রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘নিখোঁজ’ সালাহউদ্দিনের ফিরে আসা কিছু প্রশ্ন কিছু জিজ্ঞাসা

শেষ অবধি বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের ‘খোঁজ’ পাওয়া গেল। গত ১২ মে বাংলাদেশের প্রতিটি সংবাদপত্রে এটা ছিল শীর্ষ নিউজ এবং ‘টক অব দ্য টাউন।’ দীর্ঘ ৬২ দিন তার কোনো খোঁজ ছিল না। শুধু সংবাদপত্র থেকে আমরা জেনেছি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা উত্তরার একটি বাসা থেকে ১০ মার্চ রাতের বেলা তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, সালাহ উদ্দিনকে অপহরণ ঘটনার সঙ্গে র‌্যাব জড়িত । এ নিয়ে ‘জল’ কম ঘোলা হয়নি। উচ্চ আদালতে পর্যন্ত বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছিল এবং উচ্চ আদালত একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ এপ্রিল ‘সালাহ উদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া গেল কি না, সে বিষয়ে নিয়মিত অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে’ বিষয়টির নিষ্পত্তি করে দিয়েছিলেন। এর আগে ১৬ মার্চ মহানগরী পুলিশ সালাহ উদ্দিনকে খুঁজে বের করার জন্য জয়েন্ট কমিশনারের (ক্রাইম) নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল। এর মধ্য দিয়ে অন্তত একটি আশঙ্কার অবসান ঘটল। সালাহ উদ্দিন বেঁচে আছেন এবং তিনি ফিরে আসছেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘উদ্ধার’ করতে পারেনি। কিংবা তিনি নিজে নিজেই ফিরে আসেননি। বরং তাকে ‘পাওয়া’ গেছে অন্য একটি রাষ্ট্রে উ™£ান্ত অবস্থায়। এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা থাকবেই। গুজবও থাকবে এবং চলমান রাজনীতিতে তা কিছুটা হলেও ঢেউ তুলবে। তার নিখোঁজ হওয়া এবং শিলংয়ে হঠাৎ করে ‘আবির্ভূত’ হওয়া এখন অনেক প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার জন্ম দেবে। এক. প্রশ্ন উঠবে এতদিন তিনি তাহলে কোথায় ছিলেন? বাংলাদেশের ভেতরে নাকি মেঘালয়েই? ঢাকা থেকে সিলেট, সিলেটের ডাউকি সীমান্ত থেকে শিলং, দূরত্ব কম-বেশি ৩৪০ কিলোমিটার। সড়কপথেই শিলং যাওয়া যায়। ডাউকি সীমান্তে খুব কড়াকড়ি ব্যবস্থা থাকে না। এ পথে অবৈধপথে ভারত অর্থাৎ মেঘালয় রাজ্যে বাংলাদেশিদের যাতায়াতও আছে। এ ক্ষেত্রে অবৈধ পথে তাকে কেউ নিয়ে গিয়ে শিলংয়ে যদি ছেড়ে দেয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তখন সরকারের দায়িত্ব হবে এই বিষয়টি তদন্ত করে দেখা এবং জাতিকে তা জানানো। দুই. সালাহ উদ্দিন যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ছিলেন না, এ ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হলো। এতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবির সত্যতা প্রমাণিত হলো বটে। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য, একজন বাংলাদেশি নাগরিক কীভাবে ‘হাওয়া’ হয়ে গেলেন এ বিষয়টিও খোলাসা করা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগ্যতা, দক্ষতা আর গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নের সঙ্গে এই বিষয়টি সরাসরিভাবে জড়িত। তিন. সালাহ উদ্দিনের ‘নিখোঁজ’ রহস্যের ব্যাপারে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মন্তব্য করেছিল এবং বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘অভিযুক্ত’ করার একটা প্রচেষ্টাও আমরাও দেখেছি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এতে করে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে র‌্যাবের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণœ করা হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো কী বলে, সেদিকে দৃষ্টি থাকবে আমাদের। আমরা দেখতে চাইÑ তারা কী বলে এখন। চার. সালাহ উদ্দিন আহমেদের ‘আর্বিভাব’-এর ঘটনায় বিএনপি এক ধরনের নীরবতা পালন করলেও সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা এই ঘটনায় বিএনপির সমালোচনা করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মন্তব্যটি ছিল এ রকমÑ এ ‘বিএনপির অন্তরালের ব্যাপার’। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘অন্তরালের রাজনীতি করলে অন্তর্ধানে যেতে হয়। আর বিপদ তখনই আসে।’ আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন সালাহ উদ্দিনের অন্তর্ধান নিয়ে বিএনপি মিথ্যাচার করেছিল, সালাহ উদ্দিন লুকিয়ে ছিলেন। এখন বিএনপিকেই এসব অভিযোগের জবাব দিতে হবে। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর। পরস্পরের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি না করাই মঙ্গল। আমরা চাইব ‘সত্য’ উদঘাটিত হোক। পাঁচ. সালাহ উদ্দিনের ‘ফেরত’ আসার ব্যাপারে একটি আইনগত জটিলতা আছে। তিনি শিলংয়ে যেভাবেই যান না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তাকে শিলংয়ে পাওয়া গেছে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়া। এটা ভারতীয় আইনে একটি অপরাধ। তার বিরুদ্ধে শিলংয়ে একটি মামলা হয়েছেÑ এটা স্বাভাবিক। তিনি সেখানকার আইন ভঙ্গ করেছেন! আইনভঙ্গের অপরাধে তিনি অপরাধী। শিলং পুলিশ এখন দুটি কাজ করতে পারে। এক. আইনভঙ্গের অপরাধে তাকে কোর্টে তুলতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে কোর্ট তাকে শাস্তি দিতে পারে। এবং অতঃপর বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ভারত তাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে পারে। এটা সময়সাপেক্ষ। খুব তাড়াতাড়ি এ সমস্যার সমাধান নাও হতে পারে। দুই. অবৈধ নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে শিলং পুলিশ তাকে ‘ডিপোর্ট’ করতে পারে। আমরা ‘পুশব্যাক’ করতে পারি। এ ক্ষেত্রেও তিনি বাংলাদেশ পুলিশের কাছে ‘অপরাধী’ বিবেচিত হবেন এবং বাংলাদেশ পুলিশ তাকে সীমান্তে গ্রেপ্তারও করতে পারে। তবে যেহেতু বিষয়টি এই মুহূর্তে ভারতীয় পুলিশের আওতায়। সে ক্ষেত্রে একটি ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’ কাজ করবে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভূমিকা এতে থাকবে। কেননা সালাহ উদ্দিন আহমেদ সাধারণ কোনো বাংলাদেশি নাগরিক নন। তিনি নিঃসন্দেহে একজন আলোচিত ও ভিআইপি ব্যক্তি। অনেক অঙ্কের হিসাব আছে এতে। ছয়. উত্তরার যে বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ওই বাসার ভাড়াটের ভূমিকা কী ছিল, এটাও তদন্ত করে দেখা উচিত। পুলিশের তদন্ত কমিটি ওই ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলেছিল কি না কিংবা কী ‘তথ্য’ পাওয়া গিয়েছিল, এটা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এটা জানা প্রয়োজন। সাত. বাংলাদেশে সালাহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা রয়েছে। ওইসব মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছেন আদালত। ফলে বাংলাদেশে তিনি ফিরে এলেও আইনের বাইরে যেতে পারবেন না। তাকে হয় উচ্চ আদালতে জামিনের জন্য যেতে হবে নতুবা নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। বাংলাদেশের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করতে পারে। তার পরিবারের কাছে আপাতত ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। আট. সালাহ উদ্দিনের ‘আবির্ভাবের’ ঘটনায় একটা সম্ভাবনারও জন্ম হলো যে, নিখোঁজ ইলিয়াস আলীও এমনি করে কোথাও ‘আবির্ভূত’ হতে পারেন। নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী এই প্রত্যাশাই করে আসছেন বারবার। তিনি এখনও বিশ্বাস করেন ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন। ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধানের ঘটনায়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। কিন্তু তা কোনোদিন প্রমাণিত হয়নি। আমরা জানি সালাহ উদ্দিন আহমেদের ‘নিখোঁজ’ রহস্য কোনোদিন উন্মোচিত হবে কি না? এই ঘটনা থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে জনগণের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ৩১নং অনুচ্ছেদে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার দেওয়া হয়েছে। ৩২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতিত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ একজন সালাহ উদ্দিন আহমেদ রাজনীতি করেন। তিনি ‘নিখোঁজ’ হওয়ার আগে বিএনপির মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেছিলেন। এটা কোনো ব্যক্তির জন্য অপরাধ হতে পারে না। তিনি গোপন স্থান থেকে বিবৃতি পাঠাতেন, তাতে অবরোধের কথা থাকতÑ এটি অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও এটা করে তিনি যদি ‘অপরাধ’ করে থাকেন, তাহলে তার বিচার হওয়া উচিত ছিল। দেশের আইনে এ ব্যাপারে বলা আছে। আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হওয়াই কাম্য ছিল। কিন্তু ‘কিছু ব্যক্তি’ তাকে তুলে নিয়ে যাবে, দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দীর্ঘ ৬২ দিনেও তার খোঁজ পাবে নাÑ এটা কোনোমতেই কোনো ভালো খবর নয়। নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তার বিভিন্ন প্রশাসনিক যন্ত্রের মাধ্যমে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আমরা চাইব এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। রাজনীতিকদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। পার্থক্য না থাকলে তো আর রাজনীতি থাকে না! পথ ও মত ভিন্ন হবেই। তবে ভিন্নমত ও ভিন্নপথেই এক একটি দল তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। বিএনপি তথা ২০ দলের গত তিন মাসের আন্দোলন নিয়ে নানা কথা আছে। আন্দোলনের যে সহিংসতা রূপ আমরা দেখেছি, তাকে কোনো অবস্থাতেই সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা বলা যাবে না। বিএনপি যদিও বলেছে, তারা এই সহিংস কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত নয়। তাদের ডাকা আন্দোলনে যদি এ ধরনের কর্মকা- হয় তাহলে এর দায়ভার তো তারা এড়াতে পারে না। কিন্তু তাই বলে এ জন্য একজন ব্যক্তি সালাহ উদ্দিন আহমেদকে কতটুকু ‘অভিযুক্ত’ করা যাবে, সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন এখন। রাজনীতি আবার স্বাভাবিক ধারায় ফিরে এসেছে, এটা একটা ভালো লক্ষণ। বিএনপি তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েও নির্বাচনের মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বয়কট করে। নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ হয়নি এটা যেমন সত্য কথা, ঠিক তেমনি বিএনপির নির্বাচন বয়কটও ঠিক হয়নি। তবে আমার বিবেচনায় সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি না দেওয়ায় একটা ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন সালাহ উদ্দিন আহমেদকে ‘ফিরে পাওয়া’কে কেন্দ্র করে বিএনপি কোনো বড় কর্মসূচি দেবে নাÑ এটাই সবার প্রত্যাশা। আমরা চাই সালাহ উদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ রহস্য উন্মোচিত হোক। জাতি জানুক কী এবং কেন ঘটেছিল ওই ঘটনা। নিশ্চয়ই সালাহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের বলবেন তার ‘হারিয়ে যাওয়া’ ৬২ দিনের ‘কাহিনি’! এই কাহিনি জানতে বিএনপিকেও সহযোগিতা করতে হবে। বিএনপির সহযোগিতা ছাড়া প্রকৃত কাহিনি জানা যাবে না। মনে রাখতে হবে এই কাহিনি জানা সবার জন্যই মঙ্গল। আমরা অসহিষ্ণু এই রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে চাই। আমাদের চাই উন্নয়ন। রাজনৈতিক বৈরিতা যেন আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। সালাহ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে কোনো ‘রাজনীতি’ হোক আমরা তা চাই না। এ নিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত হোক, এটাও কারও কাম্য নয়। এ জন্য সবারই উচিত সংযত হয়ে কথা বলা। অহেতুক বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বললে, তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে এবং শিলং থেকে তার ফিরিয়ে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। সালাহ উদ্দিন আহমেদ তার স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে ফিরে আসুক সুস্থ হয়ে, কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই প্রার্থনা করছি। Daily Amader Somoy 16.05.15

1 comments: