ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই তাতে। এখানে প্রশ্ন অনেক। এই মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি চক্র। এরা যেমন আছে বাংলাদেশ-মিয়ানমারে, ঠিক তেমনি আছে থাইল্যান্ডে আর মালয়েশিয়ায়।
২৩ মে ২০১৫ তারিখে পত্রিকান্তরে প্রকাশ, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মতে, ‘মানব ব্যবসায়’ জড়িত পুরো থাই সমাজ। পাচারকারীরা মূলত টার্গেট করেছিল রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের, যারা মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের বাসিন্দা। মিয়ানমারে গত বেশ ক’ বছর ধরেই এক ধরনের ‘এথনিক ক্লিনসিং’ অর্থাৎ অত্যন্ত সুকৌশলে মুসলমানদের আরাকান থেকে উৎখাত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। মিয়ানমারকে একটি ‘বৌদ্ধ রাষ্ট্রে’ পরিণত করতে চায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। আর এদের মদদ জোগাচ্ছেন মিয়ানমারের শাসক চক্র। বৌদ্ধ ধর্ম শক্তির ধর্ম। এরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু আরাকানে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড এর প্রমাণ করে না। মিয়ানমারের শাসকচক্র মনে করেন রোহিঙ্গারা মূলত চট্টগ্রামের অধিবাসী এবং তারা ‘অবৈধভাবে’ আরাকানে বসবাস করছেন! অত্যন্ত কৌশলে এদের বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে একাধিকবার। এরপর একটি ‘চক্র’ এদের কৌশলে মালয়েশিয়া পাচার করার উদ্যোগ নেয়। এর সঙ্গে যোগ হয় বাংলাদেশের মানব পাচারকারীরা। বাংলাদেশিরাও চাকরির আসায় যেতে চান মালয়েশিয়ায়। কৌশলে পাচারকারীরা এদের বড় সাম্পানে তুলে দিয়ে পরে থাইল্যান্ডের পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয় এবং মুক্তিপণ দাবি করা হয়। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এভাবেই। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও নেয়া হয় এবং পরে তাদের কাছে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। রোহিঙ্গাদের বলা হয়েছিল মালয়েশিয়ায় আশ্রয় দেয়ার কথা। এখানে মিয়ানমার সরকারের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা হচ্ছে সমুদ্রে উপকূলবর্তী এলাকায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদের যোগসাজশে এই মানব পাচার চলে আসছিল। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা নিয়েও খবর বের হয়েছে। এই মানব পাচারের ঘটনা যে এই প্রথম ঘটল, তা নয়। এর আগেও ঘটেছে। কিন্তু তা প্রকাশ পেয়েছে কম। এবারই সম্ভবত ব্যাপক মানবপাচারের ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে স্থান পেয়েছে। এখানে আরো একটা বিষয় দৃষ্টিকটুÑ এই মানব পাচারের ঘটনা নৌবাহিনী কিংবা কোস্টগার্ডের চোখ এড়িয়ে গেল কিভাবে? কোস্টগার্ডের না হয় সমুদ্রে থাকার বড় জাহাজ নেই। কিন্তু নৌবাহিনী? সমুদ্রসীমায় টহল দেয়া, বিদেশি মাছ ধরা ট্রলারদের বাংলাদেশি সমুদ্রসীমায় প্রবেশে বাধাদান, সমুদ্র সীমান্ত রক্ষাÑ এসবই তো নৌবাহিনীর কাজ। তাদের তো গভীর সমুদ্রে যাওয়ার জাহাজ রয়েছে। অতি সম্প্রতি নতুন নতুন জাহাজ নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে। লেবাননে শান্তি মিশনেও গিয়েছিল নৌবাহিনী। তাহলে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে সাগরপথে যে মানব পাচার হচ্ছে, তা তাদের দৃষ্টিতে আসল না কেন? স্থানীয় কমান্ডার কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছিলেন? দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কি চার্জ গঠন করা হবে এখন? আরো দুর্ভাগ্য আমাদের যে এই ঘটনায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। ভাবমূর্তি উদ্ধারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি ভূমিকা নেয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
যারা সাগরে ভাসছেন, তাদের অনেকেরই নাগরিকত্ব এখনো চিহ্নিত হয়নি। যারা শরণার্থী শিবিরে আছেন এবং যাদের নাগরিকত্ব চিহ্নিত হয়েছে, তাদের অবিলম্বে ফিরিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া উচিত। যারা রোহিঙ্গা এবং সাগরে ভাসছেন, ১৯৫১ সালের শরণার্থী সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন ও ১৯৯৮ সালের উদবাস্তু সংক্রান্ত আইন, এমনকি এ সংক্রান্ত ১৯৬৭ সালের প্রটোকল অনুযায়ী সাগরে ভাসমান মানুষগুলো এখন ‘শরণার্থী’ হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। জাতিসংঘ এদের দায়িত্ব নেবে এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলো (এক্ষেত্রে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া) এসব শরণার্থীকে গ্রহণ করতে বাধ্য। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় কিছু নেই। আসিয়ানের দায়িত্ব এক্ষেত্রে বেশি। মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার দায়িত্বটি নিতে হবে আসিয়ানকে। মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে রোহিঙ্গাদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ করতে। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন যদি বন্ধ হয় তাহলে মানব পাচার হ্রাস পাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি সিদ্ধান্তের দিকেও আমরা তাকাতে পারি। ভূমধ্যসাগরে অতিক্রম করে গত প্রায় এক বছর ধরে শত শত আফ্রিকান অভিবাসী ইতালিতে প্রবেশ করছে এবং করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে যারা ঢুকে পড়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট একটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ছেন। অর্থাৎ এদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ২৮টি দেশের সর্বত্র পুনর্বাসন করা হবে (যদিও ব্রিটেনের টোরি সরকারের তাতে আপত্তি রয়েছে)। আসিয়ান এ ধরনের একটি কর্মসূচি নিতে পারে।
বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে, জানি না। কিন্তু এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পরও তাদের কোনো কর্মকাণ্ড আমার চোখে পড়েনি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের প্রচুর সমস্যা। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এখন কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। এদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। একাধিকবার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়েছে। তাতে ফলাফল শূন্য। এখন মানবপাচারের ঘটনার পর বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে অতি দ্রুত আলোচনা শুরু করবে কিনা, তাও অস্পষ্ট। এটা সত্য, আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কোন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। বিসিআইএম জোট কিংবা বিমসটেক জোট বাংলাদেশ ও মিয়ানমারেও আছে। আমাদের স্বার্থ আছে। কিন্তু মানব পাচারের ঘটনায় আমরা কি চুপ করে থাকব? এর দায়ভার বাংলাদেশ একা কেন নেবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অতি দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। এক. রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বিষয়টি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে জানান। মিয়ানমারের একটা প্রোপাগান্ডা আছে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি। এরা যে বাংলাদেশি নয়, তা স্পষ্ট করা এবং আসিয়ান নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা। দুই. অবিলম্বে মিয়ানমারের সঙ্গে এ ব্যাপারে একটি ‘সংলাপ’ শুরু করা। প্রয়োজনে বিমসটেক জোটকে এক্ষেত্রে ব্যবহার করা। তিন. ইইউর স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করে আসিয়ান নেতৃবৃন্দকে এ ব্যাপারে রাজি করানো এবং রোহিঙ্গাদের আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। চার. বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে আরো সক্রিয় করা এবং বাংলাদেশ থেকে সব মানব পাচার রুট মনিটর করা ও বন্ধ করা। পাঁচ. বাংলাদেশিরা যারাই এ মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের মুখোমুখি করা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। ছয়. মানব পাচার সংক্রান্ত যে আইনটি রয়েছে তা বেশ দুর্বল। এই আইনটি সংশোধন করে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর ব্যবস্থা সংবলিত আইন প্রণয়ন করা। সাত. মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে মালয়েশিয়াতে যে অবৈধ কাজের সুযোগ নেই, তা বারে বারে বলা। সরকার উপজেলা চেয়ারম্যানদেরও এ কাজে ব্যবহার করতে পারে। এতে করে মালয়েশিয়া সম্পর্কে সব বিভ্রান্তি দূর হতে পারে। আট. একটি বিশাল তরুণ প্রজš§ এখন বেকার। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে এদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া। ক্ষুদ্র ঋণের সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার।
সাগরে শত শত মানুষের ভেসে থাকার ঘটনা একটা মানবিক বিপর্যয়। আমরা যদি মনে করি পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে ‘বড় ভূমিকা’ নেবে, এটা আমাদের ভুল ধারণা। বসনিয়া, হারজেগোভিনায় সার্বরা যখন মুসলমানদের উৎখাত অভিযান শুরু করেছিল, তখন একটা পর্যায়ে ন্যাটোর বিমান করে সার্বিয়ায় বোমা হামলা পর্যন্ত চালিয়েছিল। কেননা তখন তাদের স্বার্থ ছিল। কিন্তু মিয়ানমারকে তারা ‘বাধ্য’ করার কোনো উদ্যোগ নেবে না। কেননা মিয়ানমার তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। মিয়ানমারের থেইন সেইন সরকার এখন সব কিছু ‘খুলে’ দিয়েছে। তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ নির্মাণ করছে সামরিক জান্তা! গভীর সমুদ্রে রয়েছে প্রচুর গ্যাস ও তেল। এই গ্যাস ও তেলের ব্যাপারে আগ্রহী মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো। ভারত ও চীন মিয়ানমারের গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত। এই গ্যাস ভারত নিয়ে যাবে পাইপ লাইনের মাধ্যমে। বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে আসছে মার্কিন কোম্পানিগুলো। কোকোকোলা তাদের নতুন প্লান্ট খুলেছে। মার্কিন দূতাবাস আবারো চালু করা হয়েছে। ওবামা দু’-দু’বার মিয়ানমার সফর করেছেন। অঙ্কের হিসাবটা অনেক সোজা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। আজ ওবামা প্রশাসন আরাকানে রোহিঙ্গাদের যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, এ কথাটা বলবে না। কেননা তারা দেখছে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ। এখানে সাগরে ভাসমান মানব সন্তানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি খুব বড় করে প্রাধান্য পাবে বলে আমার মনে হয় না। এমনকি ‘গণতন্ত্রের উজ্জ্বল তারকা’ অং সান সুচিও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। তার স্বপ্ন ভবিষ্যতে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হওয়া। তাই বিদেশ সফরে গিয়ে থেইন সেইন সরকারের কথারই প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেছিলেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন। ফলে পশ্চিমাদের স্বার্থের কাছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বলি হচ্ছেন!
সাগরে ভাসা মানুষদের বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশকেই আজ বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে হবে। জিটুজি পর্যায়ে আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় রোহিঙ্গা সমস্যাটি তুলে ধরা প্রয়োজন। মানবপাচারের ঘটনায় বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি এসেছে। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের এতদিনের যে অর্জন, তা এখন নষ্ট হওয়ার পথে। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি সেগুনবাগিচায় ‘আটকে’ থাকে, সেটা হবে আমাদের জন্য দুঃখের। সাগর ভাসা মানুষদের উদ্ধার করা প্রয়োজন। সরকার এক্ষেত্রে ‘চুপ’ করে বসে থাকতে পারে না।
Daily Manobkontho
24.05.15
মোদির চীন সফর ও এশিয়ায় দুই শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব
03:10
No comments
মোদির
চীন সফর সমাপ্ত হয়েছে ১৬ মে। মোদি তার চীন সফর শুরু করেছিলেন ১৪ মে চীনা
প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের জন্মস্থান শিয়ান প্রদেশ সফরের মধ্য দিয়ে। ভারতীয়
পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছে, এটা মোদির 'নিজস্ব কূটনীতি', যেখানে তিনি বিদেশি
রাষ্ট্রপ্রধান, বিশেষ করে শি জিন পিংকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আমন্ত্রণ
জানিয়েছিলেন তার নিজ শহর গুজরাটের আহমেদাবাদে। ফিরতি সফরে শি জিন পিংও সব
প্রটোকল ভেঙে মোদিকে আমন্ত্রণ জানালেন নিজ জন্মস্থান শিয়ানে। মোদি বেইজিংয়ে
২২ বিলিয়ন ডলারের ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তার সফর শেষ করলেন।
কিন্তু যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এ সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের
অর্জনই বা কতটুকু? কিংবা এ সফর ভারত-চীন দ্বন্দ্ব প্রশমনে কতটুকু সাহায্য
করবে? একটি জটিল সম্পর্কের মাঝে দেশ দুইটি আবদ্ধ। একদিকে ভারত মহাসাগরভুক্ত
অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক
স্বার্থ। এর মধ্য দিয়ে কি 'রিয়েল পলিটিকস' বিজয়ী হলো! এখানে উল্লেখ করা
প্রয়োজন, মোদির চীন সফরের সময় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত চীনা সিসিটিভিতে জম্মু ও
কাশ্মীর এবং অরুনাচল প্রদেশকে বাদ দিয়ে ভারতের মানচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
অন্য সময় হলে ভারত এর প্রতিবাদ করত। কিন্তু এবার কোনো ভারতীয় প্রতিবাদের
খবর আমরা পাইনি।
মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি চার চারবার চীন সফর করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে চীন সম্পর্কে তার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এবার সফরে গিয়ে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত-চীনের পুনরুত্থান একবিংশ শতাব্দীর মাইলফলক। যদিও তিনি একথাও বলেছেন, দুই দেশের অংশীদারিত্বের পূর্ণাঙ্গ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপদান করা থেকে উভয় দেশকে পিছিয়ে দিয়েছে এমন কিছু বিষয়ে চীনের কৌশল পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলোকে পাশ কাটিয়ে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নকে। ২২ বিলিয়ন ডলারের যে ২২টি চুক্তি হয়েছে, তাতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার। ভারত-চীন একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গঠনের কথাও রয়েছে চুক্তিতে। এ বছরটা চীনে 'ইয়ার অব ইন্ডিয়া' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর আগামী বছর ভারতে চিহ্নিত করা হবে 'ইয়ার অব চায়না' হিসেবে। চীনা নাগরিকের জন্য ই-ভিসা প্রবর্তনের কথাও ঘোষণা করেছেন মোদি। তিনি এ কথাটিও চীনাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ভারত বীমা খাতে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ খাতে তিনি চীনা বিনিয়োগ চান। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? ভারত দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' এর পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে তার প্রাচীন 'কটন রুট'কে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। আর এ লক্ষ্যেই ভারত ২০ থেকে ২২ মার্চ উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে ভারত মহাসাগরভুক্ত 'ইন্ডিয়ান ওসেন রীম' অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং সেইসঙ্গে এশিয়ায় ভারতকে অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশ সফর করেছেন। তার পররাষ্ট্র সচিবও 'সার্ক যাত্রার' অংশ হিসেবে সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশ সফর করেছেন। ভুবনেশ্বর শীর্ষ সম্মেলনের আগে নরেন্দ্র মোদি মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে সেখানে একটি ভারতীয় নৌ ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার_ ভারত ভারতীয় মহাসাগরে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ ব্যাপারে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত এবং ওই জোট মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের সিসিলি, মরিশাস কিংবা সুদূরের ওমান-মোজাম্পিকও এ প্রক্রিয়ায় একীভূত হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিকভাবে এ অঞ্চলের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ভারত তাই এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে অন্যতম শক্তি হিসেবে বিশ্ব রাজনীতিতে আবির্ভূত হতে চায়। এক্ষেত্রে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে চীন। চীন যে তার 'মেরিটাইম সিল্করুট' এর কথা বলছে, সেই 'সিল্করুট' এর সঙ্গে ভারতের এ অর্থনৈতিক স্বার্থ সাংঘর্ষিক। চীন ও ভারতের স্বার্থ মূলত এক ও অভিন্ন- ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ফলে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কমানোর যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে, তা এখন রীতিমতো প্রশ্নের মুখে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত বছর সেপ্টেম্বরে চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফর এবং আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্তৃক তাকে অভ্যর্থনা জানানো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের সেই পঞ্চাশের দশকের দুই দেশের সাবেক সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিলেও অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে সম্প্রতি দুই দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্কে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ প্রধানমন্ত্রী মোদি অরুণাচল সফর করেন। সেখানে তিনি রেলপথ ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল চীন। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদির অরুণাচল সফরকে সমালোচনা করে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়, চীনা সরকার কখনোই 'অরুণাচল প্রদেশ'কে স্বীকৃতি দেয়নি। বেইজিংয়ের মতে, চীনের অন্তর্গত তিব্বতের মনিয়ুল ও নিম্নসায়ুল এলাকা নিয়ে 'তথাকথিত অরুণাচল' প্রদেশ গড়েছে নয়াদিল্লি । ওই এলাকাগুলো এখনও ভারতের 'বেআইনি দখলদারির কবলে রয়েছে।' চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ অভিমত সঙ্গত কারণেই দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, কিছু দিন আগে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিসিদা ভারতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি অরুণাচল প্রদেশ যে ভারতের সে ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিসিদার ওই বক্তব্যে চীন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। চীন মনে করে, ভারত জাপানকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশ সফরেও আসছেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি প্রথম সফরে ভুটান গিয়েছিলেন। ওই সময় সেখানে চীনবিরোধী বক্তব্যও দিয়েছিলেন। চীন এখন অবধি ভুটানে তার দূতাবাস খোলার অনুমতি পায়নি শুধু ভারতের আপত্তির কারণে। নয়া পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর তার দক্ষিণ এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ভুটান হয়ে ২ মার্চ ঢাকা সফর করেন। এরপর তিনি যান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। ভারতে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ সংক্রান্ত চুক্তি পার্লামেন্টে অনুমোদিত হওয়ায় তা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তারপরও কথা থেকে যায়। শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনে ভারতের ভূমিকা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মোদি সরকার ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলো নিয়ে যে নীতি প্রণয়ন করেছে তা চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। সুতরাং মোদির বেইজিং সফরে এ আস্থার সম্পর্ক কতটুকু ফিরে আসবে, তা এক প্রশ্ন বটে। তবে চীনের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কের যারা ধারণা রাখেন, তারা জানেন চীনের বৈদেশিক নীতি এখন বিনিয়োগে ও ব্যবসানির্ভর। চীনারা কোনো দেশে তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের চেয়ে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী। চীনারা ব্যবসা বোঝে। ব্যবসা চায়। মোদি সরকারও একটি 'ব্যবসা ও বিনিয়োগনির্ভর' নীতি গ্রহণ করেছে। ভারতে যথেষ্ট চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে হঠাৎ করেই সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দুই দেশই চাইবে তার নিজ নিজ স্বার্থ আদায় করে নিতে। আগামী শতাব্দী হবে চীন ও ভারতের। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি, আর ভারত তৃতীয় কিংবা চতুর্থ অর্থনীতি। ফলে এ দুইটি বড় অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক যদি ভালো থাকে, তাহলে তা বিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্যও মঙ্গল। এজন্যই বেইজিংয়ে মোদি দুই দেশের সম্পর্ককে একুশ শতকের মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখন দেখার পালা, এই 'মাইলফলক' এর বক্তব্যটির বাস্তবে কতটুকু প্রতিফলন ঘটে। চীনারা সাধারণত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলায় না। তারা হস্তক্ষেপও করে না, যা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা করে। ফলে এখানে দুই দেশের এপ্রোচের ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। একটা মিল অবশ্যই আছে, আর তা হচ্ছে, দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতি ব্যবসা-বাণিজ্যনির্ভর এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। এজন্যই এক ধরনের 'প্রতিযোগিতা' থেকে যাবেই। বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দূরত্বের জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায়, মোদির এ বেইজিং সফর দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। Daily Alokito Bangladesh 24.05.15
চিন সফরে কী পেলেন মোদি
18:23
1 comment
চি ন সফরে কী পেলেন নরেন্দ্র মোদি? ২২ বিলিয়ন ডলারের ২২টি বাণিজ্য চুক্তি, ‘টেম্পল অব হেভেন’-এর (বেইজিং) সম্মুখে দাঁড়িয়ে চিনা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেই বিখ্যাত সেলফি কিংবা ১৪ মে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং সমস্ত প্রটোকল ভেঙে তার নিজ শহর শিয়ানে মোদিকে ‘রিসিভ’ করার ঐতিহাসিক ঘটনাÑ এসবই কি বড় প্রাপ্তি নরেন্দ্র মোদির? এই সফরের মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি নিজেকে একজন বিশ্বনেতায় পরিণত করতে পেরেছেন, এটা সত্য কথা। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে যেটা বিবেচ্য, তা হচ্ছে এই সফর ‘বিশ্বাস আর আস্থার’ সম্পর্ককে কতটুকু শক্তিশালী করতে পেরেছে? কিংবা ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই শক্তির মাঝে যে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তা মোদির সফরের মধ্য দিয়ে কতটুকু কমল? আপাতদৃষ্টিতে মোদির এই চিন সফর সফলই বলতে হবে। তিনি চিনা বিনিয়োগকারীদের ভারতের ব্যাপারে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন। ভারতের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্প সম্ভাবনাকে নিজেদের জন্য কাজে লাগাতে পারে চিনা কোম্পানিগুলো। এখানে মোদির ‘নিজস্ব কূটনীতিতে’ রাজনীতি প্রধান হয়নি, বরং ব্যবসা-বিনিয়োগে প্রাধান্য পেয়েছে। তাতে তিনি নিঃসন্দেহে সফল। চিন ধীরে ধীরে ভারতের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠছে। ২০১৪ সালে দুদেশের মাঝে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ বিলিয়ন ডলার। যদিও সত্য এটাইÑ বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ছে। আর এই ঘাটতি ভারতের প্রতিকূলে। যেখানে ২০০১-২০০২ সালে ১ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল, তা গত বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চিন। আর দ্রুত বিকাশমান ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের তৃতীয় অথবা চতুর্থ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এশিয়ান এই দুই বড় অর্থনীতির মাঝে সম্পর্ক কী হবে, বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব বড় কোনো সংকটের জন্ম দেবে কিনা এসব এখন ভাবনার বিষয়। তবে এটা বলতেই হয় বেশ কিছু বিষয়ে পার্শ্ববর্তী এই দেশ দুটোর মাঝে দ্বিমত আছে। বিভাজন আছে। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই বিভাজন আর বিদ্বেষকে ছাড়িয়ে গেছে। সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা ছিল তা রয়েই গেছেÑ চিন অরুণাচল প্রদেশের একটা অংশকে তাদের নিজেদের এলাকা বলে দাবি করে। এই দাবি চিন পরিত্যাগ করেনি। নরেন্দ্র মোদির বেইজিং উপস্থিতির সময় চিনা সরকারি টিভিতে ভারতের যে ম্যাপ দেখানো হয়, তাতে কাশ্মীর ও অরুণাচলকে ভারতীয় অংশ হিসেবে দেখানো হয়নি। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে চিন সড়ক নির্মাণ করছে ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও। চিন এই সড়ক নির্মাণ বন্ধ করেনি। দক্ষিণ চিন সাগরে চিন একটি বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করছে, যা কিনা জাপানের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের কর্মকা- ভারতের নিরাপত্তা স্ট্র্যাটেজিস্টদের আতঙ্কিত করেছে। ভারত তার উদ্বেগ প্রকাশ করলেও চিন তাতে সম্মান দেখায়নি। নেপাল ও মিয়ানমারে চিনা প্রভাব বাড়ছেÑ এটাও ভারতীয়দের উৎকণ্ঠার অন্যতম একটি কারণ। সবশেষ ভূমিকম্পকবলিত নেপালে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে চিন ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের ‘ঠা-া লড়াই’ও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ভারত ৩ বছর ভারত মহাসাগরে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে একটি বড় ধরনের নৌসামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে চিনাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না। ভারত একটি পারমাণবিক শক্তি। ভারত এখন পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে (এনএসজি) অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। কিন্তু তাতে আপত্তি রয়েছে চীনের। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিপণ্য নিয়ে ভারত চিনা বাজারে ঢুকতে চায়। কিন্তু তাতে রয়েছে চিনাদের আপত্তি। আগামীতে চিনাদের একটা বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে ভারতের প্রাচীন ‘কটন রুট’-এর পুনঃউত্থান। প্রাচীন যুগে ভারত ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে তার সুতিশিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছিল। প্রাচীন ভারতে বণিকরা ভারত মহাসাগরের কয়েকটি রুট ব্যবহার করে তাদের পণ্যসামগ্রী, বিশেষ করে ভারতীয় সুতি কাপড় নিয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত যেত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল এ পথ ধরেই। অথচ চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর কথা বলেছেন, তার সাথে মোদির প্রস্তাবিত ‘কটন রুট’-এর ধারণা সাংঘর্ষিক। প্রাচীন ‘কটন রুট’কে নতুন করে সাজানোর মধ্য দিয়ে ভারত এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেÑ অর্থাৎ ভারত মহাসাগরে তার সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। অনেকেই ধারণা করতে পারবেন মোদি অতিসম্প্রতি মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলংকা সফর করেছেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সাথে সেখানে একটি ভারতীয় নৌঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার সাথে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত এবং ওই জোট মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। এটা যদি কার্যকর হয়, তাহলে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে শ্রীলংকা, দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের সিসিলি, মরিশাস কিংবা ওমান-মোজাম্বিকও একই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এর অর্থ পরিষ্কারÑ বিশাল ভারত মহাসাগরে ভারত তার নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় এবং ‘ইন্ডিয়ান ওসেন রিম’ বা ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্র্ভূত হতে চায়। অথচ চিন ইতোমধ্যে তার ‘মুক্তার মালা’ নীতির মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। জিবুুতিতে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণ করতে চায় চিনÑ এ খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তবে চিনের জন্য একটি খারাপ খবর হচ্ছেÑ শ্রীলংকায় তার যে প্রভাব ছিল, তা এখন কমতির দিকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের ‘অতি চিননির্ভর’ নীতির কারণে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে। সিরিসেনার নেতৃত্বে একটি ‘ভারতবন্ধুু’ সরকার সেখানে ক্ষমতাসীন হয়েছে। ফলে আগামীদিনে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চিন ও ভারতের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা যে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। ভারত ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় তার সীমান্তবর্তী যেসব দেশ রয়েছে প্রতিটি দেশের সাথে তার সম্পর্ক শুধু ভালোই নয়, বরং সর্বকালের সেরা সম্পর্ক রয়েছে এখন। এ অঞ্চলে ভারতের অর্থনৈতিক, সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতে ভারতের মনমোহন সিং সরকার যা করতে পারেনি, তা মোদি সরকার করে দেখিয়েছে। ‘সার্ক যাত্রা’র অংশ হিসেবে ভারত এ অঞ্চলের দেশগুলোকে তার পতাকাতলে আনছে। এটা অনেকটা ‘মনরো ডকট্রিনের’ ভারতীয় সংস্করণÑ অর্থাৎ ভারত চাইবে না এ অঞ্চলে অন্য কোনো শক্তি কর্তৃত্ব করুক অথবা প্রভাব বিস্তার করুক। চিন এ অঞ্চলের নিকট প্রতিবেশী। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে চিনা সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। এ অঞ্চলে চিনের প্রভাব সঙ্কুচিত করার উদ্যোগ নিয়েই ভারত কাজ করে যাচ্ছে। ভারতের আপত্তির কারণে ভুটানে এখন অব্দি চিন তার দূতাবাস খুলতে পারেনি। তাই চিন-ভারত সম্পর্কটা অনেকের কাছেই আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়। এই সম্পর্ককে অনেক পর্যবেক্ষক ‘ভারতের হাতি বনাম চিনের ড্রাগন’ (Indian Elephant VS Chinese Dragon) হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ চিনের পরিচিতি যেখানে ড্রাগনকে দিয়ে ঠিক তেমনই ভারতের পরিচিতি হাতিকে দিয়ে। ‘হাতি বনাম ড্রাগন’ দ্বন্দ্ব নিঃসন্দেহে একুশ শতকের মধ্যভাগে শুধু এ অঞ্চলেই নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করবে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের কথা, যে যুদ্ধে ভারতের একটা বিশাল এলাকা চিন দখল করে নিয়েছিল। এর আগে মধ্য পঞ্চাশের দশকে ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ স্লোগান তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। তিব্বতকে কেন্দ্র করে ভারত ও চিন যে ‘পঞ্চশীলা নীতি’ নীতি গ্রহণ করেছিল, যা ন্যাম বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় একটি ভিত্তি দিয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের পররাষ্ট্র নীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই পঞ্চশীলা নীতি। যেমন বলা যেতে পারে, ইন্দোনেশিয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র নীতিতে এই পঞ্চশীলার কথা বলা আছে। মধ্য পঞ্চাশের সেই ‘নেহরু-চৌ এন লাইয়ের ইমেজ’ আবার ফিরে এসেছে ‘মোদি-শি জিন পিং বন্ধুত্বে’র মধ্যে দিয়ে। এটি কতটুকু কার্যকর হবে, মোদির এই সফর দুদেশের সম্পর্ককে কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মানসিকতার। ভারতের ব্যুরোক্রেসি ভারতকে একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে দেখতে চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে এই প্রভাব খাটানো কঠিন। মনমোহন সিং পারেননি। এখন দেখার পালা মোদি কতটুকু পারেন। তবে এটা তো সত্য, মোদির নিজস্ব একটি স্টাইল আছে। তিনি রাজনীতিকে পাশে ঠেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বেশি। তার চাই উন্নয়ন। চাই বিনিয়োগ। চাই ব্যবসা। সে কারণে পুরনো বৈরিতা ভুলে গিয়ে তিনি চিন সফরে বাণিজ্যিক সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তার বৈদেশিক নীতির এটাই বড় বৈশিষ্ট্য। তার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং সর্বশেষ চিন ও দক্ষিণ কোরিয়া সফরের উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে সফল করা। জাপান সফরের সময়েও তিনি সর্বোচ্চ ৩৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস পেয়েছিলেন। তিনি ভারতকে বিশ্বের ‘ম্যানুফেকচারিং হাব’ বা শিল্পকেন্দ্র হিসেবে তৈরি করতে চান। ২৫টি খাতকে সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করে মোদি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রচার শুরু করেছেন। ভারত যে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগ খরায় ভুগছিল তা থেকে দেশটিকে তিনি বের করে আনতে চান। পরিসংখ্যানই বলে তিনি এতে সফল। গত পাঁচ মাসে ভারতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিনিয়োগ এসেছে ৬ হাজার ৯১৭ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর এই সময় ছিল ৪ হাজার ৭৭১ মিলিয়ন ডলার। মোদি তার ‘গুজরাটি মডেল’কে সামনে রেখেই ‘সেফ ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারে নেমেছেন। সফলও হচ্ছেন। ভারতে গাড়িবাণিজ্যে বিনিয়োগ দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি কোম্পানি ফোর্ড মোটর্স। কোম্পানি মনে করে ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বের গাড়ি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ভারত হবে তৃতীয় বৃহৎ। সম্প্রতি পশ্চিম ভারতে এক বিলিয়ন ডলারে নির্মিত নতুন প্ল্যান্ট উদ্বোধন করে ফোর্ড। এ কারখানার ফলে দেশটিতে ফোর্ডের ইঞ্জিন উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে হবে ৬ লাখ ১০ হাজার এবং গাড়ি উৎপাদন হবে ৪ লাখ ৪০ হাজার। এতে করে সেখানে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও বাড়বে এবং অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। অনেক বিশ্লেষকই এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে, ভারতের বিনিয়োগ পরিবেশ আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। এটা নিঃসন্দেহে মোদির পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম সাফল্য। চিন সফরে মোদি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারত-চিনের পুনরুত্থান একবিংশ শতাব্দীর মাইলফলক। যে কোনো বিবেচনায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি এটা বোঝাতে চাচ্ছেন যে, ভারত ও চিনের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। প্রশ্ন সেখানেই। যেখানে দুদেশের মাঝে এক ধরনের সামরিক প্রতিযোগিতা তথা প্রভাব বিস্তার করার মানসিকতা লক্ষ করা যায়, সেখানে এই দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আগামী দিনগুলোতে? এর জবাব পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আগামী ২৬ মে মোদি তার ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পূর্ণ করবেন। মোদি থাকবেন ২০১৯ সাল পর্যন্ত। সময়টা অনেক লম্বা। এই সময়সীমায় বিশ্ব রাজনীতিতে আরও পরিবর্তন আসতে পারে এবং তাতে করে দুদেশের সম্পর্ককেও তা প্রভাবিত করতে পারে।
Daily Amader Somoy
23.05.15
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ কোন পথে
18:40
No comments
ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির বিজয়ের পর ইউরোপীয়
ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ এখন আবারও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এর আগে গ্রিসের ঋণ সংকট
থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে
পারেনি। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ একটি প্রশ্নের মুখে আছে আগে থেকেই।
এখন এর সঙ্গে যোগ হলো ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সিদ্ধান্ত।
নির্বাচনের আগে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে
থাকবে কি না, তা যাচাই করে দেখার জন্য তিনি ২০১৭ সালে একটি গণভোটের আয়োজন
করবেন। নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় তিনি এই গণভোটটি ২০১৬ সালেই
করতে চান। নির্বাচনের পরপর অভিবাসী প্রশ্নেও তিনি ইইউ নেতাদের সঙ্গে এক
বিতর্কে জড়িয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভূমধ্যসাগর পার হয়ে যেসব অভিবাসী ইউরোপের
বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে, তাদের ফিরে যেতে হবে। ইইউয়ের মধ্যে এ
প্রশ্নে দ্বিমত আছে। ফলে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে যে অভিন্ন ইউরোপ
কল্পনাতেই থেকে যেতে পারে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত
হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোনো অমূলক ধারণা ছিল না। বরং
১৯৫৭ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে
স্বাক্ষরিত ম্যাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড়
ধরনের পদক্ষেপ। ম্যাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয়
ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চে সেভেন চুক্তি ও
১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য
দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩
সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের
পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ কয়েকটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে।
ইইউয়ের সদস্য সংখ্যা এখন ২৮। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ইইউয়ের ১৫টি দেশের মধ্যে
১১টি ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৭টি দেশে। চালু হওয়ার সময়ই ইউরো
নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল, ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু
হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এ আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হলো।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তিন বছর পর্যন্ত নিজ
নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজি ও ধাতব
মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত ৯ বছর ইউরো নিয়ে বড়
ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ইইউয়ের কয়েকটি দেশ বড় ধরনের
অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে।
ইতিমধ্যে গ্রিস ও ইতালির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি চরমে ওঠে। কিন্তু গ্রিসের
পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে খারাপ। সেখানে পাপেন্দ্র সরকারের পতন, বিচারপতি
পাপাদেমাসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিংবা ২০১৫ সালের
জানুয়ারির নির্বাচনে বামপন্থী এলেক্সিস সিপ্রাসের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত
হলেও গ্রিস অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। এখন গ্রিস
পুনর্গঠনে একটি তালিকা চেয়েছে ইউরো গ্রুপ।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি শক্তি। অনেক আন্তর্জাতিক
ইস্যুতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু
ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সংকট ইইউয়ের ভূমিকাকে সংকুচিত করে দিয়েছে। এখানে বলা
ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ছয়টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি,
ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্য যে যাত্রা শুরু করেছিল, তা
আজ পরিণত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। ২৮টি দেশ এখন ইইউয়ের সদস্য। এর
মধ্যে আবার ২৪টি ন্যাটোর সদস্য। তবে জর্জিয়া ও ইউক্রেন এখনো ন্যাটোর সদস্য
হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র এই দুটি দেশকে ন্যাটোর সদস্যপদ দিতে চাচ্ছে, যাতে
রাশিয়ার রয়েছে আপত্তি।
ইউরোপে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয়
ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয়
কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দপ্তর, অর্থনৈতিক ও
সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক ও ইউরোপীয় মুদ্রা ইনস্টিটিউট
ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এ সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী
করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন
শুধু ইউরোই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে। যে
যুক্তি তুলে একসময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু)
যোগ দিতে চায়নি, সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হলো। অর্থনৈতিক সংকট
থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত
হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি
সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা
সম্ভব হবে কি না?
২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তি উৎসব পালন করে,
তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ইইউয়ের মধ্যে
বিভক্তি আছে। লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরোর
মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল,
ইউরো সব দেশের স্বার্থরক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই
ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের
ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা
করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড
নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিন্তিত
ছিল এ কারণে যে নিরাপত্তার বিষয়টিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে
খেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউয়ের জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক
চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের
সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালের
'ভেলভেট রেভল্যুশন' এ দেশগুলোকে সোভিয়েত-নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে
সাহায্য করে। যেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় ও দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত
হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ
দিতে পারেনি। এ দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউয়ের
সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু,
মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা
দান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি
পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা
কিংবা ক্রোয়েশিয়া এখনো ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব
সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারও মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে।
২০১৩-১৪ সময়সীমায় ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের শূন্য প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
ইইউয়ের প্রবৃদ্ধিও ছিল শূন্যের কোঠায়। তাই ইউরোপ নিয়ে শঙ্কা থেকেই গেল। এখন
ইইউয়ের ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ, তা আরো বাড়বে। ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের
দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি
দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাইছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট
সারকোজি খোলামেলাভাবেই এই বিভক্তির কথা বলেছিলেন। জার্মানির চ্যান্সেলর
অ্যাঙ্গেলা মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার
কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করেছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান
জোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কি না কিংবা
'নতুন ইউরোপ'-এর স্বরূপ কী হবে, তা এ মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি
পরিবর্তন যে আসন্ন, তা গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা
যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে
পারেনি। এটাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় ব্যর্থতা। তাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী
ক্যামেরন যখন ইইউতে থাকা, না থাকা নিয়ে গণভোট করতে চান, তখন ইউরোপের ঐক্যে
যে ফাটলের জন্ম হয়েছে সে ইঙ্গিতই দিলেন তিনি। ক্যামেরন স্পষ্ট করেই বলেছেন,
'আমরা যদি এখনই এসব সমস্যা নিয়ে উদ্যোগ নিতে না পারি, তাহলে ইউরোপের পতন
হবে এবং ব্রিটিশরাও পতনের দিকে যেতে থাকবে। অতীতে ইইউ সম্পর্কে এত ভয়ংকর
কথা কেউ বলেননি। এখন ক্যামেরন সাহস করেই বললেন। সামনের দিনগুলো অত্যন্ত
কঠিন সময় ইইউয়ের জন্য। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংকট যদি ইইউ কাটিয়ে উঠতে না
পারে, তাহলে এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়, আগামী এক দশকের মধ্যে আমরা এক ভিন্ন
ইউরোপের চেহারা দেখতে পাব।
ব্রিটেনের মতো একটি বড় দেশ যদি ইইউ ত্যাগ করে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের
অস্তিত্ব আর থাকে না। অভিবাসী প্রশ্নে ক্যামেরনের সর্বশেষ বক্তব্য প্রমাণ
করে, তিনি স্পষ্টতই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট।
যেখানে ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি জ্যাঁ ক্লদ জাংকার অভিবাসীদের ব্যাপারে,
বিশেষ করে তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে বসবাসের একটি পরিকল্পনা
করছেন, সেখানে ক্যামেরন এর বিরোধিতা করছেন। জাংকারের পরিকল্পনায় বিভিন্ন
দেশের জন্য একটি 'অভিবাসী কোটা' রাখার কথা বলা হয়েছে। অথচ নয়া ব্রিটিশ
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টেরেসা মে বলেছেন, এই 'কোটাব্যবস্থা' ব্রিটেন মানবে না।
এতে ইউরোপের দিকে অভিবাসীদের আসাকে উৎসাহিত করবে। এমনকি হাঙ্গেরির
প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান কোটাব্যবস্থাকে 'বিকৃত মস্তিষ্ক ও অন্যায্য'
বলে অভিহিত করেছেন। এখানে বলা ভালো, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ভূমধ্যসাগর
অতিক্রমকালে শত শত অভিবাসী উদ্ধার হয়েছে, অথবা নৌকাডুবিতে মারা গেছে। এসব
অভিবাসীর টার্গেট হচ্ছে ইতালি, গ্রিস, সাইপ্রাস ও মাল্টা। অতিরিক্ত
অভিবাসীর চাপ সামলাতে না পেরে এই দেশগুলো ইইউয়ের কাছে প্রতিকার চেয়েছিল। গত
বছর ইইউয়ের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এক লাখ ৮৫ হাজার অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছে।
ফলে এটা স্পষ্ট, আগামীতে এই অভিবাসী ইস্যু ইউরোপীয় রাজনীতিতে একটি বড়
বিতর্ক তুলবে।
ব্রিটেনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কনজারভেটিভরা ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। অভিবাসী
ইস্যু, ইইউতে থাকা না থাকা নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য নিয়ে ডেভিড ক্যামেরন
ভোটারদের কাছে গিয়েছিলেন। ভোটাররা তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে। ফলে তিনি গণভোটের
সিদ্ধান্তটি এক বছর এগিয়ে আনতে চান। এ ক্ষেত্রে গণভোটে যদি বেশির ভাগ
ভোটার ইইউতে না থাকার পক্ষে ভোট দেয়, তাহলে ইইউয়ের অস্তিত্ব বড় ধরনের
হুমকির মুখে পড়বে। এ ক্ষেত্রে ইইউয়ের নেতারা কিভাবে ব্রিটেনকে আস্থায় নেন,
সেটাই দেখার বিষয়। তবে এটা বলতেই হবে, ইইউ সংকটে আছে। এই সংকট ইইউয়ের
কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়ে
Daily Kalerkontho
21.05.15
কোন পথে যুক্তরাজ্য
18:39
No comments
গেল
সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের সংসদের নিম্নকক্ষ হাউজ অব কমন্সের নির্বাচনে
কনজারভেটিভ পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার পর একটা প্রশ্ন ইতোমধ্যে
উঠেছে যে কোন পথে এখন যুক্তরাজ্য? দুটো কারণে এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে
এসেছে_ একটি হচ্ছে যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থাকবে কিনা এটা নিয়ে
প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের একটি গণভোট করার সিদ্ধান্ত, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে_
কট্টরপন্থী স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির বিপুল বিজয়। এই দুটো বিষয়
সরাসরিভাবে যুক্তরাজের ভবিষ্যৎ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। নির্বাচনের আগে
ক্যামেরন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে ২০১৭ সালে তিনি গণভোটের আয়োজন করবেন।
কিন্তু নির্বাচনের বিজয়ের পর তিনি এখন বলছেন ওই গণভোটটি তিনি ২০১৬ সালেই
করতে চান। আর নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করার পর স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট
পার্টির প্রধান নিকোলা স্টারজিওন বিবিসিকে বলেছেন, যদি ব্রিটেন ইউরোপীয়
ইউনিয়ন ত্যাগ করে, তাহলে স্কটল্যান্ডও যুক্তরাজ্য ইউনিয়ন ত্যাগ করবে। ফলে
নির্বাচন পরবর্তী যুক্তরাজ্য এক বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে
যাচ্ছে।
আগামী ৫ বছর ক্যামেরন ক্ষমতায় থাকবেন। সুতরাং তার আগেই সিদ্ধান্ত শুধু
ইউরোপীয় রাজনীতি নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব ব্রিটেনকে বিতর্কিত করতে পারে। গেল ১১
মে পার্লামেন্টের ভাষণে নির্বাচনের পর তিনি যেসব ইস্যুর অবতারণা করেছেন।
তা ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ রাজনীতির কিছুটা ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২৮ জাতিভিত্তিক
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যে তিনি বড় ধরনের দর কষাকষিতে যাচ্ছেন নির্বাচন
পরবর্তী পার্লামেন্টে দেয়া প্রথম ভাষণে তিনি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। যদিও তিনি
এটা স্পষ্ট করেননি কোন কোন ইস্যু নিয়ে তিনি ইইউ নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন অভিবাসীদের সামাজিক সেবা পাওয়ার সুবিধা (স্বাস্থ্য,
শিক্ষা, বাসস্থান, বেকারভাতা) কাটছাঁট করার তিনি উদ্যোগ নেবেন, যা ইইউর
নীতিমালার পরিপন্থী। এ ক্ষেত্রে ব্রিটেন আলাদাভাবে যদি কোনো নীতিমালা
প্রণয়ন করে, তাহলে বিষয়টি ইইউর যে সংবিধান রয়েছে, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
কেননা একজন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশের নাগরিক ইইউভুক্ত যে কোনো
দেশে বসবাস করতে পারে এবং সে সে দেশের সামাজিক সুবিধা পাওয়ার যোগ্য।
এখানে বলা ভালো, যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্সের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি
বিজয়ী হয়েছে। জনমত জরিপে বলা হয়েছিল একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে কিন্তু তা
হয়নি। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই কনজারভেটিভ পার্টি আবারো ক্ষমতায় থেকে গেল
আগামী পাঁচ বছরের জন্য। ২০১০ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভরা যে ফলাফল
করেছিল, এবার তাদের ফলাফল গেলবারের ফলাফলকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১০ সালে
কনভারভেটিভরা পেয়েছিল ৩০৬ আসন। এবার এ সংখ্যা ৩৩১। অন্যদিকে লেবার পার্টির
ভরাডুবি হয়েছে। গেলবার তারা পেয়েছিল ২৫৮ আসন, আর এবার পেল ২৩২ আসন। ভরাডুবি
ঘটেছে লিবারেল ডেমোক্রেটদের। গেলবার তাদের আসন সংখ্যা ছিল ৫৭, এবার তা কমে
এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮টিতে। তবে অবাক করা ঘটনা ঘটেছে স্কটল্যান্ড
ন্যাশনালিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে। সর্বশেষ নির্বাচনে তারা পেয়েছিল মাত্র ৫টি
আসন। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬টিতে।
যুক্তরাজ্যের এই নির্বাচন এখন অনেক প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের গত ৯৩ বছরের যে গণতন্ত্র (১৯২২ থেকে), সেখানে মূলত দুটি
প্রধান দলই ক্ষমতা পরিচালনা করে, এই ধারা থেকে যুক্তরাজ্য এবারো বেরিয়ে
আসতে পারল না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বরাবরই কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টির মধ্যেই
সীমাবদ্ধ থাকে। এবং এরাই সরকার গঠন করে। ২০১০ সালে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল
বটে। সেবার সরকার গঠনের জন্য কনজারভেটিভ দলের প্রয়োজন ছিল তৃতীয় একটি দলের
সমর্থনের। লিবডেম বা লিবারেল ডেমোক্রেটরা কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডেবিড
ক্যামেরনের প্রতি সমর্থন দিয়ে যৌথভাবে একটি সরকার গঠন করেছিলেন এবং লিবডেম
নেতা নিক ক্লেগ উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার লিবডেমের বড়
ধরনের পরাজয় হয়েছে। এই মুহূর্তে লিবডেমকে বাদ দিয়ে ডেভিড ক্যামেরন এককভাবেই
সরকার গঠন করেছেন। তিনি এবার আর একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেননি। চারটি
জাতি নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত এবং হাউজ অব কমন্সের আসনও সেভাবে নির্ধারিত।
যেমন ইংল্যান্ডের রয়েছে ৫৩৩ আসন, ওয়েলসের ৪০, নর্থ আয়ারল্যান্ডের ১৮ ও
স্কটল্যান্ডের ৫৯। সব মিলিয়ে ৬৫০ আসনে সরকার গঠনের জন্য দরকার হয় ৩২৬টি
আসন। এই নির্বাচন প্রমাণ করল যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থানের
যে সম্ভাবনা ছিল, সে সম্ভাবনা আর নেই।
সাধারণ মানুষের আস্থা দুটো বড় দলের প্রতিই। তবে যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্রের
এটা একটা সৌন্দর্য যে, দল যদি হেরে যায় তাহলে দল নেতা পরিবর্তন করে। এড
মিলিব্যান্ড এখন আর লেবার পার্টির নেতা নন। তিনি পদত্যাগ করেছেন। একই সঙ্গে
লিবডেমের নেতৃত্বেও পরিবর্তন এসেছে। নিক ক্লেগের পরিবর্তে আমরা এখন অন্য
কাউকে দেখব লিবডেমের নেতৃত্বে। যুক্তিটা হচ্ছে দলের নেতৃত্ব যে নীতি ও
আদর্শ নিয়ে নির্বাচনে গেল, ভোটাররা তা গ্রহণ করেনি। ফলে দলকে এখন নয়ানীতি ও
আদর্শ খুঁজে বের করতে হবে। স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এসএনপি) এখন হাউজ
অব কমন্সে তৃতীয় শক্তিশালী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই দলটি
স্কটল্যান্ডের ৫৯টি আসনের মধ্যে ৫৬টি আসন পেয়েছে। অথচ এই দলটি
স্কটল্যান্ডকে যুক্তরাজ্য ইউনিয়ন থেকে বের করে নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ গড়তে
চায়। এটা ছিল তাদের সস্নোগান। যদিও গেল সেপ্টেম্বরে (২০১৪) স্কটল্যান্ডে
স্বাধীনতার প্রশ্নে যে গণভোট হয়েছিল, তাতে যুক্তরাজ্যে থাকার পক্ষেই ভোট
হয়েছিল বেশি। এখন এসএনপির নেতা নিকোলা স্টারজিওন কী ভূমিকা নেন, সেদিকে
অনেকের লক্ষ্য থাকবে। যদিও ইতোমধ্যেই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে স্কটল্যান্ডের
স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি আবারো একটি গণভোটের উদ্যোগ নেবেন। ফলে তার
ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই।
এখন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নির্বাচনের আগেই বলেছিলেন ভবিষ্যতে
যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, এটা নিয়ে যে বির্তক চলছে, তা যাচাই
করে দেখার জন্য আগামী ২০১৭ সালের (এখন ২০১৬) তিনি যুক্তরাজ্যে একটি
গণভোটের আয়োজন করবেন। মানুষ এতে সায় দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকা
নিয়ে ব্রিটেনে একটা বিতর্ক আছে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে আছে বটে, কিন্তু
ইউরোপীয় মুদ্রা, ইউরোতে কখনই যোগ দেয়নি। ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি রাষ্ট্র নিয়ে
ইউরোপীয়ান ইকোনমিক কমিটি (ইইসি) যাত্রা শুরু করে আজ তা ইউরোপীয় ইউনিয়নে
পরিণত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্য তৎকালিন ইইসিতে যোগ দেয়। আর ২০০২ সালের ১
জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের সঙ্গে ১২টি দেশ অভিন্ন মুদ্রা ইউরো
চালু করে। পরে আরো কয়েকটি দেশ ইউরো গ্রহণ করে। কিন্তু যুক্তরাজ্য তাদের
মুদ্রা পাউন্ডকে ধরে রেখেছে। তুলনামূলক বিচারে ব্রিটেনের মানুষ কিছুটা
কনজারভেটিভ। তারা মনে করে ইইউ বা ইউরোতে যোগ দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাদের
স্বকীয়তা ঐতিহ্য সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া। তাই তারা বার বার ইউরো গ্রহণ করার
বিপক্ষে মত দিয়ে আসছে। এসব কনজারভেটিভদের বিজয় এই প্রশ্নটাকেই সামনে নিয়ে
এলো যে এর মধ্যদিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রনীতিতে কতটুকু পরিবর্তন আসবে
কিংবা আদৌ পরিবর্তন আসবে কিনা? বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্কে কোনো
পরিবর্তন আসবে কিনা সে ব্যাপারেও প্রশ্ন আছে।
তবে যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কিংবা তার পররাষ্ট্রনীতিতে বড়
পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই নির্বাচন যুক্তরাজ্যের দীর্ঘ ৭৫০ বছরের
গণতন্ত্রের ইতিহাসের ধারাবাহিকতাই মাত্র। অনেক অনেক পর্যবেক্ষক ধারণা
করেছিলেন একটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই পরিবর্তনটি এলো না। এখন টিউলিপ আর
রুশনারারা ব্রিটেনের চলমান রাজনীতিতে কতটুকু অবদান রাখতে পারবেন, আমাদের
কাছে তা যতটুকু না বিবেচ্য, তার চেয়ে বেশি বিবেচ্য বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য
সম্পর্কে উন্নয়নে এরা কতটুকু অবদান রাখবেন। তবে বেশকিছু বিষয় রয়েছে। সেদিকে
দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। যে তিনটি এলাকা থেকে এরা নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানে
বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সেখানে ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশিরা বেকার।
নারীরা সেখানে নিগৃহীত। উচ্চশিক্ষায় তাদের আগ্রহ কম। এই বিষয়গুলোর দিকে
তাদের নজর দিতে হবে। টিউলিপ সিদ্দিক নিজে দীর্ঘদিন এই বাঙালি কমিউনিটিতে
কাজ করেছেন। তিনি ভালো করে জানেন সমস্যাটি। এখন তিনি তার এলাকার উন্নয়নে
যদি কাজ করেন, আমার ধারণা তিনি এই আসনটি স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে পারবেন।
তিনিও পারবেন একটি মডেল হতে। আমার জানা মতে আরো বেশ কিছু বাঙালি রয়েছেন,
যারা শিক্ষিত এবং ব্রিটেনের সমাজ উন্নয়নে তারা অবদান রাখছেন। তারাও ধীরে
ধীরে যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের শরিক করেন, আমার ধারণা আগামীতে আমরা
আরো বাঙালি এমপি পাব ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। ১০-১২ লাখ বাঙালি ব্রিটেনে
বসবাস করেন। এদের জন্য তিনজন এমপি যথেষ্ট নয়। এ সংখ্যা আরো বাড়বে। এই
বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ এরা সামাজিক ভাতা গ্রহণ করেন আবার অবৈধ
চাকরিও করেন এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এটি গুরুতর আইন লঙ্ঘনের শামিল।
বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে সব বাঙালি এটি করেন না। এটি কমিউনিটির
বদনাম। একটি অভিযোগ উঠেছে, একটি 'চক্র' লন্ডনে টিউলিপ সিদ্দিকের নির্বাচনী
এলাকায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর প্রচারপত্র বিলি করে। এর সঙ্গে
বাংলাদেশের দুটো দলের স্থানীয় নেতাকর্মীর যোগ-সাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করা
হয়েছে। এটা নিন্দনীয় এবং শাস্তিযোগ্য একটি অপরাধ। বাংলাদেশে আমরা হামেশাই এ
ধরনের কর্মকা- দেখতে পাই। তাই বলে ব্রিটেনের মতো সমাজেও এ ধরনের কর্মকা-
হবে? এতে করে প্রবাসে বাঙালি হিসেবে আমাদের মর্যাদা বাড়ে না, বরং কমে যায়।
যেটা দুঃখজনক, তা হচ্ছে বাঙালিরা ব্রিটেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার পরও এদের
অনেকে স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত না হয়ে এদের অনেকে বাংলাদেশি
রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকা-ে এবং সংগঠনে নিজেদের জড়িত করেন। তারা থাকেন
লন্ডন। অথচ রাজনীতি করেন বাংলাদেশের। ফলে স্থানীয় কমিউনিটি লিডারশিপ তৈরি
হচ্ছে না। বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের একটা বড় অভিযোগ, ওরা দক্ষ শেফ
ও রেস্টুরেন্টকর্মী পাচ্ছেন না। স্থানীয় শেতাঙ্গ কমিউনিটি এ পেশায় আসতে
আগ্রহী নয়। ফলে বাংলাদেশের ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ভিসা সমস্যার
কারণে তারা বাংলাদেশ থেকে কর্মী আনতে পারছেন না। কর্মী সমস্যার কারণে
ঝুঁকির মুখে আছে এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। নির্বাচনের আগেই ডেভিড ক্যামেরন
তার নির্বাচনী প্রচারণায় অভিবাসীদের সংখ্যা বছরে ৬০ হাজারে নামিয়ে আনার কথা
বলেছিলেন। তার ওপর চাপ বাড়ছে। তিনি যদি এটি কার্যকর করেন, তাহলে
ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশি অভিবাসীরা। এই তিন বাঙালি নারীকে এখন
পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশি পণ্যের আরো বাজার
সম্প্রসারণের একটা সম্ভাবনা রয়েছে যুক্তরাজ্যে। এই বাজার সম্প্রসারণে এরা
কাজ করতে পারেন। দুই দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তথা নেত্রীদের মধ্যে যোগাযোগ
রয়েছে। এই যোগাযোগকে আরো শক্তিশালী করতে পারেন এরা।
মোটা দাগে যা বলা যায় তা হচ্ছে যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরো উন্নত হবে।
বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের আগ্রহ আরো বাড়বে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী করা মানবাধিকার পরিস্থিতির আরো উন্নত করা,
বিনিয়োগ বাড়ানো, নারী উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ইত্যাদির মধ্যদিয়ে এ
দুই দেশের সম্পর্ক আরো উন্নত হবে। অন্যদিকে ট্রেডিশনাল
যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য সম্পর্কে তেমন পরিবর্তন আসবে না! ক্যামেরন ইইউ
ত্যাগ করার ব্যাপারে চাইলেও, আপাতত তা পারবেন না। তবে অভিবাসীদের ক্ষেত্রে
কড়াকড়ি আসবে আরো।
দক্ষিণ এশীয় এবং পূর্ব-ইউরোপের শেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর অভিবাসন প্রক্রিয়ায় আরো
কড়াকড়ি ব্যবস্থা আসবে। এতে যে কোনো ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত নাগরিক হুট করে
ব্রিটেনে বসবাস বা সামাজিক সুবিধা পাবেন না। ইউরো গ্রহণ না করেও ব্রিটেন
যেমনি ইইউতে করে গেছে, ঠিক তেমনি ইউরোপীয় অভিবাসীদের ক্ষেত্রে একই পন্থা
অবলম্বন করবে ক্যামেরন সরকার। নিঃসন্দেহে আগামী দিনে কনজারভেটিভদের
নেতৃত্বে এক নয়া ব্রিটেনকে আমরা দেখতে পাব।
Daily Jai Jai Din
20.05.15
কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন
17:30
No comments
স্নায়ুযুদ্ধের
অবসানের পর বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ঢেউ বয়ে যায়। বিশেষ করে রাশিয়া ও পূর্ব
ইউরোপে কী ধরনের সমাজ-সংস্কৃতি বিকশিত হয়, এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অনেকের।
দীর্ঘ ৭৩ বছর রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো একদলীয় সমাজতান্ত্রিক সরকারের
অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সাবেক চেক প্রেসিডেন্ট ভাসলাভ
হাভেলের নেতৃত্বে যে ভেলভেট রেভ্যুলেশনের জন্ম হয়, তা বদলে দেয় পূর্ব
ইউরোপকে, সেই সঙ্গে রাশিয়াকেও। অবসান ঘটে স্নায়ুযুদ্ধের। মার্কিন
তাত্ত্বিকদের কেউ কেউ তখন বলার চেষ্টা করেছিলেন, সমাজতন্ত্র একটি ভ্রান্ত
ধারণা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এবং লিবারেলিজমেরই জয় হল (ফ্রান্সিস
ফুকিয়ামা)।
তখন থেকেই রাশিয়া তথা পূর্ব ইউরোপের
বিকাশমান গণতন্ত্র নিয়ে যেমন প্রশ্ন ছিল, ঠিক তেমনি প্রশ্ন ছিল উন্নয়নশীল
বিশ্বের গণতন্ত্র নিয়েও। এখানে অধ্যাপক হানটিংটনের বিখ্যাত নিবন্ধ (যা পরে
বই আকারে প্রকাশিত হয়) The Clash of Civilizations the- Next Pattern or
Conflict-এর কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেখানে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন কোন
সভ্যতা ভবিষ্যতে টিকে থাকবে এবং উন্নয়নশীল বিশ্ব কোন বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব
দেবে। অধ্যাপক হানটিংটন লিখেছিলেন, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নৈকট্য বিভিন্ন
জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোকে ৮টি সভ্যতার ছত্রছায়ায় একত্রিত করবে এবং এদের
মধ্যকার দ্বন্দ্বই বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তিনি অর্থনৈতিক
শক্তিজোট ও আঞ্চলিক শক্তিকে একেবারে অস্বীকার করেননি। তিনি মন্তব্য
করেছিলেন এভাবে : 'economic regionalism may succeed only when it is
rooted in a common civilization'। অর্থাৎ অর্থনৈতিক জোটগুলো সাফল্য লাভ
করবে যদি সাংস্কৃতিক (তথা ধর্মীয়) কাজটা অটুট থাকে। এখানেই রয়েছে মোদ্দা
কথাটি। অর্থনৈতিক সাফল্যটাই আসল, রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রধান নয়। যদি আরও
খোলাসা করে বলা যায়, তাহলে বলা যেতে পারে- গণতন্ত্র হতে পারে, তবে কম
গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন। গণতন্ত্রকে কাটছাঁট করে যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ এ সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিটাই
আসল। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া এর বড়
উদাহরণ। মালয়েশিয়ার কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। এ দেশগুলোতে সীমিত
গণতন্ত্র আছে। এসব সমাজে বিকাশমান প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সঙ্গে
পশ্চিমা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না,
এটা সত্য। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার
গণতন্ত্র নিয়ে সেখানকার মানুষ খুশি।সিঙ্গাপুর
একটি ছোট্ট দেশ। দ্বীপরাষ্ট্র। মাত্র ২৫০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে যে
রাষ্ট্রটি আজ বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি, তা একসময় জেলেদের পল্লী
হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রয়াত লি কুয়ান ইউ এ রাষ্ট্রটিকে কোথায় নিয়ে গেছেন, তা
আজ সবাই জানে। সিঙ্গাপুরকে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার
ব্যাপারে কাজ করেছিল লি কুয়ান ইউর দর্শন, যেখানে তিনি সফলভাবে প্রয়োগ
করেছিলেন কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন তত্ত্ব। সেখানে গণতন্ত্র আছে, সংসদ আছে,
বিরোধী দলও আছে। তবে পিপলস অ্যাকশন পার্টির রয়েছে একক কর্তৃত্ব। একটি
শিক্ষিত, দক্ষ, ব্যবসাবান্ধব এলিট শ্রেণী রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সক্রিয়।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে (ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মতে
হাইব্রিড গণতন্ত্র) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
অনেকের মতে, কনফুসিয়াস মতবাদ সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে অন্যতম একটি শক্তিশালী
ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রাচীন চীনা পণ্ডিত কনফুসিয়াস ব্যক্তি ও
পরিবারকেন্দ্রিক সমৃদ্ধি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিশ্বাস করতেন (চীনে
একসময় কনফুসিয়াস নিষিদ্ধ ছিল। আজ চীন কনফুসিয়াসের মতবাদ ধারণ করে)।
সিঙ্গাপুর এই মতবাদটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবহার করছে। সেই সঙ্গে যোগ্য
নেতৃত্ব, রাজনীতিতে শিক্ষিত ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ,
দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ, সুশাসন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সুষ্ঠু অর্থনৈতিক
ব্যবস্থাপনা সিঙ্গাপুরকে একটি বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে।
তথাকথিত পশ্চিমা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এখানে বিকশিত হয়নি।
সিঙ্গাপুরের নেতৃত্ব এর প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেনি।দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার আরেকটি দেশ মালয়েশিয়া। শতকরা ৬১.৩ ভাগ অধিবাসী মুসলমান আর ১১ ভাগ
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর দেশ মালয়েশিয়া। এখানে বিকশিত হয়েছে প্রতিনিধিত্বশীল
গণতন্ত্র। তবে নিঃসন্দেহে, এর সঙ্গে ব্রিটেনের গণতন্ত্রের কোনো মিল নেই। লি
কুয়ান ইউর মতো মাহাথির মোহাম্মদও মালয়েশিয়াকে উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিতে
পরিণত করেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে ঐক্যই শক্তি। অর্থাৎ
বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত মালয়েশিয়ার জনগোষ্ঠীকে এক পতাকাতলে
আনতে শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক শক্তির (বারিসোয়া নেসিওনাল বা ন্যাশনাল
ফ্রন্ট, ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা উমনো যার মূল শক্তি) জন্ম
দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ১৩টি রাজনৈতিক দলের এই ফ্রন্ট, যা
মালয়েশিয়ার ঐক্যের প্রতীক, দীর্ঘদিন মালয়েশিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।
মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে ২০০৩ সালে অবসর নেন। এই ২২ বছরে
তিনি মালয়েশিয়াকে অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেন। এখানেও কাজ
করেছে সেই স্পিরিট- কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন। সেখানে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত
গণতন্ত্র। মিডিয়া স্বাধীন নয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত। সংসদ আছে,
বিরোধী দলের অস্তিত্বও রয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলের বড় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়
না। যদিও সংসদের নিুকক্ষে (Dewan Rakyat) ক্ষমতাসীন বারিসোয়া নেসিওনালের
আসন সংখ্যা ১৩৩ এবং বিরোধী ফ্রন্টের (Pakatain Rakyat, ৩ দল) রয়েছে ৮৯টি
আসন। বিরোধী দলের আসন বাড়লেও তা রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।উঠতি
অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে রাশিয়ার কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়।
সমাজতন্ত্র-পরবর্তী রাশিয়ায় যে গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে, তাকে হাইব্রিড
গণতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও সেখানে দেখা গেছে একটি গোষ্ঠীই ঘুরেফিরে
ক্ষমতা পরিচালনা করছে। অথবা বলা যেতে পারে, ক্ষমতা ধরে রেখেছে। পাঠক,
স্মরণ করার চেষ্টা করুন, ১৯৯৯ সালে ভাদিমির পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে
নিয়োগ করেছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন। কিন্তু মাত্র চার মাসের মাথায় ৩১ ডিসেম্বর
(১৯৯৯) ইয়েলৎসিন প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ালে পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে
দায়িত্ব নেন। সেই থেকে তিনি আছেন। প্রেসিডেন্ট থেকে (দুই টার্ম) পরে
প্রধানমন্ত্রী, আবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার
কারণে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দুই টার্ম পালন করার পর (২০০৮)
ছেড়ে দেন। এখন আবারও প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এবং যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন
(মেদভেদেভ) তিনি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৬ সালে পুতিন আবারও প্রেসিডেন্ট
পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং সন্দেহাতীতভাবে ২০২০ সাল পর্যন্ত থাকবেন।
একসময় মনে করা হতো রাশিয়ায় প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র বিকশিত হবে। কিন্তু
দেখা গেল সেখানে গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের গোষ্ঠীতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, যারা
ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। সেখানে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন
কার্যক্রম, ব্যবসা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। রাশিয়ার জ্বালানি শক্তি একদিকে
পূর্ব ইউরোপ তথা পশ্চিম ইউরোপের (যেমন জার্মানি) দেশগুলোকে তার ওপর
নির্ভরশীল করে তুলেছে, অন্যদিকে এই জ্বালানি শক্তিকে (গ্যাস) কেন্দ্র করে
সেখানে একটি ব্যবসায়িক শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে, যারা ক্ষমতাসীনদের পাশে থেকে
তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতার স্বাদ নিচ্ছে। সেখানে এক ধরনের মাফিয়া
শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যারা রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।সিঙ্গাপুর,
মালয়েশিয়া আর রাশিয়া- তিনটি দেশেই এক ধরনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু
রয়েছে। নির্বাচন হচ্ছে। সংসদ আছে। বহুদলীয় রাজনীতি রয়েছে। রয়েছে বিরোধী
দলও। তবে একটির সঙ্গে অন্যটির পার্থক্য রয়েছে প্রচুর। সিঙ্গাপুরের
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোথাও কোথাও
মিল যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অমিলও। একসময় সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া ফেডারেশনের
অংশ ছিল। আজ স্বাধীন দেশ। এক্ষেত্রেও সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দল
ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মধ্যে মিল যেমন আছে, তেমনি আছে অমিলও।
একটি জায়গায় মিল আছেই- আর তা হচ্ছে উন্নয়ন; তবে রয়েছে কম বা সীমিত
গণতন্ত্র। কেউ কেউ এ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র বলারও চেষ্টা করেন।
তথাকথিত প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের নামে উন্নয়ন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়,
সেটাই হচ্ছে অগ্রাধিকার। এতে করে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে জন্ম হয়েছে
ধনিকতন্ত্রের (Plutocracy) অর্থাৎ এসব দেশে (এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও) একটি
বিশেষ শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যারা অত্যন্ত সম্পদশালী এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ
ব্যবহার করে নিজেদের সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়েছে। রাশিয়ায় এই গণতন্ত্রীদের
সংখ্যা অনেক বেশি, সেখানে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্বের সংখ্যা খুবই কম।এখানে
আরও একটা কথা বলা দরকার। এসব দেশ তথাকথিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিজ দেশের
ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে বিনির্মাণ করলেও তারা সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন
প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে দেশগুলো এক একটি উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিতে
পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালে গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও নেইল MIKT
(ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা এতে যোগ দেয়ার পর হয়
BRICS)। জোটের ধারণা দিয়েছিলেন। সেই ব্রিকস এখন বাস্তব সত্য। ব্রিকসের
উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প আরেকটি বিশ্বব্যাংক তৈরি করা হয়েছে (চীন যার
মূল উদ্যোক্তা)। অনেক পশ্চিম ইউরোপীয় দেশও এতে যোগ দিয়েছে। রাশিয়া এ জোটের
অন্যতম সদস্য। ২০১১ সালে জিম ও নেইল MIKT অর্থনৈতিক জোটের কথা বলেছেন
মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক এই অর্থনৈতিক জোটের সদস্য।
একই সঙ্গে ২০১১ সালে জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যাক গোল্ডস্টোন
TIMBI জোটের প্রস্তাব করেছিলেন। তুরস্ক, ভারত, মেক্সিকো, ব্রাজিল,
ইন্দোনেশিয়া এ জোটের সদস্য। দেশগুলো সবই উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। অধ্যাপক
গোল্ডস্টোন যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, চীন ও রাশিয়ায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হ্রাস
পাবে এবং বৃদ্ধদের সামাজিক সুবিধা দেয়ায় রাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর তা প্রভাব
ফেলবে। অন্যদিকে ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশে জনগোষ্ঠী বাড়বে, এতে করে বাড়বে
বস্তির সংখ্যা। তবে বস্তিবাসীকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা যাবে। ফলে
ব্রিকসের আবেদন কমবে, আর গুরুত্ব বাড়বে TIMBI জোটের।আমরা
ব্রিকস বলি আর টিমবি জোট বলি, এদের একটা মিল আছে। এসব দেশে এক ধরনের
প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র আছে। সংসদ আছে। বিরোধী দলও আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক
উন্নয়নকে তারা গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। যেমন, বলা যেতে পারে তুরস্কের কথা।
তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শতকরা ৮ ভাগ। যেখানে ইউরোপের প্রতিটি দেশে
অর্থনীতিতে শ্লথগতি চলছে, সেখানে তুরস্ক ইউরোপের অনেক দেশকে আর্থিক সাহায্য
দিয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ায়ও বিশাল এক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা উৎপাদন
প্রক্রিয়ায় বড় অবদান রাখছে। এসব দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে ইউরোপের
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে মেলানো যাবে না। কিরঘিজস্তানের প্রেসিডেন্ট
কুরমানবেক বাকিয়েভ একবার বলেছিলেন, 'Western Democracy in not Suitable for
Kyrgyzstan। অর্থাৎ পশ্চিমা গণতন্ত্র কিরঘিজস্তানের জন্য উপযুক্ত নয়। তিনি
যে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করেছিলেন তাকে বলা হয়, Consultative democracy
envisaging dialogues with influential social groups, would be more in
keeping with his country's tradition (AP news, 23 March 2010)। পশ্চিমা
পর্যবেক্ষকরা এটাকে বলছেন Consultative Democracy, অর্থাৎ জনতার সঙ্গে
পরামর্শমূলক একটি ব্যবস্থা, যা কিরঘিজস্তানের ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।এটাই
হচ্ছে মোদ্দাকথা। নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এবং
অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ এসব দেশের
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে আমরা বিবেচনা করতে পারি। বাংলাদেশে
রয়েছে একটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। তাদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।
প্রতিটি জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় (যা কি-না কলেজেরই নামান্তর!) কোনো
সমাধান নয়। বরং বিভিন্ন পেশাজীবী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করে আমরা একটা
দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে পারি, যারা অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। অর্থনীতিতে
জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬ ভাগ ধরে রাখা (এখন যা ৫.৭ ভাগে নেমে আসার কথা),
২৪ মিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ, ২৭ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য, দারিদ্র্য ২৪
ভাগে কমিয়ে আনা, মাথাপিছু আয় ১১৯০ ডলারে উন্নীত করা, ১৩,২৮৩ মেগাওয়াট
বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, বছরে ৩৮৩ দশমিক ৪৩ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন করা
(বাংলাদেশ চাল রফতানিও করছে), ২৪ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্ট ব্যবসা, ৭৭ লাখ
গার্মেন্ট উদ্যোক্তা- এই যে পরিসংখ্যান, এ পরিসংখ্যান বলে আমাদের সম্ভাবনা
রয়েছে। আমরাও নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারি। এখন যা দরকার
তা হচ্ছে শিক্ষিত, দক্ষ নেতৃত্ব, দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, দুর্নীতি
হ্রাস, আয়ের সুষম বণ্টন এবং আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতি। এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের সঙ্গে মেলানো
যাবে না। গণতন্ত্র কম, উন্নয়নটাই আসল- এই দৃষ্টভঙ্গিই বাংলাদেশকে আগামীতে
নতুন অর্থনৈতিক জোটে শরিক হতে সাহায্য করবে।
Daily Jugantor
19.05.15
তিন বাঙালি কন্যার ব্রিটেন জয়
17:35
No comments
তিন
বাঙালি কন্যার ব্রিটেন ‘জয়’ এখন খোদ লন্ডন এবং বাংলাদেশেও আলোচনার অন্যতম
বিষয়। তিন বাঙালি কন্যা- রুশনারা আলী, রেজোয়ানা সিদ্দিক টিউলিপ আর ড. রূপা
হক- ব্রিটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের দ্বিতীয় প্রজন্ম। যদিও কবে থেকে
বাঙালিরা ব্রিটেনে বাস করতে শুরু করে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের
কাছে জানা না থাকলেও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাঙালিরা বিশেষ করে সিলেটের
বাঙালিরা জাহাজ থেকে নেমে প্রথমে লন্ডনে পা রাখেন। তবে এ তিন বাঙালি তাদের
প্রতিনিধিত্ব করেন না। এরা দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি, যারা সবাই স্বাধীন
বাংলাদেশ-পরবর্তী সময় ব্রিটেনে বাস করতে শুরু করেন। শিক্ষাদীক্ষায় তারা
ব্রিটেনকেই তাদের দেশ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। যদিও তারা বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ
করেন। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে তিন বাঙালি নারীর বিজয় প্রমাণ করল বাঙালিরা
আজ বিশ্ব আসরে প্রতিষ্ঠিত। আমি যখন রেজোয়ানা সিদ্দিকের বাংলায় দেয়া বক্তব্য
টিভিতে শুনছিলাম, তখন আমার বারবার মনে হয়েছিল সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে
নয়, যেদিন বাংলা ভাষাও জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হবে এবং বাংলা ভাষা অন্যতম
একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। যুক্তরাষ্ট্র একদিন
অভিবাসীদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব আসরে অর্থনৈতিক
ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব করার পেছনে এ অভিবাসীদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। আজ
যুক্তরাজ্যও ধীরে ধীরে সেই পথে যাচ্ছে। শুধু তিন বাঙালি নারী বলি কেন,
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এবার মোট ২২ জন দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত এমপি নির্বাচিত
হয়েছেন। তার মধ্যে ভারতের ১০, পাকিস্তানের আট ও শ্রীলঙ্কার একজন দক্ষিণ
এশীয় বংশোদ্ভূত রয়েছেন। ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে কোনো দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত
এমপি যদি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হন আমি তাতে অবাক হব না। আমি তিনজন
বাঙালি নারীর ব্যাপারেও যথেষ্ট আস্থাশীল। এরা তিনজনই যথেষ্ট শিক্ষিত।
রেজোয়ানা সিদ্দিক মাস্টার্স ডিগ্রিধারী, আর রূপা হক একটি কলেজের শিক্ষক ও
পিএইচডি ডিগ্রিধারী। এরা আগামী দিনগুলোয় লেবার পার্টির মূলধারার রাজনীতিতে
যে বড় অবদান রাখবেন, তা বলাই বাহুল্য। রুশনারা দ্বিতীয়বারের মতো এমপি হলেন।
তিনি শ্যাডো বা ছায়া মন্ত্রীও ছিলেন। এখন রেজোয়ানা সিদ্দিক কিংবা রূপা
হকের জুনিয়র ছায়া মন্ত্রী হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের জন্য এটা আরও
বড় পাওয়া এ কারণে যে, এদের দুজনের (রুশনারা ও রেজোয়ানা) বাংলাদেশের
ব্যাপারে বড় আগ্রহ রয়েছে। নিশ্চয়ই আমরা আশা করতে পারি, বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য
সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরা বড় অবদান রাখতে পারবেন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক
সংস্কৃতি, মানবাধিকার নিশ্চিত করা, বিনিয়োগ বাড়ানো, ব্রিটেনে বাংলাদেশের
পণ্যের ব্যাপক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও বড় অবদান রাখবেন- এ প্রত্যাশা এখন
অনেকেই করবেন।
এ নির্বাচনে যুক্তরাজ্যের ভোটাররা ডেভিড
ক্যামেরনের তথা কনজারভেটিভ পার্টির প্রতি আবারও আস্থা রাখলেন। ইউরোপের
সর্বত্র অর্থনীতিতে ব্যাপক মন্দাভাব দেখা দিলেও যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে তা
তেমন একটা প্রভাব ফেলেনি। ডেভিড ক্যামেরনের সরকার বেশ কিছু মানুষের জন্য
চাকরির ব্যবস্থা করেছিল। এটা ছিল তার জন্য প্লাস পয়েন্ট। জিডিপি প্রবৃদ্ধির
ধারাও তিনি ধরে রাখতে পেরেছিলেন। এতেও মানুষ তার ওপর আস্থা রেখেছে। তিনি
যুক্তরাজ্যের মানুষের জন্য একটা পরিবর্তন আনতে চান- ভোটাররা তা বিশ্বাস
করেছে। ফলে তিনি আরও ৫ বছরের জন্য ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে রয়ে গেলেন। কিন্তু
সমস্যা যে নেই, তা নয়। আগামী দিনগুলো তার জন্য সুখের নাও হতে পারে। ২০১৭
সালে ইইউ প্রশ্নে গণভোটের কথা বলছেন তিনি। এখন তিনি যদি সত্যি সত্যিই
গণভোটের আয়োজন করেন এবং গণভোটে যদি মানুষ ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত
দেয়, তখন কী হবে? ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরে থেকে যুক্তরাজ্য একাকী কি
ইউরোপে থাকতে পারবে, কিংবা একাকী থেকে তার অর্থনৈতিক শক্তি কতটুকু
শক্তিশালী হবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবা খাতে
কাটছাঁটের প্রস্তাব করেছেন ক্যামেরন। ভোটাররা তা সমর্থন করেছে। লেবাররা এর
বিরোধিতা করেও জনসমর্থন পায়নি। এখন সত্যি সত্যিই এ খাতে যদি বাজেট বরাদ্দ
কমানো হয়, যদি এ খাতে আরও বেসরকারিকরণ হয়, তাহলে তা নিম্ন আয়ের মানুষের বড়
ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এরা স্বাস্থ্যসেবা পাবে না। আর্থিক সংস্থান না
থাকায় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে তারা। একটা বড় ধরনের শঙ্কা রয়ে গেছে দক্ষিণ
এশীয় তথা ক্যারিবীয় অঞ্চলের অভিবাসীদের নিয়ে। এদের অনেকেরই ভালো চাকরি নেই।
আর্থিক সঙ্গতিও ভালো না। এরা বিপদে পড়তে পারেন আগামী দিনে। পূর্ব ইউরোপীয়
দেশগুলো থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী নিয়েও সমস্যা আছে। ভাষাগত সমস্যার
পাশাপাশি এরা নানা ধরনের অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত। আইন না মানার প্রবণতা
এদের মধ্যে বেশি।
যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কিংবা তার
পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ নির্বাচন যুক্তরাজ্যের
৭৫০ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাসের ধারাবাহিকতাই মাত্র। অনেক পর্যবেক্ষক ধারণা
করেছিলেন একটা পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই পরিবর্তন এলো না। এখন টিউলিপ আর
রুশনারারা ব্রিটেনের চলমান রাজনীতিতে কতটুকু অবদান রাখতে পারবেন, আমাদের
কাছে তা যতটুকু না বিবেচ্য, তার চেয়ে বেশি বিবেচ্য বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য
সম্পর্ক উন্নয়নে এরা কতটুকু অবদান রাখবেন। তবে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে, সে
দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এক. যে তিনটি এলাকা থেকে এরা নির্বাচিত হয়েছেন,
সেখানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সেখানে ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশী
বেকার। নারীরা সেখানে নিগৃহীত। উচ্চশিক্ষায় তাদের আগ্রহ কম। এ বিষয়গুলোর
দিকে তাদের নজর দিতে হবে। টিউলিপ সিদ্দিক নিজে দীর্ঘদিন এ বাঙালি
কমিউনিটিতে কাজ করেছেন। তিনি ভালো করে জানেন সমস্যাটি। এখন তিনি তার এলাকার
উন্নয়নে যদি কাজ করেন, আমার ধারণা তিনি এ আসনটি স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে
পারবেন। তিনিও পারবেন একটি মডেল হতে। আমার জানা মতে, আরও বেশ কিছু বাঙালি
রয়েছেন, যারা শিক্ষিত এবং ব্রিটেনের সমাজ উন্নয়নে তারা অবদান রাখছেন। তারাও
ধীরে ধীরে যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের শরিক করেন, আমার ধারণা আগামীতে
আমরা আরও বাঙালি এমপি পাব ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। ১০ থেকে ১২ লাখ বাঙালি
ব্রিটেনে বাস করেন। এদের জন্য তিনজন এমপি যথেষ্ট নয়। এ সংখ্যা আরও বাড়বে।
দুই. বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ এরা সামাজিক ভাতা গ্রহণ করেন, আবার
অবৈধ চাকরিও করেন। এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এটি গুরুতর আইন লঙ্ঘনের
শামিল। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে সব বাঙালি এটি করেন না। এটি
কমিউনিটির বদনাম। তিন. একটি অভিযোগ উঠেছে যে, একটি ‘চক্র’ লন্ডনে টিউলিপ
সিদ্দিকের নির্বাচনী এলাকায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর প্রচারপত্র
বিলি করে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের দুইটি দলের স্থানীয় নেতাকর্মীর যোগসাজশ
রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এটি নিন্দনীয় এবং শাস্তিযোগ্য একটি অপরাধ।
বাংলাদেশে আমরা হরহামেশা এ ধরনের কর্মকান্ড দেখতে পাই। তাই বলে ব্রিটেনের
মতো সমাজেও এ ধরনের কর্মকান্ড হবে? এতে করে প্রবাসে বাঙালি হিসেবে আমাদের
মর্যাদা বাড়ে না, বরং কমে। যেটা দুঃখজনক, তা হচ্ছে বাঙালিরা ব্রিটেনের
নাগরিকত্ব গ্রহণ করার পরও এদের অনেকে স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত
না হয়ে এদের অনেকে বাংলাদেশী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকান্ডে এবং সংগঠনে
নিজেদের জড়িত করেন। তারা থাকেন লন্ডনে। অথচ রাজনীতি করেন বাংলাদেশের। ফলে
স্থানীয় কমিউনিটি লিডারশিপ তৈরি হচ্ছে না। চার. বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট
ব্যবসায়ীদের একটা বড় অভিযোগ, এরা দক্ষ শেফ ও রেস্টুরেন্ট কর্মী পাচ্ছেন না।
স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ কমিউনিটি এ পেশায় আসতে আগ্রহী নয়। ফলে বাংলাদেশের ওপর
তাদের নির্ভর করতে হয়। কিন্তু ভিসা সমস্যার কারণে তারা বাংলাদেশ থেকে কর্মী
আনতে পারছেন না। কর্মী সমস্যার কারণে ঝুঁকির মুখে আছে এ রেস্টুরেন্ট
ব্যবসা। নির্বাচনের আগেই ডেভিড ক্যামেরন তার নির্বাচনী প্রচারণায়
অভিবাসীদের সংখ্যা বছরে ৬০ হাজারে নামিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। তার ওপর চাপ
বাড়ছে। তিনি যদি এটি কার্যকর করেন, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশী
অভিবাসীরা। এ তিন বাঙালি নারীকে এখন পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে
হবে। পাঁচ. বাংলাদেশী পণ্যের আরও বাজার সম্প্রসারণের একটা সম্ভাবনা রয়েছে
যুক্তরাজ্যে। এ বাজার সম্প্রসারণে এরা কাজ করতে পারেন। দুই দেশের ব্যবসায়ী
সম্প্রদায় তথা নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। এ যোগাযোগ আরও শক্তিশালী করতে
পারেন এরা। রুশনারা ও টিউলিপ সিদ্দিক মোটামুটি পরিচিত বাংলাদেশে। তবে
টিউলিপকে মানুষ চেনে বঙ্গবন্ধুর নাতনি ও প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্নি হিসেবে।
আওয়ামী লীগের বলয়ে তার পরিচিতি রয়েছে। এখন সব দলের সঙ্গে তার ‘সম্পর্ক’
তৈরি করতে হবে, যাতে করে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। কেননা লেবার পার্টি
বাংলাদেশে কোনো একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে না। যেটা আমরা দেখেছি,
রুশনারার ঢাকা সফরের সময়। তিনি যখনই ঢাকায় এসেছেন, সরকার ও বিরোধী দল সবার
সঙ্গেই কথা বলেছেন। পাবনার মেয়ে রূপা হক। বাংলাদেশে তেমন পরিচিতি তার নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক নেই। তিনি বাংলাদেশে
একটা ‘বন্ধুগোষ্ঠী’ তৈরি করতে পারেন। এতে করে তিনি তার নির্বাচনী এলাকায়
তেমন উন্নতি করতে পারবেন না বটে; কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের
প্রত্যাশা তিনি বাড়াতে পারবেন।
ছয়. এ তিন লেবার পার্টির এমপি
নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রমাণ করেছেন অন্য রাজনৈতিক দলে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত
নারীরা যদি সক্রিয় হন, তাহলে তারাও তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবেন।
বিশেষ করে কনজারভেটিভ পার্টির ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। মাত্র একজন প্রার্থী
কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। লিন ডেমের পক্ষ
থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনজন। সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। তাই মূল
ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকান্ডে আরও বেশি করে বাঙালিদের অংশগ্রহণ থাকা
উচিত।
এ তিন বাঙালি নারীই যে প্রথমবারের মতো ব্রিটেনের
পার্লামেন্টে নির্বাচিত হলেন, তা নয়। ২০১০ সালে রুশনারা প্রথম পথ
দেখিয়েছিলেন। তবে আশার কথা একটাই- এদের সবারই বয়স ৪০-এর ঘরে। টিউলিপের আরও
কম, মাত্র ৩৩। এর অর্থ এরা আরও অনেক দিন রাজনীতিতে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর
রক্তের প্রতিনিধিত্ব করছেন এমন দুজন এখন দুই পার্লামেন্টের সদস্য- একজন
বাংলাদেশের, একজন ব্রিটেনের। এটা একটা বিরল ঘটনা। কোনো একদিন এ বাঙালি
কন্যারা যদি ব্রিটেনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন, আমি অবাক হবো না। এদের মেধা
আছে। যোগ্যতা আছে এবং বয়স কম। আরও অনেক দিন ধরে রাজনীতিতে থাকার ইচ্ছা ও
আগ্রহ তাদের আছে। এ তিন বাঙালি কন্যা পথ দেখিয়ে গেলেন। এ পথ ধরে আগামীতে
আরও বাঙালি কন্যা আসবেন, এটা শুধু প্রত্যাশাই নয় বরং বাস্তব।
Daily Alokito Bangladesh
17,05.15
Subscribe to:
Posts (Atom)