রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ফিরে পাওয়া আস্থার সম্পর্ক অটুট থাকুক

শেষ পর্যন্ত ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এবং নিম্নকক্ষ লোকসভায় সীমান্ত চুক্তিটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়েছে। ৮ মে লোকসভার অধিবেশন শেষ হয়ে গেছে। এই অধিবেশনে সীমান্ত চুক্তিটি অনুমোদিত না হলে নানা জটিলতা তৈরি হতো। এবং তাতে করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুধু যে এক ধরনের অবিশ্বাসের জন্মই হতো তা নয়, বরং আগামী জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর অনিশ্চিত হয়ে যেত। এখন সীমান্ত চুক্তি সংসদে অনুমোদিত হওয়ায় এক ধরনের স্বস্তির বাতাস বইছে নয়াদিল্লি প্রশাসনের অন্দর মহলে। তবে এই চুক্তি নিয়ে 'নাটকীয়তা' কম হয়নি। বড় আপত্তি এসেছিল আসাম বিজেপির পক্ষ থেকে। আসামে ২০১৬ সালে, অর্থাৎ আগামী বছর সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। আসাম বিজেপি এটাকে ইস্যু করতে চেয়েছিল। আসাম বিজেপির ধারণা ছিল, এই সীমান্ত চুক্তিকে ইস্যু করেই তারা আসামে তাদের জনমত বাড়াতে পারবে এবং নির্বাচনে সাফল্য পাবে। কেননা তাদের কাছে দৃষ্টান্ত ছিল পশ্চিমবঙ্গের। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থবিরোধী এই যুক্তি তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁর আপত্তির কারণে এখন অব্দি তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একটি তিস্তাচুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক হলেও শুধু পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে এখন অব্দি কোনো চুক্তি হয়নি। অতীতে ইউপিএ সরকারও তিস্তা চুক্তি করতে চেয়েছিল বাংলাদেশের সঙ্গে। ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঢাকায় আসা ও চুক্তি স্বাক্ষরে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। মমতা তখন আসেননি। যদিও মমতা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সফর করে গেছেন। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে তিনি পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়ে যাননি। কেননা ২০১৬ সালে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। সুতরাং তিনি কোনো ঝুঁকি নেবেন না। ঠিক একই স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছিল আসাম বিজেপি। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরোধিতা করে আলাদা অবস্থান নিয়েছিল আসাম বিজেপি। শেষ পর্যন্ত তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করায় এই সীমান্ত চুক্তিটি পার্লামেন্টে অনুমোদিত হলো। এখানে বলা ভালো, সীমান্ত চুক্তিটি ঝুলেছিল অনেক দিন ধরে। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও দীর্ঘ ৪১ বছর ভারত এই চুক্তিটি অনুমোদন করেনি। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির বিনিময়ে আমরা বেরুবাড়ী ভারতকে দিয়েছিলাম এবং সংবিধানে তৃতীয় সংশোধনী এনে সংবিধানের ২ নম্বর অনুচ্ছেদটি সংশোধন করা হয়েছিল। কিন্তু ভারত তা করেনি। দীর্ঘদিন তারা এই সীমান্ত বিরোধকে ঝুলিয়ে রেখেছিল। তবে ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের পর এর জট কিছুটা খুলতে থাকে। ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুযায়ী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই সীমান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়। ফিরে পাওয়া আস্থার সম্পর্ক অটুট থাকুক এর পরও সমস্যা ছিল আসাম বিজেপি ও পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসকে নিয়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চুক্তিটি মেনে নেওয়ায় মোদি সরকারের পক্ষে সহজ হয় চুক্তিটি সংসদের উভয় কক্ষে উপস্থাপনের। লোকসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। ফলে সমস্যা ছিলই। একপর্যায়ে আসামকে বাদ দিয়েই অর্থাৎ আসাম-বাংলাদেশ সীমান্ত চিহ্নিত না করেই কেন্দ্র উদ্যোগ নেয় উচ্চকক্ষে বিলটি উপস্থাপন করার। কিন্তু আপত্তি ওঠে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। কংগ্রেস সভানেত্রী আসামকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। এমনকি আসামের মুখ্যমন্ত্রী এবং আসাম কংগ্রেসের সভাপতি তরুণ গগৈও প্রধানমন্ত্রী মোদিকে চিঠি লেখেন। শেষ মুহূর্তে কেন্দ্র আসাম বিজেপিকে বোঝাতে সক্ষম হয় এবং বিলটি অবিকৃতভাবেই, অর্থাৎ আসামকে অন্তর্ভুক্ত করেই উচ্চকক্ষে উত্থাপিত হয় এবং তা অনুমোদিতও হয়। সীমান্ত চুক্তি (১৯৭৪) এবং প্রটোকলের (২০১১) আওতায় ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের মোট ৭ হাজার ১১০ একর আয়তনের ৫১টি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের মোট ১৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল বিনিময় হবে। বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোয় জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার এবং ভারতীয় ছিটমহলগুলোয় জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার। এর অর্থ হচ্ছে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের ১৭ হাজার ১৬০ একর জমি পাবে বাংলাদেশ। আর ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহলের ৭ হাজার ১১০ একর জমি পাবে ভারত। আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গে এসব ছিটমহল রয়েছে। এককভাবে মোদি সরকারকে এর জন্য কৃতিত্ব দেওয়া যাবে না। বিগত ইউপিএ সরকারের অবদানও কম নয়। তবে মোদির পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্যের কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরো উন্নত করার উদ্যোগ নিলেন তিনি। বিগত ইউপিএ সরকারের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এখানেই। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির গতিবিধি যাঁরা পর্যালোচনা করেন, তাঁরা জানেন মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দেওয়া। সেই সঙ্গে তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় নিজস্ব 'মনরো ডকট্রিন'কে নয়া আঙ্গিকে উপস্থাপন করছেন। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কোনো 'শক্তি' প্রভাব বিস্তার করুক, এটা ভারতের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কোনো শক্তিকেই পূর্ণ আস্থায় নিতে পারছে না ভারত। মোদি সরকার দক্ষিণ এশিয়ায় তার একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মোদি প্রথমে ভুটান গিয়েছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে তিনি নেপাল ও শ্রীলঙ্কা গেছেন। তিনি তাঁর পররাষ্ট্রসচিব জয় শংকরকে 'সার্ক যাত্রা'র অংশ হিসেবে ভুটান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে পাঠিয়েছিলেন। আগামী জুন মাসে তিনি আসছেন বাংলাদেশে। তাই তিনি অপেক্ষা করছিলেন পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সীমান্ত চুক্তিটি অনুমোদনের। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়েই তিনি আসামকে অন্তর্ভুক্ত করে বিলটি সংসদে উপস্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা চান। অত্যন্ত প্রাগমেটিক মোদি জানেন কিভাবে বিরোধীদের আস্থা অর্জন করতে হয়। সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে মমতাকে তিনি আস্থায় নিতে পেরেছিলেন। কংগ্রেসসহ অন্য দলগুলোর সমর্থন তিনি পেয়েছেন। তবে তাঁকে যেতে হবে অনেক দূর। তিনি ভালো করে জানেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে- এর সমাধান প্রয়োজন। প্রয়োজন দুই দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। তিস্তার পানিচুক্তি, বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা কমানো, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা, ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, দুই দেশের মধ্যে যৌথ জ্বালানি ও পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকাতে যৌথ কর্মপন্থা গ্রহণ, ভিসাব্যবস্থা সহজীকরণ, টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজের ব্যাপারে 'স্ট্যাটাস কো' অবলম্বন, আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পে স্থিতাবস্থা ইত্যাদি বিষয়ের ব্যাপারে মোদি সরকার একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে- এটাই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা। এখন ভারতীয় সংসদে স্থল সীমানা চুক্তির পূর্ণ অনুমোদন হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ মোদি সরকারের ওপর আস্থা রাখতেই পারে। এখন অতি দ্রুত যদি তিস্তার পানিবন্টন চুক্তিটি হয়, তাহলে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করবেন বাংলাদেশে। 'মোদি ম্যাজিক' দুই দেশের মাঝে বিরাজমান সমস্যা সমাধানে বড় অবদান রাখতে পেরেছে। অত্যন্ত কৌশলী ও অবিবেচক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও 'মোদি ম্যাজিকের' কাছে হেরে গেছেন! স্থল সীমানা এখন নির্ধারিত হলো। বাকি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। বাংলাদেশ মোদির ওপর আস্থা রেখেছে। এর প্রতিদানও পেয়েছে। দীর্ঘ ৬৮ বছরের সমস্যা মোদি সমাধান করেছেন। আমরা ছোট দেশ হতে পারি। কিন্তু আমাদেরও দেওয়ার আছে অনেক কিছু। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। আমরা ভারতের অর্থনীতি থেকে লাভবান হতে চাই। চাই নিজেদের আরো উন্নত করতে। স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে আস্থার সম্পর্ক ফিরে এসেছে। এ সম্পর্কটা আমরা ধরে রাখতে চাই।

0 comments:

Post a Comment