রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মোদির চীন সফর ও এশিয়ায় দুই শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব


 মোদির চীন সফর সমাপ্ত হয়েছে ১৬ মে। মোদি তার চীন সফর শুরু করেছিলেন ১৪ মে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের জন্মস্থান শিয়ান প্রদেশ সফরের মধ্য দিয়ে। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছে, এটা মোদির 'নিজস্ব কূটনীতি', যেখানে তিনি বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, বিশেষ করে শি জিন পিংকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তার নিজ শহর গুজরাটের আহমেদাবাদে। ফিরতি সফরে শি জিন পিংও সব প্রটোকল ভেঙে মোদিকে আমন্ত্রণ জানালেন নিজ জন্মস্থান শিয়ানে। মোদি বেইজিংয়ে ২২ বিলিয়ন ডলারের ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তার সফর শেষ করলেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এ সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের অর্জনই বা কতটুকু? কিংবা এ সফর ভারত-চীন দ্বন্দ্ব প্রশমনে কতটুকু সাহায্য করবে? একটি জটিল সম্পর্কের মাঝে দেশ দুইটি আবদ্ধ। একদিকে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থ। এর মধ্য দিয়ে কি 'রিয়েল পলিটিকস' বিজয়ী হলো! এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মোদির চীন সফরের সময় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত চীনা সিসিটিভিতে জম্মু ও কাশ্মীর এবং অরুনাচল প্রদেশকে বাদ দিয়ে ভারতের মানচিত্র প্রদর্শন করা হয়। অন্য সময় হলে ভারত এর প্রতিবাদ করত। কিন্তু এবার কোনো ভারতীয় প্রতিবাদের খবর আমরা পাইনি।


মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি চার চারবার চীন সফর করেছেন। এর অর্থ হচ্ছে চীন সম্পর্কে তার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এবার সফরে গিয়ে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত-চীনের পুনরুত্থান একবিংশ শতাব্দীর মাইলফলক। যদিও তিনি একথাও বলেছেন, দুই দেশের অংশীদারিত্বের পূর্ণাঙ্গ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপদান করা থেকে উভয় দেশকে পিছিয়ে দিয়েছে এমন কিছু বিষয়ে চীনের কৌশল পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলোকে পাশ কাটিয়ে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনৈতিক উন্নয়নকে। ২২ বিলিয়ন ডলারের যে ২২টি চুক্তি হয়েছে, তাতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার। ভারত-চীন একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গঠনের কথাও রয়েছে চুক্তিতে। এ বছরটা চীনে 'ইয়ার অব ইন্ডিয়া' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর আগামী বছর ভারতে চিহ্নিত করা হবে 'ইয়ার অব চায়না' হিসেবে। চীনা নাগরিকের জন্য ই-ভিসা প্রবর্তনের কথাও ঘোষণা করেছেন মোদি। তিনি এ কথাটিও চীনাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ভারত বীমা খাতে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ খাতে তিনি চীনা বিনিয়োগ চান। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? ভারত দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' এর পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে তার প্রাচীন 'কটন রুট'কে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। আর এ লক্ষ্যেই ভারত ২০ থেকে ২২ মার্চ উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে ভারত মহাসাগরভুক্ত 'ইন্ডিয়ান ওসেন রীম' অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং সেইসঙ্গে এশিয়ায় ভারতকে অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করা। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশ সফর করেছেন। তার পররাষ্ট্র সচিবও 'সার্ক যাত্রার' অংশ হিসেবে সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশ সফর করেছেন। ভুবনেশ্বর শীর্ষ সম্মেলনের আগে নরেন্দ্র মোদি মরিশাস, সিসিলি ও শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। মরিশাস সফরের সময় মরিশাসের সঙ্গে সেখানে একটি ভারতীয় নৌ ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার_ ভারত ভারতীয় মহাসাগরে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ ব্যাপারে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি মৈত্রী জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত এবং ওই জোট মরিশাস ও সিসিলিকে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের সিসিলি, মরিশাস কিংবা সুদূরের ওমান-মোজাম্পিকও এ প্রক্রিয়ায় একীভূত হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিকভাবে এ অঞ্চলের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ভারত তাই এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে অন্যতম শক্তি হিসেবে বিশ্ব রাজনীতিতে আবির্ভূত হতে চায়। এক্ষেত্রে তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে চীন। চীন যে তার 'মেরিটাইম সিল্করুট' এর কথা বলছে, সেই 'সিল্করুট' এর সঙ্গে ভারতের এ অর্থনৈতিক স্বার্থ সাংঘর্ষিক। চীন ও ভারতের স্বার্থ মূলত এক ও অভিন্ন- ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ফলে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কমানোর যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে, তা এখন রীতিমতো প্রশ্নের মুখে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত বছর সেপ্টেম্বরে চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফর এবং আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্তৃক তাকে অভ্যর্থনা জানানো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের সেই পঞ্চাশের দশকের দুই দেশের সাবেক সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিলেও অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে সম্প্রতি দুই দেশের মাঝে আস্থার সম্পর্কে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ প্রধানমন্ত্রী মোদি অরুণাচল সফর করেন। সেখানে তিনি রেলপথ ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। এর প্রতিবাদ জানিয়েছিল চীন। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদির অরুণাচল সফরকে সমালোচনা করে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়, চীনা সরকার কখনোই 'অরুণাচল প্রদেশ'কে স্বীকৃতি দেয়নি। বেইজিংয়ের মতে, চীনের অন্তর্গত তিব্বতের মনিয়ুল ও নিম্নসায়ুল এলাকা নিয়ে 'তথাকথিত অরুণাচল' প্রদেশ গড়েছে নয়াদিল্লি । ওই এলাকাগুলো এখনও ভারতের 'বেআইনি দখলদারির কবলে রয়েছে।' চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ অভিমত সঙ্গত কারণেই দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, কিছু দিন আগে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিসিদা ভারতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি অরুণাচল প্রদেশ যে ভারতের সে ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিসিদার ওই বক্তব্যে চীন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। চীন মনে করে, ভারত জাপানকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। ৬ জুন প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশ সফরেও আসছেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি প্রথম সফরে ভুটান গিয়েছিলেন। ওই সময় সেখানে চীনবিরোধী বক্তব্যও দিয়েছিলেন। চীন এখন অবধি ভুটানে তার দূতাবাস খোলার অনুমতি পায়নি শুধু ভারতের আপত্তির কারণে। নয়া পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর তার দক্ষিণ এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ভুটান হয়ে ২ মার্চ ঢাকা সফর করেন। এরপর তিনি যান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। ভারতে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ সংক্রান্ত চুক্তি পার্লামেন্টে অনুমোদিত হওয়ায় তা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তারপরও কথা থেকে যায়। শ্রীলঙ্কায় সরকার পরিবর্তনে ভারতের ভূমিকা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মোদি সরকার ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলগুলো নিয়ে যে নীতি প্রণয়ন করেছে তা চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। সুতরাং মোদির বেইজিং সফরে এ আস্থার সম্পর্ক কতটুকু ফিরে আসবে, তা এক প্রশ্ন বটে। তবে চীনের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কের যারা ধারণা রাখেন, তারা জানেন চীনের বৈদেশিক নীতি এখন বিনিয়োগে ও ব্যবসানির্ভর। চীনারা কোনো দেশে তাদের রাজনৈতিক প্রভাবের চেয়ে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়াতে আগ্রহী। চীনারা ব্যবসা বোঝে। ব্যবসা চায়। মোদি সরকারও একটি 'ব্যবসা ও বিনিয়োগনির্ভর' নীতি গ্রহণ করেছে। ভারতে যথেষ্ট চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে হঠাৎ করেই সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দুই দেশই চাইবে তার নিজ নিজ স্বার্থ আদায় করে নিতে। আগামী শতাব্দী হবে চীন ও ভারতের। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি, আর ভারত তৃতীয় কিংবা চতুর্থ অর্থনীতি। ফলে এ দুইটি বড় অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক যদি ভালো থাকে, তাহলে তা বিশ্বের স্থিতিশীলতার জন্যও মঙ্গল। এজন্যই বেইজিংয়ে মোদি দুই দেশের সম্পর্ককে একুশ শতকের মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখন দেখার পালা, এই 'মাইলফলক' এর বক্তব্যটির বাস্তবে কতটুকু প্রতিফলন ঘটে। চীনারা সাধারণত অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় নাক গলায় না। তারা হস্তক্ষেপও করে না, যা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা করে। ফলে এখানে দুই দেশের এপ্রোচের ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। একটা মিল অবশ্যই আছে, আর তা হচ্ছে, দুই দেশের পররাষ্ট্রনীতি ব্যবসা-বাণিজ্যনির্ভর এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে প্রাধান্য দিয়েছে বেশি। এজন্যই এক ধরনের 'প্রতিযোগিতা' থেকে যাবেই। বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দূরত্বের জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তবুও নিঃসন্দেহে বলা যায়, মোদির এ বেইজিং সফর দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। Daily Alokito Bangladesh 24.05.15

0 comments:

Post a Comment